alt

সাময়িকী

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

জোবায়ের মিলন

: বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

কোনো কোনো কবিতা পড়তে যেয়ে কোনো কোনো সময় মনে হয় ‘ধ্যাৎ ছাই’ উঠে যাই। কোনো সময় ঝিম মেরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। পাতার পর পাতা উল্টিয়ে খুঁজতে আগ্রহ জন্মে- পরের কবিতাটিতে কী আছে। এমনি শেষ পৃষ্ঠাটিতে পৌঁছলে পাঠক কাক্সিক্ষত মুক্তি না পেয়ে আবার ফিরে আসতে সচেষ্ট হতে হয় প্রথম পাতায়। কারো কারো কাছে এটি এক যন্ত্রণা হয়তো, কারো কাছে এটিই কবিতা। কেননা, কবিতা তো গদ্যের মতো তরতর করে পড়ে যাবার মতো না, বিস্তৃত ব্যাপ্তিতে মুহূর্তেই বুঝে ওঠার মতোও না- সেটিই কবিতা, যা পাঠ করার পরও পাঠে ফিরে আসতে আদেশ জারি করে, পাঠমুক্তির নিমিত্তে অন্বেষণে নামায় কিংবা তার আচ্ছন্নতায়, মুগ্ধতায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধিত করে; মূর্ত অথবা বিমূর্ততার কোনো এক দৃশ্য পিন-পতনহীনতার মতো বোধের বোর্ডে ঝুলে থাকে জিজ্ঞাসা নিয়ে।

মালেক মুস্তাকিমের ‘আধেক জীবন আধেক ধুলো’ কাব্যগ্রন্থে তদ্রƒপ লক্ষ্য করা যায় যে, বিমূর্ততার রঙ-তুলি হাতে তিনি একটি নিখুঁত ঘোর আঁকছেন। প্রগাঢ় ঘোর আঁকতে আঁকতে তিনি শেষাবধি পৌঁছতে চেষ্টা করছেন; পাঠককে যেন তিনি বুঝতে দিচ্ছেন না যে, তিনি কী বলছেন, কী দেখাতে রূপকাশ্রয়ে শব্দের পর শব্দ বুনে খেলছেন বাক্য নির্মাণের খেলা। ফলে এমন একটি বৃত্ত তৈরি হচ্ছে যে, তা ভাঙার ’কাক্সক্ষায় পাঠক-মনোবাসনায় পুনঃপাঠের ইচ্ছা জাগ্রত হচ্ছে পুনঃপুন। যেন আর একটু পাঠ করলেই উদ্ধার সম্ভব- আধেক দেখা ছবিটা। ‘মহল্লার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে নির্জন দুপুরের নৃত্য-/অপরাহ্ণের শোকসভা-মাদুলি।/আমাকে উড়িয়ে নিচ্ছে শুকনো পাতা-/সন্ধ্যার গলিমুখ পেরিয়ে-হাসনাহেনা ফোটাচ্ছে রাত্রির কলহ-/যেন কেউ গুটিয়ে নিচ্ছে স্মৃতির সারিন্দা-ফেলে আসা পদচিহ্ন-/...মৃত মানুষের শহরে পাখিরা খুলে রাখে তন্দ্রা ও অন্ধকার,/মুহূর্তরা অবিরাম গেয়ে যায় বিস্মরণের পোপন এলিজি।’ (মুহূর্তের পদাবলি)। কবি আবার লিখছেন, ‘মানুষের ডানার পৃষ্ঠে প্যাডেল এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে মহাকাল।/আয়নায় ভেসে ওঠে মুহূর্তের কঙ্কাল-/ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মৃত মানুষের শিরদাঁড়া-/এই শহরের চলন্ত সিঁড়ি পার হলে বুকের বাঁ দিকে নিঝুম রাত-পাখির ছটফটানি-/চাঁদের আলোয় কার মুখ ভেসে ওঠে নদীতে?/...বাতাসে হেলান দিয়ে জলের দৃশ্য এঁকে যাচ্ছে পিপাসা;/এইসব তৃষ্ণারা মরে গেলে জিজ্ঞাসাচিহ্নের নিচে বসে থাকি...’ (ঝাপটানো ডানার প্যাডেল)।

প্রত্যক্ষ করি, কবি কোথাও কোথাও বাস্তব ও অতি দূর-বাস্তবতার ছিন্নপত্র সংযুক্ত করে সেটা উপস্থাপন করছেন ভিন্ন আঙ্গিকে; যেখানে খনন করে আবিষ্কারের মতো একটি চেষ্টা পাঠকের জন্য রেখে দিচ্ছেন সম্পূর্ণ সচেতনভাবে; কৌশলে বা তার নিজস্ব ছড়িছত্রের মুন্সিয়ানায়। যেন অর্ধেক বলছেন, অর্ধেক পাঠকের স্কন্ধে তুলে দিয়ে তিনি আরেকটি কবিতার খোঁজে নিঃসঙ্গ বেরিয়ে পড়ছেন আপন ভুবনের আস্তানায়। ‘বারান্দার ক্লিপে ঝুলে আছে রাত্রি-/আমি এঁকে যাচ্ছি তোমার মুখের মতো প্রতিদিনের ক্যামোফ্লেজ-/এখানে অন্ধকার জেগে থাকে শাদা শাদা আলোর অস্থির চিবুক বিছিয়ে।/ পৃথিবীর শেষ বিন্দুর নিচে জিরিয়ে নিচ্ছেন ঈশ^র-/ঘুম ভেঙে গেলে চোখ মেলে দেখি-/কিছুটা গাছ আমি, কিছুটা কাঁটা-ফুটে আছি অনস্তিত্বের স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে।/পৃথিবীর এই বারোয়ারি সম্পর্কের আড়ালে পাখিদের ফুলশয্যায় দৃশ্যহীনতাই উৎকৃষ্ট সুয়ারেজ-/দৃশ্যের ভেতর থেকে নেমে যেতে যেতে ভাগ হয়ে গেছে চুল ও চুম্বনের বলিরেখা-/ফুল আর পাতার ছদ্মবেশে অরণ্য লুকিয়ে রেখেছে জাগতিক ফ্যান্টাসি...’ (আধেক জীবন আধেক ধুলো)্। সুশোভন উপমার ব্যবহারে কবিতায় এসেছে প্রেম, কাম, দ্রোহ, স্মৃতি, বিস্মৃতি, প্রত্যাশা, বিষণœতা ও বৈরাগ্য; ¯েœহ ও মমতার আবছায়া। তবে কোনোটিতেই প্রচ্ছন্ন স্বীকারে নয়, অস্বীকারের ধারাবাহিকতায় কবি অগ্রসর হয়েছেন নিজেকে ভাঙার চেষ্টায়-প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে। যে প্রচেষ্টা নির্মাতা মাত্রকেই নিমার্ণে মহত্ত্বের দিকে ধাবিত করে।

পাঠে দেখা যায়, যা কিছু অস্বাভাবিক, যা কিছু অসুন্দর, কালো, তিমিরময় কিংবা যা কিছু আলোর অধিক তাই যেন কবির আরাধনা; অদৃশ্য, অবিশ^াস, অদেখা, ছুঁতে না পারার বেদনা, না পাওয়ার নীরবতা, পাওয়ার কান্না সবকিছুই তার কবিতার শস্যক্ষেত্র; উৎসক্ষেত্র তার অভিজ্ঞতা, জন্ম থেকে স্থিতিকাল অব্দি যতটুকু সত্য, যতটুকু মিথ্যা কিংবা সত্য মিথ্যার কোনো বিষয়ই যেখানে নেই বা আছে; ধুলো আর ধোঁয়ার ভেতরে যেন জীবন ও সময় এক মিথ্যা প্রতিপাদ্য।

আমার মনে হয়, ‘কবিতায় আঁকা ছবিটা পাঠকের কাছে শতভাগ প্রস্ফুটিত হয়ে গেলেই কবির মৃত্যু হয়, যতক্ষণ ছবিটার অন্বেষা পাঠকের মনকে তাড়িয়ে বেড়ায় ততক্ষণ কবি বেঁচে থাকেন।’ সে কারণেই বলা যায়, ‘আধেক জীবন আধেক ধুলো’তে কবির পরিবেশিত ৫২টি কবিতার প্রায় প্রতিটি কবিতা অন্বেষণ ইচ্ছা জাগ্রত করে পূর্ণ ছবি উদ্ধারের কাছাকাছি গিয়েও কাছাকাছি না। যা এ প্রতিশ্রুতিশীল কবির কবিতার বিশেষ সৌন্দর্য। তথাপি কিছু বিচ্যুতি চোখ এড়ায়নি। অদরকারি শব্দের ব্যবহার, একই শব্দ ফিরে ফিরে আসা, আবেগের অপরিমিতি বোধ, দীর্ঘ বাক্য-উপমার প্রয়োগ কোথাও কোথাও একটু বেশি মনে হয়েছে। মনে হয়েছে ভাঙা-গড়ায় রস ও কাব্যিক রঙের আরও নীরিক্ষার সুযোগ কবির সামর্থ্য ঝুলিতে থাকার পরও তা করা হয়নি কিংবা কিছুটা তাড়াহুড়া করা হয়েছে- তাই বলে যে পাঠক বঞ্চিত হবে, তা মোটেই না। বরং নিঃসন্দেহে বলা যায়, মালেক মুস্তাকিমএ সময়ের অনেকের চেয়ে আলাদা এবং স্বতন্ত্র একটি স্বর তৈরি করে পাঠানুভূতিতে টোকা দেওয়ার মতো কিছু কবিতা তৈরি করতে পেরেছেন- যা পাঠে নিশ্চয়ই উন্মুক্ত হবে।

আধেক জীবন, আধেক ধুলো। মালেক মুস্তাকিম। প্রকাশক: অন্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর। মূল্য: ২৫০ টাকা।

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

আদোনিসের কবিতা

ছবি

আড়াই লেনের কৃষ্ণচূড়া

ছবি

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক ইতিহাস ও দেশপ্রেম

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

বইমেলায় আসছে নতুন বই

ছবি

সরল প্রাণের সোপান

ছবি

হাসান আজিজুল হকের দর্শনচিন্তা

ছবি

শীতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য মানবতারই জয়গান

ছবি

বইতরণী সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শুক্লা গাঙ্গুলী

ছবি

‘শব্দঘর’ আহমদ রফিক সংখ্যা ও তাঁকে সম্মাননা প্রদান

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

ঈশ্বরের সত্য দর্শন

ছবি

মঞ্চে প্রবেশ

ছবি

আমি মাকারিও নই

ছবি

মৃতজন গল্প রচনা করে

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

tab

সাময়িকী

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

জোবায়ের মিলন

বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

কোনো কোনো কবিতা পড়তে যেয়ে কোনো কোনো সময় মনে হয় ‘ধ্যাৎ ছাই’ উঠে যাই। কোনো সময় ঝিম মেরে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। পাতার পর পাতা উল্টিয়ে খুঁজতে আগ্রহ জন্মে- পরের কবিতাটিতে কী আছে। এমনি শেষ পৃষ্ঠাটিতে পৌঁছলে পাঠক কাক্সিক্ষত মুক্তি না পেয়ে আবার ফিরে আসতে সচেষ্ট হতে হয় প্রথম পাতায়। কারো কারো কাছে এটি এক যন্ত্রণা হয়তো, কারো কাছে এটিই কবিতা। কেননা, কবিতা তো গদ্যের মতো তরতর করে পড়ে যাবার মতো না, বিস্তৃত ব্যাপ্তিতে মুহূর্তেই বুঝে ওঠার মতোও না- সেটিই কবিতা, যা পাঠ করার পরও পাঠে ফিরে আসতে আদেশ জারি করে, পাঠমুক্তির নিমিত্তে অন্বেষণে নামায় কিংবা তার আচ্ছন্নতায়, মুগ্ধতায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধিত করে; মূর্ত অথবা বিমূর্ততার কোনো এক দৃশ্য পিন-পতনহীনতার মতো বোধের বোর্ডে ঝুলে থাকে জিজ্ঞাসা নিয়ে।

মালেক মুস্তাকিমের ‘আধেক জীবন আধেক ধুলো’ কাব্যগ্রন্থে তদ্রƒপ লক্ষ্য করা যায় যে, বিমূর্ততার রঙ-তুলি হাতে তিনি একটি নিখুঁত ঘোর আঁকছেন। প্রগাঢ় ঘোর আঁকতে আঁকতে তিনি শেষাবধি পৌঁছতে চেষ্টা করছেন; পাঠককে যেন তিনি বুঝতে দিচ্ছেন না যে, তিনি কী বলছেন, কী দেখাতে রূপকাশ্রয়ে শব্দের পর শব্দ বুনে খেলছেন বাক্য নির্মাণের খেলা। ফলে এমন একটি বৃত্ত তৈরি হচ্ছে যে, তা ভাঙার ’কাক্সক্ষায় পাঠক-মনোবাসনায় পুনঃপাঠের ইচ্ছা জাগ্রত হচ্ছে পুনঃপুন। যেন আর একটু পাঠ করলেই উদ্ধার সম্ভব- আধেক দেখা ছবিটা। ‘মহল্লার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে নির্জন দুপুরের নৃত্য-/অপরাহ্ণের শোকসভা-মাদুলি।/আমাকে উড়িয়ে নিচ্ছে শুকনো পাতা-/সন্ধ্যার গলিমুখ পেরিয়ে-হাসনাহেনা ফোটাচ্ছে রাত্রির কলহ-/যেন কেউ গুটিয়ে নিচ্ছে স্মৃতির সারিন্দা-ফেলে আসা পদচিহ্ন-/...মৃত মানুষের শহরে পাখিরা খুলে রাখে তন্দ্রা ও অন্ধকার,/মুহূর্তরা অবিরাম গেয়ে যায় বিস্মরণের পোপন এলিজি।’ (মুহূর্তের পদাবলি)। কবি আবার লিখছেন, ‘মানুষের ডানার পৃষ্ঠে প্যাডেল এঁটে ঘুমিয়ে পড়েছে মহাকাল।/আয়নায় ভেসে ওঠে মুহূর্তের কঙ্কাল-/ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মৃত মানুষের শিরদাঁড়া-/এই শহরের চলন্ত সিঁড়ি পার হলে বুকের বাঁ দিকে নিঝুম রাত-পাখির ছটফটানি-/চাঁদের আলোয় কার মুখ ভেসে ওঠে নদীতে?/...বাতাসে হেলান দিয়ে জলের দৃশ্য এঁকে যাচ্ছে পিপাসা;/এইসব তৃষ্ণারা মরে গেলে জিজ্ঞাসাচিহ্নের নিচে বসে থাকি...’ (ঝাপটানো ডানার প্যাডেল)।

প্রত্যক্ষ করি, কবি কোথাও কোথাও বাস্তব ও অতি দূর-বাস্তবতার ছিন্নপত্র সংযুক্ত করে সেটা উপস্থাপন করছেন ভিন্ন আঙ্গিকে; যেখানে খনন করে আবিষ্কারের মতো একটি চেষ্টা পাঠকের জন্য রেখে দিচ্ছেন সম্পূর্ণ সচেতনভাবে; কৌশলে বা তার নিজস্ব ছড়িছত্রের মুন্সিয়ানায়। যেন অর্ধেক বলছেন, অর্ধেক পাঠকের স্কন্ধে তুলে দিয়ে তিনি আরেকটি কবিতার খোঁজে নিঃসঙ্গ বেরিয়ে পড়ছেন আপন ভুবনের আস্তানায়। ‘বারান্দার ক্লিপে ঝুলে আছে রাত্রি-/আমি এঁকে যাচ্ছি তোমার মুখের মতো প্রতিদিনের ক্যামোফ্লেজ-/এখানে অন্ধকার জেগে থাকে শাদা শাদা আলোর অস্থির চিবুক বিছিয়ে।/ পৃথিবীর শেষ বিন্দুর নিচে জিরিয়ে নিচ্ছেন ঈশ^র-/ঘুম ভেঙে গেলে চোখ মেলে দেখি-/কিছুটা গাছ আমি, কিছুটা কাঁটা-ফুটে আছি অনস্তিত্বের স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে।/পৃথিবীর এই বারোয়ারি সম্পর্কের আড়ালে পাখিদের ফুলশয্যায় দৃশ্যহীনতাই উৎকৃষ্ট সুয়ারেজ-/দৃশ্যের ভেতর থেকে নেমে যেতে যেতে ভাগ হয়ে গেছে চুল ও চুম্বনের বলিরেখা-/ফুল আর পাতার ছদ্মবেশে অরণ্য লুকিয়ে রেখেছে জাগতিক ফ্যান্টাসি...’ (আধেক জীবন আধেক ধুলো)্। সুশোভন উপমার ব্যবহারে কবিতায় এসেছে প্রেম, কাম, দ্রোহ, স্মৃতি, বিস্মৃতি, প্রত্যাশা, বিষণœতা ও বৈরাগ্য; ¯েœহ ও মমতার আবছায়া। তবে কোনোটিতেই প্রচ্ছন্ন স্বীকারে নয়, অস্বীকারের ধারাবাহিকতায় কবি অগ্রসর হয়েছেন নিজেকে ভাঙার চেষ্টায়-প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে। যে প্রচেষ্টা নির্মাতা মাত্রকেই নিমার্ণে মহত্ত্বের দিকে ধাবিত করে।

পাঠে দেখা যায়, যা কিছু অস্বাভাবিক, যা কিছু অসুন্দর, কালো, তিমিরময় কিংবা যা কিছু আলোর অধিক তাই যেন কবির আরাধনা; অদৃশ্য, অবিশ^াস, অদেখা, ছুঁতে না পারার বেদনা, না পাওয়ার নীরবতা, পাওয়ার কান্না সবকিছুই তার কবিতার শস্যক্ষেত্র; উৎসক্ষেত্র তার অভিজ্ঞতা, জন্ম থেকে স্থিতিকাল অব্দি যতটুকু সত্য, যতটুকু মিথ্যা কিংবা সত্য মিথ্যার কোনো বিষয়ই যেখানে নেই বা আছে; ধুলো আর ধোঁয়ার ভেতরে যেন জীবন ও সময় এক মিথ্যা প্রতিপাদ্য।

আমার মনে হয়, ‘কবিতায় আঁকা ছবিটা পাঠকের কাছে শতভাগ প্রস্ফুটিত হয়ে গেলেই কবির মৃত্যু হয়, যতক্ষণ ছবিটার অন্বেষা পাঠকের মনকে তাড়িয়ে বেড়ায় ততক্ষণ কবি বেঁচে থাকেন।’ সে কারণেই বলা যায়, ‘আধেক জীবন আধেক ধুলো’তে কবির পরিবেশিত ৫২টি কবিতার প্রায় প্রতিটি কবিতা অন্বেষণ ইচ্ছা জাগ্রত করে পূর্ণ ছবি উদ্ধারের কাছাকাছি গিয়েও কাছাকাছি না। যা এ প্রতিশ্রুতিশীল কবির কবিতার বিশেষ সৌন্দর্য। তথাপি কিছু বিচ্যুতি চোখ এড়ায়নি। অদরকারি শব্দের ব্যবহার, একই শব্দ ফিরে ফিরে আসা, আবেগের অপরিমিতি বোধ, দীর্ঘ বাক্য-উপমার প্রয়োগ কোথাও কোথাও একটু বেশি মনে হয়েছে। মনে হয়েছে ভাঙা-গড়ায় রস ও কাব্যিক রঙের আরও নীরিক্ষার সুযোগ কবির সামর্থ্য ঝুলিতে থাকার পরও তা করা হয়নি কিংবা কিছুটা তাড়াহুড়া করা হয়েছে- তাই বলে যে পাঠক বঞ্চিত হবে, তা মোটেই না। বরং নিঃসন্দেহে বলা যায়, মালেক মুস্তাকিমএ সময়ের অনেকের চেয়ে আলাদা এবং স্বতন্ত্র একটি স্বর তৈরি করে পাঠানুভূতিতে টোকা দেওয়ার মতো কিছু কবিতা তৈরি করতে পেরেছেন- যা পাঠে নিশ্চয়ই উন্মুক্ত হবে।

আধেক জীবন, আধেক ধুলো। মালেক মুস্তাকিম। প্রকাশক: অন্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ: মোস্তাফিজ কারিগর। মূল্য: ২৫০ টাকা।

back to top