নাসরীন জাহান
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
আমি স্মৃতিকথায় নিজের কিছু অনুভব, উপলব্ধিও শেয়ার করে যাচ্ছি। আমি অন্য কারো জীবনী বা স্মধতিকথা একেবারেই অনুসরণ করতে পছন্দ করছি না। আমি মাঝেমধ্যেই সেইসব দিনের সাথে এইসব দিনের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছি। আজ আমি উড়ুক্কু লেখার স্মতি নিয়ে লিখব। আগেও লিখেছি, আজ লিখব স্মৃতিকথার অংশ হিসেবে।
এখন হঠাৎ করে পুজোর স্মৃতি ভেতরে ঘাঁই দিয়ে উঠছে। কী জানি কে? কোন কারণ ছাড়াই।
শৈশব কৈশোরে আমরা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে আলাদা করে দেখতাম না। অন্য ধর্মের বন্ধুরা যেমন ঈদে আমাদের বাড়ি আসতো, আমরা তেমনই সপরিবারে সেজেগুঁজে দুর্গোৎসব দেখতে যেতাম। শরতের শুরুতে আমি রুবী ঝর্না হিম হিম এক ঘ্রাণ পেতাম। ঢাকের শব্দে উন্মাতাল হয়ে উঠতো আমাদের স্নায়ুকোষ। একটার পর একটা ম-প ঘুরে কি ঘোরেই না পড়তাম!
রুবীদের বাড়ির ওপাশে মেথরপট্টি।
সন্ধ্যা থেকেই ঢাক বাজতে শুরু করে। সেই শব্দ আমাদের রক্তের মধ্যে এমন কিছু তোলপাড় করত, কী করত, আমরা একজন আরেকজনকে বলার চেষ্টা করতাম, পারতাম না।
তখন সন্ধ্যার পর ওদের বাসায় রাত কাটাতে চলে যেতাম। ঝর্নার বন্ধু সার্কেল নাহার মিতা এদের ঘিরে আবর্তিত। (নাহার আমাদের পাড়ার মেয়ে। পরে তাকে আমার বড় ভাই শিপন বিয়ে করে।) কখনো আমরা একসাথে যেতাম, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে। রুবীর আব্বা নাসিরাবাদ স্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি উদার, গ্রাম থেকে আসা খালাম্মাও দারুণ বুঝতেন আমাদের। অনুরোধ করেটরে ঠিক অনুমতি মিলে যেত।
একবার পুর্ণিমা রাত, রুবী আমি তাদের বাড়ির সামনের ঘাসের সামনে বসে ছটফট করছি। আমাদের এক আত্মীয়ের দোকান থেকে আমরা দস্যু বনহুর নিয়ে আসি। মলাট লাগিয়ে দুজনের পড়া শেষ হলে ফেরত দিই। দুজনের পড়া শেষ।
আজ রাতে দুঃসাহসিক দুটো কাজ করতে হবে।
আগামীকাল বিসর্জন, ফলে মেথরপট্টিতে ঢুকে অবশ্যই পুজো দেখতে হবে। আরেকটা, দীর্ঘ রেললাইন পেরিয়ে মূল শহর গাঙ্গিনার পাড় গিয়ে দস্যু বনহুর পালটে আনতে হবে। রাত বাড়ছে, রেললাইনে আঁধার কুয়াশা ঘুটঘুট করছে। এদিকে আমাদের দুজনের বুকের মধ্যে বাজছে ঘণ্টা, আমরা কিন্তু কেউ কোন প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতে রাজি নই। রুবী খালুজানকে পটালো, আমাদের বাড়ি রাতে থাকবে বলে। আমি তো রুবীর বাড়ির কথা বলে বাসায় আগেই পটিয়ে এসেছি। আমরা দুজন প্রায়ান্ধকার রেললাইন ধরে দিলাম ছুট। সে কী দীর্ঘ রেললাইন! শীতের রাতে জনসমাগম খুবই কম। এর মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে তালুকদার লাইব্রেরির সামনে গিয়ে হাঁপাতে থাকলে দোকানী চাচা বই দিতে দিতে শাসন করলেন, বললেন, তোমরা দুটো কিশোরী মেয়ে এত রাত করে দস্যু বনহুরের টানে একা একা এত রাতে দোকানে এলে এরপর আর কোনদিন বই দেব না।
যখন ফিরছি, মনে হচ্ছিল, অন্ধকার শীত আমাদের গিলে খাবে।
ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে যখন মেথরপট্টিতে ঢুকব, হঠাৎ চমকে উঠি, টলতে টলতে একজন মাতাল বেরিয়ে আসছে। এর আগে নিজ চোখে মাতাল দেখিনি। আমাদের দেখে, হাত উড়িয়ে বলেন, থামো, বাপরে, কণ্ঠস্বরে সে কী গর্জন! আমাদের আত্মা শুকিয়ে একেবারে এইটুকু হয়ে যায়। শিশুকালে পুকুরে সাঁতার কাটলে বদমাশ ছেলেগুলো কেবলই হাফপ্যান্ট ধরে টান দিত, ওইটুকুন শিশু যোনিতে গুঁতা দিত। জোর লাত্থি দিয়ে আমরা কেবলই পাড়ে উঠে আসতাম।
আম্মা কেবল কীভাবে এদের কাছ থেকে বেঁচে চলতে হবে, তা শিখিয়ে গেছেন।
কিন্তু মাতালের হাত থেকে কীভাবে বাঁচব। তা তো শিখিনি?
সাথে সাথে আমাদের মনে হয়, আমরা তো দুজন আছি, কী? ভাবনা শেষ হওয়ার আগে মাতা দু’হাতে আমাদের আগলে জড়ানো কন্ঠে বলতে থাকেন, সময় খুব খারাপ, এক্ষণ বাড়ি চলে যাও। যাও, এইসময় কোনো মেয়ের বাইরে আসতে হয়? তোমাদেরতো সাহস কম নয়? যাও বলছি?
আমরা ফের ছুট দিই।
একবার পেছন ফিরে দেখি, বাতাসে যেমন কাকতাড়–য়া এদিক ওদিক হেলে, তেমনই ছায়ার মধ্যে তিনি হেলতে হেলতেই দাঁড়িয়ে আছেন।
দূরবর্তী ফের আওয়াজ,যা... ও।
ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, মাতালও এত ভালো হয়?
এরপর কীভাবে মানুষ সম্পর্কে, পুরুষ সম্পর্কে আমি কোন সিদ্ধান্তে আসি?
সেইরাতে আর পুজো দেখা হয়নি।
তাতে কী, মেথরপট্টিতে রাত জেগে কম পুজো দেখেছি?
এ ছাড়া প্রতি পুজোয় একদিন আব্বা-আম্মা আমাদের ম-প দেখাতে নিয়ে যেতেন, বলতেন, কোন ভালো ধর্ম মানুষের মনকে ছোট করতে পারে না।
কোন দেবী প্রথম হবে আমরা সবাই আলাদা করে ভো দিতাম! আহা! “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম”!
ময়মনসিংহে অবস্থাটা অনেকটা তেমনই আছে বুঝলাম, ক’বছর আগে রওশন ঝুনুর সাথে সেখানে পুজো দেখতে যাওয়ার পর।
আমরা একটার পর একটা ম-প ঘুরছিলাম, এক কিশোর আমাদের সাথে টানা হাঁটছিলো আর ঘ্যানঘ্যান কণ্ঠে বলে যাচ্ছিল, আমরার ম-প সবচাইতে সুন্দর, দয়া কইরা চলেন।
আমরা ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে রাত শেষে কিশোরকে বললাম, তোমার ম-প উলটা দিকে, এইবার বাদ দাও।
সে প্রায় কেঁদে ফেলে, এই অবস্থা হলে আমরা টাটানি ধরা পা নিয়ে অনেক কষ্টে তার ম-পে গিয়ে উত্তেজিত কিশোরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
বললো, আবুল কালাম।
সব ভুলে বললাম, এটা তোমাদের ম-প? তা কী করে...?
আমাদের বিস্ময় দেখে ছেলেটা আমাদের লজ্জায় ফেলে বললো, ক্যান এইটা আমরার ম-প হইবার পারে না??
জম্মের পর থাইকাই তো জানি, এই ম-প আমরার।
বিমূঢ় ছায়া ছায়া যেনবা কুয়াশা আবহে স্তম্ভিত ঘোর কাটিয়ে আমার শৈশবে ছুট দিই, ও, হ্যাঁ, আমরাও তো আমাদের শৈশবে আমাদের এলাকার ম-পকে নিজের ভাবতাম, মাঝে দেশের হাওয়া অনেকটা বদলে যাওয়ায় আমরাও কী বদলে গেছি? নইলে ওই কিশোরের কথায় বিস্মিত হলাম কেন?,
উড়–ক্কু লেখার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেয়ার পর মাথা থেকে ক্লাসিক্যাল ভাবনা বাদ দিই, নিজের অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনা মিশিয়ে কিছু একটা লেখা শুরু করি।
যা হোক একটা পর্যায়ে শেষ হলো। তখন পারভেজ আমাদের পাড়ায় থাকত। রোজার মাসে বেচারার খাওয়ার কষ্ট হলে আশরাফ তাকে আমাদের বাসায় মাসটা থাকতে বলে। উড়–ক্কু যখন শেষ হয়, বই কে করবে? এটা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। পিকনিকে পরিচয় হয় মাওলা ব্রাদার্সের কর্ণধার আহমেদ মাহমুদুল হকের সাথে। সে পা-ুলিপি পড়তে চায়।
পারভেজের সাথে মাহমুদের ভালো সম্পর্ক। পারভেজ প্রেস এবং প্রকাশক-যোগাযোগে বইটার প্রুফ দেখা পর্যন্ত আন্তরিক সাহায্য না করলে উড়ুক্কুর জন্মই হতো না। তাই আমি উড়ুক্কু গল্পকার পারভেজ হোসেনকে উৎসর্গ করেছি।
বই তো বেরোল। সেসময় বইয়ের মূল্য একশো টাকা! অনেক!
মেলায় যাই, বই বিক্রির নাম নেই। আমাদের লেখক বন্ধুরাও তখন বেকার জীবনে ভাসমান। অথবা বইয়ের অত বাজেট নেই। তখন মাওলায় দাঁড়িয়ে দু হাতে অটোগ্রাফ দিতেন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আহমেদ। তার পাশে ম্যাদা মেরে বসে থাকতাম। তিনি বলতে থাকলেন, এই বই আমি পড়েছি নাসরীন, আগুন! এই বই তোমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। মাহমুদের চেহারার ভাষা বুঝতে পারতাম না। মোনাজাত ভাইয়ের কথাগুলো সান্ত¡নার মতো শোনালো, সেই সান্ত¡না অসহ্যবোধ হলে হঠাৎ মোনাজাত ভাই বলেন, নাসরীন এক কপি গেছে!
আমি বেরিয়ে এলাম। এই উপন্যাস আমার দীর্ঘ যাতনা অসহায়ত্বের দলিল। বইমেলার এর করুণ দশা আর সহ্য হচ্ছিল না। আমার চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। ভেবেছি, আর নয়। কোনো পা-ুলিপি দিয়ে প্রকাশককে ক্ষতিগ্রস্ত করার অধিকার আমার নেই।
আমি এরপর লিখে লিখে পা-ুলিপি জমিয়ে রাখব।
পরের বছর বাড়িতে ফোন বেজে উঠল। ফিলিপস প্রাপ্তির খবরে বিস্ময়ে আমার হাত থেকে রিসিভার খসে পড়ল! এর আগে এই পুরস্কার কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, কবি আল মাহমুদ পেয়েছেন।
তারপর কীভাবে নাসরীন জাহান হয়? উপন্যাসের জগতে যাকে কেউ চেনেই না?
এই ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার যখন পাই, তখন আমি বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। আগের বছর কোনায় পড়ে থাকা একটা বইকে মিডিয়া কোথায় নিয়ে যেতে পারে, আমি চারপাশের বদলে যাওয়া বাস্তবতা থেকে অনুভব করতে শুরু করি। তখন বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হতো, আমার ছোটফুপুর খুব স্বপ্ন ছিল, টেলিভিশন খবরে যাতে কোনদিন একবার আমার খবর প্রচারিত হয়। ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার প্রচারের পর রাতের খবরে আমাকে দেখালে রাজনীতি করা ডাকসাইটে ফুপু বাড়ি থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলেন প্রায়।
এরপর উড়ুক্কু নিয়ে প্রাবন্ধিক কবীর চৌধুরী দৈনিক সংবাদে দারুণ এক আলোচনা লেখেন। সেই আলোচনা এত অসাধারণ ছিল, প্রচুর লেখক পাঠক সেই আলোচনা পড়ে উড়ুক্কু কিনেছেন, এসব অনেক শুনেছি।
তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অনুবাদক, সুফিসাধক হারুন উর রশিদ বাংলা একাডেমিতে কর্মরত সরকার আমিনের মাধ্যমে আমার জরুরি খোঁজ লাগালেন।
একাডেমিতে গিয়ে জড়তা নিয়ে আমি তাঁর রুমে গেলাম।
প্রথমে তাঁর বিস্ময়ভরা কন্ঠ, এত অল্প বয়সে জীবনের এত জটিল বাস্তবতা আমি কী করে একটা বইয়ে তুলে আনলাম? উড়–ক্কু লেখার সময় আমার বয়স তিরিশও হয়নি।
পরে বললেন, কাগজপত্র নিয়ে এসে বাংলা একাডেমিতে জয়েন করো।
আমিন দারুণ আনন্দিত! সহকর্মী হিসেবে আমাকেও পাবে ভেবে।
আমার স্বপ্ন ছিল, একাডেমিতে চাকরি করার।
কিন্তু আমি এম,এ ভর্তি হয়েছি, গ্যাপ দিয়ে দিয়ে, কিন্তু আমার অনার্স নেই।
একাডেমির রুলে আমার চাকরি হয়নি বলে হারুন স্যার, এবং আমিনেরও সে কী আফসোস!
সেই আমিনের মন তখনো ভালো ছিল, এখনো তেমনই আছে।
এছাড়াও এই বই পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রফেসর লেখক আনিসুজ্জামানের সাথে আমাদের দীর্ঘ পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়।
তখন উড়ুক্কু নিয়ে একটার পর একটা আলোচনা নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, দৈনিক দেশ, ডেইলি স্টার, কোথায় নয়? পরের বছর সেই একই বইমেলায় আমার অটোগ্রাফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে নানা রকমের পাঠক। তাদের অবিশ্রান্ত উচ্ছ্বাস ধ্বনি শুনে আমার কেবলই মনে হতে থাকে, আমার নাগাল থেকে ফের নানীর না দেয়া আধুলি খসে, যা যেন বেশ কিছু সময়ের জন্য নাগালে পেয়েছিলাম, তা খসে পড়ছে।
মনে হতে থাকে, আমি লেখালেখি করে ধীরে ধীরে কোনো একটা জায়গায় পৌঁছানোর স্বপ্ন অবশ্যই দেখেছি, কিন্তু এ যেন লটারি পাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে! আমি এত জনপ্রিয় কোনোদিন হতে চাইনি, যে অটোগ্রাফ দিতে দিতে আমাকে ক্লান্ত হতে হবে? এসব স্থায়ী নয়, এ চক্র থেকে আমাকে বেরোতে হবে।
হোটেল শেরাটনে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হলো, সেখানে আমি তীব্রভাবে বললাম, অনেকে প্রশ্ন করেছেন, এই প্রাপ্তি আমার লেখার প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিচ্ছে কী না, উত্তরে আমি বলব, অবশ্যই না।
পুরস্কার কখনো লেখকের চেয়ে বড় হতে পারে না। পুরস্কার যে লেখকের দায়িত্ববোধ বাড়ায়, তিনি কখনোই মৌলিক লেখক নন।
নিরপেক্ষভাবে পাওয়া এই পুরস্কার আমাকে সম্মানিত করেছে। তাতে আমি আনন্দিত। লেখার দায় একেবারেই লেখকের ব্যক্তিগত বিষয়।
আমি সবসময় বলি, লেখক টেবিলে একা, আজও আমি তাই বলব, আমি যখন লিখি পাঠকের মুখ, প্রাপ্তি সব ভুলে যাই।
কারণ আমি এখনো মনে করি, উড়ুক্কু প্রথম প্রকাশের সময় জলভরা চোখে যতই আমি ভেবে থাকি, আর বই করব না, একসময় আমি বই করতাম। কারণ এই পুরস্কারের আগে পাঁচটি ভালো প্রকাশনা থেকে আমার বই বেরিয়েছিল।
কোনটাতেই এক আনা পয়সা আমি খরচ করিনি। যে প্রেরণা নিয়ে পর পর পাঁচটি গল্পের বই করেছি, সেই প্রেরণাতেই উপন্যাসও বেরোত।
এত পরিচিতি হতো না।
এবং আমি এটাও মনে করি, লেখকের লেখার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। লিখে সম্মানী পাওয়া লেখকের প্রাপ্য। পুরস্কার লেখকের জীবন যাতনাকে
অনেকটা লাঘব করতে সাহায্য করে।
একটা ভালো পুরস্কার পরিচিতি দিতে পারে, কখনই ভালো লেখার প্রেরণা হতে পারে না।
আমি সে প্রলোভন থেকে বেরিয়ে ফের সিরিয়াস ধারার লেখার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারতাম না।
এখন সেই প্রলোভন থেকে বেরোনোর গল্প বলছি।
উড়ুক্কুর মোহ থেকে পাঠকদের সরাতে এরপর আমি উড়ুক্কুর বিপরীত ধারার মিথ নির্ভর দুটো পলিটিকাল ঘরানার উপন্যাস লিখি। যার বেশিরভাগ অংশ ছিল তৎসম ভাষার। যেসব ঘরানার গল্প এর আগের পাঁচটা গল্পের বইয়ে লিখেছি।
১, চন্দ্রের প্রথম কলা
২, চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার।
পাঠক ছিটকে যায়। তারা সেই ভাষা আর বিষয়ের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে পারেনি।
সেলিনা (কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন) আপা পর্যন্ত রাগ করেছিলেন,এইসব তোমার লিটলম্যাগের সাথে যুক্ত থাকার ফল।
নয়, এসময় কেউ এমন নিরীক্ষার মধ্যে নিজেকে ফেলে? উড়ুক্কুতে কম নিরীক্ষা আছে? কিন্তু সেখানে একটা পারিবারিক স্টোরিও আছে। তুমি এই ধারায় এগোতে পারলে না?
আমি অনুভব করতে থাকি, কারণটা আমি সেলিনা আপাকে বোঝাতে পারব না। ফলে চুপ করে থাকি।
অন্যদিকে পাঠকদের আক্ষেপের তো শেষ ছিল না।
ধীরে ধীরে আমি নিজের মধ্যে ভারসাম্য ফিরে পাই। ওসব বইয়ের প্রথম এডিশন বহু বছর লেগেছে শেষ হতে।
সম্পাদক কবি আবুল হাসনাত, উড়–ক্কুর আগেও একেবারে সংবাদের দরজা খুলে রেখেছিলেন, উড়ুক্কুর পরেও, গল্পের আকার যাই হোক, নো প্রব্লেম। এমনকী চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার প্রথমে দীর্ঘগল্প ছিল, হাসনাত ভাই তা পড়ার গভীর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি জাস্ট পড়তে দিয়েছিলাম। পরদিন তাজ্জব হয়ে দেখি, সংবাদের চার পাতা দখল করে আছে একটা লেখাই। শেষের তলানীতে একটা রিভিউ। এমন স্পেস পাওয়া একজন লেখকের জন্য কতটা দারুণ হতে পারে, কল্পনা করা যায়?
বেশ ক’বছর এমন অবস্থা হওয়ার পরে লক্ষ্য করতে থাকি, ধীরে ধীরে বিভিন্ন শহর থেকে উড়ুক্কুর পাঠকেরা ফিরে আসছে। সাথে চন্দ্রের প্রথম কলা, চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তারেরও আলাদা পাঠক ভালো পাঠক তৈরি হয়েছে।
তবে কোনো কোনো লেখক বা পাঠক, নাসরীন নয় আমাকে উড়ুক্কু বলে ডাকে।
যা হোক, উড়ুক্কু প্রাপ্তির অনবদ্য সারপ্রাইজ ছিল, আমি একবার দার্শনিক, লেখক সরদার ফজলুল করীমকে ক্ষীণকণ্ঠে ফোন দিয়ে বলেছিলাম, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম নাসরীন জাহান, আমি বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। আপনি যদি সামনের সংখ্যার জন্য একটা লেখা... তিনি চুপ করে রইলন, আমি জানতাম, তিনি হুটহাট কাউকে লেখা দেন না। শুনেছিলাম খুব মেজাজিও।
তিনি ‘দেব’ বলে ফোন রেখে দিলেন। পরের সপ্তাহে ‘পরাবাস্তবতার বাস্তবতা’ নামে একটা দীর্ঘ লেখা সেই সংবাদেই ছাপা হলো, যেখানে তিনি তার জেদী সন্তানকে সামাল দিতে কেমন নাস্তানাবুদ হচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী রাগ করে বাড়ি চলে গেছে, এর মধ্যে কীভাবে তিনি উড়ুক্কুর মধ্যে জীবনের আশ্রয় খুঁজছেন, ‘পরাবাস্তবের বাস্তবতা’ শিরোনামের শেষদিকে এমন লিখেছিলেন।
সরদার করিম তাঁর লেখার শেষ টেনেছিলেন এইভাবে,
“ওমর বলে, আপনি আমার কাছে করুণা চাইছেন কেন? আমি জানি আমি অতি নগণ্য, আপনাকে চাওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। আপনি যদি সমাজকেই ভয় পান, তবে আমি রাজি এই পিতৃত্বের দায় নেয়ার জন্য।
একসময় ঘরের ফোনটা বেজে উঠল, আমাকে কেউ সাধারণত পায় না। বর্বর ছেলে ধমক মারে, সে নাই। কখন পাবেন, ঠিক নাই।
কিন্তু আমি ভাগ্যে আমি এখন ঘরে আছি। ফোনে আমিও এক কথার বেশি দুকথা বলতে পারিনে।
আমি রিসিভার তুলে বলি, হ্যালো কে বলছেন?
সম্মানসূচক একটি মেয়েকণ্ঠ ভেসে আসে, স্যার আপনি আমাকে চিনবেন না।
আমি ভাবি, আমার কেনো ছাত্রী হবে হয়তো।
আমি বলি, বলুন কী ব্যাপার?
স্যার, আমার নাম নাসরীন জাহান। আমি একটু লেখালেখি করি,
বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে বলছি,
কথা শেষ করতে না বলি, আপনি তো বিখ্যাত ব্যক্তি-
নাসরীন বলে, না স্যার কী যে বলেন!
তারপর নাসরীন জাহান তার সম্পর্কিত একটি পত্রিকার জন্য লেখার কথা বলেন।
আমি বলি, আমি তো লেখক নই, তবুও আপনি যখন বলছেন, চেষ্টা করব।
আমি নাসরীন জাহানকে তাঁর নাম শুনে বলিনি, আপনার উড়ুক্কুর মধ্যেই এখন আছি।
তবুও তাঁর সঙে কথা শেষ করে ঘটনার চমৎকারিত্বে আমি চমকিত হই! নিজেকে নানা সময়ে বলেছি,জীবন কি?জীবন হচ্ছে মৃত্যু বিস্তারী চমকের এক বিস্তারমান পট।
২৩শে ফেব্রুয়ারী উড়ুক্কুর লেখকের এরূও স্বতঃপ্রবৃত্ত আলাপের মধ্যে সেইগ চমকের একটি সাক্ষাৎ যে ঘটেছিল, তা সত্য।
নাসরীন জাহান
শিল্পী : কাইয়ুম চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
আমি স্মৃতিকথায় নিজের কিছু অনুভব, উপলব্ধিও শেয়ার করে যাচ্ছি। আমি অন্য কারো জীবনী বা স্মধতিকথা একেবারেই অনুসরণ করতে পছন্দ করছি না। আমি মাঝেমধ্যেই সেইসব দিনের সাথে এইসব দিনের মেলবন্ধন ঘটাচ্ছি। আজ আমি উড়ুক্কু লেখার স্মতি নিয়ে লিখব। আগেও লিখেছি, আজ লিখব স্মৃতিকথার অংশ হিসেবে।
এখন হঠাৎ করে পুজোর স্মৃতি ভেতরে ঘাঁই দিয়ে উঠছে। কী জানি কে? কোন কারণ ছাড়াই।
শৈশব কৈশোরে আমরা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে আলাদা করে দেখতাম না। অন্য ধর্মের বন্ধুরা যেমন ঈদে আমাদের বাড়ি আসতো, আমরা তেমনই সপরিবারে সেজেগুঁজে দুর্গোৎসব দেখতে যেতাম। শরতের শুরুতে আমি রুবী ঝর্না হিম হিম এক ঘ্রাণ পেতাম। ঢাকের শব্দে উন্মাতাল হয়ে উঠতো আমাদের স্নায়ুকোষ। একটার পর একটা ম-প ঘুরে কি ঘোরেই না পড়তাম!
রুবীদের বাড়ির ওপাশে মেথরপট্টি।
সন্ধ্যা থেকেই ঢাক বাজতে শুরু করে। সেই শব্দ আমাদের রক্তের মধ্যে এমন কিছু তোলপাড় করত, কী করত, আমরা একজন আরেকজনকে বলার চেষ্টা করতাম, পারতাম না।
তখন সন্ধ্যার পর ওদের বাসায় রাত কাটাতে চলে যেতাম। ঝর্নার বন্ধু সার্কেল নাহার মিতা এদের ঘিরে আবর্তিত। (নাহার আমাদের পাড়ার মেয়ে। পরে তাকে আমার বড় ভাই শিপন বিয়ে করে।) কখনো আমরা একসাথে যেতাম, কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ে। রুবীর আব্বা নাসিরাবাদ স্কুলের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তিনি উদার, গ্রাম থেকে আসা খালাম্মাও দারুণ বুঝতেন আমাদের। অনুরোধ করেটরে ঠিক অনুমতি মিলে যেত।
একবার পুর্ণিমা রাত, রুবী আমি তাদের বাড়ির সামনের ঘাসের সামনে বসে ছটফট করছি। আমাদের এক আত্মীয়ের দোকান থেকে আমরা দস্যু বনহুর নিয়ে আসি। মলাট লাগিয়ে দুজনের পড়া শেষ হলে ফেরত দিই। দুজনের পড়া শেষ।
আজ রাতে দুঃসাহসিক দুটো কাজ করতে হবে।
আগামীকাল বিসর্জন, ফলে মেথরপট্টিতে ঢুকে অবশ্যই পুজো দেখতে হবে। আরেকটা, দীর্ঘ রেললাইন পেরিয়ে মূল শহর গাঙ্গিনার পাড় গিয়ে দস্যু বনহুর পালটে আনতে হবে। রাত বাড়ছে, রেললাইনে আঁধার কুয়াশা ঘুটঘুট করছে। এদিকে আমাদের দুজনের বুকের মধ্যে বাজছে ঘণ্টা, আমরা কিন্তু কেউ কোন প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করতে রাজি নই। রুবী খালুজানকে পটালো, আমাদের বাড়ি রাতে থাকবে বলে। আমি তো রুবীর বাড়ির কথা বলে বাসায় আগেই পটিয়ে এসেছি। আমরা দুজন প্রায়ান্ধকার রেললাইন ধরে দিলাম ছুট। সে কী দীর্ঘ রেললাইন! শীতের রাতে জনসমাগম খুবই কম। এর মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে তালুকদার লাইব্রেরির সামনে গিয়ে হাঁপাতে থাকলে দোকানী চাচা বই দিতে দিতে শাসন করলেন, বললেন, তোমরা দুটো কিশোরী মেয়ে এত রাত করে দস্যু বনহুরের টানে একা একা এত রাতে দোকানে এলে এরপর আর কোনদিন বই দেব না।
যখন ফিরছি, মনে হচ্ছিল, অন্ধকার শীত আমাদের গিলে খাবে।
ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে যখন মেথরপট্টিতে ঢুকব, হঠাৎ চমকে উঠি, টলতে টলতে একজন মাতাল বেরিয়ে আসছে। এর আগে নিজ চোখে মাতাল দেখিনি। আমাদের দেখে, হাত উড়িয়ে বলেন, থামো, বাপরে, কণ্ঠস্বরে সে কী গর্জন! আমাদের আত্মা শুকিয়ে একেবারে এইটুকু হয়ে যায়। শিশুকালে পুকুরে সাঁতার কাটলে বদমাশ ছেলেগুলো কেবলই হাফপ্যান্ট ধরে টান দিত, ওইটুকুন শিশু যোনিতে গুঁতা দিত। জোর লাত্থি দিয়ে আমরা কেবলই পাড়ে উঠে আসতাম।
আম্মা কেবল কীভাবে এদের কাছ থেকে বেঁচে চলতে হবে, তা শিখিয়ে গেছেন।
কিন্তু মাতালের হাত থেকে কীভাবে বাঁচব। তা তো শিখিনি?
সাথে সাথে আমাদের মনে হয়, আমরা তো দুজন আছি, কী? ভাবনা শেষ হওয়ার আগে মাতা দু’হাতে আমাদের আগলে জড়ানো কন্ঠে বলতে থাকেন, সময় খুব খারাপ, এক্ষণ বাড়ি চলে যাও। যাও, এইসময় কোনো মেয়ের বাইরে আসতে হয়? তোমাদেরতো সাহস কম নয়? যাও বলছি?
আমরা ফের ছুট দিই।
একবার পেছন ফিরে দেখি, বাতাসে যেমন কাকতাড়–য়া এদিক ওদিক হেলে, তেমনই ছায়ার মধ্যে তিনি হেলতে হেলতেই দাঁড়িয়ে আছেন।
দূরবর্তী ফের আওয়াজ,যা... ও।
ফিরে আসতে আসতে ভাবছিলাম, মাতালও এত ভালো হয়?
এরপর কীভাবে মানুষ সম্পর্কে, পুরুষ সম্পর্কে আমি কোন সিদ্ধান্তে আসি?
সেইরাতে আর পুজো দেখা হয়নি।
তাতে কী, মেথরপট্টিতে রাত জেগে কম পুজো দেখেছি?
এ ছাড়া প্রতি পুজোয় একদিন আব্বা-আম্মা আমাদের ম-প দেখাতে নিয়ে যেতেন, বলতেন, কোন ভালো ধর্ম মানুষের মনকে ছোট করতে পারে না।
কোন দেবী প্রথম হবে আমরা সবাই আলাদা করে ভো দিতাম! আহা! “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম”!
ময়মনসিংহে অবস্থাটা অনেকটা তেমনই আছে বুঝলাম, ক’বছর আগে রওশন ঝুনুর সাথে সেখানে পুজো দেখতে যাওয়ার পর।
আমরা একটার পর একটা ম-প ঘুরছিলাম, এক কিশোর আমাদের সাথে টানা হাঁটছিলো আর ঘ্যানঘ্যান কণ্ঠে বলে যাচ্ছিল, আমরার ম-প সবচাইতে সুন্দর, দয়া কইরা চলেন।
আমরা ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে রাত শেষে কিশোরকে বললাম, তোমার ম-প উলটা দিকে, এইবার বাদ দাও।
সে প্রায় কেঁদে ফেলে, এই অবস্থা হলে আমরা টাটানি ধরা পা নিয়ে অনেক কষ্টে তার ম-পে গিয়ে উত্তেজিত কিশোরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
বললো, আবুল কালাম।
সব ভুলে বললাম, এটা তোমাদের ম-প? তা কী করে...?
আমাদের বিস্ময় দেখে ছেলেটা আমাদের লজ্জায় ফেলে বললো, ক্যান এইটা আমরার ম-প হইবার পারে না??
জম্মের পর থাইকাই তো জানি, এই ম-প আমরার।
বিমূঢ় ছায়া ছায়া যেনবা কুয়াশা আবহে স্তম্ভিত ঘোর কাটিয়ে আমার শৈশবে ছুট দিই, ও, হ্যাঁ, আমরাও তো আমাদের শৈশবে আমাদের এলাকার ম-পকে নিজের ভাবতাম, মাঝে দেশের হাওয়া অনেকটা বদলে যাওয়ায় আমরাও কী বদলে গেছি? নইলে ওই কিশোরের কথায় বিস্মিত হলাম কেন?,
উড়–ক্কু লেখার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নেয়ার পর মাথা থেকে ক্লাসিক্যাল ভাবনা বাদ দিই, নিজের অভিজ্ঞতার সাথে কল্পনা মিশিয়ে কিছু একটা লেখা শুরু করি।
যা হোক একটা পর্যায়ে শেষ হলো। তখন পারভেজ আমাদের পাড়ায় থাকত। রোজার মাসে বেচারার খাওয়ার কষ্ট হলে আশরাফ তাকে আমাদের বাসায় মাসটা থাকতে বলে। উড়–ক্কু যখন শেষ হয়, বই কে করবে? এটা নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। পিকনিকে পরিচয় হয় মাওলা ব্রাদার্সের কর্ণধার আহমেদ মাহমুদুল হকের সাথে। সে পা-ুলিপি পড়তে চায়।
পারভেজের সাথে মাহমুদের ভালো সম্পর্ক। পারভেজ প্রেস এবং প্রকাশক-যোগাযোগে বইটার প্রুফ দেখা পর্যন্ত আন্তরিক সাহায্য না করলে উড়ুক্কুর জন্মই হতো না। তাই আমি উড়ুক্কু গল্পকার পারভেজ হোসেনকে উৎসর্গ করেছি।
বই তো বেরোল। সেসময় বইয়ের মূল্য একশো টাকা! অনেক!
মেলায় যাই, বই বিক্রির নাম নেই। আমাদের লেখক বন্ধুরাও তখন বেকার জীবনে ভাসমান। অথবা বইয়ের অত বাজেট নেই। তখন মাওলায় দাঁড়িয়ে দু হাতে অটোগ্রাফ দিতেন সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন আহমেদ। তার পাশে ম্যাদা মেরে বসে থাকতাম। তিনি বলতে থাকলেন, এই বই আমি পড়েছি নাসরীন, আগুন! এই বই তোমাকে অনেক দূর নিয়ে যাবে। মাহমুদের চেহারার ভাষা বুঝতে পারতাম না। মোনাজাত ভাইয়ের কথাগুলো সান্ত¡নার মতো শোনালো, সেই সান্ত¡না অসহ্যবোধ হলে হঠাৎ মোনাজাত ভাই বলেন, নাসরীন এক কপি গেছে!
আমি বেরিয়ে এলাম। এই উপন্যাস আমার দীর্ঘ যাতনা অসহায়ত্বের দলিল। বইমেলার এর করুণ দশা আর সহ্য হচ্ছিল না। আমার চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল। ভেবেছি, আর নয়। কোনো পা-ুলিপি দিয়ে প্রকাশককে ক্ষতিগ্রস্ত করার অধিকার আমার নেই।
আমি এরপর লিখে লিখে পা-ুলিপি জমিয়ে রাখব।
পরের বছর বাড়িতে ফোন বেজে উঠল। ফিলিপস প্রাপ্তির খবরে বিস্ময়ে আমার হাত থেকে রিসিভার খসে পড়ল! এর আগে এই পুরস্কার কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, সেলিনা হোসেন, কবি আল মাহমুদ পেয়েছেন।
তারপর কীভাবে নাসরীন জাহান হয়? উপন্যাসের জগতে যাকে কেউ চেনেই না?
এই ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার যখন পাই, তখন আমি বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলাম। আগের বছর কোনায় পড়ে থাকা একটা বইকে মিডিয়া কোথায় নিয়ে যেতে পারে, আমি চারপাশের বদলে যাওয়া বাস্তবতা থেকে অনুভব করতে শুরু করি। তখন বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরু হতো, আমার ছোটফুপুর খুব স্বপ্ন ছিল, টেলিভিশন খবরে যাতে কোনদিন একবার আমার খবর প্রচারিত হয়। ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার প্রচারের পর রাতের খবরে আমাকে দেখালে রাজনীতি করা ডাকসাইটে ফুপু বাড়ি থেকে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলছিলেন প্রায়।
এরপর উড়ুক্কু নিয়ে প্রাবন্ধিক কবীর চৌধুরী দৈনিক সংবাদে দারুণ এক আলোচনা লেখেন। সেই আলোচনা এত অসাধারণ ছিল, প্রচুর লেখক পাঠক সেই আলোচনা পড়ে উড়ুক্কু কিনেছেন, এসব অনেক শুনেছি।
তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অনুবাদক, সুফিসাধক হারুন উর রশিদ বাংলা একাডেমিতে কর্মরত সরকার আমিনের মাধ্যমে আমার জরুরি খোঁজ লাগালেন।
একাডেমিতে গিয়ে জড়তা নিয়ে আমি তাঁর রুমে গেলাম।
প্রথমে তাঁর বিস্ময়ভরা কন্ঠ, এত অল্প বয়সে জীবনের এত জটিল বাস্তবতা আমি কী করে একটা বইয়ে তুলে আনলাম? উড়–ক্কু লেখার সময় আমার বয়স তিরিশও হয়নি।
পরে বললেন, কাগজপত্র নিয়ে এসে বাংলা একাডেমিতে জয়েন করো।
আমিন দারুণ আনন্দিত! সহকর্মী হিসেবে আমাকেও পাবে ভেবে।
আমার স্বপ্ন ছিল, একাডেমিতে চাকরি করার।
কিন্তু আমি এম,এ ভর্তি হয়েছি, গ্যাপ দিয়ে দিয়ে, কিন্তু আমার অনার্স নেই।
একাডেমির রুলে আমার চাকরি হয়নি বলে হারুন স্যার, এবং আমিনেরও সে কী আফসোস!
সেই আমিনের মন তখনো ভালো ছিল, এখনো তেমনই আছে।
এছাড়াও এই বই পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রফেসর লেখক আনিসুজ্জামানের সাথে আমাদের দীর্ঘ পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়।
তখন উড়ুক্কু নিয়ে একটার পর একটা আলোচনা নানা পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। জনকণ্ঠ, ইত্তেফাক, দৈনিক দেশ, ডেইলি স্টার, কোথায় নয়? পরের বছর সেই একই বইমেলায় আমার অটোগ্রাফের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে নানা রকমের পাঠক। তাদের অবিশ্রান্ত উচ্ছ্বাস ধ্বনি শুনে আমার কেবলই মনে হতে থাকে, আমার নাগাল থেকে ফের নানীর না দেয়া আধুলি খসে, যা যেন বেশ কিছু সময়ের জন্য নাগালে পেয়েছিলাম, তা খসে পড়ছে।
মনে হতে থাকে, আমি লেখালেখি করে ধীরে ধীরে কোনো একটা জায়গায় পৌঁছানোর স্বপ্ন অবশ্যই দেখেছি, কিন্তু এ যেন লটারি পাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে! আমি এত জনপ্রিয় কোনোদিন হতে চাইনি, যে অটোগ্রাফ দিতে দিতে আমাকে ক্লান্ত হতে হবে? এসব স্থায়ী নয়, এ চক্র থেকে আমাকে বেরোতে হবে।
হোটেল শেরাটনে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হলো, সেখানে আমি তীব্রভাবে বললাম, অনেকে প্রশ্ন করেছেন, এই প্রাপ্তি আমার লেখার প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়িয়ে দিচ্ছে কী না, উত্তরে আমি বলব, অবশ্যই না।
পুরস্কার কখনো লেখকের চেয়ে বড় হতে পারে না। পুরস্কার যে লেখকের দায়িত্ববোধ বাড়ায়, তিনি কখনোই মৌলিক লেখক নন।
নিরপেক্ষভাবে পাওয়া এই পুরস্কার আমাকে সম্মানিত করেছে। তাতে আমি আনন্দিত। লেখার দায় একেবারেই লেখকের ব্যক্তিগত বিষয়।
আমি সবসময় বলি, লেখক টেবিলে একা, আজও আমি তাই বলব, আমি যখন লিখি পাঠকের মুখ, প্রাপ্তি সব ভুলে যাই।
কারণ আমি এখনো মনে করি, উড়ুক্কু প্রথম প্রকাশের সময় জলভরা চোখে যতই আমি ভেবে থাকি, আর বই করব না, একসময় আমি বই করতাম। কারণ এই পুরস্কারের আগে পাঁচটি ভালো প্রকাশনা থেকে আমার বই বেরিয়েছিল।
কোনটাতেই এক আনা পয়সা আমি খরচ করিনি। যে প্রেরণা নিয়ে পর পর পাঁচটি গল্পের বই করেছি, সেই প্রেরণাতেই উপন্যাসও বেরোত।
এত পরিচিতি হতো না।
এবং আমি এটাও মনে করি, লেখকের লেখার মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। লিখে সম্মানী পাওয়া লেখকের প্রাপ্য। পুরস্কার লেখকের জীবন যাতনাকে
অনেকটা লাঘব করতে সাহায্য করে।
একটা ভালো পুরস্কার পরিচিতি দিতে পারে, কখনই ভালো লেখার প্রেরণা হতে পারে না।
আমি সে প্রলোভন থেকে বেরিয়ে ফের সিরিয়াস ধারার লেখার সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারতাম না।
এখন সেই প্রলোভন থেকে বেরোনোর গল্প বলছি।
উড়ুক্কুর মোহ থেকে পাঠকদের সরাতে এরপর আমি উড়ুক্কুর বিপরীত ধারার মিথ নির্ভর দুটো পলিটিকাল ঘরানার উপন্যাস লিখি। যার বেশিরভাগ অংশ ছিল তৎসম ভাষার। যেসব ঘরানার গল্প এর আগের পাঁচটা গল্পের বইয়ে লিখেছি।
১, চন্দ্রের প্রথম কলা
২, চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার।
পাঠক ছিটকে যায়। তারা সেই ভাষা আর বিষয়ের সাথে নিজেদের যুক্ত করতে পারেনি।
সেলিনা (কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন) আপা পর্যন্ত রাগ করেছিলেন,এইসব তোমার লিটলম্যাগের সাথে যুক্ত থাকার ফল।
নয়, এসময় কেউ এমন নিরীক্ষার মধ্যে নিজেকে ফেলে? উড়ুক্কুতে কম নিরীক্ষা আছে? কিন্তু সেখানে একটা পারিবারিক স্টোরিও আছে। তুমি এই ধারায় এগোতে পারলে না?
আমি অনুভব করতে থাকি, কারণটা আমি সেলিনা আপাকে বোঝাতে পারব না। ফলে চুপ করে থাকি।
অন্যদিকে পাঠকদের আক্ষেপের তো শেষ ছিল না।
ধীরে ধীরে আমি নিজের মধ্যে ভারসাম্য ফিরে পাই। ওসব বইয়ের প্রথম এডিশন বহু বছর লেগেছে শেষ হতে।
সম্পাদক কবি আবুল হাসনাত, উড়–ক্কুর আগেও একেবারে সংবাদের দরজা খুলে রেখেছিলেন, উড়ুক্কুর পরেও, গল্পের আকার যাই হোক, নো প্রব্লেম। এমনকী চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তার প্রথমে দীর্ঘগল্প ছিল, হাসনাত ভাই তা পড়ার গভীর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমি জাস্ট পড়তে দিয়েছিলাম। পরদিন তাজ্জব হয়ে দেখি, সংবাদের চার পাতা দখল করে আছে একটা লেখাই। শেষের তলানীতে একটা রিভিউ। এমন স্পেস পাওয়া একজন লেখকের জন্য কতটা দারুণ হতে পারে, কল্পনা করা যায়?
বেশ ক’বছর এমন অবস্থা হওয়ার পরে লক্ষ্য করতে থাকি, ধীরে ধীরে বিভিন্ন শহর থেকে উড়ুক্কুর পাঠকেরা ফিরে আসছে। সাথে চন্দ্রের প্রথম কলা, চন্দ্রলেখার জাদুবিস্তারেরও আলাদা পাঠক ভালো পাঠক তৈরি হয়েছে।
তবে কোনো কোনো লেখক বা পাঠক, নাসরীন নয় আমাকে উড়ুক্কু বলে ডাকে।
যা হোক, উড়ুক্কু প্রাপ্তির অনবদ্য সারপ্রাইজ ছিল, আমি একবার দার্শনিক, লেখক সরদার ফজলুল করীমকে ক্ষীণকণ্ঠে ফোন দিয়ে বলেছিলাম, আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার নাম নাসরীন জাহান, আমি বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। আপনি যদি সামনের সংখ্যার জন্য একটা লেখা... তিনি চুপ করে রইলন, আমি জানতাম, তিনি হুটহাট কাউকে লেখা দেন না। শুনেছিলাম খুব মেজাজিও।
তিনি ‘দেব’ বলে ফোন রেখে দিলেন। পরের সপ্তাহে ‘পরাবাস্তবতার বাস্তবতা’ নামে একটা দীর্ঘ লেখা সেই সংবাদেই ছাপা হলো, যেখানে তিনি তার জেদী সন্তানকে সামাল দিতে কেমন নাস্তানাবুদ হচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী রাগ করে বাড়ি চলে গেছে, এর মধ্যে কীভাবে তিনি উড়ুক্কুর মধ্যে জীবনের আশ্রয় খুঁজছেন, ‘পরাবাস্তবের বাস্তবতা’ শিরোনামের শেষদিকে এমন লিখেছিলেন।
সরদার করিম তাঁর লেখার শেষ টেনেছিলেন এইভাবে,
“ওমর বলে, আপনি আমার কাছে করুণা চাইছেন কেন? আমি জানি আমি অতি নগণ্য, আপনাকে চাওয়ার দুঃসাহস আমার নেই। আপনি যদি সমাজকেই ভয় পান, তবে আমি রাজি এই পিতৃত্বের দায় নেয়ার জন্য।
একসময় ঘরের ফোনটা বেজে উঠল, আমাকে কেউ সাধারণত পায় না। বর্বর ছেলে ধমক মারে, সে নাই। কখন পাবেন, ঠিক নাই।
কিন্তু আমি ভাগ্যে আমি এখন ঘরে আছি। ফোনে আমিও এক কথার বেশি দুকথা বলতে পারিনে।
আমি রিসিভার তুলে বলি, হ্যালো কে বলছেন?
সম্মানসূচক একটি মেয়েকণ্ঠ ভেসে আসে, স্যার আপনি আমাকে চিনবেন না।
আমি ভাবি, আমার কেনো ছাত্রী হবে হয়তো।
আমি বলি, বলুন কী ব্যাপার?
স্যার, আমার নাম নাসরীন জাহান। আমি একটু লেখালেখি করি,
বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে বলছি,
কথা শেষ করতে না বলি, আপনি তো বিখ্যাত ব্যক্তি-
নাসরীন বলে, না স্যার কী যে বলেন!
তারপর নাসরীন জাহান তার সম্পর্কিত একটি পত্রিকার জন্য লেখার কথা বলেন।
আমি বলি, আমি তো লেখক নই, তবুও আপনি যখন বলছেন, চেষ্টা করব।
আমি নাসরীন জাহানকে তাঁর নাম শুনে বলিনি, আপনার উড়ুক্কুর মধ্যেই এখন আছি।
তবুও তাঁর সঙে কথা শেষ করে ঘটনার চমৎকারিত্বে আমি চমকিত হই! নিজেকে নানা সময়ে বলেছি,জীবন কি?জীবন হচ্ছে মৃত্যু বিস্তারী চমকের এক বিস্তারমান পট।
২৩শে ফেব্রুয়ারী উড়ুক্কুর লেখকের এরূও স্বতঃপ্রবৃত্ত আলাপের মধ্যে সেইগ চমকের একটি সাক্ষাৎ যে ঘটেছিল, তা সত্য।