alt

উপ-সম্পাদকীয়

ভয়ংকর রূপে করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট

শফিকুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১
image

যখন কোন ভাইরাস একটি জনসংখ্যার মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ঘটায়, তখন ভাইরাসের মিউটেশনের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন বা ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বেশিরভাগ মিউটেশন ভাইরাসের সংক্রমণ ও রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। তবে ভাইরাসের জিনগত উপাদানগুলোর বা এমাইনো এসিড সিকুয়েন্সের পরিবর্তনগুলো কোথায় অবস্থিত তার ওপর নির্ভর করে নতুন সৃষ্ট ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হার বা সংক্রমণের তীব্রতা।

বর্তমানে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় পৌঁচেছে। ভারতে প্রতিদিন আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর মিছিল যেভাবে বেড়েই চলেছে, তাতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে এবং অক্সিজেনের তীব্র সংকট সৃষ্টির দরুন অনেক রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি হওয়ায় চিতায় দাহ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতে প্রতিদিন প্রায় ৩.৫ লাখের বেশি লোক করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, এমনকি গত ২৭ মে আক্রান্তের সংখ্যা ৩.৮৬ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বিশ্বে প্রতিদিনের মোট করোনা আক্রান্ত লোকসংখ্যার ২৫ শতাংশই ভারতে, যা প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এমনকি, ভারতে করোনার ডাবল মিউট্যান্ট আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই বর্তমানে ট্রিপল মিউট্যান্ট আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, যার চারদিকে সংক্রমণ করার ৩০০ গুণ ক্ষমতা রয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। অনেকের হয়ত প্রশ্ন থাকতে পারে, ভারতে শনাক্ত ডাবল বা ট্রিপল মিউট্যান্টি কী এবং এত ভয়ঙ্কর সংক্রমণাত্মক কেন?

সাধারণত করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট বলতে কভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন মিলে সৃষ্ট ১টি নতুন ভ্যারিয়েন্টকে বোঝায়। কিন্তু ভারতে করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট বলতে ৩টি উল্লেখযোগ্য মিউটেন্টের উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে, প্রকৃত অর্থে এটি ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট নয়, বরং এটি দক্ষিণ আফ্রিকার বি.১.৩৫১ ও ব্রাজিলের পি.১ ভ্যারিয়েন্ট দুটির একটি বিবর্তিত রূপ বা লিনিয়েজ।

কিছু কারণে করোনার ভারতীয় বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টটি ১৩টি মিউটেশন বহন করছে এবং এর স্পাইক প্রোটিনে ৬টি মিউটেশনের মধ্যে এ৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর নামক দুটি উদ্বেগ সৃষ্টিকারী মিউটেশন রয়েছে বলে এটিকে ‘দ্বৈত মিউট্যান্ট’ (ডাবল মিউট্যান্ট) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বি.১.৬১৭ ডাবল ভ্যারিয়েন্টে এ৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর মিউটেশন ছাড়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য মিউটেশন পি৬৮১আর এর উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ায় ভারতের স্বাস্থ্য বিভাগ বিবর্তিত বি.১.৬১৮ মিউট্যান্টিকে ট্রিপল মিউট্যান্ট বা বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট হিসাবে আখ্যায়িত করেছে এবং এটি ভারতের মহারাষ্ট্র, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ এবং ছত্তিশগড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক প্রমাণগুলো থেকে মনে করা হয়, এ৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর মিউটেশন দুটি পি৬৮১আর মিউটেশনের সহায়তায় বি.১.৬১৮ নামে ট্রিপল ভ্যারিয়েন্টকে আরও বেশি সংক্রমণাত্বক এবং দেহের এন্টিবডি বা টিকার প্রতি কম সংবেদনশীল করার পরামর্শ দেয়।

বি.১.৬১৮ মিউট্যান্টিতে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ই৪৪কিউ, এল৪৫২আর ও পি৬৮১আর মিউটেশনগুলো স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে রূপান্তর এনেছে, যার ফলে ভাইরাসটি মানদেহের কোষের সঙ্গে সহজেই বন্ধন সৃষ্টি করে খুব দ্রুতই সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ কারণেই স্পাইকে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটে সৃষ্ট এ ৩টি মিউটেশন ভাইরাসটিকে মানুষের ত্বকের কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই ভারতে করোনা সংক্রমণ লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে চলছে।

বি.১.৬১৮ মিউট্যান্টটের ই৪৮৪কিউ মিউট্যান্টি স্পাইক প্রোটিনের ৪৮৪ পজিশনে অবস্থিত এমাইনো এসিডের একটি রূপান্তর, যেখানে গ্লুটামিক অ্যাসিড রূপান্তরিত হয়েছে গ্লুটামিনে, যার ফলে ভাইরাসটি মানুষের ত্বকের কোষের এসিই-২ রিসেপ্টরের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে আমাদের ইমিউন (রোগ প্রতিরোধ) সিস্টেমকে এড়িয়ে যাওয়ার অনেক ক্ষমতা বি.১.৬১৮ কে প্রদান করে। আর, এল৪৫২আর মিউটেশনটি স্পাইক প্রোটিনের ৪৫২ পজিশনে লিউসিন অ্যামিনো অ্যাসিডটি আর্জিনিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ফলে মানব কোষের এসিই-২ রিসেপ্টারের জন্য স্পাইক প্রোটিনের দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করার ও দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে চলার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া, পি৬৮১আর মিউটেশনটি করোনা স্পাইকের ৬৮১ পজিশনে অবস্থিত এমাইনো এসিড প্রোলিন থেকে আর্জিনিনে রূপান্তর, যা মানব কোষের মধ্যে সংক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হয়।

ইতোমধ্যে ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট নামে আখ্যায়িত বি.১.৬১৮ ভ্যারিয়েন্টি বিশ্বের ২১টির ও বেশি দেশে ছটিয়ে পড়েছে। কাজেই, ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার কারণে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি বাংলাদেশও থাকার আশঙ্কা রয়েছে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হলে দেরি না করে দ্রুতই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। নয়ত ভারতের মতো বাংলাদেশেও একই অবস্থা হতে পারে। জিনোম সিকোয়েন্সির মাধ্যমে অধিক সংক্রমণাত্মক ভ্যারিয়েন্টগুলোর উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলে সবাই সতর্ক হবে।

ভারতের করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে, যা খুবই সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যেসব অবৈধ রাস্তাগুলো রয়েছে সেগুলো বন্ধ করাসহ নজরদারি জোরদার করা অতীব জরুরি। ভারত থেকে যারা দেশে ফিরবেন তাদের কয়েক দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থেকে করোনা টেস্ট শেষে করোনা নেগেটিভ সাপেক্ষে নিজ বাড়িতে বাকি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার শর্ত অব্যাহত রাখতে হবে।

তাছাড়া, যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আঘাত হানে তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে এমনটা ভেবেই সরকারকে কালক্ষেপণ না করে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে, করোনা রোগীর জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাসহ হাসপাতালে বেড সংখ্যা (আইসিউ সহ) কয়েক গুণ বাড়ানোর ব্যবস্থা করে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সচেতনতা সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণপূর্বক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানতে বাধ্য করতে হবে।

কাজেই, এসব ভয়ঙ্কর রূপের করোনার ভ্যারিয়েন্টগুলো থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারসহ সবাইকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলাসহ বদ্ধ রুমে বা পরিবেশে অবস্থান না করার অভ্যাস সবার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে, নয়ত টিকার মাধ্যমে সবার হার্ড ইমিউনিটি সৃষ্টি না করা পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ভয়ংকর রূপে করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট

শফিকুর রহমান

image

বৃহস্পতিবার, ০৬ মে ২০২১

যখন কোন ভাইরাস একটি জনসংখ্যার মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপকভাবে সংক্রমণ ঘটায়, তখন ভাইরাসের মিউটেশনের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন বা ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্টির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। বেশিরভাগ মিউটেশন ভাইরাসের সংক্রমণ ও রোগ সৃষ্টির ক্ষমতাকে খুব একটা প্রভাবিত করে না। তবে ভাইরাসের জিনগত উপাদানগুলোর বা এমাইনো এসিড সিকুয়েন্সের পরিবর্তনগুলো কোথায় অবস্থিত তার ওপর নির্ভর করে নতুন সৃষ্ট ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের হার বা সংক্রমণের তীব্রতা।

বর্তমানে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করলেও প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় পৌঁচেছে। ভারতে প্রতিদিন আক্রান্তের হার ও মৃত্যুর মিছিল যেভাবে বেড়েই চলেছে, তাতে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে এবং অক্সিজেনের তীব্র সংকট সৃষ্টির দরুন অনেক রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা এত বেশি হওয়ায় চিতায় দাহ করার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। ভারতে প্রতিদিন প্রায় ৩.৫ লাখের বেশি লোক করোনা আক্রান্ত হচ্ছে, এমনকি গত ২৭ মে আক্রান্তের সংখ্যা ৩.৮৬ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বিশ্বে প্রতিদিনের মোট করোনা আক্রান্ত লোকসংখ্যার ২৫ শতাংশই ভারতে, যা প্রতিবেশী দেশ হিসাবে বাংলাদেশে রীতিমতো আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এমনকি, ভারতে করোনার ডাবল মিউট্যান্ট আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই বর্তমানে ট্রিপল মিউট্যান্ট আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, যার চারদিকে সংক্রমণ করার ৩০০ গুণ ক্ষমতা রয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। অনেকের হয়ত প্রশ্ন থাকতে পারে, ভারতে শনাক্ত ডাবল বা ট্রিপল মিউট্যান্টি কী এবং এত ভয়ঙ্কর সংক্রমণাত্মক কেন?

সাধারণত করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট বলতে কভিড-১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন মিলে সৃষ্ট ১টি নতুন ভ্যারিয়েন্টকে বোঝায়। কিন্তু ভারতে করোনার ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট বলতে ৩টি উল্লেখযোগ্য মিউটেন্টের উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে, প্রকৃত অর্থে এটি ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্ট নয়, বরং এটি দক্ষিণ আফ্রিকার বি.১.৩৫১ ও ব্রাজিলের পি.১ ভ্যারিয়েন্ট দুটির একটি বিবর্তিত রূপ বা লিনিয়েজ।

কিছু কারণে করোনার ভারতীয় বি.১.৬১৭ ভ্যারিয়েন্টটি ১৩টি মিউটেশন বহন করছে এবং এর স্পাইক প্রোটিনে ৬টি মিউটেশনের মধ্যে এ৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর নামক দুটি উদ্বেগ সৃষ্টিকারী মিউটেশন রয়েছে বলে এটিকে ‘দ্বৈত মিউট্যান্ট’ (ডাবল মিউট্যান্ট) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে বি.১.৬১৭ ডাবল ভ্যারিয়েন্টে এ৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর মিউটেশন ছাড়াও আরেকটি উল্লেখযোগ্য মিউটেশন পি৬৮১আর এর উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ায় ভারতের স্বাস্থ্য বিভাগ বিবর্তিত বি.১.৬১৮ মিউট্যান্টিকে ট্রিপল মিউট্যান্ট বা বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট হিসাবে আখ্যায়িত করেছে এবং এটি ভারতের মহারাষ্ট্র, দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ এবং ছত্তিশগড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক প্রমাণগুলো থেকে মনে করা হয়, এ৪৮৪কিউ ও এল৪৫২আর মিউটেশন দুটি পি৬৮১আর মিউটেশনের সহায়তায় বি.১.৬১৮ নামে ট্রিপল ভ্যারিয়েন্টকে আরও বেশি সংক্রমণাত্বক এবং দেহের এন্টিবডি বা টিকার প্রতি কম সংবেদনশীল করার পরামর্শ দেয়।

বি.১.৬১৮ মিউট্যান্টিতে উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ই৪৪কিউ, এল৪৫২আর ও পি৬৮১আর মিউটেশনগুলো স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে রূপান্তর এনেছে, যার ফলে ভাইরাসটি মানদেহের কোষের সঙ্গে সহজেই বন্ধন সৃষ্টি করে খুব দ্রুতই সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এ কারণেই স্পাইকে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনের ফিউরিন ক্লিভেজ সাইটে সৃষ্ট এ ৩টি মিউটেশন ভাইরাসটিকে মানুষের ত্বকের কোষের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে বলেই ভারতে করোনা সংক্রমণ লাগামহীনভাবে বাড়িয়ে চলছে।

বি.১.৬১৮ মিউট্যান্টটের ই৪৮৪কিউ মিউট্যান্টি স্পাইক প্রোটিনের ৪৮৪ পজিশনে অবস্থিত এমাইনো এসিডের একটি রূপান্তর, যেখানে গ্লুটামিক অ্যাসিড রূপান্তরিত হয়েছে গ্লুটামিনে, যার ফলে ভাইরাসটি মানুষের ত্বকের কোষের এসিই-২ রিসেপ্টরের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে আমাদের ইমিউন (রোগ প্রতিরোধ) সিস্টেমকে এড়িয়ে যাওয়ার অনেক ক্ষমতা বি.১.৬১৮ কে প্রদান করে। আর, এল৪৫২আর মিউটেশনটি স্পাইক প্রোটিনের ৪৫২ পজিশনে লিউসিন অ্যামিনো অ্যাসিডটি আর্জিনিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ফলে মানব কোষের এসিই-২ রিসেপ্টারের জন্য স্পাইক প্রোটিনের দৃঢ় বন্ধন সৃষ্টি করার ও দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে চলার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া, পি৬৮১আর মিউটেশনটি করোনা স্পাইকের ৬৮১ পজিশনে অবস্থিত এমাইনো এসিড প্রোলিন থেকে আর্জিনিনে রূপান্তর, যা মানব কোষের মধ্যে সংক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে মনে করা হয়।

ইতোমধ্যে ভারতের ট্রিপল মিউট্যান্ট নামে আখ্যায়িত বি.১.৬১৮ ভ্যারিয়েন্টি বিশ্বের ২১টির ও বেশি দেশে ছটিয়ে পড়েছে। কাজেই, ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার কারণে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি বাংলাদেশও থাকার আশঙ্কা রয়েছে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হলে দেরি না করে দ্রুতই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। নয়ত ভারতের মতো বাংলাদেশেও একই অবস্থা হতে পারে। জিনোম সিকোয়েন্সির মাধ্যমে অধিক সংক্রমণাত্মক ভ্যারিয়েন্টগুলোর উপস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করলে সবাই সতর্ক হবে।

ভারতের করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলো যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে, যা খুবই সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যেসব অবৈধ রাস্তাগুলো রয়েছে সেগুলো বন্ধ করাসহ নজরদারি জোরদার করা অতীব জরুরি। ভারত থেকে যারা দেশে ফিরবেন তাদের কয়েক দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন থেকে করোনা টেস্ট শেষে করোনা নেগেটিভ সাপেক্ষে নিজ বাড়িতে বাকি ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করার শর্ত অব্যাহত রাখতে হবে।

তাছাড়া, যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আঘাত হানে তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে এমনটা ভেবেই সরকারকে কালক্ষেপণ না করে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে, করোনা রোগীর জন্য পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাসহ হাসপাতালে বেড সংখ্যা (আইসিউ সহ) কয়েক গুণ বাড়ানোর ব্যবস্থা করে আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সচেতনতা সৃষ্টির কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণপূর্বক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মানতে বাধ্য করতে হবে।

কাজেই, এসব ভয়ঙ্কর রূপের করোনার ভ্যারিয়েন্টগুলো থেকে নিজেকে ও নিজের পরিবারসহ সবাইকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, জনাকীর্ণ স্থান এড়িয়ে চলাসহ বদ্ধ রুমে বা পরিবেশে অবস্থান না করার অভ্যাস সবার মধ্যে গড়ে তুলতে হবে, নয়ত টিকার মাধ্যমে সবার হার্ড ইমিউনিটি সৃষ্টি না করা পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

[লেখক : অধ্যাপক, মাইক্রোবয়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top