দেশে এ যাবৎ গণভোট হয়েছে ৩ বার
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ। তবে, গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
বৈঠক শেষে বের হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে কোনো বাধা নেই। ওই দিন আলাদা ব্যালটে গণভোটের আয়োজনের কথা বলেছেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারও জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট রাখার কথা বলেছেন।
তবে বৈঠকের বিরতিতে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বর মাসে এই গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রোববার,(০৫ অক্টোবর ২০২৫) ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চতুর্থ দিনের বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে। তবে বিএনপি ও এনসিপি বলছে তা আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই একটি পৃথক ব্যালটে আয়োজন করতে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী বলছে নির্বাচনের আগেই গণভোট হলে ভালো।’
তিনি বলেন, ‘এটি জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পদক্ষেপ।’ অন্য বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশন আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে সরকারের কাছে এক বা একাধিক সুপারিশ দেবে। তার আগে আগামী ৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে সে আইনসভা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে যে সব সংস্কার করবে তা যেন টেকসই হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া জাতীয় ঐকমত্য তৈরি; বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে আগের অবস্থান থেকে অনেক রাজনৈতিক দল সরে আসায় তিনি দলগুলোর প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে কমিশন খুব শিগগিরই সনদ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরি করে সরকারের কাছে দিতে পারবে।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেয়ার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। আজকের আলোচনায় সনদ বাস্তবায়নে ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে বলে মনে করছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।’
তিনি বলেন, ‘৩০টি রাজনৈতিক দলের তিন চতুর্থাংশ দলের প্রতিনিধির নাম পেয়েছি জুলাই সনদ স্বাক্ষরের জন্য।’
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আজকের আলাপ-আলোচনায় মোটামুটি চূড়ান্ত ঐক্যমতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গণভোটের যে প্রস্তাব এসেছে সেটা বিগত দিনে আমরাই দিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের একই দিন একটা আলাদা ব্যালটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।’
বৈঠকের বিরতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের বিষয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে আমরা চাই, গণভোট নির্বাচনের আগেই হোক।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না করে নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে গণভোট হতে পারে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেও হতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই। জনগণকে জটিল অবস্থায় না ফেলে সহজভাবে এগোলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।’ জামায়াতের এ নেতা বলেন, ‘গণভোট হলে এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্টে এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকারকেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। সেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। এ বিষয়ে বেশিরভাগ দল একমত হয়েছে।’
তিনি বলেন, “ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত। যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবে। এ ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে জনগণ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে।”
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার তিনটি দলকে গুরুত্ব দেয়। সেই তিন দলকে এক জায়গায় আনা যাচ্ছে না। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং সনদের পক্ষে ভোটগ্রহণ নিয়ে সবাই একমত। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের অনুমোদন দিতে হবে।’
* বিগত গণভোট *
এর আগে বাংলাদেশে ৩ বার গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে ২ বার অনুষ্ঠিত হয় প্রশাসনিক গণভোট এবং একবার অনুষ্ঠিত হয় সাংবিধানিক গণভোট।
প্রথমবার জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট, ১৯৭৭। এরপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের গণভোট, ১৯৮৫ এবং সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণভোট।
* ১৯৭৭ সালের গণভোট *
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালের ২১ মে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি (বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। ওই গণভোটে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষিত নীতিমালা ও কর্মসূচিকে সমর্থন করেন?’
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মোট ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং ভোটদাতাদের প্রায় ৯৮.৮৭ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন। তবে বিরোধীরা এ গণভোটকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ম পূর্ণ বলে দাবি করে।
জিয়াউর রহমানের জন্য এটি ছিল জনসমর্থন যাচাই-বাছাইয়ের রাজনৈতিক কৌশল, যা তাকে পরবর্তী নির্বাচনী বৈধতা অর্জনে সহায়তা করে।
* ১৯৮৫ সালের গণভোট *
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ, তৎকালীন সামরিক শাসক (জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে। এ গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল তার সামরিক শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন।
নির্বাচনী কমিশনের তথ্যমতে, ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৭২ শতাংশ এবং ৯৪.৫ শতাংশ ভোটার এরশাদের পক্ষে ভোট দেন। তবে দেশজুড়ে ভোট জালিয়াতি, প্রশাসনিক প্রভাব ও বিরোধী দলের বর্জনের কারণে এ গণভোটের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে এরশাদের শাসন বৈধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন।
* ১৯৯১ সালের গণভোট *
বাংলাদেশের সর্বশেষ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরের বিষয়ে জনগণের মতামত নেয়া।
ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল ‘আপনি কি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন সম্মত?’
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৮৪ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৮৮.৫ শতাংশ সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেন। এ গণভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নির্ভর সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হয়, যা আজও চলমান।
দেশে এ যাবৎ গণভোট হয়েছে ৩ বার
ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
রোববার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ। তবে, গণভোট আয়োজনের সময় নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী।
বৈঠক শেষে বের হয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছেন, সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোটে কোনো বাধা নেই। ওই দিন আলাদা ব্যালটে গণভোটের আয়োজনের কথা বলেছেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারও জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট রাখার কথা বলেছেন।
তবে বৈঠকের বিরতিতে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী নভেম্বর অথবা ডিসেম্বর মাসে এই গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে রোববার,(০৫ অক্টোবর ২০২৫) ঢাকার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চতুর্থ দিনের বৈঠক হয়।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং তাদের সম্মতির জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই একমত হয়েছে। তবে বিএনপি ও এনসিপি বলছে তা আগামী জাতীয় নির্বাচনের দিনই একটি পৃথক ব্যালটে আয়োজন করতে। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী বলছে নির্বাচনের আগেই গণভোট হলে ভালো।’
তিনি বলেন, ‘এটি জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম পদক্ষেপ।’ অন্য বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘কমিশন আগামী ১০ অক্টোবরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নে সরকারের কাছে এক বা একাধিক সুপারিশ দেবে। তার আগে আগামী ৮ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।’
ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে যে আইনসভা গঠিত হবে সে আইনসভা জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে যে সব সংস্কার করবে তা যেন টেকসই হয়, সে ব্যাপারেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যত ঐকমত্য রয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া জাতীয় ঐকমত্য তৈরি; বিশেষ করে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়ে আগের অবস্থান থেকে অনেক রাজনৈতিক দল সরে আসায় তিনি দলগুলোর প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে কমিশন খুব শিগগিরই সনদ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তৈরি করে সরকারের কাছে দিতে পারবে।’
আলী রীয়াজ বলেন, ‘বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেয়ার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। আজকের আলোচনায় সনদ বাস্তবায়নে ১০৬ অনুচ্ছেদের আওতায় সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে বলে মনে করছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।’
তিনি বলেন, ‘৩০টি রাজনৈতিক দলের তিন চতুর্থাংশ দলের প্রতিনিধির নাম পেয়েছি জুলাই সনদ স্বাক্ষরের জন্য।’
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আজকের আলাপ-আলোচনায় মোটামুটি চূড়ান্ত ঐক্যমতের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গণভোটের যে প্রস্তাব এসেছে সেটা বিগত দিনে আমরাই দিয়েছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনের একই দিন একটা আলাদা ব্যালটে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে।’
বৈঠকের বিরতিতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য গণভোটের বিষয়ে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল একমত। তবে আমরা চাই, গণভোট নির্বাচনের আগেই হোক।’
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, জাতীয় নির্বাচনে কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি না করে নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরে গণভোট হতে পারে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেও হতে পারে। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো বাধা নেই। জনগণকে জটিল অবস্থায় না ফেলে সহজভাবে এগোলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।’ জামায়াতের এ নেতা বলেন, ‘গণভোট হলে এটা কখনো চ্যালেঞ্জ করতে গেলে টিকবে না। পার্লামেন্টে এটাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না।’
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকারকেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে। সেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। এ বিষয়ে বেশিরভাগ দল একমত হয়েছে।’
তিনি বলেন, “ভাষাগত ভিন্নতা বাদ দিলে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে দলগুলো মোটামুটি একমত। যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেবে। এ ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে জনগণ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে।”
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘সরকার তিনটি দলকে গুরুত্ব দেয়। সেই তিন দলকে এক জায়গায় আনা যাচ্ছে না। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং সনদের পক্ষে ভোটগ্রহণ নিয়ে সবাই একমত। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের অনুমোদন দিতে হবে।’
* বিগত গণভোট *
এর আগে বাংলাদেশে ৩ বার গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে ২ বার অনুষ্ঠিত হয় প্রশাসনিক গণভোট এবং একবার অনুষ্ঠিত হয় সাংবিধানিক গণভোট।
প্রথমবার জিয়াউর রহমানের সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আস্থা গণভোট, ১৯৭৭। এরপর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের গণভোট, ১৯৮৫ এবং সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের সাংবিধানিক গণভোট।
* ১৯৭৭ সালের গণভোট *
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালের ২১ মে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি (বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা) জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। ওই গণভোটে ভোটারদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ‘আপনি কি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ঘোষিত নীতিমালা ও কর্মসূচিকে সমর্থন করেন?’
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, মোট ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৮৮ শতাংশ এবং ভোটদাতাদের প্রায় ৯৮.৮৭ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট দেন। তবে বিরোধীরা এ গণভোটকে প্রশাসনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ম পূর্ণ বলে দাবি করে।
জিয়াউর রহমানের জন্য এটি ছিল জনসমর্থন যাচাই-বাছাইয়ের রাজনৈতিক কৌশল, যা তাকে পরবর্তী নির্বাচনী বৈধতা অর্জনে সহায়তা করে।
* ১৯৮৫ সালের গণভোট *
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ, তৎকালীন সামরিক শাসক (জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা) হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়ে। এ গণভোটের উদ্দেশ্য ছিল তার সামরিক শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা অর্জন।
নির্বাচনী কমিশনের তথ্যমতে, ভোটার উপস্থিতি ছিল প্রায় ৭২ শতাংশ এবং ৯৪.৫ শতাংশ ভোটার এরশাদের পক্ষে ভোট দেন। তবে দেশজুড়ে ভোট জালিয়াতি, প্রশাসনিক প্রভাব ও বিরোধী দলের বর্জনের কারণে এ গণভোটের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে এরশাদের শাসন বৈধ করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেন।
* ১৯৯১ সালের গণভোট *
বাংলাদেশের সর্বশেষ গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরের বিষয়ে জনগণের মতামত নেয়া।
ভোটারদের কাছে প্রশ্ন ছিল ‘আপনি কি সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন সম্মত?’
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, প্রায় ৮৪ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহণ করেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৮৮.৫ শতাংশ সংসদীয় ব্যবস্থার পক্ষে ভোট দেন। এ গণভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুনরায় সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নির্ভর সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হয়, যা আজও চলমান।