জিয়াউদ্দীন আহমেদ
রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণকারী যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাভেলিং একজন টিকিট এগজামিনারকে (টিটিই) বরখাস্ত করা হলে মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠে। বিনা টিকিটে ভ্রমণকালীন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর তিন আত্মীয়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় দায়িত্বরত টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করে ফোনে অবহিত করা হয়। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের এক ছেলে ও দুই মামাতো ভাই ঢাকার পথে ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে গিয়ে টিকিট না পেয়ে তারা তাড়াহুড়া করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে উঠে যান। মন্ত্রীর আত্মীয়দের কথা অনুযায়ী টিটিই প্রতিজনের জন্য ৫০০ টাকা করে দাবি করেন, কিন্তু ১৫০০ টাকার রশিদ চাওয়ার পরই বিপত্তি ঘটে; রশিদ চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজনকে জরিমানাসহ ৩৬০০ টাকা করে দিতে হবে বলে টিটিই যাত্রী তিনজনকে অবহিত করেন। মনে হয় এই পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে উচ্চবাচ্য শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে টিটিইর বক্তব্য হচ্ছে, নন-এসি টিকিটের ভাড়া ৩৫০ টাকা করে নিয়ে তিনি গৃহীত টাকার রশিদ দিয়েছেন, তারা এসি কামরায় বসেই ঢাকায় এসেছেন, তাদের মধ্যে কোন উচ্চবাচ্য হয়নি।
পরস্পর বিরোধী অভিযোগ বিবেচনায় নেয়া হলে এই ঘটনায় অপরাধ ও অপরাধী নির্ধারণ করা একটু জটিল। এক সময় রেল ভ্রমণে অগ্রিম টিকিট দেয়া হতো না, স্টেশনে পৌঁছে টিকিট কাটতে হতো। টিকিট না কেটে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে বহুজনকে দেখেছি এবং এটা স্বাভাবিক বলেই বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানাসহ টিকিটের টাকা নিয়ে রশিদ দেয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। মন্ত্রীর তিন আত্মীয় প্রচলিত সুবিধা গ্রহণ করেছেন, এ ক্ষেত্রে তাদের কোন অপরাধ হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে ঘটনাটি এভাবে ঘটলে আমার কলাম লেখার প্রয়োজন হতো না। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় রেলে ভ্রমণ করছেন, ভাড়া না দেয়ার একটু দাম্ভিকতা থাকতেই পারে, তাই টিকিটের টাকা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হয়তো ক্ষেপে উঠেছিলেন। অন্যদিকে অধিকাংশ টিটিই ঘুষ খায়, ঘুষখোরের কাছে আত্মীয়-স্বজনেরও কোনো গুরুত্ব নেই। তবে ঘুষখোরও ক্ষমতাকে ভয় করে, এই টিটিই কেন ভয় করল না তা স্পষ্ট হচ্ছে না। এই টিটিইর বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। জানা যায়, যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য এই টিটিইকে পাকশী দপ্তরে একবার বুক-অফ করা হয়েছিল। ঘটনা ঘোলাটে হয়ে যাওয়ায় দুই তরফের লোকই সতর্ক হয়ে গেছেন, কে সত্য বলছে, আর কে মিথ্যা বলছে তা নিরূপণ করা কঠিন। তবে সাধারণ কোন নাগরিকের অভিযোগের ভিত্তিতে একজন সরকারি কর্মচারীকে এত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনার ঘটনা বাংলাদেশে একেবারেই বিরল। এই অসঙ্গতি বুঝতে পেরেই সম্ভবত সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন তার সঙ্গে বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই মর্মে উল্লেখ করে বিপদে পড়েছেন; কারণ তারা রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের ছেলে ও স্ত্রীর দুই মামাতো ভাই। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের শুধু একজন কর্মকর্তাই নই, ব্যাংকের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমাদের বিপক্ষ দলের নেতা নজরুল হক ছিলেন তৎকালীন গভর্নর খোরশেদ আলমের ফার্স্ট কাজিন, আমরা গভর্নরের কাছে লিখিত অভিযোগ করে জানালাম যে, নজরুল হক গভর্নরের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অফিসে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। গভর্নর আমাদের আবেদনের ওপর লিখলেন, ‘নজরুল হক যে আমার আত্মীয় তা আমি অস্বীকার করি না, তবে আমার নামে তার প্রভাব খাটানো অপরাধ, তদন্ত করে দ্রুত অবহিত করুন’। রেলমন্ত্রী বিষয়টিকে ঘোলাটে না করে এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন।
ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা পরিমাপের জন্য এই ঘটনাটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট টিকিট পরিদর্শক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে কোন ভুল বা অপরাধ করলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাৎক্ষণিক মোবাইল ফোনে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা প্রশাসনিক নিয়মনীতির বিরুদ্ধ, টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া-পদ্ধতি কিছুই মানা হয়নি। মন্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্যে একজন ঢাকা রেল স্টেশনে নেমে সংশ্লিষ্ট টিটিইর অসদাচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করলেও টিটিই বরখাস্ত হয়েছেন মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনের নির্দেশে। এটা খারাপ নজির, কারণ মন্ত্রীর স্ত্রী রেল মন্ত্রণালয়ের কোন কর্তৃপক্ষ নন। জ্ঞানহীন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা সাধারণত ‘ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে’; যিনি বরখাস্ত করেছেন তার হুঁশ ছিল না, তার ধারণা ছিল, যত তাড়াতাড়ি বরখাস্ত করা যায় তত তাড়াতাড়ি মন্ত্রীর স্ত্রী খুশি হবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেলমন্ত্রীকে তুলোধুনো করা হচ্ছে, এই মাধ্যমে আমরা যারা আছি তারা সবাই মনে হয় দেবতুল্য নিষ্পাপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা সবাই কট্টর সমালোচক- ঘুষের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ এই মাধ্যমে যারা আছি তারা সবাই সাধুসন্ত। বাংলাদেশে প্রায় ১০ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, এই ১০ কোটি লোক সৎ হলে দেশে দুর্নীতি আর ঘুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয় না; কারণ আমরা অন্যের অপরাধ দেখতে পেলেও নিজের অন্যায় কর্মকান্ডকে নিজস্ব যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে ন্যায়ের আবরণে আচ্ছাদিত করে থাকি।
ঘুষখোর এবং চোরও তাদের অভাবকে ঘুষ খাওয়া ও চুরির জন্য অপরিহার্য মনে করে থাকে। হাজী, ধার্মিক ও নীতিনিষ্ঠ এক ধনী লোককে আমি চিনতাম, তিনি এখন পরকালে। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করার চেষ্টা করতেন, ব্যাংকে টাকা রাখলেও তিনি ধর্মীয় কারণে সুদ গ্রহণ করতেন না, মসজিদ ও মাদরাসায় তিনি অকাতরে দান করতেন; কিন্তু ট্যাক্স দেয়ার ভয়ে ব্যবসার পুরো টাকা বিদেশ থেকে দেশে আনতেন না, ক্রীত জমি রেজিস্ট্রি করার সময় প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করতেন না, ব্যবসার খাতিরে তিনি দুই হাতে ঘুষ দিতেন। তিনি এত ধার্মিক ছিলেন যে, হজ করা তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। ধর্ম বিরোধী এতগুলো অপরাধ করে তিনি আবার সব অপরাধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতেন। ব্যবসার পুরো টাকা দেশে না আনার পক্ষে তার যুক্তি হচ্ছে, ব্যবসায়িক স্বার্থে বিদেশ ভ্রমণে একজন ব্যবসায়ীর জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার কোটা নির্ধারণ করা আছে তা কোনভাবেই পর্যাপ্ত নয়, কারণ এই টাকা শুধু ব্যবসার কাজে নয়, ঘুষের টাকা বিদেশে পরিশোধেও ব্যবহৃত হয়। এই ধার্মিক ব্যবসায়ীর স্পষ্ট উক্তি ছিল, ব্যবসা করতে হলে ঘুষ দিতেই হবে, ঘুষ না দিয়ে এ দেশে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তার মতে জমি রেজিস্ট্রির ফি অনেক বেশি এবং জমির প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করলেও ঘুষ দিতে হয় বিধায় তিনি প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করতেন না। তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময়ও ঘুষ দিতেন।
গত সপ্তাহে আমার প্রাক্তন এক সহকর্মী দিলকুশার ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে রেলমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করছিলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি একটি ব্যাংকের ম্যানেজারের কক্ষে প্রবেশ করে ম্যানেজারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ছিলাম’। পরিচয় পেয়ে ম্যানেজার খেদমত করার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন, পরিচয় পর্বে আরও জানা গেল তারা দুজন একই জেলার লোক। ম্যানেজার কাউন্টার থেকে একজন কর্মকর্তাকে ডেকে এনে আমার সহকর্মীর চট্টগ্রামে টাকা পাঠানোর সব বন্দোবস্ত নিমিষে করে দিলেন, আমার সহকর্মী একটি স্বাক্ষর দেয়া ছাড়া আর কিছুই করলেন না। এই যে স্বজনপ্রীতির কাজটি হলো তার পক্ষেও আমার সহকর্মীর যুক্তি ছিল, কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে করেনি। কারণ, আমিও বাংলাদেশ ব্যাংকে কোন কাজে গেলে এই সুবিধাটি নিয়ে থাকি।
প্রকৃতপক্ষে যাদের ক্ষমতা আছে তাদের কাজ এভাবেই হয়, আমজনতার মতো লাইনে দাঁড়াতে হয় না, যাদের ক্ষমতা নেই তারা ঘুষ দেন- দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমরা যারা সততার দাবিদার তারাও অনিয়মকে নিয়ম করে তুলছি। মতিঝিল, দিলকুশায় অফিসের লোকজন অফিস আওয়ারে প্রায় প্রতিদিন ফুটপাত থেকে বাজার করেন, এর পেছনেও সবার যুক্তি রয়েছে; তারা সকালে এসে রাতে ঘরে ফেরেন, বাজার করার লোক তো সরকার দেয়নি। যারা অফিসের পিয়ন এবং গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন তাদেরও অকাট্য যুক্তি রয়েছে। অফিশিয়াল কাজে রেলে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ দেখিয়ে টাকা নিয়েও অধিকাংশ লোক যাতায়াত করেন বাসে বা সুলভ বগিতে। এই অবৈধ কাজটি করার পেছনেও কর্মকর্তাদের অজগ্র যুক্তি রয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, থাকা-খাওয়ার জন্য যে টাকা দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়, প্রথম শ্রেণীতে তারা সত্ববান বিধায় ভ্রমণ না করেও বিল করে টাকা নেয়া বৈধ।
বাংলাদেশে রেলভ্রমণ জনপ্রিয় হলেও রেলের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অহর্নিশ উত্থাপিত হচ্ছে। রেলে স্বজনপ্রীতির ঘটনা আগেও ঘটেছে, আরও ঘটবে। শুধু রেলে নয়, সব প্রতিষ্ঠানেই স্বজনপ্রীতির চিত্র উলঙ্গভাবে পরিলক্ষিত হয়। কারণ আমাদের দেশে স্বজনপ্রীতি ঘৃণ্য অপরাধ নয়। কিন্তু স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে নীতিনিষ্ঠ কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তাকে নাজেহাল করা সুশাসনের পরিচায়ক নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সব সরকারের আমলেই চাকরি জীবনে যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মনীতি মেনে সততার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন তাদের অধিকাংশ দলীয় তন্ত্রমন্ত্রের অন্যায় চাপে চাকরি হারিয়েছেন বা চাকরি জীবনের পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া হোক, তা না হলে ক্ষমতাবান ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষমতার দম্ভ কমবে না, সরকারকে বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
 
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ১৪ মে ২০২২
রেলমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণকারী যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাভেলিং একজন টিকিট এগজামিনারকে (টিটিই) বরখাস্ত করা হলে মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠে। বিনা টিকিটে ভ্রমণকালীন রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর তিন আত্মীয়ের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় দায়িত্বরত টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করে ফোনে অবহিত করা হয়। রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের এক ছেলে ও দুই মামাতো ভাই ঢাকার পথে ঈশ্বরদী রেলস্টেশনে গিয়ে টিকিট না পেয়ে তারা তাড়াহুড়া করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে উঠে যান। মন্ত্রীর আত্মীয়দের কথা অনুযায়ী টিটিই প্রতিজনের জন্য ৫০০ টাকা করে দাবি করেন, কিন্তু ১৫০০ টাকার রশিদ চাওয়ার পরই বিপত্তি ঘটে; রশিদ চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজনকে জরিমানাসহ ৩৬০০ টাকা করে দিতে হবে বলে টিটিই যাত্রী তিনজনকে অবহিত করেন। মনে হয় এই পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে উচ্চবাচ্য শুরু হয়ে যায়। অন্যদিকে টিটিইর বক্তব্য হচ্ছে, নন-এসি টিকিটের ভাড়া ৩৫০ টাকা করে নিয়ে তিনি গৃহীত টাকার রশিদ দিয়েছেন, তারা এসি কামরায় বসেই ঢাকায় এসেছেন, তাদের মধ্যে কোন উচ্চবাচ্য হয়নি।
পরস্পর বিরোধী অভিযোগ বিবেচনায় নেয়া হলে এই ঘটনায় অপরাধ ও অপরাধী নির্ধারণ করা একটু জটিল। এক সময় রেল ভ্রমণে অগ্রিম টিকিট দেয়া হতো না, স্টেশনে পৌঁছে টিকিট কাটতে হতো। টিকিট না কেটে দৌড়ে ট্রেনে উঠতে বহুজনকে দেখেছি এবং এটা স্বাভাবিক বলেই বিনা টিকিটের যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানাসহ টিকিটের টাকা নিয়ে রশিদ দেয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে। মন্ত্রীর তিন আত্মীয় প্রচলিত সুবিধা গ্রহণ করেছেন, এ ক্ষেত্রে তাদের কোন অপরাধ হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে ঘটনাটি এভাবে ঘটলে আমার কলাম লেখার প্রয়োজন হতো না। রেলমন্ত্রীর আত্মীয় রেলে ভ্রমণ করছেন, ভাড়া না দেয়ার একটু দাম্ভিকতা থাকতেই পারে, তাই টিকিটের টাকা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা হয়তো ক্ষেপে উঠেছিলেন। অন্যদিকে অধিকাংশ টিটিই ঘুষ খায়, ঘুষখোরের কাছে আত্মীয়-স্বজনেরও কোনো গুরুত্ব নেই। তবে ঘুষখোরও ক্ষমতাকে ভয় করে, এই টিটিই কেন ভয় করল না তা স্পষ্ট হচ্ছে না। এই টিটিইর বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। জানা যায়, যাত্রীদের সঙ্গে অসদাচরণের জন্য এই টিটিইকে পাকশী দপ্তরে একবার বুক-অফ করা হয়েছিল। ঘটনা ঘোলাটে হয়ে যাওয়ায় দুই তরফের লোকই সতর্ক হয়ে গেছেন, কে সত্য বলছে, আর কে মিথ্যা বলছে তা নিরূপণ করা কঠিন। তবে সাধারণ কোন নাগরিকের অভিযোগের ভিত্তিতে একজন সরকারি কর্মচারীকে এত দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাস্তির আওতায় আনার ঘটনা বাংলাদেশে একেবারেই বিরল। এই অসঙ্গতি বুঝতে পেরেই সম্ভবত সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দ্রুত প্রত্যাহার করা হয়েছে।
মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন তার সঙ্গে বিনা টিকিটে ভ্রমণকারীদের আত্মীয়তার কোন সম্পর্ক নেই মর্মে উল্লেখ করে বিপদে পড়েছেন; কারণ তারা রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর বোনের ছেলে ও স্ত্রীর দুই মামাতো ভাই। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের শুধু একজন কর্মকর্তাই নই, ব্যাংকের বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমাদের বিপক্ষ দলের নেতা নজরুল হক ছিলেন তৎকালীন গভর্নর খোরশেদ আলমের ফার্স্ট কাজিন, আমরা গভর্নরের কাছে লিখিত অভিযোগ করে জানালাম যে, নজরুল হক গভর্নরের আত্মীয় পরিচয় দিয়ে অফিসে প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। গভর্নর আমাদের আবেদনের ওপর লিখলেন, ‘নজরুল হক যে আমার আত্মীয় তা আমি অস্বীকার করি না, তবে আমার নামে তার প্রভাব খাটানো অপরাধ, তদন্ত করে দ্রুত অবহিত করুন’। রেলমন্ত্রী বিষয়টিকে ঘোলাটে না করে এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারতেন।
ক্ষমতার অপব্যবহারের মাত্রা পরিমাপের জন্য এই ঘটনাটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সংশ্লিষ্ট টিকিট পরিদর্শক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনকালে কোন ভুল বা অপরাধ করলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাৎক্ষণিক মোবাইল ফোনে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা প্রশাসনিক নিয়মনীতির বিরুদ্ধ, টিটিইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া-পদ্ধতি কিছুই মানা হয়নি। মন্ত্রীর আত্মীয়দের মধ্যে একজন ঢাকা রেল স্টেশনে নেমে সংশ্লিষ্ট টিটিইর অসদাচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করলেও টিটিই বরখাস্ত হয়েছেন মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনের নির্দেশে। এটা খারাপ নজির, কারণ মন্ত্রীর স্ত্রী রেল মন্ত্রণালয়ের কোন কর্তৃপক্ষ নন। জ্ঞানহীন দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তারা সাধারণত ‘ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে’; যিনি বরখাস্ত করেছেন তার হুঁশ ছিল না, তার ধারণা ছিল, যত তাড়াতাড়ি বরখাস্ত করা যায় তত তাড়াতাড়ি মন্ত্রীর স্ত্রী খুশি হবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রেলমন্ত্রীকে তুলোধুনো করা হচ্ছে, এই মাধ্যমে আমরা যারা আছি তারা সবাই মনে হয় দেবতুল্য নিষ্পাপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা সবাই কট্টর সমালোচক- ঘুষের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ এই মাধ্যমে যারা আছি তারা সবাই সাধুসন্ত। বাংলাদেশে প্রায় ১০ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, এই ১০ কোটি লোক সৎ হলে দেশে দুর্নীতি আর ঘুষের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হয় না; কারণ আমরা অন্যের অপরাধ দেখতে পেলেও নিজের অন্যায় কর্মকান্ডকে নিজস্ব যুক্তির আলোকে ব্যাখ্যা দিয়ে ন্যায়ের আবরণে আচ্ছাদিত করে থাকি।
ঘুষখোর এবং চোরও তাদের অভাবকে ঘুষ খাওয়া ও চুরির জন্য অপরিহার্য মনে করে থাকে। হাজী, ধার্মিক ও নীতিনিষ্ঠ এক ধনী লোককে আমি চিনতাম, তিনি এখন পরকালে। তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে আদায় করার চেষ্টা করতেন, ব্যাংকে টাকা রাখলেও তিনি ধর্মীয় কারণে সুদ গ্রহণ করতেন না, মসজিদ ও মাদরাসায় তিনি অকাতরে দান করতেন; কিন্তু ট্যাক্স দেয়ার ভয়ে ব্যবসার পুরো টাকা বিদেশ থেকে দেশে আনতেন না, ক্রীত জমি রেজিস্ট্রি করার সময় প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করতেন না, ব্যবসার খাতিরে তিনি দুই হাতে ঘুষ দিতেন। তিনি এত ধার্মিক ছিলেন যে, হজ করা তার নেশায় পরিণত হয়েছিল। ধর্ম বিরোধী এতগুলো অপরাধ করে তিনি আবার সব অপরাধের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতেন। ব্যবসার পুরো টাকা দেশে না আনার পক্ষে তার যুক্তি হচ্ছে, ব্যবসায়িক স্বার্থে বিদেশ ভ্রমণে একজন ব্যবসায়ীর জন্য যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার কোটা নির্ধারণ করা আছে তা কোনভাবেই পর্যাপ্ত নয়, কারণ এই টাকা শুধু ব্যবসার কাজে নয়, ঘুষের টাকা বিদেশে পরিশোধেও ব্যবহৃত হয়। এই ধার্মিক ব্যবসায়ীর স্পষ্ট উক্তি ছিল, ব্যবসা করতে হলে ঘুষ দিতেই হবে, ঘুষ না দিয়ে এ দেশে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। তার মতে জমি রেজিস্ট্রির ফি অনেক বেশি এবং জমির প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করলেও ঘুষ দিতে হয় বিধায় তিনি প্রকৃত মূল্য উল্লেখ করতেন না। তিনি আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময়ও ঘুষ দিতেন।
গত সপ্তাহে আমার প্রাক্তন এক সহকর্মী দিলকুশার ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে রেলমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করছিলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি একটি ব্যাংকের ম্যানেজারের কক্ষে প্রবেশ করে ম্যানেজারকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ছিলাম’। পরিচয় পেয়ে ম্যানেজার খেদমত করার জন্য অস্থির হয়ে গেলেন, পরিচয় পর্বে আরও জানা গেল তারা দুজন একই জেলার লোক। ম্যানেজার কাউন্টার থেকে একজন কর্মকর্তাকে ডেকে এনে আমার সহকর্মীর চট্টগ্রামে টাকা পাঠানোর সব বন্দোবস্ত নিমিষে করে দিলেন, আমার সহকর্মী একটি স্বাক্ষর দেয়া ছাড়া আর কিছুই করলেন না। এই যে স্বজনপ্রীতির কাজটি হলো তার পক্ষেও আমার সহকর্মীর যুক্তি ছিল, কিন্তু আমার শুনতে ইচ্ছে করেনি। কারণ, আমিও বাংলাদেশ ব্যাংকে কোন কাজে গেলে এই সুবিধাটি নিয়ে থাকি।
প্রকৃতপক্ষে যাদের ক্ষমতা আছে তাদের কাজ এভাবেই হয়, আমজনতার মতো লাইনে দাঁড়াতে হয় না, যাদের ক্ষমতা নেই তারা ঘুষ দেন- দুটোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমরা যারা সততার দাবিদার তারাও অনিয়মকে নিয়ম করে তুলছি। মতিঝিল, দিলকুশায় অফিসের লোকজন অফিস আওয়ারে প্রায় প্রতিদিন ফুটপাত থেকে বাজার করেন, এর পেছনেও সবার যুক্তি রয়েছে; তারা সকালে এসে রাতে ঘরে ফেরেন, বাজার করার লোক তো সরকার দেয়নি। যারা অফিসের পিয়ন এবং গাড়ি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন তাদেরও অকাট্য যুক্তি রয়েছে। অফিশিয়াল কাজে রেলে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ দেখিয়ে টাকা নিয়েও অধিকাংশ লোক যাতায়াত করেন বাসে বা সুলভ বগিতে। এই অবৈধ কাজটি করার পেছনেও কর্মকর্তাদের অজগ্র যুক্তি রয়েছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, থাকা-খাওয়ার জন্য যে টাকা দেয়া হয় তা পর্যাপ্ত নয়, প্রথম শ্রেণীতে তারা সত্ববান বিধায় ভ্রমণ না করেও বিল করে টাকা নেয়া বৈধ।
বাংলাদেশে রেলভ্রমণ জনপ্রিয় হলেও রেলের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার অভিযোগ অহর্নিশ উত্থাপিত হচ্ছে। রেলে স্বজনপ্রীতির ঘটনা আগেও ঘটেছে, আরও ঘটবে। শুধু রেলে নয়, সব প্রতিষ্ঠানেই স্বজনপ্রীতির চিত্র উলঙ্গভাবে পরিলক্ষিত হয়। কারণ আমাদের দেশে স্বজনপ্রীতি ঘৃণ্য অপরাধ নয়। কিন্তু স্বজনপ্রীতিকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে নীতিনিষ্ঠ কোন কর্মচারী বা কর্মকর্তাকে নাজেহাল করা সুশাসনের পরিচায়ক নয়। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, সব সরকারের আমলেই চাকরি জীবনে যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মনীতি মেনে সততার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন তাদের অধিকাংশ দলীয় তন্ত্রমন্ত্রের অন্যায় চাপে চাকরি হারিয়েছেন বা চাকরি জীবনের পদে পদে বঞ্চিত ও নিগৃহীত হয়েছেন। ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া হোক, তা না হলে ক্ষমতাবান ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের ক্ষমতার দম্ভ কমবে না, সরকারকে বারবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হবে।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
