alt

সাময়িকী

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

বেলাল চৌধুরী

: বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বেলাল চৌধুরী / জন্ম: ১২ নভেম্বর ১৯৩৮; মৃত্যু: ২৪ এপ্রিল ২০১৮

বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে কবি বেলাল চৌধুরী অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। আমৃত্যু সাহিত্যমগ্ন এই কবি কবিতা, অনুবাদ, জার্নাল, আত্মজৈবনিক লেখা লিখে পাঠকের মন জয় করেছেন। আজ ২৪ এপ্রিল তাঁর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত হলো তাঁর এই সাক্ষাৎকার। গ্রহণ করেছেন পিয়াস মজিদ

- বেলাল ভাই, দীর্ঘদিন যাবৎ কবিতা লিখলেও আপনার বইপত্র আমাদের হাতে খুব কমই আসে। আমরা আপনার কবিতার বইগুলো সম্পর্কে জানতে চাইব।

- আমার বই এবং বউভাগ্য দুটোই খারাপ। বই কম বেরোয়নি, তবে তেমনভাবে প্রচার পায়নি। প্রথম বই নিষাদ প্রদেশে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। তারপর কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে রেরিয়েছে বেশ কয়েকটি বই। যেমন : বেলাল চৌধুরীর কবিতা, আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গ, স্বপ্নবন্দী, জলবিষুবের পূর্ণিমা, সেলাই করা ছায়া, কবিতার কমলবনে, যাবজ্জীবন পরম উল্লাসে, বত্রিশ নম্বর ইত্যাদি।

- বই কেনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের বইয়ের প্রতি আপনার পক্ষপাত বেশি?

- ঠিক নেই, এ ক্ষেত্রে আমি সর্বভুক। এ নিয়ে কাগজে-কলমে নামে আমার একটি গদ্য আছে।

- অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের বই ক্রয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন কি?

- অবশ্যই, তবে মধ্যবিত্তের বই ক্রয়ের চেয়ে মুখ্য হচ্ছে বই পাঠ। আমি মনে করি, পাঠের আগ্রহ থাকলে না কিনেও বই পড়া যায়। আমার নিজের একটি ঘটনাই বলি। প্রায় তিরিশ বছর পর আমার পরিচিত এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো এক দিন। তার হাতে ছিল পাবলো নেরুদার মেমোয়ার্স বইটি। সে লোক এতটা ঘনিষ্ঠ ছিল না যে, বইটা ধার চাইতে পারি। আরেকটি বিষয় ছিল, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার এক দিন পর তার বিদেশ চলে যাওয়ার কথা। তখন অনেক বলে-কয়ে এক রাতের জন্য বইটি নিলাম এবং সত্যি সত্যি সারা রাত জেগে বিশাল বইটি পড়া শেষ করলাম। যখন মেমোয়ার্স পড়া সমাপ্ত হলো তখন ঢাকার আকাশে আজানের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। অদ্ভুত সে অনুভূতি নিয়ে আমার একটি কবিতাও আছে, নাম ‘আজানময়প্রহর’। সুতরাং বলতে পারি বই পড়ার আগ্রহটিই অনেক কিছু।

- পল্টন, নীলক্ষেত ইত্যাকার ভাসমান বইবাজার থেকে বই কেনেন? এ নিয়ে কোনো স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা থাকলে বলুন।

- প্রচুর। গুরুত্বপূর্ণ কত বই যে এসব জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। অনেক লেখকের নিজ স্বাক্ষর করা বই এসব দোকান থেকে সংগ্রহ করে আমি আবার তাদের উপহার দিতে পছন্দ করি। এ নিয়ে কলকাতার একটি ঘটনা বলতে পারি। কফি হাউসে বসে আছি। নিসারুল বলে আমাদের এক পরিচিতজন এসে বলল, কোনো পুরনো বইয়ের দোকানে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা একটি বই পাওয়া গেছে। নিজের সে বই কবি তার এক বউদিকে উপহার দিয়েছিলেন। তারপর চারদিকে হই-চই পড়ে গেল। ছবি তোলা, পত্রিকায় খবর বেরুল ইত্যাদি কত কী! আমি পল্টন থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত একটি প্রেমের কবিতার সংকলন কিনি, যেটি সুফিয়া খালা বলে কাউকে (হয়তো কবি সুফিয়া কামাল) দেয়া হয়েছিল। ওই কবিতা সংকলনটির কিছু ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, যা নিয়ে বন্ধু কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ একটি লেখাও লিখে ফেলেছিলেন। মান্নান বইটির খোঁজ পাওয়ার পরই আমার কাছ থেকে কপি করে নিয়েছিলেন।

- আপনার এত বই! এর মধ্যে উপহার পাওয়া বেশি না নিজের টাকায় কেনা বেশি?

- উভয়ই। উপহার হিসেবে যেমন অজস্র বই পাই, তেমনি কিনিও কম না। বস্তুত বই ও আমি সমার্থক প্রায়। মরুভূমিতে বসিয়ে দিলেও মনে হয় আমি বই পড়ব। কারণ ছোটবেলা থেকে বইয়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তবে দুঃখের বিষয়, আমার জীবনের নানা পর্বের অনেক দুর্লভ সংগ্রহ-ই হারিয়েছি বিভিন্নভাবে। বাসা বদল, স্থান বদলে যেমন বহু বই নষ্ট হয়েছে, তেমনি অনেকে বই নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কলকাতা জীবনের পুরো বইয়ের সংগ্রহও আর আমার কাছে নেই।

- বই নিয়ে আপনার কোনো মজার স্মৃতি...

- একবার আমেরিকাতে মেয়ের জন্য রবীন্দ্র রচনাবলির পুরো সেট নিয়ে যাচ্ছিলাম। একজনের পরামর্শে সেটা মুড়িয়ে সঙ্গে নিলাম। জানতাম, আটলান্টায় চেকিং হয়। যদি আটকায় তবে বইগুলো চিরতরে খোয়া যাবে। লাগেজের মধ্যে বইয়ের সেটটা দিলাম। চেকিংয়ের এক কর্মকর্তা (যমদূতের মতো বিশালদেহী নিগ্রো) এসে আমাকে জিজ্ঞেস কলল, আপনি কি ব্যবসায়ী? আমি বললাম, ‘আমি একজন লেখক।’ সে জানতে চাইল, এগুলো সব আমার বই কি না? আমি ঝামেলা এড়াতে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ বিস্মিত হয়ে সে তার সহকর্মী এক মেয়েকে ডেকে এনে বলতে লাগল, ‘এই যে একজন লেখক। এই সব বই তার লেখা!’

- বইয়ের সঙ্গে এই যে আপনার বেড়ে ওঠা-এর প্রস্তুতিপর্বটা কেমন ছিল?

- প্রকৃতপক্ষে কুমিল্লাতে বইয়ের ব্যাপারে আমার চক্ষু উন্মীলন ঘটে। কুমিল্লা শহরে তখন বেশ কয়েকটি পাঠাগার ছিল। যেমন : বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, অমূল্য স্মৃতি পাঠাগার, জাগরণী সংঘ, জামতলার পড়ার ঘর। মনে আছে, ছোটবেলায় আমার কাজ ছিল বৃষ্টি মাথায় করে কুমিল্লার প্রত্যেক পাঠাগার থেকে একেকটি বই নিয়ে সন্ধ্যায় জ্যামিতি-বইয়ের নিচে লুকিয়ে এসব পড়া। নীহাররঞ্জনের কীরিটি সিরিজের মতো এমন কত বই যে এভাবে শেষ হয়েছে তার লেখাজোখা নেই।

- সবসময় হাতের কাছে রাখেন, প্রায় প্রতিদিন উল্টেপাল্টে দেখেন এমন বইয়ের তালিকায় আছে কোনগুলো?

- অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের নানা বই। তা ছাড়াও আরও অনেক বই-ই তালিকায় যুক্ত হবে।

- কী কী লেখার পরিকল্পনা আছে আপনার?

- আমি লেখায় ঠিক মনোযোগ দিতে পারছি না। অলিখিত লেখার পরিকল্পনা মাথায় ঘোরে। কিন্তু নানা কাজে-অকাজে সেসব লেখা হয়ে ওঠে না। এই তো পাবলো নেরুদার একটি জীবনীমূলক বই হন্যে হয়ে খুঁজেছি। এখনো পাইনি। ইচ্ছে আছে, হাতে পেলে সে বইটি অনুবাদ করব। তেমনি কাফকা, লোরকার মতো আমার প্রিয় লেখকদের আমেরিকার জীবন নিয়ে কিছু অন্য ধাঁচের লেখা তৈরি করব।

- কবিতার পাশাপাশি আপনার উপন্যাস স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল-এর সঙ্গে আমরা পরিচিত। কবিদের রচিত কথাসাহিত্যের মধ্যে আপনার দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ কী কী?

- শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস কুয়োতলাঅসাধারণ। তাছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো আছেনই।

- আমাদের এখানে সৃজনশীল গদ্যের যে নিদারুণ অভাব তার মূল কারণ কী?

- পড়াশোনা ও চর্চার অভাব, পরিশ্রমের ঘাটতি অবশ্যই এর একটি প্রধান কারণ।

- কবিতা, গদ্যচর্চা ছাড়াও আপনার অনুবাদ চর্চা সম্পর্কেও আমরা অবিদিত নই। গার্সিয়া মার্কেসের মৃত্যুর কড়ানড়া, জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্পইত্যাদির অনুবাদক হিসেবেই আমাদের অনুবাদ সাহিত্য সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ শুনতে আগ্রহী?

- আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের মান খুবই খারপ। দু’একটি কাজ ছাড়া অধিকাংশ অনুবাদের মান খুবই হতাশাজনক। নামকরা লেখকদের অনুবাদও আশাব্যঞ্জক নয়। অনুবাদ তো কোনো আক্ষরিক অনুসৃতির ব্যাপার নয়। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, জায়গাজমি এবং আনুষঙ্গিক অনেক জরুরি বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে আমরা ভালো অনুবাদ প্রত্যাশা করতে পারি না।

- সাম্প্রতিক তরুণদের লেখালেখি নিয়ে কি আপনি আশাবাদী?

- তরুদের নিয়ে আমি সবসময় আশাবাদী। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে কিছু সংকট থাকলেও সারা দেশের তরুণরা এখন লেখালেখিতে সক্রিয়। তবে পড়াশোনার অভাব, বইয়ের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কিছুটা প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। তরুণদের জন্য উপযুক্ত সাহিত্যিক পরিবেশ তৈরি করা একটি জরুরি বিষয়।

- কলকাতায় যে সাহিত্যচর্চা কৃত্তিবাস, শতভিষা-কে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আপনি তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা যদি কিছু বলেন...

- কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয় হয়। শক্তিদা ও আমার সম্পর্ক ছিল হরিহর আত্মার মতো। ক্রমে ক্রমে উৎপলকুমার বসু, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে সখ্য আমার জীবন ও সাহিত্যিক গতিপথটাই পাল্টে দিয়েছিল।

- কলকাতাসহ ভারতে আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকে আছেন। তাদের সঙ্গে আড্ডাগুলো এখনো কি মিস করেন? যোগাযোগ আছে তাদের সঙ্গে?

- সেই বন্ধুদের অর্ধেকই এখন আর বেঁচে নেই। তবে যারা আছে তারা যেমন আমাকে মিস করে আমিও তাদের ভীষণ মিস করি। অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত-অনিয়মিত যোগাযোগ হয়।

- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় কখন?

- কলকাতাতে জীবনের ঠিক প্রথমেই নয়। সুনীলদা আমেরিকা থেকে আসার পর তার সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা হয়। গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক।

- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর অর্ধেক জীবন বইয়ে জাপান গিয়ে আপনার কুমির ব্যবসার যে গল্প করেছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ আমাদের।

- সত্যি ঘটনা, জাপান গিয়ে যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাই তখন এক জাপানি আমাকে কুমির ব্যবসার প্রস্তাব দেয়, যদিও তা ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে গল্পও লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা ভালো, আমি জীবনে অনেক ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েই ব্যর্থ হয়েছি। চট্টগ্রাম গিয়ে পেরেকের ব্যবসা, কুমিল্লায় বইয়ের ব্যবসায় নেমেছিলাম। মনে আছে, রাশিয়ান বইয়ের বিশাল সংগ্রহ জোগাড় করে ফেলেছিলাম।

- আপনার বিশেষ বন্ধু, আমাদের প্রিয় কবি বিনয় মজুমদার চলে গেলেন বছর কয়েক আগে। তাঁর বইপত্র ও তাঁর সম্পর্কে জানতে চেয়ে সাক্ষাৎকারটি শেষ করব।

- সে দীর্ঘ কাহিনি। আমি কলকাতা যাওয়ার পর দেখি বিনয় প্রায় মিথ। তখন সে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আছে। কফি হাউসের সূত্রে আমার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে থাকত কলকাতার মেসবাড়িতে, মাঝেমধ্যে যেত ঠাকুরনগরে। ওর বাবা চাকরি করত রেঙ্গুনে। একদিন দেখি বেতের লাঠি নিয়ে বিনয় কফি হাউসে। আনমনে কী যেন বিড়বিড় করেছে। চলে গেলেন কিছুক্ষণ থেকে আবার ফিরেও এলেন উ™£ান্তের মতো চেহারা নিয়ে। শুনলাম, মেসের ঠাকুর তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করায় বেতের লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন বিনয় মজুমদার। সবসময়ই অন্যরকম দেখতাম তাঁকে। এই স্বাভাবিক এই অস্বাভাবিক, মাঝে-মধ্যে সুন্দর সুন্দর কথা বলত আবার কখনো গান গেয়ে উঠত। বিনয়ের কলেজবন্ধু নির্মল মৈত্রর কাছে শুনেছি, শিবপুর কলেজের এক উদ্ভিন্নযৌবনা অধ্যাপক কন্যার ন্তনস্পর্শে বিনয়ের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সেই থেকে ফুল্লরা, ঈশ্বরী, গায়ত্রী-এ রকম কত মেয়েকে নিয়ে যে তার অদ্ভুত সব পাগলামি! ফুল্লরাকে আমি চিনতাম আর গায়ত্রী চক্রবর্তীর একটি ছবি বেরিয়েছিল ১৯৬৭-তে নিউজউইকে। প্রেসিডেন্সির মেধাবী ছাত্রী, পায়ে ঘুঙুর পরত। গায়ত্রী তার লেখালেখিতে দারুণভাবে, গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিনয়ের অনেক ডায়েরির কথা মনে পড়ে। কবিতার লাইন, গান, কত কী লেখা থাকত তাতে। বিনয় ভালো অনুবাদকও ছিল; রাশিয়ান বইয়ের অনুবাদও করেছে সে। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য অঙ্কে হিসাব করত। নিজে পেলে কী করবে তা ঠিক করত। কত স্মৃতি! সব কী মনে পড়ে?

অক্টোবর : ২০০৭

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

ছবি

মেঘনাদবধ, এক নতুন দৃশ্যভাষা

ছবি

নতুন কবিতার সন্ধানে

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

tab

সাময়িকী

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

বেলাল চৌধুরী

বেলাল চৌধুরী / জন্ম: ১২ নভেম্বর ১৯৩৮; মৃত্যু: ২৪ এপ্রিল ২০১৮

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে কবি বেলাল চৌধুরী অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় নাম। আমৃত্যু সাহিত্যমগ্ন এই কবি কবিতা, অনুবাদ, জার্নাল, আত্মজৈবনিক লেখা লিখে পাঠকের মন জয় করেছেন। আজ ২৪ এপ্রিল তাঁর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশিত হলো তাঁর এই সাক্ষাৎকার। গ্রহণ করেছেন পিয়াস মজিদ

- বেলাল ভাই, দীর্ঘদিন যাবৎ কবিতা লিখলেও আপনার বইপত্র আমাদের হাতে খুব কমই আসে। আমরা আপনার কবিতার বইগুলো সম্পর্কে জানতে চাইব।

- আমার বই এবং বউভাগ্য দুটোই খারাপ। বই কম বেরোয়নি, তবে তেমনভাবে প্রচার পায়নি। প্রথম বই নিষাদ প্রদেশে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। তারপর কলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম ইত্যাদি নানা জায়গা থেকে রেরিয়েছে বেশ কয়েকটি বই। যেমন : বেলাল চৌধুরীর কবিতা, আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গ, স্বপ্নবন্দী, জলবিষুবের পূর্ণিমা, সেলাই করা ছায়া, কবিতার কমলবনে, যাবজ্জীবন পরম উল্লাসে, বত্রিশ নম্বর ইত্যাদি।

- বই কেনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের বইয়ের প্রতি আপনার পক্ষপাত বেশি?

- ঠিক নেই, এ ক্ষেত্রে আমি সর্বভুক। এ নিয়ে কাগজে-কলমে নামে আমার একটি গদ্য আছে।

- অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আমাদের দেশের মধ্যবিত্তের বই ক্রয়ের ওপর প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন কি?

- অবশ্যই, তবে মধ্যবিত্তের বই ক্রয়ের চেয়ে মুখ্য হচ্ছে বই পাঠ। আমি মনে করি, পাঠের আগ্রহ থাকলে না কিনেও বই পড়া যায়। আমার নিজের একটি ঘটনাই বলি। প্রায় তিরিশ বছর পর আমার পরিচিত এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো এক দিন। তার হাতে ছিল পাবলো নেরুদার মেমোয়ার্স বইটি। সে লোক এতটা ঘনিষ্ঠ ছিল না যে, বইটা ধার চাইতে পারি। আরেকটি বিষয় ছিল, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার এক দিন পর তার বিদেশ চলে যাওয়ার কথা। তখন অনেক বলে-কয়ে এক রাতের জন্য বইটি নিলাম এবং সত্যি সত্যি সারা রাত জেগে বিশাল বইটি পড়া শেষ করলাম। যখন মেমোয়ার্স পড়া সমাপ্ত হলো তখন ঢাকার আকাশে আজানের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। অদ্ভুত সে অনুভূতি নিয়ে আমার একটি কবিতাও আছে, নাম ‘আজানময়প্রহর’। সুতরাং বলতে পারি বই পড়ার আগ্রহটিই অনেক কিছু।

- পল্টন, নীলক্ষেত ইত্যাকার ভাসমান বইবাজার থেকে বই কেনেন? এ নিয়ে কোনো স্মৃতিময় অভিজ্ঞতা থাকলে বলুন।

- প্রচুর। গুরুত্বপূর্ণ কত বই যে এসব জায়গা থেকে সংগ্রহ করেছি তার ইয়ত্তা নেই। অনেক লেখকের নিজ স্বাক্ষর করা বই এসব দোকান থেকে সংগ্রহ করে আমি আবার তাদের উপহার দিতে পছন্দ করি। এ নিয়ে কলকাতার একটি ঘটনা বলতে পারি। কফি হাউসে বসে আছি। নিসারুল বলে আমাদের এক পরিচিতজন এসে বলল, কোনো পুরনো বইয়ের দোকানে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষর করা একটি বই পাওয়া গেছে। নিজের সে বই কবি তার এক বউদিকে উপহার দিয়েছিলেন। তারপর চারদিকে হই-চই পড়ে গেল। ছবি তোলা, পত্রিকায় খবর বেরুল ইত্যাদি কত কী! আমি পল্টন থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্পাদিত একটি প্রেমের কবিতার সংকলন কিনি, যেটি সুফিয়া খালা বলে কাউকে (হয়তো কবি সুফিয়া কামাল) দেয়া হয়েছিল। ওই কবিতা সংকলনটির কিছু ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল, যা নিয়ে বন্ধু কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ একটি লেখাও লিখে ফেলেছিলেন। মান্নান বইটির খোঁজ পাওয়ার পরই আমার কাছ থেকে কপি করে নিয়েছিলেন।

- আপনার এত বই! এর মধ্যে উপহার পাওয়া বেশি না নিজের টাকায় কেনা বেশি?

- উভয়ই। উপহার হিসেবে যেমন অজস্র বই পাই, তেমনি কিনিও কম না। বস্তুত বই ও আমি সমার্থক প্রায়। মরুভূমিতে বসিয়ে দিলেও মনে হয় আমি বই পড়ব। কারণ ছোটবেলা থেকে বইয়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছি। তবে দুঃখের বিষয়, আমার জীবনের নানা পর্বের অনেক দুর্লভ সংগ্রহ-ই হারিয়েছি বিভিন্নভাবে। বাসা বদল, স্থান বদলে যেমন বহু বই নষ্ট হয়েছে, তেমনি অনেকে বই নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। কলকাতা জীবনের পুরো বইয়ের সংগ্রহও আর আমার কাছে নেই।

- বই নিয়ে আপনার কোনো মজার স্মৃতি...

- একবার আমেরিকাতে মেয়ের জন্য রবীন্দ্র রচনাবলির পুরো সেট নিয়ে যাচ্ছিলাম। একজনের পরামর্শে সেটা মুড়িয়ে সঙ্গে নিলাম। জানতাম, আটলান্টায় চেকিং হয়। যদি আটকায় তবে বইগুলো চিরতরে খোয়া যাবে। লাগেজের মধ্যে বইয়ের সেটটা দিলাম। চেকিংয়ের এক কর্মকর্তা (যমদূতের মতো বিশালদেহী নিগ্রো) এসে আমাকে জিজ্ঞেস কলল, আপনি কি ব্যবসায়ী? আমি বললাম, ‘আমি একজন লেখক।’ সে জানতে চাইল, এগুলো সব আমার বই কি না? আমি ঝামেলা এড়াতে বললাম, ‘হ্যাঁ।’ বিস্মিত হয়ে সে তার সহকর্মী এক মেয়েকে ডেকে এনে বলতে লাগল, ‘এই যে একজন লেখক। এই সব বই তার লেখা!’

- বইয়ের সঙ্গে এই যে আপনার বেড়ে ওঠা-এর প্রস্তুতিপর্বটা কেমন ছিল?

- প্রকৃতপক্ষে কুমিল্লাতে বইয়ের ব্যাপারে আমার চক্ষু উন্মীলন ঘটে। কুমিল্লা শহরে তখন বেশ কয়েকটি পাঠাগার ছিল। যেমন : বসন্ত স্মৃতি পাঠাগার, অমূল্য স্মৃতি পাঠাগার, জাগরণী সংঘ, জামতলার পড়ার ঘর। মনে আছে, ছোটবেলায় আমার কাজ ছিল বৃষ্টি মাথায় করে কুমিল্লার প্রত্যেক পাঠাগার থেকে একেকটি বই নিয়ে সন্ধ্যায় জ্যামিতি-বইয়ের নিচে লুকিয়ে এসব পড়া। নীহাররঞ্জনের কীরিটি সিরিজের মতো এমন কত বই যে এভাবে শেষ হয়েছে তার লেখাজোখা নেই।

- সবসময় হাতের কাছে রাখেন, প্রায় প্রতিদিন উল্টেপাল্টে দেখেন এমন বইয়ের তালিকায় আছে কোনগুলো?

- অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের নানা বই। তা ছাড়াও আরও অনেক বই-ই তালিকায় যুক্ত হবে।

- কী কী লেখার পরিকল্পনা আছে আপনার?

- আমি লেখায় ঠিক মনোযোগ দিতে পারছি না। অলিখিত লেখার পরিকল্পনা মাথায় ঘোরে। কিন্তু নানা কাজে-অকাজে সেসব লেখা হয়ে ওঠে না। এই তো পাবলো নেরুদার একটি জীবনীমূলক বই হন্যে হয়ে খুঁজেছি। এখনো পাইনি। ইচ্ছে আছে, হাতে পেলে সে বইটি অনুবাদ করব। তেমনি কাফকা, লোরকার মতো আমার প্রিয় লেখকদের আমেরিকার জীবন নিয়ে কিছু অন্য ধাঁচের লেখা তৈরি করব।

- কবিতার পাশাপাশি আপনার উপন্যাস স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল-এর সঙ্গে আমরা পরিচিত। কবিদের রচিত কথাসাহিত্যের মধ্যে আপনার দৃষ্টিতে তাৎপর্যপূর্ণ কী কী?

- শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস কুয়োতলাঅসাধারণ। তাছাড়া সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো আছেনই।

- আমাদের এখানে সৃজনশীল গদ্যের যে নিদারুণ অভাব তার মূল কারণ কী?

- পড়াশোনা ও চর্চার অভাব, পরিশ্রমের ঘাটতি অবশ্যই এর একটি প্রধান কারণ।

- কবিতা, গদ্যচর্চা ছাড়াও আপনার অনুবাদ চর্চা সম্পর্কেও আমরা অবিদিত নই। গার্সিয়া মার্কেসের মৃত্যুর কড়ানড়া, জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্পইত্যাদির অনুবাদক হিসেবেই আমাদের অনুবাদ সাহিত্য সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ শুনতে আগ্রহী?

- আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের মান খুবই খারপ। দু’একটি কাজ ছাড়া অধিকাংশ অনুবাদের মান খুবই হতাশাজনক। নামকরা লেখকদের অনুবাদও আশাব্যঞ্জক নয়। অনুবাদ তো কোনো আক্ষরিক অনুসৃতির ব্যাপার নয়। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, জায়গাজমি এবং আনুষঙ্গিক অনেক জরুরি বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে আমরা ভালো অনুবাদ প্রত্যাশা করতে পারি না।

- সাম্প্রতিক তরুণদের লেখালেখি নিয়ে কি আপনি আশাবাদী?

- তরুদের নিয়ে আমি সবসময় আশাবাদী। দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির কারণে কিছু সংকট থাকলেও সারা দেশের তরুণরা এখন লেখালেখিতে সক্রিয়। তবে পড়াশোনার অভাব, বইয়ের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কিছুটা প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। তরুণদের জন্য উপযুক্ত সাহিত্যিক পরিবেশ তৈরি করা একটি জরুরি বিষয়।

- কলকাতায় যে সাহিত্যচর্চা কৃত্তিবাস, শতভিষা-কে ঘিরে গড়ে উঠেছিল আপনি তার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা যদি কিছু বলেন...

- কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয় হয়। শক্তিদা ও আমার সম্পর্ক ছিল হরিহর আত্মার মতো। ক্রমে ক্রমে উৎপলকুমার বসু, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়। কমলকুমার মজুমদারের সঙ্গে সখ্য আমার জীবন ও সাহিত্যিক গতিপথটাই পাল্টে দিয়েছিল।

- কলকাতাসহ ভারতে আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অনেকে আছেন। তাদের সঙ্গে আড্ডাগুলো এখনো কি মিস করেন? যোগাযোগ আছে তাদের সঙ্গে?

- সেই বন্ধুদের অর্ধেকই এখন আর বেঁচে নেই। তবে যারা আছে তারা যেমন আমাকে মিস করে আমিও তাদের ভীষণ মিস করি। অনেকের সঙ্গেই নিয়মিত-অনিয়মিত যোগাযোগ হয়।

- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আপনার পরিচয় কখন?

- কলকাতাতে জীবনের ঠিক প্রথমেই নয়। সুনীলদা আমেরিকা থেকে আসার পর তার সঙ্গে পরিচয়-ঘনিষ্ঠতা হয়। গড়ে ওঠে নিবিড় সম্পর্ক।

- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর অর্ধেক জীবন বইয়ে জাপান গিয়ে আপনার কুমির ব্যবসার যে গল্প করেছেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানার আগ্রহ আমাদের।

- সত্যি ঘটনা, জাপান গিয়ে যখন গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাই তখন এক জাপানি আমাকে কুমির ব্যবসার প্রস্তাব দেয়, যদিও তা ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে গল্পও লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলা ভালো, আমি জীবনে অনেক ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েই ব্যর্থ হয়েছি। চট্টগ্রাম গিয়ে পেরেকের ব্যবসা, কুমিল্লায় বইয়ের ব্যবসায় নেমেছিলাম। মনে আছে, রাশিয়ান বইয়ের বিশাল সংগ্রহ জোগাড় করে ফেলেছিলাম।

- আপনার বিশেষ বন্ধু, আমাদের প্রিয় কবি বিনয় মজুমদার চলে গেলেন বছর কয়েক আগে। তাঁর বইপত্র ও তাঁর সম্পর্কে জানতে চেয়ে সাক্ষাৎকারটি শেষ করব।

- সে দীর্ঘ কাহিনি। আমি কলকাতা যাওয়ার পর দেখি বিনয় প্রায় মিথ। তখন সে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আছে। কফি হাউসের সূত্রে আমার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সে থাকত কলকাতার মেসবাড়িতে, মাঝেমধ্যে যেত ঠাকুরনগরে। ওর বাবা চাকরি করত রেঙ্গুনে। একদিন দেখি বেতের লাঠি নিয়ে বিনয় কফি হাউসে। আনমনে কী যেন বিড়বিড় করেছে। চলে গেলেন কিছুক্ষণ থেকে আবার ফিরেও এলেন উ™£ান্তের মতো চেহারা নিয়ে। শুনলাম, মেসের ঠাকুর তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করায় বেতের লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন বিনয় মজুমদার। সবসময়ই অন্যরকম দেখতাম তাঁকে। এই স্বাভাবিক এই অস্বাভাবিক, মাঝে-মধ্যে সুন্দর সুন্দর কথা বলত আবার কখনো গান গেয়ে উঠত। বিনয়ের কলেজবন্ধু নির্মল মৈত্রর কাছে শুনেছি, শিবপুর কলেজের এক উদ্ভিন্নযৌবনা অধ্যাপক কন্যার ন্তনস্পর্শে বিনয়ের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সেই থেকে ফুল্লরা, ঈশ্বরী, গায়ত্রী-এ রকম কত মেয়েকে নিয়ে যে তার অদ্ভুত সব পাগলামি! ফুল্লরাকে আমি চিনতাম আর গায়ত্রী চক্রবর্তীর একটি ছবি বেরিয়েছিল ১৯৬৭-তে নিউজউইকে। প্রেসিডেন্সির মেধাবী ছাত্রী, পায়ে ঘুঙুর পরত। গায়ত্রী তার লেখালেখিতে দারুণভাবে, গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। বিনয়ের অনেক ডায়েরির কথা মনে পড়ে। কবিতার লাইন, গান, কত কী লেখা থাকত তাতে। বিনয় ভালো অনুবাদকও ছিল; রাশিয়ান বইয়ের অনুবাদও করেছে সে। নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য অঙ্কে হিসাব করত। নিজে পেলে কী করবে তা ঠিক করত। কত স্মৃতি! সব কী মনে পড়ে?

অক্টোবর : ২০০৭

back to top