মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি
যাকিয়া সুমি সেতু
জালালউদ্দিন রুমি / জন্ম : ৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭; মৃত্যু : ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন অল্পসংখ্যক ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁরা নিজ সময়ের সীমা ছাড়িয়ে চিরকালীন আলো হয়ে পৃথিবীর আকাশে দীপ্যমান। মাওলানা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ বালখি, যিনি বিশ্বব্যাপীরুমি নামে পরিচিত, তাঁদেরই অন্যতম। নিরবচ্ছিন্নভাবে কবি, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক সাধক ও মানবিক প্রেমের দূত হিসেবে তিনি কেবল পারস্যের সাহিত্যভা-ারকেই সমৃদ্ধ করেননি, বরং তাঁর দর্শন ও ভাবনাগুলো মানব সভ্যতার বহুমাত্রিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার যে অভিন্ন সূত্র, রুমি সেই শাশ্বত ঐক্যের মরমী ব্যাখ্যাকার। তাঁর গভীর কবিতা ও শিক্ষাগুলো এখনও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অনুপ্রেরণা যোগায়, যা প্রেম, দর্শন, সম্প্রীতির অখ-তা ও ঐশ্বরিক জ্ঞানের এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র রুমি সম্পর্কে বলেন : “রুমির কবিতা এক আধ্যাত্মিক সেতু তৈরি করে, যা ধর্ম ও সংস্কৃতির সীমারেখা ভেঙে দিয়ে মানুষকে ঐক্যের পথে আহ্বান জানায়।”
রুমি এক প-িত ও আধ্যাত্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, মধ্যযুগের পারস্য সা¤্রাজ্যের অন্তর্গত খোরাসানের বালখ শহরে। তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন একজন বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ও বিচারক, যিনি “প-িতদের সুলতান” নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি তরুণ রুমির জ্ঞানচর্চা ও আধ্যাত্মিক প্রবণতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। ফলে পিতার গভীর প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিক সাধনা ছোটবেলা থেকেই রুমির মধ্যে চিন্তা ও উপলব্ধির বীজ বপন করে। মাতা মুমিনা খাতুন ছিলেন কোমল হৃদয়ের এক মহিয়সী নারী, যাঁর কোমলতা ও গল্প বলার দক্ষতা এবং সংস্পর্শে রুমির হৃদয়স্পর্শী মানবিকতা বিকশিত হয়।
শৈশবে মঙ্গোল আক্রমণের হুমকির কারণে রুমির পরিবার বালখ ছেড়ে কনিয়া (বর্তমান তুরস্ক) শহরে স্থায়ী হয়। এই অভিবাসন রুমিকে বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও দর্শনের সংস্পর্শে এনেছিল, যা তাঁর জীবনদর্শনকে সর্বজনীন করে তুলেছিল। এর নেপথ্যে কিছু কারণ ছিল। বিশেষ করে রুমির পরিবার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মঙ্গোল আক্রমণের আশঙ্কায় বালখ ছেড়ে যেতে যেতে প্রথমে নিশাপুর, তারপর দামেস্ক ও অবশেষে আনাতোলিয়ার কনিয়ায় স্থায়ী হয়। এই ভ্রমণপথে রুমি বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সাক্ষী হন, যা পরবর্তীতে তাঁর সর্বজনীন মানবিক দর্শনের ভিত্তি রচনা করে।
প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পরিবর্তনশীলতা রুমির আত্মাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। প্রবাহমান নদী, সীমাহীন আকাশ এবং জীবন-মৃত্যুর চক্র তাঁর কবিতার রূপক হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি ঐশ্বরিকের প্রতিচ্ছবি, যা প্রেম, আত্মসমর্পণ ও ঐক্যের পাঠ শেখায়। তবে কেবল প্রকৃতি নয়, মানব সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতাগুলোও তাঁকে রূপান্তরিত করেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ১২৪৪ সালে তাবরিজের শামস নামক এক ভ্রাম্যমাণ দরবেশের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যখন তিনি তাবরিজের শামস নামে এক রহস্যময় সুফি সাধকের সংস্পর্শে আসেন তখন শামসের উপস্থিতি রুমির আত্মিক জগতকে নতুন করে আলোড়িত করে। রুমি ধীরে ধীরে প্রথাগত ধর্মতত্ত্ব থেকে সরে এসে প্রেম, আত্মদর্শন ও ঐশ্বরিক মিলনের মরমী পথে প্রবেশ করেন। শামসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধু শিক্ষক-শিষ্য সম্পর্ক ছিল না, এটি ছিল দুটি আত্মার সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে মিলিত হওয়ার এক ঐশ্বরিক অভিযান।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি ছিলেন এক বিস্ময়কর সাধক ও কবি, যাঁর সাহিত্যিক কীর্তি ভাষার গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপীপ্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁর কবিতা ও গদ্য সাহিত্য মূলত ফারসি ভাষায় রচিত, তবে তাঁর ভাষাগত বৈচিত্র্য কেবল ফারসিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। আরবি, তুর্কি ও গ্রিক ভাষার কিছু প্রভাবও তাঁর রচনায় লক্ষণীয়, যা তাঁর সময়ের বহুভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রতিফলন। তবে রুমি তাঁর প্রধান সাহিত্যকর্মগুলো ফারসি ভাষায় রচনা করেছেন, কারণ তাঁর জন্মস্থান বালখ (বর্তমান আফগানিস্তান) ও বসবাসের প্রধান কেন্দ্র কোন্যা (বর্তমান তুরস্ক)- উভয় অঞ্চলেই ফারসি ছিল শিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলের ভাষা।
রুমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা- “মাসনবি-ই-মানবি” (আধ্যাত্মিক উপদেশ ও দার্শনিক কাহিনি) এবং “দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ” (তাঁর গভীর আবেগপ্রবণ সুফি কবিতার সংকলন)- এই দুটি বই ফারসিতে লেখা হয়েছে এবং সুফিবাদের এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে। ফারসি ভাষার সৌন্দর্য, ছন্দ ও অলঙ্কারশাস্ত্র রুমির রচনায় এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। যদিও রুমি মূলত ফারসিতে লিখতেন, তাঁর অনেক চিঠি, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও ধর্মীয় আলোচনা আরবিতে পাওয়া যায়। ইসলামি দর্শন, কোরআন ও হাদিসের গভীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি আরবি ভাষার ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে রুমি তাঁর সুফি শিক্ষার বহু জায়গায় আরবি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, যেমন “ফানা” (নিজেকে বিলীন করা), “বাকা” (ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন), “হক” (চিরসত্য) প্রভৃতি।
রুমির ভাষাগত বৈচিত্র্য তাঁর বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। ফলে ফারসি ভাষায় লিখলেও, আরবির পাশাপাশি, তুর্কি ও গ্রীকের কিছু উপাদান সংযোজন করে তাঁর লেখাকে বহুমাত্রিক করেছেন। কারণ রুমি তৎকালীন আনাতোলিয়া অঞ্চলে বসবাস করতেন, যা ছিল তুর্কি ও গ্রিক ভাষাভাষিদের বাসস্থান। তাঁর ভাষার ওপর এই দুই সংস্কৃতিরও প্রভাব দেখা যায়। রুমির অনেক শিষ্য তুর্কি ভাষাভাষি ছিলেন এবং তিনি নিজেও তুর্কি জানতেন। যদিও তাঁর মূল সাহিত্য ফারসিতে, কিছু কিছু গদ্যে তুর্কি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। এছাড়া গ্রিক দর্শনের প্রতি রুমির গভীর অনুরাগ ছিল। প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও নবপ্লেটোনিজমের চিন্তাধারা তাঁর সুফি দর্শনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। তাই তাঁর রচনায় কিছু গ্রিক শব্দ ও দার্শনিক ধারণা পাওয়া যায়। রুমির রচনা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক কোলম্যান বার্কস বলেন : “রুমির কবিতা মানে আত্মার গভীরতম আনন্দ ও বেদনার ভাষা, যা আমাদের সকলকে একত্র করে।”
রুমি তাঁর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাগুলোকে কবিতায় রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো মাসনবি-ই-মানবি, যা সুফি দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের অন্যতম। এটি ছয় খণ্ডে রচিত, যেখানে আধ্যাত্মিক গল্প, উপমা ও দর্শনের মিশ্রণে এক মহাকাব্যিক মরমী জগত নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হলো দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ, যেখানে শামসের প্রতি তাঁর আত্মিক ভালোবাসা এবং ঈশ্বরমুখিতা একাকার হয়ে উঠেছে। রুমির ভাষায়: “আমি ঈশ্বরের প্রেমে এমনভাবে ডুবে আছি যে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না।”
এই আত্মলীন প্রেমই তাঁকে অনন্য করে তোলে। প্রকৃত অর্থে রুমি প্রেমকে দেখেছেন আত্মার রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসেবে। তাঁর ভাষায়: “প্রেমের মাধ্যমে তেতো মিষ্টি হয়, প্রেমের দ্বারা সীসা সোনায় পরিণত হয়, প্রেম অশুদ্ধকে পরিশুদ্ধ করে এবং মৃতকে জীবন্ত করে তোলে।” সেজন্যই রুমির প্রেম কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়; এটি সর্বজনীন, যেখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে কোনো বিভাজন নেই। এ প্রসঙ্গে জার্মান ইসলাম বিশেষজ্ঞ আন্নে ম্যারি শিমেল বলেন : “রুমি এমনভাবে প্রেমের ভাষা রচনা করেছেন, যা কোনো বিশেষ ধর্ম বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মানবতার সার্বজনীন ভাষা।”
রুমির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার হলো সামা, বা ঘূর্ণায়মান দরবেশদের নৃত্য। এটি এক ধরনের ধ্যান, যেখানে নৃত্যের মাধ্যমে আত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দ উদযাপন করে। রুমি নিজেই এই নৃত্যের পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেহের ঘূর্ণন এবং হৃদয়ের স্থিরতা ঈশ্বরের মহাজাগতিক সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। রুমি লিখেছিলেন: “এসো, এসো, তুমি যেই হও না কেন। ভ্রমণকারী, উপাসক, বিদ্রোহী- তোমার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা। হাজারবারও যদি তুমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করো, তবু এসো, এসো আবার।”
আধুনিককালে রুমি পশ্চিমা বিশ্বেরও অন্যতম জনপ্রিয় কবি। যুদ্ধ, বিভক্তি ও আত্মিক শূন্যতার যুগে তাঁর প্রেম, ঐক্য ও রূপান্তরের বার্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে সার্বজনীন বন্ধনের আহ্বান জানানো তাঁর শিক্ষা বৈশ্বিক সম্প্রীতির অন্যতম ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর স্থিতপ্রাজ্ঞ জ্ঞান, নির্মোহ দর্শন ঐশ্বরিক প্রেমে, সংহতিবাদে চিরন্তন হয়ে আছে। ফলে রুমি প্রেমকে সৃষ্টির চূড়ান্ত সত্য ও আত্মার মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে দেখেছেন। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে ঐক্যের বোধই রুমির মূল বার্তা। অহংবোধ ত্যাগ করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার হাতে সমর্পণ করা রুমির অন্যতম শিক্ষা: আত্মা সবসময় ঈশ্বরের কাছে ফেরার জন্য এক অন্তহীন যাত্রায় থাকে- এই ভাবনা তাঁর প্রতিটি লেখায় স্পষ্ট।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি একইসাথে কবি, আধ্যাত্মিক সাধক ও মানবিক প্রেমের দূত। তাঁর কবিতা ও দর্শন কেবল পারস্যের মাটি নয়, সমগ্রপৃথিবীর আত্মাকে স্পর্শ করেছে। তাঁর প্রতিটি শব্দ আমাদের আত্মার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা আলোকে জাগিয়ে তোলে। পাওলো কোয়েলহোর ভাষায়:
“রুমি সেই বিরল কবি, যিনি প্রতিটি স্তরকে আত্মার গভীরে অনুভব করেছেন এবং শব্দের মাধ্যমে সেই অনুভূতিকে উন্মোচন করেছেন।”
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি
যাকিয়া সুমি সেতু
জালালউদ্দিন রুমি / জন্ম : ৩০ সেপ্টেম্বর ১২০৭; মৃত্যু : ১৭ ডিসেম্বর ১২৭৩
বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ ২০২৫
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন অল্পসংখ্যক ব্যক্তিত্ব আছেন, যাঁরা নিজ সময়ের সীমা ছাড়িয়ে চিরকালীন আলো হয়ে পৃথিবীর আকাশে দীপ্যমান। মাওলানা জালালউদ্দিন মুহাম্মদ বালখি, যিনি বিশ্বব্যাপীরুমি নামে পরিচিত, তাঁদেরই অন্যতম। নিরবচ্ছিন্নভাবে কবি, দার্শনিক, আধ্যাত্মিক সাধক ও মানবিক প্রেমের দূত হিসেবে তিনি কেবল পারস্যের সাহিত্যভা-ারকেই সমৃদ্ধ করেননি, বরং তাঁর দর্শন ও ভাবনাগুলো মানব সভ্যতার বহুমাত্রিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। আধ্যাত্মিকতা ও মানবিকতার যে অভিন্ন সূত্র, রুমি সেই শাশ্বত ঐক্যের মরমী ব্যাখ্যাকার। তাঁর গভীর কবিতা ও শিক্ষাগুলো এখনও বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে অনুপ্রেরণা যোগায়, যা প্রেম, দর্শন, সম্প্রীতির অখ-তা ও ঐশ্বরিক জ্ঞানের এক প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র রুমি সম্পর্কে বলেন : “রুমির কবিতা এক আধ্যাত্মিক সেতু তৈরি করে, যা ধর্ম ও সংস্কৃতির সীমারেখা ভেঙে দিয়ে মানুষকে ঐক্যের পথে আহ্বান জানায়।”
রুমি এক প-িত ও আধ্যাত্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১২০৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর, মধ্যযুগের পারস্য সা¤্রাজ্যের অন্তর্গত খোরাসানের বালখ শহরে। তাঁর পিতা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদ ছিলেন একজন বিখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক ও বিচারক, যিনি “প-িতদের সুলতান” নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি তরুণ রুমির জ্ঞানচর্চা ও আধ্যাত্মিক প্রবণতাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। ফলে পিতার গভীর প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিক সাধনা ছোটবেলা থেকেই রুমির মধ্যে চিন্তা ও উপলব্ধির বীজ বপন করে। মাতা মুমিনা খাতুন ছিলেন কোমল হৃদয়ের এক মহিয়সী নারী, যাঁর কোমলতা ও গল্প বলার দক্ষতা এবং সংস্পর্শে রুমির হৃদয়স্পর্শী মানবিকতা বিকশিত হয়।
শৈশবে মঙ্গোল আক্রমণের হুমকির কারণে রুমির পরিবার বালখ ছেড়ে কনিয়া (বর্তমান তুরস্ক) শহরে স্থায়ী হয়। এই অভিবাসন রুমিকে বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও দর্শনের সংস্পর্শে এনেছিল, যা তাঁর জীবনদর্শনকে সর্বজনীন করে তুলেছিল। এর নেপথ্যে কিছু কারণ ছিল। বিশেষ করে রুমির পরিবার রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মঙ্গোল আক্রমণের আশঙ্কায় বালখ ছেড়ে যেতে যেতে প্রথমে নিশাপুর, তারপর দামেস্ক ও অবশেষে আনাতোলিয়ার কনিয়ায় স্থায়ী হয়। এই ভ্রমণপথে রুমি বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সাক্ষী হন, যা পরবর্তীতে তাঁর সর্বজনীন মানবিক দর্শনের ভিত্তি রচনা করে।
প্রকৃতির সৌন্দর্য ও পরিবর্তনশীলতা রুমির আত্মাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। প্রবাহমান নদী, সীমাহীন আকাশ এবং জীবন-মৃত্যুর চক্র তাঁর কবিতার রূপক হয়ে উঠেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি ঐশ্বরিকের প্রতিচ্ছবি, যা প্রেম, আত্মসমর্পণ ও ঐক্যের পাঠ শেখায়। তবে কেবল প্রকৃতি নয়, মানব সম্পর্ক ও অভিজ্ঞতাগুলোও তাঁকে রূপান্তরিত করেছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ১২৪৪ সালে তাবরিজের শামস নামক এক ভ্রাম্যমাণ দরবেশের সঙ্গে সাক্ষাৎ তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। যখন তিনি তাবরিজের শামস নামে এক রহস্যময় সুফি সাধকের সংস্পর্শে আসেন তখন শামসের উপস্থিতি রুমির আত্মিক জগতকে নতুন করে আলোড়িত করে। রুমি ধীরে ধীরে প্রথাগত ধর্মতত্ত্ব থেকে সরে এসে প্রেম, আত্মদর্শন ও ঐশ্বরিক মিলনের মরমী পথে প্রবেশ করেন। শামসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধু শিক্ষক-শিষ্য সম্পর্ক ছিল না, এটি ছিল দুটি আত্মার সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে মিলিত হওয়ার এক ঐশ্বরিক অভিযান।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি ছিলেন এক বিস্ময়কর সাধক ও কবি, যাঁর সাহিত্যিক কীর্তি ভাষার গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বব্যাপীপ্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁর কবিতা ও গদ্য সাহিত্য মূলত ফারসি ভাষায় রচিত, তবে তাঁর ভাষাগত বৈচিত্র্য কেবল ফারসিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। আরবি, তুর্কি ও গ্রিক ভাষার কিছু প্রভাবও তাঁর রচনায় লক্ষণীয়, যা তাঁর সময়ের বহুভাষিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রতিফলন। তবে রুমি তাঁর প্রধান সাহিত্যকর্মগুলো ফারসি ভাষায় রচনা করেছেন, কারণ তাঁর জন্মস্থান বালখ (বর্তমান আফগানিস্তান) ও বসবাসের প্রধান কেন্দ্র কোন্যা (বর্তমান তুরস্ক)- উভয় অঞ্চলেই ফারসি ছিল শিক্ষিত ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলের ভাষা।
রুমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা- “মাসনবি-ই-মানবি” (আধ্যাত্মিক উপদেশ ও দার্শনিক কাহিনি) এবং “দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ” (তাঁর গভীর আবেগপ্রবণ সুফি কবিতার সংকলন)- এই দুটি বই ফারসিতে লেখা হয়েছে এবং সুফিবাদের এক অনন্য দলিল হয়ে উঠেছে। ফারসি ভাষার সৌন্দর্য, ছন্দ ও অলঙ্কারশাস্ত্র রুমির রচনায় এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। যদিও রুমি মূলত ফারসিতে লিখতেন, তাঁর অনেক চিঠি, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য ও ধর্মীয় আলোচনা আরবিতে পাওয়া যায়। ইসলামি দর্শন, কোরআন ও হাদিসের গভীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি আরবি ভাষার ব্যবহার করেছেন। বিশেষ করে রুমি তাঁর সুফি শিক্ষার বহু জায়গায় আরবি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন, যেমন “ফানা” (নিজেকে বিলীন করা), “বাকা” (ঈশ্বরের সঙ্গে মিলন), “হক” (চিরসত্য) প্রভৃতি।
রুমির ভাষাগত বৈচিত্র্য তাঁর বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। ফলে ফারসি ভাষায় লিখলেও, আরবির পাশাপাশি, তুর্কি ও গ্রীকের কিছু উপাদান সংযোজন করে তাঁর লেখাকে বহুমাত্রিক করেছেন। কারণ রুমি তৎকালীন আনাতোলিয়া অঞ্চলে বসবাস করতেন, যা ছিল তুর্কি ও গ্রিক ভাষাভাষিদের বাসস্থান। তাঁর ভাষার ওপর এই দুই সংস্কৃতিরও প্রভাব দেখা যায়। রুমির অনেক শিষ্য তুর্কি ভাষাভাষি ছিলেন এবং তিনি নিজেও তুর্কি জানতেন। যদিও তাঁর মূল সাহিত্য ফারসিতে, কিছু কিছু গদ্যে তুর্কি শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। এছাড়া গ্রিক দর্শনের প্রতি রুমির গভীর অনুরাগ ছিল। প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও নবপ্লেটোনিজমের চিন্তাধারা তাঁর সুফি দর্শনের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছিল। তাই তাঁর রচনায় কিছু গ্রিক শব্দ ও দার্শনিক ধারণা পাওয়া যায়। রুমির রচনা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক কোলম্যান বার্কস বলেন : “রুমির কবিতা মানে আত্মার গভীরতম আনন্দ ও বেদনার ভাষা, যা আমাদের সকলকে একত্র করে।”
রুমি তাঁর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাগুলোকে কবিতায় রূপ দিয়েছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ হলো মাসনবি-ই-মানবি, যা সুফি দর্শনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের অন্যতম। এটি ছয় খণ্ডে রচিত, যেখানে আধ্যাত্মিক গল্প, উপমা ও দর্শনের মিশ্রণে এক মহাকাব্যিক মরমী জগত নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা হলো দিওয়ান-ই-শামস-ই-তাবরিজ, যেখানে শামসের প্রতি তাঁর আত্মিক ভালোবাসা এবং ঈশ্বরমুখিতা একাকার হয়ে উঠেছে। রুমির ভাষায়: “আমি ঈশ্বরের প্রেমে এমনভাবে ডুবে আছি যে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না।”
এই আত্মলীন প্রেমই তাঁকে অনন্য করে তোলে। প্রকৃত অর্থে রুমি প্রেমকে দেখেছেন আত্মার রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসেবে। তাঁর ভাষায়: “প্রেমের মাধ্যমে তেতো মিষ্টি হয়, প্রেমের দ্বারা সীসা সোনায় পরিণত হয়, প্রেম অশুদ্ধকে পরিশুদ্ধ করে এবং মৃতকে জীবন্ত করে তোলে।” সেজন্যই রুমির প্রেম কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়; এটি সর্বজনীন, যেখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে কোনো বিভাজন নেই। এ প্রসঙ্গে জার্মান ইসলাম বিশেষজ্ঞ আন্নে ম্যারি শিমেল বলেন : “রুমি এমনভাবে প্রেমের ভাষা রচনা করেছেন, যা কোনো বিশেষ ধর্ম বা সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মানবতার সার্বজনীন ভাষা।”
রুমির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার হলো সামা, বা ঘূর্ণায়মান দরবেশদের নৃত্য। এটি এক ধরনের ধ্যান, যেখানে নৃত্যের মাধ্যমে আত্মা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দ উদযাপন করে। রুমি নিজেই এই নৃত্যের পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেহের ঘূর্ণন এবং হৃদয়ের স্থিরতা ঈশ্বরের মহাজাগতিক সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়। রুমি লিখেছিলেন: “এসো, এসো, তুমি যেই হও না কেন। ভ্রমণকারী, উপাসক, বিদ্রোহী- তোমার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা। হাজারবারও যদি তুমি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করো, তবু এসো, এসো আবার।”
আধুনিককালে রুমি পশ্চিমা বিশ্বেরও অন্যতম জনপ্রিয় কবি। যুদ্ধ, বিভক্তি ও আত্মিক শূন্যতার যুগে তাঁর প্রেম, ঐক্য ও রূপান্তরের বার্তা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে সার্বজনীন বন্ধনের আহ্বান জানানো তাঁর শিক্ষা বৈশ্বিক সম্প্রীতির অন্যতম ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর স্থিতপ্রাজ্ঞ জ্ঞান, নির্মোহ দর্শন ঐশ্বরিক প্রেমে, সংহতিবাদে চিরন্তন হয়ে আছে। ফলে রুমি প্রেমকে সৃষ্টির চূড়ান্ত সত্য ও আত্মার মুক্তির একমাত্র পথ হিসেবে দেখেছেন। ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে ঐক্যের বোধই রুমির মূল বার্তা। অহংবোধ ত্যাগ করে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার হাতে সমর্পণ করা রুমির অন্যতম শিক্ষা: আত্মা সবসময় ঈশ্বরের কাছে ফেরার জন্য এক অন্তহীন যাত্রায় থাকে- এই ভাবনা তাঁর প্রতিটি লেখায় স্পষ্ট।
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি একইসাথে কবি, আধ্যাত্মিক সাধক ও মানবিক প্রেমের দূত। তাঁর কবিতা ও দর্শন কেবল পারস্যের মাটি নয়, সমগ্রপৃথিবীর আত্মাকে স্পর্শ করেছে। তাঁর প্রতিটি শব্দ আমাদের আত্মার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা আলোকে জাগিয়ে তোলে। পাওলো কোয়েলহোর ভাষায়:
“রুমি সেই বিরল কবি, যিনি প্রতিটি স্তরকে আত্মার গভীরে অনুভব করেছেন এবং শব্দের মাধ্যমে সেই অনুভূতিকে উন্মোচন করেছেন।”