শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের উত্থান ও ২০১৩ সালে কাজাখিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর প্রস্তাবিত ‘বিআরই’ বা বেল্ট রোড অ্যান্ড ইনেশিয়াটিভ প্রকল্প ভারত সাগর থেকে লোহিত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ঢেউ তুলেছে। চীনের এই প্রকল্পের বিপরীতে বিশে^র প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাডেজি’ বা আইপিএস এবং যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ ‘কোয়াড’ গঠন করেছে। বিআরই, আইপিএস ও কোয়াড দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
এশিয়ার উদীয়মান দুই অর্থনীতি চীন ও ভারত। সীমান্তে নানা ইস্যুতে বিরোধ সত্ত্বেও চীন ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক ইর্ষণীয়। দুই দেশ মার্কিন বলয়ের বিকল্প ব্রিকসের সদস্য। ব্রিকস বিশে^র ২৩ শতাংশ জিডিপি ও ৩২ শতাংশ জিডিপি পিপিপি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিকসের নিউ ডেভেলেভমেন্ট ব্যাংকের পুঁজি ১০০ বিলিয়ন ডলার, বার্ষিক ঋণ প্রদান ৩৪ বিলিয়ন ডলার পার করছে। এছাড়া নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা এসসিও’র প্রভাবশালী সদস্য চীন ও ভারত। কিন্তু গত তিন চার বছরে চীন ভারতের সম্পর্ক মুখোমুখি দাঁড় হয়েছে। চীনের বিআরই প্রকল্পে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত। গত বছর করোনা মহামারির মধ্যে দুই দেশের সীমান্তে সৈন্যদের সংঘর্ষ বাণিজ্য সম্পর্ক এমনকি স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ককেও নি¤œমুখী করেছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস এবং কোয়াডের নির্ভরযোগ্য খুঁটি ভারত।
অন্যদিকে বিআরই প্রকল্প দিয়ে চীন দক্ষিণ এশিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজস্ব বলয় তৈরি করে ফেলছে। বিআরই মূলত একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প যেখানে রেল, সড়ক ও সাগর পথে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করবে। এই প্রকল্পের অধীনে চীন ৮ হাজার কিলোমিটার সড়ক বা রেলপথ নির্মাণ করতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বিশে^র ৪০% জিডিপি। ইতিমধ্যে ভারত ও ভূটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সবক’টি দেশের সঙ্গে চীন বিআরই নিয়ে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া বিআরই প্রকল্পের ৬ টি করিডোরের ২ টি ‘চীন-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর’ ও ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’ যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার উপর দিয়ে।
চীন এই প্রকল্পের অধীনে হংকং, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ হয়ে জিবুতি, সুদান পর্যন্ত সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করে একটি সামুদ্রিক অর্থনৈতিক হাব তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে। বিনিয়োগ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করছে। চীন শুধু ব্যবসা করছে না, করছে ভূ-রাজনীতিও। মালদ্বীপে ২০১১ সালের আগে চীনের দূতাবাস না থাকলেও এখন দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বানিজ্য চুক্তি রয়েছে। রাজধানী মালের সঙ্গে বিমান বন্দর দ্বীপ হুলহুলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী ব্রিজসহ বিআরই প্রকল্পের অধীনে বহু প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ চলছে মালদ্বীপজুড়ে। SENTO CEATO এর একসময়কার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও মার্কিন মিত্র পাকিস্তান পিংপং কূটনীতির মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা করেছিল। সে পাকিস্তান এখন চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। বিআরই প্রকল্পের অধীনে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে পাকিস্তানে চীন বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে ৬০-৯০ বিলিয়ন ডলার যা পাকিস্তানের মোট জিডিপির ১৪-২০%।
বিআরই প্রকল্পের অধীনে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর বিনিয়োগ ফাঁদে পড়ে চীনের হস্তগত হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এই সমালোচনা শ্রীলঙ্কায় চীনা বিনিয়োগ দমাতে পারেনি। কলম্বো বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের কর্মযজ্ঞ চলছে শ্রীলঙ্কায়। শুধু বিনিয়োগ নয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে চীন শ্রীলঙ্কার ছাতা হয়ে থাকছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ইউএনএইচআরসি আনা একটি নিন্দা প্রস্তাবে চীন তার মিত্রসমেত শ্রীলঙ্কার পক্ষে ভেটো দিয়েছে।
বর্তমানে নেপালে চীনের বিআরই প্রকল্পের অধীনে ২৪ টি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। তৃতীয় দেশের সঙ্গে বানিজ্য করতে চীনা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি, নেপালের সীমান্ত শহর খাসা থেকে তিব্বতের লাসা পর্যন্ত রেল নির্মাণ, কাঠমান্ডু-পোখরান-লুম্বিনি রেল প্রজেক্টের মাধ্যমে নেপালের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিচ্ছে চীন। ফলে কাঠমান্ডুর রাজনীতিতে দিল্লির পাশাপাশি বেইজিংও একটি কলকাঠি।
বাংলাদেশের বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা বহুমুখী সেতুতে বিশ^ব্যাংক বিনিয়োগ আটকে দিলে কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়ায় চীন। সেতুটির রেল সংযোগ চীনের বিআরই প্রকল্পের অংশ হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প পেয়েছে চীন, নির্মাণ করছে দেশের প্রথম টানেল পথ। বাংলাদেশের বাণিজ্য রাজধানী চট্টগ্রাম থেকে সীমান্তবর্তী শহর কক্সবাজার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ চলছে পুরোদমে। চীনের বিভিন্ন ঋণদানকারী ব্যাংক বর্তমানে বিশে^র ৩৭টি দেশের ৪০০টি প্রকল্পে ১১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।
চীনের বিআরই প্রকল্পের রাজনৈতিক অর্থনীতি, চীনের জালের মতো বিস্তার প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের ‘কোয়াড’ গঠন। ২০১৭ সালে আসিয়ান সম্মেলনের সাইডলাইনে এই সংস্থা নিয়ে সদস্য দেশগুলো একমত হলেও এতদিন অস্ট্রেলিয়ার গড়িমসি নিয়ে এতদিন সংস্থার কার্যক্রমে গতি আসেনি। ২০২০ সালে কোয়াড প্লাস সদস্য হয় দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে গত বছরের এপ্রিলে করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা নিয়ে চীন-অস্ট্রেলিয়া বাগবিতন্ডা কোয়াডকে গতি দেয়। প্রথমবারের মতো কোয়াড সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০২০ এর নভেম্বরে মালাবার মহড়ায় অংশ নেয়।
অন্যদিকে চীনের রয়েছে নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা এসসিও। এই এসসিও সদস্যরাষ্ট্রগুলো ইউরেশিয়ান মার্কিন বিরোধী রাষ্ট্র। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ভারত এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ইরান, তুরস্ক ও কাতারও এসসিও’র সদস্য হতে চায়। তবে এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস ও চতুর্দেশীয় কোয়াডের বিপরীতে চীন নতুন জোট রিজওয়ানাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আইপিএস) নিয়ে ভাবছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন অসম প্রতিযোগিতার সময়ে কোয়াড ও যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক স্ট্রাডেজির সদস্য হয়ে ভারত কীভাবে ব্রিকস ও এসসিও’রও সদস্য হয়ে ভারসাম্য করবে তা দেখার বিষয়।
চীন বিআরই প্রকল্পের অধীনে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও কোয়াড রাষ্ট্রগুলো চীনের রাজনৈতিক বিনিয়োগের আড়ালের ভূ-রাজনীতি মোকাবিলায় বদ্ধপরিকর। বিআরই, আইপিএস, কোয়াড ও এসসিওর শক্তি প্রদর্শনের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়া ও এই অঞ্চলের সমুদ্র অঞ্চল। কেননা উভয়পক্ষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রভাব তৈরিতে মরিয়া। ইতোমধ্যে বিনিয়োগে চীন ভালো অবস্থানে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবক’টি রাষ্ট্রই বিনিয়োগ, বাজার, রপ্তানিতে কোয়াড রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল। সর্বশেষ কোয়াড বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভারতে ১০০ কোটি কোভিড-১৯ টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে নড়েচড়ে বসেছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশ নিয়ে চীন কোভিড ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফ্যাসিলিটি নামে একটা গ্রুপ তৈরি করেছে। চীনের এই গ্রুপে আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও নেপাল। এই দেশগুলোর সঙ্গে আবার কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে চীন ও কোয়াডের মাঝখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ভারসাম্য করতে বেশ বেগ পেতে হবে। চীন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যত তিক্ত হবে ততই এসব দেশের পর নানা দিক থেকে কূটনৈতিক চাপ আসবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান (সার্ক) ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি ]
শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন
শনিবার, ২২ মে ২০২১
বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের উত্থান ও ২০১৩ সালে কাজাখিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর প্রস্তাবিত ‘বিআরই’ বা বেল্ট রোড অ্যান্ড ইনেশিয়াটিভ প্রকল্প ভারত সাগর থেকে লোহিত সাগর হয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত ঢেউ তুলেছে। চীনের এই প্রকল্পের বিপরীতে বিশে^র প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাডেজি’ বা আইপিএস এবং যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট কোয়াড্রিল্যাটেরাল সিকিউরিটি ডায়লগ ‘কোয়াড’ গঠন করেছে। বিআরই, আইপিএস ও কোয়াড দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে।
এশিয়ার উদীয়মান দুই অর্থনীতি চীন ও ভারত। সীমান্তে নানা ইস্যুতে বিরোধ সত্ত্বেও চীন ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক ইর্ষণীয়। দুই দেশ মার্কিন বলয়ের বিকল্প ব্রিকসের সদস্য। ব্রিকস বিশে^র ২৩ শতাংশ জিডিপি ও ৩২ শতাংশ জিডিপি পিপিপি নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিকসের নিউ ডেভেলেভমেন্ট ব্যাংকের পুঁজি ১০০ বিলিয়ন ডলার, বার্ষিক ঋণ প্রদান ৩৪ বিলিয়ন ডলার পার করছে। এছাড়া নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা এসসিও’র প্রভাবশালী সদস্য চীন ও ভারত। কিন্তু গত তিন চার বছরে চীন ভারতের সম্পর্ক মুখোমুখি দাঁড় হয়েছে। চীনের বিআরই প্রকল্পে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত। গত বছর করোনা মহামারির মধ্যে দুই দেশের সীমান্তে সৈন্যদের সংঘর্ষ বাণিজ্য সম্পর্ক এমনকি স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ককেও নি¤œমুখী করেছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস এবং কোয়াডের নির্ভরযোগ্য খুঁটি ভারত।
অন্যদিকে বিআরই প্রকল্প দিয়ে চীন দক্ষিণ এশিয়াসহ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে নিজস্ব বলয় তৈরি করে ফেলছে। বিআরই মূলত একটি অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প যেখানে রেল, সড়ক ও সাগর পথে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করবে। এই প্রকল্পের অধীনে চীন ৮ হাজার কিলোমিটার সড়ক বা রেলপথ নির্মাণ করতে চায়, নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বিশে^র ৪০% জিডিপি। ইতিমধ্যে ভারত ও ভূটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার সবক’টি দেশের সঙ্গে চীন বিআরই নিয়ে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া বিআরই প্রকল্পের ৬ টি করিডোরের ২ টি ‘চীন-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর’ ও ‘চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর’ যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার উপর দিয়ে।
চীন এই প্রকল্পের অধীনে হংকং, কম্বোডিয়া, মায়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ হয়ে জিবুতি, সুদান পর্যন্ত সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করে একটি সামুদ্রিক অর্থনৈতিক হাব তৈরীর উদ্যোগ নিয়েছে। বিনিয়োগ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি করছে। চীন শুধু ব্যবসা করছে না, করছে ভূ-রাজনীতিও। মালদ্বীপে ২০১১ সালের আগে চীনের দূতাবাস না থাকলেও এখন দুই দেশের মধ্যে মুক্ত বানিজ্য চুক্তি রয়েছে। রাজধানী মালের সঙ্গে বিমান বন্দর দ্বীপ হুলহুলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনকারী ব্রিজসহ বিআরই প্রকল্পের অধীনে বহু প্রকল্পের কর্মযজ্ঞ চলছে মালদ্বীপজুড়ে। SENTO CEATO এর একসময়কার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও মার্কিন মিত্র পাকিস্তান পিংপং কূটনীতির মাধ্যমে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপনে মধ্যস্থতা করেছিল। সে পাকিস্তান এখন চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। বিআরই প্রকল্পের অধীনে চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে পাকিস্তানে চীন বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে ৬০-৯০ বিলিয়ন ডলার যা পাকিস্তানের মোট জিডিপির ১৪-২০%।
বিআরই প্রকল্পের অধীনে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর বিনিয়োগ ফাঁদে পড়ে চীনের হস্তগত হওয়ার বিষয়টি ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এই সমালোচনা শ্রীলঙ্কায় চীনা বিনিয়োগ দমাতে পারেনি। কলম্বো বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে চীনা বিনিয়োগের কর্মযজ্ঞ চলছে শ্রীলঙ্কায়। শুধু বিনিয়োগ নয় রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে চীন শ্রীলঙ্কার ছাতা হয়ে থাকছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ইউএনএইচআরসি আনা একটি নিন্দা প্রস্তাবে চীন তার মিত্রসমেত শ্রীলঙ্কার পক্ষে ভেটো দিয়েছে।
বর্তমানে নেপালে চীনের বিআরই প্রকল্পের অধীনে ২৪ টি প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। তৃতীয় দেশের সঙ্গে বানিজ্য করতে চীনা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি, নেপালের সীমান্ত শহর খাসা থেকে তিব্বতের লাসা পর্যন্ত রেল নির্মাণ, কাঠমান্ডু-পোখরান-লুম্বিনি রেল প্রজেক্টের মাধ্যমে নেপালের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিচ্ছে চীন। ফলে কাঠমান্ডুর রাজনীতিতে দিল্লির পাশাপাশি বেইজিংও একটি কলকাঠি।
বাংলাদেশের বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা বহুমুখী সেতুতে বিশ^ব্যাংক বিনিয়োগ আটকে দিলে কারিগরি সহযোগিতা নিয়ে পাশে দাঁড়ায় চীন। সেতুটির রেল সংযোগ চীনের বিআরই প্রকল্পের অংশ হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া পায়রা বন্দর নির্মাণ প্রকল্প পেয়েছে চীন, নির্মাণ করছে দেশের প্রথম টানেল পথ। বাংলাদেশের বাণিজ্য রাজধানী চট্টগ্রাম থেকে সীমান্তবর্তী শহর কক্সবাজার হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ চলছে পুরোদমে। চীনের বিভিন্ন ঋণদানকারী ব্যাংক বর্তমানে বিশে^র ৩৭টি দেশের ৪০০টি প্রকল্পে ১১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে।
চীনের বিআরই প্রকল্পের রাজনৈতিক অর্থনীতি, চীনের জালের মতো বিস্তার প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের ‘কোয়াড’ গঠন। ২০১৭ সালে আসিয়ান সম্মেলনের সাইডলাইনে এই সংস্থা নিয়ে সদস্য দেশগুলো একমত হলেও এতদিন অস্ট্রেলিয়ার গড়িমসি নিয়ে এতদিন সংস্থার কার্যক্রমে গতি আসেনি। ২০২০ সালে কোয়াড প্লাস সদস্য হয় দক্ষিণ কোরিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে গত বছরের এপ্রিলে করোনা মোকাবেলায় ব্যর্থতা নিয়ে চীন-অস্ট্রেলিয়া বাগবিতন্ডা কোয়াডকে গতি দেয়। প্রথমবারের মতো কোয়াড সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০২০ এর নভেম্বরে মালাবার মহড়ায় অংশ নেয়।
অন্যদিকে চীনের রয়েছে নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা এসসিও। এই এসসিও সদস্যরাষ্ট্রগুলো ইউরেশিয়ান মার্কিন বিরোধী রাষ্ট্র। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান ও ভারত এই সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ইরান, তুরস্ক ও কাতারও এসসিও’র সদস্য হতে চায়। তবে এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস ও চতুর্দেশীয় কোয়াডের বিপরীতে চীন নতুন জোট রিজওয়ানাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আইপিএস) নিয়ে ভাবছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন অসম প্রতিযোগিতার সময়ে কোয়াড ও যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া প্যাসিফিক স্ট্রাডেজির সদস্য হয়ে ভারত কীভাবে ব্রিকস ও এসসিও’রও সদস্য হয়ে ভারসাম্য করবে তা দেখার বিষয়।
চীন বিআরই প্রকল্পের অধীনে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও কোয়াড রাষ্ট্রগুলো চীনের রাজনৈতিক বিনিয়োগের আড়ালের ভূ-রাজনীতি মোকাবিলায় বদ্ধপরিকর। বিআরই, আইপিএস, কোয়াড ও এসসিওর শক্তি প্রদর্শনের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে দক্ষিণ এশিয়া ও এই অঞ্চলের সমুদ্র অঞ্চল। কেননা উভয়পক্ষ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রভাব তৈরিতে মরিয়া। ইতোমধ্যে বিনিয়োগে চীন ভালো অবস্থানে হলেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবক’টি রাষ্ট্রই বিনিয়োগ, বাজার, রপ্তানিতে কোয়াড রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল। সর্বশেষ কোয়াড বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ভারতে ১০০ কোটি কোভিড-১৯ টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এতে নড়েচড়ে বসেছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশ নিয়ে চীন কোভিড ইমার্জেন্সি মেডিকেল ফ্যাসিলিটি নামে একটা গ্রুপ তৈরি করেছে। চীনের এই গ্রুপে আছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও নেপাল। এই দেশগুলোর সঙ্গে আবার কোয়াডভুক্ত দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ফলে চীন ও কোয়াডের মাঝখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ভারসাম্য করতে বেশ বেগ পেতে হবে। চীন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যত তিক্ত হবে ততই এসব দেশের পর নানা দিক থেকে কূটনৈতিক চাপ আসবে।
[লেখক : শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান (সার্ক) ইউনিভার্সিটি, নয়াদিল্লি ]