alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য

: বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২

সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় সমাজের ভিত কেঁপে উঠেছে। নড়াইল ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে পুলিশের সামনে শত শত ছাত্র-জনতার উল্লসিত দর্শকের ডামাডোলে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে জুতার মালা পরিয়ে শোভাযাত্রা করানো হয়। এই ঘটনার ভিডিও করে ভাইরাল করা হয়। এ ছাড়া আশুলিয়া হাজি ইউনুস আলী কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে তারই ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু কলেজ ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্র-শিক্ষকের সামনে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পূর্বে মুন্সীগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মন্ডলকে ছাত্রদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে পড়ানোর সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। অতীতে নারায়নগঞ্জে পিয়ার সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান মিথ্যা অভিযোগে হাজার ছাত্র-জনতার সামনে কান ধরে উঠবস করান। আর লক্ষ্য করলে দেখা যায় অধিকাংস ঘটনাই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে লক্ষ্য করে সংঘটিত হচ্ছে। সার্বিক ভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেই চলছে। অনেক ঘটনা হয়তো লোক-লজ্জা বা প্রভাবশালী মহলের চাপে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না।

শিক্ষক হত্যা, লাঞ্ছনা ইত্যাদির প্রতিবাদে গতানুগতিকভাবে দেশব্যাপী প্রতিবাদ মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলে মনে হয় জাতির বিবেক জেগে উঠেছে। অপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ মুখর মানুষ ঘরে ফিরে যাবে না। প্রশাসনও ঘটনা খতিয়ে দেখছে বলে বার বার আশ্বস্ত করছে। সমানে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। কিন্তু নিহত শিক্ষক উৎপল সরকার তো আর ফিরে আসবেন না। চিরকালে জন্যে বৃদ্ধা মায়ের বুক খালি করে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। যে শিক্ষককে জনসমক্ষে জুতার মালা পরানো হলো, বিনা অপরাধে মিথ্যা অভিযোগে যে হৃদয় মন্ডলকে জেলে পাঠানো হল, যে বেচারা প্রধান শিক্ষককে এমপি সাহেব ছাত্রদের সামনে কান ধরিয়ে উঠবস করালেন তিনি কোন মুখে ক্লাসরুমে গিয়ে ছাত্রদের নীতি শিক্ষা দেবেন।

নিয়তির কি পরিহাস! কালের বিবর্তনে শিক্ষক তার ছাত্রের হাতে খুন হচ্ছেন, জুতার মালা দিয়ে ছাত্ররা শিক্ষককে বরণ করছে। এখন ম্যানেজিং কমিটির নির্দেশ মতো শিক্ষককে চলতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ছাত্ররা শিক্ষকদের শিক্ষা দিচ্ছে। উৎপল স্যার মরে মুক্তি পেয়ে গেছেন; কিন্তু অপমানিত শিক্ষক যতদিন বেঁচে থাকবেন জীবন্মৃত হয়ে তাদের দিন গুজরান করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এ সমস্ত কথা বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই উচ্চারিত হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে উপর্যুপরি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে সব ঘটনা ঘটে চলছে তাতে বাস্তবতার সঙ্গে সমাজপতিদের এসব কথার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এ ধরনের ঘটনায় ন্যায় বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে নজির সৃষ্টি হতো তাহলে সম্প্রীতি নষ্টকারী অপশক্তি এ সব অপতৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার উদ্যম হারাত। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় আজ পর্যন্ত এ ধরনের একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্র একের পর এক ষড়যন্ত্রে উৎসাহিত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের পিছনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেতনা মূল সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর স্বাধীনতা বিরোধী চক্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাত করতে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে একের পর এক চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এর ফলে দেশ সাম্প্রদায়িকতার এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

পরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল ক্ষমতায় আসলেও রাষ্ট্র ধর্মসহ স্বৈরাচারী সরকার সমূহের প্রবর্তিত ধারা থেকে খুব একটা সরে আসতে পারেনি। এ অবস্থায় স্বাধীনতার পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের তৎপরতায় মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা, শিক্ষক হত্যা নির্যাতনসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থাকে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ ১৯৭২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতি সংবিধানে সংযোজন করে। কিন্তু একই সঙ্গে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম ধারাটি বহাল রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শের এই স্ববিরোধিতার কারণে স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আরও তৎপর হয়ে উঠে। ফলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক মুক্ত চিন্তার মানুষ হত্যা,সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইত্যাদি অপতৎপরতার পথ আরও প্রশস্ত হয়। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো অধিকতর উজ্জীবিত হয়ে অপতৎপরতায় লিপ্ত হয় যা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দুর্বল করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পাশাপাশি অনেক মুক্ত চিন্তার মানুষকে হত্যার তান্ডব চালায়।

শিক্ষক লাঞ্ছনা, খুন, মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হামলা, হত্যা, নির্যাতন, সিরিজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, পাঠ্যসূচি পরিবর্তনে সরকারকে প্ররোচিতকরণ ইত্যাদি কার্যকলাপ বিরোধী চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নেরই অংশ বিশেষ। জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষক হত্যা, লাঞ্ছনা জাতিকে অভিভাবকশূন্য ও মেরুদন্ডহীন করারই ষড়যন্ত্র যা ১৯৭১ এ বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনায় অসম্পূর্ণ থেকেছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে মৌলবাদী শক্তির তৎপরতায় যে বিষবৃক্ষের জন্ম হয়েছে তার গোড়া এখনই উপড়ে না ফেলতে না পারলে অচিরেই তা মহীরুহে পরিণত হয়ে জাতিকে কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলবে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়]

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

বাগদা ফার্ম : স্মারকলিপি, অবরোধ, অনশন, আন্দোলন- কিছুতেই বরফ গলেনি

ব্যাটারি-শকট: নতুন সংকট

মতপ্রকাশ কিংবা দ্বিমত পোষণ: নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন ব্যাংক কি আদৌ প্রয়োজন

ট্রাম্প ও শি’র ‘কৌশলগত শান্তি’

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ

শুভ্রেন্দু ভট্টাচার্য

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০২২

সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনায় সমাজের ভিত কেঁপে উঠেছে। নড়াইল ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে পুলিশের সামনে শত শত ছাত্র-জনতার উল্লসিত দর্শকের ডামাডোলে হ্যান্ডমাইকে ঘোষণা দিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে জুতার মালা পরিয়ে শোভাযাত্রা করানো হয়। এই ঘটনার ভিডিও করে ভাইরাল করা হয়। এ ছাড়া আশুলিয়া হাজি ইউনুস আলী কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে তারই ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু কলেজ ক্যাম্পাসে শত শত ছাত্র-শিক্ষকের সামনে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। পূর্বে মুন্সীগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ মন্ডলকে ছাত্রদের বিজ্ঞানের বিভিন্ন তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক নিয়ে পড়ানোর সময় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। অতীতে নারায়নগঞ্জে পিয়ার সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় এমপি সেলিম ওসমান মিথ্যা অভিযোগে হাজার ছাত্র-জনতার সামনে কান ধরে উঠবস করান। আর লক্ষ্য করলে দেখা যায় অধিকাংস ঘটনাই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে লক্ষ্য করে সংঘটিত হচ্ছে। সার্বিক ভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেই চলছে। অনেক ঘটনা হয়তো লোক-লজ্জা বা প্রভাবশালী মহলের চাপে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায় না।

শিক্ষক হত্যা, লাঞ্ছনা ইত্যাদির প্রতিবাদে গতানুগতিকভাবে দেশব্যাপী প্রতিবাদ মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিলে মনে হয় জাতির বিবেক জেগে উঠেছে। অপরাধীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ মুখর মানুষ ঘরে ফিরে যাবে না। প্রশাসনও ঘটনা খতিয়ে দেখছে বলে বার বার আশ্বস্ত করছে। সমানে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। কিন্তু নিহত শিক্ষক উৎপল সরকার তো আর ফিরে আসবেন না। চিরকালে জন্যে বৃদ্ধা মায়ের বুক খালি করে তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। যে শিক্ষককে জনসমক্ষে জুতার মালা পরানো হলো, বিনা অপরাধে মিথ্যা অভিযোগে যে হৃদয় মন্ডলকে জেলে পাঠানো হল, যে বেচারা প্রধান শিক্ষককে এমপি সাহেব ছাত্রদের সামনে কান ধরিয়ে উঠবস করালেন তিনি কোন মুখে ক্লাসরুমে গিয়ে ছাত্রদের নীতি শিক্ষা দেবেন।

নিয়তির কি পরিহাস! কালের বিবর্তনে শিক্ষক তার ছাত্রের হাতে খুন হচ্ছেন, জুতার মালা দিয়ে ছাত্ররা শিক্ষককে বরণ করছে। এখন ম্যানেজিং কমিটির নির্দেশ মতো শিক্ষককে চলতে হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ছাত্ররা শিক্ষকদের শিক্ষা দিচ্ছে। উৎপল স্যার মরে মুক্তি পেয়ে গেছেন; কিন্তু অপমানিত শিক্ষক যতদিন বেঁচে থাকবেন জীবন্মৃত হয়ে তাদের দিন গুজরান করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, এ সমস্ত কথা বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই উচ্চারিত হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে উপর্যুপরি সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে সব ঘটনা ঘটে চলছে তাতে বাস্তবতার সঙ্গে সমাজপতিদের এসব কথার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এ ধরনের ঘটনায় ন্যায় বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে নজির সৃষ্টি হতো তাহলে সম্প্রীতি নষ্টকারী অপশক্তি এ সব অপতৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার উদ্যম হারাত। পরিতাপের সঙ্গে বলতে হয় আজ পর্যন্ত এ ধরনের একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং স্বাধীনতা বিরোধী চক্র একের পর এক ষড়যন্ত্রে উৎসাহিত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধের পিছনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার চেতনা মূল সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর স্বাধীনতা বিরোধী চক্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নস্যাত করতে সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে একের পর এক চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এর ফলে দেশ সাম্প্রদায়িকতার এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

পরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী দল ক্ষমতায় আসলেও রাষ্ট্র ধর্মসহ স্বৈরাচারী সরকার সমূহের প্রবর্তিত ধারা থেকে খুব একটা সরে আসতে পারেনি। এ অবস্থায় স্বাধীনতার পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের তৎপরতায় মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যা, শিক্ষক হত্যা নির্যাতনসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত থাকে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ ১৯৭২ সালের সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূল চার নীতি সংবিধানে সংযোজন করে। কিন্তু একই সঙ্গে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম ধারাটি বহাল রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শের এই স্ববিরোধিতার কারণে স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আরও তৎপর হয়ে উঠে। ফলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক মুক্ত চিন্তার মানুষ হত্যা,সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ইত্যাদি অপতৎপরতার পথ আরও প্রশস্ত হয়। হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো অধিকতর উজ্জীবিত হয়ে অপতৎপরতায় লিপ্ত হয় যা প্রকারান্তরে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দুর্বল করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পাশাপাশি অনেক মুক্ত চিন্তার মানুষকে হত্যার তান্ডব চালায়।

শিক্ষক লাঞ্ছনা, খুন, মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর হামলা, হত্যা, নির্যাতন, সিরিজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, পাঠ্যসূচি পরিবর্তনে সরকারকে প্ররোচিতকরণ ইত্যাদি কার্যকলাপ বিরোধী চক্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নেরই অংশ বিশেষ। জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষক হত্যা, লাঞ্ছনা জাতিকে অভিভাবকশূন্য ও মেরুদন্ডহীন করারই ষড়যন্ত্র যা ১৯৭১ এ বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনায় অসম্পূর্ণ থেকেছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে মৌলবাদী শক্তির তৎপরতায় যে বিষবৃক্ষের জন্ম হয়েছে তার গোড়া এখনই উপড়ে না ফেলতে না পারলে অচিরেই তা মহীরুহে পরিণত হয়ে জাতিকে কালো ছায়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলবে।

[লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়]

back to top