alt

উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংক খাতে আবার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

রেজাউল করিম খোকন

: বুধবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২২

আবারও আলোচনায় এসেছে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি। ইসলামী ব্যাংক থেকে কাগুজে কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা প্রকাশের পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তা আদায় ও বিচারের কতটা অগ্রগতি হয়েছে, বিষয়টিও সামনে আসছে। অন্য কোনো বিষয়ে নজর না দিয়ে এখানে শুধু কয়েকটি ব্যাংক সাবাড়কারীর বিচারের কথাই বলা যায়। এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও প্রশ্ন করছেন-তারা কি শুধু দর্শক হয়ে ব্যাংক খাতের লুট করা দেখবেন?

বিচারপতিদের ক্ষোভ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে তিরস্কারের ঘটনাটি ঘটল কমিশনের চেয়ারম্যান ‘বিশ্ব রেকর্ড করার মতো রাঘববোয়াল ধরার’ দাবি করার পর সপ্তাহ না পেরোতেই। এই কমিশনেরই একজন সাবেক কমিশনার বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক এবং ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে সাফাই দিতে গিয়ে তিনি বলেছেনÑ ‘সবকিছু নিয়ম মেনেই হয়েছে’।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসিক ব্যাংক লোপাটের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কেন শেষ হচ্ছে না, সেই বিষয়েও। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের আগে এবং পরে আরও যেসব ব্যাংকে কেলেঙ্কারি হয়েছে সেগুলোতে কি কিছু হয়েছে? সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকেরা তো সবাই বহাল তবিয়তে আছেন, রাজনীতি করছেন।

বলাবাহুল্য যে, উদ্যোক্তারা ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রথমসারির নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, তার পরিবার, স্বজন ও সহযোগী। শুধু ব্যাংকটিকে নতুন নামে বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে, যা এখনো সফল হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারছে না। দেশে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়নি বা বন্ধ হয়নি বলে মন্ত্রী বা আমলারা দাবি করেন। তারা যে তথ্যটি আড়াল করেন তা হলোÑ রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও বিশেষ ব্যবস্থায় এগুলোকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

এমনকি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অনাদায়ী ঋণ অবলোপন ও খেলাপি ঋণের বোঝা সামলাতে দফায় দফায় করদাতাদের টাকা দিয়ে মূলধনের ঘাটতি পূরণ না করলে সেগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। ওই টিকিয়ে রাখার মূল্য কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষই দিচ্ছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ, তা জানতে চেয়েছেন। তার পূর্বসূরিও হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকাকে কোনো টাকাই মনে করেননি। লক্ষ-কোটি টাকার বাজেট তৈরির আত্মতৃপ্তিতে তখন তার কাছে হাজার কোটির সংখ্যা গণনাযোগ্য ছিল না।

ব্যাংকিং খাত নিয়ে যেসব নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে আর কত দিন সংকট নেই কথাটা মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে? অর্ধডজনের বেশি ব্যাংক একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকার আর কোনো নজির বিশ্বের কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি নানা নামে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আইন ও নিয়মকানুন মানলে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারে ২১৫ কোটি টাকা।

এর মানে হচ্ছে যতটা পাওয়ার যোগ্য, তার চেয়ে অন্তত ১৩৯ গুণ বেশি ঋণ তারা আদায় করতে পেরেছে অদৃশ্য ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে। ২০১৭ সালে নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেয় ব্যবসায়ী গ্রুপটি। আরেকটি বিষয় হলো ঋণখেলাপিদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। পৃথিবীর অনেক দেশে ঋণখেলাপিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, বিদেশ ভ্রমণের জন্য তারা বিমানের টিকিটও পান না; কিন্তু আমাদের দেশে ঋণখেলাপিরা সর্বত্র দাপট দেখিয়ে বেড়ান, এক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ থাকা সত্ত্বেও অন্য ব্যাংক থেকে তাদের ঋণ নিতে কোনো অসুবিধা হয় না। যে সমাজে ঋণখেলাপিদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়, সেই সমাজে খেলাপি ঋণ কমার কোনো কারণ নেই। সরকারের নীতিনির্ধারকরা খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে নানা আওয়াজ তুললেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। দুদকের বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগ হলো, সরকার যে মামলাগুলো সচল রাখতে আগ্রহী, তারা শুধু সেগুলোর তদন্ত করে, বাকিগুলো হিমাগারে চলে যায়।

গত এক যুগের প্রধান ঘটনাগুলো তালিকা করলে প্রথমেই আসবে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা। এরপরই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ও প্রাইম ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়ম। এছাড়া আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম, ইউনিয়ন ব্যাংকের বেনামি ঋণ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঘটনা। আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা কয়েক বছর ধরেই আলোচনায়।

বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার প্রবণতাও বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হচ্ছে জামানত ছাড়া। অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হচ্ছেন। একই ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন। দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাই এর প্রধান কারণ। দেশে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার। দেওয়া হয়েছে একাধিকবার ঋণ তফসিলের সুবিধা।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হওয়া সংজ্ঞা হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। দেশে প্রথম খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাটি ছিল ১৯৯৪ সালের। এরপর থেকে যতগুলো সরকার এসেছে, সবাই এর সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আবার খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ কতবার পুনঃতফসিল করা যাবে, তারও পরিবর্তন করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। খেলাপি ঋণ নিয়ে এবার সত্যিকারের নতুন এক বিপদে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এত দিন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ বাড়তে দেওয়া হয়েছে, আর এখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যাংক খাতে। এখন দুষ্ট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক ভালো ব্যবসায়ীও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে সামনে খেলাপি ঋণ আরও বেশি বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সরকারকে বলতেন ‘খেলাপিবান্ধব সরকার’। শুরু থেকেই খেলাপিবান্ধব পরিবেশের কারণে দেশে হয়েছে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেড়েছে খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে অর্থ লুটপাটের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কোনো শাস্তিই এখানে হয় না। চুনোপুঁটিদের শুধু জেলে থাকতে হয়। অন্যরা থাকেন বহাল তবিয়তে, আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে। ফলে আদালত যা-ই বলুন না কেন, শেখ আবদুল হাইয়ের মতো যারা আছেন, তাদের চিন্তিত হওয়ার আসলে কিছু নেই।

অথচ পাবনায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সামান্য টাকার জন্য সাধারণ কৃষককে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা অমানবিক। অথচ দেশে রাঘববোয়ালদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের তোয়াজ করে চলা হয়। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের কাছ থেকে ওই কৃষকেরা ঋণ নিয়েছিলেন। অবশ্য ঋণের টাকা পরিশোধ করার পরও তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে দাবি কৃষকদের। করোনার সময় কৃষকেরা দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অথচ ২৫ হাজার টাকার জন্য তাদের কোমরে দড়ি দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যদিও গ্রেপ্তার হওয়া কৃষকের পরিবারের সদস্যরা বলছেনÑ তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে প্রশাসন গরিব কৃষকের কথা আমলে নেয়নি।

এখন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরাও প্রশ্ন করছেনÑ তারা কি শুধু দর্শক হয়ে ব্যাংক খাতের লুট করা দেখবেন?

গ্রামের অতি সাধারণ দরিদ্র কৃষক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশ তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় আটক করে নিয়ে যায়। অথচ বড় বড় খেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনো ব্যবস্থা নিতে সংকুচিত বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বড় বিচিত্র মনে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের এই বৈপরিত্যমূলক ব্যবস্থা। এর জন্যই কী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিল? এ প্রশ্ন জাগে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। কে দেবে তার যথাযথ জবাব? নাকি তা নিভৃতে কেঁদে যাবে শুধু। ব্যাংক খাতে আর কত অনিয়ম-দুর্নীতি, কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটবে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ব্যাংক খাতে আবার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ

রেজাউল করিম খোকন

বুধবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২২

আবারও আলোচনায় এসেছে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি। ইসলামী ব্যাংক থেকে কাগুজে কোম্পানিকে ঋণ দেওয়ার ঘটনা প্রকাশের পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেসব অনিয়ম হয়েছে, তা আদায় ও বিচারের কতটা অগ্রগতি হয়েছে, বিষয়টিও সামনে আসছে। অন্য কোনো বিষয়ে নজর না দিয়ে এখানে শুধু কয়েকটি ব্যাংক সাবাড়কারীর বিচারের কথাই বলা যায়। এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও প্রশ্ন করছেন-তারা কি শুধু দর্শক হয়ে ব্যাংক খাতের লুট করা দেখবেন?

বিচারপতিদের ক্ষোভ ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে তিরস্কারের ঘটনাটি ঘটল কমিশনের চেয়ারম্যান ‘বিশ্ব রেকর্ড করার মতো রাঘববোয়াল ধরার’ দাবি করার পর সপ্তাহ না পেরোতেই। এই কমিশনেরই একজন সাবেক কমিশনার বর্তমানে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক এবং ব্যাংকটির ঋণ কেলেঙ্কারির বিষয়ে সাফাই দিতে গিয়ে তিনি বলেছেনÑ ‘সবকিছু নিয়ম মেনেই হয়েছে’।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসিক ব্যাংক লোপাটের ঘটনা নিয়ে তদন্ত কেন শেষ হচ্ছে না, সেই বিষয়েও। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের আগে এবং পরে আরও যেসব ব্যাংকে কেলেঙ্কারি হয়েছে সেগুলোতে কি কিছু হয়েছে? সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকেরা তো সবাই বহাল তবিয়তে আছেন, রাজনীতি করছেন।

বলাবাহুল্য যে, উদ্যোক্তারা ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের প্রথমসারির নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, তার পরিবার, স্বজন ও সহযোগী। শুধু ব্যাংকটিকে নতুন নামে বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে, যা এখনো সফল হয়েছে বলে কেউ দাবি করতে পারছে না। দেশে কোনো ব্যাংক দেউলিয়া হয়নি বা বন্ধ হয়নি বলে মন্ত্রী বা আমলারা দাবি করেন। তারা যে তথ্যটি আড়াল করেন তা হলোÑ রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও বিশেষ ব্যবস্থায় এগুলোকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

এমনকি রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অনাদায়ী ঋণ অবলোপন ও খেলাপি ঋণের বোঝা সামলাতে দফায় দফায় করদাতাদের টাকা দিয়ে মূলধনের ঘাটতি পূরণ না করলে সেগুলো টিকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। ওই টিকিয়ে রাখার মূল্য কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষই দিচ্ছে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের অবস্থা কোথায় খারাপ, তা জানতে চেয়েছেন। তার পূর্বসূরিও হলমার্ক কেলেঙ্কারির সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকাকে কোনো টাকাই মনে করেননি। লক্ষ-কোটি টাকার বাজেট তৈরির আত্মতৃপ্তিতে তখন তার কাছে হাজার কোটির সংখ্যা গণনাযোগ্য ছিল না।

ব্যাংকিং খাত নিয়ে যেসব নতুন নতুন তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে আর কত দিন সংকট নেই কথাটা মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে? অর্ধডজনের বেশি ব্যাংক একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকার আর কোনো নজির বিশ্বের কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি নানা নামে দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। আইন ও নিয়মকানুন মানলে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে পারে ২১৫ কোটি টাকা।

এর মানে হচ্ছে যতটা পাওয়ার যোগ্য, তার চেয়ে অন্তত ১৩৯ গুণ বেশি ঋণ তারা আদায় করতে পেরেছে অদৃশ্য ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে। ২০১৭ সালে নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেয় ব্যবসায়ী গ্রুপটি। আরেকটি বিষয় হলো ঋণখেলাপিদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি। পৃথিবীর অনেক দেশে ঋণখেলাপিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকে, বিদেশ ভ্রমণের জন্য তারা বিমানের টিকিটও পান না; কিন্তু আমাদের দেশে ঋণখেলাপিরা সর্বত্র দাপট দেখিয়ে বেড়ান, এক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ থাকা সত্ত্বেও অন্য ব্যাংক থেকে তাদের ঋণ নিতে কোনো অসুবিধা হয় না। যে সমাজে ঋণখেলাপিদের নানাভাবে পুরস্কৃত করা হয়, সেই সমাজে খেলাপি ঋণ কমার কোনো কারণ নেই। সরকারের নীতিনির্ধারকরা খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে নানা আওয়াজ তুললেও বাস্তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। দুদকের বিরুদ্ধে সাধারণ অভিযোগ হলো, সরকার যে মামলাগুলো সচল রাখতে আগ্রহী, তারা শুধু সেগুলোর তদন্ত করে, বাকিগুলো হিমাগারে চলে যায়।

গত এক যুগের প্রধান ঘটনাগুলো তালিকা করলে প্রথমেই আসবে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা। এরপরই বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি, জনতা ও প্রাইম ব্যাংকে বিসমিল্লাহ গ্রুপের অনিয়ম, জনতা ব্যাংকের অ্যাননটেক্স ও ক্রিসেন্ট গ্রুপের ঋণ অনিয়ম। এছাড়া আলোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম, ইউনিয়ন ব্যাংকের বেনামি ঋণ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের ঘটনা। আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের ঘটনা কয়েক বছর ধরেই আলোচনায়।

বড় ঋণগ্রহীতাদের খেলাপি হওয়ার প্রবণতাও বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋণ দেওয়া হচ্ছে জামানত ছাড়া। অনেকেই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হচ্ছেন। একই ব্যক্তি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছেন। দেশে খেলাপি ঋণ বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাই এর প্রধান কারণ। দেশে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার। দেওয়া হয়েছে একাধিকবার ঋণ তফসিলের সুবিধা।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হওয়া সংজ্ঞা হচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা। দেশে প্রথম খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞাটি ছিল ১৯৯৪ সালের। এরপর থেকে যতগুলো সরকার এসেছে, সবাই এর সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। আবার খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ কতবার পুনঃতফসিল করা যাবে, তারও পরিবর্তন করা হয়েছে বেশ কয়েকবার। খেলাপি ঋণ নিয়ে এবার সত্যিকারের নতুন এক বিপদে পড়েছে ব্যাংকিং খাত। এত দিন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণ বাড়তে দেওয়া হয়েছে, আর এখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যাংক খাতে। এখন দুষ্ট ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অনেক ভালো ব্যবসায়ীও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে সামনে খেলাপি ঋণ আরও বেশি বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সরকারকে বলতেন ‘খেলাপিবান্ধব সরকার’। শুরু থেকেই খেলাপিবান্ধব পরিবেশের কারণে দেশে হয়েছে একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেড়েছে খেলাপি ঋণ। সব মিলিয়ে অর্থ লুটপাটের জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কোনো শাস্তিই এখানে হয় না। চুনোপুঁটিদের শুধু জেলে থাকতে হয়। অন্যরা থাকেন বহাল তবিয়তে, আরও বেশি প্রভাবশালী হয়ে। ফলে আদালত যা-ই বলুন না কেন, শেখ আবদুল হাইয়ের মতো যারা আছেন, তাদের চিন্তিত হওয়ার আসলে কিছু নেই।

অথচ পাবনায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে করা মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সামান্য টাকার জন্য সাধারণ কৃষককে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা অমানবিক। অথচ দেশে রাঘববোয়ালদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেই, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাদের তোয়াজ করে চলা হয়। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের কাছ থেকে ওই কৃষকেরা ঋণ নিয়েছিলেন। অবশ্য ঋণের টাকা পরিশোধ করার পরও তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে বলে দাবি কৃষকদের। করোনার সময় কৃষকেরা দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অথচ ২৫ হাজার টাকার জন্য তাদের কোমরে দড়ি দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যদিও গ্রেপ্তার হওয়া কৃষকের পরিবারের সদস্যরা বলছেনÑ তারা ঋণের টাকা পরিশোধ করেছেন। তবে প্রশাসন গরিব কৃষকের কথা আমলে নেয়নি।

এখন সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিরাও প্রশ্ন করছেনÑ তারা কি শুধু দর্শক হয়ে ব্যাংক খাতের লুট করা দেখবেন?

গ্রামের অতি সাধারণ দরিদ্র কৃষক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে তা যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশ তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় আটক করে নিয়ে যায়। অথচ বড় বড় খেলাপির হাজার হাজার কোটি টাকা অনাদায়ী থাকার পরও তাদের বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনো ব্যবস্থা নিতে সংকুচিত বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। বড় বিচিত্র মনে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের এই বৈপরিত্যমূলক ব্যবস্থা। এর জন্যই কী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়েছিল? এ প্রশ্ন জাগে এ দেশের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে। কে দেবে তার যথাযথ জবাব? নাকি তা নিভৃতে কেঁদে যাবে শুধু। ব্যাংক খাতে আর কত অনিয়ম-দুর্নীতি, কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটবে?

[লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার]

back to top