বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা গুঁড়িয়ে দিতে একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করে।
গণহত্যার সময় পাকিস্তানের যেসব সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর বই লিখেছেন। সেসব বইয়ে তারা একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। পাকিস্তানের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা একাত্তরের গণহত্যা পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন নিয়ে বইয়ে যেসব তথ্য উল্লেখ করেছেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার এফ বি আলি ১৯৬৯ সাল থেকে একাত্তরের গণহত্যার সময় বাংলাদেশে ছিলেন। ‘প্রিজন জার্নি : এ মেমোয়ার’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি।
তিনি লিখেছেন : “শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর আমাদের সদরদপ্তরে জেনারেল রহিম ও ভুট্টোর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হতে দেখেছি। এসব বৈঠকে সামরিক সরকার ও ভুট্টোর মধ্যে এক ধরনের
সমঝোতা হয়। এর ফলস্বরূপ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় ও শেষ পর্যন্ত তা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের পথ সুগম করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী ঢাকায় অভিযান শুরু করে এবং নির্বিচারে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করে।’
এফ বি আলি জানান, তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া চিঠিপত্র সেন্সর করা হতো। চট্টগ্রামের একজন নৌ অফিসারের করাচিতে তার পরিবারের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি তার ডেস্কে এসে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল তারিখে লেখা সেই চিঠির একটা দীর্ঘ অংশ তুলে ধরেছেন তিনি : “আমি এখনও বেঁচে আছি ও ভালো আছি। (মৃত) শহরের অবস্থা খুবই খারাপ। ‘মৃত’ লিখলাম কারণ, শহরটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই)। নৌ সেনারা দীর্ঘ ও কষ্টকর অপেক্ষার পর নিকৃষ্ট বিঙ্গোদের গুঁড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পায়। বন্দরে আমরা যখন টিকতে পারছিলাম না তখন স্থলবাহিনীর সাহায্য চাই। ওহ, তারা এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে এই বিঙ্গোরা তা জীবনেও ভুলবে না। বিমানবাহিনীও শত্রুদের ওপর হাজার-পাউন্ডের বোমা ফেলতে কার্পণ্য করেনি। পি এন এস জাহাঙ্গীর থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। আমি পিএনএস ঢাকার একটি প্লাটুনের কমান্ডার। বাড়িয়ে বলছি না, আমরা এখানে এত মানুষ মেরেছি যে সবাই আমাদের টি-এইচ-বি-এস (ট্রিগার হ্যাপি বাস্টার্ডস স্কোয়াড) বলে ডাকে। আমি এ পর্যন্ত ডজনখানেক গাদ্দার বিঙ্গোকে হত্যা করেছি। স্থল সেনারা ভয়ংকর মেজাজে আছে। নৌ সেনারা শত শত জনকে ধরে জেলে পুরছে। কিন্তু, স্থল সেনারা জেলে ঢোকানোয় বিশ্বাসী নয়, তারা ধরছে আর সঙ্গে সঙ্গে খতম করে দিচ্ছে। পুরো চট্টগ্রাম শহরে কেবল লাশ আর লাশ। এসব লাশের বেশিরভাগই পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কর্ণফুলী নদীতে শুধুই লাশ ভাসছে। মুখে রুমাল না বেঁধে হাঁটাচলা করা যায় না। আমার ধারণা, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র একই অবস্থা। রেডিও পাকিস্তানের কথা একদম বিশ্বাস করবে না।”
সিদ্দিক সালিক ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উইটনেস টু সারেন্ডার শিরোনামের একটি বই লিখেছেন সিদ্দিক সালিক। সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠপেনসিল দিয়ে পরিকল্পনার খসড়া লিখেছিলেন। সেই লেখা সিদ্দিক সালিক নিজের চোখে দেখেছিলেন।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা একাত্তরে বাংলাদেশেসেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন ছিলেন। তিনি ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১’ শিরোনামে স্মৃতিচারণামূলক বই লিখেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা।
বইয়ে খাদিম হুসাইন রাজা লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাকে এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে কমান্ড হাউসে ডেকে পাঠান। তারা দুজন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি হচ্ছে না। সে কারণে ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশন’ এর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
ইয়াহিয়া খানের বরাত দিয়ে টিক্কা খান সেনা কর্মকর্তাদের একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তার বইয়ে আরও লিখেছেন, সেই নির্দেশ অনুযায়ী পরদিন ১৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে তার বাসায় রাও ফরমান আলী আসেন। তারা দুজন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। তারা দুজন আলাদা দুটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। সে অনুযায়ী রাও ফরমান আলী ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব নেন এবং খাদিম হুসাইন রাজা দায়িত্ব নেন ঢাকার বাইরে।
সেই খসড়া নিয়ে তাঁরা সন্ধ্যায় যান কমান্ড হাউসে। সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই তা অনুমোদন করা হয়। এরপর বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন ১৯ মার্চ থেকে। সে অনুযায়ী ঢাকায় সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে।
সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা গুঁড়িয়ে দিতে একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিকল্পিত গণহত্যা শুরু করে।
গণহত্যার সময় পাকিস্তানের যেসব সেনা কর্মকর্তা বাংলাদেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছেন তাদের অনেকেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর বই লিখেছেন। সেসব বইয়ে তারা একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। পাকিস্তানের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা একাত্তরের গণহত্যা পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন নিয়ে বইয়ে যেসব তথ্য উল্লেখ করেছেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার এফ বি আলি ১৯৬৯ সাল থেকে একাত্তরের গণহত্যার সময় বাংলাদেশে ছিলেন। ‘প্রিজন জার্নি : এ মেমোয়ার’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি।
তিনি লিখেছেন : “শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর আমাদের সদরদপ্তরে জেনারেল রহিম ও ভুট্টোর মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হতে দেখেছি। এসব বৈঠকে সামরিক সরকার ও ভুট্টোর মধ্যে এক ধরনের
সমঝোতা হয়। এর ফলস্বরূপ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় ও শেষ পর্যন্ত তা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের পথ সুগম করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে সেনাবাহিনী ঢাকায় অভিযান শুরু করে এবং নির্বিচারে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা করে।’
এফ বি আলি জানান, তখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়া চিঠিপত্র সেন্সর করা হতো। চট্টগ্রামের একজন নৌ অফিসারের করাচিতে তার পরিবারের উদ্দেশে লেখা একটি চিঠি তার ডেস্কে এসে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল তারিখে লেখা সেই চিঠির একটা দীর্ঘ অংশ তুলে ধরেছেন তিনি : “আমি এখনও বেঁচে আছি ও ভালো আছি। (মৃত) শহরের অবস্থা খুবই খারাপ। ‘মৃত’ লিখলাম কারণ, শহরটির আর কোনো অস্তিত্ব নেই)। নৌ সেনারা দীর্ঘ ও কষ্টকর অপেক্ষার পর নিকৃষ্ট বিঙ্গোদের গুঁড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পায়। বন্দরে আমরা যখন টিকতে পারছিলাম না তখন স্থলবাহিনীর সাহায্য চাই। ওহ, তারা এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে এই বিঙ্গোরা তা জীবনেও ভুলবে না। বিমানবাহিনীও শত্রুদের ওপর হাজার-পাউন্ডের বোমা ফেলতে কার্পণ্য করেনি। পি এন এস জাহাঙ্গীর থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। আমি পিএনএস ঢাকার একটি প্লাটুনের কমান্ডার। বাড়িয়ে বলছি না, আমরা এখানে এত মানুষ মেরেছি যে সবাই আমাদের টি-এইচ-বি-এস (ট্রিগার হ্যাপি বাস্টার্ডস স্কোয়াড) বলে ডাকে। আমি এ পর্যন্ত ডজনখানেক গাদ্দার বিঙ্গোকে হত্যা করেছি। স্থল সেনারা ভয়ংকর মেজাজে আছে। নৌ সেনারা শত শত জনকে ধরে জেলে পুরছে। কিন্তু, স্থল সেনারা জেলে ঢোকানোয় বিশ্বাসী নয়, তারা ধরছে আর সঙ্গে সঙ্গে খতম করে দিচ্ছে। পুরো চট্টগ্রাম শহরে কেবল লাশ আর লাশ। এসব লাশের বেশিরভাগই পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কর্ণফুলী নদীতে শুধুই লাশ ভাসছে। মুখে রুমাল না বেঁধে হাঁটাচলা করা যায় না। আমার ধারণা, পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র একই অবস্থা। রেডিও পাকিস্তানের কথা একদম বিশ্বাস করবে না।”
সিদ্দিক সালিক ১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উইটনেস টু সারেন্ডার শিরোনামের একটি বই লিখেছেন সিদ্দিক সালিক। সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, জেনারেল রাও ফরমান আলী হালকা নীল কাগজের অফিসিয়াল প্যাডের ওপর একটি সাধারণ কাঠপেনসিল দিয়ে পরিকল্পনার খসড়া লিখেছিলেন। সেই লেখা সিদ্দিক সালিক নিজের চোখে দেখেছিলেন।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা একাত্তরে বাংলাদেশেসেনাবাহিনীর ১৪তম ডিভিশনের জিওসি ছিলেন ছিলেন। তিনি ‘আ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি ইস্ট পাকিস্তান ১৯৬৯-১৯৭১’ শিরোনামে স্মৃতিচারণামূলক বই লিখেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তারা অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা।
বইয়ে খাদিম হুসাইন রাজা লিখেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তাকে এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে কমান্ড হাউসে ডেকে পাঠান। তারা দুজন সেখানে যাওয়ার পর টিক্কা খান তাদের বলেন, শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় প্রত্যাশিত অগ্রগতি হচ্ছে না। সে কারণে ইয়াহিয়া খান ‘মিলিটারি অ্যাকশন’ এর জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
ইয়াহিয়া খানের বরাত দিয়ে টিক্কা খান সেনা কর্মকর্তাদের একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেন।
মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা তার বইয়ে আরও লিখেছেন, সেই নির্দেশ অনুযায়ী পরদিন ১৮ মার্চ ক্যান্টনমেন্টে তার বাসায় রাও ফরমান আলী আসেন। তারা দুজন মিলে অপারেশন সার্চলাইটের খসড়া তৈরি করেন। তারা দুজন আলাদা দুটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। সে অনুযায়ী রাও ফরমান আলী ঢাকা অঞ্চলে সামরিক অভিযানের দায়িত্ব নেন এবং খাদিম হুসাইন রাজা দায়িত্ব নেন ঢাকার বাইরে।
সেই খসড়া নিয়ে তাঁরা সন্ধ্যায় যান কমান্ড হাউসে। সেখানে অল্প সময়ের মধ্যেই তা অনুমোদন করা হয়। এরপর বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন ১৯ মার্চ থেকে। সে অনুযায়ী ঢাকায় সশস্ত্র আক্রমণ চালানো হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে।