মুজিবুল হক কবীর
বিমল গুহ/ জন্ম : ২৭ অক্টোবর ১৯৫২
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের কবিতায় যে জীবনবোধ ও নবতর চেতনা কাব্যশিল্পে রূপায়িত হয়েছে, বিমল গুহ সেই সময়ে আবির্ভূত কবিদের অন্যতম প্রধান রূপকার। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত করে সত্তরের কবিগণ এখন প্রৌঢ়ত্বে এসে পৌঁছেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে সত্তরের কবিতার প্রধান স্রোতটি বাংলা কবিতায় অংকন করেছে দৃশ্যমান কালচিহ্ন। সেই স্রোতের একজন প্রতিভাদীপ্ত কবি বিমল গুহ। তিনি এবং তাঁর সময়ের প্রধান কবিদের অন্য অনেকে কাব্য-জগতে এখনো সক্রিয় আছেন। বাংলা কবিতায় তাঁরা রেখে চলেছেন পরিপক্ব ও পরিশুদ্ধ অবদান। বয়সে প্রায় সবাই সত্তর-অতিক্রান্ত। গত ২৭ অক্টোবর বিমল গুহ ৭৪ বছরে পদার্পণ করেছেন। কাব্যভুবনে সমান সক্রিয় এখনো। কবিতায় তাঁর বোধি, শিল্পসুষমা ও এর বহুমাত্রিক দিক- পাঠক ও সহযাত্রী হিসেবে আমাদের বিস্মিত করে।
কবিতা একজন কবির অন্তর্গত চেতনার প্রকাশ। এ ক্ষেত্রে ভাবগত দিকটি মুখ্য, না আঙ্গিকগত দিকটি মুখ্য- তা অবশ্যই বিতর্কের বিষয়। তবে এটুকু বলতে পারা যায় যে, ‘কবিতা হলো ভাবয়িত্রী ও কারয়িত্রী প্রতিভার যুগল সম্মিলন।’ কবি বিমল গুহের কবিতার বিষয়, ভাব ও শৈলীর মেলবন্ধন সচেতন পাঠকের দৃষ্টিতে সহজেই ধরা পড়ে। তাঁর কবিতার জগৎ নানারকম অনুষঙ্গের নির্দেশক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’ (১৯৮২)-এর প্রথম কবিতা ‘আলোকবর্তিকা’য় কবিতা যেন অধরা প্রেমের মাধুর্যকণায় ভরপুর, দিবসের ক্লান্তি ও অবসাদ যেমন তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে, তেমনি পুরাণের বহু পুরাতন পাতা থেকে কবিতায় জায়গা করে নেয় পৌরাণিক নারীচরিত্র- দাক্ষায়ণী ও মহাশ্বেতা। অলৌকিক স্বপ্ন-সুতোয় বেঁধে রাখেন কবি দয়িতাকে- দাক্ষায়ণীকে। দক্ষ ব্রহ্মার মানসপুত্র। দক্ষের সকল কন্যাকে দাক্ষায়ণী বলা হয়। তবে ‘দাক্ষায়ণী’ নামে অদিতিই বিশেষভাবে অভিহিতা হতেন। আর অদিতি হলেন মহর্ষি কশ্যপের অর্ধাঙ্গিনী। কবি তাঁর মানসীকে ‘মহাশ্বেতা’ বলেও সম্বোধন করেছেন। বিশ্বের আদি কারণ দেবী দুর্গা। দুর্গা মহাভাব আশ্রয় করেও শ্বেত ও উজ্জ্বল মহাদেবকে অবলম্বন করে আছেন বলে তার আরেক নাম মহাশ্বেতা। কবির শব্দচেতনার কারণে মানসী ও দেবী ‘আলোকবর্তিকা’ কবিতায় একাকার: ‘আগুনের কাছে বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করি-/ তুমি সেরে ওঠো/ অতীতের সব গ্লানি মুছে যাক ¯েœহে;/ প্রেম পালিতা হরিণী- যেই কাছে এসে বসো, আমি/ ত্রিকালদর্শীর মতো ভবিষ্যতের কথা বলতে বলতে/ আকাশের নাভিমূল ছুঁই-/ তুমি মহাশ্বেতা’।
প্রেম হলো কাক্সিক্ষত নারীকে কাছে পাওয়ার প্রগাঢ় বাসনা। জগতের সবকিছুই শব্দের হাতে বন্দি- সৃষ্টির আদিতে ছিলো বাক্য, আর এই বাক্য নির্মিত হয়েছে প্রতীকধর্মী শব্দে। ব্রহ্মজ্ঞানেই শব্দকে গ্রহণ ও মান্য করেছেন কবিরা- স্মরণ ও বিস্মরণের ফাঁকে হঠাৎ যে ছায়ামানবী এসে দাঁড়ায় তাকে রূপ দিতে। প্রতিমার মতো একে নির্মাণ করতে প্রয়োজন লাগসই শব্দ। বিমল গুহ হাওয়ার মতো নীরবে এক অদৃশ্য মানবীর ভিতরে জাগিয়ে তোলেন চৈতন্যনির্ভর ধ্বনিপুঞ্জ; ‘তুমি’ শিরোনামের কবিতায় সেই মানবী হয়ে ওঠে স্বনির্মিত, শব্দস্ফুরিত এক অন্যরকম ব্যঞ্জনাময় সত্তা: ‘ত্বরিত দু’পায়ে তুমি ছুটে এসে/ আমার সান্নিধ্য পেতে চাও,/ শব্দের বন্ধন থেকে ঝেড়ে মুছে সবটুকু গ্লানি/ সোচ্চার হয়ে ওঠো আমার বাক্যের মমতায়-/ ওভাবে তোমার পরিচয়। দৃশ্য, স্পর্শ ও ধ্বনির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাক্প্রতিমা; নৈসর্গিক অনুষঙ্গেও কবি বেঁধেছেন নারীকে, প্রেমকে। শুধু প্রেম নয়, নারীসত্তা নয়, কবির অস্তিত্বও জড়িয়ে আছে নিসর্গের বহুমুখী রহস্যময় চেতনার সঙ্গে। প্রকৃতির শাসনে স্থাপিত নিখিলমানব। প্রকৃতির পাঠশালা থেকেই তাই বিস্তর বীজমন্ত্র, সংকেত খুঁজে নিয়েছেন বিমল গুহ। ‘দ্রোহ’ শিরোনামের কবিতার মধ্যে তাঁর অস্তিত্বের রূপান্তর লক্ষণীয়: ‘মাটি-ছাই ভস্ম থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ/ অস্থিমূলে জ্বলে ওঠে দ্রোহের আগুন’।
বৃক্ষ প্রকৃতির একটি অংশ মাত্র। আমাদের সভ্যতা প্রকৃতিমুখী বলেই উপনিষদের মর্মমূল থেকে যে বিশুদ্ধ সুরলহরি উত্থিত, তার মূর্ত প্রতীক হলো বৃক্ষ। আধুনিক যুগে এসে বৃক্ষ-চিত্রকল্পের বিবর্তন ঘটেছে। বিমল গুহের বৃক্ষভাবনা সরল। ‘এই হেমন্তে পুনরায়’ শীর্ষক কবিতায় তিনি বলেছেন: ‘এইতো বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি/ ডালপালা বাতাসে ছড়িয়ে’; কিংবা ‘মতলবি রাজনীতিবিদ/ বৃক্ষের চুড়োয় বসে গিলছে কার্বন’। আবার ‘চব্বিশের কোটায় এসে’ কবিতায়লাস্যের সঙ্গে ‘গাছের নাচন’; এ যেন দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্পের এক চমৎকার উদ্ভাসন: ‘পাহাড়ের সুউচ্চ সিঁড়িতে যুবতীর নাচ দেখে/ মনে হয় সারি সারি গাছের নাচন’।কবি অমিয় চক্রবর্তীর বৃক্ষভাবনার সঙ্গে বিমল গুহের বৃক্ষভাবনার সাযুজ্য কি খুঁজে পাওয়া যায়? তাঁর ‘দুরযানী’ শিরোনামের কবিতাটির অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি: ‘নাচে ফল/ স্রোতে নাচে।/ আছেই তো গাছ/ গাছের তবু সম্পূর্ণ নাচ/ আলোয় ছায়ায় নীলে/ দূরের আকাশ মিলে/ ঝলমল চঞ্চল’। ঈষৎ সাদৃশ্য এখানে আছে বিমল গুহের ‘গাছের নাচন’-এ। জীবনের টুকরো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। শুধু প্রেম ও নিসর্গবোধ স্বাদেশিক চেতনা, সমকালীনতা- ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা অনেক উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর কবিতায়।
বিষয় ও ভাব-বৈচিত্র্যের পাশাপাশি বিমল গুহের কবিতায় রয়েছে ছন্দোভিজ্ঞান। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’তে বেশ কয়টি কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রাধান্যলক্ষণীয়। যেমন- ‘দুঃখ বাড়ায়’ কবিতায় ‘কেউ দেখে না আমার মধ্যে/ গহন পুকুরজলে ভরা,/ উছল ঢেউয়ে দুলছে ছুটি/ পদ্ম-ভোমর/দুঃখ বাড়ায়’। কিংবা ‘স্বদেশী প্রেম ৭৫’ কবিতায় ‘ক্ষুধার ছায়া গোল বেঁধেছে/ চোখের কোণেমলিন পুকুর/রাধা এখন একা-একাই/ কুঞ্জবনে ক্লান্ত দুপুর’ ইত্যাদি।লোকজীবনের অনুষঙ্গ হলো পদ্ম-ভোমর। ঘরোয়া ছন্দেই চমৎকারভাবে বেঁধেছেন কবি আত্মমগ্নতা ও নিমজ্জনের রূপকে। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে রয়েছে পৌরাণিক চরিত্র রাধা-কৃষ্ণ প্রেমিকা গোপবালা। ‘পদ্মপুরাণে’ বর্ণিত হয়েছে যে গোলকধামে শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব হতে রাধা উদ্ভূতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতে আরম্ভ করেন। রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও। পদাবলির রস সঞ্চারিত হয়নি তাঁর এ কবিতায়, কিন্তু ভিন্ন এক ক্যানভাসে কবি এঁকেছেন রাধা ও কৃষ্ণকে, ক্ষুধার রস সুধার রসে পরিণত হলেই ইন্দ্রিয় প্রেমবোধে সাড়া দেয়- তখন কৃষ্ণের বাঁশি বাজে। প্রথম গ্রন্থের ‘আকাশ পথে, অন্ধকারে’, ‘ইচ্ছে আমার’- এ দুটো কবিতাও স্বরবৃত্ত ছন্দে নির্মিত। রোমান্টিক চেতনারও উদ্ভাসন লক্ষণীয় স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা এই কবিতাগুলোতে।
স্বরবৃত্ত ছন্দের পরিশীলিত, মার্জিত রূপটি আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সমকালের অসংখ্য কবি এ ছন্দের ধ্বনিস্পন্দনকে কাজে লাগিয়েছেন নিজের মতো। সত্তরের দশকের কবি বিমল গুহ রীতিনিষ্ঠ স্বরবৃত্ত ছন্দে এঁকেছেন চূর্ণ চিত্র উপর্যুক্ত কবিতার পঙ্ক্তি চতুষ্টয়ে। মুক্তকের ছত্র বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়নি তাঁর এ কবিতা। মাত্রাবৃত্তেও তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘কী করে ফেরাতে পারো’ কবিতা তার উদাহরণ- ‘উৎসব রাতে বৃষ্টির কলতানে/এসেছিলে তুমি ব্যস্ত দুয়ার খুলে/বিজলীর ছোঁয়া অচেনা পাখির মতো/ডেকেছিলো কাছে গোপনে কর্ণমূলে/কী করে ফেরাতে পারো?কবিতার আঙ্গিকগত নির্মাণ-ক্ষেত্রে বিশেষত ছন্দের অন্তর্লীন মাধুর্যকে পরিমিতরূপে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাঁর কবিব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে সহজেই। কবি তাঁর অন্তর অনুভবের জগতের সঙ্গে, অভিজ্ঞতার মর্মে সত্যের সঙ্গে যুক্ত করেছেন অক্ষরবৃত্তের কবিতা ও গদ্য কবিতাকে। তাঁর অনেক কবিতা স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত পয়ারের এবং মুক্তকের দরজা খোলার জন্য অপেক্ষা করছে। ভাব, ভাষা আর ছন্দ- এই তিনের সন্নিপাতে বিমল গুহের কবিতার কায়-কাঠামো ও অন্তর্জগৎ নির্মিত হয়েছে। সমকালীন ভাবনায় চৈতন্যের টানাপোড়েনে, যুগযন্ত্রণায় তাঁর কবিতা যেন জ্বলে ওঠে নতুন শব্দের ইশারায়।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মুজিবুল হক কবীর
বিমল গুহ/ জন্ম : ২৭ অক্টোবর ১৯৫২
বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫
স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের কবিতায় যে জীবনবোধ ও নবতর চেতনা কাব্যশিল্পে রূপায়িত হয়েছে, বিমল গুহ সেই সময়ে আবির্ভূত কবিদের অন্যতম প্রধান রূপকার। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত করে সত্তরের কবিগণ এখন প্রৌঢ়ত্বে এসে পৌঁছেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে সত্তরের কবিতার প্রধান স্রোতটি বাংলা কবিতায় অংকন করেছে দৃশ্যমান কালচিহ্ন। সেই স্রোতের একজন প্রতিভাদীপ্ত কবি বিমল গুহ। তিনি এবং তাঁর সময়ের প্রধান কবিদের অন্য অনেকে কাব্য-জগতে এখনো সক্রিয় আছেন। বাংলা কবিতায় তাঁরা রেখে চলেছেন পরিপক্ব ও পরিশুদ্ধ অবদান। বয়সে প্রায় সবাই সত্তর-অতিক্রান্ত। গত ২৭ অক্টোবর বিমল গুহ ৭৪ বছরে পদার্পণ করেছেন। কাব্যভুবনে সমান সক্রিয় এখনো। কবিতায় তাঁর বোধি, শিল্পসুষমা ও এর বহুমাত্রিক দিক- পাঠক ও সহযাত্রী হিসেবে আমাদের বিস্মিত করে।
কবিতা একজন কবির অন্তর্গত চেতনার প্রকাশ। এ ক্ষেত্রে ভাবগত দিকটি মুখ্য, না আঙ্গিকগত দিকটি মুখ্য- তা অবশ্যই বিতর্কের বিষয়। তবে এটুকু বলতে পারা যায় যে, ‘কবিতা হলো ভাবয়িত্রী ও কারয়িত্রী প্রতিভার যুগল সম্মিলন।’ কবি বিমল গুহের কবিতার বিষয়, ভাব ও শৈলীর মেলবন্ধন সচেতন পাঠকের দৃষ্টিতে সহজেই ধরা পড়ে। তাঁর কবিতার জগৎ নানারকম অনুষঙ্গের নির্দেশক। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’ (১৯৮২)-এর প্রথম কবিতা ‘আলোকবর্তিকা’য় কবিতা যেন অধরা প্রেমের মাধুর্যকণায় ভরপুর, দিবসের ক্লান্তি ও অবসাদ যেমন তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে ওঠে, তেমনি পুরাণের বহু পুরাতন পাতা থেকে কবিতায় জায়গা করে নেয় পৌরাণিক নারীচরিত্র- দাক্ষায়ণী ও মহাশ্বেতা। অলৌকিক স্বপ্ন-সুতোয় বেঁধে রাখেন কবি দয়িতাকে- দাক্ষায়ণীকে। দক্ষ ব্রহ্মার মানসপুত্র। দক্ষের সকল কন্যাকে দাক্ষায়ণী বলা হয়। তবে ‘দাক্ষায়ণী’ নামে অদিতিই বিশেষভাবে অভিহিতা হতেন। আর অদিতি হলেন মহর্ষি কশ্যপের অর্ধাঙ্গিনী। কবি তাঁর মানসীকে ‘মহাশ্বেতা’ বলেও সম্বোধন করেছেন। বিশ্বের আদি কারণ দেবী দুর্গা। দুর্গা মহাভাব আশ্রয় করেও শ্বেত ও উজ্জ্বল মহাদেবকে অবলম্বন করে আছেন বলে তার আরেক নাম মহাশ্বেতা। কবির শব্দচেতনার কারণে মানসী ও দেবী ‘আলোকবর্তিকা’ কবিতায় একাকার: ‘আগুনের কাছে বিশ্বাস রেখে প্রার্থনা করি-/ তুমি সেরে ওঠো/ অতীতের সব গ্লানি মুছে যাক ¯েœহে;/ প্রেম পালিতা হরিণী- যেই কাছে এসে বসো, আমি/ ত্রিকালদর্শীর মতো ভবিষ্যতের কথা বলতে বলতে/ আকাশের নাভিমূল ছুঁই-/ তুমি মহাশ্বেতা’।
প্রেম হলো কাক্সিক্ষত নারীকে কাছে পাওয়ার প্রগাঢ় বাসনা। জগতের সবকিছুই শব্দের হাতে বন্দি- সৃষ্টির আদিতে ছিলো বাক্য, আর এই বাক্য নির্মিত হয়েছে প্রতীকধর্মী শব্দে। ব্রহ্মজ্ঞানেই শব্দকে গ্রহণ ও মান্য করেছেন কবিরা- স্মরণ ও বিস্মরণের ফাঁকে হঠাৎ যে ছায়ামানবী এসে দাঁড়ায় তাকে রূপ দিতে। প্রতিমার মতো একে নির্মাণ করতে প্রয়োজন লাগসই শব্দ। বিমল গুহ হাওয়ার মতো নীরবে এক অদৃশ্য মানবীর ভিতরে জাগিয়ে তোলেন চৈতন্যনির্ভর ধ্বনিপুঞ্জ; ‘তুমি’ শিরোনামের কবিতায় সেই মানবী হয়ে ওঠে স্বনির্মিত, শব্দস্ফুরিত এক অন্যরকম ব্যঞ্জনাময় সত্তা: ‘ত্বরিত দু’পায়ে তুমি ছুটে এসে/ আমার সান্নিধ্য পেতে চাও,/ শব্দের বন্ধন থেকে ঝেড়ে মুছে সবটুকু গ্লানি/ সোচ্চার হয়ে ওঠো আমার বাক্যের মমতায়-/ ওভাবে তোমার পরিচয়। দৃশ্য, স্পর্শ ও ধ্বনির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাক্প্রতিমা; নৈসর্গিক অনুষঙ্গেও কবি বেঁধেছেন নারীকে, প্রেমকে। শুধু প্রেম নয়, নারীসত্তা নয়, কবির অস্তিত্বও জড়িয়ে আছে নিসর্গের বহুমুখী রহস্যময় চেতনার সঙ্গে। প্রকৃতির শাসনে স্থাপিত নিখিলমানব। প্রকৃতির পাঠশালা থেকেই তাই বিস্তর বীজমন্ত্র, সংকেত খুঁজে নিয়েছেন বিমল গুহ। ‘দ্রোহ’ শিরোনামের কবিতার মধ্যে তাঁর অস্তিত্বের রূপান্তর লক্ষণীয়: ‘মাটি-ছাই ভস্ম থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ/ অস্থিমূলে জ্বলে ওঠে দ্রোহের আগুন’।
বৃক্ষ প্রকৃতির একটি অংশ মাত্র। আমাদের সভ্যতা প্রকৃতিমুখী বলেই উপনিষদের মর্মমূল থেকে যে বিশুদ্ধ সুরলহরি উত্থিত, তার মূর্ত প্রতীক হলো বৃক্ষ। আধুনিক যুগে এসে বৃক্ষ-চিত্রকল্পের বিবর্তন ঘটেছে। বিমল গুহের বৃক্ষভাবনা সরল। ‘এই হেমন্তে পুনরায়’ শীর্ষক কবিতায় তিনি বলেছেন: ‘এইতো বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছি/ ডালপালা বাতাসে ছড়িয়ে’; কিংবা ‘মতলবি রাজনীতিবিদ/ বৃক্ষের চুড়োয় বসে গিলছে কার্বন’। আবার ‘চব্বিশের কোটায় এসে’ কবিতায়লাস্যের সঙ্গে ‘গাছের নাচন’; এ যেন দৃষ্টিগ্রাহ্য চিত্রকল্পের এক চমৎকার উদ্ভাসন: ‘পাহাড়ের সুউচ্চ সিঁড়িতে যুবতীর নাচ দেখে/ মনে হয় সারি সারি গাছের নাচন’।কবি অমিয় চক্রবর্তীর বৃক্ষভাবনার সঙ্গে বিমল গুহের বৃক্ষভাবনার সাযুজ্য কি খুঁজে পাওয়া যায়? তাঁর ‘দুরযানী’ শিরোনামের কবিতাটির অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি: ‘নাচে ফল/ স্রোতে নাচে।/ আছেই তো গাছ/ গাছের তবু সম্পূর্ণ নাচ/ আলোয় ছায়ায় নীলে/ দূরের আকাশ মিলে/ ঝলমল চঞ্চল’। ঈষৎ সাদৃশ্য এখানে আছে বিমল গুহের ‘গাছের নাচন’-এ। জীবনের টুকরো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি। শুধু প্রেম ও নিসর্গবোধ স্বাদেশিক চেতনা, সমকালীনতা- ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা অনেক উপাদান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাঁর কবিতায়।
বিষয় ও ভাব-বৈচিত্র্যের পাশাপাশি বিমল গুহের কবিতায় রয়েছে ছন্দোভিজ্ঞান। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অহংকার, তোমার শব্দ’তে বেশ কয়টি কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রাধান্যলক্ষণীয়। যেমন- ‘দুঃখ বাড়ায়’ কবিতায় ‘কেউ দেখে না আমার মধ্যে/ গহন পুকুরজলে ভরা,/ উছল ঢেউয়ে দুলছে ছুটি/ পদ্ম-ভোমর/দুঃখ বাড়ায়’। কিংবা ‘স্বদেশী প্রেম ৭৫’ কবিতায় ‘ক্ষুধার ছায়া গোল বেঁধেছে/ চোখের কোণেমলিন পুকুর/রাধা এখন একা-একাই/ কুঞ্জবনে ক্লান্ত দুপুর’ ইত্যাদি।লোকজীবনের অনুষঙ্গ হলো পদ্ম-ভোমর। ঘরোয়া ছন্দেই চমৎকারভাবে বেঁধেছেন কবি আত্মমগ্নতা ও নিমজ্জনের রূপকে। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিতে রয়েছে পৌরাণিক চরিত্র রাধা-কৃষ্ণ প্রেমিকা গোপবালা। ‘পদ্মপুরাণে’ বর্ণিত হয়েছে যে গোলকধামে শ্রীকৃষ্ণের বামপার্শ্ব হতে রাধা উদ্ভূতা হয়ে শ্রীকৃষ্ণের পূজা করতে আরম্ভ করেন। রাধা শ্রীকৃষ্ণের প্রাণের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও। পদাবলির রস সঞ্চারিত হয়নি তাঁর এ কবিতায়, কিন্তু ভিন্ন এক ক্যানভাসে কবি এঁকেছেন রাধা ও কৃষ্ণকে, ক্ষুধার রস সুধার রসে পরিণত হলেই ইন্দ্রিয় প্রেমবোধে সাড়া দেয়- তখন কৃষ্ণের বাঁশি বাজে। প্রথম গ্রন্থের ‘আকাশ পথে, অন্ধকারে’, ‘ইচ্ছে আমার’- এ দুটো কবিতাও স্বরবৃত্ত ছন্দে নির্মিত। রোমান্টিক চেতনারও উদ্ভাসন লক্ষণীয় স্বরবৃত্ত ছন্দের কবিতা এই কবিতাগুলোতে।
স্বরবৃত্ত ছন্দের পরিশীলিত, মার্জিত রূপটি আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর সমকালের অসংখ্য কবি এ ছন্দের ধ্বনিস্পন্দনকে কাজে লাগিয়েছেন নিজের মতো। সত্তরের দশকের কবি বিমল গুহ রীতিনিষ্ঠ স্বরবৃত্ত ছন্দে এঁকেছেন চূর্ণ চিত্র উপর্যুক্ত কবিতার পঙ্ক্তি চতুষ্টয়ে। মুক্তকের ছত্র বিন্যাসে বিন্যস্ত হয়নি তাঁর এ কবিতা। মাত্রাবৃত্তেও তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘কী করে ফেরাতে পারো’ কবিতা তার উদাহরণ- ‘উৎসব রাতে বৃষ্টির কলতানে/এসেছিলে তুমি ব্যস্ত দুয়ার খুলে/বিজলীর ছোঁয়া অচেনা পাখির মতো/ডেকেছিলো কাছে গোপনে কর্ণমূলে/কী করে ফেরাতে পারো?কবিতার আঙ্গিকগত নির্মাণ-ক্ষেত্রে বিশেষত ছন্দের অন্তর্লীন মাধুর্যকে পরিমিতরূপে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে তাঁর কবিব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে সহজেই। কবি তাঁর অন্তর অনুভবের জগতের সঙ্গে, অভিজ্ঞতার মর্মে সত্যের সঙ্গে যুক্ত করেছেন অক্ষরবৃত্তের কবিতা ও গদ্য কবিতাকে। তাঁর অনেক কবিতা স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত পয়ারের এবং মুক্তকের দরজা খোলার জন্য অপেক্ষা করছে। ভাব, ভাষা আর ছন্দ- এই তিনের সন্নিপাতে বিমল গুহের কবিতার কায়-কাঠামো ও অন্তর্জগৎ নির্মিত হয়েছে। সমকালীন ভাবনায় চৈতন্যের টানাপোড়েনে, যুগযন্ত্রণায় তাঁর কবিতা যেন জ্বলে ওঠে নতুন শব্দের ইশারায়।