alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

মতিউর রহমান

: শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন আর কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নয়, বরং এটি একটি গভীর কাঠামোগত সামাজিক সংকটের প্রতিফলন, যা আমাদের সমাজব্যবস্থার মূলে প্রোথিত।

আইন প্রয়োগের বারবার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো-আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি সরল আইনি বা প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, কাঠামো ও অভ্যাসের জটিল সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি

সমাজের প্রতিদিনের জীবন, অর্থনৈতিক গতিবিধি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে এই সংকট অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে আমরা সমাজতাত্ত্বিক অ্যান্থনি গিডেন্সের ‘গঠন প্রক্রিয়া তত্ত্ব’ বা ‘কাঠামো তত্ত্ব’ প্রয়োগ করতে পারি। এই তত্ত্ব অনুসারে, সামাজিক জীবন কেবল কাঠামো বা কেবল ব্যক্তির সক্রিয়তা (এজেন্সি) দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং এই দুইয়ের মধ্যে অবিরাম এবং গভীর মিথস্ক্রিয়া চলে-এই মিথস্ক্রিয়াকে গিডেন্স ‘দ্বৈততা’ (কাঠামো ও সক্রিয়তার দ্বৈততা) বলে অভিহিত করেছেন। সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা হলো কাঠামোগত দুর্বলতা ও ব্যক্তিগত অভ্যাসের চক্রাকার পুনরুৎপাদন-যেখানে দুর্বল কাঠামো বেপরোয়া আচরণকে উৎসাহিত করে এবং সেই বেপরোয়া আচরণ আবার কাঠামোর দুর্বলতাকে বৈধতা দেয়।

সড়ক দুর্ঘটনা মোকাবিলায় প্রথম যে কাঠামোগত সমস্যাটি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়, তা হলো ক্ষমতার বিভাজন ও প্রশাসনিক অস্পষ্টতা। সড়ক ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার সংস্থা এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্ত। এই বিচ্ছিন্ন দায়িত্ব ও ছড়ানো কর্তৃত্বের ফলে বাস্তব প্রয়োগে বড় ধরনের ফাঁক তৈরি হয়, যা গিডেন্স বর্ণিত কাঠামোর দুর্বলতা। এই দুর্বল কাঠামোর সুযোগ নিয়ে চালকরা নিয়ম ভঙ্গ করে, যা তাদের ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকাশ। কিন্তু যখন সেই নিয়ম ভঙ্গের জন্য তাদের শাস্তি হয় না, তখন তারা এই দুর্বল কাঠামোকেই পুনরুৎপাদন করে, যেখানে আইনকে উপেক্ষা করা একটি গ্রহণযোগ্য সামাজিক অনুশীলনে পরিণত হয়। এটি এক ধরনের স্ব-ধ্বংসকারী চক্র তৈরি করে, যেখানে কোনো সংস্থা একা এই চক্র ভাঙতে পারে না।

গিডেন্সের তাত্ত্বিক লেন্স দিয়ে দেখলে, সড়কের এই সংকট হলো এমন এক ‘কাঠামো’, যা তিনটি মৌলিক উপাদানের ওপর নির্মিত: আধিপত্য (কে বা কারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে), বৈধতা (কোন নিয়ম বা মূল্যবোধগুলো গ্রহণযোগ্য), এবং অর্থ (সামাজিক অনুশীলনের উদ্দেশ্য বা অর্থ কী)। বাংলাদেশে এই কাঠামোর আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করে পরিবহন সিন্ডিকেট; আইন প্রয়োগের বৈধতা ব্যবহৃত হয় দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে, এবং সড়কের নিয়ম-কানুনের অর্থ নির্ধারিত হয় ‘দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো’ (অর্থ) এবং ‘ক্ষমতা প্রদর্শন’ (আধিপত্য) দ্বারা, নিরাপত্তা দ্বারা নয়। এই তিনটি উপাদানের অসামঞ্জস্যই বিশৃঙ্খলার মূল কারণ।

বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তার সংকটের মূলে রয়েছে পরিবহন সিন্ডিকেটের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা, যা গিডেন্সের বর্ণিত ‘ক্ষমতার সংস্কৃতি’ ধারণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই সিন্ডিকেট কেবল পরিবহন বাণিজ্যের অংশ নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা-জাল, যা পরিবহন খাতকে প্রায় সমান্তরাল শাসনব্যবস্থায় পরিণত করেছে।

এই সিন্ডিকেটের হাতে থাকা শ্রমিক ধর্মঘটের হুমকি এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা হলো সেই ‘সম্পদ’ যা দিয়ে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ‘কাঠামোগত ক্ষমতা’-কে অকার্যকর করে দেয়। সিন্ডিকেট রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রবেশ করে এবং তাদের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। তাদের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জাতীয় নীতি নির্ধারণ পর্যন্ত সর্বত্র তাদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ, কঠোর আইন তৈরি হলেও তার প্রয়োগ শিথিল হয়ে পড়ে; আইন হয়ে পড়ে দর কষাকষির বিষয় এবং আইন ভঙ্গই হয়ে যায় স্বাভাবিক আচরণ। এই প্রক্রিয়া একদিকে কাঠামোগত দুর্বলতা ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করে, অন্যদিকে তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপ কাঠামোগত দুর্বলতাকে আরও গভীর করে তোলে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও যখন এই সিন্ডিকেটের চাপের মুখে নরম হতে বাধ্য হয়, তখন তারা আসলে কাঠামোর দুর্বলতাকে সম্মতি প্রদান করে এবং নিজেদের ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন কার্যকারিতাকে খর্ব করে।

এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি একটি শক্তিশালী ‘প্রতীকী সম্পদ’ হিসেবে কাজ করে। ঘুষের বিনিময়ে চালনার অনুমতিপত্র পাওয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া-এসব অনিয়ম কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করে আইনের আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখে, কিন্তু এর কার্যকারিতা ধ্বংস করে। ফলে, সড়কে একটি ‘বিকল্প নৈতিকতা’ তৈরি হয়েছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক আইনের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক লেনদেন এবং ‘সম্পর্ক’ বেশি কার্যকর। এই সমান্তরাল নৈতিকতার সংস্কৃতি আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। এই দুর্নীতি কাঠামোকে এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করে, যেখানে ঝুঁকি এবং মুনাফা দুটিই সিন্ডিকেটের অনুকূলে থাকে।

সড়ক-সংস্কৃতি বা রাস্তার সংস্কৃতি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা গিডেন্সের তত্ত্বে ‘অভ্যাসগত কর্মকাণ্ড’ এবং ‘দৈনন্দিন অনুশীলন’ হিসেবে বিবেচিত। এই সংস্কৃতি চালকদের মধ্যে এক ধরনের ‘প্রবণতাগত আচরণ’ তৈরি করে, যেখানে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, গতিসীমা লঙ্ঘন এবং আক্রমণাত্মক ড্রাইভিংকেই দক্ষতা ও সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। এই অভ্যাসগত কার্যকলাপ দুর্বল আইনি কাঠামোকে আরও দুর্বল করে তোলে, এবং আইন ভঙ্গকে সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

অন্যদিকে, পরিবহন শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ গিডেন্সের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে আরও স্পষ্ট করে। অধিকাংশ চালকের স্থায়ী চাকরি নেই, নিয়মিত আয় নেই, স্বাস্থ্যসুবিধা নেই। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির চাপ এবং মালিকদের পক্ষ থেকে গতি বাড়িয়ে ‘ট্রিপ’ বেশি করার তাগিদ তাদের ওপর অনবরত চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ হলো অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি প্রতিকূলতা, যা চালকদের মতো ব্যক্তির ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করে দেয়। তারা জানে যে তারা বিপজ্জনক কাজ করছে (জ্ঞাত অসঙ্গতি), কিন্তু জীবিকার তাগিদে তা করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক কাঠামোগত চাপ মেনে নিয়ে যখন একজন চালক ক্লান্তি সত্ত্বেও দ্রুত গতিতে গাড়ি চালায়, তখন সে একদিকে কাঠামোগত চাপ মেনে নেয়, অন্যদিকে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে কাঠামোর দুর্বলতাকেই পুনরুৎপাদন করে। এই হলো কাঠামোগত বাধ্যবাধকতার মুখে ব্যক্তির সক্রিয়তার করুণ পরিণতি।

সড়ক দুর্ঘটনার সামাজিক অসমতা এই ব্যবস্থার আরও গভীর দুর্বলতা। যেসব মানুষ সড়কে মারা যায়, তাদের বেশিরভাগই নিম্ন-আয়ের যাত্রী, পথচারী, রিকশাচালক বা শ্রমজীবী মানুষ। ব্যক্তিগত গাড়িতে চলা উচ্চবিত্তরা তুলনামূলক নিরাপদ থাকে। দুর্ঘটনার পর আইনি লড়াই, ক্ষতিপূরণ পাওয়া কিংবা চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষমতাও শ্রেণিভেদে ভিন্ন। এই অসমতা সমাজে ‘স্থিতিস্থাপকতার বৈষম্য’ তৈরি করে। গিডেন্সের গঠন প্রক্রিয়া তত্ত্বে, সম্পদের এই অসম বণ্টন হলো সেই ‘ক্ষমতার অসঙ্গতি’, যা দুর্ঘটনার প্রভাবকে শ্রেণিবদ্ধ করে এবং কাঠামোগত আধিপত্যকে স্থায়ী রূপ দেয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা সংকটটি নিছক ট্রাফিক সমস্যা নয়, এটি শ্রেণী ও বৈষম্যেরও প্রতিচ্ছবি।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নকশাগত ভুল এই সংকটকে আরও তীব্র করে, যা ঝুঁকিকে কাঠামোগতভাবে ‘নির্মিত’ করে তোলে। সড়ক নির্মাণে ‘পথচারীকে অগ্রাধিকার’ দেওয়ার যে বিশ্বজনীন নীতি, বাংলাদেশে তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। সড়ক নির্মাণের সময় প্রাতিষ্ঠানিক নকশা, নিরাপত্তা মানদণ্ড বা পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি বহু ক্ষেত্রে। ফুটপাত দখল, হাইওয়ের মাঝখানে বাজার বা বসতি রেখে দেওয়াসহ এই ত্রুটিপূর্ণ নকশা হলো কাঠামোগত অপূর্ণতা, যা ঝুঁকিকে অনিবার্য করে তোলে। এই নকশাগত ত্রুটি, যা মূলত নগর পরিকল্পনাবিদ এবং নির্মাণ কর্তৃপক্ষের কাঠামোগত সিদ্ধান্তের ফল, তা সাধারণ মানুষের ওপর ঝুঁকি চাপিয়ে দেয়-যা কাঠামোর আধিপত্যের চূড়ান্ত রূপ।

সংকটের আরেকটি দিক হলো ভুল তথ্য বা তথ্যের অভাব, যা গিডেন্সের তত্ত্বের ‘জ্ঞান ও তথ্য’ উপাদানের দুর্বলতা নির্দেশ করে। দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ভিডিও, গুজব ও আবেগপ্রবণ মন্তব্য ছড়ায়। সঠিক, দ্রুত ও সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় জনগণের অবিশ্বাস বাড়ে, যা আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতাকে আরও দুর্বল করে। এই তথ্য-সংকটের সংস্কৃতি প্রমাণ করে, সড়ক দুর্ঘটনার সমাধান শুধু রাস্তায় নয়, বরং ‘তথ্য-কাঠামো’-র দুর্বলতা দূর করার মধ্যেও নিহিত। যখন রাষ্ট্রের কাছে থাকা তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হয় না, তখন তা জনমনে সন্দেহ এবং আরও বেশি বেপরোয়া আচরণের জন্ম দেয়। আইন প্রয়োগের বারবার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো-আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি সরল আইনি বা প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, কাঠামো ও অভ্যাসের জটিল সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি।

গিডেন্সের গঠন প্রক্রিয়া তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, এই চক্রাকার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে কাঠামোর পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচেতনভাবে ভাঙতে হবে। এই কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক সাহস, যা সমাজের ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত থাকবে।

আইন প্রয়োগের বারবার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো-আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি সরল আইনি বা প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, কাঠামো ও অভ্যাসের জটিল সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি। গিডেন্সের তত্ত্ব অনুসারে, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে হবে, পাশাপাশি সমাজের ব্যক্তিদের অভ্যাসগত বেপরোয়া আচরণের সংস্কৃতিকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। কেবল ব্যক্তিগত চালকদের দায়ী করে লাভ নেই; পুরো কাঠামোর সংস্কার অপরিহার্য।

সমাধানের জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার এবং সাংস্কৃতিক রূপান্তর:

১. একক নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি (কাঠামোগত সংস্কার): একটি শক্তিশালী একক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন করে প্রশাসনিক অস্পষ্টতা দূর করা এবং প্রতিটি সংস্থার জবাবদিহি সুনির্দিষ্ট করা। আইন প্রয়োগের ক্ষমতাকে সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে বিআরটিএ-র মতো প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করে তাদের বৈধতা ও কার্যকারিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ (রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি): পরিবহন সিন্ডিকেটের রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করে ক্ষমতার সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং শ্রমিক ধর্মঘটের হুমকি মোকাবেলায় কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা। শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা-যা তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোগত চাপ থেকে মুক্তি দেবে এবং বেপরোয়া আচরণের প্রবণতা কমাবে। এই পদক্ষেপ ব্যক্তির ‘সক্রিয়তা’-কে জীবিকার তাগিদ থেকে নিরাপত্তার দিকে পরিচালিত করবে।

৩. মানবকেন্দ্রিক নকশা ও অভ্যাস পরিবর্তন (সক্রিয়তার রূপান্তর): সড়ক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ নকশা সংশোধন করা। পাশাপাশি, সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে সড়ক-সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা, যেখানে নিয়ম মানাটা একটি সামাজিক প্রত্যাশা এবং সুবিধা হিসেবে স্বীকৃত হবে। এটি ব্যক্তির ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন কার্যক্রমকে নেতিবাচক দিক থেকে ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করবে।

৪. তথ্য কাঠামো শক্তিশালীকরণ (বৈধতা ও অর্থ স্থাপন): ট্রাফিক আইন প্রয়োগে দুর্নীতি নির্মূলের মাধ্যমে আইনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সংকটকালীন যোগাযোগ এবং তথ্য ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও সমন্বিত করা। তথ্য ও জ্ঞানের মাধ্যমে জনগণের ‘জ্ঞাত সচেতনতা’ বৃদ্ধি করে তাদেরকে কাঠামোগত সংস্কারের পক্ষে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করা।

যখন সড়ক নিরাপত্তা সমাজের সামগ্রিক ন্যায়, কর্তৃত্ব, দায়বদ্ধতা ও আচরণগত সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবে-অর্থাৎ যখন কাঠামোর সঙ্গে ব্যক্তির আচরণগত ‘দ্বৈততা’ নিরাপত্তার দিকে এগোবে-তখনই আইন প্রয়োগ একটি রুটিন চর্চা নয়, বরং কার্যকর নিরাপত্তা-ব্যবস্থায় পরিণত হবে। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে কেবল মানুষকে বাঁচানো নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল সমাজ তৈরি করা।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

মতিউর রহমান

শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন আর কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নয়, বরং এটি একটি গভীর কাঠামোগত সামাজিক সংকটের প্রতিফলন, যা আমাদের সমাজব্যবস্থার মূলে প্রোথিত।

আইন প্রয়োগের বারবার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো-আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি সরল আইনি বা প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, কাঠামো ও অভ্যাসের জটিল সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি

সমাজের প্রতিদিনের জীবন, অর্থনৈতিক গতিবিধি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে এই সংকট অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে আমরা সমাজতাত্ত্বিক অ্যান্থনি গিডেন্সের ‘গঠন প্রক্রিয়া তত্ত্ব’ বা ‘কাঠামো তত্ত্ব’ প্রয়োগ করতে পারি। এই তত্ত্ব অনুসারে, সামাজিক জীবন কেবল কাঠামো বা কেবল ব্যক্তির সক্রিয়তা (এজেন্সি) দ্বারা পরিচালিত হয় না, বরং এই দুইয়ের মধ্যে অবিরাম এবং গভীর মিথস্ক্রিয়া চলে-এই মিথস্ক্রিয়াকে গিডেন্স ‘দ্বৈততা’ (কাঠামো ও সক্রিয়তার দ্বৈততা) বলে অভিহিত করেছেন। সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে, আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা হলো কাঠামোগত দুর্বলতা ও ব্যক্তিগত অভ্যাসের চক্রাকার পুনরুৎপাদন-যেখানে দুর্বল কাঠামো বেপরোয়া আচরণকে উৎসাহিত করে এবং সেই বেপরোয়া আচরণ আবার কাঠামোর দুর্বলতাকে বৈধতা দেয়।

সড়ক দুর্ঘটনা মোকাবিলায় প্রথম যে কাঠামোগত সমস্যাটি প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়, তা হলো ক্ষমতার বিভাজন ও প্রশাসনিক অস্পষ্টতা। সড়ক ব্যবস্থাপনা ও আইন প্রয়োগের দায়িত্ব পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার সংস্থা এবং পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্ত। এই বিচ্ছিন্ন দায়িত্ব ও ছড়ানো কর্তৃত্বের ফলে বাস্তব প্রয়োগে বড় ধরনের ফাঁক তৈরি হয়, যা গিডেন্স বর্ণিত কাঠামোর দুর্বলতা। এই দুর্বল কাঠামোর সুযোগ নিয়ে চালকরা নিয়ম ভঙ্গ করে, যা তাদের ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রকাশ। কিন্তু যখন সেই নিয়ম ভঙ্গের জন্য তাদের শাস্তি হয় না, তখন তারা এই দুর্বল কাঠামোকেই পুনরুৎপাদন করে, যেখানে আইনকে উপেক্ষা করা একটি গ্রহণযোগ্য সামাজিক অনুশীলনে পরিণত হয়। এটি এক ধরনের স্ব-ধ্বংসকারী চক্র তৈরি করে, যেখানে কোনো সংস্থা একা এই চক্র ভাঙতে পারে না।

গিডেন্সের তাত্ত্বিক লেন্স দিয়ে দেখলে, সড়কের এই সংকট হলো এমন এক ‘কাঠামো’, যা তিনটি মৌলিক উপাদানের ওপর নির্মিত: আধিপত্য (কে বা কারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে), বৈধতা (কোন নিয়ম বা মূল্যবোধগুলো গ্রহণযোগ্য), এবং অর্থ (সামাজিক অনুশীলনের উদ্দেশ্য বা অর্থ কী)। বাংলাদেশে এই কাঠামোর আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ করে পরিবহন সিন্ডিকেট; আইন প্রয়োগের বৈধতা ব্যবহৃত হয় দুর্নীতি ও ঘুষের মাধ্যমে, এবং সড়কের নিয়ম-কানুনের অর্থ নির্ধারিত হয় ‘দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো’ (অর্থ) এবং ‘ক্ষমতা প্রদর্শন’ (আধিপত্য) দ্বারা, নিরাপত্তা দ্বারা নয়। এই তিনটি উপাদানের অসামঞ্জস্যই বিশৃঙ্খলার মূল কারণ।

বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তার সংকটের মূলে রয়েছে পরিবহন সিন্ডিকেটের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা, যা গিডেন্সের বর্ণিত ‘ক্ষমতার সংস্কৃতি’ ধারণার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই সিন্ডিকেট কেবল পরিবহন বাণিজ্যের অংশ নয়, বরং এটি একটি শক্তিশালী, সুসংগঠিত এবং অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা-জাল, যা পরিবহন খাতকে প্রায় সমান্তরাল শাসনব্যবস্থায় পরিণত করেছে।

এই সিন্ডিকেটের হাতে থাকা শ্রমিক ধর্মঘটের হুমকি এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা হলো সেই ‘সম্পদ’ যা দিয়ে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ‘কাঠামোগত ক্ষমতা’-কে অকার্যকর করে দেয়। সিন্ডিকেট রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রবেশ করে এবং তাদের স্বার্থের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। তাদের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত যে, স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জাতীয় নীতি নির্ধারণ পর্যন্ত সর্বত্র তাদের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ, কঠোর আইন তৈরি হলেও তার প্রয়োগ শিথিল হয়ে পড়ে; আইন হয়ে পড়ে দর কষাকষির বিষয় এবং আইন ভঙ্গই হয়ে যায় স্বাভাবিক আচরণ। এই প্রক্রিয়া একদিকে কাঠামোগত দুর্বলতা ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করে, অন্যদিকে তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপ কাঠামোগত দুর্বলতাকে আরও গভীর করে তোলে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও যখন এই সিন্ডিকেটের চাপের মুখে নরম হতে বাধ্য হয়, তখন তারা আসলে কাঠামোর দুর্বলতাকে সম্মতি প্রদান করে এবং নিজেদের ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন কার্যকারিতাকে খর্ব করে।

এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি একটি শক্তিশালী ‘প্রতীকী সম্পদ’ হিসেবে কাজ করে। ঘুষের বিনিময়ে চালনার অনুমতিপত্র পাওয়া, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া-এসব অনিয়ম কাঠামোর ভেতরে প্রবেশ করে আইনের আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখে, কিন্তু এর কার্যকারিতা ধ্বংস করে। ফলে, সড়কে একটি ‘বিকল্প নৈতিকতা’ তৈরি হয়েছে, যেখানে আনুষ্ঠানিক আইনের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক লেনদেন এবং ‘সম্পর্ক’ বেশি কার্যকর। এই সমান্তরাল নৈতিকতার সংস্কৃতি আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতা নষ্ট করে। এই দুর্নীতি কাঠামোকে এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করে, যেখানে ঝুঁকি এবং মুনাফা দুটিই সিন্ডিকেটের অনুকূলে থাকে।

সড়ক-সংস্কৃতি বা রাস্তার সংস্কৃতি দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা গিডেন্সের তত্ত্বে ‘অভ্যাসগত কর্মকাণ্ড’ এবং ‘দৈনন্দিন অনুশীলন’ হিসেবে বিবেচিত। এই সংস্কৃতি চালকদের মধ্যে এক ধরনের ‘প্রবণতাগত আচরণ’ তৈরি করে, যেখানে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, গতিসীমা লঙ্ঘন এবং আক্রমণাত্মক ড্রাইভিংকেই দক্ষতা ও সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। এই অভ্যাসগত কার্যকলাপ দুর্বল আইনি কাঠামোকে আরও দুর্বল করে তোলে, এবং আইন ভঙ্গকে সমাজে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

অন্যদিকে, পরিবহন শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ গিডেন্সের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে আরও স্পষ্ট করে। অধিকাংশ চালকের স্থায়ী চাকরি নেই, নিয়মিত আয় নেই, স্বাস্থ্যসুবিধা নেই। অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির চাপ এবং মালিকদের পক্ষ থেকে গতি বাড়িয়ে ‘ট্রিপ’ বেশি করার তাগিদ তাদের ওপর অনবরত চাপ সৃষ্টি করে। এই চাপ হলো অর্থনৈতিক কাঠামোর একটি প্রতিকূলতা, যা চালকদের মতো ব্যক্তির ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে সীমিত করে দেয়। তারা জানে যে তারা বিপজ্জনক কাজ করছে (জ্ঞাত অসঙ্গতি), কিন্তু জীবিকার তাগিদে তা করতে বাধ্য হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক কাঠামোগত চাপ মেনে নিয়ে যখন একজন চালক ক্লান্তি সত্ত্বেও দ্রুত গতিতে গাড়ি চালায়, তখন সে একদিকে কাঠামোগত চাপ মেনে নেয়, অন্যদিকে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে কাঠামোর দুর্বলতাকেই পুনরুৎপাদন করে। এই হলো কাঠামোগত বাধ্যবাধকতার মুখে ব্যক্তির সক্রিয়তার করুণ পরিণতি।

সড়ক দুর্ঘটনার সামাজিক অসমতা এই ব্যবস্থার আরও গভীর দুর্বলতা। যেসব মানুষ সড়কে মারা যায়, তাদের বেশিরভাগই নিম্ন-আয়ের যাত্রী, পথচারী, রিকশাচালক বা শ্রমজীবী মানুষ। ব্যক্তিগত গাড়িতে চলা উচ্চবিত্তরা তুলনামূলক নিরাপদ থাকে। দুর্ঘটনার পর আইনি লড়াই, ক্ষতিপূরণ পাওয়া কিংবা চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষমতাও শ্রেণিভেদে ভিন্ন। এই অসমতা সমাজে ‘স্থিতিস্থাপকতার বৈষম্য’ তৈরি করে। গিডেন্সের গঠন প্রক্রিয়া তত্ত্বে, সম্পদের এই অসম বণ্টন হলো সেই ‘ক্ষমতার অসঙ্গতি’, যা দুর্ঘটনার প্রভাবকে শ্রেণিবদ্ধ করে এবং কাঠামোগত আধিপত্যকে স্থায়ী রূপ দেয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা সংকটটি নিছক ট্রাফিক সমস্যা নয়, এটি শ্রেণী ও বৈষম্যেরও প্রতিচ্ছবি।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নকশাগত ভুল এই সংকটকে আরও তীব্র করে, যা ঝুঁকিকে কাঠামোগতভাবে ‘নির্মিত’ করে তোলে। সড়ক নির্মাণে ‘পথচারীকে অগ্রাধিকার’ দেওয়ার যে বিশ্বজনীন নীতি, বাংলাদেশে তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। সড়ক নির্মাণের সময় প্রাতিষ্ঠানিক নকশা, নিরাপত্তা মানদণ্ড বা পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি বহু ক্ষেত্রে। ফুটপাত দখল, হাইওয়ের মাঝখানে বাজার বা বসতি রেখে দেওয়াসহ এই ত্রুটিপূর্ণ নকশা হলো কাঠামোগত অপূর্ণতা, যা ঝুঁকিকে অনিবার্য করে তোলে। এই নকশাগত ত্রুটি, যা মূলত নগর পরিকল্পনাবিদ এবং নির্মাণ কর্তৃপক্ষের কাঠামোগত সিদ্ধান্তের ফল, তা সাধারণ মানুষের ওপর ঝুঁকি চাপিয়ে দেয়-যা কাঠামোর আধিপত্যের চূড়ান্ত রূপ।

সংকটের আরেকটি দিক হলো ভুল তথ্য বা তথ্যের অভাব, যা গিডেন্সের তত্ত্বের ‘জ্ঞান ও তথ্য’ উপাদানের দুর্বলতা নির্দেশ করে। দুর্ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ভিডিও, গুজব ও আবেগপ্রবণ মন্তব্য ছড়ায়। সঠিক, দ্রুত ও সমন্বিত তথ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় জনগণের অবিশ্বাস বাড়ে, যা আইন প্রয়োগের ধারাবাহিকতাকে আরও দুর্বল করে। এই তথ্য-সংকটের সংস্কৃতি প্রমাণ করে, সড়ক দুর্ঘটনার সমাধান শুধু রাস্তায় নয়, বরং ‘তথ্য-কাঠামো’-র দুর্বলতা দূর করার মধ্যেও নিহিত। যখন রাষ্ট্রের কাছে থাকা তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হয় না, তখন তা জনমনে সন্দেহ এবং আরও বেশি বেপরোয়া আচরণের জন্ম দেয়। আইন প্রয়োগের বারবার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো-আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি সরল আইনি বা প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, কাঠামো ও অভ্যাসের জটিল সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি।

গিডেন্সের গঠন প্রক্রিয়া তত্ত্ব আমাদের শেখায় যে, এই চক্রাকার সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে হলে কাঠামোর পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচেতনভাবে ভাঙতে হবে। এই কাঠামোগত পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রশাসনিক সাহস, যা সমাজের ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রস্তুত থাকবে।

আইন প্রয়োগের বারবার ব্যর্থতার মূল কারণ হলো-আমরা সড়ক দুর্ঘটনাকে একটি সরল আইনি বা প্রযুক্তিগত সমস্যা হিসেবে না দেখে, কাঠামো ও অভ্যাসের জটিল সমাজতাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছি। গিডেন্সের তত্ত্ব অনুসারে, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে কাঠামোর দুর্বলতা দূর করতে হবে, পাশাপাশি সমাজের ব্যক্তিদের অভ্যাসগত বেপরোয়া আচরণের সংস্কৃতিকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে। কেবল ব্যক্তিগত চালকদের দায়ী করে লাভ নেই; পুরো কাঠামোর সংস্কার অপরিহার্য।

সমাধানের জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার এবং সাংস্কৃতিক রূপান্তর:

১. একক নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহি (কাঠামোগত সংস্কার): একটি শক্তিশালী একক নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন করে প্রশাসনিক অস্পষ্টতা দূর করা এবং প্রতিটি সংস্থার জবাবদিহি সুনির্দিষ্ট করা। আইন প্রয়োগের ক্ষমতাকে সিন্ডিকেটের প্রভাবমুক্ত করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে বিআরটিএ-র মতো প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত করে তাদের বৈধতা ও কার্যকারিতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

সংস্কৃতির চ্যালেঞ্জ (রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি): পরিবহন সিন্ডিকেটের রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করে ক্ষমতার সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং শ্রমিক ধর্মঘটের হুমকি মোকাবেলায় কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা। শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী সামাজিক নিরাপত্তা এবং ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা-যা তাদের অর্থনৈতিক কাঠামোগত চাপ থেকে মুক্তি দেবে এবং বেপরোয়া আচরণের প্রবণতা কমাবে। এই পদক্ষেপ ব্যক্তির ‘সক্রিয়তা’-কে জীবিকার তাগিদ থেকে নিরাপত্তার দিকে পরিচালিত করবে।

৩. মানবকেন্দ্রিক নকশা ও অভ্যাস পরিবর্তন (সক্রিয়তার রূপান্তর): সড়ক নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পথচারীকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ নকশা সংশোধন করা। পাশাপাশি, সামাজিক প্রচারণার মাধ্যমে সড়ক-সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা, যেখানে নিয়ম মানাটা একটি সামাজিক প্রত্যাশা এবং সুবিধা হিসেবে স্বীকৃত হবে। এটি ব্যক্তির ‘সক্রিয়তা’ বা স্বাধীন কার্যক্রমকে নেতিবাচক দিক থেকে ইতিবাচক দিকে পরিচালিত করবে।

৪. তথ্য কাঠামো শক্তিশালীকরণ (বৈধতা ও অর্থ স্থাপন): ট্রাফিক আইন প্রয়োগে দুর্নীতি নির্মূলের মাধ্যমে আইনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। সংকটকালীন যোগাযোগ এবং তথ্য ব্যবস্থাপনাকে স্বচ্ছ ও সমন্বিত করা। তথ্য ও জ্ঞানের মাধ্যমে জনগণের ‘জ্ঞাত সচেতনতা’ বৃদ্ধি করে তাদেরকে কাঠামোগত সংস্কারের পক্ষে সক্রিয় হতে উৎসাহিত করা।

যখন সড়ক নিরাপত্তা সমাজের সামগ্রিক ন্যায়, কর্তৃত্ব, দায়বদ্ধতা ও আচরণগত সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবে-অর্থাৎ যখন কাঠামোর সঙ্গে ব্যক্তির আচরণগত ‘দ্বৈততা’ নিরাপত্তার দিকে এগোবে-তখনই আইন প্রয়োগ একটি রুটিন চর্চা নয়, বরং কার্যকর নিরাপত্তা-ব্যবস্থায় পরিণত হবে। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে কেবল মানুষকে বাঁচানো নয়, বরং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও দায়িত্বশীল সমাজ তৈরি করা।

[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top