পুরোটাই ধ্বংসস্তূপ। অনেকের মতো এই প্যালেস্টাইনি বৃদ্ধাও ফিরছেন তার ঘরে, যা সম্বল আছে তা নিয়ে। কারণ এখানেই তার আবাস, তার দেশ। এই ধ্বংসস্তূপেই নতুন করে শুরু করবেন জীবন -সংগৃহীত
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর ইসরায়েলি সেনা গাজার অনেক এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গাজা থেকে পালিয়ে যাওয়া অধিবাসীরা এখন দলে দলে ফিরে আসছেন নিজেদের বাড়িঘরে। আগামীকাল জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
সোমবার থেকে জিম্মি মুক্তি শুরু হবে
৫৩ ভাগ এলাকা এখনও ইসরায়েলের অধীনে
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি গতকাল শুক্রবার সকালে কার্যকর হওয়ার পর গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে আংশিকভাবে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। সমঝোতা অনুযায়ী গাজার ভেতরেই অন্য স্থানে সেনা সরিয়ে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। এরপরও গাজার অর্ধেকের বেশি অংশ এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
গাজা সিটির যেসব এলাকা থেকে আইডিএফের সেনা সরেছে সেসব জায়গায় হামাসের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন হতে দেখা গেছে। নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর বদলে তাদের মাথায় থাকা ক্যাপে হামাস অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থার লোগো ছিল বলে ছবিতে দেখা গেছে।
এদিকে গতকাল শুক্রবারই হামাস জানিয়েছে, তারা গাজায় যে কোনো ধরনের ‘বিদেশি অভিভাবকত্ব’ প্রত্যাখ্যান করছে। গাজার শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, তা নির্ধারণের এখতিয়ার পুরোপুরি প্যালেস্টাইনিদেরই।
গতকাল শুক্রবার প্রথম প্রহরে ইসরায়েলি সরকার গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথমপর্যায় অনুমোদন করার কয়েক ঘণ্টা পর এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
প্রথম পর্যায়ের ?চুক্তি অনুযায়ী, হামাস সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে আগামীকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টা) পর্যন্ত সময় পাচ্ছে। এ জিম্মিদের মধ্যে ২০ জন এখনও জীবিত বলে অনুমান করা হচ্ছে। বাকি ২৮ জিম্মির মৃতদেহ ফেরত দিতে হবে। এর পাল্টায় ইসরায়েলও তাদের কারাগারগুলোতে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করতে থাকা প্রায়
আড়াইশ প্যালেস্টাইনিকে মুক্তি দেবে। গাজা থেকে আটক আরও এক হাজার ৭০০ প্যালেস্টাইনিকেও ছেড়ে দেয়ার কথা তাদের। চুক্তির শর্তানুযায়ী, ত্রাণবাহী লরিরও গাজায় বাধাহীনভাবে ঢুকতে পারার কথা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল শুক্রবার গাজার সিটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্বে সরেছে ইসরায়েলি বাহিনী। দক্ষিণে খান ইউনিস থেকেও কিছু ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের খবর মিলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে হালনাগাদ মোতায়েন লাইন বরাবর সেনাদের সরিয়ে নেয়া শুরু করেছে। দক্ষিণ কমান্ডের আইডিএফ সেনারা ওই এলাকায় মোতায়েন আছে এবং যে কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি মোকাবিলার কাজ চালিয়ে যাবে, বিবৃতিতে বলেছে তারা।
মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, আইডিএফের সেনারা যে ‘হলুদ দাগ’ বরাবর সেনা সরিয়ে নিয়ে কথামতো ‘প্রথম পর্যায়ের সৈন্য প্রত্যাহার শেষ করেছে’ মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড তা নিশ্চিত করছে। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউজ যে মানচিত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে যুদ্ধবিরতির প্রথমপর্যায়ে সেনা প্রত্যাহার করে কোথায় নেয়া হবে সে সংক্রান্ত ‘হলুদ দাগ’ বা ‘ইয়োলো লাইনের’ উল্লেখ ছিল। তাতেও গাজার ৫৩ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলি বাহিনীর হাতেই থেকে যাচ্ছে।
টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ‘বাস্তবায়ন করছেন’ তিনি। ইসরায়েলি সেনারা এখনও সবদিক থেকেই হামাসকে ঘিরে রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপই হচ্ছে ‘হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং গাজাকে অসামরিক অঞ্চলে পরিণত করা’। হামাস এখন পর্যন্ত তাদের অস্ত্র সমর্পণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি।
গতকাল শুক্রবার যুদ্ধবিরতি কখন থেকে কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা দেখা গেছে। গাজার বিভিন্ন এলাকায় দিনের প্রথম ভাগে বিমান হামলার কথাও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ১৭ জনের নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আইডিএফ বলেছে, তারা হালনাগাদ সীমারেখা থেকেই ‘যে কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি নির্মূলে’ অভিযান চালিয়ে যাবে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা এড়িয়ে চলতে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে তারা।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, গাজায় ভবিষ্যতে কোনো ভূমিকাতেই থাকতে পারবে না হামাস। সেখানে প্যালেস্টাইনি টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ বানানো হবে তার দেখভালের দায়িত্বে থাকবে একটি ‘বোর্ড অব পিস’, যার প্রধান হবেন ডনাল্ড ট্রাম্প, থাকবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও। এক পর্যায়ে ভূখ-টির শাসনভার প্যালেস্টাইনের কর্তৃপক্ষের (পিএ) হাতে ছেড়ে দেয়া হবে।
গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে ইসরায়েলি সেনা সরে যাওয়ার পর হাজার হাজার প্যালেস্টাইনিকে গাজার উপকূলীয় শহর ধরে উত্তরের পথে যেতে দেখা গেছে। অনেকেই তাদের অবশিষ্ট জিনিসপত্র পিঠে চাপিয়ে ২০ কিলোমিটারের বেশি এলাকা হেঁটে ঘরে ফিরছেন।
ভাঙাচোরা সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কারও কারও হাতে দেখা গেছে প্যালেস্টাইনের পতাকা, কেউ দেখিয়েছেন ‘ভিক্টরি’ চিহ্ন। কিন্তু বেশিরভাগকেই দেখা গেছে দুর্বল, পুষ্টিহীন, ক্ষুধার্ত।
‘সড়কযাত্রা দীর্ঘ ও কঠিন, কোনো খাবার বা পানিও নেই,’ বলেছেন স্কুল শিক্ষক আলা সালেহ, যিনি স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে নিয়ে দক্ষিণের খান ইউনিসে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যদের পেছনে রেখে আমি উত্তরের দিকে হাঁটা শুরু করি। আমার আশপাশের হাজারো লোক ব্যাপক কষ্ট করছে। গাড়ি ভাড়া করতে লাগছে ৪ হাজারের শেকেলের মতো (প্রায় দেড় লাখ টাকা), বেশিরভাগ মানুষের সাধ্যের অনেক বাইরে।
উত্তরের জাবালিয়ায় ঘরে ফেরার পথে থাকা ওয়ায়েল আল-নাজার বলেছেন, বাড়ি ফেরার যাত্রা শুরুর আগে তিনি তার ছেলেকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডা ফুটপাতে ঘুমিয়েছেন। যদি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংসও হয়ে যায়, যদি কেবল ধ্বংসস্তূপই থাকে, তাও আমরা ফিরবো। সেখানে তাঁবু টানাবো, এবং আমাদের লোকজনের কাছে ফিরবো।
দুই বছর পর প্যালেস্টাইনের গাজাবাসী এমন এক রাতের অভিজ্ঞতা পেল, যা এত দিন ছিল অধরা। দুই বছর ধরে কল্পনা করা যায়নি এমন রাত পার করেছে তারা। গাজার বিভিন্ন এলাকায় শনিবার রাতে ইসরায়েলি ড্রোন ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়নি। নিস্তব্ধ এক রাত পার করেছে গাজাবাসী।
গাজার আকাশে দীর্ঘ দুই বছর পর নেমে এসেছে এ নীরবতা বা শান্তি। এটি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কেবল যুদ্ধের বিরতি নয়, এটি হলো- বেঁচে থাকা এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে আবারও মিলিত হওয়ার আশা। দুই বছরের যুদ্ধ আপাতত শেষ বলে মনে হচ্ছে। এ নীরব রাত পেরিয়ে গাজাবাসী হয়তো নতুন এক সকাল পেতে যাচ্ছে।
মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে গত বুধবার হামাস ও ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। দীর্ঘ বৈঠক শেষে গতকাল শুক্রবার ভোরে চুক্তিটির অনুমোদন দেয় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা। পরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, গতকাল শুক্রবার থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর শুরু হয়েছে।
চুক্তির শর্তানুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর অবস্থান সরিয়ে নেবে ইসরায়েল। আর ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ আগামীকাল দুপুর নাগাদ গাজায় এখনও বন্দী জীবিত সব জিম্মিকে ইসরায়েলের কাছে ফিরিয়ে দেবে হামাস। এরপর ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী প্রায় দুই হাজার প্যালেস্টাইনিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
গাজায় সংঘাত বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যে ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেন, এই যুদ্ধবিরতিকে তার প্রথম ধাপ বলা হচ্ছে।
এ পরিকল্পনা নিয়ে গত সোমবার থেকে মিসরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা চলছিল। প্যালেস্টাইনি সংগঠন ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনও (পিএলএফপি) আলোচনায় যোগ দিয়েছিল।
গাজায় হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকেরা আগামী সোমবার ঘরে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ওই দিন ২০ জন জীবিত ও ২৮ জন মৃত জিম্মির দেহ হস্তান্তর করা হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল শুক্রবার রাতে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, সোমবার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কারণ, এ দিন হামাস ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে (জীবিত ও মৃত) মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ট্রাম্প বলেন, এখনো কিছু জিম্মির মরদেহ মাটির নিচ থেকে উদ্ধারের কাজ চলছে। গাজায় থাকা জীবিত জিম্মিদের বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘তাঁদের এমন কঠিন পরিবেশে রাখা হয়েছে যে খুব কম মানুষই জানে তাঁরা কোথায় আছেন।’
ট্রাম্প আরও বলেন, তিনি এই সপ্তাহান্তে কায়রো যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার আগে তিনি ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেবেন।
পুরোটাই ধ্বংসস্তূপ। অনেকের মতো এই প্যালেস্টাইনি বৃদ্ধাও ফিরছেন তার ঘরে, যা সম্বল আছে তা নিয়ে। কারণ এখানেই তার আবাস, তার দেশ। এই ধ্বংসস্তূপেই নতুন করে শুরু করবেন জীবন -সংগৃহীত
শনিবার, ১১ অক্টোবর ২০২৫
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে শান্তি চুক্তি হওয়ার পর ইসরায়েলি সেনা গাজার অনেক এলাকা থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। গাজা থেকে পালিয়ে যাওয়া অধিবাসীরা এখন দলে দলে ফিরে আসছেন নিজেদের বাড়িঘরে। আগামীকাল জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।
সোমবার থেকে জিম্মি মুক্তি শুরু হবে
৫৩ ভাগ এলাকা এখনও ইসরায়েলের অধীনে
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি গতকাল শুক্রবার সকালে কার্যকর হওয়ার পর গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে আংশিকভাবে সেনা প্রত্যাহার করে নেয়ার কথা জানিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। সমঝোতা অনুযায়ী গাজার ভেতরেই অন্য স্থানে সেনা সরিয়ে আনা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা। এরপরও গাজার অর্ধেকের বেশি অংশ এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
গাজা সিটির যেসব এলাকা থেকে আইডিএফের সেনা সরেছে সেসব জায়গায় হামাসের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন হতে দেখা গেছে। নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর বদলে তাদের মাথায় থাকা ক্যাপে হামাস অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থার লোগো ছিল বলে ছবিতে দেখা গেছে।
এদিকে গতকাল শুক্রবারই হামাস জানিয়েছে, তারা গাজায় যে কোনো ধরনের ‘বিদেশি অভিভাবকত্ব’ প্রত্যাখ্যান করছে। গাজার শাসনব্যবস্থা কেমন হবে, তা নির্ধারণের এখতিয়ার পুরোপুরি প্যালেস্টাইনিদেরই।
গতকাল শুক্রবার প্রথম প্রহরে ইসরায়েলি সরকার গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তি নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রথমপর্যায় অনুমোদন করার কয়েক ঘণ্টা পর এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপগুলো নিয়ে এখনও আলোচনা চলছে।
প্রথম পর্যায়ের ?চুক্তি অনুযায়ী, হামাস সব ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দিতে আগামীকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা পর্যন্ত (বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টা) পর্যন্ত সময় পাচ্ছে। এ জিম্মিদের মধ্যে ২০ জন এখনও জীবিত বলে অনুমান করা হচ্ছে। বাকি ২৮ জিম্মির মৃতদেহ ফেরত দিতে হবে। এর পাল্টায় ইসরায়েলও তাদের কারাগারগুলোতে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করতে থাকা প্রায়
আড়াইশ প্যালেস্টাইনিকে মুক্তি দেবে। গাজা থেকে আটক আরও এক হাজার ৭০০ প্যালেস্টাইনিকেও ছেড়ে দেয়ার কথা তাদের। চুক্তির শর্তানুযায়ী, ত্রাণবাহী লরিরও গাজায় বাধাহীনভাবে ঢুকতে পারার কথা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল শুক্রবার গাজার সিটির উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্বে সরেছে ইসরায়েলি বাহিনী। দক্ষিণে খান ইউনিস থেকেও কিছু ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের খবর মিলেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেয়া বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে হালনাগাদ মোতায়েন লাইন বরাবর সেনাদের সরিয়ে নেয়া শুরু করেছে। দক্ষিণ কমান্ডের আইডিএফ সেনারা ওই এলাকায় মোতায়েন আছে এবং যে কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি মোকাবিলার কাজ চালিয়ে যাবে, বিবৃতিতে বলেছে তারা।
মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেছেন, আইডিএফের সেনারা যে ‘হলুদ দাগ’ বরাবর সেনা সরিয়ে নিয়ে কথামতো ‘প্রথম পর্যায়ের সৈন্য প্রত্যাহার শেষ করেছে’ মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড তা নিশ্চিত করছে। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউজ যে মানচিত্র প্রকাশ করেছে, সেখানে যুদ্ধবিরতির প্রথমপর্যায়ে সেনা প্রত্যাহার করে কোথায় নেয়া হবে সে সংক্রান্ত ‘হলুদ দাগ’ বা ‘ইয়োলো লাইনের’ উল্লেখ ছিল। তাতেও গাজার ৫৩ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ ইসরায়েলি বাহিনীর হাতেই থেকে যাচ্ছে।
টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ‘বাস্তবায়ন করছেন’ তিনি। ইসরায়েলি সেনারা এখনও সবদিক থেকেই হামাসকে ঘিরে রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপই হচ্ছে ‘হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং গাজাকে অসামরিক অঞ্চলে পরিণত করা’। হামাস এখন পর্যন্ত তাদের অস্ত্র সমর্পণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি।
গতকাল শুক্রবার যুদ্ধবিরতি কখন থেকে কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা দেখা গেছে। গাজার বিভিন্ন এলাকায় দিনের প্রথম ভাগে বিমান হামলার কথাও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ১৭ জনের নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
আইডিএফ বলেছে, তারা হালনাগাদ সীমারেখা থেকেই ‘যে কোনো তাৎক্ষণিক হুমকি নির্মূলে’ অভিযান চালিয়ে যাবে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা এড়িয়ে চলতে প্যালেস্টাইনিদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে তারা।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, গাজায় ভবিষ্যতে কোনো ভূমিকাতেই থাকতে পারবে না হামাস। সেখানে প্যালেস্টাইনি টেকনোক্র্যাটদের নিয়ে যে অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষ বানানো হবে তার দেখভালের দায়িত্বে থাকবে একটি ‘বোর্ড অব পিস’, যার প্রধান হবেন ডনাল্ড ট্রাম্প, থাকবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও। এক পর্যায়ে ভূখ-টির শাসনভার প্যালেস্টাইনের কর্তৃপক্ষের (পিএ) হাতে ছেড়ে দেয়া হবে।
গাজার বিভিন্ন অংশ থেকে ইসরায়েলি সেনা সরে যাওয়ার পর হাজার হাজার প্যালেস্টাইনিকে গাজার উপকূলীয় শহর ধরে উত্তরের পথে যেতে দেখা গেছে। অনেকেই তাদের অবশিষ্ট জিনিসপত্র পিঠে চাপিয়ে ২০ কিলোমিটারের বেশি এলাকা হেঁটে ঘরে ফিরছেন।
ভাঙাচোরা সরু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কারও কারও হাতে দেখা গেছে প্যালেস্টাইনের পতাকা, কেউ দেখিয়েছেন ‘ভিক্টরি’ চিহ্ন। কিন্তু বেশিরভাগকেই দেখা গেছে দুর্বল, পুষ্টিহীন, ক্ষুধার্ত।
‘সড়কযাত্রা দীর্ঘ ও কঠিন, কোনো খাবার বা পানিও নেই,’ বলেছেন স্কুল শিক্ষক আলা সালেহ, যিনি স্ত্রী ও ছয় সন্তানকে নিয়ে দক্ষিণের খান ইউনিসে পালিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যদের পেছনে রেখে আমি উত্তরের দিকে হাঁটা শুরু করি। আমার আশপাশের হাজারো লোক ব্যাপক কষ্ট করছে। গাড়ি ভাড়া করতে লাগছে ৪ হাজারের শেকেলের মতো (প্রায় দেড় লাখ টাকা), বেশিরভাগ মানুষের সাধ্যের অনেক বাইরে।
উত্তরের জাবালিয়ায় ঘরে ফেরার পথে থাকা ওয়ায়েল আল-নাজার বলেছেন, বাড়ি ফেরার যাত্রা শুরুর আগে তিনি তার ছেলেকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাণ্ডা ফুটপাতে ঘুমিয়েছেন। যদি বাড়ি পুরোপুরি ধ্বংসও হয়ে যায়, যদি কেবল ধ্বংসস্তূপই থাকে, তাও আমরা ফিরবো। সেখানে তাঁবু টানাবো, এবং আমাদের লোকজনের কাছে ফিরবো।
দুই বছর পর প্যালেস্টাইনের গাজাবাসী এমন এক রাতের অভিজ্ঞতা পেল, যা এত দিন ছিল অধরা। দুই বছর ধরে কল্পনা করা যায়নি এমন রাত পার করেছে তারা। গাজার বিভিন্ন এলাকায় শনিবার রাতে ইসরায়েলি ড্রোন ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়নি। নিস্তব্ধ এক রাত পার করেছে গাজাবাসী।
গাজার আকাশে দীর্ঘ দুই বছর পর নেমে এসেছে এ নীরবতা বা শান্তি। এটি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কেবল যুদ্ধের বিরতি নয়, এটি হলো- বেঁচে থাকা এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে আবারও মিলিত হওয়ার আশা। দুই বছরের যুদ্ধ আপাতত শেষ বলে মনে হচ্ছে। এ নীরব রাত পেরিয়ে গাজাবাসী হয়তো নতুন এক সকাল পেতে যাচ্ছে।
মিসরের পর্যটন শহর শারম আল শেখে গত বুধবার হামাস ও ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। দীর্ঘ বৈঠক শেষে গতকাল শুক্রবার ভোরে চুক্তিটির অনুমোদন দেয় ইসরায়েলের মন্ত্রিসভা। পরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানায়, গতকাল শুক্রবার থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর শুরু হয়েছে।
চুক্তির শর্তানুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজার নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর অবস্থান সরিয়ে নেবে ইসরায়েল। আর ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ আগামীকাল দুপুর নাগাদ গাজায় এখনও বন্দী জীবিত সব জিম্মিকে ইসরায়েলের কাছে ফিরিয়ে দেবে হামাস। এরপর ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী প্রায় দুই হাজার প্যালেস্টাইনিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
গাজায় সংঘাত বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যে ২০ দফা ‘শান্তি পরিকল্পনা’ ঘোষণা করেন, এই যুদ্ধবিরতিকে তার প্রথম ধাপ বলা হচ্ছে।
এ পরিকল্পনা নিয়ে গত সোমবার থেকে মিসরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা চলছিল। প্যালেস্টাইনি সংগঠন ইসলামিক জিহাদ ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনও (পিএলএফপি) আলোচনায় যোগ দিয়েছিল।
গাজায় হামাস ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকেরা আগামী সোমবার ঘরে ফিরবেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে ওই দিন ২০ জন জীবিত ও ২৮ জন মৃত জিম্মির দেহ হস্তান্তর করা হবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল শুক্রবার রাতে হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের বলেন, সোমবার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। কারণ, এ দিন হামাস ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে (জীবিত ও মৃত) মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী দুই হাজার ফিলিস্তিনিকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ট্রাম্প বলেন, এখনো কিছু জিম্মির মরদেহ মাটির নিচ থেকে উদ্ধারের কাজ চলছে। গাজায় থাকা জীবিত জিম্মিদের বিষয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘তাঁদের এমন কঠিন পরিবেশে রাখা হয়েছে যে খুব কম মানুষই জানে তাঁরা কোথায় আছেন।’
ট্রাম্প আরও বলেন, তিনি এই সপ্তাহান্তে কায়রো যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার আগে তিনি ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেবেন।