লি ও ট ল স্ট য়ে র গ ল্প
অনুবাদ : খায়রুল আলম সবুজ
ভ্লাদিমির শহরে আইভান দিমিত্রিচ আক্সিওনোভ নামের এক ব্যবসায়ী বাস করত। তরতাজা এক যুবক তখন আইভান। এই শহরে তার দু’দুটো দোকান; নিজের বাড়িও ছিল।
আইভান দেখতে শুনতে দারুণ। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, প্রাণবন্ত, রসিক মানুষ- সঙ্গীতের ভক্ত। আরো কম বয়সে যখন একেবারে কাঁচা তরুণ, তখন তার একবার দুর্ভাগ্যজনকমতিভ্রম ঘটেছিল। মদ্যপান তাকে প্রায় গিলেই খাচ্ছিল। একে তো ওই বয়স তাতে বন্ধুদের মেলায় একটু কখনও বেশি গিলে টিলে ফেললে শুরু হতো তুমুল মাতলামো। কিন্তু বিয়ের পরে সে একেবারে ভিন্ন মানুষ। মদ্যপান প্রায় ছেড়েই দিয়েছে- ওই মাঝেমধ্যে কখনও সখনও।
এক গ্রীষ্ম কালে আইভান নিঝ্নির মেলায় যাচ্ছিল। যখন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে; তার স্ত্রী তাকে বললো, আইভান দিমিত্রিচ শোনো, আজকে বরং যেও না। আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে। আইভান হেসে বললো, তোমার ভয় হয় মেলায় পৌঁছেই আমি প্রমোদে ঢালিয়া দেবো মন, তাই না?
তার স্ত্রীী বললো, কিসের ভয় পাচ্ছি তা আমি নিজেও ঠিক জানি না; শুধু জানি আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখলাম শহর থেকে ঘরে ফিরে যখন তুমি মাথার টুপিটা খুলেছ আমি অবাক হয়ে দেখলাম তোমার মাথার সব চুল পেকে গেছে।
আইভান হেসে বললো, সে তো তবে সৌভাগ্যের লক্ষণ। আমার সব মালপত্র বিক্রি করে তোমার জন্য মেলা থেকে উপহার আনি কিনা তাই দেখো।
আর দেরি না করে পরিবারকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আইভান।
২
আধেক পথ যাওয়ার পর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আইভানের দেখা হলো। লোকটাকে সে আগে থেকেই চিনতো। যেতে যেতে পথেই রাত নামলো এবং তারা রাতের জন্য একই সরাইখানায় উঠলো। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে গল্প করে চা টা খেয়ে তারা পাশাপাশি ঘরে যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেল।
বেশি বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস আইভানের ছিল না। খুব সকালে ঠা-া হাওয়ায় নিরিবিলি ভ্রমণ তার ভালো লাগত। সে ভোর হবার আগেই চালককে উঠিয়ে গাড়িতে ঘোড়া জুততে বলে সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করতে গেল। (সরাইখানার পিছনে একটা বাড়িতে মালিক থাকত।) পাওনা গ-া মিটিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো পথে।
পঁচিশ মাইল পথ এসে ঘোড়াদের খাওয়াবার জন্য সে একটা সরাইখানায় দাঁড়ালো। ঘোড়ার খাওয়ার ফাঁকে সরাইখানার একটা চাপা জায়গায় সে খানিকটা বিশ্রামও করে নিল। তারপর গাড়িবারান্দায় এসে স্যামোভার গরম করার নির্দেশ দিয়ে তার গীটার বের করে বাজাতে লাগল।
হঠাৎই টুংটাং শব্দ তুলে একটা ট্রইকা সেখানে এসে থামলো। একজন সরকারি কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নেমে এলেন, সঙ্গে দু’জন সশস্ত্র সেনা। কর্মকর্তাটি আইভানের কাছে এসে সরাসরি তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। জানতে চাইলেন, কে সে, কোত্থেকে এসেছে। আইভান সহজ সরলভাবে প্রশ্নের উত্তর দিলো। তারপর বললো, একটু চা খাবেন? সে কথায় কর্ণপাত না করে অফিসার আইভানকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো। আইভানকে সে জিজ্ঞেস করলো, গত রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি কি একা ছিলেন নাকি সঙ্গে অন্য কোনো ব্যবসায়ী লোক ছিল? অন্য ব্যবসায়ীকে আপিনি কি আজ সকালে দেখেছেন? সকাল হবার আগেই আপনি সরাইখানা কেন ছাড়লেন? এ ধরনের প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে দেখে আইভানের অদ্ভুত লাগলো। তারপরও যা যা হয়েছে বিশদভাবেই তার উত্তর দিলো আইভান। শেষে বললো, কিন্তু আমাকে আপনি এমনভাবে জেরা করছেন মনে হচ্ছে আমি যেন চোর কিংবা ডাকাত। আমি আমার নিজের কাজে যাচ্ছি আমাকে এতো প্রশ্ন করার তো কোনো দরকার নেই! এরপর অফিসারটি সেনা দুজনকে ডাকলো এবং আইভানকে বললো, আমি এই জেলার পুলিশ অফিসার এবং আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি তার কারণ গতরাতে আপনি যে ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করেছিলেন আজ সকালে তাকে গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আমরা আপনার মালপত্র তল্লাশি করবো।
তারা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। পুলিস অফিসার তার সঙ্গী দু’জনকে নিয়ে আইভানের মালপত্র খুলে বিছিয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। হঠাৎই অফিসার আইভানের ব্যাগের ভিতর থেকে একখানা রক্তাক্ত ছুরি টেনে বের করলো। চিৎকার করে বললো, এই ছুরি কার?আইভান তাকিয়ে দেখলো। তার ব্যাগের ভিতর থেকে রক্তমাখা ছুরিটা বেরিয়েছে দেখে সে ভয় পেয়ে গেল।
-এই ছুরিটায় রক্ত এলো কী করে? আইভান আক্সিওনোভ উত্তর দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছিল না। কেবলই তোঁতলাতে থাকলো এবং কাঁপতে কাঁপতে বললো, আমি জানি না- আমার না।এরপর পুলিশ অফিসার বললো, আজ সকালে ওই লোককে গলা কাটা অবস্থায় তার বিছানার ওপর পাওয়া গেছে। আপনিই একমাত্র লোক যে এই কাজটি করতে পারেন। গোটা বাড়ি ভিতর থেকে তালা দেয়া ছিল এবং সেখানে আর কেউ ছিল না। আপনার ব্যাগের ভিতরেই রক্তমাখা ছুরিটা পাওয়া গেছে। আপনার চেহারা এবং হালচাল তো আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বলেন একে আপনি কীভাবে খুন করলেন এবং কত টাকা চুরি করেছেন।
আইভান শপথ করে বলছিল এ কাজ সে করেনি; একত্রে বসে চা খাওয়ার পর এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি; তার কাছে তার নিজের আট হাজার রুব্ল ছাড়া আর কোনও টাকা নেই এবং এই ছুরিও তার নয়; বলছিল, কিন্তু তার কণ্ঠ ভেঙে ভেঙেযাচ্ছিল, উজ্জ্বল যুবকের চেহারা বিবর্ণ পা-ুর- ভয়ে সে এমনভাবে কাঁপছিল মনে হচ্ছিল যেন অপরাধ সে-ই করেছে।
আইভানকে বাঁধার জন্য অফিসার সেনাদের নির্দেশ দিলেন এবং তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিতে বললেন। সেনারা যখন তার দু’পা একত্রে বেঁধে তাকে গাড়ির ভিতর নিক্ষেপ করলো আইভান নিজের বুকে ক্রুশ এঁকে কেঁদে উঠল। তার কাছ থেকে তার টাকা পয়সা জিনিসপত্র সব নিয়ে তাকে নিকটতম শহরের থানায় পঠিয়ে দেয়া হলো এবং সেখানেই তার জেল হলো।
ভøাদিমির শহরে তার চরিত্র নিয়ে তদন্ত হলো। শহরের ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অধিবাসীরা বললো যে অতীতে সে খুব মদ্য পান করত এবং নিজের সময় অযথাই নষ্ট করত, তবে মানুষটা খুব ভালো।
এরপর এলো বিচারের পালা: তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলো রায়জানের এক ব্যাবসয়ীকে সে খুন করেছে এবং তার কুড়ি হাজার রুব্ল নিয়ে নিয়েছে।
তার স্ত্রী একটা মহাসংকটের মধ্যে পড়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না কোনটা বিশ্বাস করবে আর কোনটা করবে না। ছেলে মেয়েরা সব ছোট ছোট। একজন তখনও বুকের দুধ খায়। সে সবাইকে নিয়ে যেখানে তার স্বামী কারা খাটছিল সেই শহরে চলে গেল।
প্রথম তো দেখা করতে দেবেই না- শেষকালে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া গেল এবং তাকে তার স¦ামীর সামনে হাজির করা হলো; যখন সে তার স¦ামীকে জেলের পোশাকে শেকল পরা অবস্থায় কতগুলো চোর ছ্যাঁচোড় ধরনের নি¤œ শ্রেণির লোকের সঙ্গে একত্রে দেখল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ তার আর জ্ঞান ফিরল না।
জ্ঞান ফিরতেই সে তার শিশুদের কোলে টেনে নিল তার পাশে চুপচাপ বসে থাকল। বাড়িঘরের খবর সে তাকে দিল এবং কী ঘটেছিল তাই জিজ্ঞেস করল। আইভান তার স্ত্রীকে যাযা ঘটেছিল সব বললো। তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?
-একজন নিরপরাধ মানুষ যাতে শাস্তি না পায় এই মর্মে জারের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। স্ত্রী বললো, দরখাস্ত করেছি কিন্তু জার তা গ্রহণ করেননি। আইভান আর কোনও কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে থাকল। আইভানের স্ত্রী তাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল, তোমার চুল ধূসর হয়ে যাবার স্বপ্ন আমি এমনিতেই দেখি নি। মনে আছে? সেদিন আসাটা তোমার ঠিক হয় নি।আইভানের ঘন চুলে বিলি কাটতে কাটতে তার স্ত্রী বলল, লক্ষ্মী ভেনিয়া, তোমার নিজের স্ত্রীকে সত্যটা বলো। তুমি তো এ কাজ করনি, তাই না?
-তার মানে তুমিও এখন আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করলে? আর কোনও কথা না বলে দুই হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আইভান কেঁদে উঠল। এই সময় একজন সেনা এসে জানালো স্ত্রী ও বাচ্চাদের এখন যেতে হবে। আইভান শেষ বারের মতো তার পরিবারকে বিদায় জানালো।
ওরা যখন চলে গেল, আইভান এতোক্ষণ যা কিছু কথা হয়েছে সে সব মনে করার চেষ্টা করল। যখন মনে পড়ল তার স্ত্রীও এখন তাকে সন্দেহ করছে তখন সে নিজেই বলল, মনে হচ্ছে শুধু ঈশ্বর একাই সত্যটা জানতে পারে; একমাত্র তার কাছেই আমরা আবেদন করতে পারি; তার থেকেই ক্ষমার আশা করতে পারি।
এরপর আর কোনও আবেদনপত্র আইভান কোনও দিন লেখেনি। সব আশা ছেড়ে কেবল ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করত।
আইভানের ভাগ্যে শুধু মার খাওয়াই বোধহয় ছিল। চাবুক দিয়ে মারার দ-াদেশ দিয়ে তাকে খনিতে পাঠানো হলো, সেখানে তাকে গিটযুক্ত চাবুক দিয়ে নিয়মিত প্রহার করা হতো। চাবুকের আঘাতে ক্ষত হয়ে গেল। সেই ক্ষত যখন শুকালো তখন তাকে অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের সঙ্গে সাইবেরিয়াতে চালান দেয়া হলো।
ছাব্বিশ বছর সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মতো আইভান সাইবেরিয়াতে থেকেছে। তার কাঁচা চুল বরফের মতো সাদা হয়ে গেল, পাতলা দাড়ি ধূসর আর লম্বা হলো। তার জীবনের সব আনন্দ শেষ। সে নুয়ে পড়েছে; ধীরে ধীরে হাঁটে। কথা বলে কম, কখনোই হাসে না। তবে মাঝে মধ্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। জেলে বসে আইভান বুটজুতা তৈরি করতে শিখেছে। তা বিক্রি করে কিছু অর্থও উপার্জন করেছে। উপার্জিত সেই অর্থ দিয়ে সে মুনি ঋষিতুল্য মানুষের জীবনীগ্রন্থ কিনে কিনে পড়তো। কারাকক্ষে যখন একটু বেশি আলো আসতো সেই আলোতে সে পড়ত। রবিবারগুলোতে সে চার্চে লেখাপড়া করতে যেত। সেখানে সে সমবেত সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলাতো। গানের কণ্ঠ তখনও তার বেশ ভালো।
জেল কর্তৃপক্ষ তার শুদ্ধ চলন এবং বিনীত বলনের জন্য তাকে খুব পছন্দ করত আর তার সঙ্গী অপরাধীরা তাকে দাদু সম্বোধন করত এবং তার শুদ্ধাচারের জন্য তাকে সবাই সাধুসন্তুর মতো শ্রদ্ধাভক্তি করত। কারাবাসীরা কখনও কোনো ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে চাইলে সবসময় তারা আইভানের কাছে আসতো আর কখনো ঝগড়াঝাটি কিংবা মারামারি হলে তারা সবাই মিলে আইভানের কাছে আসত মীমাংসা এবং সুবিচারের জন্য।
তার বাড়ি থেকে কখনও কোনও খবর আসত না এমনকি তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা এখনও বেঁচে আছে কিনা আ্ইভান তাও জানে না।
একদিন একদল নতুন অপরাধীর চালান এলো জেলখানায়। সন্ধ্যায় পুরাতন কারাবাসীরা নতুনদের ঘিরে বসল। নতুনদের দেদার প্রশ্ন করতে লাগল পুরাতনরা, যেমন: কে কোন এলাকা, গ্রাম বা শহর থেকে এসেছে এবং এই শাস্তি তাদের কেন হলো। এই সব আর কি। সকলের সঙ্গে আইভানও নতুনদের কাছে গিয়ে বসল। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগল। একজন নতুন অপরাধী, লম্বা করে, বেশ গাট্টাগেট্টা, বয়স ষাটের মতো হবে, সযতেœ ছাটা ধূসর তার দাড়ি, সে অন্যদের বলছিল- তার শাস্তিরকারণ বলছিল। বলল, আমি স্লেজে বাঁধা একমাত্র ঘোড়াটা নিয়ে গিয়েছিলাম। তার অবশ্য কারণও ছিল, আমার একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরার দরকার হয়ে পড়ে- বাড়িতে পৌঁছে ওকে আমি ছেড়েও দিতাম, তাছাড়া গাড়ির চালক মানুষটিও আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিল। অপরাধ এইটুকু। আমি তাদের বুঝিয়ে বললাম এই তো ব্যাপার, এতে কী এমন সমস্যা। এতে তো কিছু যায় আসে না- ঠিকই তো আছে। কোনও কথাই ওরা শুনলো না। ওরা বলল, না তুমি চুরি করেছ। আর এটাই তোমার অপরাধ। এই অপরাধে আমাকে চোর হিসাবে গ্রেফ্তার করল। কিন্তু কীভাবে কোথা থেকে ওটা আমি চুরি করেছি তা ওরা বলতে পারল না। কিন্তু কোনো একদিন অপরাধের মতো ভুল আমি... আমি আসলেই করেছিলাম এবং তার জন্য বহুদিন আগেই আমার এখানে আসা উচিৎ ছিল কিন্তু সেবার কেউ আমাকে ধরতে পারে নি আর খুঁজেও পায় নি। সেবার যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল, এবার এখানে এসেছি প্রায় কোনও কারণ ছাড়াই। না, আমি আপনাদের এতোক্ষণ ঠিক বলিনি; সাইবেরিয়াতে আমি এর আগেও এসেছি তবে লম্বা সময় থাকতে হয়নি।
কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়?
- ভøাদিমির। আমার পরিবার ওই শহরের। আমার নাম মাকার। সবাই আমাকে সেমিওনিচ বলেও চেনে।
আইভান মাথা সোজা করে লোকটার দিকে তাকাল। সরাসরি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সেমিওনিচ, আপনি ভøাদিমিরের ব্যবসায়ী আইভান দিমিত্রিচ আক্সিওনোভ সম্পর্কে কি কিছু জানেন? ওরা কি এখনও বেঁচে আছে? সেমিওনিচ বুক ফুলিয়ে বলল, জানি কিনা জিজ্ঞেস করছেন? অবশ্যই জানি। আক্সিওনোভরা সবাই এখন বড়লোক, ধনাঢ্য- যদিও তাদের বাবা এখনও এই সাইবেরিয়াতে; তিনি হয়তো আমাদেরই মতো একজন পাপী লোক। আচ্ছা দাদু, আপনি এখানে কেন? কী করে এলেন?
আইভান তার দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলতে চাইছিল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত- আজ ছাব্বিশ বছর ধরে আমি জেল খাটছি। মাকার সেমিওনিচ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কেন? কী পাপ করেছেন আপনি? আইভান আক্সিওনোভ খুব সংক্ষেপে বলল, আরে! এটাই আমার প্রাপ্য ছিল।
এর বেশি সে আর কিছু বলতে চাইছিল না, কিন্তু তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী-সাথীরা বলে দিল কীভাবে আইভান আক্সিওনোভ সাইবেরিয়াতে এসেছিল; কী করে এক লোক একজন ব্যবসায়ীকে খুন করে রক্তমাখা ছুরিটা আইভানের মালপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল, যার কারণে আপরাধ না করেও আইভানকে ছাব্বিশ বছর কারাবাস করতে হলো।
মাকার সেমিওনিচ এই কথা শুনেই আইভানের দিকে তাকাল। নিজের হাঁটুতে থাপ্পড় মেরে সে বিস্ময় প্রকাশ করল- উচ্চকণ্ঠে বলল, আরে এতো আজব ঘটনা! সত্য সত্যই আশ্চর্যজনক- কিন্তু দাদু আপনি এতো বুড়ো হয়ে গেছেন!
অন্য যারা উপস্থিত ছিল তারা সেমিওনিচকে এভাবে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল সেমিওনিচ আইভানকে এর আগে কখনও দেখেছে কিনা, কিন্তু সেমিওনিচ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। সে শুধু বলল, বাপুরা, এ এক অভাবনীয় ঘটনা, এভাবে এখানে আমাদের দেখা হবে-!
এই কথাগুলো শুনে আইভান আক্সিওনোভের মনে হলো সেই ব্যবসায়ীকে কে বা কারা খুন করেছিল এ লোকটা বোধ হয় নিশ্চিতভাবে তা জানে। সেমিওনিচকে সে জিজ্ঞেস করল, সেমিওনিচ, আপনি বোধ করি এই ব্যাপারটা শুনেছিলেন অথবা হতে পারে আপনি আগে কোথাও আমাকে দেখেছেন।
না শুনে পারি কী করে? পৃথিবীজুড়ে গুজবের ছড়াছড়ি। তবে ব্যাপারটা যেহেতু অনেককাল আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সে কারণেই কী শুনেছিলাম তা এখন আর মনে নেই। আইভান বলল, লোকটাকে কে খুন করেছিল সেটা হয়তো শুনেছিলেন। মাকারসেমিওনিচ হেসে উত্তর দিল, যার ব্যাগের ভিতর ছুরিটা পাওয়া গিয়েছিল কাজটা হয়তো সে-ই করেছিল। অন্য কেউ যদি ছুরি ব্যাগে রেখেও থাকে- ধরা পড়ার আগে চোরও তো চোর নয়,তাই না? এতো প্রবাদই আছে- চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। ব্যাগটা আপনার মাথার নিচে ছিল, অন্য কেউ সেই ব্যাগে ছুরি রাখে কী করে? এ অবস্থায় আপনার ঘুম তো ভেঙ্গে যাবার কথা।
এই কথাগুলো শুনেই আইভানের নিশ্চিত ধারণা হলো যে এই লোকই সেই ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল। সে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে রাতে আইভান আক্সিওনোভ একটুও ঘুমোতে পারেনি। তার কষ্ট হচ্ছিল খুব, ভয়ানক সব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগল। কেমন একটা অস্বস্তি! মেলায় যাবার আগ মুহূর্তে সে তার স্ত্রীকে যেমন দেখেছিল এখন সে আবার তাকে হুবহু সে রকমই দেখল। তাকে এমন সত্য মনে হলো যেন এই মুহূর্তে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখম-ল, চোখ দুটো- সুস্পষ্ট তার মনের চোখে ভেসে উঠল। তার কথা তার হাসি তার কানে বাজলো। সে তার সন্তানদের দেখতে পেলো- ছোট ছোট, এই যেমন তখন তারা দেখতে ছিল- একজনার পরনে ঢিলে জামা, অন্যজন মায়ের দুধ খাচ্ছে। এরপর সে তার যুবা বয়সের সেই মুখ মনে করল- ফুরফুরে সদানন্দ। গ্রেফতার হবার আগে কীভাবে সেদিন সেই সরাইখানার গাড়ি বারান্দায় বসে সে গীটার বাজাচ্ছিল, সে কথাও তার মনে পড়ল। কী পরিমাণ চিন্তা দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন ছিল তার! তারপর মনে পড়ল যেখানে তাকে চাবুক মারা হতো সেই জায়গার কথা। যেন খোলা চোখে দিব্যি দেখল সে দৃশ্য- ঘাতক আর তাকে ঘিরে লোকজন। পরিষ্কার ছবির মতো ভেসে উঠল তার চোখে। শিকলের শব্দ, অপরাধীর কোলাহল, কারাবাসের গোটা সময় জীবনের ছাব্বিশটা বছর আর অসময়ে বুড়ো হবার ঘটনা সবই তার মনের চোখে ভেসে উঠল। এ সব কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে এতোটাই বিপন্ন বোধ করল সে যে তার আত্মহননের কথা মনে হলো।
আইভান ভাবল, এই সব কিছু ওই খারাপ লোকটারই জন্য। মাকার সেমিওনিচের উপর রাগটা তার এতোটাই তীব্র হলো যে প্রতিহিংসায় মত্ত হয়ে উঠল সে; ঠিক করল এতে যদি তার ধ্বংস ও বিপর্যয়ও ঘটে তবু সে নিরত হবে না। সারা রাত ধরে সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল কিন্তু সামান্যতম শান্তিও পেল না। দিনের বেলা সে সেমিওনিচের ধারেকাছেও যায় না এমনকি তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
এভাবে এক পক্ষকাল চলে গেল। আইভান রাতে ঘুমোতে পারে না। এতোটাই বিমূঢ় হয়ে গেল যে, কী করবে তাই সে বুঝতে পারছিল না।
এক রাতে আইভান আক্সিওনোভ জেলখানার আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। হঠাৎ খেয়াল করল যেখানে কয়েদীরা ঘুমায় তার একটি তাক-বিছানার নিচ থেকে একটা মাটির ঢেলা গড়িয়ে এসে পড়ল। ব্যাপারটা কী সেটা বোঝার জন্য সে দাঁড়ালো। দেখল বিছানার নিচ থেকে মাকার সেমিওনিচ হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো। ভয়ার্ত সে আইভানের মুখের দিকে তাকাল। আইভান ভ্রুক্ষেপ না করে যেতে চাইলে সে তার হাতটা ধরে ফেলল এবং বলল যে সে দেয়ালের নিচে একটা গর্ত খুঁড়েছে। কয়েদীদের যখন কাজে নিয়ে যাওয়া হয় তখন হাই বুটের ভিতরে মাটি নিয়ে তা সে রাস্তায় ফেলে দেয়। এভাবেই সে মাটি সরায়।
‘তুমি চুপচাপ থাকবে বুড়ো। কাউকে কিছু বলবে না। তুমিও বেরোতে পারবে। এ কথা কাউকে যদি বলো ওরা আমাকে চাবকাতে চাবকাতে মেরে ফেলবে আমি জানি, কিন্তু তার আগে আমি তোমাকে মেরে ফেলব মনে রেখ।
সেমিওনিচের দিকে তাকিয়ে আইভান রাগে কাঁপছিল। সে তার হাতটা সরাতে সরাতে বলল, আমার পালানোর কোনও ইচ্ছা নেই, আর আমাকে তোমার মারতেও হবে না। তুমি তো আমাকে অনেক আগেই মেরে ফেলেছ। তোমার কথা কাউকে বলার ব্যাপারে বলছি, শোনো, আমি বলতেও পারি আবার নাও বলতে পারি। ঈশ্বর আমাকে যেমন নির্দেশ করবেন আমি সেটাই করব। পরের দিন কয়েদীদের যখন কাজে নিয়ে যাওয়াহচ্ছিল কনভয়ের সেনাদের একজন লক্ষ্য করল কয়েদীদের মধ্যে কেউ একজন বুটের ভিতর থেকে কিছু মাটি বের করে রাস্তায় ফেলছে। কারাগারের এখানে ওখানে খোঁজাখুঁজি করতেই সুরঙ পাওয়া গেল। কারাকর্মকর্তা এলেন এবং কয়েদীদের সবাইকেই জিজ্ঞেস করলেন গর্ত কে করছে। সবাই বলল তারা কেউ কিছু জানেন না। যারা জানতো তারা মাকারের সঙ্গে চুক্তি ভাঙতে চাইল না। কারণ, তারা জানতো দোষী শনাক্ত হলে চাবকে চাবকে তাকে প্রায় মেরেই ফেলা হবে। সব শেষে কারা শাসক আইভান আক্সিওনোভকে জিজ্ঞেস করলেন। জেলর তাকে বেশ ভালো করে জানতেন। মানুষটির ন্যায়নীতি নিয়ে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি তাকে বললেন, আপনি একজন সত্যবাদী বৃদ্ধ মানুষ।ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে বলুন কে করেছে এই সুরঙ।
মাকার সেমিওনিচ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন এসব ব্যাপারে তার কিছুই যায় আসে না। জেলরের দিকে সে তাকাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যতটা বৃদ্ধের দিকে ততটা নয়। আইভান আক্সিওনোভের হাত কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে। কিছুক্ষণের জন্য সে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি। সে ভাবলো, যে আমার জীবন ধংস করেছে তাকে আমি রক্ষা করতে যাবো কেন? যে অসহ্য যন্ত্রণা সে আমাকে দিয়েছে তার প্রায়শ্চিত্ত এখন সে করুক। যদি বলি তাহলে তারা হয়তো তাকে চাবকে চাবকে মেরেই ফেলবে; এমনও তো হতে পারে আমি তাকে ভুল বুঝেছি। তাছাড়া এতো কিছু করে আমার কীইবা লাভ হবে?
জেলর পুনরায় বললেন, তাহলে মহোদয় সত্যিটা আমাকে বলুন। দেয়ালের নিচে সুড়ঙ খুঁড়ছিল কে? আইভান মাকার সেমিওনিচের দিকে তাকালো এবং বলল, মাননীয় আমি বলতে পারবোনা। ঈশ্বরের ইচ্ছা নয় যে আমি বলি। আমি আপনার মুঠোর মধ্যে আমাকে যা ইচ্ছ আপনার করুন, কিন্তু আমি বলতে পারবো না। কারাপতি নানানভাবে চেষ্টা করলেন কিন্তু আইভান আর একটি কথাও বলল না। ফলে, বিষয়টা সেখানেই শেষ হয়ে গেল। সে রাতে আইভান যখন তার বিছানায় শুয়েছে- চোখটা কেবল লেগে এসেছে, কে একজন নীরবে এলো এবং তার বিছানার কিনারায় বসে পড়ল। অন্ধকারের ভিতরে আইভান দেখার চেষ্টা করল এবং মাকারকে চিনতে পারল। জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছ? তুমি আমার কাছে আর কী চাও?।
চারদিকে রাতের ঝাঁঝাঁ নীরবতা। সেমিওনিচ কোনও কথা বলে না। আইভান উঠে বসল এবং বলল, কী চাও তুমি? চলে যাও নয়তো পাহারাদার ডাকব। মাকার সেমিওনিচ আইভানের উপর ঝুঁকে ফিস ফিস করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন আইভান দিমিত্রিচ। আইভান অবাক হয়ে জিজ্ঘেস করল, কেন? কী কারণে?
-আমিই সেই ব্যবসায়ীকে খুন করেছিলাম এবং ছুরিটা লুকিয়ে আপনার মালপত্রের মধ্যে গুঁজে রেখেছিলাম। আপনাকেও আমি খুন করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাইরে একটা শব্দ হওয়াতে তা আর পারিনি। আমি ছুরিটা কোনোক্রমে আপনার ব্যাগের মধ্যে রেখে জানালা দিয়ে বেরিয়েছিলাম। আইভান আক্সিওনোভ একেবারে চুপ হয়ে গেল। কী বলবে সে বুঝতে পারছিল না।
মাকার সেমিওনিচ তাক-বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে নামল এবং সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসল। সেমিওনিচ বলল, আইভান দিমিত্রিচ ক্ষমা করুন আমাকে। ঈশ্বরকে ভালোবেসে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করব- আমিই আমার নিজের হাতে ব্যবসায়ীকে খুন করেছিলাম এ কথা নিজের মুখে আমি স্বীকার করব; আপনি মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন।
- এ কথা তোমার জন্য বলা খুব সহজ, সেমিওনিচ। আমি তোমার কারণে এই ছাব্বিশ বছর অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেছি কিন্তু এখন আমি কোথায় যাবো? আমার স্ত্রী মরে গেছে, আমার সন্তানরা আমাকে ভুলে গেছে... আমার যাবার তো কোনও জায়গা নেই।
মাকার সেমিওনিচ মেঝে থেকে উঠল না, উ™£ান্তের মতো সে মেঝেতে মাথা ঠোকাতে থাকল। কেঁদে কেঁদে বার বার বলতে লাগল আইভান দিমিত্রিচ ক্ষমা করুন আমাকে, ক্ষমা করুন; ওরা যখন আমাকে গীট চাবুক মেরেছে সে কষ্ট সহ্য করা আপনাকে দেখারকষ্টের চেয়ে কম ছিল, তারপরও আপনি আমাকে করুণা করেছেন একটি কথাও কাউকে বলেননি। এ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। যিশুর দোহাই আইভান আমাকে ক্ষমা করে দিন- আমি একটা পাষণ্ড! সে হুহু করে কেঁদে উঠল।
আইভান দিমিত্রিচ যখন তাকে কাঁদতে দেখল তার চোখ দিয়েও জল গড়াতে লাগল। তিনি বললেন, ‘ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করবেন, মাকার সেমিওনিচ। হতে পারে আমি তোমার চেয়েও শতগুণ বেশি খারাপ।’ এই শব্দগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আইভানের অন্তরের বোঝা হাল্কা হয়ে গেল এবং বাড়ি ফেরার বাসনা তাকে মুহূর্তে ছেড়ে গেল। এই জেলখানা ছাড়ার আর কোনও ইচ্ছাই তার রইল না। শুধু জীবনের শেষ প্রহর যেন এগিয়ে আসে এই আশা তার প্রবল হলো।
আইভান আক্সিওনোভ যা বলেছিলেন সে মতে কাজ হয় নি। মাকার সেমিওনিচ তার অপরাধ স্বীকার করেছিল কিন্তু খালাসের আদেশ যখন এলো তার আগেই আক্সিওনোভ জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
লি ও ট ল স্ট য়ে র গ ল্প
অনুবাদ : খায়রুল আলম সবুজ
বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫
ভ্লাদিমির শহরে আইভান দিমিত্রিচ আক্সিওনোভ নামের এক ব্যবসায়ী বাস করত। তরতাজা এক যুবক তখন আইভান। এই শহরে তার দু’দুটো দোকান; নিজের বাড়িও ছিল।
আইভান দেখতে শুনতে দারুণ। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, প্রাণবন্ত, রসিক মানুষ- সঙ্গীতের ভক্ত। আরো কম বয়সে যখন একেবারে কাঁচা তরুণ, তখন তার একবার দুর্ভাগ্যজনকমতিভ্রম ঘটেছিল। মদ্যপান তাকে প্রায় গিলেই খাচ্ছিল। একে তো ওই বয়স তাতে বন্ধুদের মেলায় একটু কখনও বেশি গিলে টিলে ফেললে শুরু হতো তুমুল মাতলামো। কিন্তু বিয়ের পরে সে একেবারে ভিন্ন মানুষ। মদ্যপান প্রায় ছেড়েই দিয়েছে- ওই মাঝেমধ্যে কখনও সখনও।
এক গ্রীষ্ম কালে আইভান নিঝ্নির মেলায় যাচ্ছিল। যখন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে; তার স্ত্রী তাকে বললো, আইভান দিমিত্রিচ শোনো, আজকে বরং যেও না। আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তোমাকে নিয়ে। আইভান হেসে বললো, তোমার ভয় হয় মেলায় পৌঁছেই আমি প্রমোদে ঢালিয়া দেবো মন, তাই না?
তার স্ত্রীী বললো, কিসের ভয় পাচ্ছি তা আমি নিজেও ঠিক জানি না; শুধু জানি আমি একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখলাম শহর থেকে ঘরে ফিরে যখন তুমি মাথার টুপিটা খুলেছ আমি অবাক হয়ে দেখলাম তোমার মাথার সব চুল পেকে গেছে।
আইভান হেসে বললো, সে তো তবে সৌভাগ্যের লক্ষণ। আমার সব মালপত্র বিক্রি করে তোমার জন্য মেলা থেকে উপহার আনি কিনা তাই দেখো।
আর দেরি না করে পরিবারকে বিদায় জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল আইভান।
২
আধেক পথ যাওয়ার পর এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে আইভানের দেখা হলো। লোকটাকে সে আগে থেকেই চিনতো। যেতে যেতে পথেই রাত নামলো এবং তারা রাতের জন্য একই সরাইখানায় উঠলো। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে গল্প করে চা টা খেয়ে তারা পাশাপাশি ঘরে যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেল।
বেশি বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাস আইভানের ছিল না। খুব সকালে ঠা-া হাওয়ায় নিরিবিলি ভ্রমণ তার ভালো লাগত। সে ভোর হবার আগেই চালককে উঠিয়ে গাড়িতে ঘোড়া জুততে বলে সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দেখা করতে গেল। (সরাইখানার পিছনে একটা বাড়িতে মালিক থাকত।) পাওনা গ-া মিটিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো পথে।
পঁচিশ মাইল পথ এসে ঘোড়াদের খাওয়াবার জন্য সে একটা সরাইখানায় দাঁড়ালো। ঘোড়ার খাওয়ার ফাঁকে সরাইখানার একটা চাপা জায়গায় সে খানিকটা বিশ্রামও করে নিল। তারপর গাড়িবারান্দায় এসে স্যামোভার গরম করার নির্দেশ দিয়ে তার গীটার বের করে বাজাতে লাগল।
হঠাৎই টুংটাং শব্দ তুলে একটা ট্রইকা সেখানে এসে থামলো। একজন সরকারি কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নেমে এলেন, সঙ্গে দু’জন সশস্ত্র সেনা। কর্মকর্তাটি আইভানের কাছে এসে সরাসরি তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। জানতে চাইলেন, কে সে, কোত্থেকে এসেছে। আইভান সহজ সরলভাবে প্রশ্নের উত্তর দিলো। তারপর বললো, একটু চা খাবেন? সে কথায় কর্ণপাত না করে অফিসার আইভানকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে চললো। আইভানকে সে জিজ্ঞেস করলো, গত রাত্রে আপনি কোথায় ছিলেন? আপনি কি একা ছিলেন নাকি সঙ্গে অন্য কোনো ব্যবসায়ী লোক ছিল? অন্য ব্যবসায়ীকে আপিনি কি আজ সকালে দেখেছেন? সকাল হবার আগেই আপনি সরাইখানা কেন ছাড়লেন? এ ধরনের প্রশ্ন তাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে দেখে আইভানের অদ্ভুত লাগলো। তারপরও যা যা হয়েছে বিশদভাবেই তার উত্তর দিলো আইভান। শেষে বললো, কিন্তু আমাকে আপনি এমনভাবে জেরা করছেন মনে হচ্ছে আমি যেন চোর কিংবা ডাকাত। আমি আমার নিজের কাজে যাচ্ছি আমাকে এতো প্রশ্ন করার তো কোনো দরকার নেই! এরপর অফিসারটি সেনা দুজনকে ডাকলো এবং আইভানকে বললো, আমি এই জেলার পুলিশ অফিসার এবং আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি তার কারণ গতরাতে আপনি যে ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করেছিলেন আজ সকালে তাকে গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আমরা আপনার মালপত্র তল্লাশি করবো।
তারা বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো। পুলিস অফিসার তার সঙ্গী দু’জনকে নিয়ে আইভানের মালপত্র খুলে বিছিয়ে তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। হঠাৎই অফিসার আইভানের ব্যাগের ভিতর থেকে একখানা রক্তাক্ত ছুরি টেনে বের করলো। চিৎকার করে বললো, এই ছুরি কার?আইভান তাকিয়ে দেখলো। তার ব্যাগের ভিতর থেকে রক্তমাখা ছুরিটা বেরিয়েছে দেখে সে ভয় পেয়ে গেল।
-এই ছুরিটায় রক্ত এলো কী করে? আইভান আক্সিওনোভ উত্তর দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারছিল না। কেবলই তোঁতলাতে থাকলো এবং কাঁপতে কাঁপতে বললো, আমি জানি না- আমার না।এরপর পুলিশ অফিসার বললো, আজ সকালে ওই লোককে গলা কাটা অবস্থায় তার বিছানার ওপর পাওয়া গেছে। আপনিই একমাত্র লোক যে এই কাজটি করতে পারেন। গোটা বাড়ি ভিতর থেকে তালা দেয়া ছিল এবং সেখানে আর কেউ ছিল না। আপনার ব্যাগের ভিতরেই রক্তমাখা ছুরিটা পাওয়া গেছে। আপনার চেহারা এবং হালচাল তো আপনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। বলেন একে আপনি কীভাবে খুন করলেন এবং কত টাকা চুরি করেছেন।
আইভান শপথ করে বলছিল এ কাজ সে করেনি; একত্রে বসে চা খাওয়ার পর এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তার আর দেখা হয়নি; তার কাছে তার নিজের আট হাজার রুব্ল ছাড়া আর কোনও টাকা নেই এবং এই ছুরিও তার নয়; বলছিল, কিন্তু তার কণ্ঠ ভেঙে ভেঙেযাচ্ছিল, উজ্জ্বল যুবকের চেহারা বিবর্ণ পা-ুর- ভয়ে সে এমনভাবে কাঁপছিল মনে হচ্ছিল যেন অপরাধ সে-ই করেছে।
আইভানকে বাঁধার জন্য অফিসার সেনাদের নির্দেশ দিলেন এবং তাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিতে বললেন। সেনারা যখন তার দু’পা একত্রে বেঁধে তাকে গাড়ির ভিতর নিক্ষেপ করলো আইভান নিজের বুকে ক্রুশ এঁকে কেঁদে উঠল। তার কাছ থেকে তার টাকা পয়সা জিনিসপত্র সব নিয়ে তাকে নিকটতম শহরের থানায় পঠিয়ে দেয়া হলো এবং সেখানেই তার জেল হলো।
ভøাদিমির শহরে তার চরিত্র নিয়ে তদন্ত হলো। শহরের ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য অধিবাসীরা বললো যে অতীতে সে খুব মদ্য পান করত এবং নিজের সময় অযথাই নষ্ট করত, তবে মানুষটা খুব ভালো।
এরপর এলো বিচারের পালা: তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলো রায়জানের এক ব্যাবসয়ীকে সে খুন করেছে এবং তার কুড়ি হাজার রুব্ল নিয়ে নিয়েছে।
তার স্ত্রী একটা মহাসংকটের মধ্যে পড়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না কোনটা বিশ্বাস করবে আর কোনটা করবে না। ছেলে মেয়েরা সব ছোট ছোট। একজন তখনও বুকের দুধ খায়। সে সবাইকে নিয়ে যেখানে তার স্বামী কারা খাটছিল সেই শহরে চলে গেল।
প্রথম তো দেখা করতে দেবেই না- শেষকালে অনেক অনুনয় বিনয়ের পর কর্র্তৃপক্ষের অনুমতি পাওয়া গেল এবং তাকে তার স¦ামীর সামনে হাজির করা হলো; যখন সে তার স¦ামীকে জেলের পোশাকে শেকল পরা অবস্থায় কতগুলো চোর ছ্যাঁচোড় ধরনের নি¤œ শ্রেণির লোকের সঙ্গে একত্রে দেখল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। অনেকক্ষণ তার আর জ্ঞান ফিরল না।
জ্ঞান ফিরতেই সে তার শিশুদের কোলে টেনে নিল তার পাশে চুপচাপ বসে থাকল। বাড়িঘরের খবর সে তাকে দিল এবং কী ঘটেছিল তাই জিজ্ঞেস করল। আইভান তার স্ত্রীকে যাযা ঘটেছিল সব বললো। তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?
-একজন নিরপরাধ মানুষ যাতে শাস্তি না পায় এই মর্মে জারের কাছে দরখাস্ত করতে হবে। স্ত্রী বললো, দরখাস্ত করেছি কিন্তু জার তা গ্রহণ করেননি। আইভান আর কোনও কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে থাকল। আইভানের স্ত্রী তাকে মনে করিয়ে দিয়ে বলল, তোমার চুল ধূসর হয়ে যাবার স্বপ্ন আমি এমনিতেই দেখি নি। মনে আছে? সেদিন আসাটা তোমার ঠিক হয় নি।আইভানের ঘন চুলে বিলি কাটতে কাটতে তার স্ত্রী বলল, লক্ষ্মী ভেনিয়া, তোমার নিজের স্ত্রীকে সত্যটা বলো। তুমি তো এ কাজ করনি, তাই না?
-তার মানে তুমিও এখন আমাকে সন্দেহ করতে শুরু করলে? আর কোনও কথা না বলে দুই হাতের মধ্যে মুখ লুকিয়ে আইভান কেঁদে উঠল। এই সময় একজন সেনা এসে জানালো স্ত্রী ও বাচ্চাদের এখন যেতে হবে। আইভান শেষ বারের মতো তার পরিবারকে বিদায় জানালো।
ওরা যখন চলে গেল, আইভান এতোক্ষণ যা কিছু কথা হয়েছে সে সব মনে করার চেষ্টা করল। যখন মনে পড়ল তার স্ত্রীও এখন তাকে সন্দেহ করছে তখন সে নিজেই বলল, মনে হচ্ছে শুধু ঈশ্বর একাই সত্যটা জানতে পারে; একমাত্র তার কাছেই আমরা আবেদন করতে পারি; তার থেকেই ক্ষমার আশা করতে পারি।
এরপর আর কোনও আবেদনপত্র আইভান কোনও দিন লেখেনি। সব আশা ছেড়ে কেবল ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করত।
আইভানের ভাগ্যে শুধু মার খাওয়াই বোধহয় ছিল। চাবুক দিয়ে মারার দ-াদেশ দিয়ে তাকে খনিতে পাঠানো হলো, সেখানে তাকে গিটযুক্ত চাবুক দিয়ে নিয়মিত প্রহার করা হতো। চাবুকের আঘাতে ক্ষত হয়ে গেল। সেই ক্ষত যখন শুকালো তখন তাকে অন্যান্য সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের সঙ্গে সাইবেরিয়াতে চালান দেয়া হলো।
ছাব্বিশ বছর সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মতো আইভান সাইবেরিয়াতে থেকেছে। তার কাঁচা চুল বরফের মতো সাদা হয়ে গেল, পাতলা দাড়ি ধূসর আর লম্বা হলো। তার জীবনের সব আনন্দ শেষ। সে নুয়ে পড়েছে; ধীরে ধীরে হাঁটে। কথা বলে কম, কখনোই হাসে না। তবে মাঝে মধ্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। জেলে বসে আইভান বুটজুতা তৈরি করতে শিখেছে। তা বিক্রি করে কিছু অর্থও উপার্জন করেছে। উপার্জিত সেই অর্থ দিয়ে সে মুনি ঋষিতুল্য মানুষের জীবনীগ্রন্থ কিনে কিনে পড়তো। কারাকক্ষে যখন একটু বেশি আলো আসতো সেই আলোতে সে পড়ত। রবিবারগুলোতে সে চার্চে লেখাপড়া করতে যেত। সেখানে সে সমবেত সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলাতো। গানের কণ্ঠ তখনও তার বেশ ভালো।
জেল কর্তৃপক্ষ তার শুদ্ধ চলন এবং বিনীত বলনের জন্য তাকে খুব পছন্দ করত আর তার সঙ্গী অপরাধীরা তাকে দাদু সম্বোধন করত এবং তার শুদ্ধাচারের জন্য তাকে সবাই সাধুসন্তুর মতো শ্রদ্ধাভক্তি করত। কারাবাসীরা কখনও কোনো ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে চাইলে সবসময় তারা আইভানের কাছে আসতো আর কখনো ঝগড়াঝাটি কিংবা মারামারি হলে তারা সবাই মিলে আইভানের কাছে আসত মীমাংসা এবং সুবিচারের জন্য।
তার বাড়ি থেকে কখনও কোনও খবর আসত না এমনকি তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা এখনও বেঁচে আছে কিনা আ্ইভান তাও জানে না।
একদিন একদল নতুন অপরাধীর চালান এলো জেলখানায়। সন্ধ্যায় পুরাতন কারাবাসীরা নতুনদের ঘিরে বসল। নতুনদের দেদার প্রশ্ন করতে লাগল পুরাতনরা, যেমন: কে কোন এলাকা, গ্রাম বা শহর থেকে এসেছে এবং এই শাস্তি তাদের কেন হলো। এই সব আর কি। সকলের সঙ্গে আইভানও নতুনদের কাছে গিয়ে বসল। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে সে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগল। একজন নতুন অপরাধী, লম্বা করে, বেশ গাট্টাগেট্টা, বয়স ষাটের মতো হবে, সযতেœ ছাটা ধূসর তার দাড়ি, সে অন্যদের বলছিল- তার শাস্তিরকারণ বলছিল। বলল, আমি স্লেজে বাঁধা একমাত্র ঘোড়াটা নিয়ে গিয়েছিলাম। তার অবশ্য কারণও ছিল, আমার একটু তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরার দরকার হয়ে পড়ে- বাড়িতে পৌঁছে ওকে আমি ছেড়েও দিতাম, তাছাড়া গাড়ির চালক মানুষটিও আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিল। অপরাধ এইটুকু। আমি তাদের বুঝিয়ে বললাম এই তো ব্যাপার, এতে কী এমন সমস্যা। এতে তো কিছু যায় আসে না- ঠিকই তো আছে। কোনও কথাই ওরা শুনলো না। ওরা বলল, না তুমি চুরি করেছ। আর এটাই তোমার অপরাধ। এই অপরাধে আমাকে চোর হিসাবে গ্রেফ্তার করল। কিন্তু কীভাবে কোথা থেকে ওটা আমি চুরি করেছি তা ওরা বলতে পারল না। কিন্তু কোনো একদিন অপরাধের মতো ভুল আমি... আমি আসলেই করেছিলাম এবং তার জন্য বহুদিন আগেই আমার এখানে আসা উচিৎ ছিল কিন্তু সেবার কেউ আমাকে ধরতে পারে নি আর খুঁজেও পায় নি। সেবার যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল, এবার এখানে এসেছি প্রায় কোনও কারণ ছাড়াই। না, আমি আপনাদের এতোক্ষণ ঠিক বলিনি; সাইবেরিয়াতে আমি এর আগেও এসেছি তবে লম্বা সময় থাকতে হয়নি।
কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়?
- ভøাদিমির। আমার পরিবার ওই শহরের। আমার নাম মাকার। সবাই আমাকে সেমিওনিচ বলেও চেনে।
আইভান মাথা সোজা করে লোকটার দিকে তাকাল। সরাসরি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সেমিওনিচ, আপনি ভøাদিমিরের ব্যবসায়ী আইভান দিমিত্রিচ আক্সিওনোভ সম্পর্কে কি কিছু জানেন? ওরা কি এখনও বেঁচে আছে? সেমিওনিচ বুক ফুলিয়ে বলল, জানি কিনা জিজ্ঞেস করছেন? অবশ্যই জানি। আক্সিওনোভরা সবাই এখন বড়লোক, ধনাঢ্য- যদিও তাদের বাবা এখনও এই সাইবেরিয়াতে; তিনি হয়তো আমাদেরই মতো একজন পাপী লোক। আচ্ছা দাদু, আপনি এখানে কেন? কী করে এলেন?
আইভান তার দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলতে চাইছিল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত- আজ ছাব্বিশ বছর ধরে আমি জেল খাটছি। মাকার সেমিওনিচ জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কেন? কী পাপ করেছেন আপনি? আইভান আক্সিওনোভ খুব সংক্ষেপে বলল, আরে! এটাই আমার প্রাপ্য ছিল।
এর বেশি সে আর কিছু বলতে চাইছিল না, কিন্তু তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী-সাথীরা বলে দিল কীভাবে আইভান আক্সিওনোভ সাইবেরিয়াতে এসেছিল; কী করে এক লোক একজন ব্যবসায়ীকে খুন করে রক্তমাখা ছুরিটা আইভানের মালপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল, যার কারণে আপরাধ না করেও আইভানকে ছাব্বিশ বছর কারাবাস করতে হলো।
মাকার সেমিওনিচ এই কথা শুনেই আইভানের দিকে তাকাল। নিজের হাঁটুতে থাপ্পড় মেরে সে বিস্ময় প্রকাশ করল- উচ্চকণ্ঠে বলল, আরে এতো আজব ঘটনা! সত্য সত্যই আশ্চর্যজনক- কিন্তু দাদু আপনি এতো বুড়ো হয়ে গেছেন!
অন্য যারা উপস্থিত ছিল তারা সেমিওনিচকে এভাবে কথা বলতে দেখে জিজ্ঞেস করল সেমিওনিচ আইভানকে এর আগে কখনও দেখেছে কিনা, কিন্তু সেমিওনিচ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। সে শুধু বলল, বাপুরা, এ এক অভাবনীয় ঘটনা, এভাবে এখানে আমাদের দেখা হবে-!
এই কথাগুলো শুনে আইভান আক্সিওনোভের মনে হলো সেই ব্যবসায়ীকে কে বা কারা খুন করেছিল এ লোকটা বোধ হয় নিশ্চিতভাবে তা জানে। সেমিওনিচকে সে জিজ্ঞেস করল, সেমিওনিচ, আপনি বোধ করি এই ব্যাপারটা শুনেছিলেন অথবা হতে পারে আপনি আগে কোথাও আমাকে দেখেছেন।
না শুনে পারি কী করে? পৃথিবীজুড়ে গুজবের ছড়াছড়ি। তবে ব্যাপারটা যেহেতু অনেককাল আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা সে কারণেই কী শুনেছিলাম তা এখন আর মনে নেই। আইভান বলল, লোকটাকে কে খুন করেছিল সেটা হয়তো শুনেছিলেন। মাকারসেমিওনিচ হেসে উত্তর দিল, যার ব্যাগের ভিতর ছুরিটা পাওয়া গিয়েছিল কাজটা হয়তো সে-ই করেছিল। অন্য কেউ যদি ছুরি ব্যাগে রেখেও থাকে- ধরা পড়ার আগে চোরও তো চোর নয়,তাই না? এতো প্রবাদই আছে- চুরি বিদ্যা বড়ো বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। ব্যাগটা আপনার মাথার নিচে ছিল, অন্য কেউ সেই ব্যাগে ছুরি রাখে কী করে? এ অবস্থায় আপনার ঘুম তো ভেঙ্গে যাবার কথা।
এই কথাগুলো শুনেই আইভানের নিশ্চিত ধারণা হলো যে এই লোকই সেই ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল। সে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
সে রাতে আইভান আক্সিওনোভ একটুও ঘুমোতে পারেনি। তার কষ্ট হচ্ছিল খুব, ভয়ানক সব দৃশ্য চোখের সামনে ভাসতে লাগল। কেমন একটা অস্বস্তি! মেলায় যাবার আগ মুহূর্তে সে তার স্ত্রীকে যেমন দেখেছিল এখন সে আবার তাকে হুবহু সে রকমই দেখল। তাকে এমন সত্য মনে হলো যেন এই মুহূর্তে সে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখম-ল, চোখ দুটো- সুস্পষ্ট তার মনের চোখে ভেসে উঠল। তার কথা তার হাসি তার কানে বাজলো। সে তার সন্তানদের দেখতে পেলো- ছোট ছোট, এই যেমন তখন তারা দেখতে ছিল- একজনার পরনে ঢিলে জামা, অন্যজন মায়ের দুধ খাচ্ছে। এরপর সে তার যুবা বয়সের সেই মুখ মনে করল- ফুরফুরে সদানন্দ। গ্রেফতার হবার আগে কীভাবে সেদিন সেই সরাইখানার গাড়ি বারান্দায় বসে সে গীটার বাজাচ্ছিল, সে কথাও তার মনে পড়ল। কী পরিমাণ চিন্তা দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন ছিল তার! তারপর মনে পড়ল যেখানে তাকে চাবুক মারা হতো সেই জায়গার কথা। যেন খোলা চোখে দিব্যি দেখল সে দৃশ্য- ঘাতক আর তাকে ঘিরে লোকজন। পরিষ্কার ছবির মতো ভেসে উঠল তার চোখে। শিকলের শব্দ, অপরাধীর কোলাহল, কারাবাসের গোটা সময় জীবনের ছাব্বিশটা বছর আর অসময়ে বুড়ো হবার ঘটনা সবই তার মনের চোখে ভেসে উঠল। এ সব কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে এতোটাই বিপন্ন বোধ করল সে যে তার আত্মহননের কথা মনে হলো।
আইভান ভাবল, এই সব কিছু ওই খারাপ লোকটারই জন্য। মাকার সেমিওনিচের উপর রাগটা তার এতোটাই তীব্র হলো যে প্রতিহিংসায় মত্ত হয়ে উঠল সে; ঠিক করল এতে যদি তার ধ্বংস ও বিপর্যয়ও ঘটে তবু সে নিরত হবে না। সারা রাত ধরে সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল কিন্তু সামান্যতম শান্তিও পেল না। দিনের বেলা সে সেমিওনিচের ধারেকাছেও যায় না এমনকি তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
এভাবে এক পক্ষকাল চলে গেল। আইভান রাতে ঘুমোতে পারে না। এতোটাই বিমূঢ় হয়ে গেল যে, কী করবে তাই সে বুঝতে পারছিল না।
এক রাতে আইভান আক্সিওনোভ জেলখানার আশপাশে ঘোরাফেরা করছিল। হঠাৎ খেয়াল করল যেখানে কয়েদীরা ঘুমায় তার একটি তাক-বিছানার নিচ থেকে একটা মাটির ঢেলা গড়িয়ে এসে পড়ল। ব্যাপারটা কী সেটা বোঝার জন্য সে দাঁড়ালো। দেখল বিছানার নিচ থেকে মাকার সেমিওনিচ হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো। ভয়ার্ত সে আইভানের মুখের দিকে তাকাল। আইভান ভ্রুক্ষেপ না করে যেতে চাইলে সে তার হাতটা ধরে ফেলল এবং বলল যে সে দেয়ালের নিচে একটা গর্ত খুঁড়েছে। কয়েদীদের যখন কাজে নিয়ে যাওয়া হয় তখন হাই বুটের ভিতরে মাটি নিয়ে তা সে রাস্তায় ফেলে দেয়। এভাবেই সে মাটি সরায়।
‘তুমি চুপচাপ থাকবে বুড়ো। কাউকে কিছু বলবে না। তুমিও বেরোতে পারবে। এ কথা কাউকে যদি বলো ওরা আমাকে চাবকাতে চাবকাতে মেরে ফেলবে আমি জানি, কিন্তু তার আগে আমি তোমাকে মেরে ফেলব মনে রেখ।
সেমিওনিচের দিকে তাকিয়ে আইভান রাগে কাঁপছিল। সে তার হাতটা সরাতে সরাতে বলল, আমার পালানোর কোনও ইচ্ছা নেই, আর আমাকে তোমার মারতেও হবে না। তুমি তো আমাকে অনেক আগেই মেরে ফেলেছ। তোমার কথা কাউকে বলার ব্যাপারে বলছি, শোনো, আমি বলতেও পারি আবার নাও বলতে পারি। ঈশ্বর আমাকে যেমন নির্দেশ করবেন আমি সেটাই করব। পরের দিন কয়েদীদের যখন কাজে নিয়ে যাওয়াহচ্ছিল কনভয়ের সেনাদের একজন লক্ষ্য করল কয়েদীদের মধ্যে কেউ একজন বুটের ভিতর থেকে কিছু মাটি বের করে রাস্তায় ফেলছে। কারাগারের এখানে ওখানে খোঁজাখুঁজি করতেই সুরঙ পাওয়া গেল। কারাকর্মকর্তা এলেন এবং কয়েদীদের সবাইকেই জিজ্ঞেস করলেন গর্ত কে করছে। সবাই বলল তারা কেউ কিছু জানেন না। যারা জানতো তারা মাকারের সঙ্গে চুক্তি ভাঙতে চাইল না। কারণ, তারা জানতো দোষী শনাক্ত হলে চাবকে চাবকে তাকে প্রায় মেরেই ফেলা হবে। সব শেষে কারা শাসক আইভান আক্সিওনোভকে জিজ্ঞেস করলেন। জেলর তাকে বেশ ভালো করে জানতেন। মানুষটির ন্যায়নীতি নিয়ে তার কোনও সন্দেহ ছিল না। তিনি তাকে বললেন, আপনি একজন সত্যবাদী বৃদ্ধ মানুষ।ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে বলুন কে করেছে এই সুরঙ।
মাকার সেমিওনিচ নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যেন এসব ব্যাপারে তার কিছুই যায় আসে না। জেলরের দিকে সে তাকাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যতটা বৃদ্ধের দিকে ততটা নয়। আইভান আক্সিওনোভের হাত কাঁপছে, ঠোঁট কাঁপছে। কিছুক্ষণের জন্য সে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি। সে ভাবলো, যে আমার জীবন ধংস করেছে তাকে আমি রক্ষা করতে যাবো কেন? যে অসহ্য যন্ত্রণা সে আমাকে দিয়েছে তার প্রায়শ্চিত্ত এখন সে করুক। যদি বলি তাহলে তারা হয়তো তাকে চাবকে চাবকে মেরেই ফেলবে; এমনও তো হতে পারে আমি তাকে ভুল বুঝেছি। তাছাড়া এতো কিছু করে আমার কীইবা লাভ হবে?
জেলর পুনরায় বললেন, তাহলে মহোদয় সত্যিটা আমাকে বলুন। দেয়ালের নিচে সুড়ঙ খুঁড়ছিল কে? আইভান মাকার সেমিওনিচের দিকে তাকালো এবং বলল, মাননীয় আমি বলতে পারবোনা। ঈশ্বরের ইচ্ছা নয় যে আমি বলি। আমি আপনার মুঠোর মধ্যে আমাকে যা ইচ্ছ আপনার করুন, কিন্তু আমি বলতে পারবো না। কারাপতি নানানভাবে চেষ্টা করলেন কিন্তু আইভান আর একটি কথাও বলল না। ফলে, বিষয়টা সেখানেই শেষ হয়ে গেল। সে রাতে আইভান যখন তার বিছানায় শুয়েছে- চোখটা কেবল লেগে এসেছে, কে একজন নীরবে এলো এবং তার বিছানার কিনারায় বসে পড়ল। অন্ধকারের ভিতরে আইভান দেখার চেষ্টা করল এবং মাকারকে চিনতে পারল। জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছ? তুমি আমার কাছে আর কী চাও?।
চারদিকে রাতের ঝাঁঝাঁ নীরবতা। সেমিওনিচ কোনও কথা বলে না। আইভান উঠে বসল এবং বলল, কী চাও তুমি? চলে যাও নয়তো পাহারাদার ডাকব। মাকার সেমিওনিচ আইভানের উপর ঝুঁকে ফিস ফিস করে বলল, আমাকে ক্ষমা করুন আইভান দিমিত্রিচ। আইভান অবাক হয়ে জিজ্ঘেস করল, কেন? কী কারণে?
-আমিই সেই ব্যবসায়ীকে খুন করেছিলাম এবং ছুরিটা লুকিয়ে আপনার মালপত্রের মধ্যে গুঁজে রেখেছিলাম। আপনাকেও আমি খুন করতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাইরে একটা শব্দ হওয়াতে তা আর পারিনি। আমি ছুরিটা কোনোক্রমে আপনার ব্যাগের মধ্যে রেখে জানালা দিয়ে বেরিয়েছিলাম। আইভান আক্সিওনোভ একেবারে চুপ হয়ে গেল। কী বলবে সে বুঝতে পারছিল না।
মাকার সেমিওনিচ তাক-বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে নামল এবং সেখানেই হাঁটু গেড়ে বসল। সেমিওনিচ বলল, আইভান দিমিত্রিচ ক্ষমা করুন আমাকে। ঈশ্বরকে ভালোবেসে আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আমার অপরাধ স্বীকার করব- আমিই আমার নিজের হাতে ব্যবসায়ীকে খুন করেছিলাম এ কথা নিজের মুখে আমি স্বীকার করব; আপনি মুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন।
- এ কথা তোমার জন্য বলা খুব সহজ, সেমিওনিচ। আমি তোমার কারণে এই ছাব্বিশ বছর অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেছি কিন্তু এখন আমি কোথায় যাবো? আমার স্ত্রী মরে গেছে, আমার সন্তানরা আমাকে ভুলে গেছে... আমার যাবার তো কোনও জায়গা নেই।
মাকার সেমিওনিচ মেঝে থেকে উঠল না, উ™£ান্তের মতো সে মেঝেতে মাথা ঠোকাতে থাকল। কেঁদে কেঁদে বার বার বলতে লাগল আইভান দিমিত্রিচ ক্ষমা করুন আমাকে, ক্ষমা করুন; ওরা যখন আমাকে গীট চাবুক মেরেছে সে কষ্ট সহ্য করা আপনাকে দেখারকষ্টের চেয়ে কম ছিল, তারপরও আপনি আমাকে করুণা করেছেন একটি কথাও কাউকে বলেননি। এ আমি আর সহ্য করতে পারছি না। যিশুর দোহাই আইভান আমাকে ক্ষমা করে দিন- আমি একটা পাষণ্ড! সে হুহু করে কেঁদে উঠল।
আইভান দিমিত্রিচ যখন তাকে কাঁদতে দেখল তার চোখ দিয়েও জল গড়াতে লাগল। তিনি বললেন, ‘ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করবেন, মাকার সেমিওনিচ। হতে পারে আমি তোমার চেয়েও শতগুণ বেশি খারাপ।’ এই শব্দগুলো উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আইভানের অন্তরের বোঝা হাল্কা হয়ে গেল এবং বাড়ি ফেরার বাসনা তাকে মুহূর্তে ছেড়ে গেল। এই জেলখানা ছাড়ার আর কোনও ইচ্ছাই তার রইল না। শুধু জীবনের শেষ প্রহর যেন এগিয়ে আসে এই আশা তার প্রবল হলো।
আইভান আক্সিওনোভ যা বলেছিলেন সে মতে কাজ হয় নি। মাকার সেমিওনিচ তার অপরাধ স্বীকার করেছিল কিন্তু খালাসের আদেশ যখন এলো তার আগেই আক্সিওনোভ জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।