alt

সাময়িকী

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

যাকিয়া সুমি সেতু

: বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

হোসে এচেগারাই

হোসে এচেগারাই (১৮৩২-১৯১৬) হলেন এক ব্যতিক্রমী স্প্যানিশ মনীষী যিনি সাহিত্যে এবং বিজ্ঞানে সমান দক্ষতায় অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন প্রথম স্প্যানিশ নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক, যাঁর নাট্যকর্মে একাধারে দর্শন, গণিতীয় যুক্তি ও সামাজিক মূল্যবোধের জটিল দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, পুরপ্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি একজন খ্যাতনামা নাট্যকার। তাঁর নাট্যকর্মে যেমন যুক্তির শৃঙ্খলা, আবেগের বিস্ফোরণ; তেমন দর্শনের গাম্ভীর্য, মানবিক বেদনাবোধের আবেশ।

হোসে এচেগারাই ই ইসাগুইরে ১৮৩২ সালের ১৯ এপ্রিল স্পেনের মাদ্রিদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা, হোসে এচেগারাই, ছিলেন সরকারি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা, এবং মাতা মারিয়া ইসাগুইরে ছিলেন এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। হোসে এচেগারাইয়ের স্ত্রী ছিলেন সুন্দরী, যাঁর সৌন্দর্য সম্পর্কে স্পেনের রাজা আমাদেও দে সাবোয়া মন্তব্য করেছিলেন: “স্পেনের সবচেয়ে সুন্দর দুটি জিনিস হলো বার্গোস ক্যাথেড্রাল ও হোসে এচেগারাইয়ের স্ত্রী”। তাঁদের সংসারে ছিল দু’জন সন্তান- আনা (Ana), তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং তিনটি সন্তানের জননী। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন। অন্যজন মানুয়েল (Manuel), তিনি অবিবাহিত ছিলেন এবং সারা জীবন একা কাটিয়েছেন। হোসে এচগারাইয়েরমৃত্যু হয় ১৯১৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, মাদ্রিদের সান ইসিদ্রো সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

শৈশব থেকেই হোসে এচেগারাইয়ের মধ্যে ছিল বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ। তিনি মাদ্রিদের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (Escuela Técnica Superior de Ingenieros de Caminos, Canales y Puertos) থেকে মাত্র বিশ বছর বয়সে সেরা ফলাফলে স্নাতক হন এবং পরে গণিত ও প্রকৌশলে অধ্যাপনা শুরু করেন। জীবনের শুরুতে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে স্পেনের সরকারে মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তবে, তার প্রকৃত খ্যাতি আসে সাহিত্যবিশ্বে। এভাবে তাঁর জ্ঞাননিষ্ঠ জীবনের পরিধির সূচনা ও বিস্তৃতি ঘটে। তবে এর জন্য ছিল গভীর অনুশীলন। সেজন্য তিনি নিয়মিত স্পেনের জাতীয় গ্রন্থাগার Biblioteca Nacional de España ব্যবহার করতেন, যেখানে তিনি দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই অধ্যয়ন করতেন। এই পড়াশোনাই তাঁর নাটকে গভীর বোধ ও যুক্তিপূর্ণ বিন্যাসের ভিত্তি গড়ে দেয় দৃঢ় প্রত্যয়ে।

হোসে এচেগারাইয়ের নাটকগুলোতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে নৈতিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক চাপ ও আত্মবিরোধী আবেগ। তাঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাটক এল গ্রান গালেওতো (El gran Galeoto) সমাজ কীভাবে মানুষের জীবন ধ্বংস করতে পারে সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে গঠিত। এই নাটকটি প্রকাশ করে সমাজের গুজব ও সন্দেহ কীভাবে মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান নষ্ট করতে পারে। নাটকে আমরা দেখি, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও মর্যাদার ওপর আঘাত হানে। এ এক সামাজিক ট্র্যাজেডি যেখানে বাস্তবতা ও ভ্রান্তি একসাথে হাত ধরে চলে। যেমন: “The great galeoto is not a person but society itself, which turns a whisper into thunder.”- অর্থাৎ বৃহৎ গালেওতো কোনো ব্যক্তি নয়, বরং গোটা সমাজ, যা একটি কানাঘুষাকেই বজ্রনিনাদে পরিণত করে।

হোসে এচেগারাই ১৮৭৪ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কালে বেশ কিছু গভীর অর্থবহ নাটক রচনা করেন। তাঁর নাট্যকর্মে নৈতিক দ্বন্দ্ব, সমাজের চাপ, ধর্মীয় ভাবনা ও ব্যক্তি-আত্মবিশ্বাসের সংঘর্ষ বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর আলোকিত সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে La esposa del vengador (প্রতিশোধগ্রহীতার স্ত্রী)- ১৮৭৪, En el puño de la espada (তলোয়ারের মুঠোয়)- ১৮৭৫, Locura o santidad (উন্মাদনা না পবিত্রতা)- ১৮৭৬, El gran galeoto (বড় গালেওতো)- ১৮৮১।

হোসে এচেগারাইয়ের বিখ্যাত নাটক El gran Galeoto (১৮৮১) মূলত সামাজিক গুজব, অপবাদ ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের অবদমিত কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী রূপক চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছে। এটি প্রকৃতঅর্থে নাটকের কেন্দ্রীয় দর্শনকে ধারণ করে। এটি শুধু স্পেনে নয়, সমগ্র ইউরোপে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল এবং পরে এটি চলচ্চিত্রে রূপায়িতও হয়। এই নাটকের একটি উক্তি স্প্যানিশ নাট্যসাহিত্যে সামাজিক নৈতিকতা এবং গুজব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক অনন্য প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে চিহ্নিত : “Truth, when imprisoned, roars louder than lies in freedom.” অর্থাৎ সত্য যখন বন্দী থাকে, তখন তার গর্জন মুক্ত মিথ্যার চেয়েও প্রলয়ংকারী হয়।

তাঁর নাটকে রয়েছে স্প্যানিশ রোমান্টিকতাবাদের প্রভাব, আবার একধরনের বাস্তবতাও। এই দুইয়ের মিশ্রণ তাঁকে অভিনব করে তোলে। একদিকে তিনি নৈতিকতা ও প্রেম নিয়ে রোমান্টিক দ্বন্দ্বে প্রবেশ করেন, অপরদিকে সমাজ ও ধর্মীয় কাঠামোর সংকটে বাস্তবিক বিশ্লেষণ হাজির করেন। আধুনিক নাট্যকার যেমন ইবসেন বা শা তাঁদের নাটকে যেমন সমাজ সংস্কার ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এচেগারাইও নায়িকাদের মানসিক দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তকে জটিলভাবে উপস্থাপন করেছেন। নারীর চরিত্র এচেগারাইয়ের নাটকে স্বয়ংক্রিয় নয়, চিন্তাশীল।

সমসাময়িক অনেক সমালোচক মনে করেছিলেন, এচেগারাইয়ের ভাষা ছিল ভারি ও অলংকারবহুল। কিন্তু আধুনিক থিয়েটারের দিকে তাকালে দেখা যায়- এই জটিলতা নাটকের গভীরতা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। তাঁর নাটক একটি চিহ্ন হয়ে থাকে, যেখানে দর্শক/পাঠককে দার্শনিক অন্বেষণে বাধ্য করা হয়। এই দার্শনিক নাট্যশৈলীর রূপান্তরেই আধুনিক থিয়েটার ‘চিন্তার ক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছে।

প্রকৃতঅর্থেই এচেগারাইয়ের নাট্যশৈলীতে ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ও গাণিতিক কাঠামোর ছাপ। তাঁর নাটকে সংলাপ থাকে বিশ্লেষণধর্মী, চরিত্রেরা দাঁড়িয়ে থাকে নৈতিক দ্বন্দ্বের মুখে, যেন গণিতের সমস্যার মতো করে তার সমাধান বের করা হচ্ছে উদাহরণস্বরূপ, “O locura o santidad” নাটকে তিনি দেখান কীভাবে ধর্মীয় নিষ্ঠা ও মানসিক অস্থিরতার সীমারেখা মুছে যেতে; যদিও আধুনিক নাট্যে এচেগারাইয়ের অলংকারময় ভাষা ও জটিল বিন্যাসের কদর কিছুটা কমে গেছে, তাঁর নাটকের নৈতিক প্রশ্নাবলি এখনো সময়োচিত। তাঁর নাটকগুলো বহুমাত্রিক গবেষণায়, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও মানবিক শাস্ত্রের মিলনস্থলে নতুন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

স্পেনের দার্শনিক মিগুয়েল দে উনামুনো, যদিও তাঁর ভাষা ও নাট্যশৈলী নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন, তবুও বলেছিলেন: “Echegaray es un titán de otra época—un dramaturgo que escribe con ecuaciones y demuestra con pasión.” অর্থাৎ “এচেগারাই এক প্রাচীন যুগের দানব- তিনি সমীকরণে লেখেন এবং আবেগ দিয়ে প্রমাণ করেন।” আবার হুয়ান ভ্যালেরা (Juan Valera), একজন সমালোচক ও সাহিত্যিক, তিনি বলেন : “Aunque su estilo sea recargado, nadie puede negar la fuerza ética de su teatro.” অর্থাৎ যদিও তাঁর ভাষাশৈলী কিছুটা ভারী, তবে তাঁর নাটকের নৈতিক শক্তিকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আর এই বক্তব্য এচেগারাইয়ের ভাষাশৈলীর পাশাপাশি তাঁর থিমেটিক গম্ভীরতার প্রতিও ইঙ্গিত দেয়।

১৯০৪ সালে হোসে এচেগারাই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, ফ্রান্সের অক্সিটান ভাষার কবি ফ্রেদেরিক মিস্ত্রালের সঙ্গে যৌথভাবে। তিনিই প্রথম স্পেনীয় যিনি এই মহোৎকৃষ্ট স্বীকৃতি লাভ করেন। নোবেল কমিটি তাঁর নাট্যসাহিত্যে নৈতিক শক্তি, সমাজ বিশ্লেষণ এবং সাহিত্যিক গভীরতার স্বীকৃতি প্রদান করে উল্লেখ করে বলেন: “EchegarayÕs plays remind us that drama can be a philosophical battleground—an equation between conscience and consequence., ১৯০৪. অর্থাৎ তাঁর অসংখ্য এবং দীপ্তিমান রচনার জন্য, যেগুলো নিজস্ব এবং মৌলিক ভঙ্গিতে স্পেনীয় নাট্যকলার মহান ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

হোসে এচেগারাই প্রমাণ করেছেন যে একজন বিজ্ঞানীও হতে পারেন এক বিশিষ্ট নাট্যকার। তাঁর রচনায় যেমন সমাজ-মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ, তেমনি এক নাট্যনির্মাতার মুন্সিয়ানা। আজকের বিশ্বে যখন সামাজিক ন্যায়বিচার, সত্য ও মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন এচেগারাইয়ের নাটক আবার নতুন করে পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবন ও সাহিত্য আমাদের শেখায় যে শিল্প মানে কেবল রূপক বা বিনোদন নয়- শিল্প এক সামাজিক অস্ত্র, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রবল ভাষ্য হতে পারে। José Echegaray-এর নাটক তাই শুধু স্পেনের নয়, সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের অংশ।

হোসে এচেগারাইয়ের নাট্যধারা পরবর্তীতে ইউরোপীয় নাট্যচর্চায় (বিশেষত ট্র্যাজেডিতে) গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর দার্শনিক দ্বন্দ্ব-নির্ভর নাটক আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক নাটকের পূর্বসূরি বলা চলে। আধুনিক নাট্যকার যেমন জাঁ পল সার্ত্র বা স্যামুয়েল বেকেট নাটকে যে অস্তিত্ববাদী দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করেছেন, তার অঙ্কুর সন্ধান করা যায় এচেগারাইয়ের নাট্যকথায়। আধুনিক নাট্য সমালোচক জেমস ফিটজমরিস (James Fitzmorris), বলেন : “EchegarayÕs plays remind us that drama can be a philosophical battleground—an equation between conscience and consequence.” অর্থাৎ এচেগারাইয়ের নাটক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নাট্যশিল্প হতে পারে এক দার্শনিক যুদ্ধক্ষেত্র- যেখানে বিবেক ও পরিণামের মাঝে চলে সমীকরণ।

হোসে এচেগারাইয়ের নাট্যধারা ছিল যুগান্তকারী। তিনি নাটকের মঞ্চে এনে দিয়েছেন যুক্তির আলো, নৈতিক প্রশ্ন, এবং আবেগের স্বর। তাঁর নাটক শুধুই কাহিনি নয়- এগুলো একেকটি নৈতিক পরীক্ষাগার, যেখানে চরিত্ররা নিজের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। আধুনিক নাট্যচর্চার গভীর স্তর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এচেগারাই এক মৌলিক সেতুবন্ধন- যিনি অতীতের নাট্যরীতি ও আধুনিক নাটকের দার্শনিক চেতনার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।

হোসে এচেগারাই দেখিয়ে দিয়েছেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য পরস্পরের পরিপূরক। নাট্যকার হিসেবে তাঁর ভূমিকা শুধু স্পেন নয়, গোটা বিশ্বের নাট্যচর্চার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। তিনি একদিকে ছিলেন গণিতজ্ঞ, অন্যদিকে একজন দার্শনিক শিল্প¯্রষ্টা। তাঁর নাটক মানুষকে আত্মবিশ্লেষণে বাধ্য করে, প্রশ্ন তোলে- এই সমাজ কতটা ন্যায়বিচার, কতটা মানবিক? এই প্রশ্ন আজও উত্তর খোঁজে, আর তাই হোসে এচেগারাই-এর নাট্যনির্মাণ আজও অমলিন, আধুনিক ও চিন্তনশীলতার প্রতীক। তাঁর কাজ এখনো নাট্যবিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

tab

সাময়িকী

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

যাকিয়া সুমি সেতু

হোসে এচেগারাই

বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫

হোসে এচেগারাই (১৮৩২-১৯১৬) হলেন এক ব্যতিক্রমী স্প্যানিশ মনীষী যিনি সাহিত্যে এবং বিজ্ঞানে সমান দক্ষতায় অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন প্রথম স্প্যানিশ নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক, যাঁর নাট্যকর্মে একাধারে দর্শন, গণিতীয় যুক্তি ও সামাজিক মূল্যবোধের জটিল দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, পুরপ্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি একজন খ্যাতনামা নাট্যকার। তাঁর নাট্যকর্মে যেমন যুক্তির শৃঙ্খলা, আবেগের বিস্ফোরণ; তেমন দর্শনের গাম্ভীর্য, মানবিক বেদনাবোধের আবেশ।

হোসে এচেগারাই ই ইসাগুইরে ১৮৩২ সালের ১৯ এপ্রিল স্পেনের মাদ্রিদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা, হোসে এচেগারাই, ছিলেন সরকারি রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা, এবং মাতা মারিয়া ইসাগুইরে ছিলেন এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। হোসে এচেগারাইয়ের স্ত্রী ছিলেন সুন্দরী, যাঁর সৌন্দর্য সম্পর্কে স্পেনের রাজা আমাদেও দে সাবোয়া মন্তব্য করেছিলেন: “স্পেনের সবচেয়ে সুন্দর দুটি জিনিস হলো বার্গোস ক্যাথেড্রাল ও হোসে এচেগারাইয়ের স্ত্রী”। তাঁদের সংসারে ছিল দু’জন সন্তান- আনা (Ana), তিনি বিবাহিত ছিলেন এবং তিনটি সন্তানের জননী। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি অল্প বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন। অন্যজন মানুয়েল (Manuel), তিনি অবিবাহিত ছিলেন এবং সারা জীবন একা কাটিয়েছেন। হোসে এচগারাইয়েরমৃত্যু হয় ১৯১৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, মাদ্রিদের সান ইসিদ্রো সমাধিক্ষেত্রে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

শৈশব থেকেই হোসে এচেগারাইয়ের মধ্যে ছিল বিজ্ঞান ও সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ। তিনি মাদ্রিদের ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল (Escuela Técnica Superior de Ingenieros de Caminos, Canales y Puertos) থেকে মাত্র বিশ বছর বয়সে সেরা ফলাফলে স্নাতক হন এবং পরে গণিত ও প্রকৌশলে অধ্যাপনা শুরু করেন। জীবনের শুরুতে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পরবর্তীতে স্পেনের সরকারে মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তবে, তার প্রকৃত খ্যাতি আসে সাহিত্যবিশ্বে। এভাবে তাঁর জ্ঞাননিষ্ঠ জীবনের পরিধির সূচনা ও বিস্তৃতি ঘটে। তবে এর জন্য ছিল গভীর অনুশীলন। সেজন্য তিনি নিয়মিত স্পেনের জাতীয় গ্রন্থাগার Biblioteca Nacional de España ব্যবহার করতেন, যেখানে তিনি দর্শন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বই অধ্যয়ন করতেন। এই পড়াশোনাই তাঁর নাটকে গভীর বোধ ও যুক্তিপূর্ণ বিন্যাসের ভিত্তি গড়ে দেয় দৃঢ় প্রত্যয়ে।

হোসে এচেগারাইয়ের নাটকগুলোতে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে নৈতিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক চাপ ও আত্মবিরোধী আবেগ। তাঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ নাটক এল গ্রান গালেওতো (El gran Galeoto) সমাজ কীভাবে মানুষের জীবন ধ্বংস করতে পারে সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে গঠিত। এই নাটকটি প্রকাশ করে সমাজের গুজব ও সন্দেহ কীভাবে মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান নষ্ট করতে পারে। নাটকে আমরা দেখি, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও মর্যাদার ওপর আঘাত হানে। এ এক সামাজিক ট্র্যাজেডি যেখানে বাস্তবতা ও ভ্রান্তি একসাথে হাত ধরে চলে। যেমন: “The great galeoto is not a person but society itself, which turns a whisper into thunder.”- অর্থাৎ বৃহৎ গালেওতো কোনো ব্যক্তি নয়, বরং গোটা সমাজ, যা একটি কানাঘুষাকেই বজ্রনিনাদে পরিণত করে।

হোসে এচেগারাই ১৮৭৪ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত সময়কালে বেশ কিছু গভীর অর্থবহ নাটক রচনা করেন। তাঁর নাট্যকর্মে নৈতিক দ্বন্দ্ব, সমাজের চাপ, ধর্মীয় ভাবনা ও ব্যক্তি-আত্মবিশ্বাসের সংঘর্ষ বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর আলোকিত সাহিত্য কর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে La esposa del vengador (প্রতিশোধগ্রহীতার স্ত্রী)- ১৮৭৪, En el puño de la espada (তলোয়ারের মুঠোয়)- ১৮৭৫, Locura o santidad (উন্মাদনা না পবিত্রতা)- ১৮৭৬, El gran galeoto (বড় গালেওতো)- ১৮৮১।

হোসে এচেগারাইয়ের বিখ্যাত নাটক El gran Galeoto (১৮৮১) মূলত সামাজিক গুজব, অপবাদ ও মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের অবদমিত কিন্তু ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী রূপক চিত্র এতে তুলে ধরা হয়েছে। এটি প্রকৃতঅর্থে নাটকের কেন্দ্রীয় দর্শনকে ধারণ করে। এটি শুধু স্পেনে নয়, সমগ্র ইউরোপে বহুল প্রশংসিত হয়েছিল এবং পরে এটি চলচ্চিত্রে রূপায়িতও হয়। এই নাটকের একটি উক্তি স্প্যানিশ নাট্যসাহিত্যে সামাজিক নৈতিকতা এবং গুজব সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক অনন্য প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে চিহ্নিত : “Truth, when imprisoned, roars louder than lies in freedom.” অর্থাৎ সত্য যখন বন্দী থাকে, তখন তার গর্জন মুক্ত মিথ্যার চেয়েও প্রলয়ংকারী হয়।

তাঁর নাটকে রয়েছে স্প্যানিশ রোমান্টিকতাবাদের প্রভাব, আবার একধরনের বাস্তবতাও। এই দুইয়ের মিশ্রণ তাঁকে অভিনব করে তোলে। একদিকে তিনি নৈতিকতা ও প্রেম নিয়ে রোমান্টিক দ্বন্দ্বে প্রবেশ করেন, অপরদিকে সমাজ ও ধর্মীয় কাঠামোর সংকটে বাস্তবিক বিশ্লেষণ হাজির করেন। আধুনিক নাট্যকার যেমন ইবসেন বা শা তাঁদের নাটকে যেমন সমাজ সংস্কার ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এচেগারাইও নায়িকাদের মানসিক দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তকে জটিলভাবে উপস্থাপন করেছেন। নারীর চরিত্র এচেগারাইয়ের নাটকে স্বয়ংক্রিয় নয়, চিন্তাশীল।

সমসাময়িক অনেক সমালোচক মনে করেছিলেন, এচেগারাইয়ের ভাষা ছিল ভারি ও অলংকারবহুল। কিন্তু আধুনিক থিয়েটারের দিকে তাকালে দেখা যায়- এই জটিলতা নাটকের গভীরতা বাড়াতে সহায়ক হয়েছে। তাঁর নাটক একটি চিহ্ন হয়ে থাকে, যেখানে দর্শক/পাঠককে দার্শনিক অন্বেষণে বাধ্য করা হয়। এই দার্শনিক নাট্যশৈলীর রূপান্তরেই আধুনিক থিয়েটার ‘চিন্তার ক্ষেত্র’ হয়ে উঠেছে।

প্রকৃতঅর্থেই এচেগারাইয়ের নাট্যশৈলীতে ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি ও গাণিতিক কাঠামোর ছাপ। তাঁর নাটকে সংলাপ থাকে বিশ্লেষণধর্মী, চরিত্রেরা দাঁড়িয়ে থাকে নৈতিক দ্বন্দ্বের মুখে, যেন গণিতের সমস্যার মতো করে তার সমাধান বের করা হচ্ছে উদাহরণস্বরূপ, “O locura o santidad” নাটকে তিনি দেখান কীভাবে ধর্মীয় নিষ্ঠা ও মানসিক অস্থিরতার সীমারেখা মুছে যেতে; যদিও আধুনিক নাট্যে এচেগারাইয়ের অলংকারময় ভাষা ও জটিল বিন্যাসের কদর কিছুটা কমে গেছে, তাঁর নাটকের নৈতিক প্রশ্নাবলি এখনো সময়োচিত। তাঁর নাটকগুলো বহুমাত্রিক গবেষণায়, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও মানবিক শাস্ত্রের মিলনস্থলে নতুন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

স্পেনের দার্শনিক মিগুয়েল দে উনামুনো, যদিও তাঁর ভাষা ও নাট্যশৈলী নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন, তবুও বলেছিলেন: “Echegaray es un titán de otra época—un dramaturgo que escribe con ecuaciones y demuestra con pasión.” অর্থাৎ “এচেগারাই এক প্রাচীন যুগের দানব- তিনি সমীকরণে লেখেন এবং আবেগ দিয়ে প্রমাণ করেন।” আবার হুয়ান ভ্যালেরা (Juan Valera), একজন সমালোচক ও সাহিত্যিক, তিনি বলেন : “Aunque su estilo sea recargado, nadie puede negar la fuerza ética de su teatro.” অর্থাৎ যদিও তাঁর ভাষাশৈলী কিছুটা ভারী, তবে তাঁর নাটকের নৈতিক শক্তিকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। আর এই বক্তব্য এচেগারাইয়ের ভাষাশৈলীর পাশাপাশি তাঁর থিমেটিক গম্ভীরতার প্রতিও ইঙ্গিত দেয়।

১৯০৪ সালে হোসে এচেগারাই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন, ফ্রান্সের অক্সিটান ভাষার কবি ফ্রেদেরিক মিস্ত্রালের সঙ্গে যৌথভাবে। তিনিই প্রথম স্পেনীয় যিনি এই মহোৎকৃষ্ট স্বীকৃতি লাভ করেন। নোবেল কমিটি তাঁর নাট্যসাহিত্যে নৈতিক শক্তি, সমাজ বিশ্লেষণ এবং সাহিত্যিক গভীরতার স্বীকৃতি প্রদান করে উল্লেখ করে বলেন: “EchegarayÕs plays remind us that drama can be a philosophical battleground—an equation between conscience and consequence., ১৯০৪. অর্থাৎ তাঁর অসংখ্য এবং দীপ্তিমান রচনার জন্য, যেগুলো নিজস্ব এবং মৌলিক ভঙ্গিতে স্পেনীয় নাট্যকলার মহান ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।

হোসে এচেগারাই প্রমাণ করেছেন যে একজন বিজ্ঞানীও হতে পারেন এক বিশিষ্ট নাট্যকার। তাঁর রচনায় যেমন সমাজ-মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ, তেমনি এক নাট্যনির্মাতার মুন্সিয়ানা। আজকের বিশ্বে যখন সামাজিক ন্যায়বিচার, সত্য ও মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ, তখন এচেগারাইয়ের নাটক আবার নতুন করে পাঠযোগ্য হয়ে উঠেছে। তাঁর জীবন ও সাহিত্য আমাদের শেখায় যে শিল্প মানে কেবল রূপক বা বিনোদন নয়- শিল্প এক সামাজিক অস্ত্র, যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রবল ভাষ্য হতে পারে। José Echegaray-এর নাটক তাই শুধু স্পেনের নয়, সমগ্র বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের অংশ।

হোসে এচেগারাইয়ের নাট্যধারা পরবর্তীতে ইউরোপীয় নাট্যচর্চায় (বিশেষত ট্র্যাজেডিতে) গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর দার্শনিক দ্বন্দ্ব-নির্ভর নাটক আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক নাটকের পূর্বসূরি বলা চলে। আধুনিক নাট্যকার যেমন জাঁ পল সার্ত্র বা স্যামুয়েল বেকেট নাটকে যে অস্তিত্ববাদী দ্বন্দ্ব উপস্থাপন করেছেন, তার অঙ্কুর সন্ধান করা যায় এচেগারাইয়ের নাট্যকথায়। আধুনিক নাট্য সমালোচক জেমস ফিটজমরিস (James Fitzmorris), বলেন : “EchegarayÕs plays remind us that drama can be a philosophical battleground—an equation between conscience and consequence.” অর্থাৎ এচেগারাইয়ের নাটক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে নাট্যশিল্প হতে পারে এক দার্শনিক যুদ্ধক্ষেত্র- যেখানে বিবেক ও পরিণামের মাঝে চলে সমীকরণ।

হোসে এচেগারাইয়ের নাট্যধারা ছিল যুগান্তকারী। তিনি নাটকের মঞ্চে এনে দিয়েছেন যুক্তির আলো, নৈতিক প্রশ্ন, এবং আবেগের স্বর। তাঁর নাটক শুধুই কাহিনি নয়- এগুলো একেকটি নৈতিক পরীক্ষাগার, যেখানে চরিত্ররা নিজের বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়ায়। আধুনিক নাট্যচর্চার গভীর স্তর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এচেগারাই এক মৌলিক সেতুবন্ধন- যিনি অতীতের নাট্যরীতি ও আধুনিক নাটকের দার্শনিক চেতনার মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।

হোসে এচেগারাই দেখিয়ে দিয়েছেন, বিজ্ঞান ও সাহিত্য পরস্পরের পরিপূরক। নাট্যকার হিসেবে তাঁর ভূমিকা শুধু স্পেন নয়, গোটা বিশ্বের নাট্যচর্চার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায়। তিনি একদিকে ছিলেন গণিতজ্ঞ, অন্যদিকে একজন দার্শনিক শিল্প¯্রষ্টা। তাঁর নাটক মানুষকে আত্মবিশ্লেষণে বাধ্য করে, প্রশ্ন তোলে- এই সমাজ কতটা ন্যায়বিচার, কতটা মানবিক? এই প্রশ্ন আজও উত্তর খোঁজে, আর তাই হোসে এচেগারাই-এর নাট্যনির্মাণ আজও অমলিন, আধুনিক ও চিন্তনশীলতার প্রতীক। তাঁর কাজ এখনো নাট্যবিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।

back to top