জিয়াউদ্দীন আহমেদ
জাতিসংঘের মতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক কোন ব্যক্তিকে বিচারব্যবস্থার কাছে হাজির করা না হলে এবং তার যদি সন্ধান না মেলে সেটিও গুম। শুধু সরকারি বাহিনীর হাতে লোকজন গুম হচ্ছে না, গুম হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে, গোষ্ঠীর হাতে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গুম হওয়ার প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে সংগঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং গুম হওয়ার ঘটনা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বেশ সোচ্চার। ইতোমধ্যে আমেরিকা র্যাব এবং এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর তাদের দেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাক্ষা আরোপ করেছে। গুম হওয়া অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের দলের নেতাকর্মী বলে বিএনপি অভিযোগ করছে। এটা সত্য যে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ এবং গুমের প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগে বলা হচ্ছে, সরকারি বাহিনীর লোকজন সিভিল ড্রেস বা ইউনিফর্মে নিজেদের অথবা ভাড়া করা গাড়িতে করে বিভিন্ন ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তুলে নেয়া লোকদের মধ্যে অনেকে ফেরত আসছে, আবার কেউ কেউ একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যারা ফেরত আসছে তারা গুমের কোন তথ্য দিচ্ছে না, নীরব থাকছে, নীরবতার এই রহস্য আজও ভেদ করা যায়নি।
দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনগণের ওপর নজরদারি রাখা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং শাসনক্ষমতা নিষ্কণ্টক ও নির্বিঘ্ন রাখতেও প্রায় প্রতিটি দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করে থাকে। কিন্তু এই বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যরা সরকারি সমর্থনে কখনো কখনো এত বেশি ক্ষমতার প্রয়োগ করে যে তারা তখন জনগণের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের বাদশাহ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর সময় ‘সাভাক’ গঠিত হয়েছিল; সাভাক ইরানের সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত এবং ভীতিকর গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতিপক্ষের ব্যক্তিদের গুম করে নির্যাতন করাই এদের অন্যতম মুখ্য কাজ ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতি কলুষিত হওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’। সালভাদর আয়েন্দেকে খুন করে ক্ষমতায় এসে অগুস্তো পিনোশে ১৯৭৩ সনে গঠন করেন ‘দিনা’; দিনা চিলিতে হাজার হাজার মানুষের গুম আর হত্যার জন্য দায়ী।
১৯৪৯ সনে সোভিয়েত সমর্থিত পূর্ব জার্মানি গঠিত হওয়ার পর ‘স্তাসি’ গোয়েন্দা সংস্থা গঠন করা হয়। নাৎসীদের ওপর নজর রাখা ছাড়াও জনগণের মধ্যে যাতে অসন্তোষ দানা বাঁধতে না পারে সে জন্য এই স্তাসি প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে অপহরণ করত। ১৮৮১ সনে রাশিয়ায় জারের আমলে প্রতিষ্ঠা হয় ‘ওখরানা’ গোয়েন্দা সংস্থা; ওখরানা কুখ্যাত ছিল এর ভয়ানক অত্যাচার আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য। ‘এনকেভিডি’র হাতে শুধু স্তালিনের সমালোচক হওয়ার অপরাধে বহু নিবেদিত কম্যুনিস্টকে প্রাণ খোয়াতে হয়েছে। ট্রটস্কিকেও হত্যা করে এক এনকেভিডি এজেন্ট। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এখনো অনেক রাশিয়ান নাগরিককে অপহরণ করে হত্যা করে অথবা ‘গুলাগে’ পাঠিয়ে দেয়। চীনের গোয়েন্দা সংস্থা ফালুন গংয়ের সদস্যদের গুম করে হত্যা করে; এমনকি জোরপূর্বক তাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অপসারণ করে বিক্রি করে দেয়। ইসরাইলের ‘মোসাদ’ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর গোয়েন্দা সংস্থা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা ইহুদিদের হত্যা করেছিল তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ খুন করেছে, কিছু ইরানি নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীকেও তারা ইরানের মাটিতে মেরে ফেলেছে। ফিলিস্তিনি হামাসকে অস্ত্র সরবরাহকারী এক ব্যবসায়ীকে কিছুদিন আগে মোসাদ দুবাইয়ের বিখ্যাত সাত তারকা হোটেল বুর্জ আল খলিফাতে গিয়ে মেরে এসেছে।
কিছুদিন আগে সিরিয়া এবং ইরাকের ভূমি দখল করে ইসলামি উগ্রপন্থী আইএস প্রতিপক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে প্রকাশ্যে শিরশ্চেদপূর্বক তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিত। এই ছড়িয়ে দেয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা। অন্যদিকে স্বীকারোক্তি আদায়ে বিভিন্ন দেশে বন্দিদের ওপর যে অমানবিক ও অকথ্য নিষ্ঠুরতা চলে তা লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ২৫ বছরের গোপন নথি জনসাধারণের নিকট উন্মুক্ত করে দেয় বিধায় তাদের গোয়েন্দা সংস্থার নিষ্ঠুর আচরণের কিছু তথ্য পৃথিবী জানতে পারে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা হাজার-হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন করে অদৃশ্য করে দিয়েছে যাদের হদিশ আজও মিলেনি।
পৃথিবীর নানা দেশে গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের প্ররোচনায় নিজেদের দেশের মানুষকেই বিনা অপরাধে বা সরকারবিরোধী মনোভাবের কারণে গুম করেছে বা গুম করে হত্যা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু সরকারবিরোধী মনোভাবের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা নির্বিচারে গুম করেছে বলে মনে হয় না। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে র্যাব পরিচয়ে সাতজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে প্রমাণিত হয়েছে, এই র্যাবেরা নিজস্ব স্বার্থে এই সাতজনকে গুম ও হত্যা করেছে। জঙ্গি কর্মকান্ডে যারা জড়িত তারা স্বেচ্ছায় গাঢাকা দিচ্ছে এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন নিখোঁজ বা গুমের অভিযোগ তুলছে। অনেকে রাগ-অভিমান করেও ঘর ছাড়ে।
গত এক মাস ধরে নিখোঁজ রহিমা বেগেমকে অতি সম্পর্কিত পুলিশ ফরিদপুরের এক বাড়িতে খুঁজে পেয়েছে, অথচ অপহরণ আর গুমের গুরুতর অভিযোগ তুলে রহিমা বেগমের কন্যা মরিয়ম মান্নান ফেসবুকে একের পর এক আবেগময় পোস্ট দিলে শত শত মানুষ তা শেয়ার করেন এবং মূলধারার গণমাধ্যমে এ নিয়ে নিয়মিত খবর বেরুতে থাকে। তার সন্তানেরা ঢাকায় মানববন্ধন করেছে। বস্তাবন্দী একটি লাশকেও মরিয়ম মান্নান তার মায়ের লাশ বলে শনাক্ত করেছিল। এই মরিয়ম মান্নানসহ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মেয়েদের ধর্ষণ করার মিথ্যা অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্তরাও গাঢাকা দেয়। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর লক্ষ্যে নিজের লোককে গুম করে মামলা করার পুরোনো ফন্দি আজও অনুসৃত হয়। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়েও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শেষোক্ত শ্রেণীর লোকগুলো টাকার জন্য এবং টাকার বিনিময়ে অন্যের পক্ষ হয়ে কাজ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক এবং নকল পরিচয়পত্র থাকায় এরা ভিকটিমকে সহজে বিনা বাধায় সবার সম্মুখ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এমন অপরাধে জড়িত বহু ভুয়া পুলিশ এবং র্যাবকে ইতোমধ্যে আটক করা হয়েছে। আবার আসল ডিবি পুলিশও টাকার জন্য লোকজন অপহরণ করে থাকে। কিছুদিন আগে কক্সবাজারে ১৭ লাখ টাকার মুক্তিপণসহ ৭ ডিবি পুলিশকে আটক করছে সেনাবাহিনী। তবে জঙ্গিপনা এবং দেশবিরোধী কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুম হওয়ার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীত নয়।
আওয়ামী লীগ সরকার গুমের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও গুমের ঘটনা উন্মোচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অক্ষমতা বা নিষ্কৃয়তা জনগণকে সন্দিহান করে তুলেছে। পুরোনো একটি খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান একটি দেশের অনানারী কনসুলার দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ, ইত্যবসরে নিশ্চয়ই উদ্ধার হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ওয়েভ নিউজ পোর্টালের রিপোর্টার উৎফল দত্ত নিখোঁজ হয়েছেন ২০১৭ সনে। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সদস্য আমিনুল ইসলামের গুম ও খুন হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে সমালোচনার ঝড় উঠে। আমিনুল ইসলামের হত্যাকারী মোস্তাফিজকে খুঁজে পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা নেই মর্মে অভিযোগ উঠেছে; অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মোস্তাফিজকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর আজও সন্ধান মিলেনি। ২০০৮ সনে অপহৃত যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেনের খোঁজ আজও মেলেনি। যতগুলো গুমের ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা পরিচয়ে কিছু লোক এসে ভিকটিমদের তুলে নিয়ে গেছে। এই বিষয় ভয়ংকর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে অন্য কোন প্রতিপক্ষ বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কাউকে তুলে নিয়ে যাবে, অথচ তার দায় সরকার নেবে না, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে গুম, ভুয়া পুলিশ, র্যাবের উদ্ভবের মূল কারণ আইনের শাসন না থাকা। গ্রেপ্তার করার পর অভিযুক্তকে কোথায় নেয়া হচ্ছে, তা জানানো বাধ্যতামূলক, এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। র্যাব বা ডিবি পুলিশের বেশ ধারণ করে যারা গ্রেপ্তার করতে আসে, তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতেও জনগণ ভয় পায়। কারণ, র্যাব-পুলিশ দেশে এমন এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যে, গ্রেপ্তার করতে আসা লোকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। জনগণ অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বাস করে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছে করলে আইনের যে কোন একটি ধারায় ফাঁসিয়ে দিতে পারবে। অস্ত্র বা মাদক কোমরে গুঁজিয়ে দিয়ে গ্রেপ্তার করার বহু ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ভুয়া পুলিশ না হয়ে প্রকৃত পুলিশ হলে গ্রেপ্তারকালীন তর্ক না করাই উত্তম, কারণ রিমান্ডের ভয় তো আছেই; সবার ধারণা, রিমান্ড মানেই অমানুষিক নির্যাতন। ব্রিটিশ আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম এবং নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে। বইটির প্রধান চরিত্র মিয়াজান দারোগা এক ব্যক্তিকে ধরে এনে নানা ধরনের নির্যাতন করতে করতে মেরেই ফেলল এবং মরার পর লাশ গুম করে ফেলা হলো। এমন ঘটনা ঘটলে পুলিশ নিখোঁজের জিডি নিতে গড়িমসি করে, জিডি নিলেও তা আর কখনো আলোর মুখ দেখে না, আলোর মুখ দেখে না বলেই নিখোঁজের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের সন্দেহ ঘনীভূত হয়।
র্যাব বা ডিবি পুলিশের বেশ করে যারা গ্রেপ্তার করতে আসে, তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতেও জনগণ ভয় পায়। কারণ, র্যাব-পুলিশ দেশে এমন এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যে, গ্রেপ্তার করতে আসা লোকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে
বাংলাদেশে সংঘটিত সব গুমকে রাজনৈতিক কালার দিয়ে গুম হওয়া সবাইকে দলীয় কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টাও হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও গুম হতে পারে। ফেনীতে একসময় দলীয় লোকদের গুম ও হত্যা করে লাশ গায়েব করে দেয়ার কথা শোনা যেত। ২০০৩ সনে বিএনপির আমলে বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় গুম। অপহরণের দুই বছর পর ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা কঙ্কাল সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষার পর তার পরিবার নিশ্চিত হয় যে, কঙ্কাল জামাল উদ্দিনের।
ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পেছনে দলীয় কোন্দলের কথা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাস স্পষ্ট করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি, ইলিয়াস আলীকে গুম করার পেছনে ভেতরের কয়েকজন নেতা দায়ী। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘ইলিয়াস গুম হওয়ার আগের রাতে দলীয় অফিসে কোন এক ব্যক্তির সঙ্গে তার প্রচন্ড বাগ্্বিতন্ডা হয়, ইলিয়াস খুব গালিগালাজ করেছিল তাকে’।
লিয়াকত হোসেন এবং চৌধুরী আলম রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বটে, কিন্তু জনগণের কাছে তাদের পরিচয়টা ছিল ভিন্ন রকম। ২০০১ সনে বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের লিয়াকত হোসেনকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিল। চৌধুরী আলম ঢাকা শহরের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে শোনা যায়, তার নিয়ন্ত্রিত অংশে যত রকমের অবৈধ চাঁদা তোলা হতো সব তার নামেই হতো। আমিনুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার ভাই রফিকুল ইসলাম মোস্তাফিজুর রহমান ও বোরকা পরা অজ্ঞাতনামা এক নারীকে আসামি করে ঘাটাইল থানায় এজাহার দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের ৭৬ জন ঘুম হওয়ার যে তালিকা তৈরি করেছে তাদের মধ্যে অনেকে নাকি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তালিকার দুজন আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নেতা।
স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। এই ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা না করে এর থেকে উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও সব নিখোঁজ এবং গুমের জন্য সরকার দায়ী। সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের জীবন-মালের নিরাপত্তা বিধান করা। গুম হলে সরকারের দায়িত্ব গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের খুঁজে বের করা। খুঁজে বের করতে না পারার অর্থই হচ্ছে, সরকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অক্ষম, জনগণের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ। কোন গুম বা হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিশ্চুপ থাকে, জিডি নথিভুক্ত করতে গড়িমসি করে, ঘটনার উন্মোচনে নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন গুমকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিসন্ধি জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। নিজের কেউ বাসার বাইরে থাকা অবস্থায় দুই তিনবার কল না ধরলে আমরা সবাই অস্থির হয়ে যাই; সেখানে একজন নিখোঁজ হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কী কষ্টদায়ক অবস্থা তা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। গুমের অভিযোগ থেকে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুক্ত থাকতে চাইলে প্রতিটি গুমের ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত কার্যক্রম জনগণের কাছে পরিস্কার করা সমীচীন ও বাঞ্ছনীয়।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ০১ অক্টোবর ২০২২
জাতিসংঘের মতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক কোন ব্যক্তিকে বিচারব্যবস্থার কাছে হাজির করা না হলে এবং তার যদি সন্ধান না মেলে সেটিও গুম। শুধু সরকারি বাহিনীর হাতে লোকজন গুম হচ্ছে না, গুম হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির হাতে, গোষ্ঠীর হাতে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গুম হওয়ার প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে সংগঠিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড এবং গুম হওয়ার ঘটনা নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন বেশ সোচ্চার। ইতোমধ্যে আমেরিকা র্যাব এবং এর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর তাদের দেশ ভ্রমণের ওপর নিষেধাক্ষা আরোপ করেছে। গুম হওয়া অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের দলের নেতাকর্মী বলে বিএনপি অভিযোগ করছে। এটা সত্য যে, বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ এবং গুমের প্রচুর ঘটনা ঘটেছে। অভিযোগে বলা হচ্ছে, সরকারি বাহিনীর লোকজন সিভিল ড্রেস বা ইউনিফর্মে নিজেদের অথবা ভাড়া করা গাড়িতে করে বিভিন্ন ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তুলে নেয়া লোকদের মধ্যে অনেকে ফেরত আসছে, আবার কেউ কেউ একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যারা ফেরত আসছে তারা গুমের কোন তথ্য দিচ্ছে না, নীরব থাকছে, নীরবতার এই রহস্য আজও ভেদ করা যায়নি।
দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনগণের ওপর নজরদারি রাখা সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং শাসনক্ষমতা নিষ্কণ্টক ও নির্বিঘ্ন রাখতেও প্রায় প্রতিটি দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা সরকারের পক্ষ হয়ে কাজ করে থাকে। কিন্তু এই বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্যরা সরকারি সমর্থনে কখনো কখনো এত বেশি ক্ষমতার প্রয়োগ করে যে তারা তখন জনগণের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের বাদশাহ মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর সময় ‘সাভাক’ গঠিত হয়েছিল; সাভাক ইরানের সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত এবং ভীতিকর গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতিপক্ষের ব্যক্তিদের গুম করে নির্যাতন করাই এদের অন্যতম মুখ্য কাজ ছিল। পাকিস্তানের রাজনীতি কলুষিত হওয়ার পেছনে রয়েছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’। সালভাদর আয়েন্দেকে খুন করে ক্ষমতায় এসে অগুস্তো পিনোশে ১৯৭৩ সনে গঠন করেন ‘দিনা’; দিনা চিলিতে হাজার হাজার মানুষের গুম আর হত্যার জন্য দায়ী।
১৯৪৯ সনে সোভিয়েত সমর্থিত পূর্ব জার্মানি গঠিত হওয়ার পর ‘স্তাসি’ গোয়েন্দা সংস্থা গঠন করা হয়। নাৎসীদের ওপর নজর রাখা ছাড়াও জনগণের মধ্যে যাতে অসন্তোষ দানা বাঁধতে না পারে সে জন্য এই স্তাসি প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে অপহরণ করত। ১৮৮১ সনে রাশিয়ায় জারের আমলে প্রতিষ্ঠা হয় ‘ওখরানা’ গোয়েন্দা সংস্থা; ওখরানা কুখ্যাত ছিল এর ভয়ানক অত্যাচার আর বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের জন্য। ‘এনকেভিডি’র হাতে শুধু স্তালিনের সমালোচক হওয়ার অপরাধে বহু নিবেদিত কম্যুনিস্টকে প্রাণ খোয়াতে হয়েছে। ট্রটস্কিকেও হত্যা করে এক এনকেভিডি এজেন্ট। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এখনো অনেক রাশিয়ান নাগরিককে অপহরণ করে হত্যা করে অথবা ‘গুলাগে’ পাঠিয়ে দেয়। চীনের গোয়েন্দা সংস্থা ফালুন গংয়ের সদস্যদের গুম করে হত্যা করে; এমনকি জোরপূর্বক তাদের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অপসারণ করে বিক্রি করে দেয়। ইসরাইলের ‘মোসাদ’ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর গোয়েন্দা সংস্থা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা ইহুদিদের হত্যা করেছিল তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ খুন করেছে, কিছু ইরানি নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীকেও তারা ইরানের মাটিতে মেরে ফেলেছে। ফিলিস্তিনি হামাসকে অস্ত্র সরবরাহকারী এক ব্যবসায়ীকে কিছুদিন আগে মোসাদ দুবাইয়ের বিখ্যাত সাত তারকা হোটেল বুর্জ আল খলিফাতে গিয়ে মেরে এসেছে।
কিছুদিন আগে সিরিয়া এবং ইরাকের ভূমি দখল করে ইসলামি উগ্রপন্থী আইএস প্রতিপক্ষের লোকদের ধরে নিয়ে প্রকাশ্যে শিরশ্চেদপূর্বক তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিত। এই ছড়িয়ে দেয়ার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা। অন্যদিকে স্বীকারোক্তি আদায়ে বিভিন্ন দেশে বন্দিদের ওপর যে অমানবিক ও অকথ্য নিষ্ঠুরতা চলে তা লোকচক্ষুর অগোচরেই থেকে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ২৫ বছরের গোপন নথি জনসাধারণের নিকট উন্মুক্ত করে দেয় বিধায় তাদের গোয়েন্দা সংস্থার নিষ্ঠুর আচরণের কিছু তথ্য পৃথিবী জানতে পারে। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা হাজার-হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্যাতন করে অদৃশ্য করে দিয়েছে যাদের হদিশ আজও মিলেনি।
পৃথিবীর নানা দেশে গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের প্ররোচনায় নিজেদের দেশের মানুষকেই বিনা অপরাধে বা সরকারবিরোধী মনোভাবের কারণে গুম করেছে বা গুম করে হত্যা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু সরকারবিরোধী মনোভাবের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা নির্বিচারে গুম করেছে বলে মনে হয় না। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জ থেকে র্যাব পরিচয়ে সাতজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কয়েক দিন পর তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পরে প্রমাণিত হয়েছে, এই র্যাবেরা নিজস্ব স্বার্থে এই সাতজনকে গুম ও হত্যা করেছে। জঙ্গি কর্মকান্ডে যারা জড়িত তারা স্বেচ্ছায় গাঢাকা দিচ্ছে এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন নিখোঁজ বা গুমের অভিযোগ তুলছে। অনেকে রাগ-অভিমান করেও ঘর ছাড়ে।
গত এক মাস ধরে নিখোঁজ রহিমা বেগেমকে অতি সম্পর্কিত পুলিশ ফরিদপুরের এক বাড়িতে খুঁজে পেয়েছে, অথচ অপহরণ আর গুমের গুরুতর অভিযোগ তুলে রহিমা বেগমের কন্যা মরিয়ম মান্নান ফেসবুকে একের পর এক আবেগময় পোস্ট দিলে শত শত মানুষ তা শেয়ার করেন এবং মূলধারার গণমাধ্যমে এ নিয়ে নিয়মিত খবর বেরুতে থাকে। তার সন্তানেরা ঢাকায় মানববন্ধন করেছে। বস্তাবন্দী একটি লাশকেও মরিয়ম মান্নান তার মায়ের লাশ বলে শনাক্ত করেছিল। এই মরিয়ম মান্নানসহ কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত মেয়েদের ধর্ষণ করার মিথ্যা অভিযোগ তুলে সংবাদ সম্মেলন করেছিল। গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্তরাও গাঢাকা দেয়। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর লক্ষ্যে নিজের লোককে গুম করে মামলা করার পুরোনো ফন্দি আজও অনুসৃত হয়। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়েও সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। শেষোক্ত শ্রেণীর লোকগুলো টাকার জন্য এবং টাকার বিনিময়ে অন্যের পক্ষ হয়ে কাজ করে। নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক এবং নকল পরিচয়পত্র থাকায় এরা ভিকটিমকে সহজে বিনা বাধায় সবার সম্মুখ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এমন অপরাধে জড়িত বহু ভুয়া পুলিশ এবং র্যাবকে ইতোমধ্যে আটক করা হয়েছে। আবার আসল ডিবি পুলিশও টাকার জন্য লোকজন অপহরণ করে থাকে। কিছুদিন আগে কক্সবাজারে ১৭ লাখ টাকার মুক্তিপণসহ ৭ ডিবি পুলিশকে আটক করছে সেনাবাহিনী। তবে জঙ্গিপনা এবং দেশবিরোধী কর্মকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুম হওয়ার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জড়িত থাকার বিষয়টি সন্দেহাতীত নয়।
আওয়ামী লীগ সরকার গুমের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করলেও গুমের ঘটনা উন্মোচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অক্ষমতা বা নিষ্কৃয়তা জনগণকে সন্দিহান করে তুলেছে। পুরোনো একটি খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে ইউরোপিয়ান একটি দেশের অনানারী কনসুলার দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ, ইত্যবসরে নিশ্চয়ই উদ্ধার হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল ওয়েভ নিউজ পোর্টালের রিপোর্টার উৎফল দত্ত নিখোঁজ হয়েছেন ২০১৭ সনে। বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান প্রচেষ্টার অনুপস্থিতি নিয়ে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সদস্য আমিনুল ইসলামের গুম ও খুন হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে সমালোচনার ঝড় উঠে। আমিনুল ইসলামের হত্যাকারী মোস্তাফিজকে খুঁজে পেতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপরতা নেই মর্মে অভিযোগ উঠেছে; অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মোস্তাফিজকে ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়ার পর আজও সন্ধান মিলেনি। ২০০৮ সনে অপহৃত যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেনের খোঁজ আজও মেলেনি। যতগুলো গুমের ঘটনা ঘটেছে, তার অধিকাংশ ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা পরিচয়ে কিছু লোক এসে ভিকটিমদের তুলে নিয়ে গেছে। এই বিষয় ভয়ংকর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নামে অন্য কোন প্রতিপক্ষ বা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কাউকে তুলে নিয়ে যাবে, অথচ তার দায় সরকার নেবে না, তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে গুম, ভুয়া পুলিশ, র্যাবের উদ্ভবের মূল কারণ আইনের শাসন না থাকা। গ্রেপ্তার করার পর অভিযুক্তকে কোথায় নেয়া হচ্ছে, তা জানানো বাধ্যতামূলক, এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। র্যাব বা ডিবি পুলিশের বেশ ধারণ করে যারা গ্রেপ্তার করতে আসে, তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতেও জনগণ ভয় পায়। কারণ, র্যাব-পুলিশ দেশে এমন এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যে, গ্রেপ্তার করতে আসা লোকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। জনগণ অভিজ্ঞতা থেকে বিশ্বাস করে যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছে করলে আইনের যে কোন একটি ধারায় ফাঁসিয়ে দিতে পারবে। অস্ত্র বা মাদক কোমরে গুঁজিয়ে দিয়ে গ্রেপ্তার করার বহু ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। ভুয়া পুলিশ না হয়ে প্রকৃত পুলিশ হলে গ্রেপ্তারকালীন তর্ক না করাই উত্তম, কারণ রিমান্ডের ভয় তো আছেই; সবার ধারণা, রিমান্ড মানেই অমানুষিক নির্যাতন। ব্রিটিশ আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম এবং নিষ্ঠুর নির্যাতনের পরিপূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে। বইটির প্রধান চরিত্র মিয়াজান দারোগা এক ব্যক্তিকে ধরে এনে নানা ধরনের নির্যাতন করতে করতে মেরেই ফেলল এবং মরার পর লাশ গুম করে ফেলা হলো। এমন ঘটনা ঘটলে পুলিশ নিখোঁজের জিডি নিতে গড়িমসি করে, জিডি নিলেও তা আর কখনো আলোর মুখ দেখে না, আলোর মুখ দেখে না বলেই নিখোঁজের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের সন্দেহ ঘনীভূত হয়।
র্যাব বা ডিবি পুলিশের বেশ করে যারা গ্রেপ্তার করতে আসে, তাদের কিছু জিজ্ঞেস করতেও জনগণ ভয় পায়। কারণ, র্যাব-পুলিশ দেশে এমন এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে যে, গ্রেপ্তার করতে আসা লোকদের পরিচয় জিজ্ঞেস করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে
বাংলাদেশে সংঘটিত সব গুমকে রাজনৈতিক কালার দিয়ে গুম হওয়া সবাইকে দলীয় কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টাও হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলেও গুম হতে পারে। ফেনীতে একসময় দলীয় লোকদের গুম ও হত্যা করে লাশ গায়েব করে দেয়ার কথা শোনা যেত। ২০০৩ সনে বিএনপির আমলে বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় গুম। অপহরণের দুই বছর পর ফটিকছড়ির পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা কঙ্কাল সিঙ্গাপুরে ডিএনএ পরীক্ষার পর তার পরিবার নিশ্চিত হয় যে, কঙ্কাল জামাল উদ্দিনের।
ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার পেছনে দলীয় কোন্দলের কথা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে। কেন্দ্রীয় নেতা মির্জা আব্বাস স্পষ্ট করে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ইলিয়াস আলীকে গুম করেনি, ইলিয়াস আলীকে গুম করার পেছনে ভেতরের কয়েকজন নেতা দায়ী। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, ‘ইলিয়াস গুম হওয়ার আগের রাতে দলীয় অফিসে কোন এক ব্যক্তির সঙ্গে তার প্রচন্ড বাগ্্বিতন্ডা হয়, ইলিয়াস খুব গালিগালাজ করেছিল তাকে’।
লিয়াকত হোসেন এবং চৌধুরী আলম রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বটে, কিন্তু জনগণের কাছে তাদের পরিচয়টা ছিল ভিন্ন রকম। ২০০১ সনে বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগের লিয়াকত হোসেনকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিল। চৌধুরী আলম ঢাকা শহরের একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে শোনা যায়, তার নিয়ন্ত্রিত অংশে যত রকমের অবৈধ চাঁদা তোলা হতো সব তার নামেই হতো। আমিনুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার ভাই রফিকুল ইসলাম মোস্তাফিজুর রহমান ও বোরকা পরা অজ্ঞাতনামা এক নারীকে আসামি করে ঘাটাইল থানায় এজাহার দিয়েছিলেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের ৭৬ জন ঘুম হওয়ার যে তালিকা তৈরি করেছে তাদের মধ্যে অনেকে নাকি দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তালিকার দুজন আবার ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের নেতা।
স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। এই ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করার চেষ্টা না করে এর থেকে উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও সব নিখোঁজ এবং গুমের জন্য সরকার দায়ী। সরকারের দায়িত্ব তার নাগরিকদের জীবন-মালের নিরাপত্তা বিধান করা। গুম হলে সরকারের দায়িত্ব গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের খুঁজে বের করা। খুঁজে বের করতে না পারার অর্থই হচ্ছে, সরকার শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে অক্ষম, জনগণের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ। কোন গুম বা হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন নিশ্চুপ থাকে, জিডি নথিভুক্ত করতে গড়িমসি করে, ঘটনার উন্মোচনে নিষ্ক্রিয় থাকে, তখন গুমকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিসন্ধি জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। নিজের কেউ বাসার বাইরে থাকা অবস্থায় দুই তিনবার কল না ধরলে আমরা সবাই অস্থির হয়ে যাই; সেখানে একজন নিখোঁজ হলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কী কষ্টদায়ক অবস্থা তা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। গুমের অভিযোগ থেকে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মুক্ত থাকতে চাইলে প্রতিটি গুমের ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত কার্যক্রম জনগণের কাছে পরিস্কার করা সমীচীন ও বাঞ্ছনীয়।
[লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক]