গৌতম রায়
সময়টা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। বাংলা সাহিত্যের ঝড়ের পাখি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সে সময়ের বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষিত ধরে সে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কথা বলছিলেন। তিনি বলেছিলেন; এই মুহূর্তেই হয়ত জামায়াত নির্বাচনী রাজনীতিতে খুব বড় একটা জায়গা করে নিতে পারবে না কিন্তু তারা যে সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক জীবনের ভেতরে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে, যাকে ইলিয়াস জামায়াতি সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেছিলেন সেই সংস্কৃতির দরুন আমাদের সমাজের সম্প্রদায় কি করন এবং মৌলবাদী করণ এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে, যার জেরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেটুকু আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত বর্তমান রয়েছে সেই চেতনা অচিরেই একটা বড় রকমের বিপদের সামনে পড়তে চলেছে এই জামায়াতি সংস্কৃতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কিছু সামাজিক ঘটনাক্রমের উদাহরণ ইলিয়াস দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন একজন নারী তিনি খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন পারিবারিক জমায়েতে তুমি খুব সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন তিনি আবার পহেলা ফাল্গুনের উৎসবে রমনার বটমূলে পান্তা ভাত খাচ্ছেন, শুঁটকি মাছ খাচ্ছেন তিনিই আবার টেলিভিশনে কোরআন তেলাওয়াত হলে মাথায় সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা দিয়ে নিচ্ছেন, আবার সেই ব্যক্তিটি পারিবারিক মজলিসে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার পর কোন ধর্মীয় প্রসঙ্গ আলোচিত হলে একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করছেন। এটাকেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই সময়ের প্রেক্ষিতে জামায়াতি সংস্কৃতি বলেছিলেন এবং এই জামায়াতি সংস্কৃতিতে অচিরে বাংলাদেশকে অতিক্রম করে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী একটা পরিবেশ রচনা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হবে তাকবিরে ইলিয়াসের কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সেই আশঙ্কা যে বর্ণে বর্ণে সত্য হয়ে উঠেছিল- পরবর্তীকালে বাংলাদেশে তা আমরা দেখেছি।
সেই জায়গা অতিক্রম করতে বাংলাদেশকে অনেক রক্ত আরো দিতে হয়েছে। গ্রেনেড হামলার মতো রক্তাক্ত হতে হয়েছে বাংলাদেশকে, যেখানে স্বয়ং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হয়েছিল।
এই পরিবেশটা এখন আমাদের গোটা ভারতজুড়ে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে বিদ্যমান। একটা সময় পর্যন্ত অনেকেরই আশঙ্কা ছিল যে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতে কোন অবস্থাতেই তার নখদন্ত বিস্তার করতে পারবে না। সেই আশঙ্কা বশবর্তী হয়ে অনেকেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিভিন্ন অপকর্ম ঘিরে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের আশঙ্কা বা বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী গুলিকে অনেক ক্ষেত্রেই উপহাস করেছে। এমনকি বামপন্থিরা যখন পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, সেই সময়কালে, একটা বড় অংশের বামপন্থীদের ভেতরেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি শেষ পর্যন্ত কোন মরণকামড় দিতে পারবে না- এমন একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা ছিল।
বামপন্থী শিবিরভুক্ত মানুষজন এবং প্রত্যক্ষভাবে দলীয় পরিমন্ডলে মধ্যে না থাকা মানুষজন, যারা নিবেদিত প্রাণ ধর্মনিরপেক্ষ, তারা যখন বারবার আরএসএস এবং তার বিভিন্ন ধরনের শাখা-প্রশাখা ঘিরে মানুষকে সচেতন করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তখন তাদের সেই সব প্রচেষ্টা গুলিকে রজ্জুতে সর্পভ্রম বলে উপহাস ও সে সময়ে বামপন্থী দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতাসীনদের ভেতরে অনেকেই করেছেন।
নয়ের দশকের শেষদিকে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক যে নীতিহীন সুবিধেবাদী জোট পর্যায়ক্রমে তিনবার, মোট প্রায় সাড়ে ছয় বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করেছিল, সেই পর্যায়ক্রম রচনার ক্ষেত্রে আরএসএসের যে সামাজিক ভূমিকা ছিল, তা আজ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই যে, ২০০৪ সালে যখন অটলবিহারি বাজপেয়ি কে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভবপর হয়েছিল, সংসদীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের স্বাধীন ভারতে প্রথম একটা অসামান্য সাফল্য এসেছিল, সেই সময় কালে কিন্তু কি কংগ্রেস, কি বামপন্থীদের একটা বড় অংশ মনে করে নিয়েছিল, বিজেপি আর মাথা তুলতে পারবে না।
ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষান সিং সুরজিত, জ্যোতি বসু প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা বয়সের কারণে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে পরিমন্ডল থেকে খানিকটা দূরে সরে যাওয়ার ফলে সেই সময় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেই শূন্যতা পূরণ করে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের রাজনৈতিক অভিষ্পা সম্পর্কে সঠিক পর্যবেক্ষণ করার মত মননশীলতার তখন অভাব ছিল।
হারকিষাণ সিং সুরজিতের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আগামী দিনটাকে বাস্তবে র মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতার একটা উদাহরণ উপস্থাপিত করলে এই শূন্যতার কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে এবং তার প্রেক্ষিতে আজকে গোটা ভারত কে কি মাশুল গুনতে হচ্ছে, তা অনেকটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে ।
মহম্মদ সেলিম প্রথম রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার পরে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ঘিরে পারস্পরিক আদান প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি সংগঠন তৈরির ভাবনা ভেবেছিলেন। সেই ভাবনার কথা যখন তিনি সুরজিতের সামনে উপস্থাপিত করেন, সুরজিত সেলিমকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, এমন সংগঠন করা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সেই সংগঠনের তুমি কোন পদাধিকারী থাকবে না । কারণ হিসেবে সুরজিত বলেছিলেন; তোমার নাম যেহেতু সেলিম, সেই কারণে, প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িক শিবির এই সংগঠনের উদ্দেশ্য কে বিকৃতভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করবে।
এই পর্যবেক্ষণ সুরজিত যখন সেলিমকে দিয়েছিলেন, তখন কিন্তু ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আজকের মতো এত জঘন্য হয়নি। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ তখনও বিদ্যমান ছিল। সংসদের ভিতরে ও বাইরে বামপন্থীদের শক্তির জায়গাটাও যথেষ্ট ছিল। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার তৈরির পর, আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নটাই অনেকটা প্রথম পর্যায়ে, শৌখিন মজুরির জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ, এই সময়টাকে কিন্তু আরএসএস ভারতীয় সমাজের বুকে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের মাহেন্দ্রক্ষণে হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা সংসদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র উপস্থিতির নিরিখে খানিকটা ধরে নিয়েছিলেন, রাজনৈতিকভাবে মমতা ক্ষমতা হীন হয়ে পড়ছেন। অথচ এই যে পাঁচটা বছর, অর্থাৎ; প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় কাল, বিশেষ করে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে সরকারের ওপর থেকে বামপন্থীরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ার পরের ছয় মাস, গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের শিবির কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে নিবিড় সামাজিক প্রযুক্তি চালিয়েছে, সে সম্পর্কে সঠিক পর্যবেক্ষণের অভাবের খেসারত আজকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নয়, গোটা ভারতের মানুষকেই দিয়ে চলতে হচ্ছে।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ২৫ জুন ২০২২
সময়টা নয়ের দশকের মাঝামাঝি। বাংলা সাহিত্যের ঝড়ের পাখি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সে সময়ের বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষিত ধরে সে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কথা বলছিলেন। তিনি বলেছিলেন; এই মুহূর্তেই হয়ত জামায়াত নির্বাচনী রাজনীতিতে খুব বড় একটা জায়গা করে নিতে পারবে না কিন্তু তারা যে সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক জীবনের ভেতরে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিচ্ছে, যাকে ইলিয়াস জামায়াতি সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেছিলেন সেই সংস্কৃতির দরুন আমাদের সমাজের সম্প্রদায় কি করন এবং মৌলবাদী করণ এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে, যার জেরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেটুকু আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত বর্তমান রয়েছে সেই চেতনা অচিরেই একটা বড় রকমের বিপদের সামনে পড়তে চলেছে এই জামায়াতি সংস্কৃতির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কিছু সামাজিক ঘটনাক্রমের উদাহরণ ইলিয়াস দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন একজন নারী তিনি খুব ভালো রবীন্দ্রসংগীত গাইতে পারেন পারিবারিক জমায়েতে তুমি খুব সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন তিনি আবার পহেলা ফাল্গুনের উৎসবে রমনার বটমূলে পান্তা ভাত খাচ্ছেন, শুঁটকি মাছ খাচ্ছেন তিনিই আবার টেলিভিশনে কোরআন তেলাওয়াত হলে মাথায় সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা দিয়ে নিচ্ছেন, আবার সেই ব্যক্তিটি পারিবারিক মজলিসে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার পর কোন ধর্মীয় প্রসঙ্গ আলোচিত হলে একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করছেন। এটাকেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সেই সময়ের প্রেক্ষিতে জামায়াতি সংস্কৃতি বলেছিলেন এবং এই জামায়াতি সংস্কৃতিতে অচিরে বাংলাদেশকে অতিক্রম করে গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী একটা পরিবেশ রচনা ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হবে তাকবিরে ইলিয়াসের কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সেই আশঙ্কা যে বর্ণে বর্ণে সত্য হয়ে উঠেছিল- পরবর্তীকালে বাংলাদেশে তা আমরা দেখেছি।
সেই জায়গা অতিক্রম করতে বাংলাদেশকে অনেক রক্ত আরো দিতে হয়েছে। গ্রেনেড হামলার মতো রক্তাক্ত হতে হয়েছে বাংলাদেশকে, যেখানে স্বয়ং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার মূর্ত প্রতীক শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র পর্যন্ত হয়েছিল।
এই পরিবেশটা এখন আমাদের গোটা ভারতজুড়ে ভয়ঙ্কর রকম ভাবে বিদ্যমান। একটা সময় পর্যন্ত অনেকেরই আশঙ্কা ছিল যে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতে কোন অবস্থাতেই তার নখদন্ত বিস্তার করতে পারবে না। সেই আশঙ্কা বশবর্তী হয়ে অনেকেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিভিন্ন অপকর্ম ঘিরে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের আশঙ্কা বা বিভিন্ন ধরনের সতর্কবাণী গুলিকে অনেক ক্ষেত্রেই উপহাস করেছে। এমনকি বামপন্থিরা যখন পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, সেই সময়কালে, একটা বড় অংশের বামপন্থীদের ভেতরেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি শেষ পর্যন্ত কোন মরণকামড় দিতে পারবে না- এমন একটা প্রচ্ছন্ন ধারণা ছিল।
বামপন্থী শিবিরভুক্ত মানুষজন এবং প্রত্যক্ষভাবে দলীয় পরিমন্ডলে মধ্যে না থাকা মানুষজন, যারা নিবেদিত প্রাণ ধর্মনিরপেক্ষ, তারা যখন বারবার আরএসএস এবং তার বিভিন্ন ধরনের শাখা-প্রশাখা ঘিরে মানুষকে সচেতন করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তখন তাদের সেই সব প্রচেষ্টা গুলিকে রজ্জুতে সর্পভ্রম বলে উপহাস ও সে সময়ে বামপন্থী দলগুলোর ভেতরে ক্ষমতাসীনদের ভেতরে অনেকেই করেছেন।
নয়ের দশকের শেষদিকে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ নামক যে নীতিহীন সুবিধেবাদী জোট পর্যায়ক্রমে তিনবার, মোট প্রায় সাড়ে ছয় বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করেছিল, সেই পর্যায়ক্রম রচনার ক্ষেত্রে আরএসএসের যে সামাজিক ভূমিকা ছিল, তা আজ অস্বীকার করার কোন উপায় নেই কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই যে, ২০০৪ সালে যখন অটলবিহারি বাজপেয়ি কে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভবপর হয়েছিল, সংসদীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের স্বাধীন ভারতে প্রথম একটা অসামান্য সাফল্য এসেছিল, সেই সময় কালে কিন্তু কি কংগ্রেস, কি বামপন্থীদের একটা বড় অংশ মনে করে নিয়েছিল, বিজেপি আর মাথা তুলতে পারবে না।
ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদ, হরকিষান সিং সুরজিত, জ্যোতি বসু প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরা বয়সের কারণে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে পরিমন্ডল থেকে খানিকটা দূরে সরে যাওয়ার ফলে সেই সময় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেই শূন্যতা পূরণ করে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের রাজনৈতিক অভিষ্পা সম্পর্কে সঠিক পর্যবেক্ষণ করার মত মননশীলতার তখন অভাব ছিল।
হারকিষাণ সিং সুরজিতের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং আগামী দিনটাকে বাস্তবে র মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখতে পাওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। সেই ক্ষমতার একটা উদাহরণ উপস্থাপিত করলে এই শূন্যতার কারণে ভারতীয় রাজনীতিতে কী ধরনের ক্ষতি হয়েছে এবং তার প্রেক্ষিতে আজকে গোটা ভারত কে কি মাশুল গুনতে হচ্ছে, তা অনেকটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে ।
মহম্মদ সেলিম প্রথম রাজ্যসভার সদস্য হওয়ার পরে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ঘিরে পারস্পরিক আদান প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি সংগঠন তৈরির ভাবনা ভেবেছিলেন। সেই ভাবনার কথা যখন তিনি সুরজিতের সামনে উপস্থাপিত করেন, সুরজিত সেলিমকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, এমন সংগঠন করা অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সেই সংগঠনের তুমি কোন পদাধিকারী থাকবে না । কারণ হিসেবে সুরজিত বলেছিলেন; তোমার নাম যেহেতু সেলিম, সেই কারণে, প্রথম থেকেই সাম্প্রদায়িক শিবির এই সংগঠনের উদ্দেশ্য কে বিকৃতভাবে মানুষের সামনে উপস্থাপিত করবার চেষ্টা করবে।
এই পর্যবেক্ষণ সুরজিত যখন সেলিমকে দিয়েছিলেন, তখন কিন্তু ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আজকের মতো এত জঘন্য হয়নি। ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ তখনও বিদ্যমান ছিল। সংসদের ভিতরে ও বাইরে বামপন্থীদের শক্তির জায়গাটাও যথেষ্ট ছিল। ২০০৪ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার তৈরির পর, আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নটাই অনেকটা প্রথম পর্যায়ে, শৌখিন মজুরির জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ, এই সময়টাকে কিন্তু আরএসএস ভারতীয় সমাজের বুকে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের মাহেন্দ্রক্ষণে হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন বামপন্থীরা সংসদে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র উপস্থিতির নিরিখে খানিকটা ধরে নিয়েছিলেন, রাজনৈতিকভাবে মমতা ক্ষমতা হীন হয়ে পড়ছেন। অথচ এই যে পাঁচটা বছর, অর্থাৎ; প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় কাল, বিশেষ করে পরমাণু চুক্তিকে কেন্দ্র করে সরকারের ওপর থেকে বামপন্থীরা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ার পরের ছয় মাস, গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের শিবির কীভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য, শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে নিবিড় সামাজিক প্রযুক্তি চালিয়েছে, সে সম্পর্কে সঠিক পর্যবেক্ষণের অভাবের খেসারত আজকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নয়, গোটা ভারতের মানুষকেই দিয়ে চলতে হচ্ছে।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]