alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ বিতর্ক

রিয়াজ মোহাম্মদ নোমান

: বৃহস্পতিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব অপসারণ প্রসঙ্গে সরব হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। বরিশাল-৩ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বিবর্তনবাদ সম্পর্কে সংসদে অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়ে দৃষ্টি কেড়েছেন আমজনতার। এরই সূত্র ধরে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় বক্তারা বিবর্তনবাদ অপসারণের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন।

বিবর্তনের একটি ছবি তুলে ধরে দেখানো হচ্ছে- পাঠ্যপুস্তকে দেখানো হয়েছে বানর থেকে মানুষের জন্ম। অথচ পাঠ্যপুস্তকের কোথাও এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। পাঠ্যপুস্তকে বোঝানো হয়েছে ছবিটি মানব প্রজাতি বিবর্তনের একটি ছবি; মানব প্রজাতির শুরুর ধাপ থেকে আজকের অবস্থান পর্যন্ত বিবর্তন হওয়ার একটি চিত্র।

ডারউইন তার ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইতে কোথাও লিখেননি, বানর থেকে মানুষ হয়েছে। তবে হ্যাঁ বলা আছে, শিম্পাঞ্জিরা আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশী ছিল। প্রায় ষাট লাখ বছর আগে তারা আমাদের গ্রেট এপ বা কমন এনসিস্টর থেকে আলাদা হয়ে যায়।

বিবর্তন একটি সময়সাপেক্ষ জটিল প্রক্রিয়া। বিবর্তনবাদ শুধু মানব প্রজাতির বিজ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে না, বিবর্তন গোটা জীব বিজ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে। বিবর্তন প্রকৃতির নিয়ন্ত্রিত সমস্ত কার্যপ্রক্রিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করে। জেনেটিক্স, জিনোমিক্স, প্রত্নতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব এসব বিবর্তনবাদ তত্ত্বেরই অংশ। কী করে শরীরের রোগ-জীবাণু তাদের গঠন প্রকৃতি বদলায়, এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া তাদের রূপ পরিবর্তন করে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়, শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে এন্টিবডি বা ইউমিনিটি তৈরি হওয়া অর্থাৎ বিবর্তনবাদ জার্মস তত্ত্বকেও প্রতিনিধিত্ব করে।

কুষ্ঠ রোগকে একটা সময় দেবতাদের অভিশাপ বলে মনে করা হতো- ঘৃণা করা হতো তাদের। কুষ্ঠরোগীকে সামাজিকভাবে বয়কট করে জীবনযাপন অতিষ্ঠ করে ফেলা হতো। ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসন যুগান্তকারী গবেষণায় প্রমাণ করেন কুষ্ঠ আসলে জীবাণুঘটিত ব্যাধি যা মূলত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। সেই থেকে কুষ্ঠ রোগীদের বিষয়ে মানুষের ইতিবাচক ধারণা আসতে শুরু করেছে।

জীবাণুর রূপান্তর ঘটে- যা একটা সময় বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও এখন তা প্রমাণিত সত্য। এই চিরন্তন সত্যটি বিবর্তনবাদের অংশ। যা দ্বারা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিবর্তন তত্ত্বকে বলা যায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুঁটি।

পাঠ্যপুস্তক থেকে বিবর্তনবাদ অপসারণ করা হলে The cell theory, The germ theory, The heliocentric theory ইত্যাদির মতো বহু সুপ্রতিষ্ঠিত পোক্ত মতবাদও পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ করার প্রশ্ন আসে- কেননা বিবর্তন এসবের চাইতেও শক্তিশালী মতবাদ। গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের প্রায় ৯৭ শতাংশ বিজ্ঞানী বিবর্তনবাদকে মেনে নিয়ে বিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের এই মেনে নেয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়াতে ৩০ লাখ বছর পূর্বের একটি ‘অস্ট্রালোপিথেকাস’ মানুষরে কংকাল পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন লুসি। লুসির কংকাল মানব প্রজাতির মাঝে ব্যাপক হৈ চৈ সৃষ্টি করে। লুসির কংকাল স্পষ্ট করে আজ থেকে ৪০ লাখ বছর পূর্বে আফ্রিকায় অস্ট্রালোপিথেকাস মানবের বিচরণ ছিল এই পৃথিবীতে। ধর্মীয় মৌলবাদী কিছু সংগঠন সে সময় বিবর্তনবাদকে পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলার জন্য তোড়জোড়ও শুরু করে।

১৮৫৬ সালে জার্মানের নিয়ান্ডার্থাল উপত্যাকায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় ৭৫ হাজার বছর পূর্বের ‘নিয়ান্ডার্থাল’ মানুষের মাথার খুলি। সেখান থেকে নিয়ান্ডার্থাল সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, পরে ১৯০৮ সালে ফ্রান্সের মাটিতে পাওয়া যায় আস্ত ‘নিয়ান্ডার্থালের’ কংকাল। সেই কংকাল গবেষণার ফলাফল আমাদের মাঝে নতুন ধারণার জন্ম দেয় তাই আমরা এখন জানতে পারি ‘নিয়ান্ডার্থাল’ বা তার সমসাময়িকের মানব প্রজাতির ছিল লম্বাটে মাথা, চ্যাপ্টা মুখ, উঁচু চোয়াল বিশিষ্ট বানর এবং মানুষের মাঝামাঝি আকৃতি বিশিষ্ট মানব প্রজাতি।

২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেন্স দ্বীপের মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় হোমো ফ্লোরিয়েন্সিস প্রজাতির মানুষ। ১৯৭৪ সালে আফ্রিকার মাটি খুঁড়ে পাওয়া ‘অস্ট্রালোপিথেকাস মানব’ থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে ফ্রান্সের মাটিতে পাওয়া ‘ফ্লোরিয়েন্সিস প্রজাতি’ মানব বিবর্তনের নতুন নতুন অধ্যায়ের প্রমাণ করে। ডিএনএ টেস্ট আর কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি এ সমস্ত ভূরিভূরি ফসিল, কংকাল, হাড়গোড় আর মাথার খুলি প্রমাণ করে এই পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ ছিল লাখ লাখ বছর আগে থেকেই।

এখানে একটা জিনিস না বললেই নয়- মানুষের সঙ্গে শিম্পাঞ্জির ডিএনএ’র ৯৮.৬ শতাংশ মিল রয়েছে, আর ওরাং-ওটাং প্রাণীর সঙ্গে আমাদের ডিএনএ’র ৯৭% মিল রয়েছে। শারীরিক গঠন অনুযায়ী মানুষের সঙ্গে শিম্পাঞ্জি ওরাং-ওটাংয়ের ব্যাপক মিল থাকার কারণে বানর সাদৃশ্য সব প্রজাতিকে মানবজাতির জ্ঞাতি ভাই মনে করে অনেকে একটি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন যা মোটেও সত্য নয়। মূলত এরা হচ্ছে ৬০ লাখ বছর পূর্বে হ্যামিনিনি উপগোত্র থেকে পৃথক হওয়া পোঙ্গো (বানরের মতো দেখতে এক প্রজাতি) ‘গণের’ প্রাণিকুল।

এ মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আমাদের বেশির ভাগ মানুষেরই অজানা। অজানা থাকা দোষের কিছু নয় তবে না জেনে বিভ্রান্তি ছড়ানোটা ভয়ংকর বিষয়। বিবর্তনবাদ একটি তত্ত্ব যা গোটা বিশ্বের বিদ্যমান চার হাজার দুইশ ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করে। অর্থাৎ গোটা সৃষ্টি তত্ত্বের বিরোধিতা করে। বিবর্তনবাদ সৃষ্টিতত্ত্বের বিপরীতে ভিন্ন একটি মত। যেখানে বলা হয়েছে প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে। হাজার-কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হচ্ছে। শৈবাল থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাচক্রে কোটি কোটি বছর ধরে রূপান্তরের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একপক্ষের যুক্তি শুনে আমরা একটি ভ্রান্ত ধারণা গ্রহণ করে বসে আছি- যেখানে বলা হয়েছে বানর থেকে মানুষ হয়েছে, যা মোটেও সত্য নয়। তাই সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত এ বিষয়ে দক্ষ কাউকে সামনে এনে উভয়পক্ষের যুক্তি বা মত প্রকাশের জায়গা তৈরি করা। বিবর্তনবাদ আসলে কী ইঙ্গিত দেয়, বিবর্তনবাদ কি শুধুই একটি কল্পিত ধারণা? এমন সব প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র ওই বিষয়ের ওপর গবেষণারত বিদগ্ধ একজন বিজ্ঞই দিতে পারবেন। কোনো রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, কিংবা কোনো ধর্মীয় বক্তা বিজ্ঞানের এ জটিল প্রক্রিয়ার বিস্তর ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বায়দূষণে অকালমৃত্যু

লাশের বদলে লাশই যদি চুড়ান্ত হয়, তবে রাষ্ট্রের দরকার কী?

ভিক্ষাবৃত্তি যেখানে অন্যতম পেশা

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

আদিবাসীদের ভূমি অধিকার ও নিরাপত্তা সংকট

“মুনীর চৌধুরীর কবর...”

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

জলবায়ু সংকট ও খাদ্য নিরাপত্তা

স্বাধীন তদন্ত কমিশন দাবির নেপথ্যে কি দায়মুক্তি?

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

প্রহর গুনি কোন আশাতে!

বিজয়ের রক্তাক্ত সূর্য ও আমাদের ঋণের হিসাব

বিজয় দিবস: নতুন প্রজন্মের রাষ্ট্রচিন্তার দিকদর্শন

ছবি

আমাদের বিজয়ের অন্তর্নিহিত বার্তা

প্রাণিসম্পদ: দেশীয় জাত, আধুনিক প্রযুক্তি

জমির জরিপ: ন্যায়বিচার প্রসঙ্গ

বুদ্ধিজীবী হত্যা ও এর স্বরূপ সন্ধানে

উন্নয়নের আড়ালে রোগীর ভোগান্তি: আস্থা সংকটে স্বাস্থ্যসেবা

ছবি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস: অমিত শক্তির উৎস

ছবি

বেগম রোকেয়া এখনো জাগ্রত

পশ্চিমবঙ্গ: বামপন্থীদের ‘বাংলা বাঁচাও’-এর ডাক

সবার বাংলাদেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হবে?

বিদেশি বিনিয়োগ : প্রয়োজন আইনের শাসন ও সামাজিক স্থিতি

চিকিৎসা যখন অসহনীয় ব্যয়, তখন প্রতিবাদই ন্যায়

মস্কোর কৌশলগত পুনর্গঠন

“সব শিয়ালের এক রা’ মারা গেল কুমিরের ছা”

ছবি

বিচূর্ণ দর্পণের মুখ

নিজের চেতনায় নিজেরই ঘা দেয়া জরুরি

ঋণ অবলোপনের প্রভাব

ভেজাল গুড়ের মরণফাঁদ: বাঙালির ঐতিহ্য, জনস্বাস্থ্য ও আস্থার নীরব বিপর্যয়

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

পাঠ্যপুস্তকে বিবর্তনবাদ বিতর্ক

রিয়াজ মোহাম্মদ নোমান

বৃহস্পতিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

ষষ্ঠ শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব অপসারণ প্রসঙ্গে সরব হয়ে উঠেছে গোটা দেশ। বরিশাল-৩ আসনের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য বিবর্তনবাদ সম্পর্কে সংসদে অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়ে দৃষ্টি কেড়েছেন আমজনতার। এরই সূত্র ধরে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় বক্তারা বিবর্তনবাদ অপসারণের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছেন।

বিবর্তনের একটি ছবি তুলে ধরে দেখানো হচ্ছে- পাঠ্যপুস্তকে দেখানো হয়েছে বানর থেকে মানুষের জন্ম। অথচ পাঠ্যপুস্তকের কোথাও এই বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। পাঠ্যপুস্তকে বোঝানো হয়েছে ছবিটি মানব প্রজাতি বিবর্তনের একটি ছবি; মানব প্রজাতির শুরুর ধাপ থেকে আজকের অবস্থান পর্যন্ত বিবর্তন হওয়ার একটি চিত্র।

ডারউইন তার ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিস’ বইতে কোথাও লিখেননি, বানর থেকে মানুষ হয়েছে। তবে হ্যাঁ বলা আছে, শিম্পাঞ্জিরা আমাদের খুব কাছের প্রতিবেশী ছিল। প্রায় ষাট লাখ বছর আগে তারা আমাদের গ্রেট এপ বা কমন এনসিস্টর থেকে আলাদা হয়ে যায়।

বিবর্তন একটি সময়সাপেক্ষ জটিল প্রক্রিয়া। বিবর্তনবাদ শুধু মানব প্রজাতির বিজ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে না, বিবর্তন গোটা জীব বিজ্ঞানকে প্রতিনিধিত্ব করে। বিবর্তন প্রকৃতির নিয়ন্ত্রিত সমস্ত কার্যপ্রক্রিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করে। জেনেটিক্স, জিনোমিক্স, প্রত্নতত্ত্ব, ভূতত্ত্ব এসব বিবর্তনবাদ তত্ত্বেরই অংশ। কী করে শরীরের রোগ-জীবাণু তাদের গঠন প্রকৃতি বদলায়, এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া তাদের রূপ পরিবর্তন করে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়, শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে এন্টিবডি বা ইউমিনিটি তৈরি হওয়া অর্থাৎ বিবর্তনবাদ জার্মস তত্ত্বকেও প্রতিনিধিত্ব করে।

কুষ্ঠ রোগকে একটা সময় দেবতাদের অভিশাপ বলে মনে করা হতো- ঘৃণা করা হতো তাদের। কুষ্ঠরোগীকে সামাজিকভাবে বয়কট করে জীবনযাপন অতিষ্ঠ করে ফেলা হতো। ১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী গেরহার্ড হ্যানসন যুগান্তকারী গবেষণায় প্রমাণ করেন কুষ্ঠ আসলে জীবাণুঘটিত ব্যাধি যা মূলত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। সেই থেকে কুষ্ঠ রোগীদের বিষয়ে মানুষের ইতিবাচক ধারণা আসতে শুরু করেছে।

জীবাণুর রূপান্তর ঘটে- যা একটা সময় বিশ্বাস অবিশ্বাসের দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও এখন তা প্রমাণিত সত্য। এই চিরন্তন সত্যটি বিবর্তনবাদের অংশ। যা দ্বারা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে সংজ্ঞায়িত করা হয়। বিবর্তন তত্ত্বকে বলা যায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের খুঁটি।

পাঠ্যপুস্তক থেকে বিবর্তনবাদ অপসারণ করা হলে The cell theory, The germ theory, The heliocentric theory ইত্যাদির মতো বহু সুপ্রতিষ্ঠিত পোক্ত মতবাদও পাঠ্যপুস্তক থেকে অপসারণ করার প্রশ্ন আসে- কেননা বিবর্তন এসবের চাইতেও শক্তিশালী মতবাদ। গোটা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের প্রায় ৯৭ শতাংশ বিজ্ঞানী বিবর্তনবাদকে মেনে নিয়ে বিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

বিজ্ঞানীদের এই মেনে নেয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়াতে ৩০ লাখ বছর পূর্বের একটি ‘অস্ট্রালোপিথেকাস’ মানুষরে কংকাল পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা তার নাম দেন লুসি। লুসির কংকাল মানব প্রজাতির মাঝে ব্যাপক হৈ চৈ সৃষ্টি করে। লুসির কংকাল স্পষ্ট করে আজ থেকে ৪০ লাখ বছর পূর্বে আফ্রিকায় অস্ট্রালোপিথেকাস মানবের বিচরণ ছিল এই পৃথিবীতে। ধর্মীয় মৌলবাদী কিছু সংগঠন সে সময় বিবর্তনবাদকে পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলার জন্য তোড়জোড়ও শুরু করে।

১৮৫৬ সালে জার্মানের নিয়ান্ডার্থাল উপত্যাকায় মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় ৭৫ হাজার বছর পূর্বের ‘নিয়ান্ডার্থাল’ মানুষের মাথার খুলি। সেখান থেকে নিয়ান্ডার্থাল সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়, পরে ১৯০৮ সালে ফ্রান্সের মাটিতে পাওয়া যায় আস্ত ‘নিয়ান্ডার্থালের’ কংকাল। সেই কংকাল গবেষণার ফলাফল আমাদের মাঝে নতুন ধারণার জন্ম দেয় তাই আমরা এখন জানতে পারি ‘নিয়ান্ডার্থাল’ বা তার সমসাময়িকের মানব প্রজাতির ছিল লম্বাটে মাথা, চ্যাপ্টা মুখ, উঁচু চোয়াল বিশিষ্ট বানর এবং মানুষের মাঝামাঝি আকৃতি বিশিষ্ট মানব প্রজাতি।

২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেন্স দ্বীপের মাটি খুঁড়ে পাওয়া যায় হোমো ফ্লোরিয়েন্সিস প্রজাতির মানুষ। ১৯৭৪ সালে আফ্রিকার মাটি খুঁড়ে পাওয়া ‘অস্ট্রালোপিথেকাস মানব’ থেকে শুরু করে ২০০৩ সালে ফ্রান্সের মাটিতে পাওয়া ‘ফ্লোরিয়েন্সিস প্রজাতি’ মানব বিবর্তনের নতুন নতুন অধ্যায়ের প্রমাণ করে। ডিএনএ টেস্ট আর কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি এ সমস্ত ভূরিভূরি ফসিল, কংকাল, হাড়গোড় আর মাথার খুলি প্রমাণ করে এই পৃথিবীতে মানুষের বিচরণ ছিল লাখ লাখ বছর আগে থেকেই।

এখানে একটা জিনিস না বললেই নয়- মানুষের সঙ্গে শিম্পাঞ্জির ডিএনএ’র ৯৮.৬ শতাংশ মিল রয়েছে, আর ওরাং-ওটাং প্রাণীর সঙ্গে আমাদের ডিএনএ’র ৯৭% মিল রয়েছে। শারীরিক গঠন অনুযায়ী মানুষের সঙ্গে শিম্পাঞ্জি ওরাং-ওটাংয়ের ব্যাপক মিল থাকার কারণে বানর সাদৃশ্য সব প্রজাতিকে মানবজাতির জ্ঞাতি ভাই মনে করে অনেকে একটি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন যা মোটেও সত্য নয়। মূলত এরা হচ্ছে ৬০ লাখ বছর পূর্বে হ্যামিনিনি উপগোত্র থেকে পৃথক হওয়া পোঙ্গো (বানরের মতো দেখতে এক প্রজাতি) ‘গণের’ প্রাণিকুল।

এ মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আমাদের বেশির ভাগ মানুষেরই অজানা। অজানা থাকা দোষের কিছু নয় তবে না জেনে বিভ্রান্তি ছড়ানোটা ভয়ংকর বিষয়। বিবর্তনবাদ একটি তত্ত্ব যা গোটা বিশ্বের বিদ্যমান চার হাজার দুইশ ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করে। অর্থাৎ গোটা সৃষ্টি তত্ত্বের বিরোধিতা করে। বিবর্তনবাদ সৃষ্টিতত্ত্বের বিপরীতে ভিন্ন একটি মত। যেখানে বলা হয়েছে প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে। হাজার-কোটি বছর ধরে বিবর্তিত হচ্ছে। শৈবাল থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাচক্রে কোটি কোটি বছর ধরে রূপান্তরের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

একপক্ষের যুক্তি শুনে আমরা একটি ভ্রান্ত ধারণা গ্রহণ করে বসে আছি- যেখানে বলা হয়েছে বানর থেকে মানুষ হয়েছে, যা মোটেও সত্য নয়। তাই সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত এ বিষয়ে দক্ষ কাউকে সামনে এনে উভয়পক্ষের যুক্তি বা মত প্রকাশের জায়গা তৈরি করা। বিবর্তনবাদ আসলে কী ইঙ্গিত দেয়, বিবর্তনবাদ কি শুধুই একটি কল্পিত ধারণা? এমন সব প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র ওই বিষয়ের ওপর গবেষণারত বিদগ্ধ একজন বিজ্ঞই দিতে পারবেন। কোনো রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, কিংবা কোনো ধর্মীয় বক্তা বিজ্ঞানের এ জটিল প্রক্রিয়ার বিস্তর ব্যাখ্যা দিতে পারবে না।

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top