alt

উপ-সম্পাদকীয়

উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

: রোববার, ১৮ জুলাই ২০২১

উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট নতুন কিছু নয়। এটা বছরের পর ধরেই বিভিন্ন সরকারের সময়ে চলে আসছে। আর্থিক লুটপাটের বড় সমস্যা হলো যে, পরিকল্পনা কমিশন বা সংশ্লিটরা প্রকল্পের মেয়াদকাল ঠিক করলেও যথাসময়ে আর শেষ হয় না। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে যায় কিন্তু প্রকল্পের কাজ অর্ধেকও শেষ হয় না। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় আর প্রকল্পের খরচ বাড়ছে। নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক উন্নয়নের (এডিপির) শতভাগ সম্পূর্ণ হয়েছে- এমন কোন নজির নেই। কোন কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পের কাজ বছর শেষে ১০ ভাগও শেষ হয় না।

গ্রামের ছোট্ট একটা প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। সংবাদমাধ্যমে ছবিতে দেখা যায় যে, সেতু আছে কিন্তু সড়ক নেই। আবার কাজ শেষ হতে না হতেই সেতু বা ভবন ভেঙে পড়েছে। আর কোন ভবন বা সেতু নির্মাণে নিম্নমানে সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভাষায় ‘রডের বদলে বাঁশ দেইনাযে’।

প্রকল্পে নিম্নমানের ইট, পাথর, সিমেন্ট, বালু ইত্যাতি সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। টাকা যায় সরকারের, অর্থাৎ জনগণের। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়ম আর যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় দাতা দেশ বা সংস্থা এখন আর প্রকল্পে ঋণ দিতে চায় না। আবার দিলেও তাদের মনোনীত পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এতে বাড়ে নানা জটিলতা। আরেক সমস্যা হচ্ছে যে, বড় বা মেগা প্রকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে ভবিষ্যতের কথা তেমন একটা ভাবা হয় না। আদৌ প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা কতটুকু যৌক্তিক, এর ভবিষ্যৎ কী হবে- এসব ভাবনার কোন প্রয়োজন মনে না করেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যেমন সম্প্রতি ১০টি বড় ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারের ‘ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়া মাস্টারপ্ল্যানে’ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক পর্যায়ে পুনঃনির্ধারণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্যারিস এগ্রিমেন্টে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করায় এবং প্রধানমন্ত্রী ক্লাইমেট তালনারেবল ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালের পর দেশে যে ১৮টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন পায়, তারই ১০ প্রকল্প বাতিল করা হলো। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেছেন যে, এসব প্রকল্পের কাজ থমকে থাকায় বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছিল। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণকালে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে নানা কথাও উঠেছিল। কথা উঠেছিল পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়েও।

কিন্তু তখন সেসব কথা সরকার আমলে নেয়নি। বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস এক প্রতিবেদনে আশঙ্কাজনক এক খবর দিয়েছিল। তারা বলেছিল, বাংলাদেশের মহেশপুর উপজেলার মাতাবাড়িতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে পরবর্তী ৩০ বছরে শুধু ওই অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ আর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ১৪ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হবে। আরো বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ খাতে মহাপরিকল্পনায় যে খসড়া করেছে, সেখানে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে এরকম কয়লাভিত্তিক মোট ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। শুধু কয়লা পুড়িয়েই ওই সময়ের মধ্যে সরকার ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। বিশ্ব যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে, তখন পরিবেশ দূষণের এই ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। কয়লা আমদানি করে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালাতে সরকারকে অনেক খেসারত দিতে হতে পারে।

গ্রিনপিস এক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জি-৭ ভুক্ত দেশ জাপান বর্তমানে মোট ১৭টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন করেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত জাপান বিনিয়োগ করেছে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চলাকালে ৩০ বছরে পরিবেশ দূষণের কারণে ওই অঞ্চলে ৪ লাখ ১০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাতাবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু থাকলে আগামী ৩০ বছরে ওই অঞ্চলে ১০ হাজার, ভারতে ১ লাখ ৬০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ৭২ হাজার ও ভিয়েনামে অকালে মৃত্যুর শিকার হবে ৩৬ হাজার মানুষের।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসছে। কাজেই এসব বিষয় চিন্তা করেই বাংলাদেশকে বিদ্যুৎভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল। এই তো গেল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা। বড় সমস্যা হচ্ছে যে, কোন প্রকল্প গ্রহণকালে এর ভবিষ্যতের কথা কমই চিন্তা-ভাবনা করা হয়। হুট করে প্রকল্প গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত সরে আসতে হয়। অপরদিকে একেকটি প্রকল্প বছরের পর বছর চলতে থাকে, সময়মতো শেষ হয় না, খরচ বাড়তেই থাকে। আর সেই সঙ্গে আর্থিক লুটপাট তো আছেই। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও মাতাবাড়ির মতো বড় প্রকল্পেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও খেয়াল খুশিমতো অর্থব্যয়ের ঘটনাসহ ১০ ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সর্বশেষ সমাপ্ত প্রকল্পের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অবশ্য এসব দুর্নীতির বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব প্রকল্পের প্রতিবেদন যখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, সেগুলোতেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য এ বিষয়ে এখন তদন্তও চলছে। যেকোন প্রকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে এর ভবিষ্যৎ ভালোমন্দ বিষয়ে চিন্তা করা দরকার। অনেক সময় দেখা যায় যে, কোন একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলো, কাজও চলছে, অর্থও ব্যয় হয়েছে। হঠাৎ সেই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল। আবার দেখা যায়, অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয় যা অসম্পূর্ণ। যেমন- গ্রামে একটি ছোট সেতু করা হলো কিন্তু রাস্তা করা হলো না। তাহলে সেতুটির প্রয়োজন কী ছিল? কাজেই ছোট-বড় যাই হোক, কোন প্রকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে এর ভবিষ্যৎ পরিণতি আর দুর্নীতির বিষয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট]

আবিষ্কারমূলক শিখন পদ্ধতি

টেকসই কৃষিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা

ছবি

জয়নুলের সাঁওতাল দম্পতি এবং সুমনের সৌন্দর্যপ্রিয়তা

এরপরও কি গাছ লাগাবেন না, বন রক্ষা করবেন না?

বিশ্ব ধরিত্রী দিবস

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়

খুব জানতে ইচ্ছে করে

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট?

কৃষিগুচ্ছ : ভর্তির আবেদনের নূ্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্তুতিতে বৈষম্য

ছবি

গণপরিবহনে নৈরাজ্যের শেষ কোথায়

ছাত্র রাজনীতি : পক্ষে-বিপক্ষে

ছবি

বি আর আম্বেদকর : নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধি

চেকের মামলায় আসামির মুক্তির পথ কী

রাম-নবমী : হিন্দুত্বের নয়া গবেষণাগার

‘একটি গ্রাম একটি পণ্য’ উদ্যোগ কি সফল হবে

কিশোর গ্যাং : সমস্যার মূলে যেতে হবে

গীতি চলচ্চিত্র ‘কাজল রেখা’ : সুস্থধারার চলচ্চিত্র বিকাশ ঘটুক

ছবি

ঋতুভিত্তিক চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

tab

উপ-সম্পাদকীয়

উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি

এসএম জাহাঙ্গীর আলম

রোববার, ১৮ জুলাই ২০২১

উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট নতুন কিছু নয়। এটা বছরের পর ধরেই বিভিন্ন সরকারের সময়ে চলে আসছে। আর্থিক লুটপাটের বড় সমস্যা হলো যে, পরিকল্পনা কমিশন বা সংশ্লিটরা প্রকল্পের মেয়াদকাল ঠিক করলেও যথাসময়ে আর শেষ হয় না। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে যায় কিন্তু প্রকল্পের কাজ অর্ধেকও শেষ হয় না। দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয় আর প্রকল্পের খরচ বাড়ছে। নির্ধারিত সময়ে বার্ষিক উন্নয়নের (এডিপির) শতভাগ সম্পূর্ণ হয়েছে- এমন কোন নজির নেই। কোন কোন মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রকল্পের কাজ বছর শেষে ১০ ভাগও শেষ হয় না।

গ্রামের ছোট্ট একটা প্রকল্পের কথাই ধরা যাক। সংবাদমাধ্যমে ছবিতে দেখা যায় যে, সেতু আছে কিন্তু সড়ক নেই। আবার কাজ শেষ হতে না হতেই সেতু বা ভবন ভেঙে পড়েছে। আর কোন ভবন বা সেতু নির্মাণে নিম্নমানে সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ভাষায় ‘রডের বদলে বাঁশ দেইনাযে’।

প্রকল্পে নিম্নমানের ইট, পাথর, সিমেন্ট, বালু ইত্যাতি সামগ্রী ব্যবহার করা হয়। টাকা যায় সরকারের, অর্থাৎ জনগণের। বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়ম আর যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় দাতা দেশ বা সংস্থা এখন আর প্রকল্পে ঋণ দিতে চায় না। আবার দিলেও তাদের মনোনীত পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। এতে বাড়ে নানা জটিলতা। আরেক সমস্যা হচ্ছে যে, বড় বা মেগা প্রকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে ভবিষ্যতের কথা তেমন একটা ভাবা হয় না। আদৌ প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা কতটুকু যৌক্তিক, এর ভবিষ্যৎ কী হবে- এসব ভাবনার কোন প্রয়োজন মনে না করেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যেমন সম্প্রতি ১০টি বড় ধরনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারের ‘ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়া মাস্টারপ্ল্যানে’ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক পর্যায়ে পুনঃনির্ধারণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া প্যারিস এগ্রিমেন্টে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করায় এবং প্রধানমন্ত্রী ক্লাইমেট তালনারেবল ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। ২০০৮ সালের পর দেশে যে ১৮টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদন পায়, তারই ১০ প্রকল্প বাতিল করা হলো। প্রতিমন্ত্রী আরো বলেছেন যে, এসব প্রকল্পের কাজ থমকে থাকায় বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছিল। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণকালে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে নানা কথাও উঠেছিল। কথা উঠেছিল পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়েও।

কিন্তু তখন সেসব কথা সরকার আমলে নেয়নি। বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস এক প্রতিবেদনে আশঙ্কাজনক এক খবর দিয়েছিল। তারা বলেছিল, বাংলাদেশের মহেশপুর উপজেলার মাতাবাড়িতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে পরবর্তী ৩০ বছরে শুধু ওই অঞ্চলে পরিবেশ দূষণ আর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে ১৪ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু হবে। আরো বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ খাতে মহাপরিকল্পনায় যে খসড়া করেছে, সেখানে আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে এরকম কয়লাভিত্তিক মোট ২৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। শুধু কয়লা পুড়িয়েই ওই সময়ের মধ্যে সরকার ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায়। বিশ্ব যখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরে আসছে, তখন পরিবেশ দূষণের এই ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। কয়লা আমদানি করে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালাতে সরকারকে অনেক খেসারত দিতে হতে পারে।

গ্রিনপিস এক প্রতিবেদনে বলেছিল, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জি-৭ ভুক্ত দেশ জাপান বর্তমানে মোট ১৭টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অর্থায়ন করেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত জাপান বিনিয়োগ করেছে ১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চলাকালে ৩০ বছরে পরিবেশ দূষণের কারণে ওই অঞ্চলে ৪ লাখ ১০ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাতাবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু থাকলে আগামী ৩০ বছরে ওই অঞ্চলে ১০ হাজার, ভারতে ১ লাখ ৬০ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ৭২ হাজার ও ভিয়েনামে অকালে মৃত্যুর শিকার হবে ৩৬ হাজার মানুষের।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসছে। কাজেই এসব বিষয় চিন্তা করেই বাংলাদেশকে বিদ্যুৎভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল। এই তো গেল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা। বড় সমস্যা হচ্ছে যে, কোন প্রকল্প গ্রহণকালে এর ভবিষ্যতের কথা কমই চিন্তা-ভাবনা করা হয়। হুট করে প্রকল্প গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত সরে আসতে হয়। অপরদিকে একেকটি প্রকল্প বছরের পর বছর চলতে থাকে, সময়মতো শেষ হয় না, খরচ বাড়তেই থাকে। আর সেই সঙ্গে আর্থিক লুটপাট তো আছেই। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও মাতাবাড়ির মতো বড় প্রকল্পেও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় ৮শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত ১৫টি উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও খেয়াল খুশিমতো অর্থব্যয়ের ঘটনাসহ ১০ ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের সর্বশেষ সমাপ্ত প্রকল্পের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

অবশ্য এসব দুর্নীতির বিষয়ে পরিকল্পনা সচিব একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এসব প্রকল্পের প্রতিবেদন যখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যায়, তখন তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে। মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রী গরিব মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন, সেগুলোতেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অবশ্য এ বিষয়ে এখন তদন্তও চলছে। যেকোন প্রকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে এর ভবিষ্যৎ ভালোমন্দ বিষয়ে চিন্তা করা দরকার। অনেক সময় দেখা যায় যে, কোন একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলো, কাজও চলছে, অর্থও ব্যয় হয়েছে। হঠাৎ সেই প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল। আবার দেখা যায়, অনেক প্রকল্প গ্রহণ করা হয় যা অসম্পূর্ণ। যেমন- গ্রামে একটি ছোট সেতু করা হলো কিন্তু রাস্তা করা হলো না। তাহলে সেতুটির প্রয়োজন কী ছিল? কাজেই ছোট-বড় যাই হোক, কোন প্রকল্প গ্রহণ করতে গিয়ে এর ভবিষ্যৎ পরিণতি আর দুর্নীতির বিষয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

[লেখক : সাবেক কর কমিশনার; পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট]

back to top