alt

উপ-সম্পাদকীয়

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

সাদেকুর রহমান

: শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩

(গতকালের পর)

সৈয়দপুরে সেনানিবাস থাকায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বিহারি নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি। তখন লে. কর্নেল শফির অধীনে ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট ও লে. কর্নেল হাকিম এ কোরেশীর অধীনে ২৬ এফএফ রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাসে ছিল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের আগেই ২৩ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনায় ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিহারিরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে প্রচুর অর্থ-সম্পদ লুট করে নেয়। শহরের পাড়া-মহল্লার বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে গণহত্যা চালায় এবং মা- বোনের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। তাদের এই হত্যাতান্ডবে সৈয়দপুর শহর পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। ওইদিন থেকেই সৈয়দপুর শহরে বাঙালিদের কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়।

এ পরিস্থিতিতে সৈয়দপুর এবং আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সৈয়দপুর ছাড়াও নীলফামারী, দিনাজপুরের খানসামা, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর এলাকার বাঙালিরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় এবং হাজার হাজার বাঙালির সমাবেশ ঘটিয়ে সৈয়দপুর শহর ঘেরাও করে অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪ মার্চ চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকদিহি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে আনুমানিক চার থেকে পাঁচ হাজার বাঙালি দেশীয় অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের প্রথমেই অংশগ্রহণকারী বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। শত্রুসেনারা নির্বিচারে বাঙালিদের ওপর গুলি করে। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মাহাতাব বেগ ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নিহত হলে বিহারিরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাহাতাব বেগের মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার দ্বিখন্ডিত মাথা নিয়ে শহরময় বিজয় উল্লাস করে।

ঘেরাওয়ের ঘটনার জের ধরে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডা. জিকরুল হক, ডা. সামছুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, সৈয়দপুরের ভাসানী ন্যাপের সভাপতি ডা. ইয়াকুব আলী, বিশি’ ব্যবসায়ী তুলসীরাম আগরওয়ালা, রামেশ্বরলাল আগরওয়ালা, কমলা প্রসাদসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সুধীজনকে পাকসেনারা আটক করে নিয়ে যায় এবং ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জের বালারঘাট বধ্যভূমিতে নিয়ে অন্য আরও ১৫০ জন বিশি’ ব্যক্তির সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের ভেতর ব্যাপক আতঙ্কের সৃ’ি হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সৈয়দপুর শহরে অবরুদ্ধ বাঙালিরা যেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জার্মানদের তৈরি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের মতো জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। ব্যাপক ধরপাকড়ে বন্দী বাঙালি পরিবারের সদস্যদের মূলত দুটি বন্দী শিবিরে রাখা হয়েছিল। এদের একটি অংশে ছিল বাঙালি সংখ্যালঘু হিন্দু ও মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের কয়েক শ পরিবার। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা প্রতিদিন আটক বাঙালি ও হিন্দু মাড়োয়ারিদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণ কাজে লাগাত। সারা দিন কাঠফাটা রোদে নবনির্মিত বিমানবন্দরের ইট বিছানোর কাজ শেষে সন্ধ্যায় তাদের আবার ফিরিয়ে আনা হতো। বিমানবন্দরের কাজ যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে তখন আটক হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিয়ে সেনা কর্তৃপক্ষ এক গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সৈয়দপুরে বাঙালি নিধনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে ১৩ জুন সংঘটিত ঘটনা ছিল সর্ববৃহৎ লোহহর্ষক গণহত্যা।

৫ জুন থেকেই সৈয়দপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, সৈয়দপুর শহরে যে ক’জন হিন্দু মাড়োয়ারি আটকা পড়ে আছেন, তাদের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়া হবে। সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে করে তাদের চিলাহাটা হয়ে শিলিগুড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সেনা কর্তৃপক্ষ ৬ জুন বাড়িতে বাড়িতে বিহারি রাজাকার পাঠিয়ে শুধু পুরুষদের সৈয়দপুর সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে বন্দী করে রাখে। এদের মধ্যে যারা বিশি’ ব্যবসায়ী এবং ধনী শ্রেণীর ব্যক্তি ছিলেন, পাক কর্তৃপক্ষ তাদের একে একে ব্যাংকে পাঠিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকা উঠিয়ে নেয়।

১২ জুন রাতে ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর জাভেদ ইউনুস আটক বাঙালি হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের বলেন, ‘তোমরা পাকিস্তানের জন্য অনেক করেছ। তোমাদের আমরা ক্ষতি করব না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেব।’ মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারে জর্জরিত আটক এসব ব্যক্তি মেজর জাভেদের মি’ি কথায় যেন কিছতা আশার আলো দেখতে পান। তাদের মানসিক অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন যেন ভারতে চলে যেতে পারলেই বাঁচেন। এ কারণে তারা এক কথায় রাজি হয়ে মেজর জাভেদকে অনুরোধ করেন, পরিবারের সদস্যদেরও যেন তাদের সঙ্গে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। মেজর জাভেদ সানন্দে তাদের অনুরোধে রাজি হয়ে যায় এবং ঠোঁটের কোণায় এক বিকৃত হাসি হেসে সবাইকে ওপারে (ভারতে) পাঠানোর সুব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। আটক মানুষগুলো তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, মেজর জাভেদের ওই রহস্যময় হাসির আড়ালে কী ভয়াবহ পরিণতি লুকিয়ে আছে!

১৩ জুন খুব ভোরে সেনানিবাসে আটক হিন্দু মাড়োয়ারিদের বাসে করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। অপরদিকে অন্য কয়েকটি বাসে তাদের পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য বাঙালি হিন্দুকে স্টেশনে নিয়ে আসে। স্টেশনে আসার পর পর পাকিস্তানি সৈন্যরা জোর করে ১৮ সুন্দরী তরুণী ও মহিলাকে বাছাই করে আলাদা করে ফেলে এবং তাদের গাড়িতে করে সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। ততক্ষণে চার বগির একটি বিশেষ ট্রেন বাকি সবার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। সময় ন’ না করে সঙ্গে সঙ্গে সামনের দুটো বগিতে পুরুষদের তোলা হয় এবং পরের দুই বগিতে মহিলা ও শিশুদের তোলা হয়। যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার পরপর বগির সব দরজা ও জালানা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর সকাল আনুমানিক ৭টায় চিলাহাটার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। খুব ধীরগতিতে চলতে চলতে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাটের বর্তমান লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেন থামার কারণ জানার জন্য যাত্রীরা জানালা ফাঁক দিয়ে তাকাতেই অস্প’ আলোতে দেখতে পান, অসংখ্য পাকিস্তান সেনাসদস্য ও বিহারি পুলিশ রেললাইনের দু’দিকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মুখে কাপড় বাঁধা একদল বিহারি। তাদের কারও হাতে তলোয়ার, কারও হাতে রামদা কিংবা তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি।

ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রধারী বিহারিরা প্রতিটি কামরায় ঢুকে একে একে সবাইকে নামিয়ে রামদা ও ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা শুরু করে। ট্রেনের ভেতর শুরু হয় বুক ফাটা আর্তনাদ। মহিলাদের করা হয় নির্মম নির্যাতন এবং অবুঝ শিশুদের পায়ে ধরে ধোপার কাপড় কাচার মতো করে রেললাইনের ওপর আঘাত করে করে মাথা থেঁতলে দেয়া হয়। তলোয়ারের আঘাতে কচুকাটা করে এক একজনকে। কখনও যুবক, কখনও বৃদ্ধ, কখনও বা মহিলা এবং শিশুর চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে নির্জন গোলাহাটের বাতাস। প্রাণ বাঁচাতে কাতর নারী-পুরুষের নিষ্ফল আর্তনাদ তলোয়ার এবং রামদার এক একটি আঘাতে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। (চলবে)

জমি আপনার, দখল অন্যের?

সিধু-কানু : ধ্বংসস্তূপের নিচেও জেগে আছে সাহস

ছবি

বাংলার অনন্য লোকসংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক চেতনা

চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান

তিন দিক থেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি : করোনা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া

দেশের অর্থ পাচারের বাস্তবতা

খাদ্য নিরাপত্তার নতুন দিগন্ত

আবারও কি রোহিঙ্গাদের ত্যাগ করবে বিশ্ব?

প্লান্ট ক্লিনিক বদলে দিচ্ছে কৃষির ভবিষ্যৎ

ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করতে করণীয়

রম্যগদ্য : ‘ডন ডনা ডন ডন...’

ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব : কে সন্ত্রাসী, কে শিকার?

সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব

প্রতিরোধই উত্তম : মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ার ডাক

ছবি

বিকাশের পথকে পরিত্যাগ করা যাবে না

বর্ষা ও বৃক্ষরোপণ : সবুজ বিপ্লবের আহ্বান

প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া রোধে শিক্ষকের করণীয়

পারমাণবিক ন্যায়বিচার ও বৈশ্বিক ভণ্ডামির প্রতিচ্ছবি

পরিবেশের নীরব রক্ষক : শকুন সংরক্ষণে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন

মশার উপদ্রব : জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার চরম ব্যর্থতা

ভুল স্বীকারে গ্লানি নেই

ভাঙনের বুকে টিকে থাকা স্বপ্ন

একটি সফর, একাধিক সংকেত : কে পেল কোন বার্তা?

দেশের কারা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ইসলামী ব্যাংক একীভূতকরণ : আস্থা ফেরাতে সংস্কার, না দায়মুক্তির প্রহসন?

রম্যগদ্য : চাঁদাবাজি চলছে, চলবে

বায়ুদূষণ : নীরব ঘাতক

ইসরায়েলের কৌশলগত ঔদ্ধত্য

পরিবার : সুনাগরিক ও সুশাসক তৈরির ভিত্তিমূল

শিল্পে গ্যাস সংকট : দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিন

আমাদের লড়াইটা আমাদের লড়তে দিন

ব্যাকবেঞ্চারদের পৃথিবী : ব্যর্থতার গায়ে সাফল্যের ছাপ

আমের অ্যানথ্রাকনোজ ও বোঁটা পঁচা রোগ

শিশুদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি : স্কুল ব্যাংকিংয়ের সম্ভাবনা ও সংকট

প্রশিক্ষণ থেকে কেন বাদ নারী কৃষকরা?

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ফিরে দেখা : একাত্তরে কিছু গণহত্যার কথা

সাদেকুর রহমান

শুক্রবার, ০২ জুন ২০২৩

(গতকালের পর)

সৈয়দপুরে সেনানিবাস থাকায় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বিহারি নেতাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি। তখন লে. কর্নেল শফির অধীনে ২৩ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট ও লে. কর্নেল হাকিম এ কোরেশীর অধীনে ২৬ এফএফ রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাসে ছিল। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ ঢাকায় ক্র্যাকডাউনের আগেই ২৩ মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের প্ররোচনায় ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিহারিরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে বাঙালিদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালিয়ে প্রচুর অর্থ-সম্পদ লুট করে নেয়। শহরের পাড়া-মহল্লার বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করে গণহত্যা চালায় এবং মা- বোনের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। তাদের এই হত্যাতান্ডবে সৈয়দপুর শহর পরিণত হয় বধ্যভূমিতে। ওইদিন থেকেই সৈয়দপুর শহরে বাঙালিদের কার্যত অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়।

এ পরিস্থিতিতে সৈয়দপুর এবং আশপাশের এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সৈয়দপুর ছাড়াও নীলফামারী, দিনাজপুরের খানসামা, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর এলাকার বাঙালিরা প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয় এবং হাজার হাজার বাঙালির সমাবেশ ঘটিয়ে সৈয়দপুর শহর ঘেরাও করে অবরুদ্ধ বাঙালিদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৪ মার্চ চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকদিহি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহাতাব বেগের নেতৃত্বে আনুমানিক চার থেকে পাঁচ হাজার বাঙালি দেশীয় অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসে। ঘেরাওয়ের প্রথমেই অংশগ্রহণকারী বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়। শত্রুসেনারা নির্বিচারে বাঙালিদের ওপর গুলি করে। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মাহাতাব বেগ ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নিহত হলে বিহারিরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাহাতাব বেগের মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার দ্বিখন্ডিত মাথা নিয়ে শহরময় বিজয় উল্লাস করে।

ঘেরাওয়ের ঘটনার জের ধরে ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ডা. জিকরুল হক, ডা. সামছুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, সৈয়দপুরের ভাসানী ন্যাপের সভাপতি ডা. ইয়াকুব আলী, বিশি’ ব্যবসায়ী তুলসীরাম আগরওয়ালা, রামেশ্বরলাল আগরওয়ালা, কমলা প্রসাদসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সুধীজনকে পাকসেনারা আটক করে নিয়ে যায় এবং ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন নিসবেতগঞ্জের বালারঘাট বধ্যভূমিতে নিয়ে অন্য আরও ১৫০ জন বিশি’ ব্যক্তির সঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের ভেতর ব্যাপক আতঙ্কের সৃ’ি হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সৈয়দপুর শহরে অবরুদ্ধ বাঙালিরা যেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জার্মানদের তৈরি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের মতো জীবন কাটাতে বাধ্য হয়। ব্যাপক ধরপাকড়ে বন্দী বাঙালি পরিবারের সদস্যদের মূলত দুটি বন্দী শিবিরে রাখা হয়েছিল। এদের একটি অংশে ছিল বাঙালি সংখ্যালঘু হিন্দু ও মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের কয়েক শ পরিবার। সে সময় পাকিস্তানি সেনারা প্রতিদিন আটক বাঙালি ও হিন্দু মাড়োয়ারিদের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণ কাজে লাগাত। সারা দিন কাঠফাটা রোদে নবনির্মিত বিমানবন্দরের ইট বিছানোর কাজ শেষে সন্ধ্যায় তাদের আবার ফিরিয়ে আনা হতো। বিমানবন্দরের কাজ যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে তখন আটক হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিয়ে সেনা কর্তৃপক্ষ এক গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সৈয়দপুরে বাঙালি নিধনের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে ১৩ জুন সংঘটিত ঘটনা ছিল সর্ববৃহৎ লোহহর্ষক গণহত্যা।

৫ জুন থেকেই সৈয়দপুর শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিল, সৈয়দপুর শহরে যে ক’জন হিন্দু মাড়োয়ারি আটকা পড়ে আছেন, তাদের সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়া হবে। সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে একটি বিশেষ ট্রেনে করে তাদের চিলাহাটা হয়ে শিলিগুড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এ ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও সেনা কর্তৃপক্ষ ৬ জুন বাড়িতে বাড়িতে বিহারি রাজাকার পাঠিয়ে শুধু পুরুষদের সৈয়দপুর সেনানিবাসে ডেকে নিয়ে বন্দী করে রাখে। এদের মধ্যে যারা বিশি’ ব্যবসায়ী এবং ধনী শ্রেণীর ব্যক্তি ছিলেন, পাক কর্তৃপক্ষ তাদের একে একে ব্যাংকে পাঠিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকা উঠিয়ে নেয়।

১২ জুন রাতে ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর জাভেদ ইউনুস আটক বাঙালি হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের বলেন, ‘তোমরা পাকিস্তানের জন্য অনেক করেছ। তোমাদের আমরা ক্ষতি করব না। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের সবাইকে ভারতে পাঠিয়ে দেব।’ মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারে জর্জরিত আটক এসব ব্যক্তি মেজর জাভেদের মি’ি কথায় যেন কিছতা আশার আলো দেখতে পান। তাদের মানসিক অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন যেন ভারতে চলে যেতে পারলেই বাঁচেন। এ কারণে তারা এক কথায় রাজি হয়ে মেজর জাভেদকে অনুরোধ করেন, পরিবারের সদস্যদেরও যেন তাদের সঙ্গে নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। মেজর জাভেদ সানন্দে তাদের অনুরোধে রাজি হয়ে যায় এবং ঠোঁটের কোণায় এক বিকৃত হাসি হেসে সবাইকে ওপারে (ভারতে) পাঠানোর সুব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করেন। আটক মানুষগুলো তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি, মেজর জাভেদের ওই রহস্যময় হাসির আড়ালে কী ভয়াবহ পরিণতি লুকিয়ে আছে!

১৩ জুন খুব ভোরে সেনানিবাসে আটক হিন্দু মাড়োয়ারিদের বাসে করে সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হয়। অপরদিকে অন্য কয়েকটি বাসে তাদের পরিবারের সদস্য ও অন্যান্য বাঙালি হিন্দুকে স্টেশনে নিয়ে আসে। স্টেশনে আসার পর পর পাকিস্তানি সৈন্যরা জোর করে ১৮ সুন্দরী তরুণী ও মহিলাকে বাছাই করে আলাদা করে ফেলে এবং তাদের গাড়িতে করে সৈয়দপুর সেনানিবাসে পাঠিয়ে দেয়। ততক্ষণে চার বগির একটি বিশেষ ট্রেন বাকি সবার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। সময় ন’ না করে সঙ্গে সঙ্গে সামনের দুটো বগিতে পুরুষদের তোলা হয় এবং পরের দুই বগিতে মহিলা ও শিশুদের তোলা হয়। যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার পরপর বগির সব দরজা ও জালানা বন্ধ করে দেয়া হয়। অতঃপর সকাল আনুমানিক ৭টায় চিলাহাটার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে ট্রেনটি। খুব ধীরগতিতে চলতে চলতে স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে গোলাহাটের বর্তমান লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে এসে ট্রেনটি থেমে যায়। ট্রেন থামার কারণ জানার জন্য যাত্রীরা জানালা ফাঁক দিয়ে তাকাতেই অস্প’ আলোতে দেখতে পান, অসংখ্য পাকিস্তান সেনাসদস্য ও বিহারি পুলিশ রেললাইনের দু’দিকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে মুখে কাপড় বাঁধা একদল বিহারি। তাদের কারও হাতে তলোয়ার, কারও হাতে রামদা কিংবা তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি।

ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্রধারী বিহারিরা প্রতিটি কামরায় ঢুকে একে একে সবাইকে নামিয়ে রামদা ও ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যা শুরু করে। ট্রেনের ভেতর শুরু হয় বুক ফাটা আর্তনাদ। মহিলাদের করা হয় নির্মম নির্যাতন এবং অবুঝ শিশুদের পায়ে ধরে ধোপার কাপড় কাচার মতো করে রেললাইনের ওপর আঘাত করে করে মাথা থেঁতলে দেয়া হয়। তলোয়ারের আঘাতে কচুকাটা করে এক একজনকে। কখনও যুবক, কখনও বৃদ্ধ, কখনও বা মহিলা এবং শিশুর চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে নির্জন গোলাহাটের বাতাস। প্রাণ বাঁচাতে কাতর নারী-পুরুষের নিষ্ফল আর্তনাদ তলোয়ার এবং রামদার এক একটি আঘাতে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। (চলবে)

back to top