জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ফেনী জেলার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় আমার বাবা ১৯২৪ সনে এন্ট্রান্স পাস করেই ১৯২৬ সনে স্থানীয় জমিদারদের দেয়া জমিতে এলকাবাসীর সহযোগিতায় জিএমহাট মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমার আব্বার একটি গ্রামোফোন বা কলেরগান ছিল, আমি শিশু বয়স থেকেই কলেরগানের পাশে বসে আব্বাস উদ্দিন, কে এল সয়গল, মুহাম্মদ রফি, সামসাদ বেগম, লতা মুঙ্গেশকর, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ফিরোজা বেগম, শচীন দেব বর্মন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়সহ অনেকের গান শুনেছি। তখন শুধু গানই শুনেছি, শিল্পীদের কারও নাম জানতাম না। বড়ু চন্ডীদাসকে নিয়ে একটি নাটকের ১৬টি রেকওর্ড ছিল। আমার বাবার কলেরগানে যাদের গান শুনেছি তাদের একজনও আজ জীবিত নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালি নয়, সারা বিশ্বের সৃজনশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন এমন কয়েকজন বিদেশি কণ্ঠশিল্পীর কথা আজ বলব।
গত ৯ জানুয়ারি ৯২ বছর বয়সে কোভিড-পরবর্তী জটিলতার কারণে লতা মঙ্গেশকর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন, বাঙালি না হয়েও বাংলায় কালজয়ী অনেক গান করেছেন-সাত ভাই চম্পা জাগো রে, আকাশ প্রদীপ জ্বলে, আষাঢ় শ্রাবণ, না যেওনা, রঙ্গিলা বাঁশিতে, ও মোর ময়না গো, নিঝুম সন্ধ্যায়, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ইত্যাদি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শরণার্থীদের সহায়তা করার লক্ষ্যে তহবিল গঠনে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি অব মহারাষ্ট্র’ নামে একটি সংগঠন ভারতীয় অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে লতা মুঙ্গেশকরের কাছে চাঁদা চাইতে গেলে কোন প্রশ্ন না করেই তিনি এক লাখ টাকার একটি চেক লিখে দিয়েছিলেন; একাত্তরে এক লাখ টাকা অনেক বড় অনুদান। পরবর্তীতে লতা মঙ্গেশকর বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে এই সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে গান গাওয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরবর্তীতে মমতাজ আলীর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী এবং প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকার, মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী। এছাড়া নিজের গাওয়া কয়েকটি গানের রয়ালিটিও লতা মঙ্গেশকর লিখে দিয়েছিলেন ফান্ডের নামে; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এসব গান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ফান্ডে জমা হয়েছিল। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনেও অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় চলে গেলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি গায়িকা গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ শুধু গানের দিন, ঘুম ঘুম চাঁদ, জানি না ফুরাবে কবে, কে তুমি আমারে ডাকো, এই পথ যদি না শেষ হয়, তুমি না হয় রহিতে কাছে প্রভৃতি গান বাঙালি প্রবীণদের চিন্তায় ও মননে মিশেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে আগত লাখ লাখ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনিও গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’ গানটির কথা আমরা সবাই জানি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি গানটি প্রথম প্রচারিত হয় আকাশ বাণীতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানে আয়োজিত উন্মুক্ত কনসার্টে তিনি গান গেয়েছিলেন। একাত্তরে লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা ছাড়াও আশা ভোসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখ বাংলাদেশের জন্য সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই এবার না ফেরার পথে যাত্রা করলেন উপমহাদেশের আরেক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ি।
পন্ডিত রবিশঙ্কর তার গুরু আচার্য বাংলাদেশের আলাউদ্দীন খান সাহেবের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। আলাউদ্দীন খানকে রবিশঙ্কর ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভূমিকায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলাসহ ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে একাত্তরের ১ আগস্ট পন্ডিত রবিশঙ্কর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং বিশ্বখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে এই অনুষ্ঠানে গান গাইতে উদ্বুদ্ধ করেন। জর্জ হ্যারিসন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রতিভাবান জনপ্রিয় গায়ক। তিনি বিখ্যাত ব্যান্ড সংগীত দল দ্য বিটলসের চার সদস্যের একজন ছিলেন।
পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার মর্মস্তুদ কাহিনী এবং বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাদের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বড় আকর্ষণ বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন হলেও এই ঐতিহাসিক কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন সেতারসম্রাট রবিশঙ্কর, সরোদসম্রাট ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, তবলার কিংবদন্তি শিল্পী আল্লারাখা খাঁ, গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাটন এবং গান গাইলেন জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রিস্টন এবং বব ডিলান। জর্জ হ্যারিসনের লেখা ও সুর দেয়া ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানটি তার কণ্ঠে শোনার সময় এখনও আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের অম্লান স্মৃতি। গানটির কথার মাধ্যমে বিশ্বের সব মানুষকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘আই মি মাইন’ বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, ‘মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে’। হ্যারিসন ৫৮ বছর বয়সে ২০০১ সনে মৃত্যুবরণ করেন। সেতারবাদনে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত রবিশঙ্কর ২০১২ সনে পরলোকগমন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন পেশার, শ্রেণীর জনগণের অংশগ্রহণ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। একাত্তরে রক্তঝরা দিনগুলোতে অসংখ্য গান বাঙালি জাতির মুক্তিপাগল মানুষের মনে অফুরান প্রাণশক্তি জুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে গানের রচয়িতা, সুরকার, শিল্পীদের নাম চলে আসে। কলকাতার রামগড়ের পদ্মশ্রী সিনেমা হলের মুখোমুখি অবস্থিত একটি পুরনো চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে শুনতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের সাদা কাগজে একাত্তরের ১৩ এপ্রিলে লিখলেন-‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লাখো মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি...’। সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে হারমোনিয়াম দিয়ে গানটি গাইলেন অংশুমান রায়, শক্ত মলাটের একটি গানের খাতায় তবলা বাজালেন উপেন তরফদার। সে দিনই আকাশবাণীর সংবাদ বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে গানটি বাজানো হলো। তার লেখা ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি’- গানটি হেমন্ত মুখাপাধ্যায়ের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ইথারে ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করার সাহস শতগুণে বেড়ে গেল। গান দুটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই আজ জাবিত নেই।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লেখা কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, পথের ক্লান্তি ভুলে, অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়, যদি কাগজে লেখ নাম, দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বউ এনে দে, ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কেন দূরে থাকো শুধু আড়ালে রাখো, কে তুমি আমায় ডাকো, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে, আমি যামিনী তুমি শশী হে- ইত্যাদি গান আমাদের মতো প্রবীণেরা এখনো তন্ময় হয়ে শুনি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সনে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সনে কলকাতায় তার জীবনাবসান হয়।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যারা গানের একটি অতুলনীয় ভুবনের নির্মাণ করছিলেন তাদের বিদায় নেয়ার লম্বা সারির মধ্যে শেষ শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আমার বাবা মারা গেলেন ১৯৭৩ সনে, আমরা শিশু থেকে প্রবীণ হলাম, যাদের গান বাবার গ্রামোফোনে ষাট ও সত্তর দশকে শুনেছিলাম তারাও পরকালে পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু তাদের গান এখনো বুড়ো হয়নি। তবে শিগগিরই বুড়ো হয়ে যেতে পারে, কারণ আমাদের সন্তানেরা সুরেলা, সুমধুর ও সুললিত গানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আশঙ্কা করি, আমাদের যুগের বাংলা আধুনিক গান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ঐতিহাসিক যুগের গান হয়ে আর্কাইভে স্থান করে নেবে না তো!
যেসব বিদেশি শিল্পী গান গেয়ে, গান রচনা করে, সুর দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলাম তাদেরসহ সদ্য প্রয়াত তিন সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাপ্পি লাহিড়ির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছি।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২
ফেনী জেলার একটি প্রত্যন্ত এলাকায় আমার বাবা ১৯২৪ সনে এন্ট্রান্স পাস করেই ১৯২৬ সনে স্থানীয় জমিদারদের দেয়া জমিতে এলকাবাসীর সহযোগিতায় জিএমহাট মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমার আব্বার একটি গ্রামোফোন বা কলেরগান ছিল, আমি শিশু বয়স থেকেই কলেরগানের পাশে বসে আব্বাস উদ্দিন, কে এল সয়গল, মুহাম্মদ রফি, সামসাদ বেগম, লতা মুঙ্গেশকর, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ফিরোজা বেগম, শচীন দেব বর্মন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়সহ অনেকের গান শুনেছি। তখন শুধু গানই শুনেছি, শিল্পীদের কারও নাম জানতাম না। বড়ু চন্ডীদাসকে নিয়ে একটি নাটকের ১৬টি রেকওর্ড ছিল। আমার বাবার কলেরগানে যাদের গান শুনেছি তাদের একজনও আজ জীবিত নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালি নয়, সারা বিশ্বের সৃজনশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছেন এমন কয়েকজন বিদেশি কণ্ঠশিল্পীর কথা আজ বলব।
গত ৯ জানুয়ারি ৯২ বছর বয়সে কোভিড-পরবর্তী জটিলতার কারণে লতা মঙ্গেশকর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৩৬টি ভাষায় গান করেছেন, বাঙালি না হয়েও বাংলায় কালজয়ী অনেক গান করেছেন-সাত ভাই চম্পা জাগো রে, আকাশ প্রদীপ জ্বলে, আষাঢ় শ্রাবণ, না যেওনা, রঙ্গিলা বাঁশিতে, ও মোর ময়না গো, নিঝুম সন্ধ্যায়, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ইত্যাদি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শরণার্থীদের সহায়তা করার লক্ষ্যে তহবিল গঠনে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি অব মহারাষ্ট্র’ নামে একটি সংগঠন ভারতীয় অভিনেত্রী ওয়াহিদা রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল। এই সংগঠনের পক্ষ থেকে লতা মুঙ্গেশকরের কাছে চাঁদা চাইতে গেলে কোন প্রশ্ন না করেই তিনি এক লাখ টাকার একটি চেক লিখে দিয়েছিলেন; একাত্তরে এক লাখ টাকা অনেক বড় অনুদান। পরবর্তীতে লতা মঙ্গেশকর বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে এই সংগঠনের সঙ্গে যোগ দিয়ে অজন্তা শিল্পীগোষ্ঠীর সঙ্গে গান গাওয়ার জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরবর্তীতে মমতাজ আলীর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমার সংগীত পরিচালক ছিলেন সলিল চৌধুরী এবং প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন লতা মঙ্গেশকার, মান্না দে ও সবিতা চৌধুরী। এছাড়া নিজের গাওয়া কয়েকটি গানের রয়ালিটিও লতা মঙ্গেশকর লিখে দিয়েছিলেন ফান্ডের নামে; মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এসব গান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ফান্ডে জমা হয়েছিল। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপনেও অর্থ সাহায্য করেছিলেন।
১৫ ফেব্রুয়ারি ফাগুনের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় চলে গেলেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি গায়িকা গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এ শুধু গানের দিন, ঘুম ঘুম চাঁদ, জানি না ফুরাবে কবে, কে তুমি আমারে ডাকো, এই পথ যদি না শেষ হয়, তুমি না হয় রহিতে কাছে প্রভৃতি গান বাঙালি প্রবীণদের চিন্তায় ও মননে মিশেমিশে একাকার হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে আগত লাখ লাখ উদ্বাস্তুদের জন্য তিনিও গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির উপলক্ষে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’ গানটির কথা আমরা সবাই জানি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি গানটি প্রথম প্রচারিত হয় আকাশ বাণীতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকায় পল্টন ময়দানে আয়োজিত উন্মুক্ত কনসার্টে তিনি গান গেয়েছিলেন। একাত্তরে লতা মঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা ছাড়াও আশা ভোসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সলিল চৌধুরী প্রমুখ বাংলাদেশের জন্য সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। লতা মঙ্গেশকর ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে ওঠার আগেই এবার না ফেরার পথে যাত্রা করলেন উপমহাদেশের আরেক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী বাপ্পি লাহিড়ি।
পন্ডিত রবিশঙ্কর তার গুরু আচার্য বাংলাদেশের আলাউদ্দীন খান সাহেবের মেয়ে অন্নপূর্ণা দেবীকে বিয়ে করেন। আলাউদ্দীন খানকে রবিশঙ্কর ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভূমিকায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলাসহ ভারতে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে একাত্তরের ১ আগস্ট পন্ডিত রবিশঙ্কর এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং বিশ্বখ্যাত শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে এই অনুষ্ঠানে গান গাইতে উদ্বুদ্ধ করেন। জর্জ হ্যারিসন বিংশ শতাব্দীর একজন প্রতিভাবান জনপ্রিয় গায়ক। তিনি বিখ্যাত ব্যান্ড সংগীত দল দ্য বিটলসের চার সদস্যের একজন ছিলেন।
পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যার মর্মস্তুদ কাহিনী এবং বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাদের অন্তরকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের বড় আকর্ষণ বব ডিলান ও জর্জ হ্যারিসন হলেও এই ঐতিহাসিক কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন সেতারসম্রাট রবিশঙ্কর, সরোদসম্রাট ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, তবলার কিংবদন্তি শিল্পী আল্লারাখা খাঁ, গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাটন এবং গান গাইলেন জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রিস্টন এবং বব ডিলান। জর্জ হ্যারিসনের লেখা ও সুর দেয়া ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ গানটি তার কণ্ঠে শোনার সময় এখনও আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের অম্লান স্মৃতি। গানটির কথার মাধ্যমে বিশ্বের সব মানুষকে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘আই মি মাইন’ বইয়ে জর্জ হ্যারিসন লিখেছেন, ‘মোদ্দা কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ঘটনাবলির ব্যাপারে আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমরা যখন কনসার্টের প্রস্তুতি নিচ্ছি, মার্কিনরা তখন পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মৃত্যু হচ্ছে’। হ্যারিসন ৫৮ বছর বয়সে ২০০১ সনে মৃত্যুবরণ করেন। সেতারবাদনে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত রবিশঙ্কর ২০১২ সনে পরলোকগমন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন পেশার, শ্রেণীর জনগণের অংশগ্রহণ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। একাত্তরে রক্তঝরা দিনগুলোতে অসংখ্য গান বাঙালি জাতির মুক্তিপাগল মানুষের মনে অফুরান প্রাণশক্তি জুগিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গানের সঙ্গে অনিবার্যভাবে গানের রচয়িতা, সুরকার, শিল্পীদের নাম চলে আসে। কলকাতার রামগড়ের পদ্মশ্রী সিনেমা হলের মুখোমুখি অবস্থিত একটি পুরনো চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়ার সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে শুনতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরের সাদা কাগজে একাত্তরের ১৩ এপ্রিলে লিখলেন-‘শোন একটি মুজিবুরের থেকে লাখো মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি...’। সঙ্গে সঙ্গে সুরারোপ করে হারমোনিয়াম দিয়ে গানটি গাইলেন অংশুমান রায়, শক্ত মলাটের একটি গানের খাতায় তবলা বাজালেন উপেন তরফদার। সে দিনই আকাশবাণীর সংবাদ বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ফাঁকে ফাঁকে গানটি বাজানো হলো। তার লেখা ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি’- গানটি হেমন্ত মুখাপাধ্যায়ের কণ্ঠে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ইথারে ছড়িয়ে পড়লে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করার সাহস শতগুণে বেড়ে গেল। গান দুটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই আজ জাবিত নেই।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লেখা কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, পথের ক্লান্তি ভুলে, অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে, নীড় ছোট ক্ষতি নেই আকাশ তো বড়, যদি কাগজে লেখ নাম, দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বউ এনে দে, ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে, এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে না তো মন, কেন দূরে থাকো শুধু আড়ালে রাখো, কে তুমি আমায় ডাকো, আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে, প্রেম একবার এসেছিল নীরবে, যদি হই চোরকাঁটা ওই শাড়ির ভাঁজে, আমি যামিনী তুমি শশী হে- ইত্যাদি গান আমাদের মতো প্রবীণেরা এখনো তন্ময় হয়ে শুনি। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ১৯২৫ সনে পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সনে কলকাতায় তার জীবনাবসান হয়।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যারা গানের একটি অতুলনীয় ভুবনের নির্মাণ করছিলেন তাদের বিদায় নেয়ার লম্বা সারির মধ্যে শেষ শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আমার বাবা মারা গেলেন ১৯৭৩ সনে, আমরা শিশু থেকে প্রবীণ হলাম, যাদের গান বাবার গ্রামোফোনে ষাট ও সত্তর দশকে শুনেছিলাম তারাও পরকালে পাড়ি দিয়েছেন, কিন্তু তাদের গান এখনো বুড়ো হয়নি। তবে শিগগিরই বুড়ো হয়ে যেতে পারে, কারণ আমাদের সন্তানেরা সুরেলা, সুমধুর ও সুললিত গানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাই আশঙ্কা করি, আমাদের যুগের বাংলা আধুনিক গান, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, লালনগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি ঐতিহাসিক যুগের গান হয়ে আর্কাইভে স্থান করে নেবে না তো!
যেসব বিদেশি শিল্পী গান গেয়ে, গান রচনা করে, সুর দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলাম তাদেরসহ সদ্য প্রয়াত তিন সংগীতশিল্পী লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও বাপ্পি লাহিড়ির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করছি।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]