পাভেল পার্থ
চৈত্র যেন নিষ্ঠুরকাল। চৈত্র থেকে বৈশাখ হাওরের মানুষ দমবন্ধ করে থাকে। যেন কোন আপদ-বিপদ হামলে না পড়ে হাওরে। কারণ এ সময়েই হাওরাঞ্চলে বোরো মৌসুমের ধান ঘরে তোলা হয়। আর বছর বছর এ সময়েই আসে পাহাড়ি ঢল কী শিলাবৃষ্টি। চুরমার হয়ে যায় দেশের ছয় ভাগের একভাগ অঞ্চলের স্বপ্ন-সাধ। ‘বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও’ এই ছিল হাওরের জীবনবিজ্ঞান। আফাল কী আফরমারার মতো আপদের সাথে সখ্য ছিল হাওরবাসীর। কিন্তু দিনে দিনে বেড়েছে পাহাড়ি ঢল, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কোল্ড ইনজুরি আর নিত্যনতুন বালাইয়ের উপদ্রব। এতকিছু সামলেও হাওরবাসী বাংলাদেশের সামনে প্রতিদিন হাজির করছে তরতাজা ভাতের থালা। এমনকি করোনাকালে স্থবির হয়ে থাকা দুনিয়ায় জানবাজি রেখে হাওরের কৃষক থেকেছেন নির্ঘুম। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় সংক্রমণ ঢেউ শুরু হলে ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দেশব্যাপী লকডাউন। এবার পাহাড়ি ঢল নয়, লকডাউনের ঠিক আগের দিন হাওরাঞ্চল ঝলসে গেছে এক ‘আজব’ তীব্র গরম বাতাসে। ‘আজব’ এ কারণেই যে, হাওরের প্রবীণজনের ভাষ্য তারা কখনোই এমন আপদ দেখেননি। গরম বাতাসে ধানের জমিন নষ্ট হওয়ার কোনো স্মৃতি তাদের নাই। কয়েক ঘণ্টার তীব্র গরম হাওয়া ও ঝড়ে ধান গাছের শীষ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও ধান চিটা হয়েছে। কোথাও পরাগায়ন হতে পারেনি। কোথাও ধানের শীষের রঙ কালো আবার কোথাও সাদা হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ধানের। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলেই ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। সুনামগঞ্জের শাল্লাতেও ক্ষতি হয়েছে বোরো জমিনের। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির বোরো মৌসুমের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে কৃষিবিভাগ। যখন আমরা পুরো তালিকা ও চিত্র পাব দেখা যাবে ক্ষতিটা এরচেয়ে বেশি। এ ক্ষতির ফলে সৃষ্ট দুর্গতি ও যন্ত্রণা হয়তো কাতর করবে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা। আঘাত করবে মহামারীকালীন টিকে থাকার সক্ষমতাকে। মহামারী সামলে লকডাউনে অবরুদ্ধ হলেও, থামছে না হাওরের আহাজারি। শুধু মহামারীর শংকা নয়, সামনে ভাসছে অনিশ্চিত ভাতের থালার দীর্ঘ সারি। এখনি হাওরের পাশে আমাদের দাঁড়ানো জরুরি। সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি। খাদ্য-অর্থসহ প্রয়োজনীয় চাহিদার জোগান নিয়ে নিঃস্ব হাওরের পাশে দাঁড়াক বাংলাদেশ। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানামুখী উৎপাদনভিত্তিক প্রণোদনা এবং নানা মেয়াদের কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক। ভবিষ্যতে এ ধরণের ঝুঁকি ও দুর্যোগ সামাল দিতে এখন থেকেই সামগ্রিক তৎপরতা জরুরি।
সব ধান ‘হিইজ্যা’ গেছে
নেত্রকোনা মদনের গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের বাউগ্যা হাওর ও রামদীঘা হাওরে প্রায় ৪ আড়া জমিতে এবার বোরো মৌসুমে ধান আবাদ করেছিলেন হেলাল মিয়ার পরিবার। স্থানীয় জমির মাপ অনুযায়ী ১৬ কাঠাতে এক আড়া হয়। ১০ শতকে এক কাঠা। এক আড়া জমিনে ধান ফলে প্রায় ১৫০ মণ। রোববারের গরম বাতাসে ঝলসে চিটা হয়ে গেছে হেলাল মিয়াদের ৪ আড়া জমির প্রায় ৬০০ মণ ধান। প্রতি মণ ধানের দাম বর্তমান দরে ৯০০ টাকা হলে শুধু ধানের দামে ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক এই বিপর্যয় নিয়ে মোবাইলে কথা বলি সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের প্রবীণজনের সঙ্গে। তারা কেউ এমন আপদ স্মরণ করতে পারেননি। এদের অনেকেই স্মরণে রেখেছেন ‘কলেরা’ ও ‘বসন্ত’ মহামারীর স্মৃতি। গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক সিকুল মিয়া, মতিয়ার রহমান, হেলাল মিয়াদের পর্যবেক্ষণ এবারের ঝড়ে বৃষ্টিপাত ছিল না তেমন, শুধু ঝড়ো হাওয়া ছিল আর ছিল প্রচন্ড ধূলিঝড়। বাতাস ছিল বেশ গরম, অনেকে বলেছেন ‘লু হাওয়া’। প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা এ গরম ঝড়ো হাওয়া চলেছে। পরদিন সকালে ধানের জমিনে গিয়ে তারা দেখেন ধান গাছের ওপর একটা কেমন ধূলিময় আস্তর পড়েছে। এর পরদিন দেখা যায় ধীরে ধীরে ধানের শীষ রঙ পাল্টে গাছসহ সাদাটে হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও কালচেও হয়েছে। শীষ থেকে ধানের দানা নিয়ে খুলে দেখেন ভেতরে কিছুই নেই। ধানের খোসার ভেতর কোনো দানা হয়নি, দুধ ও পানি জমেনি। সব শুকিয়ে গেছে। যেখানে ধানের ফুল ফুটেছিল তা সব ঝরে গেছে। পরাগায়ন হয়নি। ধীরে ধীরে দুদিনে সব ধান ‘হিইজ্যা’ গেছে। মানে দানার ভেতরের সব রস শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে গেছে।
কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি!
কোন দুর্যোগে ফসলহানি হলে শুধু দানার উৎপাদন গণনা করা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত গবাদি প্রাণিসম্পদের খাদ্য, গৃহস্থালি নানা সম্পর্ক, নারীর অদৃশ্য শ্রম, পরিবার-পরিজনের নানা সহযোগিতাসহ এক বিশাল কৃষিজীবনের ওপর আঘাতকে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সামগ্রিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা দরকার। বিশেষ করে এই করোনা মহামারীকালে। কারণ তাহলে সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষ ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। যদিও এবার জনপ্রতিনিধিরা দ্রুতই হাওরের বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছেন। ৬ এপ্রিল বিকালে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু মদন উপজেলার বেশকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হাওর পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। মদনের গোবিন্দশ্রীর হেলাল মিয়ার যেমন প্রায় ৬০০ মণ ধান নষ্ট হয়েছে, পাশাপাশি সব হাওরই হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। মদন উপজেলার কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার আটটি ইউনিয়নে প্রায় ১৭ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ হয়েছে। কৃষি অফিস প্রাথমিকভাবে জানায়, উপজেলার প্রায় ৫০ ভাগ ধানই নষ্ট হয়ে গেছে। নেত্রকোনার ২১ হাজার ৬৭৭ হেক্টর, কিশোরগঞ্জের ২৫ হাজার হেক্টর, ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬৩০ হেক্টর এবং সুনামগঞ্জের শাল্লার প্রায় ২০ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে কিছু অনুমান করেছে কৃষিবিভাগ। সুনামগঞ্জের শাল্লার খলার হাওর, ঘাতুয়া হাওর, ভেড়াডহর হাওর, উদগল হাওর, ছাগলনাইয়া হাওরের ধানও গরম বাতাস ও শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে।
এটা কী জলবায়ু সংকটের লক্ষণ?
হাওরে গত ১০০ বছরে এমন গরম বাতাসে ফসলহানির কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। পাহাড়ি ঢল, বড় বন্যা, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কালবৈশাখী, কোল্ড ইনজুরি, বালাই উপদ্রব এরকম আপদ-বিপদের সঙ্গে কী তাহলে নতুন করে যুক্ত হয়ে গেল এ ‘গরম বাতাস’? এমনকি হাওরের আবহাওয়াভিত্তিক লোকায়ত পঞ্জিকা ও জলবায়ু জ্ঞানভাষ্যেও এই গরম বাতাসের নজির নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড়ের বার্তা দিলেও ‘গরম বাতাসের’ এই আগাম বার্তা দিতে পারেনি। পুস্তকি ভাষায় এটি হয়তো ‘হিট ইনজুরি’, কারণ এর আগে হাওরাঞ্চল ভুগেছে কোল্ড-ইনজুরিতেও। তার মানে কী আবহাওয়ার এমন অনেক উল্টাপাল্টা খেলা আমরা ধরতে পারছি না। আন্দাজ বা অনুমান করতে পারছি না। যদি গরম বাতাসের আগাম সংকেত ও পূর্বাভাস থাকত তবে কী আমরা প্রস্তুতি নিতে পারতাম? কী হতো সেই প্রস্তুতি? কৃষিবিভাগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এখন এসব নিয়েও কাজ করতে হবে। এলাকা অনুযায়ী কেমন ঝুঁকি হতে পারে এবং সেই ঝুঁকি সামালে কৃষক তাৎক্ষণিক কি কি প্রস্তুতি নিতে পারে সেসব আগেভাগেই কৃষকেরা সঙ্গে আলাপ করে নেয়া জরুরি। কারণ ফসলহানি হলে কী শুধু কৃষকের ক্ষতি হয়, ভাতের থালা শূন্য হয়ে যায় গোটা বাংলাদেশের। দুনিয়াব্যাপী তৈরি হতে পারে এভাবে খাদ্যহীনতা। তো এই যে দেশের উপকূলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য, উত্তরাঞ্চলে দাবদাহ ও খরা এবং হাওরাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলসহ গরম বাতাসের মতো নয়া সংকট। এসব কী বিপর্যস্ত জলবায়ুর স্বাস্থ্যহানির সংকেত। কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয়ের এ সংকট কেন শুধু বাংলাদেশের কৃষককে সামাল দিতে হবে? এ সংকটের জন্য দায়ী সব ধনী দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানিকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ক্ষতিপূরণ এবং ঝুঁকি সামলে বাংলাদেশের কৃষকদের সক্ষমতা তৈরির জন্য তহবিল আদায়ে তাদের বাধ্য করতে হবে।
হিরাল আর চুরাকের কথা মনে আছে?
হাওরভাটি হলো গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর। এমনকি এখানে চুরাক, সকালমুখী ও হাতীবান্ধার মতো ধানও আছে। বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টির ভেতরেও যে গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। শীষ থেকে ঝরে যায় না পুষ্ট দানা। কিন্তু আমরা হাওরাঞ্চলের স্থানীয় ধানকে গুরুত্ব দেইনি। তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে বোরো মৌসুম দেশের প্রধান কৃষি মৌসুম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এ সময়টাতে বহুজাতিক কোম্পানিদের সার-বিষ-বীজের ব্যবসাও হয় বেশি। আর চাষ হয় শুধু ব্রিধান-২৮, ব্রি-ধান-২৯, বি-আর-১০ আর কিছু হাইব্রিড ধান। এসব ধান অল্প বাতাসেই ঝরে যায়, আবহাওয়ার সামান্যতম পরিবর্তনে মুষড়ে পড়ে। ধানের ক্ষেত্রে ফুল আসা থেকে দানার ভেতর দুধ তৈরি হওয়ার সময় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি থাকলে ধান নষ্ট হয়ে যায়। চিটা হয়ে যায়। ঝলসে রঙ পরিবর্তিত হয়। জমির মাটিতে পর্যাপ্ত হিউমাস, আর্দ্রতা ও পানি থাকলে এই গরম আবহাওয়া থেকে কিছু রক্ষা পাওয়া যায়। হাওরাঞ্চলে এক সময় হিরালপ্রথা চালু ছিল। বিজ্ঞ হিরালেরা বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি থেকে হাওরের কৃষিজমি রক্ষা করতেন। জমি, বীজ, কৃষির সঙ্গে হাওরের তাই গড়ে ওঠেছে এমন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক। সাম্প্রতিক গরম বাতাসের আঘাতে নিঃস্ব হাওরের পাশে সত্যিকারভাবে দাঁড়াতে হলে হাওরবাসীর কৃষিচিন্তা ও কৃষিদর্শন আগলেই দাঁড়ানো দরকার।
[ লেখক : গবেষক ]
animistbangla@gmail.com
পাভেল পার্থ
বুধবার, ০৭ এপ্রিল ২০২১
চৈত্র যেন নিষ্ঠুরকাল। চৈত্র থেকে বৈশাখ হাওরের মানুষ দমবন্ধ করে থাকে। যেন কোন আপদ-বিপদ হামলে না পড়ে হাওরে। কারণ এ সময়েই হাওরাঞ্চলে বোরো মৌসুমের ধান ঘরে তোলা হয়। আর বছর বছর এ সময়েই আসে পাহাড়ি ঢল কী শিলাবৃষ্টি। চুরমার হয়ে যায় দেশের ছয় ভাগের একভাগ অঞ্চলের স্বপ্ন-সাধ। ‘বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও’ এই ছিল হাওরের জীবনবিজ্ঞান। আফাল কী আফরমারার মতো আপদের সাথে সখ্য ছিল হাওরবাসীর। কিন্তু দিনে দিনে বেড়েছে পাহাড়ি ঢল, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কোল্ড ইনজুরি আর নিত্যনতুন বালাইয়ের উপদ্রব। এতকিছু সামলেও হাওরবাসী বাংলাদেশের সামনে প্রতিদিন হাজির করছে তরতাজা ভাতের থালা। এমনকি করোনাকালে স্থবির হয়ে থাকা দুনিয়ায় জানবাজি রেখে হাওরের কৃষক থেকেছেন নির্ঘুম। করোনা মহামারীর দ্বিতীয় সংক্রমণ ঢেউ শুরু হলে ৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় দেশব্যাপী লকডাউন। এবার পাহাড়ি ঢল নয়, লকডাউনের ঠিক আগের দিন হাওরাঞ্চল ঝলসে গেছে এক ‘আজব’ তীব্র গরম বাতাসে। ‘আজব’ এ কারণেই যে, হাওরের প্রবীণজনের ভাষ্য তারা কখনোই এমন আপদ দেখেননি। গরম বাতাসে ধানের জমিন নষ্ট হওয়ার কোনো স্মৃতি তাদের নাই। কয়েক ঘণ্টার তীব্র গরম হাওয়া ও ঝড়ে ধান গাছের শীষ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও ধান চিটা হয়েছে। কোথাও পরাগায়ন হতে পারেনি। কোথাও ধানের শীষের রঙ কালো আবার কোথাও সাদা হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে ধানের। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলেই ক্ষতিটা বেশি হয়েছে। সুনামগঞ্জের শাল্লাতেও ক্ষতি হয়েছে বোরো জমিনের। নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমির বোরো মৌসুমের ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে কৃষিবিভাগ। যখন আমরা পুরো তালিকা ও চিত্র পাব দেখা যাবে ক্ষতিটা এরচেয়ে বেশি। এ ক্ষতির ফলে সৃষ্ট দুর্গতি ও যন্ত্রণা হয়তো কাতর করবে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা। আঘাত করবে মহামারীকালীন টিকে থাকার সক্ষমতাকে। মহামারী সামলে লকডাউনে অবরুদ্ধ হলেও, থামছে না হাওরের আহাজারি। শুধু মহামারীর শংকা নয়, সামনে ভাসছে অনিশ্চিত ভাতের থালার দীর্ঘ সারি। এখনি হাওরের পাশে আমাদের দাঁড়ানো জরুরি। সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রকাশ করা জরুরি। খাদ্য-অর্থসহ প্রয়োজনীয় চাহিদার জোগান নিয়ে নিঃস্ব হাওরের পাশে দাঁড়াক বাংলাদেশ। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানামুখী উৎপাদনভিত্তিক প্রণোদনা এবং নানা মেয়াদের কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক। ভবিষ্যতে এ ধরণের ঝুঁকি ও দুর্যোগ সামাল দিতে এখন থেকেই সামগ্রিক তৎপরতা জরুরি।
সব ধান ‘হিইজ্যা’ গেছে
নেত্রকোনা মদনের গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের বাউগ্যা হাওর ও রামদীঘা হাওরে প্রায় ৪ আড়া জমিতে এবার বোরো মৌসুমে ধান আবাদ করেছিলেন হেলাল মিয়ার পরিবার। স্থানীয় জমির মাপ অনুযায়ী ১৬ কাঠাতে এক আড়া হয়। ১০ শতকে এক কাঠা। এক আড়া জমিনে ধান ফলে প্রায় ১৫০ মণ। রোববারের গরম বাতাসে ঝলসে চিটা হয়ে গেছে হেলাল মিয়াদের ৪ আড়া জমির প্রায় ৬০০ মণ ধান। প্রতি মণ ধানের দাম বর্তমান দরে ৯০০ টাকা হলে শুধু ধানের দামে ক্ষতি হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। সাম্প্রতিক এই বিপর্যয় নিয়ে মোবাইলে কথা বলি সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের প্রবীণজনের সঙ্গে। তারা কেউ এমন আপদ স্মরণ করতে পারেননি। এদের অনেকেই স্মরণে রেখেছেন ‘কলেরা’ ও ‘বসন্ত’ মহামারীর স্মৃতি। গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক সিকুল মিয়া, মতিয়ার রহমান, হেলাল মিয়াদের পর্যবেক্ষণ এবারের ঝড়ে বৃষ্টিপাত ছিল না তেমন, শুধু ঝড়ো হাওয়া ছিল আর ছিল প্রচন্ড ধূলিঝড়। বাতাস ছিল বেশ গরম, অনেকে বলেছেন ‘লু হাওয়া’। প্রায় ৫-৬ ঘণ্টা এ গরম ঝড়ো হাওয়া চলেছে। পরদিন সকালে ধানের জমিনে গিয়ে তারা দেখেন ধান গাছের ওপর একটা কেমন ধূলিময় আস্তর পড়েছে। এর পরদিন দেখা যায় ধীরে ধীরে ধানের শীষ রঙ পাল্টে গাছসহ সাদাটে হয়ে যাচ্ছে। কোথাও কোথাও কালচেও হয়েছে। শীষ থেকে ধানের দানা নিয়ে খুলে দেখেন ভেতরে কিছুই নেই। ধানের খোসার ভেতর কোনো দানা হয়নি, দুধ ও পানি জমেনি। সব শুকিয়ে গেছে। যেখানে ধানের ফুল ফুটেছিল তা সব ঝরে গেছে। পরাগায়ন হয়নি। ধীরে ধীরে দুদিনে সব ধান ‘হিইজ্যা’ গেছে। মানে দানার ভেতরের সব রস শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে গেছে।
কতটুকু ক্ষয়ক্ষতি!
কোন দুর্যোগে ফসলহানি হলে শুধু দানার উৎপাদন গণনা করা হয়। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত গবাদি প্রাণিসম্পদের খাদ্য, গৃহস্থালি নানা সম্পর্ক, নারীর অদৃশ্য শ্রম, পরিবার-পরিজনের নানা সহযোগিতাসহ এক বিশাল কৃষিজীবনের ওপর আঘাতকে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে সামগ্রিক বিজ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা দরকার। বিশেষ করে এই করোনা মহামারীকালে। কারণ তাহলে সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষ ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। যদিও এবার জনপ্রতিনিধিরা দ্রুতই হাওরের বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছেন। ৬ এপ্রিল বিকালে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু মদন উপজেলার বেশকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হাওর পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে। মদনের গোবিন্দশ্রীর হেলাল মিয়ার যেমন প্রায় ৬০০ মণ ধান নষ্ট হয়েছে, পাশাপাশি সব হাওরই হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। মদন উপজেলার কৃষি অফিসের তথ্যমতে, উপজেলার আটটি ইউনিয়নে প্রায় ১৭ হাজার ৩৪০ হেক্টর জমিতে বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ হয়েছে। কৃষি অফিস প্রাথমিকভাবে জানায়, উপজেলার প্রায় ৫০ ভাগ ধানই নষ্ট হয়ে গেছে। নেত্রকোনার ২১ হাজার ৬৭৭ হেক্টর, কিশোরগঞ্জের ২৫ হাজার হেক্টর, ময়মনসিংহে ২ হাজার ৬৩০ হেক্টর এবং সুনামগঞ্জের শাল্লার প্রায় ২০ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে কিছু অনুমান করেছে কৃষিবিভাগ। সুনামগঞ্জের শাল্লার খলার হাওর, ঘাতুয়া হাওর, ভেড়াডহর হাওর, উদগল হাওর, ছাগলনাইয়া হাওরের ধানও গরম বাতাস ও শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে।
এটা কী জলবায়ু সংকটের লক্ষণ?
হাওরে গত ১০০ বছরে এমন গরম বাতাসে ফসলহানির কোন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। পাহাড়ি ঢল, বড় বন্যা, অনাবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, কালবৈশাখী, কোল্ড ইনজুরি, বালাই উপদ্রব এরকম আপদ-বিপদের সঙ্গে কী তাহলে নতুন করে যুক্ত হয়ে গেল এ ‘গরম বাতাস’? এমনকি হাওরের আবহাওয়াভিত্তিক লোকায়ত পঞ্জিকা ও জলবায়ু জ্ঞানভাষ্যেও এই গরম বাতাসের নজির নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড়ের বার্তা দিলেও ‘গরম বাতাসের’ এই আগাম বার্তা দিতে পারেনি। পুস্তকি ভাষায় এটি হয়তো ‘হিট ইনজুরি’, কারণ এর আগে হাওরাঞ্চল ভুগেছে কোল্ড-ইনজুরিতেও। তার মানে কী আবহাওয়ার এমন অনেক উল্টাপাল্টা খেলা আমরা ধরতে পারছি না। আন্দাজ বা অনুমান করতে পারছি না। যদি গরম বাতাসের আগাম সংকেত ও পূর্বাভাস থাকত তবে কী আমরা প্রস্তুতি নিতে পারতাম? কী হতো সেই প্রস্তুতি? কৃষিবিভাগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে এখন এসব নিয়েও কাজ করতে হবে। এলাকা অনুযায়ী কেমন ঝুঁকি হতে পারে এবং সেই ঝুঁকি সামালে কৃষক তাৎক্ষণিক কি কি প্রস্তুতি নিতে পারে সেসব আগেভাগেই কৃষকেরা সঙ্গে আলাপ করে নেয়া জরুরি। কারণ ফসলহানি হলে কী শুধু কৃষকের ক্ষতি হয়, ভাতের থালা শূন্য হয়ে যায় গোটা বাংলাদেশের। দুনিয়াব্যাপী তৈরি হতে পারে এভাবে খাদ্যহীনতা। তো এই যে দেশের উপকূলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ঘূর্ণিঝড়ের প্রাবল্য, উত্তরাঞ্চলে দাবদাহ ও খরা এবং হাওরাঞ্চলে পাহাড়ি ঢলসহ গরম বাতাসের মতো নয়া সংকট। এসব কী বিপর্যস্ত জলবায়ুর স্বাস্থ্যহানির সংকেত। কিন্তু জলবায়ু বিপর্যয়ের এ সংকট কেন শুধু বাংলাদেশের কৃষককে সামাল দিতে হবে? এ সংকটের জন্য দায়ী সব ধনী দেশ ও বহুজাতিক কোম্পানিকে দায়বদ্ধ করতে হবে। ক্ষতিপূরণ এবং ঝুঁকি সামলে বাংলাদেশের কৃষকদের সক্ষমতা তৈরির জন্য তহবিল আদায়ে তাদের বাধ্য করতে হবে।
হিরাল আর চুরাকের কথা মনে আছে?
হাওরভাটি হলো গভীর পানির ধানের আঁতুড়ঘর। এমনকি এখানে চুরাক, সকালমুখী ও হাতীবান্ধার মতো ধানও আছে। বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টির ভেতরেও যে গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। শীষ থেকে ঝরে যায় না পুষ্ট দানা। কিন্তু আমরা হাওরাঞ্চলের স্থানীয় ধানকে গুরুত্ব দেইনি। তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে বোরো মৌসুম দেশের প্রধান কৃষি মৌসুম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি এ সময়টাতে বহুজাতিক কোম্পানিদের সার-বিষ-বীজের ব্যবসাও হয় বেশি। আর চাষ হয় শুধু ব্রিধান-২৮, ব্রি-ধান-২৯, বি-আর-১০ আর কিছু হাইব্রিড ধান। এসব ধান অল্প বাতাসেই ঝরে যায়, আবহাওয়ার সামান্যতম পরিবর্তনে মুষড়ে পড়ে। ধানের ক্ষেত্রে ফুল আসা থেকে দানার ভেতর দুধ তৈরি হওয়ার সময় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রির বেশি থাকলে ধান নষ্ট হয়ে যায়। চিটা হয়ে যায়। ঝলসে রঙ পরিবর্তিত হয়। জমির মাটিতে পর্যাপ্ত হিউমাস, আর্দ্রতা ও পানি থাকলে এই গরম আবহাওয়া থেকে কিছু রক্ষা পাওয়া যায়। হাওরাঞ্চলে এক সময় হিরালপ্রথা চালু ছিল। বিজ্ঞ হিরালেরা বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি থেকে হাওরের কৃষিজমি রক্ষা করতেন। জমি, বীজ, কৃষির সঙ্গে হাওরের তাই গড়ে ওঠেছে এমন সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সম্পর্ক। সাম্প্রতিক গরম বাতাসের আঘাতে নিঃস্ব হাওরের পাশে সত্যিকারভাবে দাঁড়াতে হলে হাওরবাসীর কৃষিচিন্তা ও কৃষিদর্শন আগলেই দাঁড়ানো দরকার।
[ লেখক : গবেষক ]
animistbangla@gmail.com