alt

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

দেলোয়ার হাসান

: বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

সমরেশ মজুমদার (১৯৪২-২০২৩)

সমরেশ মজুমদার চলে গেছেন সাতাশ মাস আগে। ৮ মে ২০২৩। কিন্তু তাঁর স্মৃতিগুলো এতটাই এলোমেলো অগোছালো যে এখনো বিনুনি করে জোড়া লাগাতে পারিনি। কোনটার পর কোনটা লিখব । পাঠক কোনটা বেশি পছন্দ করবেন। তিনি যে নাই, আমাদের মাঝে বিশ্বলয়ে আসবেন না, আসা সম্ভব না সে আমি জানি। তবুও মনে হচ্ছে এই যে বইমেলা আসছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসবেন তাঁর ভক্তরা, পাঠক। ব্রহ্মপুত্রের তীরে নিলক্ষীয়ার চরে, মুন্সিগঞ্জে পদ্মার বাঁকে বাতাসে দোল খাচ্ছে পাপড়ি চড়ানো যুবতি কাশফুল। কোন একদিন সমরেশ মজুমদার হুটহাট এসেই বলবেন, ‘দেলোয়ার ভাই চলেন ঘুরতে যাই। পদ্মার তীরে।’ সমরেশ মজুমদারের আসার খবর শুনে গাড়ি নিয়ে আসবে কামরুজ্জামান। ঢাকায় তাঁর পুত্রসহ। ময়মনসিংহ থেকে আসবেন কবি ফরিদ আহমদ দুলাল। ইস্কাটন থেকে খাবার ভর্তি পাঁচ বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আসবেন প্রকাশক অশোক রায় নন্দী। আসবেন ব্যবসায়ী নেতা ফয়েজ ভাই। প্রয়াত আনিসুজ্জামান স্যার এসে দেখবেন আমরা বসে গেছি রাতের মাতালের আড্ডায়।

লেখক সমরেশ মজুমদার সাহেব যে একদিন সমরেশদা হয়ে উঠবেন তা কখনোই ভাবিনি। লেখক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রটা তাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’। সময়টা ১৯৭৯ কিংবা ’৮০। আমি তখন নবম দশম শ্রেণির। আব্বা আমাকে এনে দিলেন ছোট্ট একটি বই। নাম ‘দৌড়’। লেখকের নাম সমরেশ মজুমদার। আব্বা বললেন লেখকের প্রথম উপন্যাস। রাতে পড়তে পড়তে অবাক লাগলো এত চমৎকার গল্প। কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। এই হলো প্রথম উপন্যাস। ঘোড়ার রেসে গিয়ে কীভাবে জীবন কোথায় চলে যায় সে এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় থ্রিলার গল্প। রাত প্রায়। শেষ হারিকেনের তেলও শেষ; কিন্তু বই শেষ হচ্ছে না। তখন অবশ্য আব্বার বই পড়ে আমার অনেক সময় চলে যায়। দস্যু বনহুর সিরিজ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র প্রমুখের বই পড়ে। তারও আগে পড়া হয় পুথি সাহিত্য গাজী কালো চম্পাবতী, জঙ্গনামা। তারপর মহাভারত, রামায়ণ, বিষাদ সিন্ধু ইত্যাদি পড়ে। এর মূলে ছিলেন আমার বাবা। তিনি এবং আমার এক ফুফু ছিলেন পুথি পাঠের ওস্তাদ। তাদের মুন্সিয়ানা পুথি পাঠের কথা এখনো নেত্রকোনা জেলার মগরা ও কংস পারের মানুষ মনে করেন। আর সেই সুবাদেই আমার বই পড়ার আগ্রহ। দৌড় উপন্যাস পড়ার পর আমি অপেক্ষায় থাকলাম এই লেখকের আর কি বই আছে। কীভাবে পাওয়া যায়? দৌড় সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। তারপর অনেকদিন চলে গেল। সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, জনজাজক, শরণাগত, হরিণবাড়ি, সাতকাহন, আট কুঠুরি নয় দরজা, জলের নিচে প্রথম প্রেম, আমাকে চাই, কেউ কেউ একা,এই আমি রেণু, নীল ইত্যাদি প্রায় সব বই পড়তে পড়তে সমরেশ মজুমদারের প্রতি তৈরি হচ্ছে ভক্তি শ্রদ্ধার অতুলনীয় পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। ঢাকা কলকাতা যাতায়াত হয়। ঢাকায় কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আড্ডা হয় কিন্তু সমরেশ মজুমদারকে পাই না।

সংবাদপত্র ছেড়ে আমি ছোট্ট করে শুরু করেছি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আবিষ্কার। এতে অবশ্য শতভাগ উৎসাহ যোগান প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরী এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আর যার সহযোগিতা না পেলে আবিষ্কার আজকের জায়গায় আসতো না তাদের একজন সমরেশ মজুমদার। আরেকজন সুমাইয়া সুমি। আরো যাদের নাম না বললেই নয় তারা হলেন লেখক ওবেইদ জায়গীরদার, এবনে গোলাম সামাদ, আনিসুজ্জামান স্যার, বেবি মওদুদ, অধ্যাপক একে আজাদ খান, সেলিনা হুসেন, ফরহাদ মজহার, কবি নির্মলেন্দু গুণ সাযযাদ কাদির, রফিক আজাদ, মাহবুব তালুকদার, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান,কবি হেলাল হাফিজ, ফরিদুল রেজা সাগর, হাসান হাফিজ, মারুফুল ইসলাম প্রমুখের সহযোগিতায় আবিষ্কার আজ এতো দূর।

সমরেশ মজুমদার লেখক হিসেবে ঢাকার আসা-যাওয়া করেন ১৯৮৯-৯০ সাল থেকে। ঢাকায় আসলে উঠতেন পার্ল পাবলিকেশনের মালিক আলতাব হোসেনের বাসায়। আলতাব হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় কলকাতা মিত্র এ্যান্ড ঘোষের কাউন্টারে।

২০০৯ সালের শীতকালে সমরেশ মজুমদার ঢাকা এলেন। উঠেছেন ঢাকা ক্লাবে। সুমি আমাকে বললেন সমরেশ মজুমদারের বই চলে। তিনি এখন ঢাকায়। চলেন দেখা করি। দুদিন পর সকালে কবি বেলাল চৌধুরীকে নিয়ে আমরা তিনজন শাহাবাগ থেকে বিশাল একটি ফুলের তোড়া নিয়ে ক্লাবের গেস্ট হাউজের গেস্ট রুমে হাজির হই।

২৩ আগস্ট ২০১৩ আবিষ্কার আয়োজন করে সুনীল-হুমায়ূন স্মরণ অনুষ্ঠান। এবং সুনীল-হুমায়ূন স্মৃতি পদক অনুষ্ঠান। ২০ তারিখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন সমরেশ মজুমদার। ওঠেন যথারীতি ঢাকা ক্লাবে। পুরো অনুষ্ঠানটি আবিষ্কারের হলেও ঢাকা ক্লাবে বসে এর ছক তৈরি করেন সমরেশ মজুমদার। আর আবিষ্কারের অস্থায়ী অফিস যেন তখন ঢাকা ক্লাব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন গরম হাওয়া। বিএনপি এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির জন্য মরিয়া আওয়ামী লীগ সরকার। এরই মাঝে এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথিরা হচ্ছেন সর্বজনাব প্রফেসর আনিসুজ্জামান,কবি আল মাহমুদ, হুমায়ূন পতœী মেহের আফরোজ শাওন, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, কবি রফিক আজাদ, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি হেলাল হাফিজ, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ। পদকপ্রাপ্তরা হলেন ডক্টর আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, কবি বেলাল চৌধুরী এবং বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন। আজ বলতেই হয় সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের যহুর হোসেন চৌধুরী হলে একমঞ্চে এত গুণীজনকে একত্র করা যতটা আমার জন্য কঠিন ছিল তার চেয়েও কঠিন ছিল কবি আল মাহমুদ এবং আনিসুজ্জামানকে এক মঞ্চে বসানো। সেদিন আল মাহমুদপন্থীরা যেমন আল মাহমুদকে প্রোগ্রামে আসতে বাধা দিচ্ছিল ঠিক তেমনি ডক্টর আনিসুজ্জামানকে প্রেসক্লাব থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল কয়েকজন। পরে অবশ্য তারাও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সুযোগ পান। ঐদিনের পর থেকে সমরেশ মজুমদার আমাকে দেলোয়ার ভাই এবং আপনি বলে সম্বোধন করতেন। সেদিনের অনুষ্ঠানের সব শেষে সকলের আমন্ত্রণে আমি মঞ্চে উঠে বলেছিলাম, স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কবি সাহিত্যিকদের যেমন মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করা উচিত তেমনি দল মতের ঊর্ধ্বে থেকে কবি সাহিত্যিকদের সম্মান জানানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটেছিল নেত্রকোনার আরেক কৃতি সন্তান বারী সিদ্দিকীর বংশী বাজনা ও গানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ দিয়ে।

দিন যত সামনের দিকে এগোচ্ছে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তত বাড়ছে। তিনি ঢাকায় এলে যে কদিন ঢাকা ক্লাবে থাকেন প্রতিদিনের সঙ্গী আমি। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত এমনকি পর দিন সকাল পর্যন্ত ঢাকা ক্লাব আমার ঠিকানা। আমার যেন বাসায় যেতে না হয় সেজন্য সমরেশ মজুমদার আমার স্ত্রীকে ফোন করে বলে দিতেন। আমারও তাতে আর বাসায় যাওয়ার জন্য তাগিদ থাকতো না।

একবার ঢাকায় আসার দুদিন পর তার ভীষণ জ্বর হলো। আনিস স্যার বললেন সমরেশের জ্বর। তুমি ক্লাবে যাও। গিয়ে দেখি তিনি জ্বরে কাঁপছেন। খাটের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত দামাল দেহ, হাত-পা। আমি তার পিঠের সঙ্গে আমার গা মিশিয়ে শুয়ে শুয়ে তার শরীরের জ্বর আমার দেহে নেবার চেষ্টা করলাম। তিনি সরে গেলেন আরেকটু দূরে। আমি আবার আমাকে মিশিয়ে দিলাম তার সাথে। কিছুক্ষণ পর ফোন করলাম বারডেম হাসপাতালের আজাদ স্যারকে। তিনি ওষুধের নাম বললেন। আমি এনে খাইয়ে দিলাম সমরেশ মজুমদারকে। সন্ধ্যায় আনিস স্যার আসলেন। দাদার জ্বর অনেকটা কমলো। তিনি স্যারের কাছে আমার সেবার কথা বললেন। আস্তে আস্তে তার আমার সম্পর্কটা আরো জোরালো হলো।

ঢাকা থেকে চলে গেলে প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে অন্তত তিন চারবার ফোনে কথা হয় দাদার সঙ্গে। তার নিজের বই প্রকাশের পাশাপাশি বই লেখার জন্য উৎসাহিত করছেন আমাকে। আমার দুটি বইয়ের ছোট্ট ভূমিকা লিখে দিয়েছেন তিনি। ততদিনে আমার খাতিরে অন্যের বইয়ের ভূমিকা তিনি লিখে দিচ্ছেন। জীবনের স্মৃতি মধুর গল্পগুলো বলতে শুরু করছেন আমার সঙ্গে। প্রেম ভালোবাসা বিরহ অন্ধকার গলির কাহিনীও আমাদের আলোচনার বিষয় ততদিনে। দাদার সব নেশা আমারও সয়ে গেছে।

রাত গভীর হওয়ায় সবাই চলে গেছেন। দাদাও ঢুকলেন ওয়াশরুমে। আর তখন বাজতে শুরু করলো তার মােবাইল। তিনি বললেন, ধরেন দেলোয়ার ভাই, ধরেন। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আমার খুব পরিচিত এক মহিলা কবি। একটি পাক্ষিক কাগজের সম্পাদক। ফোন বেজেই চলেছে আমি আর ধরি না। তিনি যখন ফোনের কাছে এলেন ততক্ষণে রিং বাজা শেষ। তিনি এসেই ফোন দেখে বললেন, ও বুঝেছি মেয়ে মানুষ দেখে আপনি ফোন ধরেননি। আমি বরলাম আপনি মেয়ে কোথায় পেলেন। ইনি তো আগে পুরুষ ছিলেন। ঢাকার নটরডেম কলেজের ছাত্র। পরে তিনি মেয়ে হয়েছেন। দাদার তো হাসতে হাসতে দম আটকে যাবার উপক্রম। তিনি বললেন, আমি বিশ্বাস করি না। আমি বললাম অশোক বাবুকে ফোন করেন। তিনি বললেন আমি আনিস স্যারকে ফোন করি। দেখি আনিস স্যার কী বলেন। আমি বললাম আনিস স্যার পরেরটার কথাই বলবেন। তিনি পরেরটাই জানেন। সমরেশদা হাসতে হাসতে বললেন বেঁচে গেছি আমি তার বাসায় যাইনি। গেলে যদি আমার ক্ষতি হতো।

সেবার ঢাকায় আসার প্রথম রাতে আমি ঢাকা ক্লাবে যাইনি। প্রকাশক বন্ধুরা রাতে দাদার সে আড্ডায় আমার পক্ষে বিপক্ষে বলতে বলতে এও বললেন, দেলোয়ার সাহেব চারটি বিয়ে করেছেন। দাদা বললেন আপনাদের তো চার বিয়ে জায়েজ। কিন্তু আনিস স্যার বললেন, আপনারা যা বলছেন তা সঠিক না। পরদিন সমরেশদাদা বললেন, দেলোয়ার ভাই বিষয়টি আসলে কী? বললাম রাতের পানাহারের পরের ঘটনা সুতরাং আপনি ভুল শুনেছেন।

আরেক রাতের ঘটনা সবাই বিদায় নিয়েছে এক এক করে। দাদা একটি পুরাতন পত্রিকার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের পাতাটি বের করে বলেন, এই নাম্বারে ফোন করেন। আমি বললাম এতো পাত্র চাই। পাত্র কে? কেন আমি। আমি ফোন করতেই অপর প্রান্ত থেকে পঞ্চান্ন উর্ধ মোটা মহিলা কণ্ঠের প্রশ্ন/ পাত্র কে? আমার বড় ভাই। পাত্র কী করে? ডিমের ব্যবসা। ডিমের ব্যবসা? কেন,ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটি ডিম আমদানি হয়। আমরা সাপ্লাই দেই দেড় কোটি ডিম। প্রতি ডিমে পঞ্চাশ পয়সা করে লাভ থাকে। ডেলি আমাদের লাভ পঞ্চাশ লাখ টাকা। পাত্রের বয়স কত? ষাট বছর। কোন কথা না বলেই মহিলা লাইন কেটে দেন। তারপর আরও একটি নাম্বারে এভাবে রাত প্রায় তিনটা। আরেকটি নাম্বারে ফোন করতেই সেই মোটা গলার নারী কণ্ঠের প্রশ্ন আপনারা এখনও পাত্রি পান নি? ভাসর করবেন কখন? আমরা তখন হাসতে হাসতে মরি।

এভাবেই আরও কিছুদিন চলে যায়। একেবারেই বিদায় দিয়েছি তার আর আমার বয়সের পার্থক্য। ঢাকার প্রকাশকরা কেউ এখন টাকা দিলে দাদা আমার হাতে তুলে দেন গুনে ব্রিফকেসে রাখার জন্য। কেউ খাবার আনলে আমার জন্য রেখে দেন। কোথাও দাওয়াতে গেলে আমাকে না নিয়ে যেতে চান না। তিনি ঘুমিয়ে থাকলে, বাথরুমে থাকলে তার ফোন রিসিভ করি আমি। তার প্রিয় খাবার চিংড়ি মাছ কচুর লতি, শিম ভর্তা, শিং মাছ কাঁচা কলা দিয়ে ঝোল, ইলিশ মাছ পছন্দের পানীয় সব আমি দাওয়াতিদের বলে দেই। এমনিভাবে বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার হয়ে উঠলেন আমার বন্ধু, বড় ভাই সমরেশ দা। তিনি দ্রুত উন্নতি দেখতে চান আমার, আবিষ্কারের। নিজের বইয়ের বাইরে আর কী কী বই করলে আবিষ্কারের জনপ্রিয়তা বাড়বে, ব্যবসা সফল হবে সেদিকেও প্রখর নজর তার। আর আমার শ্রদ্ধার জায়গাটি আস্তে আস্তে দখল করে নেন সমরেশ মজুমদার। বিশেষ করে উপন্যাসে সেই আমার পূজনীয় বলে জ্ঞান হলো। আমি আমার চেতনায় এখনো তাকে পাই। তার স্মৃতিগুলো কিছুতেই ভুলবার নয়।

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বিমল গুহের কবিতার অন্তর্জগৎ ও শিল্পৈশ্বর্য

ছবি

কবিতার সুনীল সুনীলের কবিতা

ছবি

রূপান্তরের অকথিত গল্পটা

ছবি

মানব সভ্যতার আত্মবিশ্লেষণের আয়না

ছবি

বাইরে একটা কিছু জ্বলছে

ছবি

‘কাফকার মতো হবো বলে আইন পড়েছিলাম’

ছবি

সত্যেন সেনের উপন্যাস: মিথ ও ইতিহাসলগ্ন মানুষ

ছবি

বিস্ময়ের সীমা নাই

ছবি

নগর বাউল ও ত্রিকালদর্শী সন্ত কবি শামসুর রাহমান

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ও বন্ধু আমার

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘মিথ’

ছবি

বহুমাত্রিক শামসুর রাহমান

ছবি

দূর-সময়ের সার্বভৌম কবি

ছবি

মাহফুজ আল-হোসেন-এর দশটি কবিতা

ছবি

মনোজগতের অন্বেষায়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

এক ঘর রোদ

ছবি

দ্রোহের রম্য পঙ্ক্তিমালা

ছবি

সংবেদী রঙে ও রেখায় প্রাণের উন্মোচন

ছবি

অলস দিনের হাওয়া

ছবি

লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের মর্মস্পর্শী ও দূরদর্শী সাহিত্যকর্ম

ছবি

‘ভাষার আরোপিত কারুকাজে খেই হারিয়ে ফেলি’

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের জিন্দা লাশ কি প্রকৃত লাশ

ছবি

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের শিক্ষা দর্শন ও অলস দিনের হাওয়া

ছবি

ধ্রুপদী বোধ ও ব্যাধির কবিতা

ছবি

সুকান্তর কবিতায় বিপ্লবী চেতনা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

মগ্নচৈতন্যে সৌন্দর্যধ্যান

ছবি

অধুনাবাদী নিরীক্ষার অগ্রসাধক

ছবি

‘বায়ান্নর আধুনিকতা ও প্রগতিশীল ধারাকে বহন করতে চেয়েছি’

ছবি

জাতীয় চেতনার অমলিন ধারক

ছবি

নক্ষত্রের অনন্ত যাত্রা

tab

এলোমেলো স্মৃতির সমরেশ মজুমদার

দেলোয়ার হাসান

সমরেশ মজুমদার (১৯৪২-২০২৩)

বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

সমরেশ মজুমদার চলে গেছেন সাতাশ মাস আগে। ৮ মে ২০২৩। কিন্তু তাঁর স্মৃতিগুলো এতটাই এলোমেলো অগোছালো যে এখনো বিনুনি করে জোড়া লাগাতে পারিনি। কোনটার পর কোনটা লিখব । পাঠক কোনটা বেশি পছন্দ করবেন। তিনি যে নাই, আমাদের মাঝে বিশ্বলয়ে আসবেন না, আসা সম্ভব না সে আমি জানি। তবুও মনে হচ্ছে এই যে বইমেলা আসছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসবেন তাঁর ভক্তরা, পাঠক। ব্রহ্মপুত্রের তীরে নিলক্ষীয়ার চরে, মুন্সিগঞ্জে পদ্মার বাঁকে বাতাসে দোল খাচ্ছে পাপড়ি চড়ানো যুবতি কাশফুল। কোন একদিন সমরেশ মজুমদার হুটহাট এসেই বলবেন, ‘দেলোয়ার ভাই চলেন ঘুরতে যাই। পদ্মার তীরে।’ সমরেশ মজুমদারের আসার খবর শুনে গাড়ি নিয়ে আসবে কামরুজ্জামান। ঢাকায় তাঁর পুত্রসহ। ময়মনসিংহ থেকে আসবেন কবি ফরিদ আহমদ দুলাল। ইস্কাটন থেকে খাবার ভর্তি পাঁচ বাটির টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে আসবেন প্রকাশক অশোক রায় নন্দী। আসবেন ব্যবসায়ী নেতা ফয়েজ ভাই। প্রয়াত আনিসুজ্জামান স্যার এসে দেখবেন আমরা বসে গেছি রাতের মাতালের আড্ডায়।

লেখক সমরেশ মজুমদার সাহেব যে একদিন সমরেশদা হয়ে উঠবেন তা কখনোই ভাবিনি। লেখক সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রটা তাঁর উপন্যাস ‘দৌড়’। সময়টা ১৯৭৯ কিংবা ’৮০। আমি তখন নবম দশম শ্রেণির। আব্বা আমাকে এনে দিলেন ছোট্ট একটি বই। নাম ‘দৌড়’। লেখকের নাম সমরেশ মজুমদার। আব্বা বললেন লেখকের প্রথম উপন্যাস। রাতে পড়তে পড়তে অবাক লাগলো এত চমৎকার গল্প। কিছুতেই রাখা যাচ্ছে না। এই হলো প্রথম উপন্যাস। ঘোড়ার রেসে গিয়ে কীভাবে জীবন কোথায় চলে যায় সে এক রুদ্ধশ্বাস নাটকীয় থ্রিলার গল্প। রাত প্রায়। শেষ হারিকেনের তেলও শেষ; কিন্তু বই শেষ হচ্ছে না। তখন অবশ্য আব্বার বই পড়ে আমার অনেক সময় চলে যায়। দস্যু বনহুর সিরিজ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র প্রমুখের বই পড়ে। তারও আগে পড়া হয় পুথি সাহিত্য গাজী কালো চম্পাবতী, জঙ্গনামা। তারপর মহাভারত, রামায়ণ, বিষাদ সিন্ধু ইত্যাদি পড়ে। এর মূলে ছিলেন আমার বাবা। তিনি এবং আমার এক ফুফু ছিলেন পুথি পাঠের ওস্তাদ। তাদের মুন্সিয়ানা পুথি পাঠের কথা এখনো নেত্রকোনা জেলার মগরা ও কংস পারের মানুষ মনে করেন। আর সেই সুবাদেই আমার বই পড়ার আগ্রহ। দৌড় উপন্যাস পড়ার পর আমি অপেক্ষায় থাকলাম এই লেখকের আর কি বই আছে। কীভাবে পাওয়া যায়? দৌড় সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। তারপর অনেকদিন চলে গেল। সমরেশ মজুমদারের উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ, গর্ভধারিণী, জনজাজক, শরণাগত, হরিণবাড়ি, সাতকাহন, আট কুঠুরি নয় দরজা, জলের নিচে প্রথম প্রেম, আমাকে চাই, কেউ কেউ একা,এই আমি রেণু, নীল ইত্যাদি প্রায় সব বই পড়তে পড়তে সমরেশ মজুমদারের প্রতি তৈরি হচ্ছে ভক্তি শ্রদ্ধার অতুলনীয় পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। ঢাকা কলকাতা যাতায়াত হয়। ঢাকায় কলকাতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আড্ডা হয় কিন্তু সমরেশ মজুমদারকে পাই না।

সংবাদপত্র ছেড়ে আমি ছোট্ট করে শুরু করেছি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আবিষ্কার। এতে অবশ্য শতভাগ উৎসাহ যোগান প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরী এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আর যার সহযোগিতা না পেলে আবিষ্কার আজকের জায়গায় আসতো না তাদের একজন সমরেশ মজুমদার। আরেকজন সুমাইয়া সুমি। আরো যাদের নাম না বললেই নয় তারা হলেন লেখক ওবেইদ জায়গীরদার, এবনে গোলাম সামাদ, আনিসুজ্জামান স্যার, বেবি মওদুদ, অধ্যাপক একে আজাদ খান, সেলিনা হুসেন, ফরহাদ মজহার, কবি নির্মলেন্দু গুণ সাযযাদ কাদির, রফিক আজাদ, মাহবুব তালুকদার, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান,কবি হেলাল হাফিজ, ফরিদুল রেজা সাগর, হাসান হাফিজ, মারুফুল ইসলাম প্রমুখের সহযোগিতায় আবিষ্কার আজ এতো দূর।

সমরেশ মজুমদার লেখক হিসেবে ঢাকার আসা-যাওয়া করেন ১৯৮৯-৯০ সাল থেকে। ঢাকায় আসলে উঠতেন পার্ল পাবলিকেশনের মালিক আলতাব হোসেনের বাসায়। আলতাব হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় কলকাতা মিত্র এ্যান্ড ঘোষের কাউন্টারে।

২০০৯ সালের শীতকালে সমরেশ মজুমদার ঢাকা এলেন। উঠেছেন ঢাকা ক্লাবে। সুমি আমাকে বললেন সমরেশ মজুমদারের বই চলে। তিনি এখন ঢাকায়। চলেন দেখা করি। দুদিন পর সকালে কবি বেলাল চৌধুরীকে নিয়ে আমরা তিনজন শাহাবাগ থেকে বিশাল একটি ফুলের তোড়া নিয়ে ক্লাবের গেস্ট হাউজের গেস্ট রুমে হাজির হই।

২৩ আগস্ট ২০১৩ আবিষ্কার আয়োজন করে সুনীল-হুমায়ূন স্মরণ অনুষ্ঠান। এবং সুনীল-হুমায়ূন স্মৃতি পদক অনুষ্ঠান। ২০ তারিখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন সমরেশ মজুমদার। ওঠেন যথারীতি ঢাকা ক্লাবে। পুরো অনুষ্ঠানটি আবিষ্কারের হলেও ঢাকা ক্লাবে বসে এর ছক তৈরি করেন সমরেশ মজুমদার। আর আবিষ্কারের অস্থায়ী অফিস যেন তখন ঢাকা ক্লাব। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন গরম হাওয়া। বিএনপি এবং জামায়াত নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির জন্য মরিয়া আওয়ামী লীগ সরকার। এরই মাঝে এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রিত অতিথিরা হচ্ছেন সর্বজনাব প্রফেসর আনিসুজ্জামান,কবি আল মাহমুদ, হুমায়ূন পতœী মেহের আফরোজ শাওন, কবি মুহাম্মদ নূরুল হুদা, কবি রফিক আজাদ, কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, কবি হেলাল হাফিজ, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ। পদকপ্রাপ্তরা হলেন ডক্টর আনিসুজ্জামান, কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, কবি বেলাল চৌধুরী এবং বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন। আজ বলতেই হয় সেদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের যহুর হোসেন চৌধুরী হলে একমঞ্চে এত গুণীজনকে একত্র করা যতটা আমার জন্য কঠিন ছিল তার চেয়েও কঠিন ছিল কবি আল মাহমুদ এবং আনিসুজ্জামানকে এক মঞ্চে বসানো। সেদিন আল মাহমুদপন্থীরা যেমন আল মাহমুদকে প্রোগ্রামে আসতে বাধা দিচ্ছিল ঠিক তেমনি ডক্টর আনিসুজ্জামানকে প্রেসক্লাব থেকে নিয়ে যেতে এসেছিল কয়েকজন। পরে অবশ্য তারাও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সুযোগ পান। ঐদিনের পর থেকে সমরেশ মজুমদার আমাকে দেলোয়ার ভাই এবং আপনি বলে সম্বোধন করতেন। সেদিনের অনুষ্ঠানের সব শেষে সকলের আমন্ত্রণে আমি মঞ্চে উঠে বলেছিলাম, স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে কবি সাহিত্যিকদের যেমন মতের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করা উচিত তেমনি দল মতের ঊর্ধ্বে থেকে কবি সাহিত্যিকদের সম্মান জানানো আমাদের সকলের দায়িত্ব। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটেছিল নেত্রকোনার আরেক কৃতি সন্তান বারী সিদ্দিকীর বংশী বাজনা ও গানের মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম হুমায়ূন আহমেদের শেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ দিয়ে।

দিন যত সামনের দিকে এগোচ্ছে সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তত বাড়ছে। তিনি ঢাকায় এলে যে কদিন ঢাকা ক্লাবে থাকেন প্রতিদিনের সঙ্গী আমি। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে রাত এমনকি পর দিন সকাল পর্যন্ত ঢাকা ক্লাব আমার ঠিকানা। আমার যেন বাসায় যেতে না হয় সেজন্য সমরেশ মজুমদার আমার স্ত্রীকে ফোন করে বলে দিতেন। আমারও তাতে আর বাসায় যাওয়ার জন্য তাগিদ থাকতো না।

একবার ঢাকায় আসার দুদিন পর তার ভীষণ জ্বর হলো। আনিস স্যার বললেন সমরেশের জ্বর। তুমি ক্লাবে যাও। গিয়ে দেখি তিনি জ্বরে কাঁপছেন। খাটের এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত দামাল দেহ, হাত-পা। আমি তার পিঠের সঙ্গে আমার গা মিশিয়ে শুয়ে শুয়ে তার শরীরের জ্বর আমার দেহে নেবার চেষ্টা করলাম। তিনি সরে গেলেন আরেকটু দূরে। আমি আবার আমাকে মিশিয়ে দিলাম তার সাথে। কিছুক্ষণ পর ফোন করলাম বারডেম হাসপাতালের আজাদ স্যারকে। তিনি ওষুধের নাম বললেন। আমি এনে খাইয়ে দিলাম সমরেশ মজুমদারকে। সন্ধ্যায় আনিস স্যার আসলেন। দাদার জ্বর অনেকটা কমলো। তিনি স্যারের কাছে আমার সেবার কথা বললেন। আস্তে আস্তে তার আমার সম্পর্কটা আরো জোরালো হলো।

ঢাকা থেকে চলে গেলে প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে অন্তত তিন চারবার ফোনে কথা হয় দাদার সঙ্গে। তার নিজের বই প্রকাশের পাশাপাশি বই লেখার জন্য উৎসাহিত করছেন আমাকে। আমার দুটি বইয়ের ছোট্ট ভূমিকা লিখে দিয়েছেন তিনি। ততদিনে আমার খাতিরে অন্যের বইয়ের ভূমিকা তিনি লিখে দিচ্ছেন। জীবনের স্মৃতি মধুর গল্পগুলো বলতে শুরু করছেন আমার সঙ্গে। প্রেম ভালোবাসা বিরহ অন্ধকার গলির কাহিনীও আমাদের আলোচনার বিষয় ততদিনে। দাদার সব নেশা আমারও সয়ে গেছে।

রাত গভীর হওয়ায় সবাই চলে গেছেন। দাদাও ঢুকলেন ওয়াশরুমে। আর তখন বাজতে শুরু করলো তার মােবাইল। তিনি বললেন, ধরেন দেলোয়ার ভাই, ধরেন। আমি মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি আমার খুব পরিচিত এক মহিলা কবি। একটি পাক্ষিক কাগজের সম্পাদক। ফোন বেজেই চলেছে আমি আর ধরি না। তিনি যখন ফোনের কাছে এলেন ততক্ষণে রিং বাজা শেষ। তিনি এসেই ফোন দেখে বললেন, ও বুঝেছি মেয়ে মানুষ দেখে আপনি ফোন ধরেননি। আমি বরলাম আপনি মেয়ে কোথায় পেলেন। ইনি তো আগে পুরুষ ছিলেন। ঢাকার নটরডেম কলেজের ছাত্র। পরে তিনি মেয়ে হয়েছেন। দাদার তো হাসতে হাসতে দম আটকে যাবার উপক্রম। তিনি বললেন, আমি বিশ্বাস করি না। আমি বললাম অশোক বাবুকে ফোন করেন। তিনি বললেন আমি আনিস স্যারকে ফোন করি। দেখি আনিস স্যার কী বলেন। আমি বললাম আনিস স্যার পরেরটার কথাই বলবেন। তিনি পরেরটাই জানেন। সমরেশদা হাসতে হাসতে বললেন বেঁচে গেছি আমি তার বাসায় যাইনি। গেলে যদি আমার ক্ষতি হতো।

সেবার ঢাকায় আসার প্রথম রাতে আমি ঢাকা ক্লাবে যাইনি। প্রকাশক বন্ধুরা রাতে দাদার সে আড্ডায় আমার পক্ষে বিপক্ষে বলতে বলতে এও বললেন, দেলোয়ার সাহেব চারটি বিয়ে করেছেন। দাদা বললেন আপনাদের তো চার বিয়ে জায়েজ। কিন্তু আনিস স্যার বললেন, আপনারা যা বলছেন তা সঠিক না। পরদিন সমরেশদাদা বললেন, দেলোয়ার ভাই বিষয়টি আসলে কী? বললাম রাতের পানাহারের পরের ঘটনা সুতরাং আপনি ভুল শুনেছেন।

আরেক রাতের ঘটনা সবাই বিদায় নিয়েছে এক এক করে। দাদা একটি পুরাতন পত্রিকার ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের পাতাটি বের করে বলেন, এই নাম্বারে ফোন করেন। আমি বললাম এতো পাত্র চাই। পাত্র কে? কেন আমি। আমি ফোন করতেই অপর প্রান্ত থেকে পঞ্চান্ন উর্ধ মোটা মহিলা কণ্ঠের প্রশ্ন/ পাত্র কে? আমার বড় ভাই। পাত্র কী করে? ডিমের ব্যবসা। ডিমের ব্যবসা? কেন,ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই কোটি ডিম আমদানি হয়। আমরা সাপ্লাই দেই দেড় কোটি ডিম। প্রতি ডিমে পঞ্চাশ পয়সা করে লাভ থাকে। ডেলি আমাদের লাভ পঞ্চাশ লাখ টাকা। পাত্রের বয়স কত? ষাট বছর। কোন কথা না বলেই মহিলা লাইন কেটে দেন। তারপর আরও একটি নাম্বারে এভাবে রাত প্রায় তিনটা। আরেকটি নাম্বারে ফোন করতেই সেই মোটা গলার নারী কণ্ঠের প্রশ্ন আপনারা এখনও পাত্রি পান নি? ভাসর করবেন কখন? আমরা তখন হাসতে হাসতে মরি।

এভাবেই আরও কিছুদিন চলে যায়। একেবারেই বিদায় দিয়েছি তার আর আমার বয়সের পার্থক্য। ঢাকার প্রকাশকরা কেউ এখন টাকা দিলে দাদা আমার হাতে তুলে দেন গুনে ব্রিফকেসে রাখার জন্য। কেউ খাবার আনলে আমার জন্য রেখে দেন। কোথাও দাওয়াতে গেলে আমাকে না নিয়ে যেতে চান না। তিনি ঘুমিয়ে থাকলে, বাথরুমে থাকলে তার ফোন রিসিভ করি আমি। তার প্রিয় খাবার চিংড়ি মাছ কচুর লতি, শিম ভর্তা, শিং মাছ কাঁচা কলা দিয়ে ঝোল, ইলিশ মাছ পছন্দের পানীয় সব আমি দাওয়াতিদের বলে দেই। এমনিভাবে বাংলা ভাষার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার হয়ে উঠলেন আমার বন্ধু, বড় ভাই সমরেশ দা। তিনি দ্রুত উন্নতি দেখতে চান আমার, আবিষ্কারের। নিজের বইয়ের বাইরে আর কী কী বই করলে আবিষ্কারের জনপ্রিয়তা বাড়বে, ব্যবসা সফল হবে সেদিকেও প্রখর নজর তার। আর আমার শ্রদ্ধার জায়গাটি আস্তে আস্তে দখল করে নেন সমরেশ মজুমদার। বিশেষ করে উপন্যাসে সেই আমার পূজনীয় বলে জ্ঞান হলো। আমি আমার চেতনায় এখনো তাকে পাই। তার স্মৃতিগুলো কিছুতেই ভুলবার নয়।

back to top