alt

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

আনিসুজ জামান

: বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

Als Gregor Samsa eines Morgens aus unruhigen Traumen erwachte, fand er sich in seinem Bett zu einm ungeheueren Ungeziefer verwandelt.

- দাদা, ভগবান আর আল্লাহর মধ্যে কার শক্তি বেশি?

- কেন নানাভাই?

- তাতা যে কয়, এই দুইজনে খালি ঝগড়া করে!

তাতাকে ছুঁয়ে দিলে ছুটে যেত স্নানে- কাইয়ার-আ-া আমগাছটার পাশ দিয়ে বকুলতলার ঝরাফুল মাড়িয়ে মাইটালে নেমে কচুরিপানা সরিয়ে কোনো মতে একটা ডুব দিলেই হতো। আবার যেন এই নচ্ছার ছেলেটা ছুঁয়ে না দেয়, খুব সাবধানে থাকতে হতো তাতাকে। কিন্তু আমিও ছিলাম তাতার ভীষণ ন্যাওটা, সব সময় আশেপাশে ছোঁক ছোঁক করতাম, একদম আমাদের মিনি বিড়ালটার মতো, সুযোগ পেলেই গা ঘষাঘষি। ওঁর গায়ের গন্ধটা, পরনের সাদা থান কাপড়, স্তনসহ ঝুলে পড়া চামড়া, সব কিছুই অন্যরকম। খুব ছোটবেলায় ওই স্তন খেয়েছি- আমি একটা, ময়না আরেকটা। পেট ভরতো কিনা জানি না, মন ভরতো, না হলে কান্না থামত কেন! মা আর পারুল খালা, মানে ময়নার মা, তাতার কাছে আমাদেরকে রেখে পাড়া বেড়াতে যেত। তাতাই আমাদের রাখত। আগলে রাখত যেন স্বপন মামা না মারতে পারে। মামা আমাদের থেকে বছর তিনেকের বড়, ছুতো পেলেই পেটাতো।

ভোরে উঠান নিকিয়ে, ঘসি দিয়ে গাভী দুটোকে গোয়াল থেকে বের করলে পারুল খালা দুধ দোয়াতো। ‘এই আমি মাসি, খালা খালা করবি না’, খালা বলত, মা বলত তোর যা ইচ্ছে ডাকবি। আমার খালাই ভালো, মাসি কেমন পরপর!

- ওই বাছুরটার জন্য কিন্তু রাখিস, সব আবার দুয়াইস না, তাতা গরু বের করে বাঁধতে বাঁধতে বলত।

তারপর সে স্নান করত, আমি মাঝে মাঝে নিরালা সাবান এগিয়ে দিতাম ঘাট থেকে। সে হাত পাতলে ওপর থেকে সাবানটা এমনভাবে দিতে হতো যাতে ছোঁয়া না লাগে। এরই মধ্যে সে সব মন্তর জপে রামরাম বলে ফেলেছে, আর ছোঁয়া যাবে না। অনেকবারই বিপত্তি হতো, হাত থেকে পিছলে সাবান পানিতে পড়ে গেলে আমাকেই ডুব দিয়ে তুলে আনতে হতো। এত সকালে ময়না জলে নামতে চাইত না। আমি ডুব দিয়ে সাবান খুঁজছি আর শয়তানটা ঘাটে বসে হাসছে। একমাত্র স্নানের আগেই তাতাকে জড়িয়ে ধরা যেত। তবে ময়না যখন তখন ছুঁতে পারতো, আমি ছুঁলেই সমস্যা!

আমার নানিকে দিদি ডাকত তাতা, নানাকে মৌলভী সাব। নানা ছিলেন ইব্রাহীমপুর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, আলিয়া মাদ্রাসায় উলা জামাত পাস। সারাজীবন ওরকমই শুনেছি। পদ্মায় রামকৃষ্ণপুরের বাড়ি ভেঙে নিলে নানা দুই শরিকের একজনের কাছ থেকে এই বাড়িটা কিনেছিলেন। সেই দাদা সব নানার কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে।

তাতা বিধবা হয়েছে অনেক আগে। মা’র মুখে শোনা সতীদাহ প্রথা রদ হবার জন্য আমি সব রাজাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাতাম আর তাতা ওদের গুষ্ঠি উদ্ধার করত, ‘ক্যান যে হ্যার লগে আমারে চিতায় দিল না, হারামজাদা, গু-খাকি’। অদৃশ্য কাউকে গালাগাল দিত। আমরা দুই শরিকে মিলেমিশে থাকতাম। পাড়া ঘুরে বিলেতি গাব, আম চাইলতা, বেথুল, কলা জোগাড় করে বকা খেতাম তাতার কাছে, কিন্তু ফলারটা সে ওগুলো দিয়েই সারতো। জবাফুল, বেলপাতা ওসবের জোগাড়ও আমাকেই করতে হতো। কিন্তু বুঝতাম না কেন আমার ছোঁয়া সানকিটা ওদের রসুইঘরে ঢোকানো যাবে না, বারান্দার চাতালে গুঁজে রাখতে হবে! একবার তাতার সানকিতে জুলাভাতি খেয়ে মা’র হাতে পিটুনি খেয়েছিলাম। পরে ওটি গোবর দিয়ে মেজে শুদ্ধ করতে হয়েছিল- কাঁসার সানকি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না, মাটির হলে কথা ছিল!

আমাদের ঈদ আর ওদের পূজাপার্বণ, দারুণ কাটত দিনগুলো! না চেয়ে তাতাদের বাগান থেকে কোনো ফল খাওয়া ছিল একদম বারণ। দুই বাড়ির সীমানার বড়ইগাছটা নিয়ে ছিল সব চেয়ে বড় বিপত্তি। গাছের গুঁড়িটাও যেমন, ডালপালাগুলোও তেমনি- দুই বাড়িতে গিয়েই পড়েছে, মাটির নিচের শিকড়ও হয়তবা তাই-ই। কিন্তু তারপরও কেন যেন ওদের ভাগের বড়ইগুলো ছিল ভীষণ মিষ্টি, অন্যদিকে স্বপন মামা খেত আমাদের ভাগেরটা। কেন যে, আজও জানি না। এ নিয়ে হতো ভীষণ ঝগড়া। একবার তো তাতা আর নানা মিলে গাছটা কেটেই ফেলতে চেয়েছিল। শত কাঁটার ঘা খেয়েও বরই পাড়ার জন্য গাছে চড়তাম। গাছের উপরেই মামার সঙ্গে হাতাহাতি হলে আমি পড়ে গিয়েছিলাম, তবে পা ভাঙেনি, ডান পা’টা একটু মচকে গিয়েছিল, শুয়ে থাকতে হয়েছিল কয়েক দিন। সেই থেকে দুই শরিকের মন কষাকষির শুরু।

আল্লাহ্? বড় না ভগবান বড়- প্রশ্নটা করেছিলাম সেই সময়টাতে। স্কুল থেকে ফিরে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা। আমি জানালায় হেলান দিয়ে বাঁশের চটি দিয়ে বাঁধা ডান পা ছড়িয়ে আধশোয়া হয়ে কথা বলছিলাম। প্রশ্ন শুনে নানা রাগ করেছিলেন। কী সব আবোল-তাবোল কথা, উনি বলেছিলেন।

আবোল তাবোল! ভেবেছিলাম। তাহলে তাতাকে ছোঁয়া যাবে না কেন, পুজোর প্রসাদ খাওয়া যাবে কেন, কুত্তায় চাটলে গোবর লাগবে না, মসুলমান ছুঁলে লাগবে কেন, স্বপন মামার মসুলমানি হবে না কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। দাদা সব জানতে পারেন, কিন্তু এ ব্যাপারটা জানেন না- ভগবান আর আল্লাহ্? যে আকাশে প্রতিদিন পাছড়া-পাছড়ি করে এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহই ছিল না। হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু জানেন না ধরে নিয়ে উনাকে বোঝাতে গিয়ে ধমক খেয়েছিলাম। নানাকে এর আগে কখনই রাগ করতে দেখিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন। উনি রাগ করে তাতাকে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়ের মাথা খাওয়া নিয়ে কী সব বলেছিলেন! সম্পর্ক ক্রমশই খারাপ হচ্ছিল। মা আর পারুল খালার মধ্যেও তখন ঠিকমত কথা হতো না।

তবে একাত্তরে সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আমার বয়স তখন দশ। ভটভটি থেকে নেমে মিলিটারিরা বাড়িতে এসেছিল হিন্দুর খোঁজে। দাদা বলেছিলেন, ‘এটা তো মসুলমানের বাড়ি। আপনারা এখানে কেন?’ আলাপ উর্দুতে হলেও বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। নানার পেছনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম, কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে হেঁটে আসার সময় চোখে পড়া বীভৎস দৃশ্য চোখের সামনে নাচানাচি করছিল।

- ভেতরে ঢুকতে দিন, চড়া গলায় আদেশ দিচ্ছিল ওদের নেতা।

- তোমার দেশে তোমার ঘরে মা-বোনের পর্দা নষ্ট করে আমাকে ঢুকতে দেবে?

- তোমার ঘরে হিন্দু লুকিয়ে নেই? ঢুকতে দাও, দেখব।

- ঘরে ঢুকতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে, বলেছিলেন চুন্নু মৌলভী।

অনেক সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ওরা চলে গিয়েছিল। এরও তিন দিন তিন রাত পর তাতা, ময়না, পারুল খালা নেমে এসেছিল আমাদের পাটাতন থেকে। স্বপন মামা যুদ্ধে গিয়েছিল অথবা হারিয়ে গিয়েছিল, আর কখনো ফেরেনি।

- ওই ময়না, এদিকে আয়, চোকিতে বয়।

- না, এইখানেই কও।

- আরে, আরে, দেখ দেখ, একটা ঝিঁঝিঁ পোকা আরেকটার সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলতাছে।

- ঘোড়া না ছাই, ওরা বিয়া করছে। তুই কিচ্ছু বুজস না।

- পোকায় আবার বিয়া করে নাকি?

- তাইলে পোলাপান হয় ক্যামনে?

পোলাপান হওয়ার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কটা মাথায় আসছিল না। ইদানীং মেয়েটা অনেক কিছু বোঝে, আমার থেকে অনেক বেশি, ইঁচড়েপাকা, কিন্তু আমি যে কিছু বুঝিনি তা ওকে জানতে দেওয়া যাবে না। সব জান্তার চেহারা করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি, ওই বয়ামটা আন।

ও মাচার ওপর থেকে কাচের বয়ামটা এনে হাতে দেয়। আমার মচকানো পা তখন ভালো হতে শুরু করেছে, কিছু একটা ভর দিয়ে হাঁটতে পারলেও বিছানাতেই থাকি।

- কী করবি? জিজ্ঞেস করে।

কিছু বলি না। ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, টিনের চালের ফুটো গলে ঢোকা এক বিন্দু রোদ ওর কপোলে গোপনে চুমু খাচ্ছিল, মেয়েটা খুব দ্রুতই বদলে যাচ্ছে, ভেবেছিলাম।

- আজ, যাই রে, কাল আসব, ছোট মামার দেখাদেখি আমরাও মাঝে মাঝে শুদ্ধ কথা বলার চেষ্টা করছিলাম।

- আরেকটু বোস।

- নাহ্, আজ না। বলে চলে গিয়েছিল।

সেদিন ধীরে ধীরে দরজা খুলে ঢুকেছিল ময়না। প্রায় দিনে এই সময়টাতেই আসে। স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়ার ঠিক আগে এক ঝলক দেখে যায়।

- আয়, বয়, চোকিতে বয়। বসবে না জেনেও বলি।

কিছু না বলে ও জলচৌকি টেনে বসে।

‘দেখ কী ধরছি, বলে বয়ামটা উঁচু করে দেখাই, ভেতরে দুটি ঝিঁঝিঁ পোকা, চুপ করে বসে আছে।

- ছাড়, ছাড় বলে আঁতকে ওঠে ও, অকারণে জীবহত্যা পাপ, বলে।

- শোন, কালকে ছোটমামা আর মা গল্প করছিল। আমি এই ঘর থেকে শুনেছি। জার্মান দেশে কোনো এক গ্রেগরি নাকি ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গিয়েছে!

- ধুর।

- মা’ও তাই কয়। বিশ্বাস করে না। কিন্তু মামা কয় ক্যামনে ক্যামনে বলে মানুষও পোকা হইয়া যায়। কী কী কইতেছিল, বুঝি নাই। শক্ত শক্ত কথা। তাই এই দুইটারে ধরছি। দেখুম এইডি মানুষ অয় নি।

- তুই একটা পাগল, ঝিঁঝিঁপোকা মানুষ হইব ক্যামনে!

- মানুষ পোকা হইলে, পোকার মানুষ হইতে সমস্যা কী? মামায় কইছে, ইউরোপের সেলতা আদিবাসীরা বিশ্বাস করে মানুষ মইরা গিয়া ঝিঁঝিঁ পোকা হয়, তারপর আমাগো দেখতে আসে। দ্যাখ, এইডারে আমার নানার মতোন লাগে না?

- তুই এট্টা পাগল।

- আয় এদিকে আয়- বলে ওর হাত ধরে টান দিয়েছিলাম।

টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলেছিল, ‘তরে না কইছি, তোর লগে ঢলাঢলি করুম না। মায় দীপ্তি দিদিরে কইছে, মসুলমান পোলার সাথে ঢলাঢলি করলে আর বিয়া হইব না। তোর লগে মিশি দেইখ্যা স্কুলের পোলাপানে ক্ষ্যাপায়। আমার সই কইছে, তর লগে কথা না কইতে’।

- আমারেও তো ক্ষ্যাপায়। আমার কিচ্ছু হয় না। শালা গো ধরবার পারলে মাইর দেই।

- জানি, তুই খুব গোঁয়াড়।

- কিন্তু আমি তো তরে বিয়া করুম।

- গাধা, আমি তো হিন্দু; ক্যামনে করবি?

কিছু বলতে না পেরে মাথা চুলকাই। তাকের ওপর নানার তিলাপড়া সাদা টুপিটা আমার দিকে বিটলা হাসি মারে। রাগ হয়! মুখ ঘুরিয়ে ময়নার দিকে তাকাই, মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু করতে না পেরে আক্রোশে জানালার দিকে তাকাই কান্না চাপতে। জানালার শিকের ফাঁকে বয়ামের ভেতর থেকে আমার পরদাদা দুই ঠ্যাং দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।

- এই, ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গ্যালে হয় না? অগো তো আর জাতপাত নাই। মুখ ঘুরিয়ে বলি।

- ক্যামনে হমু? ছলছল চোখ তুলে ময়না বলে।

- খাড়া, ওই বয়ামটা দে।

বয়ামটার ভেতরে একটা পোকা ঢুকিয়ে ওর হাতে দিই, পরদাদি কিছুতেই পরদাদাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না।

- শোন, শোয়ার আগে এইটার দিকে এক নজরে চাইয়া থাকবি। আমিও আমরাটার দিকে চাইয়া থাকুম।

কিছু না বলে উজ্জ্বল মুখে ময়না চলে গিয়েছিল। আমি রাতের খাবার সময়টা বাদে তখন থেকেই পরদাদার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছিলাম।

পরদিন সকালে অস্বস্তিকর এক স্বপ্ন শেষে ঘুম ভেঙে দেখতে পেলাম আমি ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গেছি।

তলপেটের নিচে, না নুনুর মাথায় চিনচিনে ব্যথা। আমি ঘুমাতাম একা। পাশের চৌকিতে কাজের ছেলেটা নিথর হয়ে ঘুমাচ্ছে। একবার ঘুমালে ঠেলেও জাগানো যায় না। নিশ্চিন্তে হাফপ্যান্ট নামিয়ে পরীক্ষা করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠি : হায় আল্লাহ! আমি হিন্দু হয়ে গেছি, আমার মসুলমানি করা নুনুর মাথা বুজে গেছে। পায়ের ব্যথা ভুলে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দৌড়াই। ময়নাকে বলতে হবে। নিশ্চিত জানি, সামনের পুস্কুনির ঘাটে বসে কয়লা দিয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো মাজছে, ও নিমের ডালের তিতা সহ্য করতে পারে না।

- ময়না, ও ময়না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলাম।

ওর মুখও ভীষণ উজ্জ্বল। কী যেন বলবে বলবে করছে।

- আর চিন্তা নাই, আমি হিন্দু হইয়া গেছি। প্রায় নাচতে নাচতে বলি, পারলে প্যান্ট নামিয়ে নুনু দেখাই।

ওর মুখটা ধীরে ধীরে কালো হয়ে যায়, চোখ নামায়:

- কিন্তু, কিন্তু আমি যে মসুলমান হইছি। এখন কী হইব? আবার তো হিন্দু হওন যাইব না।

ছবি

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বিমল গুহের কবিতার অন্তর্জগৎ ও শিল্পৈশ্বর্য

ছবি

কবিতার সুনীল সুনীলের কবিতা

ছবি

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

ছবি

বাইরে একটা কিছু জ্বলছে

ছবি

‘কাফকার মতো হবো বলে আইন পড়েছিলাম’

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

ছবি

‘ভাষার আরোপিত কারুকাজে খেই হারিয়ে ফেলি’

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জিন্দা লাশ কি প্রকৃত লাশ

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষা দর্শন ও অলস দিনের হাওয়া

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

tab

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

আনিসুজ জামান

বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

Als Gregor Samsa eines Morgens aus unruhigen Traumen erwachte, fand er sich in seinem Bett zu einm ungeheueren Ungeziefer verwandelt.

- দাদা, ভগবান আর আল্লাহর মধ্যে কার শক্তি বেশি?

- কেন নানাভাই?

- তাতা যে কয়, এই দুইজনে খালি ঝগড়া করে!

তাতাকে ছুঁয়ে দিলে ছুটে যেত স্নানে- কাইয়ার-আ-া আমগাছটার পাশ দিয়ে বকুলতলার ঝরাফুল মাড়িয়ে মাইটালে নেমে কচুরিপানা সরিয়ে কোনো মতে একটা ডুব দিলেই হতো। আবার যেন এই নচ্ছার ছেলেটা ছুঁয়ে না দেয়, খুব সাবধানে থাকতে হতো তাতাকে। কিন্তু আমিও ছিলাম তাতার ভীষণ ন্যাওটা, সব সময় আশেপাশে ছোঁক ছোঁক করতাম, একদম আমাদের মিনি বিড়ালটার মতো, সুযোগ পেলেই গা ঘষাঘষি। ওঁর গায়ের গন্ধটা, পরনের সাদা থান কাপড়, স্তনসহ ঝুলে পড়া চামড়া, সব কিছুই অন্যরকম। খুব ছোটবেলায় ওই স্তন খেয়েছি- আমি একটা, ময়না আরেকটা। পেট ভরতো কিনা জানি না, মন ভরতো, না হলে কান্না থামত কেন! মা আর পারুল খালা, মানে ময়নার মা, তাতার কাছে আমাদেরকে রেখে পাড়া বেড়াতে যেত। তাতাই আমাদের রাখত। আগলে রাখত যেন স্বপন মামা না মারতে পারে। মামা আমাদের থেকে বছর তিনেকের বড়, ছুতো পেলেই পেটাতো।

ভোরে উঠান নিকিয়ে, ঘসি দিয়ে গাভী দুটোকে গোয়াল থেকে বের করলে পারুল খালা দুধ দোয়াতো। ‘এই আমি মাসি, খালা খালা করবি না’, খালা বলত, মা বলত তোর যা ইচ্ছে ডাকবি। আমার খালাই ভালো, মাসি কেমন পরপর!

- ওই বাছুরটার জন্য কিন্তু রাখিস, সব আবার দুয়াইস না, তাতা গরু বের করে বাঁধতে বাঁধতে বলত।

তারপর সে স্নান করত, আমি মাঝে মাঝে নিরালা সাবান এগিয়ে দিতাম ঘাট থেকে। সে হাত পাতলে ওপর থেকে সাবানটা এমনভাবে দিতে হতো যাতে ছোঁয়া না লাগে। এরই মধ্যে সে সব মন্তর জপে রামরাম বলে ফেলেছে, আর ছোঁয়া যাবে না। অনেকবারই বিপত্তি হতো, হাত থেকে পিছলে সাবান পানিতে পড়ে গেলে আমাকেই ডুব দিয়ে তুলে আনতে হতো। এত সকালে ময়না জলে নামতে চাইত না। আমি ডুব দিয়ে সাবান খুঁজছি আর শয়তানটা ঘাটে বসে হাসছে। একমাত্র স্নানের আগেই তাতাকে জড়িয়ে ধরা যেত। তবে ময়না যখন তখন ছুঁতে পারতো, আমি ছুঁলেই সমস্যা!

আমার নানিকে দিদি ডাকত তাতা, নানাকে মৌলভী সাব। নানা ছিলেন ইব্রাহীমপুর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, আলিয়া মাদ্রাসায় উলা জামাত পাস। সারাজীবন ওরকমই শুনেছি। পদ্মায় রামকৃষ্ণপুরের বাড়ি ভেঙে নিলে নানা দুই শরিকের একজনের কাছ থেকে এই বাড়িটা কিনেছিলেন। সেই দাদা সব নানার কাছে বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন ভারতে।

তাতা বিধবা হয়েছে অনেক আগে। মা’র মুখে শোনা সতীদাহ প্রথা রদ হবার জন্য আমি সব রাজাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানাতাম আর তাতা ওদের গুষ্ঠি উদ্ধার করত, ‘ক্যান যে হ্যার লগে আমারে চিতায় দিল না, হারামজাদা, গু-খাকি’। অদৃশ্য কাউকে গালাগাল দিত। আমরা দুই শরিকে মিলেমিশে থাকতাম। পাড়া ঘুরে বিলেতি গাব, আম চাইলতা, বেথুল, কলা জোগাড় করে বকা খেতাম তাতার কাছে, কিন্তু ফলারটা সে ওগুলো দিয়েই সারতো। জবাফুল, বেলপাতা ওসবের জোগাড়ও আমাকেই করতে হতো। কিন্তু বুঝতাম না কেন আমার ছোঁয়া সানকিটা ওদের রসুইঘরে ঢোকানো যাবে না, বারান্দার চাতালে গুঁজে রাখতে হবে! একবার তাতার সানকিতে জুলাভাতি খেয়ে মা’র হাতে পিটুনি খেয়েছিলাম। পরে ওটি গোবর দিয়ে মেজে শুদ্ধ করতে হয়েছিল- কাঁসার সানকি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না, মাটির হলে কথা ছিল!

আমাদের ঈদ আর ওদের পূজাপার্বণ, দারুণ কাটত দিনগুলো! না চেয়ে তাতাদের বাগান থেকে কোনো ফল খাওয়া ছিল একদম বারণ। দুই বাড়ির সীমানার বড়ইগাছটা নিয়ে ছিল সব চেয়ে বড় বিপত্তি। গাছের গুঁড়িটাও যেমন, ডালপালাগুলোও তেমনি- দুই বাড়িতে গিয়েই পড়েছে, মাটির নিচের শিকড়ও হয়তবা তাই-ই। কিন্তু তারপরও কেন যেন ওদের ভাগের বড়ইগুলো ছিল ভীষণ মিষ্টি, অন্যদিকে স্বপন মামা খেত আমাদের ভাগেরটা। কেন যে, আজও জানি না। এ নিয়ে হতো ভীষণ ঝগড়া। একবার তো তাতা আর নানা মিলে গাছটা কেটেই ফেলতে চেয়েছিল। শত কাঁটার ঘা খেয়েও বরই পাড়ার জন্য গাছে চড়তাম। গাছের উপরেই মামার সঙ্গে হাতাহাতি হলে আমি পড়ে গিয়েছিলাম, তবে পা ভাঙেনি, ডান পা’টা একটু মচকে গিয়েছিল, শুয়ে থাকতে হয়েছিল কয়েক দিন। সেই থেকে দুই শরিকের মন কষাকষির শুরু।

আল্লাহ্? বড় না ভগবান বড়- প্রশ্নটা করেছিলাম সেই সময়টাতে। স্কুল থেকে ফিরে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা। আমি জানালায় হেলান দিয়ে বাঁশের চটি দিয়ে বাঁধা ডান পা ছড়িয়ে আধশোয়া হয়ে কথা বলছিলাম। প্রশ্ন শুনে নানা রাগ করেছিলেন। কী সব আবোল-তাবোল কথা, উনি বলেছিলেন।

আবোল তাবোল! ভেবেছিলাম। তাহলে তাতাকে ছোঁয়া যাবে না কেন, পুজোর প্রসাদ খাওয়া যাবে কেন, কুত্তায় চাটলে গোবর লাগবে না, মসুলমান ছুঁলে লাগবে কেন, স্বপন মামার মসুলমানি হবে না কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। দাদা সব জানতে পারেন, কিন্তু এ ব্যাপারটা জানেন না- ভগবান আর আল্লাহ্? যে আকাশে প্রতিদিন পাছড়া-পাছড়ি করে এ ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহই ছিল না। হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু জানেন না ধরে নিয়ে উনাকে বোঝাতে গিয়ে ধমক খেয়েছিলাম। নানাকে এর আগে কখনই রাগ করতে দেখিনি। কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন। উনি রাগ করে তাতাকে বাড়ির ছোট ছেলেমেয়ের মাথা খাওয়া নিয়ে কী সব বলেছিলেন! সম্পর্ক ক্রমশই খারাপ হচ্ছিল। মা আর পারুল খালার মধ্যেও তখন ঠিকমত কথা হতো না।

তবে একাত্তরে সবকিছু ঠিক হয়ে গিয়েছিল। আমার বয়স তখন দশ। ভটভটি থেকে নেমে মিলিটারিরা বাড়িতে এসেছিল হিন্দুর খোঁজে। দাদা বলেছিলেন, ‘এটা তো মসুলমানের বাড়ি। আপনারা এখানে কেন?’ আলাপ উর্দুতে হলেও বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। নানার পেছনে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম, কিছুদিন আগে ঢাকা থেকে হেঁটে আসার সময় চোখে পড়া বীভৎস দৃশ্য চোখের সামনে নাচানাচি করছিল।

- ভেতরে ঢুকতে দিন, চড়া গলায় আদেশ দিচ্ছিল ওদের নেতা।

- তোমার দেশে তোমার ঘরে মা-বোনের পর্দা নষ্ট করে আমাকে ঢুকতে দেবে?

- তোমার ঘরে হিন্দু লুকিয়ে নেই? ঢুকতে দাও, দেখব।

- ঘরে ঢুকতে হলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে, বলেছিলেন চুন্নু মৌলভী।

অনেক সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ওরা চলে গিয়েছিল। এরও তিন দিন তিন রাত পর তাতা, ময়না, পারুল খালা নেমে এসেছিল আমাদের পাটাতন থেকে। স্বপন মামা যুদ্ধে গিয়েছিল অথবা হারিয়ে গিয়েছিল, আর কখনো ফেরেনি।

- ওই ময়না, এদিকে আয়, চোকিতে বয়।

- না, এইখানেই কও।

- আরে, আরে, দেখ দেখ, একটা ঝিঁঝিঁ পোকা আরেকটার সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলতাছে।

- ঘোড়া না ছাই, ওরা বিয়া করছে। তুই কিচ্ছু বুজস না।

- পোকায় আবার বিয়া করে নাকি?

- তাইলে পোলাপান হয় ক্যামনে?

পোলাপান হওয়ার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কটা মাথায় আসছিল না। ইদানীং মেয়েটা অনেক কিছু বোঝে, আমার থেকে অনেক বেশি, ইঁচড়েপাকা, কিন্তু আমি যে কিছু বুঝিনি তা ওকে জানতে দেওয়া যাবে না। সব জান্তার চেহারা করে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি, ওই বয়ামটা আন।

ও মাচার ওপর থেকে কাচের বয়ামটা এনে হাতে দেয়। আমার মচকানো পা তখন ভালো হতে শুরু করেছে, কিছু একটা ভর দিয়ে হাঁটতে পারলেও বিছানাতেই থাকি।

- কী করবি? জিজ্ঞেস করে।

কিছু বলি না। ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, টিনের চালের ফুটো গলে ঢোকা এক বিন্দু রোদ ওর কপোলে গোপনে চুমু খাচ্ছিল, মেয়েটা খুব দ্রুতই বদলে যাচ্ছে, ভেবেছিলাম।

- আজ, যাই রে, কাল আসব, ছোট মামার দেখাদেখি আমরাও মাঝে মাঝে শুদ্ধ কথা বলার চেষ্টা করছিলাম।

- আরেকটু বোস।

- নাহ্, আজ না। বলে চলে গিয়েছিল।

সেদিন ধীরে ধীরে দরজা খুলে ঢুকেছিল ময়না। প্রায় দিনে এই সময়টাতেই আসে। স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের খাবার খাওয়ার ঠিক আগে এক ঝলক দেখে যায়।

- আয়, বয়, চোকিতে বয়। বসবে না জেনেও বলি।

কিছু না বলে ও জলচৌকি টেনে বসে।

‘দেখ কী ধরছি, বলে বয়ামটা উঁচু করে দেখাই, ভেতরে দুটি ঝিঁঝিঁ পোকা, চুপ করে বসে আছে।

- ছাড়, ছাড় বলে আঁতকে ওঠে ও, অকারণে জীবহত্যা পাপ, বলে।

- শোন, কালকে ছোটমামা আর মা গল্প করছিল। আমি এই ঘর থেকে শুনেছি। জার্মান দেশে কোনো এক গ্রেগরি নাকি ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গিয়েছে!

- ধুর।

- মা’ও তাই কয়। বিশ্বাস করে না। কিন্তু মামা কয় ক্যামনে ক্যামনে বলে মানুষও পোকা হইয়া যায়। কী কী কইতেছিল, বুঝি নাই। শক্ত শক্ত কথা। তাই এই দুইটারে ধরছি। দেখুম এইডি মানুষ অয় নি।

- তুই একটা পাগল, ঝিঁঝিঁপোকা মানুষ হইব ক্যামনে!

- মানুষ পোকা হইলে, পোকার মানুষ হইতে সমস্যা কী? মামায় কইছে, ইউরোপের সেলতা আদিবাসীরা বিশ্বাস করে মানুষ মইরা গিয়া ঝিঁঝিঁ পোকা হয়, তারপর আমাগো দেখতে আসে। দ্যাখ, এইডারে আমার নানার মতোন লাগে না?

- তুই এট্টা পাগল।

- আয় এদিকে আয়- বলে ওর হাত ধরে টান দিয়েছিলাম।

টান দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলেছিল, ‘তরে না কইছি, তোর লগে ঢলাঢলি করুম না। মায় দীপ্তি দিদিরে কইছে, মসুলমান পোলার সাথে ঢলাঢলি করলে আর বিয়া হইব না। তোর লগে মিশি দেইখ্যা স্কুলের পোলাপানে ক্ষ্যাপায়। আমার সই কইছে, তর লগে কথা না কইতে’।

- আমারেও তো ক্ষ্যাপায়। আমার কিচ্ছু হয় না। শালা গো ধরবার পারলে মাইর দেই।

- জানি, তুই খুব গোঁয়াড়।

- কিন্তু আমি তো তরে বিয়া করুম।

- গাধা, আমি তো হিন্দু; ক্যামনে করবি?

কিছু বলতে না পেরে মাথা চুলকাই। তাকের ওপর নানার তিলাপড়া সাদা টুপিটা আমার দিকে বিটলা হাসি মারে। রাগ হয়! মুখ ঘুরিয়ে ময়নার দিকে তাকাই, মাথা নিচু করে বসে আছে। কিছু করতে না পেরে আক্রোশে জানালার দিকে তাকাই কান্না চাপতে। জানালার শিকের ফাঁকে বয়ামের ভেতর থেকে আমার পরদাদা দুই ঠ্যাং দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছে।

- এই, ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গ্যালে হয় না? অগো তো আর জাতপাত নাই। মুখ ঘুরিয়ে বলি।

- ক্যামনে হমু? ছলছল চোখ তুলে ময়না বলে।

- খাড়া, ওই বয়ামটা দে।

বয়ামটার ভেতরে একটা পোকা ঢুকিয়ে ওর হাতে দিই, পরদাদি কিছুতেই পরদাদাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না।

- শোন, শোয়ার আগে এইটার দিকে এক নজরে চাইয়া থাকবি। আমিও আমরাটার দিকে চাইয়া থাকুম।

কিছু না বলে উজ্জ্বল মুখে ময়না চলে গিয়েছিল। আমি রাতের খাবার সময়টা বাদে তখন থেকেই পরদাদার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে গিয়েছিলাম।

পরদিন সকালে অস্বস্তিকর এক স্বপ্ন শেষে ঘুম ভেঙে দেখতে পেলাম আমি ঝিঁঝিঁ পোকা হয়ে গেছি।

তলপেটের নিচে, না নুনুর মাথায় চিনচিনে ব্যথা। আমি ঘুমাতাম একা। পাশের চৌকিতে কাজের ছেলেটা নিথর হয়ে ঘুমাচ্ছে। একবার ঘুমালে ঠেলেও জাগানো যায় না। নিশ্চিন্তে হাফপ্যান্ট নামিয়ে পরীক্ষা করে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠি : হায় আল্লাহ! আমি হিন্দু হয়ে গেছি, আমার মসুলমানি করা নুনুর মাথা বুজে গেছে। পায়ের ব্যথা ভুলে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দৌড়াই। ময়নাকে বলতে হবে। নিশ্চিত জানি, সামনের পুস্কুনির ঘাটে বসে কয়লা দিয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো মাজছে, ও নিমের ডালের তিতা সহ্য করতে পারে না।

- ময়না, ও ময়না, হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিলাম।

ওর মুখও ভীষণ উজ্জ্বল। কী যেন বলবে বলবে করছে।

- আর চিন্তা নাই, আমি হিন্দু হইয়া গেছি। প্রায় নাচতে নাচতে বলি, পারলে প্যান্ট নামিয়ে নুনু দেখাই।

ওর মুখটা ধীরে ধীরে কালো হয়ে যায়, চোখ নামায়:

- কিন্তু, কিন্তু আমি যে মসুলমান হইছি। এখন কী হইব? আবার তো হিন্দু হওন যাইব না।

back to top