alt

উপ-সম্পাদকীয়

বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক বৈষম্য কি ঘুচবে

এসএম খায়রুল বাসার

: বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার’ রূপকল্পে আন্তর্জাতিক মান ও সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করেছে সরকার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণীতে এ বছর (২০২৩) থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুও হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে বলা হয়েছে- শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছেন শিক্ষক। সুতরাং শিক্ষক উন্নয়নে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দূরদর্শী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মানসম্মত শিক্ষার মূল অনুঘটক হিসেবে শিক্ষকদেরই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি বলেছিলেন- আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজ আজও আর্থিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে অত্যন্ত অবহেলিত-বঞ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, একজন বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকের কথা বলা যায়, যার প্রারম্ভিক বেতন স্কেল মাত্র ১২ হাজার ৫শ টাকা। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫শ টাকা যোগ হয়। অপরদিকে ‘শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট’ এবং ‘অবসর সুবিধা বোর্ড’-এর ১০ শতাংশ টাকা কর্তন করে নেয়া হয়। সর্বসাকুল্যে তিনি মাসিক বেতন পান মাত্র ১২ হাজার ৭৫০ টাকা মাত্র। অথচ জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মত হলো- বাংলাদেশের একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ২৭৬ টাকা। তাহলে ন্যূনতম ৪ সদস্যের একটি পরিবারের খাবার খরচ বাবদ মাসে প্রয়োজন হবে ৩৩ হাজার ১২০ টাকা। সিপিডি বলেছে- খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, যাতায়াত, মোবাইল ও ইন্টারনেট খরচ হিসাব করলে একটি পরিবারের মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় নিলে এ খরচের পরিমাণ আরও বেশি হবে। ১২ হাজার ৫শ টাকার বেতন স্কেলে একজন মানুষ কিভাবে মানবিক জীবন-যাপন করতে পারে? কিভাবে নিজের পেশায় শতভাগ মনোনিবেশ করতে পারে? এ স্বল্প বেতনে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ কেন দেখাবে?

এখানেই শেষ নয়। একে তো বেতন কম, তারপর আবার এ দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে। জাতি গঠন এবং সরকারের উন্নয়ন অংশীদার, দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী বেসরকারি শিক্ষকরা বেতন-ভাতা, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, মর্যাদা, অবসর সুবিধাসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা শুধুমাত্র স্কেলের মূল বেতন পান। বাকি সব ভাতা, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারা সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের থেকে যোজন-যোজন পিছিয়ে আছে।

সরকারি শিক্ষকরা ক্ষেত্রবিশেষ মূল বেতনের ৩৫-৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পান। অন্যদিকে এমপিওভুক্ত কর্মচারী-শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষ পর্যন্ত সবাই বাড়িভাড়া পান মাত্র ১ হাজার টাকা, যা দিয়ে দেশের কোথাও বাড়িভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। সরকারি শিক্ষকরা চিকিৎসা ভাতা পান ১ হাজার ৫শ টাকা। বেসরকারি শিক্ষকরা চিকিৎসা ভাতা পান মাত্র ৫শ টাকা। সরকারি শিক্ষকরা ২টি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা পান অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা মাত্র ২৫% উৎসব ভাতা পান। সরকারি শিক্ষকরা প্রতি সন্তানের জন্য ৫শ টাকা হিসেবে শিক্ষা সহায়ক ভাতা পান, পান শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, পাহাড়ি ভাতা। আশ্চর্য হলেও সত্য বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের জন্য কোনরূপ শিক্ষা সহায়ক ভাতা পান না, পান না শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, পাহাড়ি ভাতার সুবিধা।

সরকারি শিক্ষকদের আছে পদোন্নতির ব্যবস্থা। যেমন- কলেজ পর্যায়ে সরকারি শিক্ষকরা প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পান। বেসরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) স্তরে আগে সহকারী অধ্যাপক হওয়া যেত। এখন সেটাও বাদ দেয়া হয়েছে। এখন শুধু জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হওয়ার সুযোগ আছে। স্নাতক কলেজে অবশ্য সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ বহাল আছে, কিন্তু সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ নেই। সরকারি শিক্ষকদের আছে বদলির সুযোগ কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের নেই কোন বদলির সুযোগ। প্রশিক্ষণ সুবিধার ক্ষেত্রেও বেসরকারি শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার।

বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরের পর সরকারি শিক্ষকদের মতো পূর্ণ অবসর ভাতা, মাসিক পেনশন সুবিধা পান না। বেসরকারি শিক্ষকদের অবসরকালীন একসঙ্গে যে ভাতা পাওয়ার কথা, তাও অনেক শিক্ষক জীবদ্দশায় পান না। ‘শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট’ এবং ‘অবসর সুবিধা বোর্ড’-এ অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নেয়া শিক্ষক সমাজ আজও মেনে নিতে পারেননি। কেননা অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নিলেও সে অনুপাতে অবসরকালীন সুবিধা বাড়েনি। মর্মন্তুদ ব্যাপর হলো- বেসরকারি শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ এখনো এমপিওভুক্তই হননি। তারা কোন সরকারি সুবিধাই পান না। বছরের পর বছর বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেয়ার নজির বিশ্বের কোন দেশে নেই। একই নিয়োগ যোগ্যতায়, একই শিক্ষাক্রমে পাঠদান করেও আকাশ-পাতাল বৈষম্যকে ‘পেশার অমর্যাদা’ হিসেবে দেখেন বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।

বছরের পর বছর বেসরকারি শিক্ষক সমাজ এসব বৈষম্যের মধ্য দিয়ে চলছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং বাজেটে শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় হচ্ছে না বৈষম্যের প্রতিকার। এসব বৈষম্য দূর করার একমাত্র উপায় হলো গোটা বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ। জাতীয়করণের জন্য বেসরকারি শিক্ষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনও করে আসছেন। তাদের জাতীয়করণের এ প্রাণের দাবির যৌক্তিকতাও আছে। তবে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমান দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় আমরা বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র একটি বাজেটে বেসরকারি শিক্ষা খাতের সমগ্রই জাতীয়করণ সম্ভব নয়।

তাই গ্রহণযোগ্য সময়সীমা নির্ধারণ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণের রোডম্যাপ ঘোষণা করে, আসন্ন বাজেট থেকে শুরু করে সামনের প্রতিটি বাজেটে ক্রমবর্ধমান হারে অর্থ বরাদ্দের প্রত্যাশা করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। যতদিন না সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ না হোক অন্ততপক্ষে একটা নির্দিষ্ট শতাংশ হারে বাড়িভাড়া, পূর্ণ উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, সন্তানের শিক্ষা সহায়ক ভাতা, অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করার অনুপাতে অবসরকালীন সুবিধা বৃদ্ধিসহ অবসর গ্রহণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে অবসর সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে আসন্ন বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রত্যাশাই করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।

কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০-১২ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যা বিশ্বের পরিমিতমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ ধনী দেশে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা খাতে অবশ্যই জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। সেটা করতে পারলে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করাও সম্ভব হবে।

আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী মহোদয় বাজেট পেশ করবেন, তাই সময় অতি সন্নিকটেই বলা যায়। সংক্ষিপ্ত এ সময়ে বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূরীকরণে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে- সেই আমরা আশা করি।

[লেখক : অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ

মহাবিদ্যালয়, যশোর]

ছবি

স্মরণ : কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার

ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

দাবদাহে সুস্থ থাকবেন কীভাবে

কত দিন পরে এলে, একটু শোনো

রম্যগদ্য : আনন্দ, দ্বিগুণ আনন্দ...

ছবি

ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম

বৈসাবি : ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব

‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইন

উদার-উদ্দাম বৈশাখ চাই

ঈদ নিয়ে আসুক শান্তি ও সমৃদ্ধি, বিস্তৃত হোক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ

প্রসঙ্গ: বিদেশি ঋণ

ছাত্ররাজনীতি কি খারাপ?

জাকাত : বিশ্বের প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশ স্কাউটস দিবস : শুরুর কথা

ছবি

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত

প্রবাসীর ঈদ-ভাবনা

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস

ধানের ফলন বাড়াতে ক্লাইমেট স্মার্ট গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি

কমিশন কিংবা ভিজিটে জমি রেজিস্ট্রির আইনি বিধান ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি

ঈদের অর্থনীতি

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের রাজনীতিতে ‘পোস্ট পার্টিশন সিনড্রম’

শিক্ষকের বঞ্চনা, শিক্ষকের বেদনা

নিরাপদ সড়ক কেন চাই

রম্যগদ্য : ‘প্রহরীর সাতশ কোটি টাকা...’

ছবি

অবন্তিকাদের আত্মহনন

শিক্ষাবিষয়ক ভাবনা

অপ্রয়োজনে সিজারিয়ান নয়

পণ্য রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে

আত্মহত্যা রোধে নৈতিক শিক্ষা

আউশ ধান : পরিবেশ ও কৃষকবান্ধব ফসল

ছবি

বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস

জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আতুড়ঘর

চেক ডিজঅনার মামলার অধিক্ষেত্র ও প্রাসঙ্গিকতা

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশের কৃষি

ছবি

‘হৃৎ কলমের’ পাখি এবং আমাদের জেগে ওঠা

ছবি

ভূগর্ভস্থ পানি সুরক্ষায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক বৈষম্য কি ঘুচবে

এসএম খায়রুল বাসার

বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম সুখী ও বৈশ্বিক নাগরিক গড়ে তোলার’ রূপকল্পে আন্তর্জাতিক মান ও সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ প্রণয়ন করেছে সরকার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণীতে এ বছর (২০২৩) থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুও হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে বলা হয়েছে- শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছেন শিক্ষক। সুতরাং শিক্ষক উন্নয়নে সর্বোচ্চ বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দূরদর্শী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও মানসম্মত শিক্ষার মূল অনুঘটক হিসেবে শিক্ষকদেরই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি বলেছিলেন- আগামী প্রজন্মের ভাগ্য শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করছে। শিশুদের যথাযথ শিক্ষার ব্যত্যয় ঘটলে কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হবে।

কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজ আজও আর্থিক নিরাপত্তা এবং সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে অত্যন্ত অবহেলিত-বঞ্চিত। উদাহরণস্বরূপ, একজন বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষকের কথা বলা যায়, যার প্রারম্ভিক বেতন স্কেল মাত্র ১২ হাজার ৫শ টাকা। এর সঙ্গে বাড়ি ভাড়া ১ হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫শ টাকা যোগ হয়। অপরদিকে ‘শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট’ এবং ‘অবসর সুবিধা বোর্ড’-এর ১০ শতাংশ টাকা কর্তন করে নেয়া হয়। সর্বসাকুল্যে তিনি মাসিক বেতন পান মাত্র ১২ হাজার ৭৫০ টাকা মাত্র। অথচ জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত মত হলো- বাংলাদেশের একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য দৈনিক প্রয়োজন ২৭৬ টাকা। তাহলে ন্যূনতম ৪ সদস্যের একটি পরিবারের খাবার খরচ বাবদ মাসে প্রয়োজন হবে ৩৩ হাজার ১২০ টাকা। সিপিডি বলেছে- খাবারের সঙ্গে এক কক্ষের ঘরভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুতের বিল, চিকিৎসা ব্যয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষার পণ্য ক্রয়, যাতায়াত, মোবাইল ও ইন্টারনেট খরচ হিসাব করলে একটি পরিবারের মাসিক খরচ দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা। বর্তমান দ্রব্যমূল্য বিবেচনায় নিলে এ খরচের পরিমাণ আরও বেশি হবে। ১২ হাজার ৫শ টাকার বেতন স্কেলে একজন মানুষ কিভাবে মানবিক জীবন-যাপন করতে পারে? কিভাবে নিজের পেশায় শতভাগ মনোনিবেশ করতে পারে? এ স্বল্প বেতনে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ কেন দেখাবে?

এখানেই শেষ নয়। একে তো বেতন কম, তারপর আবার এ দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য বিরাজমান রয়েছে। জাতি গঠন এবং সরকারের উন্নয়ন অংশীদার, দেশের ৯৭ ভাগ শিক্ষার্থীদের পাঠদানকারী বেসরকারি শিক্ষকরা বেতন-ভাতা, পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, মর্যাদা, অবসর সুবিধাসহ সবক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা শুধুমাত্র স্কেলের মূল বেতন পান। বাকি সব ভাতা, সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারা সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের থেকে যোজন-যোজন পিছিয়ে আছে।

সরকারি শিক্ষকরা ক্ষেত্রবিশেষ মূল বেতনের ৩৫-৫০ শতাংশ বাড়িভাড়া পান। অন্যদিকে এমপিওভুক্ত কর্মচারী-শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রধান শিক্ষক-অধ্যক্ষ পর্যন্ত সবাই বাড়িভাড়া পান মাত্র ১ হাজার টাকা, যা দিয়ে দেশের কোথাও বাড়িভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। সরকারি শিক্ষকরা চিকিৎসা ভাতা পান ১ হাজার ৫শ টাকা। বেসরকারি শিক্ষকরা চিকিৎসা ভাতা পান মাত্র ৫শ টাকা। সরকারি শিক্ষকরা ২টি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা পান অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা মাত্র ২৫% উৎসব ভাতা পান। সরকারি শিক্ষকরা প্রতি সন্তানের জন্য ৫শ টাকা হিসেবে শিক্ষা সহায়ক ভাতা পান, পান শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, পাহাড়ি ভাতা। আশ্চর্য হলেও সত্য বেসরকারি শিক্ষকরা তাদের সন্তানদের জন্য কোনরূপ শিক্ষা সহায়ক ভাতা পান না, পান না শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, পাহাড়ি ভাতার সুবিধা।

সরকারি শিক্ষকদের আছে পদোন্নতির ব্যবস্থা। যেমন- কলেজ পর্যায়ে সরকারি শিক্ষকরা প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পান। বেসরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। উচ্চ মাধ্যমিক (কলেজ) স্তরে আগে সহকারী অধ্যাপক হওয়া যেত। এখন সেটাও বাদ দেয়া হয়েছে। এখন শুধু জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হওয়ার সুযোগ আছে। স্নাতক কলেজে অবশ্য সহকারী অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ বহাল আছে, কিন্তু সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ নেই। সরকারি শিক্ষকদের আছে বদলির সুযোগ কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের নেই কোন বদলির সুযোগ। প্রশিক্ষণ সুবিধার ক্ষেত্রেও বেসরকারি শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার।

বেসরকারি শিক্ষকরা অবসরের পর সরকারি শিক্ষকদের মতো পূর্ণ অবসর ভাতা, মাসিক পেনশন সুবিধা পান না। বেসরকারি শিক্ষকদের অবসরকালীন একসঙ্গে যে ভাতা পাওয়ার কথা, তাও অনেক শিক্ষক জীবদ্দশায় পান না। ‘শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট’ এবং ‘অবসর সুবিধা বোর্ড’-এ অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নেয়া শিক্ষক সমাজ আজও মেনে নিতে পারেননি। কেননা অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কেটে নিলেও সে অনুপাতে অবসরকালীন সুবিধা বাড়েনি। মর্মন্তুদ ব্যাপর হলো- বেসরকারি শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ এখনো এমপিওভুক্তই হননি। তারা কোন সরকারি সুবিধাই পান না। বছরের পর বছর বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেয়ার নজির বিশ্বের কোন দেশে নেই। একই নিয়োগ যোগ্যতায়, একই শিক্ষাক্রমে পাঠদান করেও আকাশ-পাতাল বৈষম্যকে ‘পেশার অমর্যাদা’ হিসেবে দেখেন বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।

বছরের পর বছর বেসরকারি শিক্ষক সমাজ এসব বৈষম্যের মধ্য দিয়ে চলছে। সঠিক পরিকল্পনা এবং বাজেটে শিক্ষা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না থাকায় হচ্ছে না বৈষম্যের প্রতিকার। এসব বৈষম্য দূর করার একমাত্র উপায় হলো গোটা বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ। জাতীয়করণের জন্য বেসরকারি শিক্ষক সমাজ দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনও করে আসছেন। তাদের জাতীয়করণের এ প্রাণের দাবির যৌক্তিকতাও আছে। তবে কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমান দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবেচনায় আমরা বিশ্বাস করি, শুধুমাত্র একটি বাজেটে বেসরকারি শিক্ষা খাতের সমগ্রই জাতীয়করণ সম্ভব নয়।

তাই গ্রহণযোগ্য সময়সীমা নির্ধারণ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণের রোডম্যাপ ঘোষণা করে, আসন্ন বাজেট থেকে শুরু করে সামনের প্রতিটি বাজেটে ক্রমবর্ধমান হারে অর্থ বরাদ্দের প্রত্যাশা করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। যতদিন না সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা সম্ভব হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ না হোক অন্ততপক্ষে একটা নির্দিষ্ট শতাংশ হারে বাড়িভাড়া, পূর্ণ উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, সন্তানের শিক্ষা সহায়ক ভাতা, অতিরিক্ত ৪ শতাংশ কর্তন করার অনুপাতে অবসরকালীন সুবিধা বৃদ্ধিসহ অবসর গ্রহণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে অবসর সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে আসন্ন বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রত্যাশাই করে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ।

কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ১০-১২ শতাংশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে, যা বিশ্বের পরিমিতমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অথচ বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ ধনী দেশে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষা খাতে অবশ্যই জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হবে। সেটা করতে পারলে বেসরকারি শিক্ষকদের আর্থিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি দেশের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করাও সম্ভব হবে।

আগামী ১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী মহোদয় বাজেট পেশ করবেন, তাই সময় অতি সন্নিকটেই বলা যায়। সংক্ষিপ্ত এ সময়ে বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূরীকরণে বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে- সেই আমরা আশা করি।

[লেখক : অধ্যক্ষ, পল্লীমঙ্গল আদর্শ

মহাবিদ্যালয়, যশোর]

back to top