হুয়ান রুলফোর গল্প
অনুবাদ : শাহাব আহমেদ
আমি ব্যাঙগুলোর বের হয়ে আসার অপেক্ষায় ড্রেনের পাশে বসে আছি। গতকালের নৈশভোজের সময় ওরা ভীষণভাবে ডাকতে শুরু করে এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত তাদের গান নিস্তব্ধ হয় না। আমার পালক-মা’ও তাই বলেছে, ওদের চিৎকার তার মধ্যে এতটাই ভয়ের সঞ্চার করেছে যে, সে ঘুমাতে পারেনি। এখন তার একটু না ঘুমালেই নয়। তাই সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে একটি কাঠের বোর্ড হাতে নিয়ে এখানে বসে থাকতে, কোনো ব্যাঙ লাফ দিয়ে ড্রেন থেকে বের হয়ে এলেই পিটিয়ে ভর্তা করে দেবার জন্য। পেটের জায়গাটুকু ছাড়া ব্যাঙগুলোর সারা শরীর সবুজ কিন্তু কোলাব্যাঙ কালো, আমার পালক-মায়ের চোখগুলোও কালো। ব্যাঙ খেতে খুব স্বাদু, তবে কোলাব্যাঙ নয়, ওদের কেউ খায় না। লোকে না খেলেও আমি খাই এবং স্বাদ তাদের ব্যাঙের মাংসের মতোই। ফেলিপা’ই বলে যে, কোলাব্যাঙ খাওয়া ভালো নয়। ফেলিপার চোখগুলো বিড়ালের চোখের মতো সবুজ। খাবার সময় হলে রান্নাঘরে সেই আমাকে খেতে দেয়। সে চায় না আমি ব্যাঙেদের কষ্ট দিই। পালক-মা উল্টা তাদের মারতেই বলে। আমি পালক-মায়ের চেয়ে ফেলিপাকে বেশি পছন্দ করি, যদিও পালক-মা’ই তার ব্যাগ খুলে ফেলিপার হাতে টাকা তুলে দেয় বাজার করার জন্য।
ফেলিপা একা রান্না করে আমাদের তিনজনের জন্য। যতদিন থেকে আমি তাকে চিনি এটাই তার কাজ। থালা-বাসন ধুই আমি। চুলোর জন্য কাঠ এনে দেয়ার দায়িত্বও আমার। পালক-মা নিজে খাওয়া শেষ করে নিজ হাতে দুটো ছোট স্তূপে আমাদের খাবার পরিবেশন করে, একটি আমার, অন্যটি ফেলিপার। তবে মাঝে মাঝে ফেলিপা বলে তার ক্ষুধা নেই, তখন দুটো স্তূপই আমার জোটে। একারণেই আমি ফেলিপাকে ভালোবাসি। আমি সদাই ক্ষুধার্ত এবং আমার কখনই পেট ভরে না, কখনই না, এমনকি আমি যখন নিজেরটুকু খেয়ে ওর খাবারও খাই। তারা বলে, খেয়ে মানুষের পেট ভরে কিন্তু আমি নিশ্চিত করে জানি, আমার পেট ভরে না, তাদের দেয়া সবটুকু খাদ্য খেয়েও না। ফেলিপাও এটা জানে। আশেপাশের লোকজন বলে, আমার মাথার ঠিক নেই, কারণ কখনই আমার ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না। পালক-মা তাদের মুখে এ কথা শুনেছে। আমি শুনি নাই। পালক-মা আমাকে একা বাইরে যেতে দেয় না। যখন সে আমাকে বাইরে নেয়, নেয় শুধু গির্জায় ভজন শুনতে যাবার সময়। সেখানে তার পাশে বসিয়ে শাল দিয়ে আমার হাতদুটো বেঁধে রাখে। আমি জানি না কেন সে আমার হাত বাঁধে, কিন্তু সে বলে, লোকমুখে শুনেছে আমি নাকি বিদঘুটে সব ঘটনা ঘটাই। একদিন নাকি তারা আমাকে দেখেছে কারো গলায় ফাঁস দিতে। সেটা ছিল এক মহিলা যার গলায় আমি ফাঁস দিয়েছিলাম কোনো কারণ ছাড়াই। আমার এমন কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু একমাত্র পালক-মা’ই বলে যে আমি এসব করি এবং মিথ্যা কথা বলা তার স্বভাব নয়। সে আমাকে যখন ডাকে, ডাকে খেতে দেবার জন্য। সে অন্যদের মত নয়, যারা আমাকে তাদের সাথে খাবার খেতে দাওয়াত দেয় কিন্তু কাছে গেলেই ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে যতক্ষণ না আমি কোনো কিছু না খেয়েই পালিয়ে আসি। পালক-মা এমন নয়, সে আমার প্রতি সদয়। এ কারণেই আমি তুষ্ট চিত্তে তার বাড়িতে আছি। তাছাড়া, ফেলিপা এখানে থাকে। সে আমার প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল এবং আমি তাকে ভালো না বেসে পারি না। তার দুধ ঝুমকোজবার মত মিষ্টি। আমি ছাগীর দুধ খেয়েছি, সদ্য ছানা জন্ম-দেয়া শূকরীর দুধও খেয়ে দেখেছি, কিন্তু না, কোনোটাই ফেলিপার দুধের মতো এত স্বাদু নয়। যদিও অনেকদিন পার হয়ে গেছে যখন সে আমাকে তার স্তন পান করতে দিয়েছে। আমাদের যেখানে পাঁজর, সেখানেই তার স্তন এবং কৌশল জানা থাকলে সেখান থেকে যা বের হয়ে আসে, তা রবিবারের মধ্যহ্ন ভোজনের সময় পালক-মায়ের দেয়া দুধের চেয়েও উত্তম। আমি যে রুমটিতে ঘুমাই ফেলিপা প্রতি রাতে সেখানে আসতো, খুব নিবিড়ভাবে আমার দিকে বা আমার একপাশে একটু হেলে মুখে স্তন তুলে দিত যাতে তা চুষে চুষে আমি জিভে মিষ্টি ও উষ্ণ দুধের প্রবাহ অনুভব করতে পারি। আমি ক্ষুধা ভুলতে বহুবার ঝুমকো জবাফুল খেয়েছি। ফেলিপার দুধের স্বাদ ও ঘ্রাণ অবিকল ওরকমই, তা সত্ত্বেও আমি ফেলিপার দুধই বেশি পছন্দ করতাম কারণ, তার বুক চোষার সময় সে আমার দেহের সর্বত্র কাতুকুতু দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো। তারপরে প্রায় প্রতিরাতেই সে আমার পাশে ঘুমাতো ভোর হওয়া পর্যন্ত। এটা ছিল আমার জন্য খুবই সুখপ্রদ, কারণ আমার ঠা-ায় কাঁপতে হতো না, এবং কোনো রাতে নিঃসঙ্গ কক্ষে মরে গিয়ে দোজখে যাবার ভয় পেতে হতো না। কোনো কোনো রাতে দোজখের ভয় আমি পাই না, তবে কোনো কোনো রাতে পাই। ইদানীং আমি নিজেই নিজেকে ভয় পাইয়ে দিই এই ভেবে যে, শিগগিরই, যে কোনো দিন আমি নরকে নিক্ষিপ্ত হবো, কারণ আমার মাথাটি এতই শক্ত এবং সামনে যা কিছু পাই তাতেই মাথা কুটতে শুরু করি। কিন্তু ফেলিপা এসে ভয়গুলোকে তাড়িয়ে দেয়। সে তার হাত দিয়ে আমাকে এমনভাবে কাতকুতু দিতে থাকে যেন সে জানে কীভাবে আমার মৃত্যুভয়ের ইতি টানা যায়। এবং স্বল্পসময়ের জন্য আমি এসব ভুলে থাকলেও ফেলিপা বলে, যদিও সে আমার সাথেই থাকতে চায়, শিগগিরই সে স্বর্গে চলে যাবে এবং ঈশ্বরকে আমার পাপগুলোর কথা বলে আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যদিও সে খুব করেই জানে আমি আপাদমস্তক পাপকর্মে নিমজ্জিত।
সে ঈশ্বরকে অনুরোধ করবে আমাকে ক্ষমা করার জন্য যাতে আমার আর এ নিয়ে ভয় পেতে না হয়। এ জন্যই সে প্রতিদিন গির্জায় পাপ-স্বীকার করতে যায়। যায় সে নিজে মন্দ এ কারণে নয়, বরং আমিই যে সমস্ত সত্তায় শয়তানী দিয়ে পরিপূর্ণ এবং তাদের থেকে আমার দেহ মুক্ত করার জন্যই সে গির্জায় যায় আমার হয়ে দোষ স্বীকার করার জন্য। প্রতিটি দিন সে যায়, প্রতিটি অপরাহ্ণে। আমার জন্য এই উপকারটুকু সে করবে সারাজীবন- এই কথাই ফেলিপা বলে। এ কারণেই আমি তাকে এত ভালোবাসি, তা সত্ত্বেও শক্ত একটি মাথা থাকা মোটেও মন্দ নয়। আমি করিডরের কোনো থাম দেখলেই দীর্ঘসময় ধরে সেখানে মাথা কুটতে থাকি কিন্তু কিছুই হয় না, মাথা আঘাত করেই চলে, কোনো ফাটল ধরে না। আমি মেঝেতেও মাথা কুটি, প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপরে জোর থেকে আরও জোরে এবং তা ড্রামের মতো শব্দ করে।
গির্জার জানালা দিয়ে আসা বাঁশির সুরের সাথে ড্রামের যে বুম বুম শব্দ আমি শুনতে পাই পালক-মায়ের দ্বারা হাত-বাঁধা অবস্থায় এবং সে বলে যদি আমি মেঝেতে মাথা কোটা বন্ধ না করি এবং আমার ঘরে ছারপোকা, আরশোলা বা বিছাজাতীয় কিছু থাকে তো আমি নিশ্চিত নরকে পুড়ে মরবো।
কিন্তু আমি ড্রামের শব্দ শুনতে পছন্দ করি, তার সেটা জানার কথা। আমি গির্জায় বসে উসখুস করি কখন বাইরে গিয়ে বোঝার সুযোগ পাবো কেন গির্জার ভেতরে যাজকের ধিক্কারপূর্ণ কণ্ঠকেও অতিক্রম করে গির্জার ড্রামের শব্দ রাস্তার এত দূর থেকে শোনা যায়
‘ভালোকাজের পথ আলো ঝলসিত, মন্দকাজের পথ নিমজ্জিত অন্ধকারে’- এই কথাই বলে ধর্মযাজক।
আমি উঠি, নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসি যদিও বাইরে তখনও অন্ধকার ঘাপটি মেরে থাকে। রাস্তাঘাট অলিগলি চষে আবার ঘরে ফিরে আসি দিনের আলো আমাকে পাকড়াও করার আগেই। রাস্তায় অনেক কিছু ঘটে, বহুলোক আছে যারা দেখতে পেলেই পাথর তুলে আমার মাথায় আঘাত করতে ছাড়ে না। চারিদিক থেকে বড় বড় চোখা পাথর বৃষ্টির মত ছুটে আসে। আমার জামা সেলাই করতে হয়, মুখের বা হাঁটুর ঘাগুলো শুকোনো পর্যন্ত ঘরে বসে থাকতে হয় দিনের পর দিন। আমার হাতগুলো বেঁধে না রাখলে খুঁটে খুঁটে আধা শুকনো ঘাগুলো দগদগে করে ফেলি এবং সেখান থেকে নতুন করে রক্ত বের হয়ে আসে। রক্তেরও একটা স্বাদ আছে যদিও তা ফেলিপা’র দুধের স্বাদের মতো নয়। এ কারণেই আমি সবসময় নিজেকে বাসায় বন্দি করে রাখি যাতে ওরা আমার দিকে পাথর ছুড়ে মারতে না পারে। খাওয়া শেষ করেই আমি নিজেকে ঘরে পুরে দরজা বন্ধ করে দিই যাতে অন্ধকারে পাপেরা আমাকে খুঁজে না পায়। আরশোলাগুলো আমার শরীরের কোথায় হাঁটছে তা দেখার জন্য পর্যন্ত আলো জ্বালি না। অনড় শুয়ে থাকি। ছালার বিছানায় ঘুমাই এবং যখনই টের পাই কোনো আরশোলা আঁচড়কাটা পায়ে আমার গলার কাছ দিয়ে হাঁটছে আমি হাত দিয়ে থাপ্পড় মেরে থেঁতলে দিই কিন্তু আলো জ্বালাই না। আলো জ্বেলে কম্বলের নিচে তেলাপোকা খুঁজতে গিয়ে আমার যে পাপেরা তাদের আচম্বিতে আমাকে পাকড়াও করার সুযোগ আমি দেবো না। তবে যখন মারি তেলাপোকাগুলো আতশবাতি ফাটার শব্দের মতো শব্দ করে। আমি জানি না ঝিল্লি পোকা এমনভাবে ফাটে কি না। আমি কখনই ঝিল্লি পোকা মারি না। ফেলিপা বলে ঝিল্লি পোকারা সবসময় শব্দ করে বলেই নরকের শুদ্ধিলয়ে পাপাত্মাদের শাস্তির চিৎকার শোনা যায় না। যেদিন পৃথিবীতে কোনো ঝিল্লি পোকা থাকবে না, সারা পৃথিবী ওই আত্মাদের চিৎকারে ভরে যাবে এবং আমরা ভয়ে পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটতে শুরু করবো।
এ ছাড়াও আমি কান তুলে ঝিল্লিপোকার শব্দ শুনতে পছন্দ করি। আমার ঘরে এদের এন্তার উপস্থিতি। আমি যে ছালার ওপরে ঘুমাই তার ভাঁজে ভাঁজে আমার বিশ্বাস তেলাপোকার চেয়ে ঝিল্লি পোকাই বেশি।
কাঁকড়া-বিছা ও প্রচুর। মাঝে মধ্যেই ওরা সিলিং থেকে আমার গায়ে পড়ে এবং আমি নিশ্চল দম বন্ধ করে থাকি যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে ওরা মেঝেতে পৌঁছায়। কারণ যদি আমার বাহু নড়ে বা কোনো অস্থি কেঁপে ওঠে আমি মুহূর্তের মধ্যেই হুলের জ্বালাপোড়া টের পাই। কী যে ব্যথা লাগে! একবার ফেলিপা’র নিতম্বে এমন হুল ফুটেছিল, বেচারি সারারাত ব্যথায় কঁকিয়ে মৃদু গলায় পবিত্র কুমারির কাছে প্রার্থনা করেছে যাতে তার পশ্চাৎ পচে গলে না যায়।আমি থুথু দিয়ে মালিশ করেছি। সারারাত মালিশ করে ও তার সাথে প্রার্থনা করেও যখন দেখলাম আমার থুথু তার যন্ত্রণা একটুও লাঘব করে নাই, তাকে আমার চোখ দিয়ে কাঁদতে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছু করতে পারি নাই। তবে আমি এটা আমার ঘরেই করতে পছন্দ করি, রাস্তাঘাটে যারা মানুষের দিকে পাথর ছুড়তে ভালোবাসে তাদের নজর কেড়ে নয়। এখানে কেউ আমাকে স্পর্শ করে না। পালক-মা আমাকে তার ঝুমকো জবা, জারুল বা বেদানা খেতে দেখেও বকে না। সে জানে কী জঘন্য রকমের ক্ষুধা আমার অনুক্ষণ। যদিও আমি সদাই এখানে সেখানে খাবারের জন্য ছেঁচড়ামি করি, কোনো ভোজনই যে আমার পেট ভরাতে পারে না, সে জানে।
এও জানে যে মোটা শুয়োরগুলোর জন্য দেয়া মটর দানা এবং শীর্ণ শুয়োরগুলোর জন্য দেয়া শুকনো ভুট্টাও আমি গোগ্রাসে গিলে ফেলি। সুতরাং তার মোটেও অজ্ঞাত নয় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত আমি কী পরিমাণ ক্ষুধায় কষ্ট পাই। এবং যতদিন পর্যন্ত এই বাড়িতে আমাকে কিছু খেতে দেবে আমি কোথাও যাবো না। কারণ আমার মনে হয়, যেদিন খাওয়া বন্ধ করবো আমি মরে যাবো এবং সটান দোযখে গিয়ে উপস্থিত হবো। এবং কেউ আমাকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারবে না, আমার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ফেলিপাও না, এমনকি পালক মায়ের দেয়া যে তাবিজটি আমি গলায় ঝুলিয়ে রাখি, তাও না। আমি এখন ড্রেনের পাশে বসে ভেকগুলোর বের হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছি। এবং এই যে এতক্ষণ ধরে বক বক করছি, একটি ব্যাঙও বের হয়ে আসেনি। যদি তারা বের হয়ে আসতে দেরি করে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি, তখন কোনোভাবেই তাদের মারা হয়ে উঠবে না এবং পালক মায়ের ভীষণভাবে ঘুমে ব্যাঘাত হবে। যখনই সে ব্যাঙের ডাক শোনে, তার রাগের সীমা থাকে না। এবং তখনই সে তার ঘরে যে সন্তদের দলটি আছে তাদের কাউকে বলবে আমার ঘরে যেন এক্ষুনিই কোনো শয়তানকে পাঠিয়ে দেয়া হয় যে আমাকে অনন্তকালের জন্য দোযখে নিয়ে যাবে, শুদ্ধিলয়ও অতিক্রম করতে দেবে না এবং আমি আমার মা-বাবাকেও আর দেখতে পাবো না, যারা শুদ্ধিলয়েই আছে। তাই আমার জন্য বক বক করে যাওয়াই উত্তম, তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমি কয়েক ঢোক ফেলিপার দুধ পান করতে পারতাম, সেই অসামান্য স্বাদু দুধ, যা মধুর মত মিষ্টি, যা ঝুমকো জবার অন্তস্থল থেকে প্রবাহিত হয়।
লেখক পরিচিতি:
হুয়ান রুলফো (১৬ মে ১৯১৭-৭ জানুয়ারি ১৯৮৬), ছিলেন একজন মেক্সিকান লেখক, চিত্রনাট্যকার এবং ফটোগ্রাফার। তিনি দুটি সাহিত্যকর্মের জন্য সর্বাধিক পরিচিত, ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস “পেড্রো প্যারামো” এবং ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ছোটগল্পের সংকলন “এল ল্লানো এন লামাস”। এই সংগ্রহে রয়েছে জনপ্রিয় গল্প “Diles que no me maten!” (‘আমাকে হত্যা না করতে তাদের বলুন!’)। “দ্য বার্নিং প্লেইন এ্যান্ড আদার স্টোরিজ” গ্রন্থভুক্ত এই অনুবাদিত গল্পটি জর্জ ডি শেইডের ইংরেজি অনুবাদ থেকে উন্মুক্ত ভাষান্তর করা হয়েছে। -অনুবাদক।
হুয়ান রুলফোর গল্প
অনুবাদ : শাহাব আহমেদ
বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
আমি ব্যাঙগুলোর বের হয়ে আসার অপেক্ষায় ড্রেনের পাশে বসে আছি। গতকালের নৈশভোজের সময় ওরা ভীষণভাবে ডাকতে শুরু করে এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত তাদের গান নিস্তব্ধ হয় না। আমার পালক-মা’ও তাই বলেছে, ওদের চিৎকার তার মধ্যে এতটাই ভয়ের সঞ্চার করেছে যে, সে ঘুমাতে পারেনি। এখন তার একটু না ঘুমালেই নয়। তাই সে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে একটি কাঠের বোর্ড হাতে নিয়ে এখানে বসে থাকতে, কোনো ব্যাঙ লাফ দিয়ে ড্রেন থেকে বের হয়ে এলেই পিটিয়ে ভর্তা করে দেবার জন্য। পেটের জায়গাটুকু ছাড়া ব্যাঙগুলোর সারা শরীর সবুজ কিন্তু কোলাব্যাঙ কালো, আমার পালক-মায়ের চোখগুলোও কালো। ব্যাঙ খেতে খুব স্বাদু, তবে কোলাব্যাঙ নয়, ওদের কেউ খায় না। লোকে না খেলেও আমি খাই এবং স্বাদ তাদের ব্যাঙের মাংসের মতোই। ফেলিপা’ই বলে যে, কোলাব্যাঙ খাওয়া ভালো নয়। ফেলিপার চোখগুলো বিড়ালের চোখের মতো সবুজ। খাবার সময় হলে রান্নাঘরে সেই আমাকে খেতে দেয়। সে চায় না আমি ব্যাঙেদের কষ্ট দিই। পালক-মা উল্টা তাদের মারতেই বলে। আমি পালক-মায়ের চেয়ে ফেলিপাকে বেশি পছন্দ করি, যদিও পালক-মা’ই তার ব্যাগ খুলে ফেলিপার হাতে টাকা তুলে দেয় বাজার করার জন্য।
ফেলিপা একা রান্না করে আমাদের তিনজনের জন্য। যতদিন থেকে আমি তাকে চিনি এটাই তার কাজ। থালা-বাসন ধুই আমি। চুলোর জন্য কাঠ এনে দেয়ার দায়িত্বও আমার। পালক-মা নিজে খাওয়া শেষ করে নিজ হাতে দুটো ছোট স্তূপে আমাদের খাবার পরিবেশন করে, একটি আমার, অন্যটি ফেলিপার। তবে মাঝে মাঝে ফেলিপা বলে তার ক্ষুধা নেই, তখন দুটো স্তূপই আমার জোটে। একারণেই আমি ফেলিপাকে ভালোবাসি। আমি সদাই ক্ষুধার্ত এবং আমার কখনই পেট ভরে না, কখনই না, এমনকি আমি যখন নিজেরটুকু খেয়ে ওর খাবারও খাই। তারা বলে, খেয়ে মানুষের পেট ভরে কিন্তু আমি নিশ্চিত করে জানি, আমার পেট ভরে না, তাদের দেয়া সবটুকু খাদ্য খেয়েও না। ফেলিপাও এটা জানে। আশেপাশের লোকজন বলে, আমার মাথার ঠিক নেই, কারণ কখনই আমার ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় না। পালক-মা তাদের মুখে এ কথা শুনেছে। আমি শুনি নাই। পালক-মা আমাকে একা বাইরে যেতে দেয় না। যখন সে আমাকে বাইরে নেয়, নেয় শুধু গির্জায় ভজন শুনতে যাবার সময়। সেখানে তার পাশে বসিয়ে শাল দিয়ে আমার হাতদুটো বেঁধে রাখে। আমি জানি না কেন সে আমার হাত বাঁধে, কিন্তু সে বলে, লোকমুখে শুনেছে আমি নাকি বিদঘুটে সব ঘটনা ঘটাই। একদিন নাকি তারা আমাকে দেখেছে কারো গলায় ফাঁস দিতে। সেটা ছিল এক মহিলা যার গলায় আমি ফাঁস দিয়েছিলাম কোনো কারণ ছাড়াই। আমার এমন কিছু মনে পড়ে না। কিন্তু একমাত্র পালক-মা’ই বলে যে আমি এসব করি এবং মিথ্যা কথা বলা তার স্বভাব নয়। সে আমাকে যখন ডাকে, ডাকে খেতে দেবার জন্য। সে অন্যদের মত নয়, যারা আমাকে তাদের সাথে খাবার খেতে দাওয়াত দেয় কিন্তু কাছে গেলেই ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে যতক্ষণ না আমি কোনো কিছু না খেয়েই পালিয়ে আসি। পালক-মা এমন নয়, সে আমার প্রতি সদয়। এ কারণেই আমি তুষ্ট চিত্তে তার বাড়িতে আছি। তাছাড়া, ফেলিপা এখানে থাকে। সে আমার প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল এবং আমি তাকে ভালো না বেসে পারি না। তার দুধ ঝুমকোজবার মত মিষ্টি। আমি ছাগীর দুধ খেয়েছি, সদ্য ছানা জন্ম-দেয়া শূকরীর দুধও খেয়ে দেখেছি, কিন্তু না, কোনোটাই ফেলিপার দুধের মতো এত স্বাদু নয়। যদিও অনেকদিন পার হয়ে গেছে যখন সে আমাকে তার স্তন পান করতে দিয়েছে। আমাদের যেখানে পাঁজর, সেখানেই তার স্তন এবং কৌশল জানা থাকলে সেখান থেকে যা বের হয়ে আসে, তা রবিবারের মধ্যহ্ন ভোজনের সময় পালক-মায়ের দেয়া দুধের চেয়েও উত্তম। আমি যে রুমটিতে ঘুমাই ফেলিপা প্রতি রাতে সেখানে আসতো, খুব নিবিড়ভাবে আমার দিকে বা আমার একপাশে একটু হেলে মুখে স্তন তুলে দিত যাতে তা চুষে চুষে আমি জিভে মিষ্টি ও উষ্ণ দুধের প্রবাহ অনুভব করতে পারি। আমি ক্ষুধা ভুলতে বহুবার ঝুমকো জবাফুল খেয়েছি। ফেলিপার দুধের স্বাদ ও ঘ্রাণ অবিকল ওরকমই, তা সত্ত্বেও আমি ফেলিপার দুধই বেশি পছন্দ করতাম কারণ, তার বুক চোষার সময় সে আমার দেহের সর্বত্র কাতুকুতু দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো। তারপরে প্রায় প্রতিরাতেই সে আমার পাশে ঘুমাতো ভোর হওয়া পর্যন্ত। এটা ছিল আমার জন্য খুবই সুখপ্রদ, কারণ আমার ঠা-ায় কাঁপতে হতো না, এবং কোনো রাতে নিঃসঙ্গ কক্ষে মরে গিয়ে দোজখে যাবার ভয় পেতে হতো না। কোনো কোনো রাতে দোজখের ভয় আমি পাই না, তবে কোনো কোনো রাতে পাই। ইদানীং আমি নিজেই নিজেকে ভয় পাইয়ে দিই এই ভেবে যে, শিগগিরই, যে কোনো দিন আমি নরকে নিক্ষিপ্ত হবো, কারণ আমার মাথাটি এতই শক্ত এবং সামনে যা কিছু পাই তাতেই মাথা কুটতে শুরু করি। কিন্তু ফেলিপা এসে ভয়গুলোকে তাড়িয়ে দেয়। সে তার হাত দিয়ে আমাকে এমনভাবে কাতকুতু দিতে থাকে যেন সে জানে কীভাবে আমার মৃত্যুভয়ের ইতি টানা যায়। এবং স্বল্পসময়ের জন্য আমি এসব ভুলে থাকলেও ফেলিপা বলে, যদিও সে আমার সাথেই থাকতে চায়, শিগগিরই সে স্বর্গে চলে যাবে এবং ঈশ্বরকে আমার পাপগুলোর কথা বলে আমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যদিও সে খুব করেই জানে আমি আপাদমস্তক পাপকর্মে নিমজ্জিত।
সে ঈশ্বরকে অনুরোধ করবে আমাকে ক্ষমা করার জন্য যাতে আমার আর এ নিয়ে ভয় পেতে না হয়। এ জন্যই সে প্রতিদিন গির্জায় পাপ-স্বীকার করতে যায়। যায় সে নিজে মন্দ এ কারণে নয়, বরং আমিই যে সমস্ত সত্তায় শয়তানী দিয়ে পরিপূর্ণ এবং তাদের থেকে আমার দেহ মুক্ত করার জন্যই সে গির্জায় যায় আমার হয়ে দোষ স্বীকার করার জন্য। প্রতিটি দিন সে যায়, প্রতিটি অপরাহ্ণে। আমার জন্য এই উপকারটুকু সে করবে সারাজীবন- এই কথাই ফেলিপা বলে। এ কারণেই আমি তাকে এত ভালোবাসি, তা সত্ত্বেও শক্ত একটি মাথা থাকা মোটেও মন্দ নয়। আমি করিডরের কোনো থাম দেখলেই দীর্ঘসময় ধরে সেখানে মাথা কুটতে থাকি কিন্তু কিছুই হয় না, মাথা আঘাত করেই চলে, কোনো ফাটল ধরে না। আমি মেঝেতেও মাথা কুটি, প্রথমে আস্তে আস্তে, তারপরে জোর থেকে আরও জোরে এবং তা ড্রামের মতো শব্দ করে।
গির্জার জানালা দিয়ে আসা বাঁশির সুরের সাথে ড্রামের যে বুম বুম শব্দ আমি শুনতে পাই পালক-মায়ের দ্বারা হাত-বাঁধা অবস্থায় এবং সে বলে যদি আমি মেঝেতে মাথা কোটা বন্ধ না করি এবং আমার ঘরে ছারপোকা, আরশোলা বা বিছাজাতীয় কিছু থাকে তো আমি নিশ্চিত নরকে পুড়ে মরবো।
কিন্তু আমি ড্রামের শব্দ শুনতে পছন্দ করি, তার সেটা জানার কথা। আমি গির্জায় বসে উসখুস করি কখন বাইরে গিয়ে বোঝার সুযোগ পাবো কেন গির্জার ভেতরে যাজকের ধিক্কারপূর্ণ কণ্ঠকেও অতিক্রম করে গির্জার ড্রামের শব্দ রাস্তার এত দূর থেকে শোনা যায়
‘ভালোকাজের পথ আলো ঝলসিত, মন্দকাজের পথ নিমজ্জিত অন্ধকারে’- এই কথাই বলে ধর্মযাজক।
আমি উঠি, নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসি যদিও বাইরে তখনও অন্ধকার ঘাপটি মেরে থাকে। রাস্তাঘাট অলিগলি চষে আবার ঘরে ফিরে আসি দিনের আলো আমাকে পাকড়াও করার আগেই। রাস্তায় অনেক কিছু ঘটে, বহুলোক আছে যারা দেখতে পেলেই পাথর তুলে আমার মাথায় আঘাত করতে ছাড়ে না। চারিদিক থেকে বড় বড় চোখা পাথর বৃষ্টির মত ছুটে আসে। আমার জামা সেলাই করতে হয়, মুখের বা হাঁটুর ঘাগুলো শুকোনো পর্যন্ত ঘরে বসে থাকতে হয় দিনের পর দিন। আমার হাতগুলো বেঁধে না রাখলে খুঁটে খুঁটে আধা শুকনো ঘাগুলো দগদগে করে ফেলি এবং সেখান থেকে নতুন করে রক্ত বের হয়ে আসে। রক্তেরও একটা স্বাদ আছে যদিও তা ফেলিপা’র দুধের স্বাদের মতো নয়। এ কারণেই আমি সবসময় নিজেকে বাসায় বন্দি করে রাখি যাতে ওরা আমার দিকে পাথর ছুড়ে মারতে না পারে। খাওয়া শেষ করেই আমি নিজেকে ঘরে পুরে দরজা বন্ধ করে দিই যাতে অন্ধকারে পাপেরা আমাকে খুঁজে না পায়। আরশোলাগুলো আমার শরীরের কোথায় হাঁটছে তা দেখার জন্য পর্যন্ত আলো জ্বালি না। অনড় শুয়ে থাকি। ছালার বিছানায় ঘুমাই এবং যখনই টের পাই কোনো আরশোলা আঁচড়কাটা পায়ে আমার গলার কাছ দিয়ে হাঁটছে আমি হাত দিয়ে থাপ্পড় মেরে থেঁতলে দিই কিন্তু আলো জ্বালাই না। আলো জ্বেলে কম্বলের নিচে তেলাপোকা খুঁজতে গিয়ে আমার যে পাপেরা তাদের আচম্বিতে আমাকে পাকড়াও করার সুযোগ আমি দেবো না। তবে যখন মারি তেলাপোকাগুলো আতশবাতি ফাটার শব্দের মতো শব্দ করে। আমি জানি না ঝিল্লি পোকা এমনভাবে ফাটে কি না। আমি কখনই ঝিল্লি পোকা মারি না। ফেলিপা বলে ঝিল্লি পোকারা সবসময় শব্দ করে বলেই নরকের শুদ্ধিলয়ে পাপাত্মাদের শাস্তির চিৎকার শোনা যায় না। যেদিন পৃথিবীতে কোনো ঝিল্লি পোকা থাকবে না, সারা পৃথিবী ওই আত্মাদের চিৎকারে ভরে যাবে এবং আমরা ভয়ে পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটতে শুরু করবো।
এ ছাড়াও আমি কান তুলে ঝিল্লিপোকার শব্দ শুনতে পছন্দ করি। আমার ঘরে এদের এন্তার উপস্থিতি। আমি যে ছালার ওপরে ঘুমাই তার ভাঁজে ভাঁজে আমার বিশ্বাস তেলাপোকার চেয়ে ঝিল্লি পোকাই বেশি।
কাঁকড়া-বিছা ও প্রচুর। মাঝে মধ্যেই ওরা সিলিং থেকে আমার গায়ে পড়ে এবং আমি নিশ্চল দম বন্ধ করে থাকি যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে ওরা মেঝেতে পৌঁছায়। কারণ যদি আমার বাহু নড়ে বা কোনো অস্থি কেঁপে ওঠে আমি মুহূর্তের মধ্যেই হুলের জ্বালাপোড়া টের পাই। কী যে ব্যথা লাগে! একবার ফেলিপা’র নিতম্বে এমন হুল ফুটেছিল, বেচারি সারারাত ব্যথায় কঁকিয়ে মৃদু গলায় পবিত্র কুমারির কাছে প্রার্থনা করেছে যাতে তার পশ্চাৎ পচে গলে না যায়।আমি থুথু দিয়ে মালিশ করেছি। সারারাত মালিশ করে ও তার সাথে প্রার্থনা করেও যখন দেখলাম আমার থুথু তার যন্ত্রণা একটুও লাঘব করে নাই, তাকে আমার চোখ দিয়ে কাঁদতে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছু করতে পারি নাই। তবে আমি এটা আমার ঘরেই করতে পছন্দ করি, রাস্তাঘাটে যারা মানুষের দিকে পাথর ছুড়তে ভালোবাসে তাদের নজর কেড়ে নয়। এখানে কেউ আমাকে স্পর্শ করে না। পালক-মা আমাকে তার ঝুমকো জবা, জারুল বা বেদানা খেতে দেখেও বকে না। সে জানে কী জঘন্য রকমের ক্ষুধা আমার অনুক্ষণ। যদিও আমি সদাই এখানে সেখানে খাবারের জন্য ছেঁচড়ামি করি, কোনো ভোজনই যে আমার পেট ভরাতে পারে না, সে জানে।
এও জানে যে মোটা শুয়োরগুলোর জন্য দেয়া মটর দানা এবং শীর্ণ শুয়োরগুলোর জন্য দেয়া শুকনো ভুট্টাও আমি গোগ্রাসে গিলে ফেলি। সুতরাং তার মোটেও অজ্ঞাত নয় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত আমি কী পরিমাণ ক্ষুধায় কষ্ট পাই। এবং যতদিন পর্যন্ত এই বাড়িতে আমাকে কিছু খেতে দেবে আমি কোথাও যাবো না। কারণ আমার মনে হয়, যেদিন খাওয়া বন্ধ করবো আমি মরে যাবো এবং সটান দোযখে গিয়ে উপস্থিত হবো। এবং কেউ আমাকে সেখান থেকে বের করে আনতে পারবে না, আমার প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ফেলিপাও না, এমনকি পালক মায়ের দেয়া যে তাবিজটি আমি গলায় ঝুলিয়ে রাখি, তাও না। আমি এখন ড্রেনের পাশে বসে ভেকগুলোর বের হয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছি। এবং এই যে এতক্ষণ ধরে বক বক করছি, একটি ব্যাঙও বের হয়ে আসেনি। যদি তারা বের হয়ে আসতে দেরি করে আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি, তখন কোনোভাবেই তাদের মারা হয়ে উঠবে না এবং পালক মায়ের ভীষণভাবে ঘুমে ব্যাঘাত হবে। যখনই সে ব্যাঙের ডাক শোনে, তার রাগের সীমা থাকে না। এবং তখনই সে তার ঘরে যে সন্তদের দলটি আছে তাদের কাউকে বলবে আমার ঘরে যেন এক্ষুনিই কোনো শয়তানকে পাঠিয়ে দেয়া হয় যে আমাকে অনন্তকালের জন্য দোযখে নিয়ে যাবে, শুদ্ধিলয়ও অতিক্রম করতে দেবে না এবং আমি আমার মা-বাবাকেও আর দেখতে পাবো না, যারা শুদ্ধিলয়েই আছে। তাই আমার জন্য বক বক করে যাওয়াই উত্তম, তবে সবচেয়ে ভালো হতো যদি আমি কয়েক ঢোক ফেলিপার দুধ পান করতে পারতাম, সেই অসামান্য স্বাদু দুধ, যা মধুর মত মিষ্টি, যা ঝুমকো জবার অন্তস্থল থেকে প্রবাহিত হয়।
লেখক পরিচিতি:
হুয়ান রুলফো (১৬ মে ১৯১৭-৭ জানুয়ারি ১৯৮৬), ছিলেন একজন মেক্সিকান লেখক, চিত্রনাট্যকার এবং ফটোগ্রাফার। তিনি দুটি সাহিত্যকর্মের জন্য সর্বাধিক পরিচিত, ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস “পেড্রো প্যারামো” এবং ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ছোটগল্পের সংকলন “এল ল্লানো এন লামাস”। এই সংগ্রহে রয়েছে জনপ্রিয় গল্প “Diles que no me maten!” (‘আমাকে হত্যা না করতে তাদের বলুন!’)। “দ্য বার্নিং প্লেইন এ্যান্ড আদার স্টোরিজ” গ্রন্থভুক্ত এই অনুবাদিত গল্পটি জর্জ ডি শেইডের ইংরেজি অনুবাদ থেকে উন্মুক্ত ভাষান্তর করা হয়েছে। -অনুবাদক।