alt

জন্মেজয় দৈনিক সংবাদ যেন সফল হয় সর্প নিধনে

সাদ কামালী

: মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

‘সত্যকে আংশিকভাবে দেখিলে অনেক সময়ে তাহা মিথ্যার রূপান্তর ধারণ করে।’ আবার এও তো সত্য যে সত্যকে সবসময় সর্বতোভাবে দেখা বা উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক ও সম্ভাবনাগুলোকে সৎভাবে বোঝা এবং বোঝানো জাতীয় প্রয়োজনেই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করবে প্রধানত আমাদের সংবাদপত্রগুলো এবং সমাজের বিজ্ঞজন বা বিশেষজ্ঞ সমাজ। এই আকাক্সক্ষাটিও সমাজ ও রাষ্ট্রের। সমাজ বা রাষ্ট্র আসলে বিমূর্ত ধারণা। মানুষ, সাধারণ জনগণই তার আধার। জনম-লীই গঠিত করে পরিবার সমজা রাষ্ট্র...।

জনম-লীর প্রতি দায়িত্ব পালন হলো মুখ্য কাজ। সংবাদপত্রের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তারা অবশ্যই এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে না। কারণ তাদের ব্যর্থতার প্রভাব করোনার মতো সংক্রামক ব্যাধি হয়ে সমাজকে গ্রাস করে। এখন পর্যন্ত সৎসাংবাদিকতার অভাব স্বাধীন বাংলাদেশের বিপর্যয়ের পিছনে ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা বরাবর দেখে আসছি, সেই সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম থেকেই রাষ্ট্রের প্রবল প্রতাপে সত্য, ন্যায় ও সততা গরম ফুটন্ত তেলে ও তেজের কাছে চর্বির টুকরার মতো গলে নিজেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। পাঁচ যুগ বা পাঁচ দশক আগের দুই একটি ঘটনায় প্রত্যাশিত ভূমিকার ব্যাপক বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করতে চাই সাম্প্রতিক সময়ের তুলনীয় পরিবেশের জন্য। যেমন ডাকসুসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চলছে। স্বাধীন দেশে দ্বিতীয় ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এবারও সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর ভোট গণনার সময় ভয়াবহ সন্ত্রাসীযজ্ঞ ঘটিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওই সন্ত্রাসীযজ্ঞে ব্যবহৃত হয় ভারি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত করার দায় বর্তায় তৎকালীন বিরোধী কিন্তু জনপ্রিয় প্যানেল জাসদ ছাত্রলীগের ওপর। প্রকৃত ঘটনা ও দোষীদের কর্তব্যরত সাংবাদিক ভাইয়েরা দেখেছিল; কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল দায়ী করে প্রতিপক্ষকে। সেই শুরুতেই যদি প্রধানপ্রধান সংবাদপত্রগুলো প্রকৃত দায়ীদের শনাক্ত করে খবর করত, তাহলে ওই সময়ের পরপরই আরও কিছু সহিংস ঘটনা বিশ্ববদ্যালয়ে ঘটা কঠিন হতো। শুধু জাসদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’ প্রকাশ করেছিল প্রকৃত সন্ত্রাসীদের পরিচয়। আবার বর্তমান এই নির্বাচনের সময় একটি প্রমাণিত প্রতিক্রিয়াশীল দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থক প্রতিবাদী ছাত্রীকে গণধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। কোনো সংবাদপত্র ওই সংগঠনের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে গণধর্ষণের হুমকিদাতাদের মুখোশ উন্মোচন করেছে? হ্যাঁ আমরা জানি হুমকিদাতার ছাত্র হিসেবে তার পরিচয়ের কথা, কিন্তু তার এবং মুরব্বি সংগঠনের রাজনৈতিক পরিচয় কেন সামনে এলো না! বর্তমানের এই সাময়িক সরকারে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই একই গোষ্ঠীর প্রভাবের কথা আমরা সাধারণভাবে জানি; কিন্তু কোনো সংবাদপত্র তাদের নাম নিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় এবং ওই রাজনৈতিক দলের অতীত ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে? সেই পাঁচ যুগ আগে ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি তাজউদ্দীন আহমেদকে মন্ত্রিসভা থেকে সরে যেতে হলো। খুনী, বিশ্বাসঘাতক মোশতাক মন্ত্রিসভায় সরবে আসন করে নিল। তখন কোনো সংবাদপত্র সরকারের এই সিদ্ধান্তের চরম সর্বনাশটি চিনিয়ে দিয়েছিল বা সতর্ক করে দিয়েছিল? তখনো অনেকগুলো সংবাদপত্র ছিল, তখনো ‘বাকশাল’ কায়েম হয়নি। শুধু মৃত্যুভয়ই নয়, আর্থিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাতে হয়তো সংবাদপত্রগুলো সার্বিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ কথা ধরে নিলে সাহসিকতা এবং সততার কী পরিচয় থাকল!

সম্প্রতি কোনো কোনো ইউটিউবার ১৯৪৭কেই আমাদের স্বাধীনতা হিসেবে অথবা প্রথম স্বাধীনতা হিসেবে প্রচারে অনেক জ্ঞানের অপচয় করছেন। তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বড়ই মৌলিক, কারণ ইতিহাস ও কা-জ্ঞান তাদের ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমঝোতা ও আপোসের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ভাগ হওয়াকে তাদের মৌলিক জ্ঞানে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ওই স্বাধীনতার এক মাস পরেই বুঝতে পেরেছে সমঝোতার স্বাধীনতার স্বরূপ। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত করে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমরা তখনো উপনিবেশ। কোনো সংবাদপত্র বা বিজ্ঞজনেরা সত্যের উন্মোচন করে বলেছিল বা বলছে ১৯৪৭ সালের আগস্টে আমরা ২য় বারের মতো উপনিবেশ হলাম পশ্চিম পাকিস্তানের। রবীন্দ্রনাথ সর্পজাতিকে বুদ্ধিমান বলতে চান। ‘নহিলে তাহারা বাঁকিয়া চলে কেন?’ এবং তিনি বিজ্ঞজনদেরও সাপের মতো বুদ্ধিমান ভাবছেন- যারা সত্যকে সহজে সোজা পথে দেখতে পান না। তিনি বলছেন, ‘হে বিজ্ঞগণ তোমরাও খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু একটা বিষয় তোমাদের জানা নাই- পৃথিবীতে সিধা জিনিসও অনেক আছে। তোমাদের প্রাণের বাঁকা আর্শিতে যে একটা বাঁকা ছায়া দেখিতেছ, জগতের চেহারাখানা নিতান্তই অমনতর না।... জন্মেজয় যখন সর্পসত্র করিয়াছিলেন তখন কি গোটাকতক ঢোঁড়া সাপই মরিয়াছিল, তোমাদের মতো বিষাক্ত বুদ্ধিমান সাপগুলো ছিল কোথায়?’ ‘বিজ্ঞগণ’ বুদ্ধিমান শুধু অধ্যাপকবৃন্দই নন, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকও তার অন্তর্ভুক্ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ক্রমে যে অশুভ শক্তি আমাদের শুভবুদ্ধি ও সাধারণের মনকে বিপর্যস্ত করে তোলে সেই বিপন্ন বিপর্যস্ত মন ও মননই দেশে ভরে আছে। শুভবুদ্ধি, প্রকৃত জনবান্ধব মানুষ, নেতা, সংবাদপত্র এবং রাজনীতিকের অভাবে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে মুমূর্ষু, বলা যায় দেশ এখন ‘তাজা মরা’, মরে গেছে, কিন্তু পচে যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর অসহায় ভরসা করা ছাড়া আর কী উপায় আছে। ক্রম বিপর্যয়ের বিভিন্ন পর্বে জিয়া, এরশাদ, খালেদা বা সর্বশেষ শেখ হাসিনা সরকারের কোনো অন্যায়, ভুল সিদ্ধান্ত, লোভ, সন্ত্রাসের রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় বিষয়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের আশান্বিত করতে পারেনি। বরং সত্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বস্তুগত লোভ লালসায় বহু সাংবাদিক নিজেদের লজ্জিত করেছেন। তাদের সাহসের অভাব এবং আপোসকামিতার সব নিদর্শন তারা রেখে চলেছেন। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সময়ে ’৪৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত অকাতরে যত বুকের রক্ত দিয়েছেন, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সামনে তেমন দৃষ্টান্ত কি আমাদের সাংবাদিক সমাজ দেখাতে পারেন। তবে অবশ্যই কিছু সাহসী ব্যতিক্রমী সাংবাদিক, সংবাদপত্র আছে, কিন্তু কর্পোরেশনের মালিকানায় সংবাদপত্রগুলোর কর্মীদের ভিড়ে সেই ব্যতিক্রমদের দেখা মেলা কষ্টকর। একটা নেতিবাচক কিন্তু সত্য অবলোকনের যে চেষ্টা এই গদ্যে প্রকাশ হলো তার প্রায় উল্টোপিঠে ব্যতিক্রমী হলেও ‘দৈনিক সংবাদ’ দীর্ঘ ৭৫ বৎসর ধরে নিজেদের অবস্থান, গণমানুষের পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছে। রাজনীতির প্রগতিমুখী ভাষ্য ছাড়াও শিল্প-সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশে দৈনিক সংবাদ-এর ইতিহাস এখনও আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক আদর্শের জন্যই হোক, অথবা আর্থিক ঝুঁকির কারণেই দৈনিক সংবাদ হয়তো সবসময় সমাজের প্রতি প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট এবং গণবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সপক্ষে কখনো সোচ্চার ভূমিকা রাখেনি- যা অন্যান্য কর্পোরেশনের কাগজগুলো নগ্নভাবে করে আসছে। বিশেষ করে আজকে মুমূর্ষু দেশের নিবু নিবু প্রাণ প্রদীপের সলতেয় দৈনিক সংবাদ চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনায়ুর তেল সরবরাহ করার। যদিও সেই চেষ্টা স্বার্থান্বেষীদের ভিড়ে খুব চোখে পড়ে না।

জন্মেজয় সর্পসত্র যজ্ঞ করে সাপের বিনাশ শুরু করলেও কিছু বিজ্ঞদের ভুল অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্তে শেষপর্যন্ত তক্ষক এবং কিছু বিষাক্ত সাপ যজ্ঞের আগুন থেকে রেহাই পেয়ে যায়। সেইসব বিষধর বাঁকা পথের বাঁকা দৃষ্টির বিজ্ঞগণ এখন বংশ বিস্তার করতে করতে সব শুভ বুদ্ধির গলা টিপে ধরেছে। দৈনিক সংবাদ কি পারবে ওই সর্পকুলের হাত থেকে দেশের পতাকা রক্ষা করতে!

ছবি

গাছপাথরের সময়

ছবি

সন্তোষ গুপ্ত : এক বিরল ব্যক্তিত্ব

ছবি

সংস্কৃতি কি বাঁচাবে আমাদের?

ছবি

স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা নারীর সংখ্যালঘু-দশার শেষ কোথায়?

ছবি

পার্বত্য আদিবাসী সংস্কৃতির ভেতর-বাহির

ছবি

বিশ্বসেরা বিাশ্ববিদ্যালয়ে কাব্যচর্চা

ছবি

গণমাধ্যমের হাল-হকিকত

ছবি

গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য মুক্ত ভাবনার সুরক্ষা

ছবি

সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ জহুর হোসেন চৌধুরী

ছবি

পঁচাত্তর বছরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ

ছবি

গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

উত্তাল চল্লিশে দেশ বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?

গণমানুষের সংগ্রামের প্রগতিশীল মুখপত্র

ছবি

দৈনিক সংবাদের সাথেই বেড়ে উঠেছি

সংবাদ থাকুক সংবাদ-এর মতোই

ক্ষমতার হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই

tab

জন্মেজয় দৈনিক সংবাদ যেন সফল হয় সর্প নিধনে

সাদ কামালী

শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন

মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

‘সত্যকে আংশিকভাবে দেখিলে অনেক সময়ে তাহা মিথ্যার রূপান্তর ধারণ করে।’ আবার এও তো সত্য যে সত্যকে সবসময় সর্বতোভাবে দেখা বা উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতির বিভিন্ন দিক ও সম্ভাবনাগুলোকে সৎভাবে বোঝা এবং বোঝানো জাতীয় প্রয়োজনেই গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি পালন করবে প্রধানত আমাদের সংবাদপত্রগুলো এবং সমাজের বিজ্ঞজন বা বিশেষজ্ঞ সমাজ। এই আকাক্সক্ষাটিও সমাজ ও রাষ্ট্রের। সমাজ বা রাষ্ট্র আসলে বিমূর্ত ধারণা। মানুষ, সাধারণ জনগণই তার আধার। জনম-লীই গঠিত করে পরিবার সমজা রাষ্ট্র...।

জনম-লীর প্রতি দায়িত্ব পালন হলো মুখ্য কাজ। সংবাদপত্রের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তারা অবশ্যই এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবে না। কারণ তাদের ব্যর্থতার প্রভাব করোনার মতো সংক্রামক ব্যাধি হয়ে সমাজকে গ্রাস করে। এখন পর্যন্ত সৎসাংবাদিকতার অভাব স্বাধীন বাংলাদেশের বিপর্যয়ের পিছনে ভূমিকা রেখে আসছে। আমরা বরাবর দেখে আসছি, সেই সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম থেকেই রাষ্ট্রের প্রবল প্রতাপে সত্য, ন্যায় ও সততা গরম ফুটন্ত তেলে ও তেজের কাছে চর্বির টুকরার মতো গলে নিজেই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। পাঁচ যুগ বা পাঁচ দশক আগের দুই একটি ঘটনায় প্রত্যাশিত ভূমিকার ব্যাপক বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করতে চাই সাম্প্রতিক সময়ের তুলনীয় পরিবেশের জন্য। যেমন ডাকসুসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চলছে। স্বাধীন দেশে দ্বিতীয় ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এবারও সেপ্টেম্বর মাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সেই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর ভোট গণনার সময় ভয়াবহ সন্ত্রাসীযজ্ঞ ঘটিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওই সন্ত্রাসীযজ্ঞে ব্যবহৃত হয় ভারি ভারি আগ্নেয়াস্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত করার দায় বর্তায় তৎকালীন বিরোধী কিন্তু জনপ্রিয় প্যানেল জাসদ ছাত্রলীগের ওপর। প্রকৃত ঘটনা ও দোষীদের কর্তব্যরত সাংবাদিক ভাইয়েরা দেখেছিল; কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল দায়ী করে প্রতিপক্ষকে। সেই শুরুতেই যদি প্রধানপ্রধান সংবাদপত্রগুলো প্রকৃত দায়ীদের শনাক্ত করে খবর করত, তাহলে ওই সময়ের পরপরই আরও কিছু সহিংস ঘটনা বিশ্ববদ্যালয়ে ঘটা কঠিন হতো। শুধু জাসদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’ প্রকাশ করেছিল প্রকৃত সন্ত্রাসীদের পরিচয়। আবার বর্তমান এই নির্বাচনের সময় একটি প্রমাণিত প্রতিক্রিয়াশীল দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থক প্রতিবাদী ছাত্রীকে গণধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। কোনো সংবাদপত্র ওই সংগঠনের সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরে গণধর্ষণের হুমকিদাতাদের মুখোশ উন্মোচন করেছে? হ্যাঁ আমরা জানি হুমকিদাতার ছাত্র হিসেবে তার পরিচয়ের কথা, কিন্তু তার এবং মুরব্বি সংগঠনের রাজনৈতিক পরিচয় কেন সামনে এলো না! বর্তমানের এই সাময়িক সরকারে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওই একই গোষ্ঠীর প্রভাবের কথা আমরা সাধারণভাবে জানি; কিন্তু কোনো সংবাদপত্র তাদের নাম নিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় এবং ওই রাজনৈতিক দলের অতীত ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে? সেই পাঁচ যুগ আগে ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি তাজউদ্দীন আহমেদকে মন্ত্রিসভা থেকে সরে যেতে হলো। খুনী, বিশ্বাসঘাতক মোশতাক মন্ত্রিসভায় সরবে আসন করে নিল। তখন কোনো সংবাদপত্র সরকারের এই সিদ্ধান্তের চরম সর্বনাশটি চিনিয়ে দিয়েছিল বা সতর্ক করে দিয়েছিল? তখনো অনেকগুলো সংবাদপত্র ছিল, তখনো ‘বাকশাল’ কায়েম হয়নি। শুধু মৃত্যুভয়ই নয়, আর্থিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাতে হয়তো সংবাদপত্রগুলো সার্বিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ কথা ধরে নিলে সাহসিকতা এবং সততার কী পরিচয় থাকল!

সম্প্রতি কোনো কোনো ইউটিউবার ১৯৪৭কেই আমাদের স্বাধীনতা হিসেবে অথবা প্রথম স্বাধীনতা হিসেবে প্রচারে অনেক জ্ঞানের অপচয় করছেন। তাদের জ্ঞান বুদ্ধি বড়ই মৌলিক, কারণ ইতিহাস ও কা-জ্ঞান তাদের ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সমঝোতা ও আপোসের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ভাগ হওয়াকে তাদের মৌলিক জ্ঞানে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ওই স্বাধীনতার এক মাস পরেই বুঝতে পেরেছে সমঝোতার স্বাধীনতার স্বরূপ। ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত করে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমরা তখনো উপনিবেশ। কোনো সংবাদপত্র বা বিজ্ঞজনেরা সত্যের উন্মোচন করে বলেছিল বা বলছে ১৯৪৭ সালের আগস্টে আমরা ২য় বারের মতো উপনিবেশ হলাম পশ্চিম পাকিস্তানের। রবীন্দ্রনাথ সর্পজাতিকে বুদ্ধিমান বলতে চান। ‘নহিলে তাহারা বাঁকিয়া চলে কেন?’ এবং তিনি বিজ্ঞজনদেরও সাপের মতো বুদ্ধিমান ভাবছেন- যারা সত্যকে সহজে সোজা পথে দেখতে পান না। তিনি বলছেন, ‘হে বিজ্ঞগণ তোমরাও খুব বুদ্ধিমান, কিন্তু একটা বিষয় তোমাদের জানা নাই- পৃথিবীতে সিধা জিনিসও অনেক আছে। তোমাদের প্রাণের বাঁকা আর্শিতে যে একটা বাঁকা ছায়া দেখিতেছ, জগতের চেহারাখানা নিতান্তই অমনতর না।... জন্মেজয় যখন সর্পসত্র করিয়াছিলেন তখন কি গোটাকতক ঢোঁড়া সাপই মরিয়াছিল, তোমাদের মতো বিষাক্ত বুদ্ধিমান সাপগুলো ছিল কোথায়?’ ‘বিজ্ঞগণ’ বুদ্ধিমান শুধু অধ্যাপকবৃন্দই নন, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিকও তার অন্তর্ভুক্ত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ক্রমে যে অশুভ শক্তি আমাদের শুভবুদ্ধি ও সাধারণের মনকে বিপর্যস্ত করে তোলে সেই বিপন্ন বিপর্যস্ত মন ও মননই দেশে ভরে আছে। শুভবুদ্ধি, প্রকৃত জনবান্ধব মানুষ, নেতা, সংবাদপত্র এবং রাজনীতিকের অভাবে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে মুমূর্ষু, বলা যায় দেশ এখন ‘তাজা মরা’, মরে গেছে, কিন্তু পচে যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর অসহায় ভরসা করা ছাড়া আর কী উপায় আছে। ক্রম বিপর্যয়ের বিভিন্ন পর্বে জিয়া, এরশাদ, খালেদা বা সর্বশেষ শেখ হাসিনা সরকারের কোনো অন্যায়, ভুল সিদ্ধান্ত, লোভ, সন্ত্রাসের রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয় বিষয়ে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকা আমাদের আশান্বিত করতে পারেনি। বরং সত্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বস্তুগত লোভ লালসায় বহু সাংবাদিক নিজেদের লজ্জিত করেছেন। তাদের সাহসের অভাব এবং আপোসকামিতার সব নিদর্শন তারা রেখে চলেছেন। সাধারণ মানুষ বিভিন্ন সময়ে ’৪৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত অকাতরে যত বুকের রক্ত দিয়েছেন, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সামনে তেমন দৃষ্টান্ত কি আমাদের সাংবাদিক সমাজ দেখাতে পারেন। তবে অবশ্যই কিছু সাহসী ব্যতিক্রমী সাংবাদিক, সংবাদপত্র আছে, কিন্তু কর্পোরেশনের মালিকানায় সংবাদপত্রগুলোর কর্মীদের ভিড়ে সেই ব্যতিক্রমদের দেখা মেলা কষ্টকর। একটা নেতিবাচক কিন্তু সত্য অবলোকনের যে চেষ্টা এই গদ্যে প্রকাশ হলো তার প্রায় উল্টোপিঠে ব্যতিক্রমী হলেও ‘দৈনিক সংবাদ’ দীর্ঘ ৭৫ বৎসর ধরে নিজেদের অবস্থান, গণমানুষের পক্ষে তার অবস্থান তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছে। রাজনীতির প্রগতিমুখী ভাষ্য ছাড়াও শিল্প-সাহিত্যচর্চা ও প্রকাশে দৈনিক সংবাদ-এর ইতিহাস এখনও আলোচনার বিষয়। রাজনৈতিক আদর্শের জন্যই হোক, অথবা আর্থিক ঝুঁকির কারণেই দৈনিক সংবাদ হয়তো সবসময় সমাজের প্রতি প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট এবং গণবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সপক্ষে কখনো সোচ্চার ভূমিকা রাখেনি- যা অন্যান্য কর্পোরেশনের কাগজগুলো নগ্নভাবে করে আসছে। বিশেষ করে আজকে মুমূর্ষু দেশের নিবু নিবু প্রাণ প্রদীপের সলতেয় দৈনিক সংবাদ চেষ্টা করে যাচ্ছে জীবনায়ুর তেল সরবরাহ করার। যদিও সেই চেষ্টা স্বার্থান্বেষীদের ভিড়ে খুব চোখে পড়ে না।

জন্মেজয় সর্পসত্র যজ্ঞ করে সাপের বিনাশ শুরু করলেও কিছু বিজ্ঞদের ভুল অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্তে শেষপর্যন্ত তক্ষক এবং কিছু বিষাক্ত সাপ যজ্ঞের আগুন থেকে রেহাই পেয়ে যায়। সেইসব বিষধর বাঁকা পথের বাঁকা দৃষ্টির বিজ্ঞগণ এখন বংশ বিস্তার করতে করতে সব শুভ বুদ্ধির গলা টিপে ধরেছে। দৈনিক সংবাদ কি পারবে ওই সর্পকুলের হাত থেকে দেশের পতাকা রক্ষা করতে!

back to top