জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
একসময় ছিলাম আহমদুল কবিরের নিকট প্রতিবেশী। তিনি থাকেন ইন্দিরা রোডে, আমি উত্তরায়। আমার সেই দেখা করার ইচ্ছাটির অপমৃত্যু ঘটল হঠাৎ তার মৃত্যু সংবাদে। বলতে বাধা নেই, এই মৃত্যু সংবাদ আমাকে রীতিমতো ধাক্কাই দিয়েছে। এতদিন ধরে তাকে দেখে আসছি, তার মধ্যে অসুস্থতার, এমনকি দুর্বলতার চিহ্নমাত্র চোখে পড়েনি। অমন একহারা বলিষ্ঠ নির্মেদ শরীর, অমন ঋদ্ধ কণ্ঠস্বর, এমন স্থির অকম্প উচ্চারণ- কে বলবে এই মানুষটির মৃত্যু আসন্ন।
প্রয়াত কবি সানাউল হকের সঙ্গেও আমার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। একদিন তিনি তার বন্ধুদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ব্যক্তি হলেন আহমদুল কবির। ব্যাখ্যা করে বলেননি, তবে কী বলতে চান, মনে হয় আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। তিনি শুধু বৈষয়িক সাফল্যের কথাই বলেননি, জীবনের সার্বিক সাফল্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন, সবার সব ইচ্ছা পূরণ হয় না, আহমদুল কবির সেদিক দিয়ে পেয়েছেন সার্থকতার স্বাদ। কী ইচ্ছা ছিল আহমদুল কবিরের? কোনোদিন জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি। সার্থকতার কোন সংজ্ঞা কি জেনেছিলেন আহমদুল কবির? প্রশ্নটি আমাদের মনের মধ্যে স্পষ্ট রেখায় অঙ্কিত হয় না। একজনের সব ইচ্ছাই পূরণ হলো, অন্যের দৃষ্টিতে তাই তাকে সার্থক মানুষ নাও দেখাতে পারে। কেউ মানুষ হিসেবে সফল কিনা সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের ওপর নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে, অন্যদের দৃষ্টিতে তিনি সফল কিনা তার ওপর। সানাউল হকের চোখে, তার বিশিষ্ট বন্ধুদের মধ্যেও আহমদুল কবির ছিলেন সফলতার নিরিখে এক নম্বর। আমি এর ব্যাখ্যায় বলব, সানাউল হক দেখতে পেয়েছিলেন অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে কবির সাহেব সমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন এবং সেটা তিনি হয়েছিলেন তার নিজের গুণে, নিজের কর্মফলে, নিজের নিষ্ঠার পুরস্কার হিসেবে, কোন অলৌকিক সৌভাগ্যের কারণে নয়।
তবে অবশ্যই জন্মসূত্রে সৌভাগ্যবান ছিলেন আহমদুল কবির। পারিবারিক ঐতিহ্যের এমন সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় ক’জন? ছাত্রজীবন শেষ করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। ছাত্রজীবনেই প্রমাণ রেখেছেন নেতৃত্ব ছিল তার স্বভাবে। ব্যাংকিংয়ের জগতে প্রবেশ করেছিলেন যেভাবে, ওই পেশায় লেগে থাকলে সর্বোচ্চ স্তরেই উঠে যেতেন তরতর করে। কিন্তু না, তিনি অতি শীঘ্রই বুঝে নিয়েছিলেন, তার জন্য অপেক্ষা করছে এক স্বাবলম্বী জীবনের দুরূহ, অনিশ্চিত পথ। মনে হয়, ব্যাংকিংয়ের তৈরি রাজপথ ছেড়ে নিজের জন্য পথ তৈরি করার সংকল্প গ্রহণ করতে তিনি আদৌ দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার স্ত্রীর সমর্থন ও সহযোগিতা পুরোমাত্রায় ছিল বলেই ধরে নিচ্ছি। তার নিজের পথ বলতে আমি প্রধানত সাংবাদিকতার কথাই বলছি, যদিও এমন দাবি করছি না যে, সাংবাদিকতায় তিনি সর্বসমর্পিত ছিলেন। সাংবাদিকতার বাইরেও তার কর্মক্ষেত্র ছিল, তার রাজনীতি ছিল, চা বাগান ছিল, আরও কী কী ছিল, সব খবর আমার জানা নেই। যে অর্থে মওলানা আকরম খাঁ বা সওগাতের নাসিরুদ্দীন সাংবাদিকতা করেছেন, শুধুই সাংবাদিকতা, অবশ্য মওলানা সাহেব একই সঙ্গে রাজনীতিও করেছেন, সে অর্থে আহমদুল কবির ‘প্রকৃত সাংবাদিকতা করেছেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তিনি কি কখনও সম্পাদকের চেয়ারে বসে সম্পাদকীয় লিখেছেন বা প্রতিদিনের কাগজের রূপরেখা স্থির করে দিয়েছেন? এর চেয়ে যা জরুরি কথা, তিনি তার পত্রিকাকে সচল করার লক্ষ্যে যা করার, সবই করেছেন। সর্বোপরি, তিনি তার পত্রিকার চরিত্র বেঁধে নিয়েছেন- বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আনুগত্য। এই চরিত্র নিয়ে ‘সংবাদ’-এর জন্ম হয়নি। কিন্তু ‘সংবাদ’-এর যারা জন্মদাতা, তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে পেছনে ফেলে ‘সংবাদ’ যে অল্পদিনেই গণতন্ত্র ও উদারনীতির প্রবক্তা হয়ে দাঁড়াল, সেই চরিত্র পরিবর্তনে তার ভূমিকা ছিল মুখ্য। অন্যরাও ছিলেন ওই চরিত্র পরিবর্তনে তার সহযোগী। ‘সংবাদ’-এর সেই জন্মান্তর গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে যে তরুণ-অনতিতরুণ সহকর্মী দল নিয়ে গড়ে উঠেছিল সংবাদ পরিবার, সেই পরিবার গঠনেও ধরা পড়ে আহমদুল কবিরের বিচক্ষণতা ও মূল্যবোধের পরিচয়। ‘সংবাদ’, যতদূর জানি, কোনোদিনই ঈর্ষণীয়ভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি। যারা ‘সংবাদ’-এ কাজ করেছেন, সবাইকে কমবেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এরপরও তারা সংবাদ পরিবারের সদস্য পরিচয়কে বড় করে দেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেও সংবাদ ছেড়ে চলে যাননি যারা, তাদের সংখ্যা কম নয়।
আহমদুল কবিরের আর এক পরিচয়, তিনি রাজনীতি করেছেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন ও গণতন্ত্রী পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন। পারিবারিক-সামাজিক পরিচয় যে তাকে কোন রক্ষণশীল দলের দিকে ঠেলে দেয়নি; যারা কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের হাতে হাত মেলাতে প্রলুব্ধ করেনি; বরং বাম চিন্তার ধারক একটি ছোট দল নিয়েই যে তিনি চলেছেন, এ তার পরিচয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তিনি রাজনীতি করলেও ক্ষমতার রাজনীতি করেননি। তা যদি- করতেন, তাহলে তাকে বেছে নিতে হতো দুটি বড় দলের একটিকে। ও পথে না গিয়ে তিনি নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি নিষ্ঠ থেকেছেন। তবে এটা আমাদের ও দেশের দুর্ভাগ্য যে, এভাবে প্রান্তিক রাজনীতির জগতে বিচরণ করে, তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ে দেশের রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ হারিয়েছেন। চলমান রাজনীতির যে চরিত্র, তার পক্ষে দুটি বড় দলের কোনটিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কথা ছিল না। এখানে ব্যক্তিত্বের সমাদর আছে বলে মনে হয় না। যার মধ্যে যতটুকু বোধ-মেধা-ব্যক্তিত্ব আছে, সবগুলো শিকেয় তুলে রেখে এখানে এসে এক নিরীহ, নির্বিষ, নিরামিষ অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা যায়। সেটা সম্ভব হতো না আহমদুল কবিরের পক্ষে। আমি যদি তাকে সঠিক চিনে থাকি, আমি তাকে কল্পনা করতে পারি একজন দক্ষ কূটনীতিক, একজন দক্ষ পররাষ্ট্র বা অর্থমন্ত্রী হিসেবে। তবে তার মেধা-যোগ্যতার পরিপূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ দেবে, সে রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি হয়নি। বন্ধ্যা রাজনীতি এভাবেই দেশকে বঞ্চিত করে প্রকৃত মেধাবী মানুষের সেবা থেকে। মাঝারি ও ছোট মাপের মানুষ যখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়, তখন রাজনীতি যে মেধার দাবি করে, কেউ তার খোঁজ নেয় না, যদিও হাত বাড়ালেই সে মেধার নাগাল পাওয়া যায়। এক অবিশ্বাস্য চরিত্রহীনতার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, আহমদুল কবির সেই জগতে তার বিশ্বাস ও আদর্শকে সমুন্নত রেখেই চলেছেন, এই গৌরব তার প্রাপ্য। রাজনীতির এই দুরবস্থা আর এর মধ্যে রাজনীতিক পরিচয়ে তার অবস্থান। এতদসত্ত্বেও তাকে সানাউল হক কীভাবে একজন সফল ব্যক্তি বলে শনাক্ত করলেন? একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পরিচয়ে চিনলেন? সানাউল হক যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ আমরা। পাচ্ছি সেই ব্যক্তিটির মৃত্যুর পর। বড় দলে থাকলেই যে বড় মানুষ হওয়া যায় না, ছোট দলে থেকেও সবার চোখে বড় হওয়া যায়, সর্বজন শ্রদ্ধার পাত্র হওয়া যায়, আর সেটা সম্ভব হয় চরিত্র গৌরবের কারণে, সেই সত্যকেই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম আরও একবার। একসময় আহমদুল কবির ভেবেছিলেন, ‘সংবাদ’ ভবন থেকে একটি সাহিত্যপত্র বের করবেন। সেই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি সম্ভবত বজলুর রহমানের পরামর্শ মতো বেছে নিলেন আমাকে। প্রস্তাবটি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করলেন বজলুর রহমান। এরপর কথা হলো কবির সাহেবের সঙ্গে। আমি অভিভূত হলাম তার উৎসাহ দেখে। প্রায় পাঁচ বছরকাল আমি সেই পত্রিকা ‘দীপঙ্কর’কে একটি সাহিত্যপত্র হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছি। সেই সুবাদে তাকে কাছে থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছি, এ আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি।
আত্মপ্রচারবিমুখ আহমদুল কবির যে বাংলাদেশের দুর্দিনের একজন সৎ, সাহসী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার মৃত্যু যে দেশের জন্য বড় ক্ষতি এই উপলব্ধি আমার ও আমার মতো অসংখ্য মানুষের। আমার ও আমাদের আশা, দৈনিক সংবাদ তার আদর্শের প্রতীক হয়ে থাকবে, তার আদর্শের প্রদীপ হয়ে জ্বলবে।
(সংক্ষেপিত। লেখাটি নেয়া হয়েছে আহমদুল কবির স্মারকগ্রন্থ থেকে।)
[প্রয়াত লেখক ছিলেন দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক]
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী
বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২
একসময় ছিলাম আহমদুল কবিরের নিকট প্রতিবেশী। তিনি থাকেন ইন্দিরা রোডে, আমি উত্তরায়। আমার সেই দেখা করার ইচ্ছাটির অপমৃত্যু ঘটল হঠাৎ তার মৃত্যু সংবাদে। বলতে বাধা নেই, এই মৃত্যু সংবাদ আমাকে রীতিমতো ধাক্কাই দিয়েছে। এতদিন ধরে তাকে দেখে আসছি, তার মধ্যে অসুস্থতার, এমনকি দুর্বলতার চিহ্নমাত্র চোখে পড়েনি। অমন একহারা বলিষ্ঠ নির্মেদ শরীর, অমন ঋদ্ধ কণ্ঠস্বর, এমন স্থির অকম্প উচ্চারণ- কে বলবে এই মানুষটির মৃত্যু আসন্ন।
প্রয়াত কবি সানাউল হকের সঙ্গেও আমার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। একদিন তিনি তার বন্ধুদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, এদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ব্যক্তি হলেন আহমদুল কবির। ব্যাখ্যা করে বলেননি, তবে কী বলতে চান, মনে হয় আমি ঠিকই বুঝেছিলাম। তিনি শুধু বৈষয়িক সাফল্যের কথাই বলেননি, জীবনের সার্বিক সাফল্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। বোধহয় বলতে চেয়েছিলেন, সবার সব ইচ্ছা পূরণ হয় না, আহমদুল কবির সেদিক দিয়ে পেয়েছেন সার্থকতার স্বাদ। কী ইচ্ছা ছিল আহমদুল কবিরের? কোনোদিন জিজ্ঞেস করার সুযোগ হয়নি। সার্থকতার কোন সংজ্ঞা কি জেনেছিলেন আহমদুল কবির? প্রশ্নটি আমাদের মনের মধ্যে স্পষ্ট রেখায় অঙ্কিত হয় না। একজনের সব ইচ্ছাই পূরণ হলো, অন্যের দৃষ্টিতে তাই তাকে সার্থক মানুষ নাও দেখাতে পারে। কেউ মানুষ হিসেবে সফল কিনা সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছাপূরণের ওপর নির্ভর করে না। সেটা নির্ভর করে, অন্যদের দৃষ্টিতে তিনি সফল কিনা তার ওপর। সানাউল হকের চোখে, তার বিশিষ্ট বন্ধুদের মধ্যেও আহমদুল কবির ছিলেন সফলতার নিরিখে এক নম্বর। আমি এর ব্যাখ্যায় বলব, সানাউল হক দেখতে পেয়েছিলেন অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে কবির সাহেব সমাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন এবং সেটা তিনি হয়েছিলেন তার নিজের গুণে, নিজের কর্মফলে, নিজের নিষ্ঠার পুরস্কার হিসেবে, কোন অলৌকিক সৌভাগ্যের কারণে নয়।
তবে অবশ্যই জন্মসূত্রে সৌভাগ্যবান ছিলেন আহমদুল কবির। পারিবারিক ঐতিহ্যের এমন সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় ক’জন? ছাত্রজীবন শেষ করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। ছাত্রজীবনেই প্রমাণ রেখেছেন নেতৃত্ব ছিল তার স্বভাবে। ব্যাংকিংয়ের জগতে প্রবেশ করেছিলেন যেভাবে, ওই পেশায় লেগে থাকলে সর্বোচ্চ স্তরেই উঠে যেতেন তরতর করে। কিন্তু না, তিনি অতি শীঘ্রই বুঝে নিয়েছিলেন, তার জন্য অপেক্ষা করছে এক স্বাবলম্বী জীবনের দুরূহ, অনিশ্চিত পথ। মনে হয়, ব্যাংকিংয়ের তৈরি রাজপথ ছেড়ে নিজের জন্য পথ তৈরি করার সংকল্প গ্রহণ করতে তিনি আদৌ দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার স্ত্রীর সমর্থন ও সহযোগিতা পুরোমাত্রায় ছিল বলেই ধরে নিচ্ছি। তার নিজের পথ বলতে আমি প্রধানত সাংবাদিকতার কথাই বলছি, যদিও এমন দাবি করছি না যে, সাংবাদিকতায় তিনি সর্বসমর্পিত ছিলেন। সাংবাদিকতার বাইরেও তার কর্মক্ষেত্র ছিল, তার রাজনীতি ছিল, চা বাগান ছিল, আরও কী কী ছিল, সব খবর আমার জানা নেই। যে অর্থে মওলানা আকরম খাঁ বা সওগাতের নাসিরুদ্দীন সাংবাদিকতা করেছেন, শুধুই সাংবাদিকতা, অবশ্য মওলানা সাহেব একই সঙ্গে রাজনীতিও করেছেন, সে অর্থে আহমদুল কবির ‘প্রকৃত সাংবাদিকতা করেছেন কিনা আমি নিশ্চিত নই। তিনি কি কখনও সম্পাদকের চেয়ারে বসে সম্পাদকীয় লিখেছেন বা প্রতিদিনের কাগজের রূপরেখা স্থির করে দিয়েছেন? এর চেয়ে যা জরুরি কথা, তিনি তার পত্রিকাকে সচল করার লক্ষ্যে যা করার, সবই করেছেন। সর্বোপরি, তিনি তার পত্রিকার চরিত্র বেঁধে নিয়েছেন- বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আনুগত্য। এই চরিত্র নিয়ে ‘সংবাদ’-এর জন্ম হয়নি। কিন্তু ‘সংবাদ’-এর যারা জন্মদাতা, তাদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে পেছনে ফেলে ‘সংবাদ’ যে অল্পদিনেই গণতন্ত্র ও উদারনীতির প্রবক্তা হয়ে দাঁড়াল, সেই চরিত্র পরিবর্তনে তার ভূমিকা ছিল মুখ্য। অন্যরাও ছিলেন ওই চরিত্র পরিবর্তনে তার সহযোগী। ‘সংবাদ’-এর সেই জন্মান্তর গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ পর্বে যে তরুণ-অনতিতরুণ সহকর্মী দল নিয়ে গড়ে উঠেছিল সংবাদ পরিবার, সেই পরিবার গঠনেও ধরা পড়ে আহমদুল কবিরের বিচক্ষণতা ও মূল্যবোধের পরিচয়। ‘সংবাদ’, যতদূর জানি, কোনোদিনই ঈর্ষণীয়ভাবে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেনি। যারা ‘সংবাদ’-এ কাজ করেছেন, সবাইকে কমবেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এরপরও তারা সংবাদ পরিবারের সদস্য পরিচয়কে বড় করে দেখেছেন। ত্যাগ স্বীকার করেও সংবাদ ছেড়ে চলে যাননি যারা, তাদের সংখ্যা কম নয়।
আহমদুল কবিরের আর এক পরিচয়, তিনি রাজনীতি করেছেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হয়েছেন ও গণতন্ত্রী পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন। পারিবারিক-সামাজিক পরিচয় যে তাকে কোন রক্ষণশীল দলের দিকে ঠেলে দেয়নি; যারা কায়েমি স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের হাতে হাত মেলাতে প্রলুব্ধ করেনি; বরং বাম চিন্তার ধারক একটি ছোট দল নিয়েই যে তিনি চলেছেন, এ তার পরিচয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তিনি রাজনীতি করলেও ক্ষমতার রাজনীতি করেননি। তা যদি- করতেন, তাহলে তাকে বেছে নিতে হতো দুটি বড় দলের একটিকে। ও পথে না গিয়ে তিনি নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি নিষ্ঠ থেকেছেন। তবে এটা আমাদের ও দেশের দুর্ভাগ্য যে, এভাবে প্রান্তিক রাজনীতির জগতে বিচরণ করে, তিনি রাজনৈতিক পরিচয়ে দেশের রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ হারিয়েছেন। চলমান রাজনীতির যে চরিত্র, তার পক্ষে দুটি বড় দলের কোনটিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার কথা ছিল না। এখানে ব্যক্তিত্বের সমাদর আছে বলে মনে হয় না। যার মধ্যে যতটুকু বোধ-মেধা-ব্যক্তিত্ব আছে, সবগুলো শিকেয় তুলে রেখে এখানে এসে এক নিরীহ, নির্বিষ, নিরামিষ অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকা যায়। সেটা সম্ভব হতো না আহমদুল কবিরের পক্ষে। আমি যদি তাকে সঠিক চিনে থাকি, আমি তাকে কল্পনা করতে পারি একজন দক্ষ কূটনীতিক, একজন দক্ষ পররাষ্ট্র বা অর্থমন্ত্রী হিসেবে। তবে তার মেধা-যোগ্যতার পরিপূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ দেবে, সে রাজনৈতিক ধারার সৃষ্টি হয়নি। বন্ধ্যা রাজনীতি এভাবেই দেশকে বঞ্চিত করে প্রকৃত মেধাবী মানুষের সেবা থেকে। মাঝারি ও ছোট মাপের মানুষ যখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়, তখন রাজনীতি যে মেধার দাবি করে, কেউ তার খোঁজ নেয় না, যদিও হাত বাড়ালেই সে মেধার নাগাল পাওয়া যায়। এক অবিশ্বাস্য চরিত্রহীনতার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতি, আহমদুল কবির সেই জগতে তার বিশ্বাস ও আদর্শকে সমুন্নত রেখেই চলেছেন, এই গৌরব তার প্রাপ্য। রাজনীতির এই দুরবস্থা আর এর মধ্যে রাজনীতিক পরিচয়ে তার অবস্থান। এতদসত্ত্বেও তাকে সানাউল হক কীভাবে একজন সফল ব্যক্তি বলে শনাক্ত করলেন? একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পরিচয়ে চিনলেন? সানাউল হক যে ভুল করেননি, তার প্রমাণ আমরা। পাচ্ছি সেই ব্যক্তিটির মৃত্যুর পর। বড় দলে থাকলেই যে বড় মানুষ হওয়া যায় না, ছোট দলে থেকেও সবার চোখে বড় হওয়া যায়, সর্বজন শ্রদ্ধার পাত্র হওয়া যায়, আর সেটা সম্ভব হয় চরিত্র গৌরবের কারণে, সেই সত্যকেই আমরা প্রত্যক্ষ করলাম আরও একবার। একসময় আহমদুল কবির ভেবেছিলেন, ‘সংবাদ’ ভবন থেকে একটি সাহিত্যপত্র বের করবেন। সেই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি সম্ভবত বজলুর রহমানের পরামর্শ মতো বেছে নিলেন আমাকে। প্রস্তাবটি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করলেন বজলুর রহমান। এরপর কথা হলো কবির সাহেবের সঙ্গে। আমি অভিভূত হলাম তার উৎসাহ দেখে। প্রায় পাঁচ বছরকাল আমি সেই পত্রিকা ‘দীপঙ্কর’কে একটি সাহিত্যপত্র হিসেবে চালানোর চেষ্টা করেছি। সেই সুবাদে তাকে কাছে থেকে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছি, এ আমি আমার সৌভাগ্য মনে করি।
আত্মপ্রচারবিমুখ আহমদুল কবির যে বাংলাদেশের দুর্দিনের একজন সৎ, সাহসী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তার মৃত্যু যে দেশের জন্য বড় ক্ষতি এই উপলব্ধি আমার ও আমার মতো অসংখ্য মানুষের। আমার ও আমাদের আশা, দৈনিক সংবাদ তার আদর্শের প্রতীক হয়ে থাকবে, তার আদর্শের প্রদীপ হয়ে জ্বলবে।
(সংক্ষেপিত। লেখাটি নেয়া হয়েছে আহমদুল কবির স্মারকগ্রন্থ থেকে।)
[প্রয়াত লেখক ছিলেন দেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক]