এস এম জাহাঙ্গীর আলম
খবরটি উদ্বেগজনক। তিন কোটি ৬০ লাখ শিশুর শরীরে সিসা। আইইডিআর ও আইসিডিডিআর’র গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু রক্তে (৬০ শতাংশ) উচ্চমাত্রার ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে এক কোটি শিশুর রক্তে রয়েছে ১০ মাইক্রোগ্রাম পার ডেসিলিটারের বেশি সিসা। দুই বছর থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে।
বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে এ সিসার নেতিবাচক প্রভাব বেশি। এর প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে এবং লেখাপড়ায় তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার শঙ্কাও প্রবল।
সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন, যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। মস্তিষ্কের পুরোপুরিভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই ক্ষতিসাধন করে। এতে শিশুদের সারা জীবনের জন্য স্নায়ুবিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধিকতার মুখে পড়তে হয়। মারাত্মক সিসা দূষণ অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়। বাংলাদেশে সিসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস পুরোনো সিসা অ্যাডিস ব্যাটারির অবৈধ রিসাইক্লিং কারখানা।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধবিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রা ৩ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। কারও শরীরে এর চেয়ে বেশি সিসার উপস্থিতি থাকলে তা ক্ষতিকর বলে বিবেচিত। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মানবদেহে সিসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই। অন্যদিকে সিসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর হারের দিক থেকে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সিসা দূষণের কারণে প্রতি বছর ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা দেশের মোট মৃত্যুর ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সিসা দূষণের কারণে যে পরিমাণ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, তাতে বার্ষিক ১৬০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়; যা দেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়কৃত অর্থের প্রায় অর্ধেক।
দেওয়ালের রং, পানির পাইপ ও ফিটিংস, কসমেটিকস ও সিঁদুরের গুঁড়া, মাছ ধরার জাল, ড্রিংকস ক্যান, ইলেকট্রনিকস বর্জ্য, হার্বাল ওষুধ, গহনা প্রস্তুতকারক ও স্বর্ণ প্রক্রিয়াজাতকারক ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সিসা খাদ্য পানীয় ও ত্বকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে, যা শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফ কত গত ২০২০ সালে একটি গবেষণায় বলে, বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়, মহামারির মধ্যে গত মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নিয়ে ইউনিসেফ উদ্বিগ্ন। ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে প্রকাশিত ‘চাইল্ড লেবার : গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শিশুশ্রম বন্ধে অগ্রগতি গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো থমকে গেছে। অর্থাৎ যে নিম্নমুখী প্রবণতা হয়েছিল, তা আবার ঘুরে গেছে। শিশুর সংখ্যা শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের বেশি।
অর্থনৈতিক চাপ এবং স্কুল বন্ধের কারণে ইতিমধ্যে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের হয়তো দৈনিক আরও দীর্ঘ সময় ধরে বা আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারগুলোতে কাজ হারানোয় বা আয় কমে যাওয়ার কারণে অনেক শিশু হয়তো সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন, যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম বিদ্যমান। যে বয়সে একটি শিশুর বই, খাতা, পেন্সিল নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া, আনন্দচিত্তে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা সেই বয়সে ওই শিশুকে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে একজন বাবা যখন তার পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হয়, তখন ওই বাবার পক্ষে তার সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ রাখা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। আর এভাবে একটি শিশু একবার পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর সে হারিয়ে যায় অগণিত মানুষের মধ্যে। এদের কেউ তখন হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কেউ ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে, কেউবা বাসা-বাড়িতে কাজ নেয়।
উল্লিখিত কাজ ছাড়াও শিশুরা বাজারে বোঝা টানা, মিন্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, রিকশা বহন, ঠেলা গাড়ি টানা, বিড়ি বাঁধা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকে। কোন কাজ না পেয়ে কেউ আবার ছিন্নমূল শিশুতে পরিণত হয়। সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এসব শিশুর সুকুমার বৃত্তিগুলো আর প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে এ শিশুরা সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
শিশুশ্রমের কারণ বাংলাদেশে শিশুশ্রমের প্রথম এবং প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে ভরণপোষণ মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগান দেয়া আর সম্ভব হয় না। ফলে তাদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকেরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতিতে বয়সের কথা বিবেচনা না করে বাবার পেশায় বা অন্য কোনো পেশায় সন্তান নিয়োজিত হয়ে আয়-রোজগার করলে মা-বাবা একে লাভজনক মনে করেন। অন্যদিকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বা ঝরে পড়া শিশু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
শিশুদের স্বল্পমূল্যে দীর্ঘক্ষণ কাজে খাটানো যায় বলে নিয়োগকর্তা শিশুদের কাজে নিয়োগ করার বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী থাকে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক দুরবস্থাও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ। আমাদের সমাজে পরিবারের প্রধান তথা বাবার যদি মৃত্যু ঘটে, তবে ওই পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া তো দূরের কথা, ভরণপোষণের ব্যবস্থা করাই দায় হয়ে পড়ে। পারিবারিক ভাঙনে মা-বাবা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তাদের সন্তানদের খবর কেউ রাখে না। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করার কারণে সন্তান-সন্ততির সংখ্যাধিক্য হওয়ায় এদের ভরণপোষণে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো ভীষণ অর্থকষ্টের সম্মুখীন হয়।
গ্রামে কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সামাজিক অনিশ্চয়তা, মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব ইত্যাদি কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। নদীভাঙন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে অহরহ। এ জাতীয় প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনাই প্রতিনিয়ত শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে কায়িক শ্রমের দিকে। মা-বাবার স্বল্প শিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অসচেতনতার কারণে তারা শিক্ষাকে একটি অলাভজনক কর্মকান্ড মনে করে। সন্তানদের ১০-১৫ বছর ধরে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য তখন তাদের থাকে না। শিক্ষা উপকরণ ও সুযোগের অভাব এবং শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের উদাসীনতায় শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর জীবনে গৃহস্থালির কাজে গৃহকর্মীর ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীলতা, গতানুগতিক সংস্কৃতির কারণে গ্রামে লেখাপড়ায় মগ্ন শিশুটিকেও নিয়ে আসা হয় শহরে বাসার কাজের জন্য।
শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। এ বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, শিশু মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার]
এস এম জাহাঙ্গীর আলম
শুক্রবার, ২৮ অক্টোবর ২০২২
খবরটি উদ্বেগজনক। তিন কোটি ৬০ লাখ শিশুর শরীরে সিসা। আইইডিআর ও আইসিডিডিআর’র গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু রক্তে (৬০ শতাংশ) উচ্চমাত্রার ক্ষতিকারক সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে এক কোটি শিশুর রক্তে রয়েছে ১০ মাইক্রোগ্রাম পার ডেসিলিটারের বেশি সিসা। দুই বছর থেকে চার বছর বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরে সিসার উপস্থিতি মিলেছে।
বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে এ সিসার নেতিবাচক প্রভাব বেশি। এর প্রভাবে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমে যায়। মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে এবং লেখাপড়ায় তারা দুর্বল হয়ে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই যাদের শরীরে সিসার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি মিলছে, বড় হয়ে তাদের আগ্রাসী হয়ে ওঠার শঙ্কাও প্রবল।
সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন, যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। মস্তিষ্কের পুরোপুরিভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই ক্ষতিসাধন করে। এতে শিশুদের সারা জীবনের জন্য স্নায়ুবিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধিকতার মুখে পড়তে হয়। মারাত্মক সিসা দূষণ অনেক সময় মৃত্যুর কারণ হয়। বাংলাদেশে সিসা দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস পুরোনো সিসা অ্যাডিস ব্যাটারির অবৈধ রিসাইক্লিং কারখানা।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধবিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রা ৩ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। কারও শরীরে এর চেয়ে বেশি সিসার উপস্থিতি থাকলে তা ক্ষতিকর বলে বিবেচিত। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী মানবদেহে সিসার কোন নিরাপদ মাত্রা নেই। অন্যদিকে সিসার বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর হারের দিক থেকে বিশ্বে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। সিসা দূষণের কারণে প্রতি বছর ৩১ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা দেশের মোট মৃত্যুর ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সিসা দূষণের কারণে যে পরিমাণ উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, তাতে বার্ষিক ১৬০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়; যা দেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে আয়কৃত অর্থের প্রায় অর্ধেক।
দেওয়ালের রং, পানির পাইপ ও ফিটিংস, কসমেটিকস ও সিঁদুরের গুঁড়া, মাছ ধরার জাল, ড্রিংকস ক্যান, ইলেকট্রনিকস বর্জ্য, হার্বাল ওষুধ, গহনা প্রস্তুতকারক ও স্বর্ণ প্রক্রিয়াজাতকারক ইত্যাদিতে ব্যবহৃত সিসা খাদ্য পানীয় ও ত্বকের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে, যা শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফ কত গত ২০২০ সালে একটি গবেষণায় বলে, বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়, মহামারির মধ্যে গত মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দারিদ্র্য বৃদ্ধি অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা নিয়ে ইউনিসেফ উদ্বিগ্ন। ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে প্রকাশিত ‘চাইল্ড লেবার : গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শিশুশ্রম বন্ধে অগ্রগতি গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো থমকে গেছে। অর্থাৎ যে নিম্নমুখী প্রবণতা হয়েছিল, তা আবার ঘুরে গেছে। শিশুর সংখ্যা শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের বেশি।
অর্থনৈতিক চাপ এবং স্কুল বন্ধের কারণে ইতিমধ্যে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের হয়তো দৈনিক আরও দীর্ঘ সময় ধরে বা আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারগুলোতে কাজ হারানোয় বা আয় কমে যাওয়ার কারণে অনেক শিশু হয়তো সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
সিসা একটি শক্তিশালী নিউরোটক্সিন, যা শিশুদের মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি করে। এটি বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুশ্রম বিদ্যমান। যে বয়সে একটি শিশুর বই, খাতা, পেন্সিল নিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া, আনন্দচিত্তে সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা করার কথা সেই বয়সে ওই শিশুকে নেমে পড়তে হয় জীবিকার সন্ধানে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে একজন বাবা যখন তার পরিবারের ভরণপোষণে ব্যর্থ হয়, তখন ওই বাবার পক্ষে তার সন্তানদের পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ রাখা আর সম্ভব হয়ে উঠে না। আর এভাবে একটি শিশু একবার পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন হওয়ার পর সে হারিয়ে যায় অগণিত মানুষের মধ্যে। এদের কেউ তখন হোটেল-রেস্তোরাঁয়, কেউ ফ্যাক্টরি-ওয়ার্কশপে, কেউবা বাসা-বাড়িতে কাজ নেয়।
উল্লিখিত কাজ ছাড়াও শিশুরা বাজারে বোঝা টানা, মিন্তি, ভিক্ষাবৃত্তি, রিকশা বহন, ঠেলা গাড়ি টানা, বিড়ি বাঁধা ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত থাকে। কোন কাজ না পেয়ে কেউ আবার ছিন্নমূল শিশুতে পরিণত হয়। সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এসব শিশুর সুকুমার বৃত্তিগুলো আর প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে এ শিশুরা সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
শিশুশ্রমের কারণ বাংলাদেশে শিশুশ্রমের প্রথম এবং প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক দুরবস্থা। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে ভরণপোষণ মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগান দেয়া আর সম্ভব হয় না। ফলে তাদের স্কুলে পাঠাতে অভিভাবকেরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতিতে বয়সের কথা বিবেচনা না করে বাবার পেশায় বা অন্য কোনো পেশায় সন্তান নিয়োজিত হয়ে আয়-রোজগার করলে মা-বাবা একে লাভজনক মনে করেন। অন্যদিকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বা ঝরে পড়া শিশু বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
শিশুদের স্বল্পমূল্যে দীর্ঘক্ষণ কাজে খাটানো যায় বলে নিয়োগকর্তা শিশুদের কাজে নিয়োগ করার বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী থাকে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক দুরবস্থাও শিশুশ্রমের অন্যতম কারণ। আমাদের সমাজে পরিবারের প্রধান তথা বাবার যদি মৃত্যু ঘটে, তবে ওই পরিবারের সদস্যদের লেখাপড়া তো দূরের কথা, ভরণপোষণের ব্যবস্থা করাই দায় হয়ে পড়ে। পারিবারিক ভাঙনে মা-বাবা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তাদের সন্তানদের খবর কেউ রাখে না। এ ছাড়া দরিদ্র পরিবারগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করার কারণে সন্তান-সন্ততির সংখ্যাধিক্য হওয়ায় এদের ভরণপোষণে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো ভীষণ অর্থকষ্টের সম্মুখীন হয়।
গ্রামে কাজের অপ্রতুল সুযোগ, সামাজিক অনিশ্চয়তা, মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাব ইত্যাদি কারণে গ্রাম থেকে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। নদীভাঙন, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে অহরহ। এ জাতীয় প্রতিটি ঘটনা-দুর্ঘটনাই প্রতিনিয়ত শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে কায়িক শ্রমের দিকে। মা-বাবার স্বল্প শিক্ষা, দারিদ্র্য এবং অসচেতনতার কারণে তারা শিক্ষাকে একটি অলাভজনক কর্মকান্ড মনে করে। সন্তানদের ১০-১৫ বছর ধরে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়ার ধৈর্য তখন তাদের থাকে না। শিক্ষা উপকরণ ও সুযোগের অভাব এবং শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে অভিভাবকদের উদাসীনতায় শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর জীবনে গৃহস্থালির কাজে গৃহকর্মীর ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীলতা, গতানুগতিক সংস্কৃতির কারণে গ্রামে লেখাপড়ায় মগ্ন শিশুটিকেও নিয়ে আসা হয় শহরে বাসার কাজের জন্য।
শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। এ বিষয়ে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, শিশু মন্ত্রণালয় ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
[লেখক : সাবেক কর কমিশনার]