ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী - ১৬
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শেষ বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়তেই আসলাম গুয়াদালকিবির নদীর পাশে; সামনেই সুন্দর এক টাওয়ার, নাম ‘থরে দেল ওরো’ এ স্পেনীয় শব্দটির মানে হলো ‘সোনালি টাওয়ার’। নামটির উৎপত্তি হয়েছে এর সোনালি আভা থেকে, যা প্রতিফলিত হয় পাশের নদীর জলে। এখানেই সেভিয়া-র রিভার ক্রুজের জেটি। এখানে ওঠার পর দেখি- সত্যিই, এ টাওয়ারের আভা পাশের গুয়াদিলকিভি-এর জলে সোনালি রঙে ঝিলমিল করছে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য!
রিভার ক্রুজ-এর সারি সারি জাহাজের মাঝে একটি, লস রিনকোনেছ-এ আমরা উঠেছি। গুয়াদিলকুইভির-এর বুকে জাহাজে ভেসে যাচ্ছি, মাথার ওপরে আকাশে উড়ছে একটি বিমান, পাশের রাস্তায় চলছে ঘোড়ার গাড়ি, বাস, কার, বাই সাইকেল। জল-আকাশ-স্থলে তিন বাহনের একসাথে চলার দৃশ্য দেখা এক মজার অভিজ্ঞতা।
ক্রুজের গাইড এসে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে নিজের নাম বলল। কোম্পানির নীল-সাদা কোট পরা, তার ওপর হালকা অলংকারে সজ্জিতা বেশ হাসিখুশি এক তরুণী জেনিকা। সে বলল, ‘গুয়াদিলকিভির নদীর ওপরে পুরো ক্রুজটি এক ঘণ্টার, কিছু সময় বেশিও লাগতে পারে। এটি স্পেনের একমাত্র রিভার ক্রুজ, কারণ সেভিয়া ছাড়া আর কোথাও নৌ চলাচলের উপযুক্ত নদী নেই।’ এরপর জেনিকা দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে বলল, ‘গুয়াদিলকিভির নদীর দুপারে সেভিয়া-র দুটি রূপ। এদিকে পূর্ব দিক- এখানে ঐতিহাসিক সেভিয়া। আর এদিকে পশ্চিম দিক- আধুনিক সেভিয়া। আমরা দুটি দিক পাশাপাশি দেখতে দেখতে যাব।’
জেনিকা বলে যাচ্ছে ইতিহাস, আর তা আমরা শুনছি, সাথে দেখছি, যেন চলছে এক স্লাইড শো।
জেনিকা-র বর্ণনা চলল, ‘আমরা যেখান থেকে রওয়ানা দিলাম, সে ৩৬-মিটার লম্বা ‘থরে দেল ওরো’ টাওয়ারটি ১২২০ সালে নির্মাণ করে মুররা। উদ্দেশ্য ছিল শহরের প্রবেশ পথ ও পোতাশ্রয়ের প্রতিরক্ষা।
একটি বছরের দু’টি ঘটনা বদলে দিয়েছে স্পেন ও ইউরোপকে, সাথে বড় পরিবর্তন এনেছে সারা পৃথিবীতেও। সেটা ছিল ১৪৯২ সাল। সে বছরের শুরুতে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা দখল করে ৭৮১ বছর ধরে চলা যুদ্ধ ‘রিকনকুইস্তা’-র শেষ পর্বে পৌঁছে। এরপর ক্যাথলিক মনার্ক ফার্দিনান্দ-ইসাবেলা তাঁদের শাসনে একীভূত করে স্পেনকে। বছরের শেষ দিকে গ্রানাদার আলহাম্বরায় বসে রানী ইসাবেলা অনুমতি দেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে সমুদ্র যাত্রার। ১২ অক্টোবর, ১৪৯২ সালে কলম্বাস পৌঁছেন নিউ ওয়ার্ল্ড, আমেরিকায়আর খোঁজ পান অনেক ভূমি ও প্রচুর সম্পদের। শুরু হয় এ নতুন পৃথিবীতে স্পেনের উপনিবেশ। আসতে থাকে নতুন পৃথিবী থেকে অঢেল সম্পদ, আর সেখানে পাঠানো হয় আফ্রিকা আনা ক্রীতদাস- যাদের বেচাকেনার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে সেভিয়া। তবে গুয়াদিলকুইভির-এর পাশে ৩০০০ বছর ধরে গড়ে উঠেছে এ শহর- ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, এখন আন্দালুসিয়ার রাজধানী।
মুরদের বিদায়ের পর এই টাওয়ার ‘থরে দেল ওরো’ হয়ে উঠে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর প্রবেশদ্বার। বের হওয়ার সময় যেত অস্ত্রসজ্জিত সেনাদল, তার মধ্যে কিছু ফিরে আসত, সাথে করে নিয়ে আসত জাহাজভর্তি স্বর্ণ ও অন্যান্য রত্ন। এ টাওয়ারের তিনটি অংশের সবচেয়ে নিচের অংশে তারা এসব সম্পদ জমা রাখত। নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে আনা ধন-সম্পদে দ্রুত সমৃদ্ধ উঠে সেভিয়া, সাথে স্পেনও। ১৬০০ সালের মধ্যে সেভিয়া হয়ে ওঠে স্পেনের বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম নগরী, আর স্পেন হয়ে যায় সম্পদ ও ক্ষমতায় পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। তবে সোনালি দিনগুলো বেশি দিন টিকল না। এর মধ্যে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। স্পেনের দুর্ভাগ্যের সাথে সাথে সেভিয়ার দুর্ভাগ্যও বাড়তে থাকে। গুয়াদিলকুইভির নদীর বুকে পলি-স্তর বেড়ে যাওয়াতে বন্দর ও পোতাশ্রয় সরিয়ে নেয়া হয় কাদিজে। ১৭০০ সালের দিকে স্পেন ও সেভিয়া- দুটিরই সোনালি দিনের অবসান ঘটে।’
এতটুকু একনাগাড়ে বলে জেনিকা একটু থামল। তারপর পূর্ব দিকে একটি টাওয়ার দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো হিরালডা টাওয়ার- মাথা উঁচু করে ঘোষণা করছে সেভিয়ার ইতিহাস ও গৌরব। এটি তার পাশের সেভিয়া ক্যাথেড্রালের বেল টাওয়ার। এ ক্যাথেড্রাল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গথিক চার্চ। জায়গাটি সেভিয়ার ঐতিহাসিক কেন্দ্র। মুররা ভিসিগথদের গির্জার ওপর করেছিল একটি মসজিদ- এ ছিল প্রথম ভুল। দ্বিতীয় ভুল করল ক্যাথলিকরা, তারা সে মসজিদের ওপর করল এই সেভিয়া ক্যাথেড্রাল। নতুন একটি ভুল দিয়ে পুরনো ভুলের সংশোধন করা যায় না। ব্যাপারটি অনেকটা এ রকম- ‘Ôthe conquerors write the history।’ আমি একটু যোগ করলাম: ‘Ôthe conquerors remake the history..’
কথার মোড় ঘুরিয়ে জেনিকা বলল, ‘ক্যাথেড্রালের পাশেই দেখ মুরদের তৈরি আলকাছার দুর্গ। প্রায় এক হাজার বছর ধরে এটি স্পেনের রাজন্যবর্গের বাসস্থান- যা ইউরোপের প্রাচীনতম চালু রাজপ্রাসাদ।’
এরপর একটি সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় জেনিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুয়েন্তে দে ইসাবেল- এটি শহরের পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে যাবার প্রধান সেতু। পশ্চিমদিকের জায়গাটির নাম ‘বারিয়ো দে থ্রিয়ানা’- যা মূলত দক্ষ কারিগর ও ফ্লেমেনকো শিল্পীদের এক জনপদ। ফ্লেমেনকো যখন, জিপসিরা তো থাকবেই, সাথে তা হবে আন্দলুসিয়ার ঐতিহ্যে ভরপুর ও সদা প্রাণচঞ্চল! এলাকাটি অনেক বিখ্যাত বুল-ফাইটার ও ফ্লেমেনকো শিল্পীর জন্ম দিয়েছে। তাছাড়া এখানে আছে সিরামিক আর্টের অনেক কর্মশালা, যেখানে নির্মিত হয় বিখ্যাত আছুলেহস টাইলস, যা নীল রঙের চিত্রাঙ্কন দিয়ে শোভিত করা হয়।’
জাহাজ ‘বারিয়ো দে থ্রিয়ানা’ যাবার সময় জেনিকার সাথে আমরাও থাকালাম পশ্চিম দিকে। সে জানাল, ‘দেখ, এদিকে নদীর পাড় ঘিরে এক সুন্দর বড় রাস্তা- কায়ে বেটিস। তার ওপর সারি সারি বাড়ি, কোনটিই ৫-তলার বে নয়, প্রতিটির রঙ ভিন্ন, তারা রচনা করেছে রঙের এক ইন্দ্রজাল। প্রতিটির নিচ তলায় রেস্তোরাঁ বা বার, সামনের চত্বরে বসার জায়গা আছে- এখানে বসে দেখা যায় অপর পাড়ের থরে দেল ওরো, আলকাছার, ক্যাথেড্রাল, হিরালডা।’ কায়ে বেটিস পর্যটকদের প্রিয় একটি জায়গা।’
জাহাজ সামনে একটু এগুতে জেনিকা দেখাল প্লাছা দে থরোছ- এখানকার বুল-ফাইটিংয়ের প্রধান অঙ্গন।
ইতিহাসের পথে যেতে যেতে হঠাৎ যেন সুর কেটে গেল। পশ্চিম দিকে জেগে উঠল এক গগনচুম্বী অট্টালিকা। জেনিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘এর নাম থরে সেভিয়া, অনেকে বলে ‘সেভিল টাওয়ার’, আধুনিক সেভিয়া-র প্রতীক। ১৮০.৫ মিটার দীর্ঘ টাওয়ারটি নির্মিত হয় ২০১৫ সালে, যাতে রয়েছে অনেক অফিস ও পাঁচ-তারকা হোটেল। এটি আন্দালুসিয়া ও সেভিয়া-র সবচেয়ে উঁচু ভবন।’
বিদায়ী সূর্যের রঙে উজ্জল সেভিল টাওয়ারটি দেখিয়ে নাতাশা বলে উঠল, ‘সেভিয়া-র সাথে এ টাওয়ারটি বেমানান। এটি এখানকার ইতিহাস ও স্থাপত্যকে তুলে ধরে না।’ জেনিকা হেসে বলল, ‘এ কথাটি বলে থাকে অনেকে, বিশেষ করে যারা পর্যটক। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ইউনেস্কো, যারা দাবি করেছিল এর উচ্চতা বর্তমানের ৪০-তলা থেকে কমিয়ে আনতে হবে। তবে শহর কর্তৃপক্ষ আধুনিকতার দোহাই দিয়ে রাজি হয়নি।’
এলাকাটি লা কার্তুহা নামে পরিচিত। এখানে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশান’, এর জন্য নির্মিত হয় অনেক আধুনিক স্থাপনা। জেনিকা মজা করে বলল, ‘তোমাদের জন্য একটি কুইজ। ১৯৯২ সালটি কেন বিখ্যাত?’। সবাই নিরুত্তর দেখে সে নিজেই বলল, ‘১৯৯২ সালটি ছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৫০০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে সে বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই এক্সপোজিশান অনুষ্ঠিত হয়।’
জেনিকা এরপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি কেউ আমেরিকা থেকে এসেছ? তোমাদের আমেরিকা আবিষ্কারের বীর হলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস’। নাবিল ও নাতাশা দুজনেই হাত তুলে বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা আমেরিকা থেকে এসেছি। তবে কলম্বাস কখনো আমেরিকার মূল ভূখ-ে পা দেন নি। তিনি আশেপাশের কিছু দ্বীপে গিয়েছিলেন; সেখানে আদি বাসিন্দাদের। ওপর অনেক নির্যাতন করেছিলেন। তাই আমেরিকার অনেকে কলম্বাসকে পছন্দ করে না। সে দলে আছি আমরাও। ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েড-এর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বাসের ৪০টির বেশি মনুমেন্ট তুলে ফেলা হয়।’
জেনিকা-র মুখ একটু অন্ধকার হয়ে গেল। বলল, ‘গৌরব-স্তম্ভের পাদপীঠে ছায়া থাকে, এটিও সে রকম। কলম্বাস অবশ্যই কিছু বাড়াবাড়ি করেছেন। হাইতি ও ডোমিনিকান রিপাবলিক নিয়ে গঠিত হিসপানিওলা দ্বীপ এর শাসনের দায়িত্বে ছিলেন কলম্বাস। সেখানে নির্যাতনের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং শিকল পরিয়ে সে দ্বীপ থেকে জাহাজে করে স্পেনে নিয়ে আসা হয়। তাঁর পদবী প্রত্যাহার করে তাঁকে কয়েক সপ্তাহ কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। এ এক ট্র্যাজেডি।’
একটু ভাবলাম- কী আশ্চর্য মিল দুজন কিংবদন্তি বিজয়ীর জীবনের শেষ অধ্যায়ের! আর কী নির্মম রায় ইতিহাসের। কলম্বাস ও ক্লাইভ- দুজনেই তাদের রাজা-রাণীর জন্য জয় করেছেন নতুন ভূখ-, যার ফল অনেক ক্ষমতা ও অঢেল সম্পদ। ভূমি ও সম্পদ নিয়ে জোরজবরদস্তি ইতিহাসের নির্মম নিয়ম, তবে এ দু’জন তা করেছিলেন একটু বেশি, যা তাদের দেশ ও রাজন্যবর্গের জন্য হয়ে উঠেছিল অস্বস্তিকর। দু’জনেই স্বদেশে বিচারের সম্মুখীন হন, পরিণতিতে আসে হতাশা। কলম্বাস করুণভাবে মারা যান ৫৫ বছর বয়সে, আর ক্লাইভ আত্মহত্যা করেন ৪৯ বছর বয়সে।
নাবিল জিজ্ঞেস করল, ‘কলম্বাস কি সেভিয়া থেকে তাঁর আমেরিকার সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিল?’ জেনিকা বলল, ‘না। কলম্বাস তাঁর প্রথম আমেরিকা অভিযান শুরু করেন এখান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের ‘পেলোস দি লা ফ্রনথেরা’ নামক এক বন্দর থেকে। তবে তাঁর অভিযানের পরিকল্পনা ও আয়োজনের প্রধান কেন্দ্র ছিল সেভিয়া। কলম্বাস এখানে এসে প্রায়ই থাকতেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন এখান থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে ভায়াদোলিদ শহরে, যদিও তাঁর দেহাবশেষ রাখা আছে সেভিয়া ক্যাথেড্রালের ভেতরে। মজার ব্যাপার হলো, এখন সম্পদ ও ক্ষমতায় পৃথিবীতে প্রথম স্থানে আছে তোমাদের যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু কলম্বাসের আবিষ্কারের আগে সে দেশটির অস্তিত্বই জানত না বাকি পৃথিবী ।’
গুয়াদিলকুইভির-এর জলে ভেসে যেতে যেতে আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম স্পেনের ইতিহাসের এক ফ্ল্যাশব্যাক।
সামনে পালতোলা বিরাট এক জাহাজ। ওপরের প্রধান ডেকের সামনে বসে আছেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তাঁর পাশের টেবিলে রাখা কম্পাস ও ম্যাপের পাশে বসে তিনি হাই তুলছেন- এ যেন তৃপ্তি ও ক্লান্তির চিহ্ন। তৃপ্তি তো হবেই, কারণ, রাজা-রাণীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি পালন করেছেন, স্পেনের জন্য বয়ে এনেছেন বিশাল জয় ও অঢেল সম্পদ, আর নিজের জন্য অপেক্ষা করছে বহু উপঢৌকন ও সম্মান। শ্রান্তি তো আসবেই, কারণ আমেরিকা সফর শেষে, দীর্ঘ ১০ সপ্তাহের সমুদ্র ভ্রমণের পর ফিরে আসা এ বয়সে ভাগ্যের ব্যাপার। নিচের ডেকে দেখলাম কলম্বাসের নাবিকদের- মোট ৯০ জন। ফিরে এসেছেন বন্দরে, তাই সবাই আনন্দে মত্ত। আনন্দের আরেকটি কারণ নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে সাথে নিয়ে আসা সোনা, রূপা ও অন্যান্য সম্পদ। ভীষণ মন খারাপ একটি দলের, কতজন ঠিক গোনা যাচ্ছে না- সবচেয়ে নিচের পাটাতনে তারা সবাই গাদাগাদি করে আছে- কুচকুচে কালো রঙের, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তাদের হাত-পা শেকলে বাঁধা কিনা। তবে তাতে কিছু আসে যায় না, এমনিতেই প্রহারে, অনাহারে তারা প্রায় আধমরা। এরা হলো উপনিবেশ থেকে আনা মানুষদের চালান।
কল্পনা থেকে বাস্তবে এলাম যখন জাহাজটি পার হচ্ছে একটি সেতু, নাম- লা বারকোয়েথা। এর পশ্চিম দিকে অনেক আধুনিক ভবন ও পার্ক- ‘ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশান’-এর জন্য নির্মিত।
একটু পরে জাহাজটি ঘুরে আবার ‘থরে দেল ওরো’ টাওয়ারটির দিকে যাত্রা করল। সেটি ছাড়িয়ে ‘সান থেলমো’ সেতু পার হয়ে সে থামল পূর্বদিকে এক বিশাল সবুজ পার্কের পাশে। এতক্ষণ পর জেনিকা আবার শুরু করল তার বর্ণনা, ‘এটি পার্কে দি মারিয়া লুইজা-সেভিয়া শহরের অনেকগুলি পার্কের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যা গুয়াদিলকুইভির নদী বরাবর ছড়িয়ে আছে। পার্কটি সংযুক্ত করা হয় পরে নির্মিত প্লাজা দি এসপানিয়া ও প্লাজা দি আমেরিকা-র সাথে, যা নির্মিত হয়েছে ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠিত আইবেরীয়-আমেরিকান প্রদর্শনীর জন্য। এ ছিল পুরো পৃথিবীর স্পেনীয় ভাষা-ভাষী মানুষের মহামিলনের এক মেলা। তোমরা সময় করে অবশ্যই প্লাজা দি এসপানিয়া দেখতে যাবে।’
জাহাজটি যাত্রা শেষ করল তার ছাড়ার স্থান ‘থরে দেল ওরো’ জেটিতে এসে। জেনিকা শেষ বারের মতো বলল, ‘তোমাদেরকে বিদায় দেবার আগে ইতিহাসের এক নাটকীয় ঘটনার কথা বলি। মুররা গুয়াদালকিবির নদীর ওপর নির্মাণ করেছিল এক ভাসমান সেতু, যাতে পেঁচিয়ে রাখা হয় বিশাল এক ধাতব শেকল- একদিকে পাশের ‘থরে দেল ওরো’, আর অন্যদিকে ‘থ্রিয়ানা’, যা একটু আগে আমরা পার হয়েছি। উদ্দেশ্য- সেভিয়া শহরের প্রতিরক্ষা, যাতে কোন জাহাজ শহরের কাছে আসতে না পারে। ১২৪৮ সালের মে মাসে রাজা ফার্দিনান্দ-এর নৌ সেনাপতি এডমিরাল বনিফাজ তাঁর নৌবহর নিয়ে সে সেতু ও শেকল ভেঙ্গে ফেলে। ফলে ক’মাস পরেই, ২৩ নভেম্বর ১২৪৮ সালে ক্যাথলিকরা সেভিয়া অধিকার করে। এরপর শুরু হলো এর আরেকটি ইতিহাস। তোমরা এবার সেভিয়া-র সে ইতিহাস ঘুরে দেখ।’
লোরকা সে ইতিহাসেরই যেন ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর এ কবিতায়:
আঁধার তীরবাজ
ঘিরে আসে সেভিলার দিকে।
খুলে দেয় গুয়াদালকিবির।
চ্যাটা, ধানী টুপি,
আলগা ঝোল্লাই জামাজোড়া।
হায়, গুয়াদালকিবির।
আসছে সুদূর বিষাদের
দিকদেশ থেকে।
খুলে দিল গুয়াদালকিবির।
ঢুকে ঢুকে যায় ধাঁধাঁপথে।
ভালোবাসা, স্ফটিক, পাথর।
হায়, গুয়াদালকিবির।
সেভিয়া আর গুয়াদালকিবির এক হয়ে গেল নতুন ইতিহাসের অনুরণনে, তার রেশ নিয়ে আর সাথে জেনিকা-কে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।
জেনিকা সত্যিই একজন চমৎকার গাইড, যেন ইতিহাস চেতনার এক কবি, যেমন ছিলেন লোরকা ও জীবনানন্দ!
জবভ:
১.Poema de la Saeta:Arqueros: সায়তা-র কবিতা: তীরবাজ: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী - ১৬
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
শেষ বিকেলের আলো ছড়িয়ে পড়তেই আসলাম গুয়াদালকিবির নদীর পাশে; সামনেই সুন্দর এক টাওয়ার, নাম ‘থরে দেল ওরো’ এ স্পেনীয় শব্দটির মানে হলো ‘সোনালি টাওয়ার’। নামটির উৎপত্তি হয়েছে এর সোনালি আভা থেকে, যা প্রতিফলিত হয় পাশের নদীর জলে। এখানেই সেভিয়া-র রিভার ক্রুজের জেটি। এখানে ওঠার পর দেখি- সত্যিই, এ টাওয়ারের আভা পাশের গুয়াদিলকিভি-এর জলে সোনালি রঙে ঝিলমিল করছে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য!
রিভার ক্রুজ-এর সারি সারি জাহাজের মাঝে একটি, লস রিনকোনেছ-এ আমরা উঠেছি। গুয়াদিলকুইভির-এর বুকে জাহাজে ভেসে যাচ্ছি, মাথার ওপরে আকাশে উড়ছে একটি বিমান, পাশের রাস্তায় চলছে ঘোড়ার গাড়ি, বাস, কার, বাই সাইকেল। জল-আকাশ-স্থলে তিন বাহনের একসাথে চলার দৃশ্য দেখা এক মজার অভিজ্ঞতা।
ক্রুজের গাইড এসে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে নিজের নাম বলল। কোম্পানির নীল-সাদা কোট পরা, তার ওপর হালকা অলংকারে সজ্জিতা বেশ হাসিখুশি এক তরুণী জেনিকা। সে বলল, ‘গুয়াদিলকিভির নদীর ওপরে পুরো ক্রুজটি এক ঘণ্টার, কিছু সময় বেশিও লাগতে পারে। এটি স্পেনের একমাত্র রিভার ক্রুজ, কারণ সেভিয়া ছাড়া আর কোথাও নৌ চলাচলের উপযুক্ত নদী নেই।’ এরপর জেনিকা দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে বলল, ‘গুয়াদিলকিভির নদীর দুপারে সেভিয়া-র দুটি রূপ। এদিকে পূর্ব দিক- এখানে ঐতিহাসিক সেভিয়া। আর এদিকে পশ্চিম দিক- আধুনিক সেভিয়া। আমরা দুটি দিক পাশাপাশি দেখতে দেখতে যাব।’
জেনিকা বলে যাচ্ছে ইতিহাস, আর তা আমরা শুনছি, সাথে দেখছি, যেন চলছে এক স্লাইড শো।
জেনিকা-র বর্ণনা চলল, ‘আমরা যেখান থেকে রওয়ানা দিলাম, সে ৩৬-মিটার লম্বা ‘থরে দেল ওরো’ টাওয়ারটি ১২২০ সালে নির্মাণ করে মুররা। উদ্দেশ্য ছিল শহরের প্রবেশ পথ ও পোতাশ্রয়ের প্রতিরক্ষা।
একটি বছরের দু’টি ঘটনা বদলে দিয়েছে স্পেন ও ইউরোপকে, সাথে বড় পরিবর্তন এনেছে সারা পৃথিবীতেও। সেটা ছিল ১৪৯২ সাল। সে বছরের শুরুতে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা দখল করে ৭৮১ বছর ধরে চলা যুদ্ধ ‘রিকনকুইস্তা’-র শেষ পর্বে পৌঁছে। এরপর ক্যাথলিক মনার্ক ফার্দিনান্দ-ইসাবেলা তাঁদের শাসনে একীভূত করে স্পেনকে। বছরের শেষ দিকে গ্রানাদার আলহাম্বরায় বসে রানী ইসাবেলা অনুমতি দেন ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে সমুদ্র যাত্রার। ১২ অক্টোবর, ১৪৯২ সালে কলম্বাস পৌঁছেন নিউ ওয়ার্ল্ড, আমেরিকায়আর খোঁজ পান অনেক ভূমি ও প্রচুর সম্পদের। শুরু হয় এ নতুন পৃথিবীতে স্পেনের উপনিবেশ। আসতে থাকে নতুন পৃথিবী থেকে অঢেল সম্পদ, আর সেখানে পাঠানো হয় আফ্রিকা আনা ক্রীতদাস- যাদের বেচাকেনার প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে সেভিয়া। তবে গুয়াদিলকুইভির-এর পাশে ৩০০০ বছর ধরে গড়ে উঠেছে এ শহর- ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, এখন আন্দালুসিয়ার রাজধানী।
মুরদের বিদায়ের পর এই টাওয়ার ‘থরে দেল ওরো’ হয়ে উঠে ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর প্রবেশদ্বার। বের হওয়ার সময় যেত অস্ত্রসজ্জিত সেনাদল, তার মধ্যে কিছু ফিরে আসত, সাথে করে নিয়ে আসত জাহাজভর্তি স্বর্ণ ও অন্যান্য রত্ন। এ টাওয়ারের তিনটি অংশের সবচেয়ে নিচের অংশে তারা এসব সম্পদ জমা রাখত। নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে আনা ধন-সম্পদে দ্রুত সমৃদ্ধ উঠে সেভিয়া, সাথে স্পেনও। ১৬০০ সালের মধ্যে সেভিয়া হয়ে ওঠে স্পেনের বৃহত্তম ও সমৃদ্ধতম নগরী, আর স্পেন হয়ে যায় সম্পদ ও ক্ষমতায় পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। তবে সোনালি দিনগুলো বেশি দিন টিকল না। এর মধ্যে স্পেনীয় সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। স্পেনের দুর্ভাগ্যের সাথে সাথে সেভিয়ার দুর্ভাগ্যও বাড়তে থাকে। গুয়াদিলকুইভির নদীর বুকে পলি-স্তর বেড়ে যাওয়াতে বন্দর ও পোতাশ্রয় সরিয়ে নেয়া হয় কাদিজে। ১৭০০ সালের দিকে স্পেন ও সেভিয়া- দুটিরই সোনালি দিনের অবসান ঘটে।’
এতটুকু একনাগাড়ে বলে জেনিকা একটু থামল। তারপর পূর্ব দিকে একটি টাওয়ার দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো হিরালডা টাওয়ার- মাথা উঁচু করে ঘোষণা করছে সেভিয়ার ইতিহাস ও গৌরব। এটি তার পাশের সেভিয়া ক্যাথেড্রালের বেল টাওয়ার। এ ক্যাথেড্রাল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গথিক চার্চ। জায়গাটি সেভিয়ার ঐতিহাসিক কেন্দ্র। মুররা ভিসিগথদের গির্জার ওপর করেছিল একটি মসজিদ- এ ছিল প্রথম ভুল। দ্বিতীয় ভুল করল ক্যাথলিকরা, তারা সে মসজিদের ওপর করল এই সেভিয়া ক্যাথেড্রাল। নতুন একটি ভুল দিয়ে পুরনো ভুলের সংশোধন করা যায় না। ব্যাপারটি অনেকটা এ রকম- ‘Ôthe conquerors write the history।’ আমি একটু যোগ করলাম: ‘Ôthe conquerors remake the history..’
কথার মোড় ঘুরিয়ে জেনিকা বলল, ‘ক্যাথেড্রালের পাশেই দেখ মুরদের তৈরি আলকাছার দুর্গ। প্রায় এক হাজার বছর ধরে এটি স্পেনের রাজন্যবর্গের বাসস্থান- যা ইউরোপের প্রাচীনতম চালু রাজপ্রাসাদ।’
এরপর একটি সেতুর নিচ দিয়ে যাওয়ার সময় জেনিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুয়েন্তে দে ইসাবেল- এটি শহরের পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে যাবার প্রধান সেতু। পশ্চিমদিকের জায়গাটির নাম ‘বারিয়ো দে থ্রিয়ানা’- যা মূলত দক্ষ কারিগর ও ফ্লেমেনকো শিল্পীদের এক জনপদ। ফ্লেমেনকো যখন, জিপসিরা তো থাকবেই, সাথে তা হবে আন্দলুসিয়ার ঐতিহ্যে ভরপুর ও সদা প্রাণচঞ্চল! এলাকাটি অনেক বিখ্যাত বুল-ফাইটার ও ফ্লেমেনকো শিল্পীর জন্ম দিয়েছে। তাছাড়া এখানে আছে সিরামিক আর্টের অনেক কর্মশালা, যেখানে নির্মিত হয় বিখ্যাত আছুলেহস টাইলস, যা নীল রঙের চিত্রাঙ্কন দিয়ে শোভিত করা হয়।’
জাহাজ ‘বারিয়ো দে থ্রিয়ানা’ যাবার সময় জেনিকার সাথে আমরাও থাকালাম পশ্চিম দিকে। সে জানাল, ‘দেখ, এদিকে নদীর পাড় ঘিরে এক সুন্দর বড় রাস্তা- কায়ে বেটিস। তার ওপর সারি সারি বাড়ি, কোনটিই ৫-তলার বে নয়, প্রতিটির রঙ ভিন্ন, তারা রচনা করেছে রঙের এক ইন্দ্রজাল। প্রতিটির নিচ তলায় রেস্তোরাঁ বা বার, সামনের চত্বরে বসার জায়গা আছে- এখানে বসে দেখা যায় অপর পাড়ের থরে দেল ওরো, আলকাছার, ক্যাথেড্রাল, হিরালডা।’ কায়ে বেটিস পর্যটকদের প্রিয় একটি জায়গা।’
জাহাজ সামনে একটু এগুতে জেনিকা দেখাল প্লাছা দে থরোছ- এখানকার বুল-ফাইটিংয়ের প্রধান অঙ্গন।
ইতিহাসের পথে যেতে যেতে হঠাৎ যেন সুর কেটে গেল। পশ্চিম দিকে জেগে উঠল এক গগনচুম্বী অট্টালিকা। জেনিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘এর নাম থরে সেভিয়া, অনেকে বলে ‘সেভিল টাওয়ার’, আধুনিক সেভিয়া-র প্রতীক। ১৮০.৫ মিটার দীর্ঘ টাওয়ারটি নির্মিত হয় ২০১৫ সালে, যাতে রয়েছে অনেক অফিস ও পাঁচ-তারকা হোটেল। এটি আন্দালুসিয়া ও সেভিয়া-র সবচেয়ে উঁচু ভবন।’
বিদায়ী সূর্যের রঙে উজ্জল সেভিল টাওয়ারটি দেখিয়ে নাতাশা বলে উঠল, ‘সেভিয়া-র সাথে এ টাওয়ারটি বেমানান। এটি এখানকার ইতিহাস ও স্থাপত্যকে তুলে ধরে না।’ জেনিকা হেসে বলল, ‘এ কথাটি বলে থাকে অনেকে, বিশেষ করে যারা পর্যটক। তাদের সাথে যোগ দিয়েছে ইউনেস্কো, যারা দাবি করেছিল এর উচ্চতা বর্তমানের ৪০-তলা থেকে কমিয়ে আনতে হবে। তবে শহর কর্তৃপক্ষ আধুনিকতার দোহাই দিয়ে রাজি হয়নি।’
এলাকাটি লা কার্তুহা নামে পরিচিত। এখানে ১৯৯২ সালে অনুষ্ঠিত হয় ‘ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশান’, এর জন্য নির্মিত হয় অনেক আধুনিক স্থাপনা। জেনিকা মজা করে বলল, ‘তোমাদের জন্য একটি কুইজ। ১৯৯২ সালটি কেন বিখ্যাত?’। সবাই নিরুত্তর দেখে সে নিজেই বলল, ‘১৯৯২ সালটি ছিল ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের ৫০০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষে সে বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই এক্সপোজিশান অনুষ্ঠিত হয়।’
জেনিকা এরপর জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি কেউ আমেরিকা থেকে এসেছ? তোমাদের আমেরিকা আবিষ্কারের বীর হলেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস’। নাবিল ও নাতাশা দুজনেই হাত তুলে বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা আমেরিকা থেকে এসেছি। তবে কলম্বাস কখনো আমেরিকার মূল ভূখ-ে পা দেন নি। তিনি আশেপাশের কিছু দ্বীপে গিয়েছিলেন; সেখানে আদি বাসিন্দাদের। ওপর অনেক নির্যাতন করেছিলেন। তাই আমেরিকার অনেকে কলম্বাসকে পছন্দ করে না। সে দলে আছি আমরাও। ২০২০ সালে জর্জ ফ্লয়েড-এর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বাসের ৪০টির বেশি মনুমেন্ট তুলে ফেলা হয়।’
জেনিকা-র মুখ একটু অন্ধকার হয়ে গেল। বলল, ‘গৌরব-স্তম্ভের পাদপীঠে ছায়া থাকে, এটিও সে রকম। কলম্বাস অবশ্যই কিছু বাড়াবাড়ি করেছেন। হাইতি ও ডোমিনিকান রিপাবলিক নিয়ে গঠিত হিসপানিওলা দ্বীপ এর শাসনের দায়িত্বে ছিলেন কলম্বাস। সেখানে নির্যাতনের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং শিকল পরিয়ে সে দ্বীপ থেকে জাহাজে করে স্পেনে নিয়ে আসা হয়। তাঁর পদবী প্রত্যাহার করে তাঁকে কয়েক সপ্তাহ কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। এ এক ট্র্যাজেডি।’
একটু ভাবলাম- কী আশ্চর্য মিল দুজন কিংবদন্তি বিজয়ীর জীবনের শেষ অধ্যায়ের! আর কী নির্মম রায় ইতিহাসের। কলম্বাস ও ক্লাইভ- দুজনেই তাদের রাজা-রাণীর জন্য জয় করেছেন নতুন ভূখ-, যার ফল অনেক ক্ষমতা ও অঢেল সম্পদ। ভূমি ও সম্পদ নিয়ে জোরজবরদস্তি ইতিহাসের নির্মম নিয়ম, তবে এ দু’জন তা করেছিলেন একটু বেশি, যা তাদের দেশ ও রাজন্যবর্গের জন্য হয়ে উঠেছিল অস্বস্তিকর। দু’জনেই স্বদেশে বিচারের সম্মুখীন হন, পরিণতিতে আসে হতাশা। কলম্বাস করুণভাবে মারা যান ৫৫ বছর বয়সে, আর ক্লাইভ আত্মহত্যা করেন ৪৯ বছর বয়সে।
নাবিল জিজ্ঞেস করল, ‘কলম্বাস কি সেভিয়া থেকে তাঁর আমেরিকার সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিল?’ জেনিকা বলল, ‘না। কলম্বাস তাঁর প্রথম আমেরিকা অভিযান শুরু করেন এখান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের ‘পেলোস দি লা ফ্রনথেরা’ নামক এক বন্দর থেকে। তবে তাঁর অভিযানের পরিকল্পনা ও আয়োজনের প্রধান কেন্দ্র ছিল সেভিয়া। কলম্বাস এখানে এসে প্রায়ই থাকতেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেন এখান থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে ভায়াদোলিদ শহরে, যদিও তাঁর দেহাবশেষ রাখা আছে সেভিয়া ক্যাথেড্রালের ভেতরে। মজার ব্যাপার হলো, এখন সম্পদ ও ক্ষমতায় পৃথিবীতে প্রথম স্থানে আছে তোমাদের যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু কলম্বাসের আবিষ্কারের আগে সে দেশটির অস্তিত্বই জানত না বাকি পৃথিবী ।’
গুয়াদিলকুইভির-এর জলে ভেসে যেতে যেতে আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম স্পেনের ইতিহাসের এক ফ্ল্যাশব্যাক।
সামনে পালতোলা বিরাট এক জাহাজ। ওপরের প্রধান ডেকের সামনে বসে আছেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তাঁর পাশের টেবিলে রাখা কম্পাস ও ম্যাপের পাশে বসে তিনি হাই তুলছেন- এ যেন তৃপ্তি ও ক্লান্তির চিহ্ন। তৃপ্তি তো হবেই, কারণ, রাজা-রাণীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি তিনি পালন করেছেন, স্পেনের জন্য বয়ে এনেছেন বিশাল জয় ও অঢেল সম্পদ, আর নিজের জন্য অপেক্ষা করছে বহু উপঢৌকন ও সম্মান। শ্রান্তি তো আসবেই, কারণ আমেরিকা সফর শেষে, দীর্ঘ ১০ সপ্তাহের সমুদ্র ভ্রমণের পর ফিরে আসা এ বয়সে ভাগ্যের ব্যাপার। নিচের ডেকে দেখলাম কলম্বাসের নাবিকদের- মোট ৯০ জন। ফিরে এসেছেন বন্দরে, তাই সবাই আনন্দে মত্ত। আনন্দের আরেকটি কারণ নিউ ওয়ার্ল্ড থেকে সাথে নিয়ে আসা সোনা, রূপা ও অন্যান্য সম্পদ। ভীষণ মন খারাপ একটি দলের, কতজন ঠিক গোনা যাচ্ছে না- সবচেয়ে নিচের পাটাতনে তারা সবাই গাদাগাদি করে আছে- কুচকুচে কালো রঙের, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তাদের হাত-পা শেকলে বাঁধা কিনা। তবে তাতে কিছু আসে যায় না, এমনিতেই প্রহারে, অনাহারে তারা প্রায় আধমরা। এরা হলো উপনিবেশ থেকে আনা মানুষদের চালান।
কল্পনা থেকে বাস্তবে এলাম যখন জাহাজটি পার হচ্ছে একটি সেতু, নাম- লা বারকোয়েথা। এর পশ্চিম দিকে অনেক আধুনিক ভবন ও পার্ক- ‘ইউনিভার্সেল এক্সপোজিশান’-এর জন্য নির্মিত।
একটু পরে জাহাজটি ঘুরে আবার ‘থরে দেল ওরো’ টাওয়ারটির দিকে যাত্রা করল। সেটি ছাড়িয়ে ‘সান থেলমো’ সেতু পার হয়ে সে থামল পূর্বদিকে এক বিশাল সবুজ পার্কের পাশে। এতক্ষণ পর জেনিকা আবার শুরু করল তার বর্ণনা, ‘এটি পার্কে দি মারিয়া লুইজা-সেভিয়া শহরের অনেকগুলি পার্কের মধ্যে সবচেয়ে বড়, যা গুয়াদিলকুইভির নদী বরাবর ছড়িয়ে আছে। পার্কটি সংযুক্ত করা হয় পরে নির্মিত প্লাজা দি এসপানিয়া ও প্লাজা দি আমেরিকা-র সাথে, যা নির্মিত হয়েছে ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠিত আইবেরীয়-আমেরিকান প্রদর্শনীর জন্য। এ ছিল পুরো পৃথিবীর স্পেনীয় ভাষা-ভাষী মানুষের মহামিলনের এক মেলা। তোমরা সময় করে অবশ্যই প্লাজা দি এসপানিয়া দেখতে যাবে।’
জাহাজটি যাত্রা শেষ করল তার ছাড়ার স্থান ‘থরে দেল ওরো’ জেটিতে এসে। জেনিকা শেষ বারের মতো বলল, ‘তোমাদেরকে বিদায় দেবার আগে ইতিহাসের এক নাটকীয় ঘটনার কথা বলি। মুররা গুয়াদালকিবির নদীর ওপর নির্মাণ করেছিল এক ভাসমান সেতু, যাতে পেঁচিয়ে রাখা হয় বিশাল এক ধাতব শেকল- একদিকে পাশের ‘থরে দেল ওরো’, আর অন্যদিকে ‘থ্রিয়ানা’, যা একটু আগে আমরা পার হয়েছি। উদ্দেশ্য- সেভিয়া শহরের প্রতিরক্ষা, যাতে কোন জাহাজ শহরের কাছে আসতে না পারে। ১২৪৮ সালের মে মাসে রাজা ফার্দিনান্দ-এর নৌ সেনাপতি এডমিরাল বনিফাজ তাঁর নৌবহর নিয়ে সে সেতু ও শেকল ভেঙ্গে ফেলে। ফলে ক’মাস পরেই, ২৩ নভেম্বর ১২৪৮ সালে ক্যাথলিকরা সেভিয়া অধিকার করে। এরপর শুরু হলো এর আরেকটি ইতিহাস। তোমরা এবার সেভিয়া-র সে ইতিহাস ঘুরে দেখ।’
লোরকা সে ইতিহাসেরই যেন ইঙ্গিত দিয়েছেন তাঁর এ কবিতায়:
আঁধার তীরবাজ
ঘিরে আসে সেভিলার দিকে।
খুলে দেয় গুয়াদালকিবির।
চ্যাটা, ধানী টুপি,
আলগা ঝোল্লাই জামাজোড়া।
হায়, গুয়াদালকিবির।
আসছে সুদূর বিষাদের
দিকদেশ থেকে।
খুলে দিল গুয়াদালকিবির।
ঢুকে ঢুকে যায় ধাঁধাঁপথে।
ভালোবাসা, স্ফটিক, পাথর।
হায়, গুয়াদালকিবির।
সেভিয়া আর গুয়াদালকিবির এক হয়ে গেল নতুন ইতিহাসের অনুরণনে, তার রেশ নিয়ে আর সাথে জেনিকা-কে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।
জেনিকা সত্যিই একজন চমৎকার গাইড, যেন ইতিহাস চেতনার এক কবি, যেমন ছিলেন লোরকা ও জীবনানন্দ!
জবভ:
১.Poema de la Saeta:Arqueros: সায়তা-র কবিতা: তীরবাজ: অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়