ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল প্রথম পরীক্ষা। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি এবং সয স্টেকহোল্ডারদের কাছে আস্থা অর্জনের একটি দারুণ সুযোগ ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পূর্বের নির্বাচন কমিশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত সামান্য ভোটে জয়ী হয়েছেন। দুবারের নির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু পরাজিত হয়েছেন চারশ’র কম ভোটে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আরেক প্রার্থী নিজামুল হক কায়সারও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন। বিএনপির ভোট বিভক্ত হওয়ার কারণেই যে সাক্কু পরাজিত হয়েছেন-এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু যেভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তা ছিল অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাক্সিক্ষত। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছিল দীর্ঘদিন প্রকাশ্য বিভক্তি। আফজল খান আর বাহাউদ্দিন বিরোধ বহুবার আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি করেছে। প্রথম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিলেন আফজল খান। এ সময় আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী এক গ্রুপ মনিরুল হক সাক্কুকে প্রায় প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিলেন। আফজলকে হারানোর জন্যই তারা কাছে টেনে নিয়েছিলেন বিএনপির সাক্কুকে। দ্বিতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা। দলীয় বিরোধে ধরাশয়ী হন নৌকার প্রার্থী। আফজল খানের মৃত্যুর পর বাহাউদ্দিনের প্রভাব বাড়ে কুমিল্লায় এবং আওয়ামী লীগে। এবার মনোনয়ন পান বাহাউদ্দিনের আপন লোক আরফানুল হক রিফাত। রিফাত মনোনয়ন পাওয়ার পরপরই সাক্কুকে ছুড়ে ফেলে দেন বাহাউদ্দিন। শেষ পর্যন্ত এমপির আপন লোক জিতেছেন বটে, কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগের ক্ষতিই হয়েছে। একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন জিততে গিয়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিরোধী শিবিরে প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এ নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার দূরে থাকলেও আওয়ামী লীগ হয়তো বিজয়ী হতো।
দলে গণতন্ত্র থাকলে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রচলিত থাকলে সংসদ সদস্যের আচরণেরও জবাবদিহিতা থাকার কথা। কিন্তু স্থানীয় এমপির নির্বাচনী আচরণ বিধি অমান্যতা সাংবিধানিক সংস্থা ইসির প্রতি অবজ্ঞাই প্রদর্শিত হয়েছে। কারণ, হয়তো এটাই যে তিনি সরকারদলীয় এমপি এবং তিনি ইসির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে কার্পণ্য করেননি। সেই এমপি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাওয়ার পরও এলাকা ছেড়ে যাননি। এটাকে আইন অমান্য বলা যাবে কি না, তা নির্বাচন কমিশন ভালো বলতে পারবেন। পুলিশও তাকে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেনি। কারণ পুলিশ সরকারের অধীন, নির্বাচন কমিশনের নয়।
নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ প্রতিপালনই চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়ার কথা। তবে এ নির্বাচনের একটি ভালো দিক হলো প্রতিপক্ষের ওপর তেমন কোন হামলা বা পাল্টা হামলা হয়নি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সারাদিনে পরিবেশ ভালো থাকা সত্ত্বেও শেষ সময়ে এসে ফলাফল ঘোষণা নাকি কেন্দ্র স্থগিত এ বিষয়ে তুমুল সমালোচনা ও জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এ নির্বাচনটি হচ্ছে এমন এক সময় যখন বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানামুখী মেরুকরণ চলছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির ভূমিকা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অনেকেই বলছেন, যে নির্বাচন কমিশন একজন সংসদ সদস্যকেই সামাল দিতে পারে না সেই কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ সংসদ সদস্যকে সামলাবে কীভাবে?
কুসিক নির্বাচন জনগণের সামনে বাহ্যিক স্বচ্ছতা দেখিয়ে শেষ মহূর্তে ভোটের ফলাফল নিয়ে জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ সন্দেহ বা দ্বিধা নির্বাচন কমিশন কীভাবে এড়িয়ে যাবেন এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন সেটির জন্য আপামর জনসাধারণ ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। কুসিক নির্বাচনের কারণে ইসিসহ বিভিন্ন সংস্থার মুরাদনগর ইউপি নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি কম ছিল। ষষ্ঠ ধাপ ইউপি নির্বাচনে সব জায়গাতে ইসি সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেনি। তার একমাত্র কারণ জনবলের ঘাটতি। সঙ্গত কারণেই তাকে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ও অর্থের প্রলোভনে কতটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন বা পেরেছেন-বিভিন্ন জায়গায় সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। নির্বাচনে প্রার্থীদের অর্থ ব্যয় ও আচরণবিধি মানার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দৌরাত্ম্য চলে সেদিকটায় বোধ হয় নির্বাচন কমিশন কমই খোঁজখবর রাখেন।
কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দলীয় ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে দেয়া জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি খারাপ শিক্ষা দেয়া হয় বলে মনে হয়। এমনকি ছোট খাটো বিষয়ে এরকম নগ্ন হস্তক্ষেপে সরকারের বা ইসির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে হচ্ছে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]
ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
বুধবার, ২২ জুন ২০২২
নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল প্রথম পরীক্ষা। এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের কাছে নিজেদের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি এবং সয স্টেকহোল্ডারদের কাছে আস্থা অর্জনের একটি দারুণ সুযোগ ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সে কাজটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন পূর্বের নির্বাচন কমিশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। কুসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত সামান্য ভোটে জয়ী হয়েছেন। দুবারের নির্বাচিত মেয়র মনিরুল হক সাক্কু পরাজিত হয়েছেন চারশ’র কম ভোটে। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আরেক প্রার্থী নিজামুল হক কায়সারও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পেয়েছেন। বিএনপির ভোট বিভক্ত হওয়ার কারণেই যে সাক্কু পরাজিত হয়েছেন-এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু যেভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়ী হয়েছেন, তা ছিল অপ্রয়োজনীয় ও অনাকাক্সিক্ষত। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ছিল দীর্ঘদিন প্রকাশ্য বিভক্তি। আফজল খান আর বাহাউদ্দিন বিরোধ বহুবার আওয়ামী লীগের বড় ক্ষতি করেছে। প্রথম সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছিলেন আফজল খান। এ সময় আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহী এক গ্রুপ মনিরুল হক সাক্কুকে প্রায় প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিলেন। আফজলকে হারানোর জন্যই তারা কাছে টেনে নিয়েছিলেন বিএনপির সাক্কুকে। দ্বিতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা। দলীয় বিরোধে ধরাশয়ী হন নৌকার প্রার্থী। আফজল খানের মৃত্যুর পর বাহাউদ্দিনের প্রভাব বাড়ে কুমিল্লায় এবং আওয়ামী লীগে। এবার মনোনয়ন পান বাহাউদ্দিনের আপন লোক আরফানুল হক রিফাত। রিফাত মনোনয়ন পাওয়ার পরপরই সাক্কুকে ছুড়ে ফেলে দেন বাহাউদ্দিন। শেষ পর্যন্ত এমপির আপন লোক জিতেছেন বটে, কিন্তু তাতে আওয়ামী লীগের ক্ষতিই হয়েছে। একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন জিততে গিয়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিরোধী শিবিরে প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এ নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার দূরে থাকলেও আওয়ামী লীগ হয়তো বিজয়ী হতো।
দলে গণতন্ত্র থাকলে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রচলিত থাকলে সংসদ সদস্যের আচরণেরও জবাবদিহিতা থাকার কথা। কিন্তু স্থানীয় এমপির নির্বাচনী আচরণ বিধি অমান্যতা সাংবিধানিক সংস্থা ইসির প্রতি অবজ্ঞাই প্রদর্শিত হয়েছে। কারণ, হয়তো এটাই যে তিনি সরকারদলীয় এমপি এবং তিনি ইসির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে কার্পণ্য করেননি। সেই এমপি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাওয়ার পরও এলাকা ছেড়ে যাননি। এটাকে আইন অমান্য বলা যাবে কি না, তা নির্বাচন কমিশন ভালো বলতে পারবেন। পুলিশও তাকে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেনি। কারণ পুলিশ সরকারের অধীন, নির্বাচন কমিশনের নয়।
নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ প্রতিপালনই চূড়ান্ত বলে গণ্য হওয়ার কথা। তবে এ নির্বাচনের একটি ভালো দিক হলো প্রতিপক্ষের ওপর তেমন কোন হামলা বা পাল্টা হামলা হয়নি। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সারাদিনে পরিবেশ ভালো থাকা সত্ত্বেও শেষ সময়ে এসে ফলাফল ঘোষণা নাকি কেন্দ্র স্থগিত এ বিষয়ে তুমুল সমালোচনা ও জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। এ নির্বাচনটি হচ্ছে এমন এক সময় যখন বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানামুখী মেরুকরণ চলছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসির ভূমিকা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। অনেকেই বলছেন, যে নির্বাচন কমিশন একজন সংসদ সদস্যকেই সামাল দিতে পারে না সেই কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ সংসদ সদস্যকে সামলাবে কীভাবে?
কুসিক নির্বাচন জনগণের সামনে বাহ্যিক স্বচ্ছতা দেখিয়ে শেষ মহূর্তে ভোটের ফলাফল নিয়ে জনমনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এ সন্দেহ বা দ্বিধা নির্বাচন কমিশন কীভাবে এড়িয়ে যাবেন এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টিকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন সেটির জন্য আপামর জনসাধারণ ধোঁয়াশার মধ্যে আছে। কুসিক নির্বাচনের কারণে ইসিসহ বিভিন্ন সংস্থার মুরাদনগর ইউপি নির্বাচনের দিকে দৃষ্টি কম ছিল। ষষ্ঠ ধাপ ইউপি নির্বাচনে সব জায়গাতে ইসি সেভাবে মনোযোগ দিতে পারেনি। তার একমাত্র কারণ জনবলের ঘাটতি। সঙ্গত কারণেই তাকে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ও অর্থের প্রলোভনে কতটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারেন বা পেরেছেন-বিভিন্ন জায়গায় সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও তদন্তে তা বেরিয়ে আসবে। নির্বাচনে প্রার্থীদের অর্থ ব্যয় ও আচরণবিধি মানার ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দৌরাত্ম্য চলে সেদিকটায় বোধ হয় নির্বাচন কমিশন কমই খোঁজখবর রাখেন।
কোনো স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দলীয় ভাবমূর্তিকে নষ্ট করে দেয়া জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি খারাপ শিক্ষা দেয়া হয় বলে মনে হয়। এমনকি ছোট খাটো বিষয়ে এরকম নগ্ন হস্তক্ষেপে সরকারের বা ইসির ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে যায় বলে মনে হচ্ছে।
[লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি]