alt

ব্যাংক কোম্পানি অধ্যাদেশ সংশোধনের খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে, ‘পরিবারতন্ত্রে’র লাগাম টানার উদ্যোগ

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক : রোববার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের লাগাম টানতে উদ্যোগী হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধন করা হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইন, যেখানে পরিবারের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি কমানো হবে একই পরিবার থেকে পরিচালকদের সংখ্যা এবং পরিচালকদের একটানা পদে থাকার সময়সীমা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা হলে এবং পরিচালকদের পদে থাকার সময়সীমা কমানো হলে কোনো ব্যাংক একটি পরিবারের কবজায় রাখা কঠিন হবে। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর একটি খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা হলে এবং পরিচালকদের পদে থাকার সময়সীমা কমানো হলে কোনো ব্যাংক একটি পরিবারের কবজায় রাখা কঠিন হবে। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, প্রিমিয়ার গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব গ্রুপের পরিচালকেরা নিজেদের পাশাপাশি তাদের স্ত্রী, স্বামী, ছেলে-মেয়ে, জামাতা এবং নিকটাত্মীয়দের ব্যাংকের পর্ষদে বসাতেন।

কয়েকটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু ব্যাংক এখন দুর্দশায় রয়েছে। আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। সরকার পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি ব্যাংক গঠন করছে। একীভূত ব্যাংকটিকে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন দিতে হচ্ছে সরকারের কোষাগার থেকে, যা সাধারণ মানুষের করের টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশের ব্যাংক ব্যবসা নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করা, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করাই এবারের ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আইনটির খসড়া নিয়ে এখন কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তবে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) খসড়াটির বিভিন্ন ধারা নিয়ে তাদের মতামত দিয়েছে।

দেশে এখন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ (এর মধ্যে ৫টি একীভূত হওয়ার পথে)। এসব ব্যাংক পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে। ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নেয়। মানুষের টাকা যাতে নিরাপদ থাকে, তা নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের লাগাম টানতে আইনে কয়েকটি ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসছে। তার একটি হলো ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা।

বিদ্যমান আইনে ‘ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান’ নামের একটি অংশে পরিবারের সদস্যদের তালিকা দেওয়া আছে। বর্তমানে পরিবারের সদস্য বলতে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী/স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। খসড়ায় নতুন করে যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে আরও কিছু স্বজনকে। তার মধ্যে রয়েছে ভাবি, ভগ্নিপতি, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা (স্ত্রীর ক্ষেত্রে দেবর-ননদ) এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি।

বিএবি ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞা শুধু স্বামী-স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে। সংগঠনটি উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ভারতের আইনে পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী বা হিন্দু অবিভক্ত পরিবারকে বোঝানো হয়। পাকিস্তানে তা স্বামী-স্ত্রী, নির্ভরশীল সরাসরি বংশধর ও নির্ভরশীল ভাই-বোন। শ্রীলঙ্কায় পরিবার বলতে শুধু স্বামী-স্ত্রী বা নির্ভরশীল সন্তানকে বোঝানো হয়।

ব্যাংকে একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা কমানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন ব্যাংকের পর্ষদে থাকতে পারেন। নতুন নিয়মে তা কমিয়ে দুজন করার কথা বলা হয়েছে। বিএবি এই সীমা তুলে দেওয়া বা শিথিল করার প্রস্তাব করে বলেছে, সতর্কতার সঙ্গে এ বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী ও অঙ্গীকারসম্পন্ন পরিচালককে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ব্যাংক সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছিল যে একই পরিবারের একাধিক সদস্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবেন না। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এখন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।

বর্তমান নিয়মে পরিচালকেরা টানা ১২ বছর পর্ষদে থাকতে পারে। এ নিয়মে পরিবর্তন করে সময়সীমা টানা ছয় বছরের কথা বলা হয়েছে। বিএবি বলছে, পরিচালকদের ৯ বছর থাকার সুযোগ রাখা হোক। মেয়াদ কমালে অভিজ্ঞতার ঘাটতি হবে ও ব্যাংক খাতে নেতিবাচক বার্তা যাবে।

অবশ্য বিশ্লেষকেরা বিএবির এ যুক্তিকে সঠিক মনে করছেন না। কারণ অতীতে একটানা দীর্ঘসময় থাকতে দিয়েই ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে এবং ব্যাংক দুর্দশায় পড়েছে।

২০১৮ সালের আগেই পরিচালকদের একটানা মেয়াদ ছিল ছয় বছর। ২০১৮ সালে তা ৯ বছর করা হয়। ২০২৩ সালে আইন আবার সংশোধন করে করা হয় ১২ বছর। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন ঘিরে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে হইচই ও হট্টগোল হয়েছিল। ওই বছরের ৮ জুন ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩ জাতীয় সংসদে তুলেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংশোধনীর মূল প্রস্তাবে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানো-কমানোর বিষয়ে কোনো প্রস্তাব ছিল না। কিন্তু সংসদে এ বিল পাসের আগে এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব দেন তৎকালীন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম। তিনি পরিচালক পদের মেয়াদ টানা ১২ বছর করার প্রস্তাব করেন। সেটাই পাস হয়। বিশ্লেষকেরা বিএবির এ যুক্তিকে সঠিক মনে করছেন না। কারণ অতীতে একটানা দীর্ঘসময় থাকতে দিয়েই ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে এবং ব্যাংক দুর্দশায় পড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ হবে ১৫ সদস্যের, যার ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ অর্ধেকই থাকবেন স্বতন্ত্র পরিচালক। বর্তমানে ২০ সদস্যের পর্ষদ রয়েছে ব্যাংকগুলোতে, যার মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার বিধান আছে ৩ জন। বিএবি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছে, স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা ২ থেকে ৩ জন হতে পারে। অর্ধেক স্বতন্ত্র পরিচালক থাকলে শেয়ারমালিকদের নিয়ন্ত্রণ কমবে এবং ব্যাংক পরিচালনায় মুনাফা ও প্রবৃদ্ধির চেয়ে কেবল নীতিপালন অগ্রাধিকার পাবে। অবশ্য এ বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালক সংখ্যায় হবে ৮ জন। পর্ষদের শতভাগই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে পারলে আরও ভালো হতো।’

ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য পরিচালনা পর্ষদে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা থাকতে পারবেন না- এমন একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাবও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বর্তমানে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা পরিচালক নিয়োগ, পুনর্নিয়োগ, পদায়ন, অব্যাহতি, বরখাস্ত, অপসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ইত্যাদি বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রে লাগে না। এসব ব্যাংকে সরকার নিয়োগ দেয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ‘একই ধরনের বিধান’ করার স্বার্থে বিশেষায়িত ব্যাংকের এমডি, সিইও বা পরিচালকদের বেলায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমডি, সিইও বা পরিচালক হওয়ার বর্তমান শর্ত হচ্ছে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা। এটা বাড়িয়ে ১৫ বছর করার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়।

ছবি

শেয়ারবাজারে লেনদেন কমে দাঁড়ালো ২০০ কোটি টাকার ঘরে

ছবি

বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদত্যাগসহ ৮ দাবিতে বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ

ছবি

বেক্সিমকো টেক্সটাইল সচল করছে রিভাইভাল

ছবি

পণ্য পরিবহন নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন চায় বিসিভিওএ-কোয়াব

ছবি

মিডল্যান্ড ব্যাংক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সামির উদ্দিনের যোগদান

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের সেমিকন্ডাক্টর রোড শো অনুষ্ঠিত

ছবি

টানা পতনে ১৭ হাজার কোটি টাকা মূলধন হারালো শেয়ারবাজার

ছবি

এ বছর বিশ্ববাজারে চালের দাম কমেছে ১৪ শতাংশ

ছবি

৫ হাজার কোটি টাকা চেয়ে ১ হাজার কোটি পাচ্ছে আইসিবি

ছবি

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান হলেন কায়সার আলম

ছবি

ক্লাইমেট রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সিটি ব্যাংক

ছবি

দুই মাস বন্ধ থাকার পর টিসিবির পণ্য বিক্রি শুরু

ছবি

রিয়েলমি সি৮৫ প্রো’র সেল শুরু

ছবি

বাড়তি দামেই বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ, সরবরাহ বাড়ায় সবজির দাম কমেছে

ছবি

আইএমএফ থেকে পরের কিস্তি পাওয়ার আলোচনা হবে নতুন সরকারের সঙ্গে

ছবি

পাঁচ ব্যাংক নয়, সরকারের টাকা পাবে ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’

ছবি

খেলাপি হার ২০ শতাংশ হলেও তহবিল পরিচালনায় যোগ্য হবে ব্যাংক

ছবি

এবার স্বর্ণের দাম ভরিতে বাড়লো ৫ হাজার টাকা

ছবি

সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ নীতিমালা অনুমোদন

ছবি

ঠিকায় কাজ করা পোশাক কারখানাও প্রণোদনা পাবে

ছবি

রমজান-নির্বাচন উপলক্ষে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর তাগিদ

ছবি

বাকিতে আমদানি করা যাবে রোজার পণ্য

ছবি

সুমিটোমো থার্ড টার্মিনালের অপারেশনস-মেইটেনেন্স কাজ করতে আগ্রহী জাপান

ছবি

চলমান গ্যাস সংকট কমাতে দীর্ঘ পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার

ছবি

প্রথম প্রান্তিকে ওয়ালটনের মুনাফায় ৪৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি

ছবি

সয়াবিন তেল ও চিনি কিনছে সরকার

ছবি

১৬৪ টাকায় সয়াবিন তেল, ৯৪ টাকায় চিনি কিনবে সরকার

ছবি

ভারতে মূল্যস্ফীতি শূন্যের কাছাকাছি

ছবি

সিএমএসএমইর তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ল

ছবি

সরকারের জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ, অর্থবিভাগ-এর সাথে সর্বজনীন পেনশন স্কিমসমুহে রেজিস্ট্রেশন

ছবি

মিউচুয়াল ফান্ড বিধিমালা নিয়ে গেজেট, থাকছে না মেয়াদি ফান্ড

ছবি

মেট্রোরেল প্রকল্প বাতিল হয়নি, ব্যয় কমানোর চেষ্টা চলছে: ডিএমটিসিএল এমডি

ছবি

পাঁচ ব্যাংকের অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চেয়ে চিঠি

ছবি

নতুন পে-স্কেলের ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে যাবে বর্তমান সরকার: অর্থ উপদেষ্টা

ছবি

চট্টগ্রামে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল: ৩০ বছর চালাবে ডেনমার্কের কোম্পানি

ছবি

পাঁচ ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানত নিয়ে উদ্বিগ্ন না হওয়ার অনুরোধ প্রশাসকদের

tab

ব্যাংক কোম্পানি অধ্যাদেশ সংশোধনের খসড়া অর্থ মন্ত্রণালয়ে, ‘পরিবারতন্ত্রে’র লাগাম টানার উদ্যোগ

অর্থনৈতিক বার্তা পরিবেশক

রোববার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের লাগাম টানতে উদ্যোগী হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশোধন করা হচ্ছে ব্যাংক কোম্পানি আইন, যেখানে পরিবারের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি কমানো হবে একই পরিবার থেকে পরিচালকদের সংখ্যা এবং পরিচালকদের একটানা পদে থাকার সময়সীমা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা হলে এবং পরিচালকদের পদে থাকার সময়সীমা কমানো হলে কোনো ব্যাংক একটি পরিবারের কবজায় রাখা কঠিন হবে। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর একটি খসড়া তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা হলে এবং পরিচালকদের পদে থাকার সময়সীমা কমানো হলে কোনো ব্যাংক একটি পরিবারের কবজায় রাখা কঠিন হবে। এতে অনিয়ম-দুর্নীতি কমবে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো, প্রিমিয়ার গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব গ্রুপের পরিচালকেরা নিজেদের পাশাপাশি তাদের স্ত্রী, স্বামী, ছেলে-মেয়ে, জামাতা এবং নিকটাত্মীয়দের ব্যাংকের পর্ষদে বসাতেন।

কয়েকটি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু ব্যাংক এখন দুর্দশায় রয়েছে। আমানতকারীরা অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না। সরকার পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করে একটি ব্যাংক গঠন করছে। একীভূত ব্যাংকটিকে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধন দিতে হচ্ছে সরকারের কোষাগার থেকে, যা সাধারণ মানুষের করের টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশের ব্যাংক ব্যবসা নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ এখতিয়ার প্রতিষ্ঠা করা, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করাই এবারের ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

আইনটির খসড়া নিয়ে এখন কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তবে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) খসড়াটির বিভিন্ন ধারা নিয়ে তাদের মতামত দিয়েছে।

দেশে এখন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা ৬১ (এর মধ্যে ৫টি একীভূত হওয়ার পথে)। এসব ব্যাংক পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে। ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত নেয়। মানুষের টাকা যাতে নিরাপদ থাকে, তা নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্রের লাগাম টানতে আইনে কয়েকটি ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসছে। তার একটি হলো ব্যাংক কোম্পানি আইনে পরিবারের সংজ্ঞা বিস্তৃত করা।

বিদ্যমান আইনে ‘ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান’ নামের একটি অংশে পরিবারের সদস্যদের তালিকা দেওয়া আছে। বর্তমানে পরিবারের সদস্য বলতে কোনো ব্যক্তির স্ত্রী/স্বামী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিকে বোঝানো হয়। খসড়ায় নতুন করে যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে আরও কিছু স্বজনকে। তার মধ্যে রয়েছে ভাবি, ভগ্নিপতি, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা (স্ত্রীর ক্ষেত্রে দেবর-ননদ) এবং ওই ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল কোনো ব্যক্তি।

বিএবি ‘পরিবার’-এর সংজ্ঞা শুধু স্বামী-স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে। সংগঠনটি উদাহরণ দিয়ে বলেছে, ভারতের আইনে পরিবার বলতে স্বামী-স্ত্রী বা হিন্দু অবিভক্ত পরিবারকে বোঝানো হয়। পাকিস্তানে তা স্বামী-স্ত্রী, নির্ভরশীল সরাসরি বংশধর ও নির্ভরশীল ভাই-বোন। শ্রীলঙ্কায় পরিবার বলতে শুধু স্বামী-স্ত্রী বা নির্ভরশীল সন্তানকে বোঝানো হয়।

ব্যাংকে একই পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা কমানোর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে একটি পরিবার থেকে সর্বোচ্চ তিনজন ব্যাংকের পর্ষদে থাকতে পারেন। নতুন নিয়মে তা কমিয়ে দুজন করার কথা বলা হয়েছে। বিএবি এই সীমা তুলে দেওয়া বা শিথিল করার প্রস্তাব করে বলেছে, সতর্কতার সঙ্গে এ বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে পরিচালনা পর্ষদে ব্যাংকের প্রতি আরও বেশি মনোযোগী ও অঙ্গীকারসম্পন্ন পরিচালককে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। ১৯৯৬ সালে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ব্যাংক সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছিল যে একই পরিবারের একাধিক সদস্য পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে পারবেন না। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এখন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।

বর্তমান নিয়মে পরিচালকেরা টানা ১২ বছর পর্ষদে থাকতে পারে। এ নিয়মে পরিবর্তন করে সময়সীমা টানা ছয় বছরের কথা বলা হয়েছে। বিএবি বলছে, পরিচালকদের ৯ বছর থাকার সুযোগ রাখা হোক। মেয়াদ কমালে অভিজ্ঞতার ঘাটতি হবে ও ব্যাংক খাতে নেতিবাচক বার্তা যাবে।

অবশ্য বিশ্লেষকেরা বিএবির এ যুক্তিকে সঠিক মনে করছেন না। কারণ অতীতে একটানা দীর্ঘসময় থাকতে দিয়েই ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে এবং ব্যাংক দুর্দশায় পড়েছে।

২০১৮ সালের আগেই পরিচালকদের একটানা মেয়াদ ছিল ছয় বছর। ২০১৮ সালে তা ৯ বছর করা হয়। ২০২৩ সালে আইন আবার সংশোধন করে করা হয় ১২ বছর। ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন ঘিরে ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে হইচই ও হট্টগোল হয়েছিল। ওই বছরের ৮ জুন ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল-২০২৩ জাতীয় সংসদে তুলেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংশোধনীর মূল প্রস্তাবে পরিচালক পদের মেয়াদ বাড়ানো-কমানোর বিষয়ে কোনো প্রস্তাব ছিল না। কিন্তু সংসদে এ বিল পাসের আগে এ বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব দেন তৎকালীন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম। তিনি পরিচালক পদের মেয়াদ টানা ১২ বছর করার প্রস্তাব করেন। সেটাই পাস হয়। বিশ্লেষকেরা বিএবির এ যুক্তিকে সঠিক মনে করছেন না। কারণ অতীতে একটানা দীর্ঘসময় থাকতে দিয়েই ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে এবং ব্যাংক দুর্দশায় পড়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ হবে ১৫ সদস্যের, যার ৫০ শতাংশ, অর্থাৎ অর্ধেকই থাকবেন স্বতন্ত্র পরিচালক। বর্তমানে ২০ সদস্যের পর্ষদ রয়েছে ব্যাংকগুলোতে, যার মধ্যে স্বতন্ত্র পরিচালক থাকার বিধান আছে ৩ জন। বিএবি এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছে, স্বতন্ত্র পরিচালকের সংখ্যা ২ থেকে ৩ জন হতে পারে। অর্ধেক স্বতন্ত্র পরিচালক থাকলে শেয়ারমালিকদের নিয়ন্ত্রণ কমবে এবং ব্যাংক পরিচালনায় মুনাফা ও প্রবৃদ্ধির চেয়ে কেবল নীতিপালন অগ্রাধিকার পাবে। অবশ্য এ বিষয়ে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত বৃহস্পতিবার বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালক সংখ্যায় হবে ৮ জন। পর্ষদের শতভাগই স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে পারলে আরও ভালো হতো।’

ব্যাংক পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য পরিচালনা পর্ষদে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা থাকতে পারবেন না- এমন একটি ধারা সংযোজনের প্রস্তাবও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বর্তমানে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা পরিচালক নিয়োগ, পুনর্নিয়োগ, পদায়ন, অব্যাহতি, বরখাস্ত, অপসারণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব) ইত্যাদি বিশেষায়িত ব্যাংকের ক্ষেত্রে লাগে না। এসব ব্যাংকে সরকার নিয়োগ দেয়।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় ‘একই ধরনের বিধান’ করার স্বার্থে বিশেষায়িত ব্যাংকের এমডি, সিইও বা পরিচালকদের বেলায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমডি, সিইও বা পরিচালক হওয়ার বর্তমান শর্ত হচ্ছে ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা। এটা বাড়িয়ে ১৫ বছর করার কথা বলা হয়েছে খসড়ায়।

back to top