জাহিদা পারভেজ ছন্দা
কয়েক মাস আগে বাংলার মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতে ফুটবলে ইতিহাস তৈরি করেছিল। ফুটবল মঞ্চে ইতিহাস গড়ে আনন্দে ভেসেছে ও ভাসিয়েছে এই সাফজয়ী স্বর্ণ কন্যারা। দেশের জন্য বয়ে এনেছিল গৌরব। তাদের এই উৎসবে যখন পুরো দেশ ভাসছিল ঠিক তখনই বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল পায়ে কাতারে প্রতিনিধিত্ব করছিল ১১ পথশিশু।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ২০১০ সাল থেকে ‘দ্য স্ট্রিট চাইল্ড ওয়ার্ল্ড কাপ’ বা পথশিশুদের নিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। এবার (২০২২) ২৪টি দেশের ২৬টি দলের একটি ছিল বাংলাদেশ। পথশিশুদের নিয়ে এবারই প্রথম এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেয় ১১ বঞ্চিত, অবহেলিত মেয়ে।
পথশিশুদের এই বিশ্বকাপে এবার শিরোপা জিতেছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। বাংলাদেশের মেয়েরা কোন স্থান অর্জন করতে পারেনি ঠিকই তবে দেশের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লড়াই করেছিল প্রাণপণ। শিরোপা অর্জন করতে পারেনি হয়তো, কিন্তু যা পেরেছে তা হলো বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। এই শিশুদের খেলায় অংশগ্রহণ করা শিরোপা জয়ের চেয়েও যেন বড় জয়।
পথশিশুদের এই ফুটবল দলের সবাই এখন বেসরকারি সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া আর নিজেদের স্বাবলম্বী করতে ব্যস্ত। তারা এখন আর তাদের অতীত নিয়ে কথা বলতে চায় না, মনে করতে চায় না তাদের করুণ, নোংরা অতীত।
কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চ তাদের জন্য আলোকিত এক অধ্যায়। কিন্তু এই আলোর নিচে যে অন্ধকার তা অত্যন্ত করুণ। ঝলমলে আলোর নিচে যে কাহিনি তা রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায়। তারা শুনিয়েছে তাদের ছোট্ট জীবনের অতীতে ঘটে যাওয়া বিভৎস, কদর্য সমাজের কথা।
বিশ্বকাপের এই আয়োজনে অংশ নেয়া পুরো ফুটবল টিমের সঙ্গে কথা বলেছে সংবাদ। তবে তাদের অনেকেই চায় না তাদের কদর্য অতীত সামনে আসুক। এদের মধ্যে ইতি আক্তার ও জেসমিন আক্তার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের অতীত স্মৃতিকথা বলেছে সংবাদ এর সঙ্গে।
খেলোয়াড় হতে চাই : ইতি আক্তার
‘আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম। বোতল টোকাইতাম, ভিক্ষা করতাম, নেশাও করতাম। সারাদিন ডান্ডি (নেশা জাতীয় দ্রব্য) খাইতাম। কতদিন না খায়া ছিলাম। যখন খিদা লাগত তখন বেশি বেশি কইরা ডান্ডি খাইতাম। মানুষ খুব খরাপ কথা কইত। কত মারত’- এই কথাগুলো বলছিল সম্প্রতি পথশিশুদের নিয়ে কাতার বিশ্ব কাপে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ইতি আক্তার।
ইতি আক্তার। বয়স ১২ কি ১৩। বাড়ি ভৈরব। এটুকুই তার স্বাভাবিক অতীত। বাবা-মা, ভাই-বোন হয়তো সবাই আছে। কিন্তু ইতির কাছে তাদের কোন স্মৃতি নাই, স্থানও নাই। সে এখন আর মনে করতে চায় না তার পরিবারের কথা। তার জন্ম বৃত্তান্ত। তার স্মৃতিতে এখন শুধুই নষ্ট মানুষ আর নোংরা জীবনের কদর্যতা, যা এখনো তার এই ছোট্ট জীবনে মন খারাপের কারণ। এখনো ঘুমের মধ্যে তাকে তাড়া করে ফেরে সেই রাস্তার অতীত। তখন চুপ হয়ে যায়, আপন মনে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। কারণ এই বয়সেই সমাজের অন্ধকার জায়গাগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তার।
ইতির সঙ্গে কথা হয়, লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে থাকা পথশিশুদের একটি আশ্রমে। এই সংগঠনটি (লীডো) প্রায় ২ বছর আগে ইতিকে ঢাকার এয়ারপোর্টের ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে এই আশ্রমে।
‘তখনকার ইতির সঙ্গে এখনকার ইতিকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না। যখন তাকে আনা হয় তখন আকাশ আর এখন পাতাল। নানভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। ব্যবহার ছিল রুক্ষ-’ বলেন এই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়নকারী মো. সোহেল রানা।
ছোট্ট হালকা পাতলা মিষ্টি চেহেরার ইতি, ডিফেন্সে খেলে। হালকা শরীরে শক্ত বল পায়ে পায়ে এগিয়ে নেয়া ইতি এখন নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত।
ইতি বলে, ‘কেমনে এইহানে (ঢাকা এয়ারপোর্টে) আসছি এহন আর মনে নাই। আমরা ৩ ভাই ৩ বোন এইটা মনে আছে। আর কিছু মনে নাই। আমি এহন আর কিছু মনে করতেও চাই না’- এ কথা বলে কিছুটা উদাস হয়ে যায় যেন ইতি।
তুমি তো প্লেনে উঠেছো, বিদেশে গিয়া খেলে আসলে, কেমন লাগলো- এমন প্রশ্নে ইতির চোখ-মুখ আলোকিত হয়ে যায়। গদ গদ গলায় বলে, ‘আমি তো আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম, প্লেন উড়তে নামতে দেখতাম। কোনদিন ভাবি নাই প্লেনে উঠতে পারব। প্রথমে খুব ভয় পাইছিলাম। কত কিছু খাইতে দিছে প্লেনে।’
‘আগে এই খাবারগুলা মাইনষেরা খাইতো চায়া চায়া দেখতাম, চাইতাম। কেউ একটু খায়া তার অর্ধেক খাওয়াটা দিত, কেউ আবার গালি দিত। সেই খাবারগুলা আমারে যখন খাইতে দিছে, সেইটা দেইখা আমার খুব কান্না আইসা পড়ছিল’।
‘তবে কাতার গিয়া ওই সব খাবার খাইতে খাইতে তখন বুঝছি আমাদের খাবারই ভালো।’
ইতি আপন মনে বলতে থাকে, ‘আমার তো ঘরবাড়ি বাপ-মা কেউ আছিলো না। নেশা কইরা রাস্তায় ঘুমায় পড়তাম। কত মাইনষে যে আমারে ১০ টেকা ২০ টেকা দিয়া কত কিছু করছে।’
তুমি এখন কি করছ কী হতে চাও এমন প্রশ্নের জবাবে ইতি বলে, ‘আমি এখন কেলাস (ক্লাস) ওয়ানে পড়ি। ভালোভাবে খেলাধুলা করে একজন খেলোয়াড় হতে চাই। আমি দেখাতে চাই ভালোভাবে ট্রেনিং দিলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারি। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই। রাস্তার বাচ্চারাও যে কিছু করতে পারে তা দেখাতে চাই। আর আমার মতো পথশিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা।’
ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছা অনেক : জেসমিন আক্তার
কাতারে অংশগ্রহণকারী ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন জেসমিন আক্তার এখন আঁটি পাঁচদোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা-মা ভাই-বোন এমনকি তার বাড়ির কথাও কিছু মনে করতে পারে না। যেটুকু মনে আছে তা হলো- তার বয়স যখন ৫ কি ৬ তখন নারায়নগঞ্জের কোন এক জায়গায় এক বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে থাকত। সে কীভাবে ওই বাসায় এসেছে বা কেউ তাকে ওই বাড়িতে দিয়ে গেছে কি না এসবের কিছুই এখন আর মনে নেই। যেটুকু মনে আছে, কাজের মেয়ে হিসেবে যে বাসায় থাকত একদিন ওই বাসার আন্টি তাকে অনেক বকা দেয়ে। বকা খেয়ে মন খারাপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে জেসমিন। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে চলে আসে। কোথায় যাবে কী করবে এসব কিছু না ভেবে একটা ট্রেনে উঠে বসে। ট্রেনে উঠে পড়ার পর আর নামতে পারে না। তাকে কেউ কিছু বলেও না। সে নারায়নগঞ্জে থেকে ঢাকা, আবার ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ আসে। আবার ঢাকায়। এভাবে ২ বার যাওয়া আসা করার মধ্যে খিদা লেগে গেলে ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে পড়ে।
‘কীভাবে কী করবে যখন বুঝে উঠতে পারছিল না জেসমিন। ৫/৬ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে, যে কোনদিনও একা এভাবে বাড়ির বাইরে আসে নাই। ভয়ে, খিদায় কাহিল হয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে আশেপাশের অনেকেই বুঝে গেছে মেয়েটি হারিয়ে গেছে। এ সুযোগে তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করার চেষ্টা করছিল তারা। অনেকেই নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমত সেই সময় লীডোর রেসকিউ টিম উপস্থিত ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। তারা জেসমিনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে তখন থেকে জেসমিন এখানে’ বলেন, এই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়নকারী মো. সোহেল রানা।
আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা বলছিল জেসমিন। সে লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র আশ্রমে আছে ১০ বছর হয়ে গেল। জেসমিন বলে, ‘এখন আমার পরিচয় আছে। আমি লেখাপড়া করতেছি। আমার ছোট্টবেলার কোন কথাই মনে নাই, যেটুকু মনে আছে তাও এখন আর মনে করতে চাই না।’
‘আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা পার্লারে কাজ শিখছি। যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। তবে আমার শখ পুলিশ হওয়ার। পুলিশ মনে হয় হতে পারব না। কারণ আমার শ্বাস কষ্ট আছে। আমার আরেকটা শখ ফটোগ্রাফার হওয়ার। আমার ছবি তুলতে ভালো লাগে। সুযোগ পাইলে এ কাজটা করতে চাই’- কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেললো শুকনা লম্বা টিম লিডার।
জেসমিন বলে, ‘আমরা কাতার যাওয়ার আগে অল্প কয়েক মাস মাত্র প্রশিক্ষণ করতে পারছি। আরও প্রাকটিস করতে পারলে ভালো করতে পারতাম মনে হয়।’
‘আমার ভালো লাগছে, আমরা যখন বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে গেছি তখন আমাদেরকে অনেক বড় বড় মানুষ রিসিভ করছে আবার যখন কাতার গেছি সেখানে আয়োজক নিজে এসে আমাদের রিসিভ করছে।’
মাঠে যখন দেশের পতাকা নিয়া জাতীয় সংগীত করছি, তখন যে কেমন ভালো লাগছে এটা ভাষা দিয়ে বলতে পারব না।’
কয়েক মাস আগে বাংলার মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতে ফুটবলে ইতিহাস তৈরি করেছিল। ফুটবল মঞ্চে ইতিহাস গড়ে আনন্দে ভেসেছে ও ভাসিয়েছে এই সাফজয়ী স্বর্ণ কন্যারা। দেশের জন্য বয়ে এনেছিল গৌরব। তাদের এই উৎসবে যখন পুরো দেশ ভাসছিল ঠিক তখনই বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল পায়ে কাতারে প্রতিনিধিত্ব করছিল ১১ পথশিশু।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ২০১০ সাল থেকে ‘দ্য স্ট্রিট চাইল্ড ওয়ার্ল্ড কাপ’ বা পথশিশুদের নিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। এবার (২০২২) ২৪টি দেশের ২৬টি দলের একটি ছিল বাংলাদেশ। পথশিশুদের নিয়ে এবারই প্রথম এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেয় ১১ বঞ্চিত, অবহেলিত মেয়ে।
পথশিশুদের এই বিশ্বকাপে এবার শিরোপা জিতেছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। বাংলাদেশের মেয়েরা কোন স্থান অর্জন করতে পারেনি ঠিকই তবে দেশের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লড়াই করেছিল প্রাণপণ। শিরোপা অর্জন করতে পারেনি হয়তো, কিন্তু যা পেরেছে তা হলো বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। এই শিশুদের খেলায় অংশগ্রহণ করা শিরোপা জয়ের চেয়েও যেন বড় জয়।
পথশিশুদের এই ফুটবল দলের সবাই এখন বেসরকারি সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া আর নিজেদের স্বাবলম্বী করতে ব্যস্ত। তারা এখন আর তাদের অতীত নিয়ে কথা বলতে চায় না, মনে করতে চায় না তাদের করুণ, নোংরা অতীত।
কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চ তাদের জন্য আলোকিত এক অধ্যায়। কিন্তু এই আলোর নিচে যে অন্ধকার তা অত্যন্ত করুণ। ঝলমলে আলোর নিচে যে কাহিনি তা রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায়। তারা শুনিয়েছে তাদের ছোট্ট জীবনের অতীতে ঘটে যাওয়া বিভৎস, কদর্য সমাজের কথা।
বিশ্বকাপের এই আয়োজনে অংশ নেয়া পুরো ফুটবল টিমের সঙ্গে কথা বলেছে সংবাদ। তবে তাদের অনেকেই চায় না তাদের কদর্য অতীত সামনে আসুক। এদের মধ্যে ইতি আক্তার ও জেসমিন আক্তার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের অতীত স্মৃতিকথা বলেছে সংবাদ এর সঙ্গে।
জাহিদা পারভেজ ছন্দা
রোববার, ২০ নভেম্বর ২০২২
কয়েক মাস আগে বাংলার মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতে ফুটবলে ইতিহাস তৈরি করেছিল। ফুটবল মঞ্চে ইতিহাস গড়ে আনন্দে ভেসেছে ও ভাসিয়েছে এই সাফজয়ী স্বর্ণ কন্যারা। দেশের জন্য বয়ে এনেছিল গৌরব। তাদের এই উৎসবে যখন পুরো দেশ ভাসছিল ঠিক তখনই বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল পায়ে কাতারে প্রতিনিধিত্ব করছিল ১১ পথশিশু।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ২০১০ সাল থেকে ‘দ্য স্ট্রিট চাইল্ড ওয়ার্ল্ড কাপ’ বা পথশিশুদের নিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। এবার (২০২২) ২৪টি দেশের ২৬টি দলের একটি ছিল বাংলাদেশ। পথশিশুদের নিয়ে এবারই প্রথম এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেয় ১১ বঞ্চিত, অবহেলিত মেয়ে।
পথশিশুদের এই বিশ্বকাপে এবার শিরোপা জিতেছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। বাংলাদেশের মেয়েরা কোন স্থান অর্জন করতে পারেনি ঠিকই তবে দেশের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লড়াই করেছিল প্রাণপণ। শিরোপা অর্জন করতে পারেনি হয়তো, কিন্তু যা পেরেছে তা হলো বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। এই শিশুদের খেলায় অংশগ্রহণ করা শিরোপা জয়ের চেয়েও যেন বড় জয়।
পথশিশুদের এই ফুটবল দলের সবাই এখন বেসরকারি সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া আর নিজেদের স্বাবলম্বী করতে ব্যস্ত। তারা এখন আর তাদের অতীত নিয়ে কথা বলতে চায় না, মনে করতে চায় না তাদের করুণ, নোংরা অতীত।
কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চ তাদের জন্য আলোকিত এক অধ্যায়। কিন্তু এই আলোর নিচে যে অন্ধকার তা অত্যন্ত করুণ। ঝলমলে আলোর নিচে যে কাহিনি তা রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায়। তারা শুনিয়েছে তাদের ছোট্ট জীবনের অতীতে ঘটে যাওয়া বিভৎস, কদর্য সমাজের কথা।
বিশ্বকাপের এই আয়োজনে অংশ নেয়া পুরো ফুটবল টিমের সঙ্গে কথা বলেছে সংবাদ। তবে তাদের অনেকেই চায় না তাদের কদর্য অতীত সামনে আসুক। এদের মধ্যে ইতি আক্তার ও জেসমিন আক্তার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের অতীত স্মৃতিকথা বলেছে সংবাদ এর সঙ্গে।
খেলোয়াড় হতে চাই : ইতি আক্তার
‘আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম। বোতল টোকাইতাম, ভিক্ষা করতাম, নেশাও করতাম। সারাদিন ডান্ডি (নেশা জাতীয় দ্রব্য) খাইতাম। কতদিন না খায়া ছিলাম। যখন খিদা লাগত তখন বেশি বেশি কইরা ডান্ডি খাইতাম। মানুষ খুব খরাপ কথা কইত। কত মারত’- এই কথাগুলো বলছিল সম্প্রতি পথশিশুদের নিয়ে কাতার বিশ্ব কাপে অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ইতি আক্তার।
ইতি আক্তার। বয়স ১২ কি ১৩। বাড়ি ভৈরব। এটুকুই তার স্বাভাবিক অতীত। বাবা-মা, ভাই-বোন হয়তো সবাই আছে। কিন্তু ইতির কাছে তাদের কোন স্মৃতি নাই, স্থানও নাই। সে এখন আর মনে করতে চায় না তার পরিবারের কথা। তার জন্ম বৃত্তান্ত। তার স্মৃতিতে এখন শুধুই নষ্ট মানুষ আর নোংরা জীবনের কদর্যতা, যা এখনো তার এই ছোট্ট জীবনে মন খারাপের কারণ। এখনো ঘুমের মধ্যে তাকে তাড়া করে ফেরে সেই রাস্তার অতীত। তখন চুপ হয়ে যায়, আপন মনে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। কারণ এই বয়সেই সমাজের অন্ধকার জায়গাগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে তার।
ইতির সঙ্গে কথা হয়, লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে থাকা পথশিশুদের একটি আশ্রমে। এই সংগঠনটি (লীডো) প্রায় ২ বছর আগে ইতিকে ঢাকার এয়ারপোর্টের ফুটপাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে এই আশ্রমে।
‘তখনকার ইতির সঙ্গে এখনকার ইতিকে কোনভাবেই মেলানো যাবে না। যখন তাকে আনা হয় তখন আকাশ আর এখন পাতাল। নানভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ায় কাউকে বিশ্বাস করতে পারত না। ব্যবহার ছিল রুক্ষ-’ বলেন এই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়নকারী মো. সোহেল রানা।
ছোট্ট হালকা পাতলা মিষ্টি চেহেরার ইতি, ডিফেন্সে খেলে। হালকা শরীরে শক্ত বল পায়ে পায়ে এগিয়ে নেয়া ইতি এখন নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত।
ইতি বলে, ‘কেমনে এইহানে (ঢাকা এয়ারপোর্টে) আসছি এহন আর মনে নাই। আমরা ৩ ভাই ৩ বোন এইটা মনে আছে। আর কিছু মনে নাই। আমি এহন আর কিছু মনে করতেও চাই না’- এ কথা বলে কিছুটা উদাস হয়ে যায় যেন ইতি।
তুমি তো প্লেনে উঠেছো, বিদেশে গিয়া খেলে আসলে, কেমন লাগলো- এমন প্রশ্নে ইতির চোখ-মুখ আলোকিত হয়ে যায়। গদ গদ গলায় বলে, ‘আমি তো আগে এয়ারপোর্টের ফুটপাতে থাকতাম, প্লেন উড়তে নামতে দেখতাম। কোনদিন ভাবি নাই প্লেনে উঠতে পারব। প্রথমে খুব ভয় পাইছিলাম। কত কিছু খাইতে দিছে প্লেনে।’
‘আগে এই খাবারগুলা মাইনষেরা খাইতো চায়া চায়া দেখতাম, চাইতাম। কেউ একটু খায়া তার অর্ধেক খাওয়াটা দিত, কেউ আবার গালি দিত। সেই খাবারগুলা আমারে যখন খাইতে দিছে, সেইটা দেইখা আমার খুব কান্না আইসা পড়ছিল’।
‘তবে কাতার গিয়া ওই সব খাবার খাইতে খাইতে তখন বুঝছি আমাদের খাবারই ভালো।’
ইতি আপন মনে বলতে থাকে, ‘আমার তো ঘরবাড়ি বাপ-মা কেউ আছিলো না। নেশা কইরা রাস্তায় ঘুমায় পড়তাম। কত মাইনষে যে আমারে ১০ টেকা ২০ টেকা দিয়া কত কিছু করছে।’
তুমি এখন কি করছ কী হতে চাও এমন প্রশ্নের জবাবে ইতি বলে, ‘আমি এখন কেলাস (ক্লাস) ওয়ানে পড়ি। ভালোভাবে খেলাধুলা করে একজন খেলোয়াড় হতে চাই। আমি দেখাতে চাই ভালোভাবে ট্রেনিং দিলে আমরাও ভালো কিছু করতে পারি। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই। রাস্তার বাচ্চারাও যে কিছু করতে পারে তা দেখাতে চাই। আর আমার মতো পথশিশুদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা।’
ফটোগ্রাফার হওয়ার ইচ্ছা অনেক : জেসমিন আক্তার
কাতারে অংশগ্রহণকারী ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন জেসমিন আক্তার এখন আঁটি পাঁচদোনা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বাবা-মা ভাই-বোন এমনকি তার বাড়ির কথাও কিছু মনে করতে পারে না। যেটুকু মনে আছে তা হলো- তার বয়স যখন ৫ কি ৬ তখন নারায়নগঞ্জের কোন এক জায়গায় এক বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে থাকত। সে কীভাবে ওই বাসায় এসেছে বা কেউ তাকে ওই বাড়িতে দিয়ে গেছে কি না এসবের কিছুই এখন আর মনে নেই। যেটুকু মনে আছে, কাজের মেয়ে হিসেবে যে বাসায় থাকত একদিন ওই বাসার আন্টি তাকে অনেক বকা দেয়ে। বকা খেয়ে মন খারাপ করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে জেসমিন। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনে চলে আসে। কোথায় যাবে কী করবে এসব কিছু না ভেবে একটা ট্রেনে উঠে বসে। ট্রেনে উঠে পড়ার পর আর নামতে পারে না। তাকে কেউ কিছু বলেও না। সে নারায়নগঞ্জে থেকে ঢাকা, আবার ঢাকা থেকে নারায়নগঞ্জ আসে। আবার ঢাকায়। এভাবে ২ বার যাওয়া আসা করার মধ্যে খিদা লেগে গেলে ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে পড়ে।
‘কীভাবে কী করবে যখন বুঝে উঠতে পারছিল না জেসমিন। ৫/৬ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে, যে কোনদিনও একা এভাবে বাড়ির বাইরে আসে নাই। ভয়ে, খিদায় কাহিল হয়ে গিয়েছিল। তাকে দেখে আশেপাশের অনেকেই বুঝে গেছে মেয়েটি হারিয়ে গেছে। এ সুযোগে তাকে নানাভাবে উত্যক্ত করার চেষ্টা করছিল তারা। অনেকেই নিয়ে যেতে চাচ্ছিল। আল্লাহর অশেষ রহমত সেই সময় লীডোর রেসকিউ টিম উপস্থিত ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। তারা জেসমিনকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে তখন থেকে জেসমিন এখানে’ বলেন, এই আশ্রমের তত্ত্বাবধায়নকারী মো. সোহেল রানা।
আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা বলছিল জেসমিন। সে লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র আশ্রমে আছে ১০ বছর হয়ে গেল। জেসমিন বলে, ‘এখন আমার পরিচয় আছে। আমি লেখাপড়া করতেছি। আমার ছোট্টবেলার কোন কথাই মনে নাই, যেটুকু মনে আছে তাও এখন আর মনে করতে চাই না।’
‘আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি একটা পার্লারে কাজ শিখছি। যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি। তবে আমার শখ পুলিশ হওয়ার। পুলিশ মনে হয় হতে পারব না। কারণ আমার শ্বাস কষ্ট আছে। আমার আরেকটা শখ ফটোগ্রাফার হওয়ার। আমার ছবি তুলতে ভালো লাগে। সুযোগ পাইলে এ কাজটা করতে চাই’- কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে ফেললো শুকনা লম্বা টিম লিডার।
জেসমিন বলে, ‘আমরা কাতার যাওয়ার আগে অল্প কয়েক মাস মাত্র প্রশিক্ষণ করতে পারছি। আরও প্রাকটিস করতে পারলে ভালো করতে পারতাম মনে হয়।’
‘আমার ভালো লাগছে, আমরা যখন বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে গেছি তখন আমাদেরকে অনেক বড় বড় মানুষ রিসিভ করছে আবার যখন কাতার গেছি সেখানে আয়োজক নিজে এসে আমাদের রিসিভ করছে।’
মাঠে যখন দেশের পতাকা নিয়া জাতীয় সংগীত করছি, তখন যে কেমন ভালো লাগছে এটা ভাষা দিয়ে বলতে পারব না।’
কয়েক মাস আগে বাংলার মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতে ফুটবলে ইতিহাস তৈরি করেছিল। ফুটবল মঞ্চে ইতিহাস গড়ে আনন্দে ভেসেছে ও ভাসিয়েছে এই সাফজয়ী স্বর্ণ কন্যারা। দেশের জন্য বয়ে এনেছিল গৌরব। তাদের এই উৎসবে যখন পুরো দেশ ভাসছিল ঠিক তখনই বাংলাদেশের হয়ে ফুটবল পায়ে কাতারে প্রতিনিধিত্ব করছিল ১১ পথশিশু।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে ২০১০ সাল থেকে ‘দ্য স্ট্রিট চাইল্ড ওয়ার্ল্ড কাপ’ বা পথশিশুদের নিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের। এবার (২০২২) ২৪টি দেশের ২৬টি দলের একটি ছিল বাংলাদেশ। পথশিশুদের নিয়ে এবারই প্রথম এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের হয়ে অংশ নেয় ১১ বঞ্চিত, অবহেলিত মেয়ে।
পথশিশুদের এই বিশ্বকাপে এবার শিরোপা জিতেছে ফুটবলের দেশ ব্রাজিল। বাংলাদেশের মেয়েরা কোন স্থান অর্জন করতে পারেনি ঠিকই তবে দেশের পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। লড়াই করেছিল প্রাণপণ। শিরোপা অর্জন করতে পারেনি হয়তো, কিন্তু যা পেরেছে তা হলো বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে। এই শিশুদের খেলায় অংশগ্রহণ করা শিরোপা জয়ের চেয়েও যেন বড় জয়।
পথশিশুদের এই ফুটবল দলের সবাই এখন বেসরকারি সংগঠন লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (লীডো)র তত্ত্বাবধানে লেখাপড়া আর নিজেদের স্বাবলম্বী করতে ব্যস্ত। তারা এখন আর তাদের অতীত নিয়ে কথা বলতে চায় না, মনে করতে চায় না তাদের করুণ, নোংরা অতীত।
কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের মঞ্চ তাদের জন্য আলোকিত এক অধ্যায়। কিন্তু এই আলোর নিচে যে অন্ধকার তা অত্যন্ত করুণ। ঝলমলে আলোর নিচে যে কাহিনি তা রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায়। তারা শুনিয়েছে তাদের ছোট্ট জীবনের অতীতে ঘটে যাওয়া বিভৎস, কদর্য সমাজের কথা।
বিশ্বকাপের এই আয়োজনে অংশ নেয়া পুরো ফুটবল টিমের সঙ্গে কথা বলেছে সংবাদ। তবে তাদের অনেকেই চায় না তাদের কদর্য অতীত সামনে আসুক। এদের মধ্যে ইতি আক্তার ও জেসমিন আক্তার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের অতীত স্মৃতিকথা বলেছে সংবাদ এর সঙ্গে।