মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান
২০১৯ সালের কোভিড অতিমারীর কারণে দেশে দেশে যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। কর্মহীন হয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষ। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু। যার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, উন্নয়ন কর্মকান্ডে আর মানবিক বিপর্যয়ে। বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তীব্র ভাবেই। সাম্প্রতিককালে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ায় অল্প কয় দিনের ব্যবধানে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বিষয়ের গভীরতা অনুধাবনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতিপয় নির্দশনাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সুস্পষ্ট সুপারিশমালা পণয়নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন এ জন্য যে অনাকাক্সিক্ষত কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়।
দেশের যে সব খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে তন্মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সন্তোষজনক রিজার্ভ এর পরিমাণ হঠাৎ করে নেমে যাওয়া, আশানুরূপ রেমিট্যান্স না আসা, ডলারের চাহিদা হঠাত বৃদ্ধি পাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ যদি সহসাই না থামে তবে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ তার আমদানি ব্যয় মেটাতে সমর্থ হবে না, বৈদেশিক ঋণের দায় মেটানো হয়ে পড়বে প্রায় অসম্ভব। জ্বালানি আর খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির উত্তাপ সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছড়াতে পারে, উদ্বেগটা এখানেই।
গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদশের সমষ্টিক অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। গত মার্চ মসে রপ্তানি আয় হয় ৪৭৬ কোটি ডলার এবং প্রবাসী আয় আসে ১৮৬ কোটি ডলার। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় মিলিয়ে মার্চে ৬৬২ কোটি ডলারের আয়ের বিপরীতে আমদানি দায় শোধ করতে হয় ৭১৪ কোটি ডলার। এর ফলে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫২ কোটি ডলার। তবে জুলাই-মার্চের হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ১৩০ কোটি ডলার আয় উদ্বৃত্ত আছে। আমদানি খরচ বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এ কারণে এই সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৫২০ কোটি ডলার, এতে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ ডলারের দাম বাড়ছে কেন এবং ঊর্ধ্বমুখী বিশ্ববাজার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখে দেশীয় বাজার সম্পর্কে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তথ্য উপাত্তভিত্তিক সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন সে বিষয়ে আমরা আশাবাদী। তবে এ ক্ষেত্রে যে সব উপাদান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তা সে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক, যে পর্যায়ের হোক না কেন বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আর্থিক ও রাজস্ব নীতিমালায় যে কোন পরিবর্তন কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে রিজার্ভ সুরক্ষায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ভালোমন্দ দিক।
করোনাকালে ভোগ্য দ্রব্য, শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি আমদানি সীমিত পর্যায়ে থাকায় রপ্তানি এবং প্রবাসী আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার খরচ সীমিত থাকায় রিজার্ভ এর মজুদ দাঁড়ায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি উত্তরণের পর সামগ্রিক উৎপাদনে গতিশীলতা আসবে, কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি পাবে, এক শ্রেণীর মানুষ বিদেশে বেড়াতে, চিকিৎসা করাতে এবং তাদের সন্তানদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া উৎসাহী হবে এবং যে কারণে স্বভাবিকভাবেই বৈদেশিক মুদ্রা খরচে চাপ পড়বে সেটা আমরা বিবেচনায় নিয়ে থাকলে রিজার্ভ সংকট এতটা তীব্র হতো কিনা সন্দেহ।
প্রবাসী আয়ে ২% প্রণোদনা দেয়ার পর বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসতে থাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে, কিন্তু সেই একই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হার হ্রাস পেয়েছে, এর কারণ বিশ্লেষণ জরুরি। বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে অবৈধ চ্যানেলে রেমিটান্স আসছে কেন সেটাও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে শুধু রাজস্বনীতির পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে কি না, ভেবে দেখতে হবে। আমদানির নামে ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ক্ষেত্রে আমাদের মুদ্রা নীতিতে কোন সমন্বিত নীতিমালা ছিল কি না, এলসি মার্জিন বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সামগ্রিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্থ হবে কি না, তা দেখা দরকার। এভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল উপাদান ও সমীকরণ বিবেচনায় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতি উত্তরণে একটি কার্যকর ও তথ্যভিত্তিক সুপারিশমালা পেশ করবেন বলে আশা করা যায়।
নতুন যে চ্যালঞ্জ আমাদের সামনে আসছে, তা হলো বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুতগতিতে, মূল্যস্ফীতি ঘটছে অপ্রতিহতভাবে। করোনা সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতায় প্রশংসা করেছিল বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। কিন্তু বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতি একটি বিপর্যয়কর অবস্থায় নিপতিত হবে বলে বিশ্ব সংস্থাসমূহও আশঙ্কা করছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যশস্য, জ্বালানি, নিত্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে এবং বহু মানুষ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে।
উল্লেখ্য ইতোমধ্যে সরকার অর্থনৈতিক ব্যয় সংকোচন, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আর্থিক নীতিমালায় যে সব সতর্ক পদক্ষেপে গ্রহণ করেছে তন্মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, দ্বিতীয়ত, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের নির্দেশনা জারি, তৃতীয়ত, সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পর এবার রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশ এবং চতুর্থত, বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র খোলার সময় এখন ৭৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম জমা এবং শিশুখাদ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, ওষুধ, কৃষি ও রপ্তানিমুখী শিল্প ছাড়া সব আমদানিতে ৫০ শতাংশ অর্থ আগে জমা দেয়া অন্যতম। নিতান্তই জরুরি প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার, ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধিকে নিরুৎসাহিত করণ ইতাদি।
গত ১৯ মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে জনসাধারণের কাছে পণ্য সরবরাহকারী অতিমুনাফা লোভী ব্যবসায়ী ও উৎপাদক গোষ্ঠীর অপতৎপরতার কারণে জনসাধারণের কাছে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ভোজ্যতেলের মজুদদারদের কারসাজির উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অতিরিক্ত টাকা ব্যয়ে ডলার ক্রয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
সর্বোপরি অর্থনৈতিক সুশাসন, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অর্থ পাচার রোধেও থাকতে হবে আইন ও তার কার্যকর প্রয়োগ। এভাবে বৈশ্বিক সংকট থেকে বাংলাদেশক নিরাপদ রাখতে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যে সুপারিশমালা প্রণীত হতে যাচ্ছে সেখানে যেমন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ মালা থাকবে তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উপাদানগুলোও সমভাবে বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক।
[লেখক : জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক]
মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান
রোববার, ২২ মে ২০২২
২০১৯ সালের কোভিড অতিমারীর কারণে দেশে দেশে যে তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার সৃষ্টি হয় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। কর্মহীন হয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষ। এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই গত ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু। যার প্রভাব পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, উন্নয়ন কর্মকান্ডে আর মানবিক বিপর্যয়ে। বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে তীব্র ভাবেই। সাম্প্রতিককালে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ায় অল্প কয় দিনের ব্যবধানে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। বিষয়ের গভীরতা অনুধাবনে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতিপয় নির্দশনাসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে সুস্পষ্ট সুপারিশমালা পণয়নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন এ জন্য যে অনাকাক্সিক্ষত কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়।
দেশের যে সব খাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে তন্মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার সন্তোষজনক রিজার্ভ এর পরিমাণ হঠাৎ করে নেমে যাওয়া, আশানুরূপ রেমিট্যান্স না আসা, ডলারের চাহিদা হঠাত বৃদ্ধি পাওয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ যদি সহসাই না থামে তবে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশ তার আমদানি ব্যয় মেটাতে সমর্থ হবে না, বৈদেশিক ঋণের দায় মেটানো হয়ে পড়বে প্রায় অসম্ভব। জ্বালানি আর খাদ্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির উত্তাপ সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছড়াতে পারে, উদ্বেগটা এখানেই।
গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বাংলাদশের সমষ্টিক অর্থনীতিতে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয় তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক। গত মার্চ মসে রপ্তানি আয় হয় ৪৭৬ কোটি ডলার এবং প্রবাসী আয় আসে ১৮৬ কোটি ডলার। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় মিলিয়ে মার্চে ৬৬২ কোটি ডলারের আয়ের বিপরীতে আমদানি দায় শোধ করতে হয় ৭১৪ কোটি ডলার। এর ফলে ঘাটতি দাঁড়ায় ৫২ কোটি ডলার। তবে জুলাই-মার্চের হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে ১৩০ কোটি ডলার আয় উদ্বৃত্ত আছে। আমদানি খরচ বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এ কারণে এই সময়ে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিক্রি করেছে ৫২০ কোটি ডলার, এতে রিজার্ভ কমে হয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার।
বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ ডলারের দাম বাড়ছে কেন এবং ঊর্ধ্বমুখী বিশ্ববাজার পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রেখে দেশীয় বাজার সম্পর্কে করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের তথ্য উপাত্তভিত্তিক সুপারিশমালা প্রণয়ন করবেন সে বিষয়ে আমরা আশাবাদী। তবে এ ক্ষেত্রে যে সব উপাদান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তা সে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক, যে পর্যায়ের হোক না কেন বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। আর্থিক ও রাজস্ব নীতিমালায় যে কোন পরিবর্তন কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। বিবেচনায় নিতে হবে রিজার্ভ সুরক্ষায় আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ভালোমন্দ দিক।
করোনাকালে ভোগ্য দ্রব্য, শিল্পের কাঁচামাল, জ্বালানি আমদানি সীমিত পর্যায়ে থাকায় রপ্তানি এবং প্রবাসী আয় থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার খরচ সীমিত থাকায় রিজার্ভ এর মজুদ দাঁড়ায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি উত্তরণের পর সামগ্রিক উৎপাদনে গতিশীলতা আসবে, কাঁচামাল আমদানি বৃদ্ধি পাবে, এক শ্রেণীর মানুষ বিদেশে বেড়াতে, চিকিৎসা করাতে এবং তাদের সন্তানদের বিদেশি প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া উৎসাহী হবে এবং যে কারণে স্বভাবিকভাবেই বৈদেশিক মুদ্রা খরচে চাপ পড়বে সেটা আমরা বিবেচনায় নিয়ে থাকলে রিজার্ভ সংকট এতটা তীব্র হতো কিনা সন্দেহ।
প্রবাসী আয়ে ২% প্রণোদনা দেয়ার পর বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসতে থাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে, কিন্তু সেই একই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এখন রেমিট্যান্স প্রাপ্তির হার হ্রাস পেয়েছে, এর কারণ বিশ্লেষণ জরুরি। বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে অবৈধ চ্যানেলে রেমিটান্স আসছে কেন সেটাও বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে শুধু রাজস্বনীতির পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে কি না, ভেবে দেখতে হবে। আমদানির নামে ওভার ইনভয়েস, আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ক্ষেত্রে আমাদের মুদ্রা নীতিতে কোন সমন্বিত নীতিমালা ছিল কি না, এলসি মার্জিন বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ সামগ্রিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্থ হবে কি না, তা দেখা দরকার। এভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল উপাদান ও সমীকরণ বিবেচনায় স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিস্থিতি উত্তরণে একটি কার্যকর ও তথ্যভিত্তিক সুপারিশমালা পেশ করবেন বলে আশা করা যায়।
নতুন যে চ্যালঞ্জ আমাদের সামনে আসছে, তা হলো বিশ্বব্যাপী খাদ্যশস্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দ্রুতগতিতে, মূল্যস্ফীতি ঘটছে অপ্রতিহতভাবে। করোনা সমস্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতায় প্রশংসা করেছিল বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। কিন্তু বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে অবস্থায় বিশ্ব অর্থনীতি একটি বিপর্যয়কর অবস্থায় নিপতিত হবে বলে বিশ্ব সংস্থাসমূহও আশঙ্কা করছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির কারণে খাদ্যশস্য, জ্বালানি, নিত্যপণ্যের ঘাটতি দেখা দেবে এবং বহু মানুষ খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে।
উল্লেখ্য ইতোমধ্যে সরকার অর্থনৈতিক ব্যয় সংকোচন, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও আর্থিক নীতিমালায় যে সব সতর্ক পদক্ষেপে গ্রহণ করেছে তন্মধ্যে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, দ্বিতীয়ত, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের নির্দেশনা জারি, তৃতীয়ত, সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের পর এবার রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের নির্দেশ এবং চতুর্থত, বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গাড়ি ও ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানির বিপরীতে ঋণপত্র খোলার সময় এখন ৭৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম জমা এবং শিশুখাদ্য, খাদ্যপণ্য, জ্বালানি, ওষুধ, কৃষি ও রপ্তানিমুখী শিল্প ছাড়া সব আমদানিতে ৫০ শতাংশ অর্থ আগে জমা দেয়া অন্যতম। নিতান্তই জরুরি প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার, ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধিকে নিরুৎসাহিত করণ ইতাদি।
গত ১৯ মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে জনসাধারণের কাছে পণ্য সরবরাহকারী অতিমুনাফা লোভী ব্যবসায়ী ও উৎপাদক গোষ্ঠীর অপতৎপরতার কারণে জনসাধারণের কাছে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে ভোজ্যতেলের মজুদদারদের কারসাজির উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অতিরিক্ত টাকা ব্যয়ে ডলার ক্রয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
সর্বোপরি অর্থনৈতিক সুশাসন, আইনের শাসন, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অর্থ পাচার রোধেও থাকতে হবে আইন ও তার কার্যকর প্রয়োগ। এভাবে বৈশ্বিক সংকট থেকে বাংলাদেশক নিরাপদ রাখতে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় যে সুপারিশমালা প্রণীত হতে যাচ্ছে সেখানে যেমন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ মালা থাকবে তেমনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উপাদানগুলোও সমভাবে বিবেচনায় নেয়া আবশ্যক।
[লেখক : জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের সাবেক পরিচালক]