আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে ‘গুম’, ‘আটকে রেখে নির্যাতন’ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে ধরে এনে ‘হত্যার’ অভিযোগের বেশকিছু ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনার খবর উঠে এসেছে গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘গুম ও আয়নাঘরের’ বিষয়টি ফের সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে গুম সংক্রান্ত একটি কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৪ ডিসেম্বর শনিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনের কিছু অংশ পরদিন রোববার গণমাধ্যমকে সরবরাহ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। পুরো প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি, শুধুমাত্র ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ দেয়া হয়েছে। সেখানে গুম ও নির্যাতনের চিত্র পাওয়া গেছে।
কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বয়ানে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের নানা রোমহর্ষক বর্ণনা।
প্রতিবেদনের প্রকাশ করা একটি অংশে দাবি করা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আগের সরকারের সময়ে ‘পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে গুম’ করা হত।
বিভিন্ন অভিযোগ ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ‘গুম, নির্যাতন ও ধরে এনে হত্যার’ মতো ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। অনেকগুলো বাহিনীর কার্যালয়ে পাওয়া গেছে নির্যাতনের বিশেষায়িত যন্ত্র ও সাউন্ড প্রুফ কক্ষ।
প্রতিবেদনের প্রকাশ করা অংশে তুলে ধরা হয়েছে, মাথায় গুলির পর সিমেন্টের বস্তা বেঁধে নদীতে লাশ ফেলে দেয়া ছিল একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ কর্মপ্রক্রিয়া। মুখ সেলাই করে নির্যাতন, রেললাইনে ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্য লাশ ফেলে রাখার মতো ভয়াবহ ঘটনার কথা বলা হয়েছে। মহাসড়কে নিয়ে চলন্ত গাড়ির নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলার চেষ্টার মতো ঘটনাও এসেছে প্রতিবেদনে।
এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এক বন্দীকে ছেড়ে দেয়ার তথ্য ও ঘটনাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের এ অংশের তথ্য অনুযায়ী, গুম সংক্রান্ত কমিশনে জমা পড়া ১৬৭৬টি অভিযোগের বেশির ভাগই জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের সংজ্ঞা অনুযায়ী চারটি শর্ত পূরণ করে। এরমধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগের প্রাথমিক যাচাই সম্পন্ন করেছে কমিশন। যে ঘটনাগুলোতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা যায়নি সেগুলো তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কীভাবে গুমের জন্য ব্যক্তিদের বাছাই করা হত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানোর মতো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি ধরনের কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে একটা হল, একজনকে আটকে তাকে নির্যাতন করলে তিনি যে নামগুলো বলতেন তাদেরও ধরে আনা হত।
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর সরকারপ্রধানের দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। ‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশও করা হয় ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেয়া ওই প্রতিবেদনে।
সেদিন প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর গুম বিষয়ক কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তারা মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন পড়বে।
কমিশন প্রতিবেদন দেয়ার পর প্রেস উইংয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গুমের’ ঘটনায় হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে; যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান এবং আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও হারুন অর রশীদ।
সরকার পতনের পর এদের মধ্যে জিয়াউল গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অন্যদের আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
১৫ ডিসেম্বর রোববার গুম কমিশনের প্রতিবেদনের প্রকাশ করা অংশে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, অভিযুক্ত র্যাব-১১ এর সাবেক পরিচালক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ আদালতে দেয়া তার জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি র্যাবের তৎকালীন এডিজি জিয়াউল আহসানের কাছ থেকে এগিয়ে যাওয়ার সংকেত (গো এহেড সিগন্যাল) পেয়েছিলেন।
জিয়াউল আহসান সর্বশেষ মেজর জেনারেল পদে এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি গ্রেপ্তার হন, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
প্রতিবেদনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদ-ে দ-িত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ধরে নেয়ার সাত মাস পর ২০১৭ সালের ৩ মার্চ ধানম-ি এলাকায় ফেলে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়।
প্রকাশিত অংশে বলা হয়, ‘গুমের শিকার হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ছেড়ে দেয়ার সময় বারবার বলা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে একটি দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন, কিন্তু এর কিছু শর্ত রয়েছে। আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে, দেশ ছাড়তে হবে এবং পরিস্থিতি ভালো হলে ফেরা যাবে। আপনাকে বুঝতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার জীবনের একটি দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন।’
*একই রকম ডিটেনশন সেন্টার*
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুম করে মানুষদের রাখার জন্য নিজেদের দপ্তরে জায়গা তৈরি করেছিল বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন ভবনে অবস্থিত ডিটেনশন সেলগুলোর নকশার মধ্যে থাকা মিল থাকা এটির আকর্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে। র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের ভবনগুলো ভৌগলিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত হলেও এগুলোর ভেতরে ডিটেনশন সেন্টারগুলোর নকশা একই রকম। এগুলো করা হয়েছে অস্ত্রাগারের পাশে বা একই নকশা অনুসরণ করে।
এ আলামতগুলো নির্দেশ করে, এগুলো মোটেই পরোক্ষ বা দুর্ঘটনাজনিত বা বিচ্ছিন্ন দুষ্ট কর্মকর্তাদের কাজ নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি কেন্দ্রীয় কাঠামোগত নির্দেশনাকে প্রতিফলিত করে যেখানে ইচ্ছেকৃতভাবে এ ধরনের নকশা করা হয়েছিল বলে প্রতিবেদন মন্তব্য করা হয়।
উদহারণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১, চট্টগ্রামের র্যাব-৭ বা মোহাম্মদপুরের র্যাব-২ এর ভবনগুলো বেশ দূরত্বে অবস্থিত হলেও এগুলোর নকশা একই রকমের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে একটা ‘টপ ডাউন’ নির্দেশ কাঠামোর বিষয়ে জানা যায়। নিম্নস্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা প্রায়ই জানতেন না আটক করা ব্যক্তিটির পরিচয়। আর কমান্ডারদের সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তারা তাদের নির্দেশে পরিচালিত কার্যক্রমের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন এবং গত ১৫ বছরে এই কমান্ড কাঠামো অটুট ছিল।
এতে বলা হয়, আটকের বিষয়টি লুকানোর জন্য গুমের পুরো প্রক্রিয়াটি সুক্ষভাবে (মেটিকুলাসলি) সাজানো হয়েছিল যাতে একটা মূল বিষয় ছিল অপারেশনাল বিষয়টিকে বিভক্ত করে ফেলা।
*অভিযান সাদা পোশাকে *
গত ১৫ বছরের ‘গুম সংস্কৃতিতে’ খুবই কৌশলে পরিকল্পনাগুলো প্রণয়ন করার কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাহিনীগুলোর সদস্যরা সাদা পোশাকে অভিযানগুলো চালাত। একটি বাহিনী নিজেদের পরিচয় লুকোতে মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করত। যেমন- ডিজিএফআই অভিযান চালালে তারা নিজেদের র্যাব পরিচয় দিত, আবার র্যাব নিজেদের ডিবি পরিচয় অভিযান চালাত। এমনকি বাহিনীগুলো নিজেদের মধ্যে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিনিময় করত। এক বাহিনী অপহরণ করত, এ বাহিনী আটকে রাখত আর তৃতীয় আরেকটি বাহিনী ওই ভিক্টিমকে খুন করত বা ছেড়ে দিত বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, এমনকি শুধু একটি বাহিনী এরকম কোনো অভিযান করলে অভিযানের কাজগুলো ভাগ ভাগ করে পৃথক টিম দিয়ে করানো হতে। একটি দল অপহরণ করত, অন্যটি দল আটকে রাখত আবার ‘এলিমিনেশন’ (হত্যা) করত আরেকটি দল। এ কারণে কাকে অপহরণ করা হচ্ছে বা কাকে এলিমিনেট (নির্মূল বা হত্যা) করা হচ্ছে এ সম্পর্কে অভিযানের সময় দলগুলো খুব বেশি জানত না।
*নজরদারিতে মোবাইল*
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজরদারিতে ব্যবহৃত হত মূলত মোবাইল প্রযুক্তি। এটি ছাড়া এরকম বাধাহীন অপহরণ বা নিঃশব্দে তুলে নেয়া সম্ভব হত না। ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসি এই কাজ করত। এর আগে ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার বা এনএমসি এ কাজ করত, যেটি ডিজিএফআই সদর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত ছিল। সেখান থেকে সবগুলো বাহিনীকেই এই নজরদারির তথ্য সরবরাহ করা হত।
ঘটনার শিকার এক ব্যক্তির বরাতে বলা হয়েছে, তাকে আটকের পর আটককারীরা তার স্ত্রীর দাঁতের চিকিৎসার প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছিলেন। তাতে তিনি ধারণা করেন বহুদিন ধরে তার মোবাইলে (কথোপকথন) নজরদারি করা হচ্ছিল।
আরেকজন ভুক্তভোগীর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাকে অপহরণের আগে আগে কয়েকটি কল আসে কিন্তু কেউ কথা বলেনি। ব্যক্তির অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার জন্য এরকম করা হত। আবার আরেকটি ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ঘরে ঢুকে সবার ফোন টেবিলে রাখতে বলে। এরপর যার ফোনে একটি ফোন আসে তখন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
*খুব কমই ছাড়া পেয়েছে*
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতে রাস্তা অথবা বাসা থেকে প্রশাসনের লোক, ডিবি অথবা র্যাব পরিচয় দিয়ে তাদের ধরে নেয়া হত। জনবহুল এলাকা, রাস্তার পাশ থেকে বা ফেরি থেকেও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই তাদের নাম ধরে ডেকে ‘হাইয়েস’ মডেলের মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হত।
বিভিন্ন মেয়াদে ভুক্তভোগীদের আটকে রাখা হতো। ৪৮ থেকে ৬০ ঘণ্টা হতে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ, মাস এবং ক্ষেত্র বিশেষে আট বছর পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা হয়েছে বলে প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়।
তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করার অভিযোগের কথাও এসেছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, ডিবি এবং সিটিটিসির মতো দপ্তরগুলোতে নির্যাতন করা তাদের দৈনিক কাজের একটা অংশ ছিল। সেখানে বৈধ ও অবৈধভাবে ধরে আনাদের একসঙ্গে রাখা হত।
প্রতিবেদনে অন্য বাহিনীর ইউনিটের নির্যাতনের বিশেষ আয়োজনের তথ্য তুলে ধরা হয়। এই জায়গাগুলোতে সাউন্ডপ্রুফ রুম ও বিশেষ যন্ত্রপাতি দেখা গেছে, যেগুলো মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। অনুসন্ধানের স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
* ঠোঁটজোড়া সেলাই*
প্রতিবেদনের প্রকাশিত অংশে বলা হয়, ২০১২ সালে র্যাবের হাতে অপহৃত ধানম-ির এক যুবক বলেছেন, তাকে একটি ঘরে নিয়ে তার ঠোঁটজোড়া সুই দিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়। তিনি এই প্রক্রিয়াকে গরুর চামড়া সেলাইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর আট বছর পরে র্যাবের দ্বারা ধরে নেয়া অন্য ব্যক্তি বলেছেন, তার জননাঙ্গ ও কানে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে।
জায়গা ও পরিস্থিতির ভিন্নতা সত্ত্বেও নির্যাতনের চর্চার এই ধারাবাহিকতা এবং মিল এই চর্চাগুলো কেবল সিস্টেমেটিকই না এগুলো বাহিনীগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠানিক বলে প্রতিবেদনে গুরুত্বসহকারে মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের মেরে ফেলা হয়েছে, না হয় তাদের বিচারিক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তিকে কোনো প্রকার অভিযোগ না এনেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
*সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে*
প্রতিবেদনে হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, তাদের বিষয়ে নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট থেকে হত্যার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেছে। অনেকগুলো ঘটনায় লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তে বলা হয়েছে, যে নিহত ব্যক্তিকে মাথায় গুলি করা হয়েছে। এরপর সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। র্যাবে কাজ করা সামরিক অফিসাররা বলেছেন, লাশ ডুবিয়ে দেয়ার এটা হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর। হত্যা ও লাশ ফেলে দেওয়ার জায়গাগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদী, কাঞ্চন সেতু, পোস্তগোলা সেতু রয়েছে। পোস্তগোলা সেতু এলাকায় সুন্দরবনের দস্যুদের কাছ থেকে জব্দ করা একটি নৌকা রয়েছে। যেটিকে লাশ ফেলে দেয়ার মতো জঘন্য কাজে ব্যবহারের জন্য মডিফাই করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাবের একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার বলছেন, র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং তাকে একটি ওরিয়েন্টেশন সেসনে নিয়ে গিয়েছিল যেখানে তার সামনে দুজনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। আরেকজন সৈনিক বলেছেন, তিনি র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে থাকার সময় ধরে নিয়ে আসা একজন পালানোর জন্য নদীতে লাফ দেয়। ওই সৈনিক ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন এবং তাকে সেখানে মেরে ফেলা হয়।
*রেল লাইনে লাশ*
প্রতিবেদনে আরেকজন সৈনিককে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ওই সৈনিক বলেছেন, তাকে একটি লাশ বয়ে নিয়ে রেললাইনের ওপর ফেলতে বলা হয়। অফিসার এবং অন্য সদস্যরা তাদের গাড়িতে বসে ট্রেন যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন যাতে দেহটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
আরেকটি ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন ব্যক্তি বলেছেন, তাকে মহাসড়কে নিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্কা মারে। তবে গাড়িটি সরে যায় এবং তিনি বেঁচে যান। এরপর ওই অফিসার আর চেষ্টা করেননি।
বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে তুলে ধর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধরে নেয়া অনেকেই যে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, সেটা স্বীকার করেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বানানো মামলায় তাদের ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হয়েছে।
*ভারতের কাছে সমর্পণ*
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গুমের ক্ষেত্রে ভারতের জড়িত হওয়ার বিষয়টাও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রকাশিত অংশে বলা হয়েছে, এ অভিযানগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়েছে সে বিষয়ে দুটো খুব আলোচিত ঘটনা মূল্যবান ধারণা দেয়। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে সুখরঞ্জন বালি অপহৃত হওয়ার পর তাকে ভারতীয় কারাগারে পাওয়ার বিষয়টি এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহেমেদের মামলাটি রয়েছে। এর বাইরেও হুম্মাম কাদের চৌধুরী আটকাবস্থায় হিন্দিভাষি লোকদের কথা বলতে শুনেছেন। যেমন- তাকে কখন তোলা হয়েছে? সে কি কোনো তথ্য দিয়েছে? এখন পর্যন্ত কী জিজ্ঞাসা করা হলো? ইত্যাদি বলতে শুনেছেন তিনি।
*বিএসএফের সঙ্গে বিনিময়*
অপরদিকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদকে উত্তরা থেকে ধরে নেয়া হয় ২০১৫ সালে। তাকে একটি খালি সেলে রাখা হয় যেখানে মেঝেতে থাকা একটি ফুটো টয়লেট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাকে যে কম্বল দেওয়া হয়েছিল সেখানে ‘টিএফআই’ (টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টোরেগেশন) লেখা ছিল। ওই সময়ে র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং র্যাব সদর দপ্তরের অধীনে একমাত্র টিএফআই সেন্টারটি পরিচালনা করত। এটা র্যাব-১ এর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সালাহউদ্দীন আহমেদের বর্ণনায় তুলে ধরা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিয়ে ভারতের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অনেকটা আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের সময় বাংলাদেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জমটুপি পরিহিত ছিলেন।
র্যাবের একজন সদস্যকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তার উপস্থিতিতে ২০১১ সালে র্যাব ইন্টেলিজেন্স তামাবিল বর্ডারে ভারতের বিএসএফ এর ইউনিফরম পরা সদস্যদের উপস্থিতিতে তিনজন বন্দীকে বুঝে নেয়। আরেকটি ঘটনায় একজন জীবিত বন্দিকে র্যাবের হাতে তুলে দেয়া হয়। বদলায় র্যাব দুজনকে ভারতের হাতে তুলে দেয়।
মঙ্গলবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪
আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে ‘গুম’, ‘আটকে রেখে নির্যাতন’ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মাধ্যমে ধরে এনে ‘হত্যার’ অভিযোগের বেশকিছু ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনার খবর উঠে এসেছে গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে। রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে এসব ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ‘গুম ও আয়নাঘরের’ বিষয়টি ফের সামনে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে গুম সংক্রান্ত একটি কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৪ ডিসেম্বর শনিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনের কিছু অংশ পরদিন রোববার গণমাধ্যমকে সরবরাহ করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। পুরো প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়নি, শুধুমাত্র ‘প্রকাশযোগ্য অংশ’ দেয়া হয়েছে। সেখানে গুম ও নির্যাতনের চিত্র পাওয়া গেছে।
কমিশনের তদন্ত, ঘটনায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তা ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের বয়ানে উঠে এসেছে গুম ও নির্যাতনের নানা রোমহর্ষক বর্ণনা।
প্রতিবেদনের প্রকাশ করা একটি অংশে দাবি করা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত আগের সরকারের সময়ে ‘পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরাসরি নির্দেশে গুম’ করা হত।
বিভিন্ন অভিযোগ ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো ‘গুম, নির্যাতন ও ধরে এনে হত্যার’ মতো ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে। অনেকগুলো বাহিনীর কার্যালয়ে পাওয়া গেছে নির্যাতনের বিশেষায়িত যন্ত্র ও সাউন্ড প্রুফ কক্ষ।
প্রতিবেদনের প্রকাশ করা অংশে তুলে ধরা হয়েছে, মাথায় গুলির পর সিমেন্টের বস্তা বেঁধে নদীতে লাশ ফেলে দেয়া ছিল একটি ‘স্ট্যান্ডার্ড’ কর্মপ্রক্রিয়া। মুখ সেলাই করে নির্যাতন, রেললাইনে ছিন্নভিন্ন হওয়ার জন্য লাশ ফেলে রাখার মতো ভয়াবহ ঘটনার কথা বলা হয়েছে। মহাসড়কে নিয়ে চলন্ত গাড়ির নিচে ধাক্কা দিয়ে ফেলার চেষ্টার মতো ঘটনাও এসেছে প্রতিবেদনে।
এমনকি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এক বন্দীকে ছেড়ে দেয়ার তথ্য ও ঘটনাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের এ অংশের তথ্য অনুযায়ী, গুম সংক্রান্ত কমিশনে জমা পড়া ১৬৭৬টি অভিযোগের বেশির ভাগই জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের সংজ্ঞা অনুযায়ী চারটি শর্ত পূরণ করে। এরমধ্যে ৭৫৮টি অভিযোগের প্রাথমিক যাচাই সম্পন্ন করেছে কমিশন। যে ঘটনাগুলোতে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা যাচাই করা যায়নি সেগুলো তদন্তের জন্য পুলিশের কাছে পাঠানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কীভাবে গুমের জন্য ব্যক্তিদের বাছাই করা হত সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট উপসংহারে পৌঁছানোর মতো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি ধরনের কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে একটা হল, একজনকে আটকে তাকে নির্যাতন করলে তিনি যে নামগুলো বলতেন তাদেরও ধরে আনা হত।
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর সরকারপ্রধানের দপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘গুমের নির্দেশদাতা’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন। ‘গুমের’ ঘটনায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশও করা হয় ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শিরোনামে জমা দেয়া ওই প্রতিবেদনে।
সেদিন প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর গুম বিষয়ক কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, তারা মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবেন। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজন পড়বে।
কমিশন প্রতিবেদন দেয়ার পর প্রেস উইংয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গুমের’ ঘটনায় হাসিনা প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে; যাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান এবং আওয়ামী লীগ শাসনামলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম ও হারুন অর রশীদ।
সরকার পতনের পর এদের মধ্যে জিয়াউল গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং অন্যদের আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
১৫ ডিসেম্বর রোববার গুম কমিশনের প্রতিবেদনের প্রকাশ করা অংশে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, অভিযুক্ত র্যাব-১১ এর সাবেক পরিচালক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ আদালতে দেয়া তার জবানবন্দিতে বলেছেন, তিনি র্যাবের তৎকালীন এডিজি জিয়াউল আহসানের কাছ থেকে এগিয়ে যাওয়ার সংকেত (গো এহেড সিগন্যাল) পেয়েছিলেন।
জিয়াউল আহসান সর্বশেষ মেজর জেনারেল পদে এনটিএমসির মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি গ্রেপ্তার হন, তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
প্রতিবেদনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদ-ে দ-িত সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ধরে নেয়ার সাত মাস পর ২০১৭ সালের ৩ মার্চ ধানম-ি এলাকায় ফেলে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়।
প্রকাশিত অংশে বলা হয়, ‘গুমের শিকার হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে ছেড়ে দেয়ার সময় বারবার বলা হয়েছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে একটি দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন, কিন্তু এর কিছু শর্ত রয়েছে। আপনাকে অবশ্যই রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে, দেশ ছাড়তে হবে এবং পরিস্থিতি ভালো হলে ফেরা যাবে। আপনাকে বুঝতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার জীবনের একটি দ্বিতীয় সুযোগ দিচ্ছেন।’
*একই রকম ডিটেনশন সেন্টার*
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুম করে মানুষদের রাখার জন্য নিজেদের দপ্তরে জায়গা তৈরি করেছিল বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বিভিন্ন ভবনে অবস্থিত ডিটেনশন সেলগুলোর নকশার মধ্যে থাকা মিল থাকা এটির আকর্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে। র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের ভবনগুলো ভৌগলিকভাবে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত হলেও এগুলোর ভেতরে ডিটেনশন সেন্টারগুলোর নকশা একই রকম। এগুলো করা হয়েছে অস্ত্রাগারের পাশে বা একই নকশা অনুসরণ করে।
এ আলামতগুলো নির্দেশ করে, এগুলো মোটেই পরোক্ষ বা দুর্ঘটনাজনিত বা বিচ্ছিন্ন দুষ্ট কর্মকর্তাদের কাজ নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি একটি কেন্দ্রীয় কাঠামোগত নির্দেশনাকে প্রতিফলিত করে যেখানে ইচ্ছেকৃতভাবে এ ধরনের নকশা করা হয়েছিল বলে প্রতিবেদন মন্তব্য করা হয়।
উদহারণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের র্যাব-১১, চট্টগ্রামের র্যাব-৭ বা মোহাম্মদপুরের র্যাব-২ এর ভবনগুলো বেশ দূরত্বে অবস্থিত হলেও এগুলোর নকশা একই রকমের।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে একটা ‘টপ ডাউন’ নির্দেশ কাঠামোর বিষয়ে জানা যায়। নিম্নস্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা প্রায়ই জানতেন না আটক করা ব্যক্তিটির পরিচয়। আর কমান্ডারদের সাক্ষাৎকারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তারা তাদের নির্দেশে পরিচালিত কার্যক্রমের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিলেন এবং গত ১৫ বছরে এই কমান্ড কাঠামো অটুট ছিল।
এতে বলা হয়, আটকের বিষয়টি লুকানোর জন্য গুমের পুরো প্রক্রিয়াটি সুক্ষভাবে (মেটিকুলাসলি) সাজানো হয়েছিল যাতে একটা মূল বিষয় ছিল অপারেশনাল বিষয়টিকে বিভক্ত করে ফেলা।
*অভিযান সাদা পোশাকে *
গত ১৫ বছরের ‘গুম সংস্কৃতিতে’ খুবই কৌশলে পরিকল্পনাগুলো প্রণয়ন করার কথা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাহিনীগুলোর সদস্যরা সাদা পোশাকে অভিযানগুলো চালাত। একটি বাহিনী নিজেদের পরিচয় লুকোতে মিথ্যা পরিচয় ব্যবহার করত। যেমন- ডিজিএফআই অভিযান চালালে তারা নিজেদের র্যাব পরিচয় দিত, আবার র্যাব নিজেদের ডিবি পরিচয় অভিযান চালাত। এমনকি বাহিনীগুলো নিজেদের মধ্যে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিনিময় করত। এক বাহিনী অপহরণ করত, এ বাহিনী আটকে রাখত আর তৃতীয় আরেকটি বাহিনী ওই ভিক্টিমকে খুন করত বা ছেড়ে দিত বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, এমনকি শুধু একটি বাহিনী এরকম কোনো অভিযান করলে অভিযানের কাজগুলো ভাগ ভাগ করে পৃথক টিম দিয়ে করানো হতে। একটি দল অপহরণ করত, অন্যটি দল আটকে রাখত আবার ‘এলিমিনেশন’ (হত্যা) করত আরেকটি দল। এ কারণে কাকে অপহরণ করা হচ্ছে বা কাকে এলিমিনেট (নির্মূল বা হত্যা) করা হচ্ছে এ সম্পর্কে অভিযানের সময় দলগুলো খুব বেশি জানত না।
*নজরদারিতে মোবাইল*
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নজরদারিতে ব্যবহৃত হত মূলত মোবাইল প্রযুক্তি। এটি ছাড়া এরকম বাধাহীন অপহরণ বা নিঃশব্দে তুলে নেয়া সম্ভব হত না। ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার বা এনটিএমসি এই কাজ করত। এর আগে ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার বা এনএমসি এ কাজ করত, যেটি ডিজিএফআই সদর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত ছিল। সেখান থেকে সবগুলো বাহিনীকেই এই নজরদারির তথ্য সরবরাহ করা হত।
ঘটনার শিকার এক ব্যক্তির বরাতে বলা হয়েছে, তাকে আটকের পর আটককারীরা তার স্ত্রীর দাঁতের চিকিৎসার প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছিলেন। তাতে তিনি ধারণা করেন বহুদিন ধরে তার মোবাইলে (কথোপকথন) নজরদারি করা হচ্ছিল।
আরেকজন ভুক্তভোগীর বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, তাকে অপহরণের আগে আগে কয়েকটি কল আসে কিন্তু কেউ কথা বলেনি। ব্যক্তির অবস্থান সুনির্দিষ্ট করার জন্য এরকম করা হত। আবার আরেকটি ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা ঘরে ঢুকে সবার ফোন টেবিলে রাখতে বলে। এরপর যার ফোনে একটি ফোন আসে তখন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি।
*খুব কমই ছাড়া পেয়েছে*
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতে রাস্তা অথবা বাসা থেকে প্রশাসনের লোক, ডিবি অথবা র্যাব পরিচয় দিয়ে তাদের ধরে নেয়া হত। জনবহুল এলাকা, রাস্তার পাশ থেকে বা ফেরি থেকেও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। প্রায়ই তাদের নাম ধরে ডেকে ‘হাইয়েস’ মডেলের মাইক্রোবাসে তুলে নেয়া হত।
বিভিন্ন মেয়াদে ভুক্তভোগীদের আটকে রাখা হতো। ৪৮ থেকে ৬০ ঘণ্টা হতে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ, মাস এবং ক্ষেত্র বিশেষে আট বছর পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা হয়েছে বলে প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়।
তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করার অভিযোগের কথাও এসেছে প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, ডিবি এবং সিটিটিসির মতো দপ্তরগুলোতে নির্যাতন করা তাদের দৈনিক কাজের একটা অংশ ছিল। সেখানে বৈধ ও অবৈধভাবে ধরে আনাদের একসঙ্গে রাখা হত।
প্রতিবেদনে অন্য বাহিনীর ইউনিটের নির্যাতনের বিশেষ আয়োজনের তথ্য তুলে ধরা হয়। এই জায়গাগুলোতে সাউন্ডপ্রুফ রুম ও বিশেষ যন্ত্রপাতি দেখা গেছে, যেগুলো মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। অনুসন্ধানের স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
* ঠোঁটজোড়া সেলাই*
প্রতিবেদনের প্রকাশিত অংশে বলা হয়, ২০১২ সালে র্যাবের হাতে অপহৃত ধানম-ির এক যুবক বলেছেন, তাকে একটি ঘরে নিয়ে তার ঠোঁটজোড়া সুই দিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়। তিনি এই প্রক্রিয়াকে গরুর চামড়া সেলাইয়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এর আট বছর পরে র্যাবের দ্বারা ধরে নেয়া অন্য ব্যক্তি বলেছেন, তার জননাঙ্গ ও কানে বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয়েছে।
জায়গা ও পরিস্থিতির ভিন্নতা সত্ত্বেও নির্যাতনের চর্চার এই ধারাবাহিকতা এবং মিল এই চর্চাগুলো কেবল সিস্টেমেটিকই না এগুলো বাহিনীগুলোর মধ্যে প্রতিষ্ঠানিক বলে প্রতিবেদনে গুরুত্বসহকারে মন্তব্য করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার ব্যক্তিদের মেরে ফেলা হয়েছে, না হয় তাদের বিচারিক ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়েছে। খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তিকে কোনো প্রকার অভিযোগ না এনেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
*সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে*
প্রতিবেদনে হত্যার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে বলা হয়েছে, তাদের বিষয়ে নির্ভরযোগ্য রিপোর্ট থেকে হত্যার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা গেছে। অনেকগুলো ঘটনায় লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তে বলা হয়েছে, যে নিহত ব্যক্তিকে মাথায় গুলি করা হয়েছে। এরপর সিমেন্টের বস্তায় বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে। র্যাবে কাজ করা সামরিক অফিসাররা বলেছেন, লাশ ডুবিয়ে দেয়ার এটা হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড প্রসিডিউর। হত্যা ও লাশ ফেলে দেওয়ার জায়গাগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা নদী, কাঞ্চন সেতু, পোস্তগোলা সেতু রয়েছে। পোস্তগোলা সেতু এলাকায় সুন্দরবনের দস্যুদের কাছ থেকে জব্দ করা একটি নৌকা রয়েছে। যেটিকে লাশ ফেলে দেয়ার মতো জঘন্য কাজে ব্যবহারের জন্য মডিফাই করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, র্যাবের একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার বলছেন, র্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং তাকে একটি ওরিয়েন্টেশন সেসনে নিয়ে গিয়েছিল যেখানে তার সামনে দুজনকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। আরেকজন সৈনিক বলেছেন, তিনি র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইংয়ে থাকার সময় ধরে নিয়ে আসা একজন পালানোর জন্য নদীতে লাফ দেয়। ওই সৈনিক ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করেন এবং তাকে সেখানে মেরে ফেলা হয়।
*রেল লাইনে লাশ*
প্রতিবেদনে আরেকজন সৈনিককে উদ্ধৃত করে বলা হয়, ওই সৈনিক বলেছেন, তাকে একটি লাশ বয়ে নিয়ে রেললাইনের ওপর ফেলতে বলা হয়। অফিসার এবং অন্য সদস্যরা তাদের গাড়িতে বসে ট্রেন যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন যাতে দেহটি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
আরেকটি ঘটনায় বেঁচে যাওয়া একজন ব্যক্তি বলেছেন, তাকে মহাসড়কে নিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা একটি চলন্ত গাড়ির সামনে ধাক্কা মারে। তবে গাড়িটি সরে যায় এবং তিনি বেঁচে যান। এরপর ওই অফিসার আর চেষ্টা করেননি।
বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে তুলে ধর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধরে নেয়া অনেকেই যে ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, সেটা স্বীকার করেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন বানানো মামলায় তাদের ‘শ্যোন অ্যারেস্ট’ দেখানো হয়েছে।
*ভারতের কাছে সমর্পণ*
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গুমের ক্ষেত্রে ভারতের জড়িত হওয়ার বিষয়টাও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রকাশিত অংশে বলা হয়েছে, এ অভিযানগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়েছে সে বিষয়ে দুটো খুব আলোচিত ঘটনা মূল্যবান ধারণা দেয়। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গন থেকে সুখরঞ্জন বালি অপহৃত হওয়ার পর তাকে ভারতীয় কারাগারে পাওয়ার বিষয়টি এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহেমেদের মামলাটি রয়েছে। এর বাইরেও হুম্মাম কাদের চৌধুরী আটকাবস্থায় হিন্দিভাষি লোকদের কথা বলতে শুনেছেন। যেমন- তাকে কখন তোলা হয়েছে? সে কি কোনো তথ্য দিয়েছে? এখন পর্যন্ত কী জিজ্ঞাসা করা হলো? ইত্যাদি বলতে শুনেছেন তিনি।
*বিএসএফের সঙ্গে বিনিময়*
অপরদিকে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদকে উত্তরা থেকে ধরে নেয়া হয় ২০১৫ সালে। তাকে একটি খালি সেলে রাখা হয় যেখানে মেঝেতে থাকা একটি ফুটো টয়লেট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাকে যে কম্বল দেওয়া হয়েছিল সেখানে ‘টিএফআই’ (টাস্ক ফোর্স ফর ইন্টোরেগেশন) লেখা ছিল। ওই সময়ে র্যাবের ইন্টেলিজেন্স উইং র্যাব সদর দপ্তরের অধীনে একমাত্র টিএফআই সেন্টারটি পরিচালনা করত। এটা র্যাব-১ এর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত ছিল বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সালাহউদ্দীন আহমেদের বর্ণনায় তুলে ধরা হয়েছে, তাকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিয়ে ভারতের কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অনেকটা আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের সময় বাংলাদেশি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জমটুপি পরিহিত ছিলেন।
র্যাবের একজন সদস্যকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, তার উপস্থিতিতে ২০১১ সালে র্যাব ইন্টেলিজেন্স তামাবিল বর্ডারে ভারতের বিএসএফ এর ইউনিফরম পরা সদস্যদের উপস্থিতিতে তিনজন বন্দীকে বুঝে নেয়। আরেকটি ঘটনায় একজন জীবিত বন্দিকে র্যাবের হাতে তুলে দেয়া হয়। বদলায় র্যাব দুজনকে ভারতের হাতে তুলে দেয়।