সিরাজ প্রামাণিক
চেক ডিজঅনার হলেই এখন আর সাজা নয়। প্রতিদানবিহীন হস্তান্তরযোগ্য দলিল বিষয়ে যখন পক্ষগণের মধ্যে যেখানে কোন প্রতিদান (কনসিডারেশন) থাকে না, সেখানে হস্তান্তরযোগ্য দলিল অকার্যকর হিসেবে গণ্য হবে। প্রতিদান ছাড়া যেমন চুক্তি হয় না, তেমনি প্রতিদান ছাড়া কোন হস্তান্তর যোগ্য দলিল কার্যকর করা যাবে না। কাজেই স্বাক্ষরসহ চেক কারও কাছে হস্তগত হলেই কিংবা ব্যাংক ডিজঅনার করলেই চেকের প্রতিদান বা দেনা পাওনা বা লেনদেন প্রমাণ করতে না পারলে মামলায় আসামি খালাস পাবে- এমনটিই বলেছেন উচ্চ আদালত। (লোকমান বনাম আয়ুব আলী এবং রাষ্ট্র মামলা, যা ৩৮ বিএলডি, পৃষ্ঠা ৬১৬,৬১৭-৬২০)।
মামলায় ঘটনায় প্রকাশ এই যে, বাদী কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামির বিরুদ্ধে এই মর্মে নালিশি মামলা দাখিল করেন যে, আসামি বাদীর কাছ থেকে ঋণ হিসেবে ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করার পর উক্ত ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে উক্ত পরিমাণ টাকা সম্বলিত একটি চেক বাদীর অনুকূলে ইস্যু করেন। উক্ত চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিলে ‘সিগনেচার ডিফারস’ অর্থাৎ চেকের স্বাক্ষরে মিল নেই মন্তব্যসহ ডিজঅনার হয়।
এরপর বাদী আসামি বরাবর একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠায়। আসামি উক্ত লিগ্যাল নোটিশ প্রাপ্ত হলেও বাদীর অনুকূলে টাকা পরিশোধের কোন উদ্যোগ নেয় নাই। নালিশটি দায়েরের পর আসামি সমন প্রাপ্ত হয়ে জামিন হলে মামলাটি বিচারের জন্য কুমিল্লার অতিরিক্ত দায়রা জজ, ৪র্থ আদালতে আসলে আদালত উভয়পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিয়ে আসামিকে এ মামলার দায় থেকে খালাস দেয়। আদালত পর্যবেক্ষণে বলে যে, আসামি সাফাই সাক্ষ্যর মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, বাদীর সঙ্গে তার বৈধ কোন লেনদেন বা চেক সম্পর্কিত কোন কনসিডারেশন ছিল না। এরপর বাদী উক্ত রায়ের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে যান। আদালত সেখানেও নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখে। এভাবে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগও আদেশ বহাল রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ আইনজীবীর ৩৪২ ধারা আসামি পরীক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।
অনেক আদালতও সঠিভাবে ৩৪২ ধারায় আসামি পরীক্ষা করেন না। এটাকে শুধুমাত্র ফরমালিটি মনে করে। এজন্য ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামিকে পরীক্ষার সময় শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করে আসামি নির্দোষ দাবি করে কিনা এবং সাফাই সাক্ষী দেবে কিনা। এটা আদৌও আইন সম্মত নয়। হতাশ হতে হয় যখন আপিল আদালত আপিল শুনানির সময় বলে- আপনার দাবি, ঘটনার সময়, কি পরিস্থিতিতে তাকে মিথ্য মামলায় জড়িত করা হয়েছে, চেক সম্পর্কিত বিষয় কোনোরূপ কনসিডারেশন ছিল না তার ব্যাখ্যা ৩৪২ ধারার বিবৃতিতে নেই, তাহলে কিভাবে আসামিকে খালাস দেওয়া যাবে।
৩৪২ ধারা আসামি পরীক্ষা বিবৃতির ওপর ভিত্তি করে মামলা খালাস কিংবা সাজা কমানোর অনেক নজির আছে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলার রায়ে। হাসান আলী বনাম রাষ্ট, এ মামলায় অ্যাপিলেট ডিভিশন শুধুমাত্র ৩৪২ ধারায় আসামির বয়স ৯০ বছর উল্লেখ থাকায় তার সাজা মানবিক দিকে বিবেচনা করে যতদিন হাজতে ছিল তত দিন করে দিয়েছে। হাসান আলী বনাম রাষ্ট্র, ১৫ বিএলডি (এডি) পৃষ্ঠা-৩৭।
অপর এক মামলায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে দন্ড বিধি ৪২০ ধারায় দন্ডাদেশ দিলে আসামি সেই দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে আপিল দায়ের করলে আপিল আদালত তাকে খালাস দেন।
উক্ত খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে বাদী হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। আপিল শুনানি শেষে হইকোর্ট ডিভিশন আপিল নামঞ্জুর করে এবং দায়রা জজ আদালতের রায় বহাল রখেন। হাইকোর্ট ডিভিশন রায়ে উল্লেখ করেন, দায়রা আপিল আদালত ৩৪২ ধারায় আসামির সাফাই সাক্ষী যেখানে আসামি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও সাক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে খালাস দিয়ে কোন ভুল করেনি। ওই রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৩৪২ ধারার পরীক্ষা শুধুমাত্র আসামি এবং আসামির উপকারের জন্য। (আব্দুল করিম বনাম শাসসুল ইসলাম ৪৫ ডিএলআর পৃষ্ঠা-৫৭৮)।
[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]
সিরাজ প্রামাণিক
রোববার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩
চেক ডিজঅনার হলেই এখন আর সাজা নয়। প্রতিদানবিহীন হস্তান্তরযোগ্য দলিল বিষয়ে যখন পক্ষগণের মধ্যে যেখানে কোন প্রতিদান (কনসিডারেশন) থাকে না, সেখানে হস্তান্তরযোগ্য দলিল অকার্যকর হিসেবে গণ্য হবে। প্রতিদান ছাড়া যেমন চুক্তি হয় না, তেমনি প্রতিদান ছাড়া কোন হস্তান্তর যোগ্য দলিল কার্যকর করা যাবে না। কাজেই স্বাক্ষরসহ চেক কারও কাছে হস্তগত হলেই কিংবা ব্যাংক ডিজঅনার করলেই চেকের প্রতিদান বা দেনা পাওনা বা লেনদেন প্রমাণ করতে না পারলে মামলায় আসামি খালাস পাবে- এমনটিই বলেছেন উচ্চ আদালত। (লোকমান বনাম আয়ুব আলী এবং রাষ্ট্র মামলা, যা ৩৮ বিএলডি, পৃষ্ঠা ৬১৬,৬১৭-৬২০)।
মামলায় ঘটনায় প্রকাশ এই যে, বাদী কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামির বিরুদ্ধে এই মর্মে নালিশি মামলা দাখিল করেন যে, আসামি বাদীর কাছ থেকে ঋণ হিসেবে ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করার পর উক্ত ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে উক্ত পরিমাণ টাকা সম্বলিত একটি চেক বাদীর অনুকূলে ইস্যু করেন। উক্ত চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিলে ‘সিগনেচার ডিফারস’ অর্থাৎ চেকের স্বাক্ষরে মিল নেই মন্তব্যসহ ডিজঅনার হয়।
এরপর বাদী আসামি বরাবর একটি লিগ্যাল নোটিশ পাঠায়। আসামি উক্ত লিগ্যাল নোটিশ প্রাপ্ত হলেও বাদীর অনুকূলে টাকা পরিশোধের কোন উদ্যোগ নেয় নাই। নালিশটি দায়েরের পর আসামি সমন প্রাপ্ত হয়ে জামিন হলে মামলাটি বিচারের জন্য কুমিল্লার অতিরিক্ত দায়রা জজ, ৪র্থ আদালতে আসলে আদালত উভয়পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিয়ে আসামিকে এ মামলার দায় থেকে খালাস দেয়। আদালত পর্যবেক্ষণে বলে যে, আসামি সাফাই সাক্ষ্যর মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, বাদীর সঙ্গে তার বৈধ কোন লেনদেন বা চেক সম্পর্কিত কোন কনসিডারেশন ছিল না। এরপর বাদী উক্ত রায়ের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে যান। আদালত সেখানেও নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখে। এভাবে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগও আদেশ বহাল রাখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ আইনজীবীর ৩৪২ ধারা আসামি পরীক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।
অনেক আদালতও সঠিভাবে ৩৪২ ধারায় আসামি পরীক্ষা করেন না। এটাকে শুধুমাত্র ফরমালিটি মনে করে। এজন্য ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামিকে পরীক্ষার সময় শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করে আসামি নির্দোষ দাবি করে কিনা এবং সাফাই সাক্ষী দেবে কিনা। এটা আদৌও আইন সম্মত নয়। হতাশ হতে হয় যখন আপিল আদালত আপিল শুনানির সময় বলে- আপনার দাবি, ঘটনার সময়, কি পরিস্থিতিতে তাকে মিথ্য মামলায় জড়িত করা হয়েছে, চেক সম্পর্কিত বিষয় কোনোরূপ কনসিডারেশন ছিল না তার ব্যাখ্যা ৩৪২ ধারার বিবৃতিতে নেই, তাহলে কিভাবে আসামিকে খালাস দেওয়া যাবে।
৩৪২ ধারা আসামি পরীক্ষা বিবৃতির ওপর ভিত্তি করে মামলা খালাস কিংবা সাজা কমানোর অনেক নজির আছে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলার রায়ে। হাসান আলী বনাম রাষ্ট, এ মামলায় অ্যাপিলেট ডিভিশন শুধুমাত্র ৩৪২ ধারায় আসামির বয়স ৯০ বছর উল্লেখ থাকায় তার সাজা মানবিক দিকে বিবেচনা করে যতদিন হাজতে ছিল তত দিন করে দিয়েছে। হাসান আলী বনাম রাষ্ট্র, ১৫ বিএলডি (এডি) পৃষ্ঠা-৩৭।
অপর এক মামলায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে দন্ড বিধি ৪২০ ধারায় দন্ডাদেশ দিলে আসামি সেই দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে আপিল দায়ের করলে আপিল আদালত তাকে খালাস দেন।
উক্ত খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে বাদী হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। আপিল শুনানি শেষে হইকোর্ট ডিভিশন আপিল নামঞ্জুর করে এবং দায়রা জজ আদালতের রায় বহাল রখেন। হাইকোর্ট ডিভিশন রায়ে উল্লেখ করেন, দায়রা আপিল আদালত ৩৪২ ধারায় আসামির সাফাই সাক্ষী যেখানে আসামি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও সাক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে খালাস দিয়ে কোন ভুল করেনি। ওই রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৩৪২ ধারার পরীক্ষা শুধুমাত্র আসামি এবং আসামির উপকারের জন্য। (আব্দুল করিম বনাম শাসসুল ইসলাম ৪৫ ডিএলআর পৃষ্ঠা-৫৭৮)।
[লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট]