নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসীতে গাজী গ্রুপের টায়ার তৈরি কারখানায় দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুন ২৪ ঘন্টা পরও জ্বলছে। তবে সোমবার (২৬ আগস্ট) সন্ধ্যায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ফায়ার সার্ভিস জানায়। আগুন পুরোপুরি নেভার কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম। ২৫ আগস্ট রোববার রাত নয়টার দিকে কারখানাটিতে আগুন দেয়া হয়। এর আগে দুপুর থেকে কারখানাটিতে লুটপাট চলতে থাকে। এর আগে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও কারখানাটিতে লুটপাট, ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয়েছিল।

সোমবারও দিনভর কারখানাটির বিভিন্ন অংশে লুটপাট করতে দেখা গেছে? যদিও কারখানাটির ভেতর ও বাইরে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে সোমবার সকাল থেকেই নিখোঁজ হয়েছেন বলে কারখানার সামনে এসে ভীড় জমান অনেক স্বজন। বিকেল ৩টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৭৬ জনের একটি তালিকা পাওয়া যায়। তালিকার বাইরেও অনেকে ছবি হাতে সন্ধ্যানের আশায় অপেক্ষা করতে দেখা যায়। বেশিরভাগ নিখোঁজদের বাড়ি উপজেলার মিকুলী, রূপসী কাজিপাড়া, ছাতিয়ান, মুগরাকুল, কাহিনা, বরপা, মাসাবো, তারাব, বরাব, মুড়াপাড়াসহ আশ-পাশের এলাকার বলে জানা গেছে।

তবে তাদের কেউ কারখানার শ্রমিক নন বলে দাবি কারখানা কর্তৃপক্ষের। কারখানায় হামলা চালিয়ে লুটপাট কিংবা অন্য কোনো কাজে তারা এসেছিলেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

যেভাবে আগুন লাগানো হয়
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী এবং সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীরের মালিকানাধীন রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানা রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রবল ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ শত শত লোকজন ও লুটপাটকারীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে রূপসী এলাকায় গাজী টায়ার কারখানা ও কর্ণগোপ এলাকায় গাজী পাইপ এবং ট্যাংক কারখানায় প্রবেশ করে ভাঙচুর ও মালামাল লুটপাট করেন। এক পর্যায়ে ওই দুটি কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরে রূপগঞ্জের নবকিশোলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যা মামলার আসামি গোলাম দস্তগীর গাজীকে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার এবং নারায়ণগঞ্জ আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে সোপর্দ করার পর আদালত ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ খবরের পরই রোববার সন্ধ্যার দিকে কয়েক শতাধীক লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে রূপসী গাজী টায়ার কারখানার সামনে ও ভেতরে ঢুকে পরে। এরপর আবারও ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করেন বলে স্থানীয়দের ভাষ্য।

স্থানীয়রা বলছেন, এক পর্যায়ে রোববার রাত সাড়ে ৯টার দিকে কারখানার ভেতরের ৬ তলা ভবনে প্রবেশ করেন কয়েক শতাধীক লোকজন। ওই ভবনে ক্যামিকেল ও টায়ার তৈরির কাঁচামাল ছিল। ভবনের ভেতরে লুটপাট নিয়ে দুটি পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারপিটেয়র ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি পক্ষ ভবন ত্যাগ করলে ভবনের প্রবেশ গেট বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে পুরো ভবনে আগুন লেগে যায়। এ সময় আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের ভেতরে আটকা পড়া অনেকেই স্বজনদের ফোন করে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায় বলে বেশ কয়েকজন স্বজন দাবি করেছেন। খবর পেয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া ফায়ার সার্ভিস, ডেমড়া ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, কাঞ্চন ফায়ার সার্ভিস, আড়াইহাজার ফায়ার সার্ভিসসহ ১২টি ইউনিট কাজ চালিয়ে যান।

তালিকা নিয়ে দুইরকম বক্তব্য
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে ভবনটির সামনে ব্রিফিংয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (ঢাকা) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম বলেন, ‘রোববার রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আমরা আগুনের খবর পাই? যানজটের কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে ১১টা ৪০ বেজে যায়? তারপর থেকে আমরা অগ্নিনির্বাপনে কাজ শুরু করি।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও পুরোপুরি নেভানো যায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরোপুরি নেভাতে আরও সময় লাগবে। তবে আগুন আর ছড়াবে না বলে আশা করছি। যেহেতু টায়ার তৈরির কাচামাল ও রাসায়নিক অত্যান্ত দাহ্য, সেই কারণে আগুন নেভাতে সময় লাগছে। আগুন নেভা পর্যন্ত কাজ চলবে।’

নিখোঁজদের তালিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভিক্টিম লিস্ট তৈরির দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের? আগুন নির্বাপন করাই আমাদের প্রথম দায়িত্ব? ভিক্টিম লিস্টের দিকে আমাদের নজর নেই? আমরা সকাল পর্যন্ত ১৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছি? তাদের স্বজনদের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছি?’ কারখানার প্রধান ফটকে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তালিকা করছিলেন? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে ব্যাপারে কোনো তথ্য আমার জানা নেই? কেউ তালিকা করে থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন? কেননা আমিও কিছুটা ডাউটের (সন্দেহ) মধ্যে পড়ে গেছি যে (তালিকা করার) এ তথ্যটা আপনাদের কে দিলো? আমরা তো কখনও কোনো অগ্নিকা-ের ঘটনায় কোনো তালিকা করি না?’

যদিও বেলা সোয়া একটায় এক ব্রিফিংএ লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম বলেছিলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস থেকে ৯২ জন নিখোঁজের তালিকা করা হয়েছে।’

নিখোঁজ কারা?
সোমবার সন্ধ্যায় কারখানার মূল ফটকে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এমন অন্তত ১০ জন স্বজনের। রোববার রাত থেকে বড় বোন শিউলী বেগমের (৩৫) খোঁজে দাঁড়িয়ে আছেন মো. রায়হান। তিনি জানান, রোববার রাত ৮টায় শিউলী ও তার স্বামী মো. নাহিদ কারখানায় আসে। আসার পর ভীড়ের মধ্যে দুজন আলাদা হয়ে যায়। আগুন লাগার পর নাহিদ বেরিয়ে আসতে পারলেও আটকা পরেন শিউলী।

বাবা ও বড় ভাইয়ের খোঁজে অপেক্ষা করছিল আপন নামে এক কিশোর। আপন জানান, তারা দুজন কারখানার শ্রমিক। রাতে তারা এক সঙ্গে এসেছিল, এরপর থেকেই তারা নিখোঁজ।

কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম জানান, ‘রোববার দুপুরে কয়েকশ’ লোক কারখানায় ঢুকে পড়ে? তাদের বাধা দেয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না? লুটপাটের সময় রাত নয়টার দিকে কারখানাটির ছয়তলা ভবনটির নিচতলায় আগুন লাগিয়ে দেয় লুটপাটকারীরা।’

দুপুরে লুটপাট শুরু হলে পুলিশসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি জানানো হলেও কেউ এগিয়ে আসেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি? তবে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (গ-সার্কেল) হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশ কোনো অবহেলা করেনি। আমরা কারখানার নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’