মাছের ও আবাসন ব্যবসায়ের আগ্রাসনে ধ্বংস হচ্ছে হরিণার বিলের তিন ফসলি জমি। প্রাকৃতিক এই জলাধারটি ভরাট করে প্লট আকারে জমি বিক্রি করছে ‘রিয়েল স্টেট’ ব্যবসায়ীরা। আইন ভেঙে শ্রেণী পরিবর্তন করে বিলের উর্বর কৃষি জমির এভাবে বিনাশ চলছে। পাশাপাশি অনেক ধনী ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট কারোর অনুমোদন না নিয়েই এসব কৃষি জমিতে মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। আর এভাবে বিলের বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এতে এক সময়ের শষ্য ও মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ বিলটির প্রাকৃতিক বৈচিত্র ধ্বংসের মুখে এখন।
যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ও রামনগর ইউনিয়ন এলাকা জুড়ে হরিণার বিল। ইউনিয়ন পরিষদ দুটির দেয়া তথ্যমতে, বিলটি প্রায় ১৭ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। সদর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এই বিলের আয়তন প্রায় ৫০৭ হেক্টর। আবাদি জমি প্রায় ৪৮৫ হেক্টর। বিল হরিণা মূলত ধান আবাদ এলাকা। বিলের চাঁচড়া ও শংকরপুর অংশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্প গড়ে তুলে প্রাকৃতিক জলাশয়টি ভরাট করে প্লট আকারে ফসলি জমি বিক্রি চলছে। এক্ষেত্রে জমির শ্রেণী পরিবর্তনে ভূমি অফিসের কোনো অনুমতি নেয়া হচ্ছে না। ইচ্ছেমাফিক মাটি ফেলে বিল ভরাট চলছে। শংকরপুর বাস টার্মিনাল, যশোর মেডিকেল কলেজের আশপাশে চাঁচড়ার ভাতুড়িয়া ও মাহিদিয়া এলাকায় বিল ভরাট করে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় জমি বিক্রি করা হচ্ছে।
চাঁচড়ার ভাতুড়িয়া বাজার পার হলে সাইন বোর্ডে প্লট আকারে জমি বিক্রির বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে। গ্রিন ভিউ হাইজিং সিটির ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। বাজারটি থেকে কালাবাগা পর্যন্ত সড়কের পাশে বেশ কয়েক জায়গায় মাইল পোস্টের মতো করে নির্মিত কংক্রিটের স্থাপনায় লেখা হয়েছেÑ ‘গ্রিন ভিউ সিটিতে স্বাগতম’।
ভাতুড়িয়া বাজার পেরিয়ে প্লট আকারে জমি বিক্রির সাইনবোর্ড দেখা যায়। রাস্তার পাশে থাকা ওই সাইনবোর্ডের বর্ণনা অনুযায়ী বিলের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েক বিঘা জমি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। বিভিন্ন মাপের প্লট আকারে বিক্রি চলছে। বিলের মধ্যে বিদ্যুতের একটি বড় টাওয়ারের পাশে জমিটির অবস্থান।
সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বিল ধ্বংস করে জমি বিক্রি করছেন। জমি বিক্রিকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। মাঠে কাজ করে জীবন চালাই। এসব ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সস্পর্কে কিছু বলার সাহস নেই আমাদের। পত্রিকায় নাম প্রকাশ করা হবে না বলে আশ্বস্ত করলেও তারা মুখ খুলতে রাজি হননি।
যশোর শহরের বড় একটি অংশের পানি ড্রেনেজ সিস্টেমের মাধ্যমে হরিণার বিলে গিয়ে পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই জলাধারটি শুধুমাত্র পানি নিষ্কাশন নয়; ধান উৎপাদনেরও বিশাল একটি ক্ষেত্র। আর এভাবে ভরাটের মুখে বিলটি বছরভর জলাবদ্ধ হয়ে থাকছে। এতে ফি বছর ধান চাষিরা ফসলহানির কারণে বিরাট অঙ্কের লোকশান গুনছেন। যশোর শহরও ভারী বৃষ্টির দিনগুলোয় তলিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র হারাচ্ছে জলাধারটি।
তবে এভাবে বিল ধ্বংস চললেও আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও কোনো প্রয়োগ নেই। আইনে বিলকে প্রাকৃতিক জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনের সজ্ঞায় এমনটি উল্লেখ রয়েছে। এই আইনের বিধিনিষেধ সংক্রান্ত অংশে বলা হচ্ছে- প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন ও অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
আইনটি শাস্তি বিধান সংক্রান্ত অংশে বলা হয়েছে, এই আইন ভাঙলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হবে। শ্রেণী পরিবর্তন করা হলে বাধা দেয়া ও নির্মাণকৃত অংশ ভেঙে ফেলতে পারবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবকাঠামো আদালতের আদেশে বাজেয়াপ্তও করা যাবে। কিন্তু হরিণার বিলের জমির শ্রেণী অহরহ পরিবর্তন হচ্ছে। আবাসন ব্যবসায়ের পেটে চলে যাওয়াসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ হলেও আইনের কেনো প্রয়োগ নেই।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরিণার বিলের চাঁচড়ার ভাতুড়িয়ায় কালাবাগা খালের পাশে গ্রিন ভিউ হাউজিং সিটি নামে একটি হাউজিং প্রতিষ্ঠান বিলের প্রায় ৭ বিঘা জমি ভরাট করেছে। ওই জমি প্লট আকারে বিক্রি চলছে। জমি কেনার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ক্রেতা পরিচয় দিয়ে গ্রিন ভিউ হাউজিং সিটির ব্যবস্থাপক আবদুল্লা হেল বাকী’র মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি জানান, আপাতত ৭ বিঘার বেশি জমি ভরাট সম্পন্ন হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে আরও আট বিঘা জমি ভরাট করা হবে। এই প্রকল্প আরও সম্প্রাসরণ করে ৫০ বিঘায় উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি জানান, প্রথমে ৩৫টি প্লট নিয়ে যাত্রা শুরু হয় প্রকল্পটির। সেটি ৭৩টি প্লটে উন্নীত হবে শিগগিরি। মাটি দিয়ে বিল ভরাটের প্রক্রিয়া চলছে। আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে মাটি ভরাট সম্পন্ন হবে। প্রকল্পে বিভিন্ন মাপের প্লট রয়েছে। তিন দশমিক ৩৮ পয়েন্ট, সাড়ে ৪ শতক ও ৪ দশমি ৬৮ শতকের প্লট আছে। ১৮ ফুট বিশিষ্ট রাস্তার পাশে প্লট নিলে ১৫ লাখ টাকা ও ২২ ফুটের রাস্তার পাশের প্লটের দাম ২০ লাখ টাকার ওপর। ক্রেতাদের কাছে কোন শ্রেণীর জমি হিসেবে প্লট বিক্রি চলছে; বিলের জমি বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে আবাসনের জন্য অনুমতি নেয়া হয়েছে কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ধানী জমি হিসেবে এগুলো বিক্রির বন্দোবস্ত করেছেন। রেজিস্ট্রির সময় সেগুলো বাগান হিসেবে দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে দেবেন। ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্লট বিক্রিও করেছেন।
এই আবাসন প্রকল্পটির পাশে ভাতুড়িয়া মৌজার ‘১৮২৬/১৮১৭’ নম্বর দাগে ও ৭৮৮ নম্বর খতিয়ানে ১২৭ শতক জমিতে বহুতল একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা গড়ে তোলা হয়েছে। আবু বকর হাফিজিয়া ও এতিমখানা নামে ওই প্রতিষ্ঠানটির বহুতল ভবন নির্মাণের সময় বিল ভরাট করা হয়। ভবন নির্মাণ ছাড়াও চারপাশ সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বিল ভরাট করে ওই হাউজিং প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা নির্মাণ করায় বিলের একটি অংশে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিলের কালাবাগা ও রূপদিয়ার কয়েক’শ বিঘা জমি থেকে বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে আর পানি সরছে না। এবারের দুই দিনের ভারী বর্ষণের পর সেখানে রোপণ করা আমন চারা বুক সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। সপ্তাহের ব্যবধানেও পানি না সরায় চারা পচে নষ্ট হয়ে যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, হাউজিং ও মাদ্রাসার পাশে সারা বছরই এখন পানি জমে থাকছে। যার কারণে সেখানে কোনো ফসলই আবাদ করা যাচ্ছে না। ২০২০ সালের পর বিল ভরাট করে ওই মাদ্রাসা ও হাউজিং প্রকল্প শুরু হয়। এগুলোর উদ্যোক্তারা প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তি হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। বিলের জমি তাদের কারণে অনাবাদি হয়ে পড়লেও কিছু করতে পারছেন না।
তবে এসব তথ্যদাতাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় প্রতিবেদনে নাম না উল্লেখ করার শর্ত দেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবু বকর হাফিজিয়া ও এতিমখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তনের যেমন অনুমতি নেয়া হয়নি; ঠিক তেমনিভাবে ইউনিয় পরিষদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার অনুমোদনও নেয়া হয়নি।
চাঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইউনিয়ন এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য নকশার অনুমোদন নিতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে এক্ষেত্রে আবেদন করতে হয়। কিন্তু আবু বকর হাফিজিয়া ও এতিমখানা এসব নিয়ম অনুসরণ করেনি।
এ ব্যাপারে যশোর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল হাসান জানান, জমির শ্রেণী পরিবর্তনের একটি নীতিমালা আছে। সেই নীতি অনুসরণ করে সেটি পরিবর্তনের অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক শ্রেণী পরিবর্তনের অনুমতি দেন।
তিনি জানান, ভূমি সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে (স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনেন্সি অ্যাক্ট) কৃষিজমি কীভাবে জমির মালিক ব্যবহার করবেন সেটির উল্লেখ নেই। তবে পরিবেশ সংক্রান্ত জলাধার আইনে বলা আছে; জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। আইনে এটি ‘বারিত’ (নিষেধ) করা হয়েছে।
হরিণার বিলে হাউজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বিক্রি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এসব হাউজিং বা রিয়েল এসেস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই। হাউজিং প্রকল্পের নাম দিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি বিক্রি করেন অনেকে। হরিণার বিল ভরাট করে প্লট বিক্রির বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
মাছের ও আবাসন ব্যবসায়ের আগ্রাসনে ধ্বংস হচ্ছে হরিণার বিলের তিন ফসলি জমি। প্রাকৃতিক এই জলাধারটি ভরাট করে প্লট আকারে জমি বিক্রি করছে ‘রিয়েল স্টেট’ ব্যবসায়ীরা। আইন ভেঙে শ্রেণী পরিবর্তন করে বিলের উর্বর কৃষি জমির এভাবে বিনাশ চলছে। পাশাপাশি অনেক ধনী ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট কারোর অনুমোদন না নিয়েই এসব কৃষি জমিতে মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। আর এভাবে বিলের বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। এতে এক সময়ের শষ্য ও মৎস্য সম্পদে পরিপূর্ণ বিলটির প্রাকৃতিক বৈচিত্র ধ্বংসের মুখে এখন।
যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ও রামনগর ইউনিয়ন এলাকা জুড়ে হরিণার বিল। ইউনিয়ন পরিষদ দুটির দেয়া তথ্যমতে, বিলটি প্রায় ১৭ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। সদর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এই বিলের আয়তন প্রায় ৫০৭ হেক্টর। আবাদি জমি প্রায় ৪৮৫ হেক্টর। বিল হরিণা মূলত ধান আবাদ এলাকা। বিলের চাঁচড়া ও শংকরপুর অংশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠেছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্প গড়ে তুলে প্রাকৃতিক জলাশয়টি ভরাট করে প্লট আকারে ফসলি জমি বিক্রি চলছে। এক্ষেত্রে জমির শ্রেণী পরিবর্তনে ভূমি অফিসের কোনো অনুমতি নেয়া হচ্ছে না। ইচ্ছেমাফিক মাটি ফেলে বিল ভরাট চলছে। শংকরপুর বাস টার্মিনাল, যশোর মেডিকেল কলেজের আশপাশে চাঁচড়ার ভাতুড়িয়া ও মাহিদিয়া এলাকায় বিল ভরাট করে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় জমি বিক্রি করা হচ্ছে।
চাঁচড়ার ভাতুড়িয়া বাজার পার হলে সাইন বোর্ডে প্লট আকারে জমি বিক্রির বিজ্ঞাপন নজরে পড়ে। গ্রিন ভিউ হাইজিং সিটির ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড দেখা যায়। বাজারটি থেকে কালাবাগা পর্যন্ত সড়কের পাশে বেশ কয়েক জায়গায় মাইল পোস্টের মতো করে নির্মিত কংক্রিটের স্থাপনায় লেখা হয়েছেÑ ‘গ্রিন ভিউ সিটিতে স্বাগতম’।
ভাতুড়িয়া বাজার পেরিয়ে প্লট আকারে জমি বিক্রির সাইনবোর্ড দেখা যায়। রাস্তার পাশে থাকা ওই সাইনবোর্ডের বর্ণনা অনুযায়ী বিলের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েক বিঘা জমি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। বিভিন্ন মাপের প্লট আকারে বিক্রি চলছে। বিলের মধ্যে বিদ্যুতের একটি বড় টাওয়ারের পাশে জমিটির অবস্থান।
সেখানে অবস্থানরত কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বিল ধ্বংস করে জমি বিক্রি করছেন। জমি বিক্রিকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে জানতে চাইলে স্থানীয় কয়েকজন বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। মাঠে কাজ করে জীবন চালাই। এসব ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের সস্পর্কে কিছু বলার সাহস নেই আমাদের। পত্রিকায় নাম প্রকাশ করা হবে না বলে আশ্বস্ত করলেও তারা মুখ খুলতে রাজি হননি।
যশোর শহরের বড় একটি অংশের পানি ড্রেনেজ সিস্টেমের মাধ্যমে হরিণার বিলে গিয়ে পড়ে। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এই জলাধারটি শুধুমাত্র পানি নিষ্কাশন নয়; ধান উৎপাদনেরও বিশাল একটি ক্ষেত্র। আর এভাবে ভরাটের মুখে বিলটি বছরভর জলাবদ্ধ হয়ে থাকছে। এতে ফি বছর ধান চাষিরা ফসলহানির কারণে বিরাট অঙ্কের লোকশান গুনছেন। যশোর শহরও ভারী বৃষ্টির দিনগুলোয় তলিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রাণবৈচিত্র হারাচ্ছে জলাধারটি।
তবে এভাবে বিল ধ্বংস চললেও আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষায় আইন থাকলেও কোনো প্রয়োগ নেই। আইনে বিলকে প্রাকৃতিক জলাশয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনের সজ্ঞায় এমনটি উল্লেখ রয়েছে। এই আইনের বিধিনিষেধ সংক্রান্ত অংশে বলা হচ্ছে- প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণী পরিবর্তন ও অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না।
আইনটি শাস্তি বিধান সংক্রান্ত অংশে বলা হয়েছে, এই আইন ভাঙলে অনধিক ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হবে। শ্রেণী পরিবর্তন করা হলে বাধা দেয়া ও নির্মাণকৃত অংশ ভেঙে ফেলতে পারবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অবকাঠামো আদালতের আদেশে বাজেয়াপ্তও করা যাবে। কিন্তু হরিণার বিলের জমির শ্রেণী অহরহ পরিবর্তন হচ্ছে। আবাসন ব্যবসায়ের পেটে চলে যাওয়াসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ হলেও আইনের কেনো প্রয়োগ নেই।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হরিণার বিলের চাঁচড়ার ভাতুড়িয়ায় কালাবাগা খালের পাশে গ্রিন ভিউ হাউজিং সিটি নামে একটি হাউজিং প্রতিষ্ঠান বিলের প্রায় ৭ বিঘা জমি ভরাট করেছে। ওই জমি প্লট আকারে বিক্রি চলছে। জমি কেনার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ক্রেতা পরিচয় দিয়ে গ্রিন ভিউ হাউজিং সিটির ব্যবস্থাপক আবদুল্লা হেল বাকী’র মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি জানান, আপাতত ৭ বিঘার বেশি জমি ভরাট সম্পন্ন হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হলে আরও আট বিঘা জমি ভরাট করা হবে। এই প্রকল্প আরও সম্প্রাসরণ করে ৫০ বিঘায় উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি জানান, প্রথমে ৩৫টি প্লট নিয়ে যাত্রা শুরু হয় প্রকল্পটির। সেটি ৭৩টি প্লটে উন্নীত হবে শিগগিরি। মাটি দিয়ে বিল ভরাটের প্রক্রিয়া চলছে। আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে মাটি ভরাট সম্পন্ন হবে। প্রকল্পে বিভিন্ন মাপের প্লট রয়েছে। তিন দশমিক ৩৮ পয়েন্ট, সাড়ে ৪ শতক ও ৪ দশমি ৬৮ শতকের প্লট আছে। ১৮ ফুট বিশিষ্ট রাস্তার পাশে প্লট নিলে ১৫ লাখ টাকা ও ২২ ফুটের রাস্তার পাশের প্লটের দাম ২০ লাখ টাকার ওপর। ক্রেতাদের কাছে কোন শ্রেণীর জমি হিসেবে প্লট বিক্রি চলছে; বিলের জমি বিক্রির ক্ষেত্রে কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে আবাসনের জন্য অনুমতি নেয়া হয়েছে কী না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ধানী জমি হিসেবে এগুলো বিক্রির বন্দোবস্ত করেছেন। রেজিস্ট্রির সময় সেগুলো বাগান হিসেবে দেখিয়ে রেজিস্ট্রি করিয়ে দেবেন। ইতোমধ্যে অনেকগুলো প্লট বিক্রিও করেছেন।
এই আবাসন প্রকল্পটির পাশে ভাতুড়িয়া মৌজার ‘১৮২৬/১৮১৭’ নম্বর দাগে ও ৭৮৮ নম্বর খতিয়ানে ১২৭ শতক জমিতে বহুতল একটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা গড়ে তোলা হয়েছে। আবু বকর হাফিজিয়া ও এতিমখানা নামে ওই প্রতিষ্ঠানটির বহুতল ভবন নির্মাণের সময় বিল ভরাট করা হয়। ভবন নির্মাণ ছাড়াও চারপাশ সুউচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বিল ভরাট করে ওই হাউজিং প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা নির্মাণ করায় বিলের একটি অংশে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিলের কালাবাগা ও রূপদিয়ার কয়েক’শ বিঘা জমি থেকে বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে আর পানি সরছে না। এবারের দুই দিনের ভারী বর্ষণের পর সেখানে রোপণ করা আমন চারা বুক সমান পানিতে তলিয়ে গেছে। সপ্তাহের ব্যবধানেও পানি না সরায় চারা পচে নষ্ট হয়ে যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, হাউজিং ও মাদ্রাসার পাশে সারা বছরই এখন পানি জমে থাকছে। যার কারণে সেখানে কোনো ফসলই আবাদ করা যাচ্ছে না। ২০২০ সালের পর বিল ভরাট করে ওই মাদ্রাসা ও হাউজিং প্রকল্প শুরু হয়। এগুলোর উদ্যোক্তারা প্রভাবশালী ও ধনী ব্যক্তি হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। বিলের জমি তাদের কারণে অনাবাদি হয়ে পড়লেও কিছু করতে পারছেন না।
তবে এসব তথ্যদাতাদের কেউ নাম প্রকাশ করতে চাননি। রোষানলে পড়ার আশঙ্কায় প্রতিবেদনে নাম না উল্লেখ করার শর্ত দেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবু বকর হাফিজিয়া ও এতিমখানা নির্মাণের ক্ষেত্রে কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তনের যেমন অনুমতি নেয়া হয়নি; ঠিক তেমনিভাবে ইউনিয় পরিষদ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নকশার অনুমোদনও নেয়া হয়নি।
চাঁচড়া ইউনিয়ন পরিষদের সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানান, ইউনিয়ন এলাকায় ভবন নির্মাণের জন্য নকশার অনুমোদন নিতে হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে এক্ষেত্রে আবেদন করতে হয়। কিন্তু আবু বকর হাফিজিয়া ও এতিমখানা এসব নিয়ম অনুসরণ করেনি।
এ ব্যাপারে যশোর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদুল হাসান জানান, জমির শ্রেণী পরিবর্তনের একটি নীতিমালা আছে। সেই নীতি অনুসরণ করে সেটি পরিবর্তনের অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক শ্রেণী পরিবর্তনের অনুমতি দেন।
তিনি জানান, ভূমি সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনে (স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনেন্সি অ্যাক্ট) কৃষিজমি কীভাবে জমির মালিক ব্যবহার করবেন সেটির উল্লেখ নেই। তবে পরিবেশ সংক্রান্ত জলাধার আইনে বলা আছে; জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তন করা যাবে না। আইনে এটি ‘বারিত’ (নিষেধ) করা হয়েছে।
হরিণার বিলে হাউজিং প্রতিষ্ঠানগুলোর জমির শ্রেণী পরিবর্তন করে বিক্রি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, এসব হাউজিং বা রিয়েল এসেস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেরই নিবন্ধন নেই। হাউজিং প্রকল্পের নাম দিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি বিক্রি করেন অনেকে। হরিণার বিল ভরাট করে প্লট বিক্রির বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।