alt

suppliment » anniversary2025

গাছপাথরের সময়

হোসেন আবদুল মান্নান

: মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আশির দশকের শেষ দিকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলো তখন উত্তপ্ত। স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম পার্শ্বে এখনকার রাজু ভাস্কর্যের সোজা পূর্বদিকে একটি গোল চক্করের মতন জায়গা ছিল। সেখানে মাটি থেকে এক-দেড় ফুট উঁচু পাকা বেঞ্চের মতো বসার স্থান ছিল। উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করার পর খোলা আকাশের নিচে কেউ কেউ সেখানটায় একটু জিরিয়ে যেতেন। তবে স্থানটি প্রায় নির্ধারিত ছিল প্রথাবিরোধী লেখক, বয়োঃবৃদ্ধ বিপ্লবী ও আমৃত্যু প্রতিবাদী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের জন্য। যারাই বসতেন শরীফ স্যার এলেই উঠে সসম্মানে স্থান ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। সে-সময়ে কাউকে বসে থাকতে দেখিনি। ড. আহমদ শরীফ উদ্যানে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটতেন। তখন উদ্যানে দল বেঁধে হাঁটার চমৎকার ওয়াকিং ট্র্যাক ছিল। উত্তর দিকের শিশু পার্ক, পূর্বে ইঞ্জিনিয়ারস্ ইন্সটিটিউট হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের পুকুরের পাড় দিয়ে ঘুরে আসা যেত। তিনি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতেন। একটু হাঁপিয়ে উঠতেন তবু গল্প বলেই চলতেন। যেন কথা বলাতেই তাঁর আনন্দ ছিল। বৈকালিক হাঁটায় বেশিরভাগ সময়ে তাঁর সহগামী হতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত দুই দিকপাল অধ্যাপক। অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ফারুক এবং অধ্যাপক ড. মমতাজুর রহমান তরফদার। ড. ফারুক ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের ট্রেজারার। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যও ছিলেন। ড. তরফদার ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক ছিলেন। তিনি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের অন্যতম একজন একনিষ্ঠ সংগঠকও ছিলেন।

দুই.

শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে শরীফ স্যার ঈশারায় বলতেন, সকলই বসো। বসা মানে উদ্যানের সবুজ ঘাসে গোল হয়ে বসা। তাঁর দু’পাশে দুই মহারথী। সেকালের দুই মেধাবী অধ্যাপক। সামনে ঘাসের কার্পেটে আসন পেতে বসে আছেন ১৫ থেকে ২০ জন উৎসুক আগন্তুক। এরা শরীফ স্যারের অপরিচিত তবে সকলই নিবিড় শ্রোতা। বেশিরভাগই ছাত্র, অন্যান্য পেশাজীবীও হবে। মনে পড়ে, মাঝেমধ্যে সেখানে প্রয়াত অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকেও পেয়েছি। তিনি অধ্যাপক শরীফের সরাসরি ছাত্র এবং ভাবশিষ্যতুল্য ছিলেন। তবে তখনো তাঁর স্থান ঘাসের আসনেই ছিল। এঁদের সমাসনে নয়। আলোচনার বিষয়বস্তু কখনো নির্ধারিত করা থাকত না। কেউ বিশেষ কোনো ইস্যু উত্থাপন করলে শরীফ স্যার মন্তব্য করতেন। এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতেন বিচক্ষণ অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ফারুক। তাঁর কথায় সারাক্ষণপাবনা অঞ্চলের রসবোধের সংশ্লেষ জড়িয়ে থাকত। তিনি আলোচনা জোরালো করার স্বার্থে প্রশ্নকারী ছাত্রটিকে সহযোগিতা করে অধ্যাপক আহমদ শরীফকে কিছুটা উস্কে দিতেন। শরীফ স্যারের ভাষা ছিল শাণিত, ছুরির মতন ধারালো, সুস্পষ্ট বাক্যের তরঙ্গের মতো। যুক্তি ও তথ্যের অকাট্যতায় সবসময় বিমোহিত হতো তরুণ শ্রোতার দল। তাঁর বলায় শব্দ চয়নে ও কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যের মাহাত্ম্য ছিল অসাধারণ এবং অননুকরণীয়। যদিও সামনাসামনি মনে হতো, তিনি খানিকটা উত্তেজিত এবং কর্তৃত্ববাদী উপস্থাপক।

তিন.

একদিন বিকেলে প্রসঙ্গক্রমে কেউ একজন বললেন, আজকের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ‘গাছপাথর’-এর কলাম ‘সময় বহিয়া যায়’ এতে দেশের বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে একটা ভালো লেখা ছাপা হয়েছে।

‘তাতে কী লেখা হয়েছে?’ জানতে চান অধ্যাপক আহমদ শরীফ। সঙ্গে সঙ্গে স্বগতোক্তির মতো করে তিনি নিজেই বললেন, ‘তাঁর লেখায় কেমন যেন ইনিয়ে-বিনিয়ে পেঁচিয়ে বাক্য তৈরি করা হয়। তিনি কী বলতে চান তাও স্পষ্ট হয় বলে মনে হয় না’। উল্লেখ করা যায়, সেই বিখ্যাত কলামটির লেখক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

চার.

উল্লেখ্য, সেকালের ‘সংবাদ’ মানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এক মানসম্পন্ন দৈনিকের নাম। শিক্ষিত, রুচিবান শ্রেণিসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও ছিল ভরসা করার মতো কাগজ। দৈনিক সংবাদের উপসম্পাদকীয় কলাম, সাহিত্য সাময়িকীর পাতা, আন্তর্জাতিক ইস্যু বিষয়ক ফিচারসমূহ থেকে তখনকার তরুণ শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতো। সেকালে উপসম্পাদকীয় কলামের মধ্যে ‘গাছপাথর’ ছাড়াও বিখ্যাত লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন-এর ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের নিয়মিত কলাম, অধ্যাপক আহসাব উদ্দিনের কলাম, অধ্যাপক জহুরুল হকের ‘আগুনের কি গুণ’, সাহিত্যের পাতার ধারাবাহিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘অলস দিনের হাওয়া’ ইত্যাদি খুব জনপ্রিয় ছিল।

পাঁচ.

আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে ঘটনার এক দশক বাদে ১৯৯৯ সালের একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয় অধ্যাপক আহমদ শরীফের ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’। দুঃখজনক এবং সত্য যে, বইটা যেদিন মেলায় পৌঁছে এর আগের দিন রাতে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার উৎসর্গাংশে লেখা হলো- উৎসর্গ: ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রিয়বরেষু। এমনটা হয়তো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেও কখনো ভাবেননি। এ-ই ছিলেন অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ এবং তাঁর অভাবনীয় ব্যক্তিত্বের অনিঃশেষ ভুবন। উল্লেখ্য, তাঁর প্রয়াণের অব্যবহিত পরের প্রথম স্মরণসভায় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনোমুগ্ধকর ও হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য রেখেছিলেন। বলাবাহুল্য, উভয় অধ্যাপক ছিলেন বাম ঘরানার চিন্তাবিদ। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনীতির পর্যবেক্ষক, মার্কসীয় শিল্প-সাহিত্যের নিরলস পাঠক। এঁদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণের মূল চালিকাশক্তি ছিল চিরায়তমার্কসীয় দর্শন। তাঁরা উভয়ই দেশের একাধিক বাম রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিকতায় আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেছেন- যা তাঁদের ভাবনার জগতকে সবসময় একই সূত্রে বেঁধে রেখেছিল। এঁদের একজন আজও নবতিপর হয়ে বেঁচে আছেন। তিনি সরব, সচল এবং কর্মক্ষম। এই সব দেশপ্রেমিক, বরেণ্য, বিদ্বান ও আলোকিত মানুষগুলোর মুখ বারবার স্মরণের আয়নায় ভেসে উঠুক।

ছবি

সন্তোষ গুপ্ত : এক বিরল ব্যক্তিত্ব

ছবি

সংস্কৃতি কি বাঁচাবে আমাদের?

ছবি

স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা নারীর সংখ্যালঘু-দশার শেষ কোথায়?

ছবি

পার্বত্য আদিবাসী সংস্কৃতির ভেতর-বাহির

ছবি

বিশ্বসেরা বিাশ্ববিদ্যালয়ে কাব্যচর্চা

ছবি

গণমাধ্যমের হাল-হকিকত

ছবি

গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য মুক্ত ভাবনার সুরক্ষা

ছবি

সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ জহুর হোসেন চৌধুরী

ছবি

জন্মেজয় দৈনিক সংবাদ যেন সফল হয় সর্প নিধনে

ছবি

পঁচাত্তর বছরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ

ছবি

গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

উত্তাল চল্লিশে দেশ বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?

গণমানুষের সংগ্রামের প্রগতিশীল মুখপত্র

ছবি

দৈনিক সংবাদের সাথেই বেড়ে উঠেছি

সংবাদ থাকুক সংবাদ-এর মতোই

ক্ষমতার হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই

tab

suppliment » anniversary2025

গাছপাথরের সময়

হোসেন আবদুল মান্নান

মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

আশির দশকের শেষ দিকের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের ক্যাম্পাসগুলো তখন উত্তপ্ত। স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলন পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পশ্চিম পার্শ্বে এখনকার রাজু ভাস্কর্যের সোজা পূর্বদিকে একটি গোল চক্করের মতন জায়গা ছিল। সেখানে মাটি থেকে এক-দেড় ফুট উঁচু পাকা বেঞ্চের মতো বসার স্থান ছিল। উদ্যানে হাঁটাহাঁটি করার পর খোলা আকাশের নিচে কেউ কেউ সেখানটায় একটু জিরিয়ে যেতেন। তবে স্থানটি প্রায় নির্ধারিত ছিল প্রথাবিরোধী লেখক, বয়োঃবৃদ্ধ বিপ্লবী ও আমৃত্যু প্রতিবাদী অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফের জন্য। যারাই বসতেন শরীফ স্যার এলেই উঠে সসম্মানে স্থান ছেড়ে দিয়ে পাশে দাঁড়াতেন। সে-সময়ে কাউকে বসে থাকতে দেখিনি। ড. আহমদ শরীফ উদ্যানে প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটতেন। তখন উদ্যানে দল বেঁধে হাঁটার চমৎকার ওয়াকিং ট্র্যাক ছিল। উত্তর দিকের শিশু পার্ক, পূর্বে ইঞ্জিনিয়ারস্ ইন্সটিটিউট হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের পুকুরের পাড় দিয়ে ঘুরে আসা যেত। তিনি হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতেন। একটু হাঁপিয়ে উঠতেন তবু গল্প বলেই চলতেন। যেন কথা বলাতেই তাঁর আনন্দ ছিল। বৈকালিক হাঁটায় বেশিরভাগ সময়ে তাঁর সহগামী হতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত দুই দিকপাল অধ্যাপক। অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ফারুক এবং অধ্যাপক ড. মমতাজুর রহমান তরফদার। ড. ফারুক ছিলেন মার্কেটিং বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের ট্রেজারার। তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যও ছিলেন। ড. তরফদার ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক ছিলেন। তিনি দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের অন্যতম একজন একনিষ্ঠ সংগঠকও ছিলেন।

দুই.

শরীরের ঘাম মুছতে মুছতে শরীফ স্যার ঈশারায় বলতেন, সকলই বসো। বসা মানে উদ্যানের সবুজ ঘাসে গোল হয়ে বসা। তাঁর দু’পাশে দুই মহারথী। সেকালের দুই মেধাবী অধ্যাপক। সামনে ঘাসের কার্পেটে আসন পেতে বসে আছেন ১৫ থেকে ২০ জন উৎসুক আগন্তুক। এরা শরীফ স্যারের অপরিচিত তবে সকলই নিবিড় শ্রোতা। বেশিরভাগই ছাত্র, অন্যান্য পেশাজীবীও হবে। মনে পড়ে, মাঝেমধ্যে সেখানে প্রয়াত অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদকেও পেয়েছি। তিনি অধ্যাপক শরীফের সরাসরি ছাত্র এবং ভাবশিষ্যতুল্য ছিলেন। তবে তখনো তাঁর স্থান ঘাসের আসনেই ছিল। এঁদের সমাসনে নয়। আলোচনার বিষয়বস্তু কখনো নির্ধারিত করা থাকত না। কেউ বিশেষ কোনো ইস্যু উত্থাপন করলে শরীফ স্যার মন্তব্য করতেন। এক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতেন বিচক্ষণ অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ ফারুক। তাঁর কথায় সারাক্ষণপাবনা অঞ্চলের রসবোধের সংশ্লেষ জড়িয়ে থাকত। তিনি আলোচনা জোরালো করার স্বার্থে প্রশ্নকারী ছাত্রটিকে সহযোগিতা করে অধ্যাপক আহমদ শরীফকে কিছুটা উস্কে দিতেন। শরীফ স্যারের ভাষা ছিল শাণিত, ছুরির মতন ধারালো, সুস্পষ্ট বাক্যের তরঙ্গের মতো। যুক্তি ও তথ্যের অকাট্যতায় সবসময় বিমোহিত হতো তরুণ শ্রোতার দল। তাঁর বলায় শব্দ চয়নে ও কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্যের মাহাত্ম্য ছিল অসাধারণ এবং অননুকরণীয়। যদিও সামনাসামনি মনে হতো, তিনি খানিকটা উত্তেজিত এবং কর্তৃত্ববাদী উপস্থাপক।

তিন.

একদিন বিকেলে প্রসঙ্গক্রমে কেউ একজন বললেন, আজকের দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ‘গাছপাথর’-এর কলাম ‘সময় বহিয়া যায়’ এতে দেশের বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে একটা ভালো লেখা ছাপা হয়েছে।

‘তাতে কী লেখা হয়েছে?’ জানতে চান অধ্যাপক আহমদ শরীফ। সঙ্গে সঙ্গে স্বগতোক্তির মতো করে তিনি নিজেই বললেন, ‘তাঁর লেখায় কেমন যেন ইনিয়ে-বিনিয়ে পেঁচিয়ে বাক্য তৈরি করা হয়। তিনি কী বলতে চান তাও স্পষ্ট হয় বলে মনে হয় না’। উল্লেখ করা যায়, সেই বিখ্যাত কলামটির লেখক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

চার.

উল্লেখ্য, সেকালের ‘সংবাদ’ মানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এক মানসম্পন্ন দৈনিকের নাম। শিক্ষিত, রুচিবান শ্রেণিসহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেও ছিল ভরসা করার মতো কাগজ। দৈনিক সংবাদের উপসম্পাদকীয় কলাম, সাহিত্য সাময়িকীর পাতা, আন্তর্জাতিক ইস্যু বিষয়ক ফিচারসমূহ থেকে তখনকার তরুণ শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হতো। সেকালে উপসম্পাদকীয় কলামের মধ্যে ‘গাছপাথর’ ছাড়াও বিখ্যাত লেখক আবু জাফর শামসুদ্দিন-এর ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’, সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের নিয়মিত কলাম, অধ্যাপক আহসাব উদ্দিনের কলাম, অধ্যাপক জহুরুল হকের ‘আগুনের কি গুণ’, সাহিত্যের পাতার ধারাবাহিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘অলস দিনের হাওয়া’ ইত্যাদি খুব জনপ্রিয় ছিল।

পাঁচ.

আশ্চর্যের বিষয় হলো, সে ঘটনার এক দশক বাদে ১৯৯৯ সালের একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত হয় অধ্যাপক আহমদ শরীফের ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ’। দুঃখজনক এবং সত্য যে, বইটা যেদিন মেলায় পৌঁছে এর আগের দিন রাতে অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার উৎসর্গাংশে লেখা হলো- উৎসর্গ: ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রিয়বরেষু। এমনটা হয়তো অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী নিজেও কখনো ভাবেননি। এ-ই ছিলেন অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ এবং তাঁর অভাবনীয় ব্যক্তিত্বের অনিঃশেষ ভুবন। উল্লেখ্য, তাঁর প্রয়াণের অব্যবহিত পরের প্রথম স্মরণসভায় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনোমুগ্ধকর ও হৃদয়স্পর্শী বক্তব্য রেখেছিলেন। বলাবাহুল্য, উভয় অধ্যাপক ছিলেন বাম ঘরানার চিন্তাবিদ। সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনীতির পর্যবেক্ষক, মার্কসীয় শিল্প-সাহিত্যের নিরলস পাঠক। এঁদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজকে নিরীক্ষণ ও বিশ্লেষণের মূল চালিকাশক্তি ছিল চিরায়তমার্কসীয় দর্শন। তাঁরা উভয়ই দেশের একাধিক বাম রাজনৈতিক দলের আনুষ্ঠানিকতায় আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করেছেন- যা তাঁদের ভাবনার জগতকে সবসময় একই সূত্রে বেঁধে রেখেছিল। এঁদের একজন আজও নবতিপর হয়ে বেঁচে আছেন। তিনি সরব, সচল এবং কর্মক্ষম। এই সব দেশপ্রেমিক, বরেণ্য, বিদ্বান ও আলোকিত মানুষগুলোর মুখ বারবার স্মরণের আয়নায় ভেসে উঠুক।

back to top