alt

সাময়িকী

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

নূর-ই আলম সিদ্দিকী

: বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

শিল্পী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৈচিত্র্য ও বিচিত্র গতির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া এ মানুষটি জীবনের পরতে পরতে নিত্যনতুন সাহিত্য নির্মাণে ছিলেন প্রত্যয়দীপ্ত। তাঁর প্রতিভার এই জাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করে, কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন- ‘যে পারে সে এমনি পারে। পারে সে ফুল ফোটাতে।’ অজ¯্র লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি পেয়েছেন তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য। এ পুরস্কার কবিকে সকলের কাছে পরিচিত করে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম বাঙালি হিসেবে অনন্য মর্যাদা প্রাপ্তিও ঘটে তাঁর। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ প্রাপ্তি কবিকে অপ্রত্যাশিত বেদনায় অস্থির করেছে সমসাময়িক কালে ও তৎপরবর্তী সময়ে।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ নভেম্বর ‘রয়টার সংবাদ সংস্থা’য় বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষেও একটি ছোট্ট সংবাদপ্রকাশিত হয়: Stockholm, Thursday, Nov, 13, The nobel prize for literature for 1913 has been awarded to the Indian poet Rabindranath Tagore. নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ, বাঙালি কবির বিশ্ব পরিচিত হবার যেমন এক মাহেন্দ্রক্ষণ; একইসঙ্গে এই অর্জনের পেছনের ইতিহাসটুকু দুঃখ জাগানিয়া ও কৌতূহলপ্রদ। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ নোবেল ঘোষণার প্রথম বছর। ১৯০১ থেকে পর পর ১২ বছরে পুরস্কার পেয়েছেন ১২ জন প্রতিভাবান ব্যক্তি। সে সময় ১২ জন নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে চারজন ছিলেন জার্মানির। দুজন ফ্রান্সের এবং সুইডেন, নরওয়েজিয়া, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের একজন করে।

রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের উপর। কবির এ পুরস্কারের পিছনের ইতিহাস গভিীর উদ্দীপনাময়। ১৯১০ সালে ‘Song Offerings’ প্রকাশ হয় গীতাঞ্জলি কাব্যের অনুবাদ হিসেবে। তবে এই অনুবাদ কিন্তু ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ নয়। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে ১৫৭টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত। সেখান থেকে ৫৩টি কবিতা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’-এ স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থমধ্যে ‘গীতিমাল্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১৬টি, ‘নৈবদ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১৬টি, ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১১টি, ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনটি এবং ‘চৈতালি’, ‘কল্পনা’, ‘উৎসর্গ’ ও ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি করে কবিতা স্থান পেয়েছে। তৎসঙ্গে ‘অচলায়তন’ নাটকের একটি গানও রয়েছে। অন্য তিনটি কবিতার মধ্যে ‘নৈবদ্য’ কাব্যগ্রন্থের দুটি কবিতা ও অন্য কবিতা নিয়ে ইংরেজি গীতাঞ্জলি ‘Song Offerings’ নির্মিত হয়েছে।

গীতাঞ্জলি কাব্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপট এবং প্রকাশের ভৌগোলিক বিচরণ ক্ষেত্রটি বেশ উদ্দীপনাময়। জলের প্রতি অনুরাগী রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে পদ্মার বুকে গীতাঞ্জলি রচনা শুরু করেন। তারপর হাওড়া থেকে বোম্বে রেল গাড়ির ভেতর কিছু অংশ। এবং শেষ পর্ব সমাপ্ত হয় প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ‘City Of Glasgow’ নামক জাহাজের কেবিনে। ১৯১২ সালে বিদেশে যাবার পথে গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাবার ঘটনা ঘটে। সে বছর মে মাসের শেষে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে বোম্বে থেকে লন্ডন রওনা হন। ১৬ই জুন হোটেলে যাবার পথে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনূদিত পাণ্ডুলিপি টিউব রেলে হারিয়ে যায়। অবশ্য পরের দিন পুত্র রথীন্দ্রনাথ রেলের ‘লস প্রপার্টির’ অফিস থেকে তা ফিরিয়ে আনেন।

‘Song Offerings’-এর প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন ইংরেজ চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইন। বিখ্যাত এ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে কবিরপারিবারিক সূত্রে পরিচয় ছিল। উল্লেখ্য শিল্পী রোদেনস্টাইনের প্রেরণায় কবির লেখা আন্তর্জাতিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। কবি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গীতাঞ্জলি কাব্য তাঁকেই উৎসর্গ করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখ ‘Song Offerings’ প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির ভূমিকা লেখেন কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস। ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে ভারতীয় ভদ্রলোকদের উদ্যোগে এটি প্রথম ছাপা হয় ৭৫০ কপি। ‘Song Offerings’ প্রকাশিত হলে ইংল্যান্ডের নামকরা পত্রিকা এর প্রতুল প্রশংসা করে। এমনকি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের শেষে এটি প্রকাশের দায়িত্ব নেয় বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘ম্যাকমিলান।’

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ। নোবেল পুরস্কারের জন্য বিশ্বের নামকরা ২৮ জন ব্যক্তির তালিকা সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে সুপারিশসহ পাঠানো হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় তালিকায় কবি ‘Thomas Hardz’-এর নাম ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ৯৭ জন সদস্য সুপারিশ করে জমা দেয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘Songs Offerings’-এর পক্ষে একমাত্র সুপারিশ করেন ইংরেজ কবি T.Sturge Moore. তিনি খুব সহজ ভাষায় সুপারিশ পত্রে লিখেন-

To

The Secretary of the noble Committee of the Swedish Academy, Stockholm.

Sir

As a fellow of Royal society of literary of literacy of the United Kingdom, I have the honour to the propose of the name of Rabindra Nath Tagore. As a person qualified, in my opinion, to the awarded the Noble prize in literature.

T. Sturge Moore.

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল কমিটির সদস্য ছিল ১৮ জন। এই সদস্যগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেনরিক ভিলহেলম ট্যাগরার। তিনি ছিলেন সুইডেনের বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও কবি অ্যাসিয়াস ট্যাগনারের নাতি। অবাক হবার বিষয় ভিলহেম ট্যাগরার বাংলা ভাষা জানতেন এবং তিনি বাংলা গীতাঞ্জলিও পড়েছিলেন। সে বার নোবেল কমিটির ১৩জন সদস্য ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ১২ ভোট।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ নভেম্বর রয়টারের টেলিগ্রামের দিনেই কলকাতার ‘Empire’ নামের পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় সংবাদ জানার পর শুরু হয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আর্ত-চিৎকার। ‘Song Offerings’ ছিল ১০৩টি কবিতার ৮০ পৃষ্ঠার বই। এর মধ্যে ১৬ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল সূচি, উৎসর্গ এবং কবি ইয়েটস এর ভূমিকা। এর ফলে কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে সমালোচকরা প্রথম অভিযোগ আনেন এটিকে ৬৪ পাতার একটি চটি পুস্তিকা হিসেবে। সমালোচনার ভব্যতাটুকু হারিয়ে অভিযোগের ডালিতে তারা যুক্ত করেন রবীন্দ্রনাথ স্কুল-কলেজে পড়লেন না,অথচ তাঁর নোবেল প্রাপ্তি ঘটে কীভাবে? এমনি বিকার মনের রুচিহীন মন্তব্য। এতেই শেষ নয়, তারা অবিবেচনাপ্রসূত কথার হৈ, হৈ রব ছড়াতে থাকেন দিক থেকে দিগন্তে। সবকিছু শুনে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে খুব ব্যথিত ও বিব্রত হন। কিন্তু অবাক হবার বিষয়, এত বিদ্রƒপের মধ্যেও কবি থেকেছেন শান্ত ও প্রতিবাদহীন। তাঁর সমাহত এ আচরণ তাঁকে তাই সে সময়ে পরিচিতি দিয়েছে একজন উন্নত মানব হিসেবে। আমরা বাঙালিরা যেমন লজ্জা, শরমকে মনের ভেতরে স্থান দিইনা,অন্যদিকে তেমনি পরশ্রীকাতরতাকেও অন্তর থেকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি না। আর এ কারণেই একজন ভদ্র ও মেধাবী রবীন্দ্রনাথকে চেনা যেমন আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে,আবার তাঁর সাফল্যেও মনের জ্বালাকে নেভাতে পারিনা কোনোভাবেই। সঙ্গতভাবেই তাই মান্য ব্যক্তির মানকে হেয় করে,পরক্ষণেই আবার তাঁকে আদর দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠি। যার চূড়ান্তপ্রতিচ্ছবি আমরা সে সময় দেখতে পাই কবিকে ঘিরে। ফলে কিছু দিন যেতে না যেতে নানাদিক থেকে নানাভাবে কবিকে তুচ্ছজ্ঞান করার মধ্যেও, সেদিন তাঁকে সংবর্ধনা দেবার দৃষ্টিকটূ উন্মাদনা শুরু হয়।

সব থেকে লক্ষণীয় হলো- এসব নোংরামির মধ্যেই ১৯১৩’র ২৩ নভেম্বর ৫০০ জন বিদ্বান নর-নারী কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে যান কবিকে সংবর্ধনা দিতে। যথারীতি তাঁকে নিয়ে নানামুখি আলোচনা শুরু হয় অনুষ্ঠানে, কিন্তু অজ¯্রপ্রশংসার মধ্যেও কবি সে সময় খুব শান্ত ও সংযত হয়ে প্রত্যেকের কথা শুনতে থাকেন। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে সমাগত সুধীজনদের উদ্দেশ্যে যখন তিনি কথা শুরু করেন,তখন তাঁর বক্তব্য ছিল বড় হৃদয়স্পর্শী ও বেদনাময়। তিনি বলে ওঠেন- ‘আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরা পাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছ পর্যন্ত ঠেকাবো, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারবো না।’

আলোচনার অন্যপিঠে কবিকে আমরা পাই বিশাল এক মহানুভব ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ হিসেবে। সে সময় অধিক বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কবির পুরস্কার বাবদ পাওয়া-১,২০,০০০ (৮হাজার পাউন্ড) টাকার ব্যাপারটি। প্রাপ্ত এ টাকার একটি নোটও তিনি নিজে গ্রহণ করেননি। তাঁর জমিদারিতে মহাজনদের হাত থেকে গরিব কৃষকদের বাঁচাতে কবি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিস্বরূপ, স্বল্প সুদে ‘কৃষি ও কুটিরশিল্পে’ ঋণের জন্য সবটাকা তিনি ১৯০৫ খ্রি. পতিসরে স্থাপিত ‘সমবায় কৃষি ব্যাংকে’ প্রদান করেন। ব্যাপক কর্মভারে ব্যাপ্তেএই মহান মানুষটিকে চিনতে তাই আমাদের কান পেতে দিতে হয় তাঁর সৃষ্টি আঙিনায়। যেখানে বেজে যায়, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়’- অমৃত এই বাণী।অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া এ কথার রেশ ধরে, কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে এবংদ্বিধাহীন চিত্তেতাই কবিকে তাঁর প্রাপ্ত সস্মান জানানো ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর থাকেনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোদীপ্ত অসামান্য মানুষ। তাঁর সৃজন বিভায় স্নাত বাঙালি। বাঙালির ইতিহাসে বাঁক ফেরানো এই মানুষটি হাজারো কষ্টের ভেতর দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টির পাথারে। আমি বিস্ময়ে বিমুগ্ধ চিত্তে তাই তাঁর কথায় বলে যাই- ‘বিষ মন্থন করি,তুমি সকলি করেছ দান।’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

tab

সাময়িকী

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

নূর-ই আলম সিদ্দিকী

শিল্পী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

বৈচিত্র্য ও বিচিত্র গতির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া এ মানুষটি জীবনের পরতে পরতে নিত্যনতুন সাহিত্য নির্মাণে ছিলেন প্রত্যয়দীপ্ত। তাঁর প্রতিভার এই জাদুকরী প্রভাব লক্ষ্য করে, কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেন- ‘যে পারে সে এমনি পারে। পারে সে ফুল ফোটাতে।’ অজ¯্র লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি পেয়েছেন তাঁর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য। এ পুরস্কার কবিকে সকলের কাছে পরিচিত করে। এশিয়া মহাদেশের প্রথম বাঙালি হিসেবে অনন্য মর্যাদা প্রাপ্তিও ঘটে তাঁর। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ প্রাপ্তি কবিকে অপ্রত্যাশিত বেদনায় অস্থির করেছে সমসাময়িক কালে ও তৎপরবর্তী সময়ে।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ নভেম্বর ‘রয়টার সংবাদ সংস্থা’য় বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে ভারতবর্ষেও একটি ছোট্ট সংবাদপ্রকাশিত হয়: Stockholm, Thursday, Nov, 13, The nobel prize for literature for 1913 has been awarded to the Indian poet Rabindranath Tagore. নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ, বাঙালি কবির বিশ্ব পরিচিত হবার যেমন এক মাহেন্দ্রক্ষণ; একইসঙ্গে এই অর্জনের পেছনের ইতিহাসটুকু দুঃখ জাগানিয়া ও কৌতূহলপ্রদ। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ নোবেল ঘোষণার প্রথম বছর। ১৯০১ থেকে পর পর ১২ বছরে পুরস্কার পেয়েছেন ১২ জন প্রতিভাবান ব্যক্তি। সে সময় ১২ জন নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে চারজন ছিলেন জার্মানির। দুজন ফ্রান্সের এবং সুইডেন, নরওয়েজিয়া, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম ও ইংল্যান্ডের একজন করে।

রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের উপর। কবির এ পুরস্কারের পিছনের ইতিহাস গভিীর উদ্দীপনাময়। ১৯১০ সালে ‘Song Offerings’ প্রকাশ হয় গীতাঞ্জলি কাব্যের অনুবাদ হিসেবে। তবে এই অনুবাদ কিন্তু ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’ নয়। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে ১৫৭টি কবিতা অন্তর্ভুক্ত। সেখান থেকে ৫৩টি কবিতা ‘ঝড়হম ঙভভবৎরহমং’-এ স্থান পেয়েছে। এ গ্রন্থমধ্যে ‘গীতিমাল্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১৬টি, ‘নৈবদ্য’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১৬টি, ‘খেয়া’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ১১টি, ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনটি এবং ‘চৈতালি’, ‘কল্পনা’, ‘উৎসর্গ’ ও ‘স্মরণ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে একটি করে কবিতা স্থান পেয়েছে। তৎসঙ্গে ‘অচলায়তন’ নাটকের একটি গানও রয়েছে। অন্য তিনটি কবিতার মধ্যে ‘নৈবদ্য’ কাব্যগ্রন্থের দুটি কবিতা ও অন্য কবিতা নিয়ে ইংরেজি গীতাঞ্জলি ‘Song Offerings’ নির্মিত হয়েছে।

গীতাঞ্জলি কাব্য সৃষ্টির প্রেক্ষাপট এবং প্রকাশের ভৌগোলিক বিচরণ ক্ষেত্রটি বেশ উদ্দীপনাময়। জলের প্রতি অনুরাগী রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে পদ্মার বুকে গীতাঞ্জলি রচনা শুরু করেন। তারপর হাওড়া থেকে বোম্বে রেল গাড়ির ভেতর কিছু অংশ। এবং শেষ পর্ব সমাপ্ত হয় প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ‘City Of Glasgow’ নামক জাহাজের কেবিনে। ১৯১২ সালে বিদেশে যাবার পথে গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাবার ঘটনা ঘটে। সে বছর মে মাসের শেষে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে বোম্বে থেকে লন্ডন রওনা হন। ১৬ই জুন হোটেলে যাবার পথে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনূদিত পাণ্ডুলিপি টিউব রেলে হারিয়ে যায়। অবশ্য পরের দিন পুত্র রথীন্দ্রনাথ রেলের ‘লস প্রপার্টির’ অফিস থেকে তা ফিরিয়ে আনেন।

‘Song Offerings’-এর প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন ইংরেজ চিত্রশিল্পী রোদেনস্টাইন। বিখ্যাত এ চিত্রশিল্পীর সঙ্গে কবিরপারিবারিক সূত্রে পরিচয় ছিল। উল্লেখ্য শিল্পী রোদেনস্টাইনের প্রেরণায় কবির লেখা আন্তর্জাতিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়ে। কবি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গীতাঞ্জলি কাব্য তাঁকেই উৎসর্গ করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের ১৩ তারিখ ‘Song Offerings’ প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির ভূমিকা লেখেন কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস। ইন্ডিয়া সোসাইটি থেকে ভারতীয় ভদ্রলোকদের উদ্যোগে এটি প্রথম ছাপা হয় ৭৫০ কপি। ‘Song Offerings’ প্রকাশিত হলে ইংল্যান্ডের নামকরা পত্রিকা এর প্রতুল প্রশংসা করে। এমনকি ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের শেষে এটি প্রকাশের দায়িত্ব নেয় বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘ম্যাকমিলান।’

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ। নোবেল পুরস্কারের জন্য বিশ্বের নামকরা ২৮ জন ব্যক্তির তালিকা সুইডিশ অ্যাকাডেমিতে সুপারিশসহ পাঠানো হয়। লক্ষ্যণীয় বিষয় তালিকায় কবি ‘Thomas Hardz’-এর নাম ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ৯৭ জন সদস্য সুপারিশ করে জমা দেয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের ‘Songs Offerings’-এর পক্ষে একমাত্র সুপারিশ করেন ইংরেজ কবি T.Sturge Moore. তিনি খুব সহজ ভাষায় সুপারিশ পত্রে লিখেন-

To

The Secretary of the noble Committee of the Swedish Academy, Stockholm.

Sir

As a fellow of Royal society of literary of literacy of the United Kingdom, I have the honour to the propose of the name of Rabindra Nath Tagore. As a person qualified, in my opinion, to the awarded the Noble prize in literature.

T. Sturge Moore.

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেল কমিটির সদস্য ছিল ১৮ জন। এই সদস্যগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেনরিক ভিলহেলম ট্যাগরার। তিনি ছিলেন সুইডেনের বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও কবি অ্যাসিয়াস ট্যাগনারের নাতি। অবাক হবার বিষয় ভিলহেম ট্যাগরার বাংলা ভাষা জানতেন এবং তিনি বাংলা গীতাঞ্জলিও পড়েছিলেন। সে বার নোবেল কমিটির ১৩জন সদস্য ভোট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ১২ ভোট।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৩ নভেম্বর রয়টারের টেলিগ্রামের দিনেই কলকাতার ‘Empire’ নামের পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় সংবাদ জানার পর শুরু হয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের আর্ত-চিৎকার। ‘Song Offerings’ ছিল ১০৩টি কবিতার ৮০ পৃষ্ঠার বই। এর মধ্যে ১৬ পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল সূচি, উৎসর্গ এবং কবি ইয়েটস এর ভূমিকা। এর ফলে কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে সমালোচকরা প্রথম অভিযোগ আনেন এটিকে ৬৪ পাতার একটি চটি পুস্তিকা হিসেবে। সমালোচনার ভব্যতাটুকু হারিয়ে অভিযোগের ডালিতে তারা যুক্ত করেন রবীন্দ্রনাথ স্কুল-কলেজে পড়লেন না,অথচ তাঁর নোবেল প্রাপ্তি ঘটে কীভাবে? এমনি বিকার মনের রুচিহীন মন্তব্য। এতেই শেষ নয়, তারা অবিবেচনাপ্রসূত কথার হৈ, হৈ রব ছড়াতে থাকেন দিক থেকে দিগন্তে। সবকিছু শুনে রবীন্দ্রনাথ মনে মনে খুব ব্যথিত ও বিব্রত হন। কিন্তু অবাক হবার বিষয়, এত বিদ্রƒপের মধ্যেও কবি থেকেছেন শান্ত ও প্রতিবাদহীন। তাঁর সমাহত এ আচরণ তাঁকে তাই সে সময়ে পরিচিতি দিয়েছে একজন উন্নত মানব হিসেবে। আমরা বাঙালিরা যেমন লজ্জা, শরমকে মনের ভেতরে স্থান দিইনা,অন্যদিকে তেমনি পরশ্রীকাতরতাকেও অন্তর থেকে ছুঁড়ে ফেলতে পারি না। আর এ কারণেই একজন ভদ্র ও মেধাবী রবীন্দ্রনাথকে চেনা যেমন আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে,আবার তাঁর সাফল্যেও মনের জ্বালাকে নেভাতে পারিনা কোনোভাবেই। সঙ্গতভাবেই তাই মান্য ব্যক্তির মানকে হেয় করে,পরক্ষণেই আবার তাঁকে আদর দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠি। যার চূড়ান্তপ্রতিচ্ছবি আমরা সে সময় দেখতে পাই কবিকে ঘিরে। ফলে কিছু দিন যেতে না যেতে নানাদিক থেকে নানাভাবে কবিকে তুচ্ছজ্ঞান করার মধ্যেও, সেদিন তাঁকে সংবর্ধনা দেবার দৃষ্টিকটূ উন্মাদনা শুরু হয়।

সব থেকে লক্ষণীয় হলো- এসব নোংরামির মধ্যেই ১৯১৩’র ২৩ নভেম্বর ৫০০ জন বিদ্বান নর-নারী কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে যান কবিকে সংবর্ধনা দিতে। যথারীতি তাঁকে নিয়ে নানামুখি আলোচনা শুরু হয় অনুষ্ঠানে, কিন্তু অজ¯্রপ্রশংসার মধ্যেও কবি সে সময় খুব শান্ত ও সংযত হয়ে প্রত্যেকের কথা শুনতে থাকেন। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে সমাগত সুধীজনদের উদ্দেশ্যে যখন তিনি কথা শুরু করেন,তখন তাঁর বক্তব্য ছিল বড় হৃদয়স্পর্শী ও বেদনাময়। তিনি বলে ওঠেন- ‘আজ আপনারা আদর করে সম্মানের যে সুরা পাত্র আমার সম্মুখে ধরেছেন তা আমি ওষ্ঠের কাছ পর্যন্ত ঠেকাবো, কিন্তু এ মদিরা আমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারবো না।’

আলোচনার অন্যপিঠে কবিকে আমরা পাই বিশাল এক মহানুভব ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ হিসেবে। সে সময় অধিক বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কবির পুরস্কার বাবদ পাওয়া-১,২০,০০০ (৮হাজার পাউন্ড) টাকার ব্যাপারটি। প্রাপ্ত এ টাকার একটি নোটও তিনি নিজে গ্রহণ করেননি। তাঁর জমিদারিতে মহাজনদের হাত থেকে গরিব কৃষকদের বাঁচাতে কবি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলশ্রুতিস্বরূপ, স্বল্প সুদে ‘কৃষি ও কুটিরশিল্পে’ ঋণের জন্য সবটাকা তিনি ১৯০৫ খ্রি. পতিসরে স্থাপিত ‘সমবায় কৃষি ব্যাংকে’ প্রদান করেন। ব্যাপক কর্মভারে ব্যাপ্তেএই মহান মানুষটিকে চিনতে তাই আমাদের কান পেতে দিতে হয় তাঁর সৃষ্টি আঙিনায়। যেখানে বেজে যায়, ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়’- অমৃত এই বাণী।অন্তর ছুঁয়ে যাওয়া এ কথার রেশ ধরে, কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে এবংদ্বিধাহীন চিত্তেতাই কবিকে তাঁর প্রাপ্ত সস্মান জানানো ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর থাকেনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আলোদীপ্ত অসামান্য মানুষ। তাঁর সৃজন বিভায় স্নাত বাঙালি। বাঙালির ইতিহাসে বাঁক ফেরানো এই মানুষটি হাজারো কষ্টের ভেতর দিয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টির পাথারে। আমি বিস্ময়ে বিমুগ্ধ চিত্তে তাই তাঁর কথায় বলে যাই- ‘বিষ মন্থন করি,তুমি সকলি করেছ দান।’

back to top