alt

১৭ মার্চ ১৯৭১, জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা

সাদেকুর রহমান

: বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩

১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা -ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ছিল বুধবার। সেদিন ছিল মুক্তিকামী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১তম জন্মবার্ষিকী। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ এদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। টালমাটাল সময়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে এতটুকু ভয় পায়নি বাঙালি!

পূর্বঘোষিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ষোড়শ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকাল দশটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক শুরু হয়। এদিন বৈঠক প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী চলে।

পাকিস্তানিদের ভাষায়, সে বৈঠক ছিল একটা ‘টাফ সেশন’। এদিনও বঙ্গবন্ধু বৈঠকের শুরুতেই সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং ইয়াহিয়া আবারও আইনগত সমস্যার কথা বলেন।

প্রথম দিনের মতোই আলোচনা শেষে অপেক্ষমাণ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তবে আলোচনার পরবর্তী সময়ও ঠিক হয়নি। আলোচনা চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনও চলবে।

বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে পৌঁছলে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের অনুরোধে তিনি তাদের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। জন্মদিনে তার কামনা কী, জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোন মুহূর্তে আমাদের মৃত্যু হতে পারে।’

পরদিন ১৮ মার্চ ঢাকার দৈনিক সংবাদে ‘মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিতীয় দফা বৈঠক সম্পন্ন। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। জনগণকে ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান।’ - এমন শিরোনাম-উপশিরোনামে নিষ্ফলা বৈঠকের খবর ছাপা হয়।

এদিন সন্ধ্যায়ই আবার ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের পরপরই ইয়াহিয়া খান ‘বেলুচিস্তানের কসাই’খ্যাত টিক্কা খানকে বলেন, ‘দ্য বাস্টার্ড ইজ নট বিহেভিং, ইউ গেট রেডি।’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার জেনারেল টিক্কা খান ১৪তম ডিভিশনের দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজাকে রাতে ফোন করে জানান, ‘খাদিম, ইউ ক্যান গো অ্যাহেড!’ ধীরে ধীরে সম্পন্ন হচ্ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’এর সব প্রস্তুতি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত ও আন্তর্জাতিকমহলের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য ইয়াহিয়া গংয়ের কূটচালের আভাস মেলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে। এতে ১৭ মার্চ ১৯৭১-এর ঘটনাবলি তুলে ধরে তিনি এক স্থানে লিখেছেন, ‘রুমি হাতের দৈনিক আজাদ পত্রিকাটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। পড়লাম খবরটা। হেডিং হচ্ছে :

জানেন কি?

রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতজন পদস্থ ব্যক্তি অবস্থান করিতেছেন?

খবরটা সংক্ষেপে হলো : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর এবং আরও ছয়জন ব্রিগেডিয়ার ঢাকা এসেছেন। তবে এ সম্বন্ধে কোন সরকারি সমর্থন পাওয়া যায়নি। কেবল প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ অফিসার সাংবাদিকদের প্রশ্নের চাপে, পীরজাদা ও ওমরের ঢাকা আসার কথা স্বীকার করেছেন।’

একই দিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন স্বাধীন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘আমার ৮৯ বছরের অতীতের সবকটি আন্দোলনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। কিন্তু একটি সার্বজনীন দাবিতে জনগণের মধ্যে বর্তমান সময়ের মতো একতা ও সহযোগিতা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।’

স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এদিন ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে ছাত্র নেতারা এদিন সকাল ৬টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সকল প্রকার যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, শহীদানের মাজার জিয়ারত, শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র-জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে।

লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকরা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ভুট্টোর দুই অংশের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ নির্বাচন গোটা দেশের জন্য হয়েছে। দুই অংশের জন্য পৃথক পৃথক নির্বাচন হয়নি। কাজেই জাতীয় পরিষদে একটি মাত্র মেজরিটি পার্টি থাকবে। ভুট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ও প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট দু’টি আইন সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন

নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হবে দুর্গোৎসব: ডিএমপি কমিশনার

ছবি

পাহাড়ি ঢলে ঝিনাইগাতীতে নদীর বাঁধ ভেঙে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

ছবি

কাঁটাতারে ঝুলে মারা যাওয়া সেই ফেলানীর ছোট ভাই এখন বর্ডারগার্ড

ডেঙ্গু: আরও ৬ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬৪৭ জন

৪ আগস্ট মুহাম্মদ ইউনূসকে নতুন সরকারের প্রধান হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়: নাহিদ ইসলাম

ছবি

কুমিল্লায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে ৪টি মাজারে হামলা, আগুন

ছবি

জুলাই আন্দোলনের ঘটনায় রামপুরায় হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ: পাঁচ আসামির বিচার শুরু

ছবি

সাবেক ভূমিমন্ত্রী জাবেদ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড নোটিসের আবেদন

ছবি

সরকার নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: প্রধান উপদেষ্টা

ছবি

টিআইবির প্রশ্ন: ভবিষ্যৎ মন্ত্রীদের জন্য বিলাসবহুল গাড়ি কেনায় অতি আগ্রহ কেন?

ছবি

নাহিদ ইসলামের জবানবন্দি: ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ আখ্যায়িত করে অপমানিত করা হয়েছে

ছবি

জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস

ছবি

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ

ছবি

আমি যে কাজ করেছি তা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনদিন হয় নি: সিলেটে আসিফ নজরুল

ছবি

অগ্রণী ব্যাংকে শেখ হাসিনার দুটি লকার জব্দ

ছবি

দেশে ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, নতুন ভর্তি ৬২২

ছবি

মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতিসংঘে যাচ্ছেন ফখরুল-তাহের-আখতার

ছবি

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে চারটি পদ্ধতির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ছবি

ডেমু ট্রেন কেনায় রাষ্ট্রের ক্ষতি, দুদকের মামলা

ছবি

বাংলাদেশ ও ব্রাজিলের প্রধান বিচারপতির বৈঠক

ছবি

ট্রাইব্যুনাল: নাহিদের সাক্ষ্য বুধবার, মাহমুদুর রহমানের জেরা শুরু

ছবি

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, দলগুলোর সঙ্গে বুধবার আবার আলোচনায় বসছে ঐকমত্য কমিশন

ছবি

ভারতীয় হাই কমিশনার প্রণয় ভার্মা: বাংলাদেশ-ভারতের ভৌগোলিক নৈকট্য ও আন্তঃনির্ভতা নতুন সুযোগে রূপান্তরের সম্ভাবনা

ছবি

ধর্মীয় উৎসবে অতিরিক্ত নিরাপত্তা নয়, সমান নাগরিক অধিকারের বাংলাদেশ চান প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস

ছবি

ভুয়া প্রমাণিত হলে জুলাই যোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ

ছবি

মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলায় নাহিদ ইসলামের সাক্ষ্য বুধবার

ছবি

জুলাই আন্দোলন: ইনু-নূরসহ ৯ আসামির ভার্চুয়াল হাজিরা

ছবি

বাংলাদেশে উষ্ণায়নের প্রভাব: কর্মদিবস নষ্ট, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যে বড় ক্ষতি

ছবি

এলডিসি থেকে উত্তরণ পিছিয়ে দিতে কাজ করছে সরকার: বাণিজ্য সচিব

ছবি

ডেঙ্গু মোকাবিলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১২ দফা জরুরি নির্দেশনা

ছবি

দুর্গাপূজা প্রস্তুতি নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক

ছবি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিচালকদের দপ্তর বদল, একজনকে ওএসডি

ছবি

ফিলিস্তিনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাল বাংলাদেশ

ছবি

আরও ১ মাস বাড়লো ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ

ছবি

দেশে ডেঙ্গুতে আরও ৫ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ছাড়াল ৩৮ হাজার

tab

১৭ মার্চ ১৯৭১, জান্তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা

সাদেকুর রহমান

১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা -ফাইল ছবি

বৃহস্পতিবার, ১৬ মার্চ ২০২৩

১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ ছিল বুধবার। সেদিন ছিল মুক্তিকামী বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫১তম জন্মবার্ষিকী। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ এদিন ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসভবনে গিয়ে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানায়। টালমাটাল সময়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার রক্তচক্ষুকে এতটুকু ভয় পায়নি বাঙালি!

পূর্বঘোষিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ষোড়শ দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সকাল দশটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকে মিলিত হন। কড়া সামরিক প্রহরার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে এই বৈঠক শুরু হয়। এদিন বৈঠক প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী চলে।

পাকিস্তানিদের ভাষায়, সে বৈঠক ছিল একটা ‘টাফ সেশন’। এদিনও বঙ্গবন্ধু বৈঠকের শুরুতেই সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং ইয়াহিয়া আবারও আইনগত সমস্যার কথা বলেন।

প্রথম দিনের মতোই আলোচনা শেষে অপেক্ষমাণ দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি। তবে আলোচনার পরবর্তী সময়ও ঠিক হয়নি। আলোচনা চলছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনও চলবে।

বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে পৌঁছলে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের অনুরোধে তিনি তাদের সঙ্গে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন। জন্মদিনে তার কামনা কী, জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী! আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোন মুহূর্তে আমাদের মৃত্যু হতে পারে।’

পরদিন ১৮ মার্চ ঢাকার দৈনিক সংবাদে ‘মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিতীয় দফা বৈঠক সম্পন্ন। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। জনগণকে ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান।’ - এমন শিরোনাম-উপশিরোনামে নিষ্ফলা বৈঠকের খবর ছাপা হয়।

এদিন সন্ধ্যায়ই আবার ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের একটি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের পরপরই ইয়াহিয়া খান ‘বেলুচিস্তানের কসাই’খ্যাত টিক্কা খানকে বলেন, ‘দ্য বাস্টার্ড ইজ নট বিহেভিং, ইউ গেট রেডি।’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার জেনারেল টিক্কা খান ১৪তম ডিভিশনের দায়িত্বে থাকা মেজর জেনারেল খাদিম হোসাইন রাজাকে রাতে ফোন করে জানান, ‘খাদিম, ইউ ক্যান গো অ্যাহেড!’ ধীরে ধীরে সম্পন্ন হচ্ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’এর সব প্রস্তুতি।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে বাঙালি জাতিকে বিভ্রান্ত ও আন্তর্জাতিকমহলের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য ইয়াহিয়া গংয়ের কূটচালের আভাস মেলে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থে। এতে ১৭ মার্চ ১৯৭১-এর ঘটনাবলি তুলে ধরে তিনি এক স্থানে লিখেছেন, ‘রুমি হাতের দৈনিক আজাদ পত্রিকাটা এগিয়ে দিল আমার দিকে। পড়লাম খবরটা। হেডিং হচ্ছে :

জানেন কি?

রাজধানী ঢাকায় বর্তমানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতজন পদস্থ ব্যক্তি অবস্থান করিতেছেন?

খবরটা সংক্ষেপে হলো : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ, প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল ওমর এবং আরও ছয়জন ব্রিগেডিয়ার ঢাকা এসেছেন। তবে এ সম্বন্ধে কোন সরকারি সমর্থন পাওয়া যায়নি। কেবল প্রেসিডেন্টের জনসংযোগ অফিসার সাংবাদিকদের প্রশ্নের চাপে, পীরজাদা ও ওমরের ঢাকা আসার কথা স্বীকার করেছেন।’

একই দিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-ভাসানী) নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন স্বাধীন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি এখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ।’ তিনি বলেন, ‘আমার ৮৯ বছরের অতীতের সবকটি আন্দোলনের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম। কিন্তু একটি সার্বজনীন দাবিতে জনগণের মধ্যে বর্তমান সময়ের মতো একতা ও সহযোগিতা আমি এর আগে কখনো দেখিনি।’

স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এদিন ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানসহ বিভিন্ন এলাকায় কুচকাওয়াজ ও রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন।

২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে ছাত্র নেতারা এদিন সকাল ৬টায় সরকারি-বেসরকারি অফিস, আদালত, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সকল প্রকার যানবাহনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, প্রভাতফেরি, শহীদানের মাজার জিয়ারত, শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় ছাত্র-জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করে।

লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিকরা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে ভুট্টোর দুই অংশের দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ নির্বাচন গোটা দেশের জন্য হয়েছে। দুই অংশের জন্য পৃথক পৃথক নির্বাচন হয়নি। কাজেই জাতীয় পরিষদে একটি মাত্র মেজরিটি পার্টি থাকবে। ভুট্টোর প্রস্তাব পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ও প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ জানান।

লেখক : অনুষ্ঠান সমন্বয়ক ও গবেষক, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার।

back to top