মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই সংকট আরও বেশি তীব্র। ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্ন সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটি প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততার বিস্তারসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, যা মানুষের জীবন, সম্পদ এবং দেশের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য মারাত্মক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্রুত তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা বন্যা এবং খরার মতো বিপর্যয় বাড়িয়ে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লাখো মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭% এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে, যার ফলে বাস্তুচ্যুত হবে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং খরার প্রভাব সরাসরি কৃষিক্ষেত্রে পড়ছে। কৃষিজমির অবনতি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি। একইসঙ্গে, তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতা, যেমন ডিহাইড্রেশন এবং তাপমাত্রা সম্পর্কিত হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। কৃষিতে মিঠাপানির অভাব এবং লবণাক্ততার কারণে ধান উৎপাদন প্রতি বছরে কমে যাচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন ১০-১৫% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের বাস্তুচ্যুত হয়। এই পরিস্থিতি গ্রামীণ থেকে শহরে জনসংখ্যা চাপ বাড়িয়ে দেয়, যা নগরায়ণের সমস্যাকে তীব্র করে।
বাংলাদেশ জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ঘঅচ) কৌশল গ্রহণ করবে। এই পরিকল্পনা কৃষি, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস এবং পুনর্বাসনে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। এছাড়াও, ২০০৯ সালে গৃহীত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (ইঈঈঝঅচ) জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এছাড়া বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (ইঈঈঞঋ) গঠন করে নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন, বনায়ন কর্মসূচি, সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন, এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্যারিস চুক্তি এবং অন্যান্য জলবায়ু আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে চাপ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক কারণেও বাংলাদেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
তবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব। বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং তরুণ প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করাও অত্যন্ত জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে গভীরভাবে অনুভূত হলেও, এর মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে এই লড়াই আরও কার্যকর করতে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার শক্তিশালী ভিত্তি।
স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর সহযোগিতা এবং টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এ লড়াই শুধু বাংলাদেশের নয় বরং বৈশ্বিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।
মালিহা মেহনাজ
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
সোমবার, ০৬ জানুয়ারী ২০২৫
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এই সংকট আরও বেশি তীব্র। ভৌগোলিক অবস্থান, নিম্ন সমুদ্রপৃষ্ঠ এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশটি প্রতিবছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততার বিস্তারসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, যা মানুষের জীবন, সম্পদ এবং দেশের অর্থনীতির ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ইতোমধ্যে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য মারাত্মক। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্রুত তাপমাত্রা বৃদ্ধি। তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা বন্যা এবং খরার মতো বিপর্যয় বাড়িয়ে তুলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের লাখো মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। ২০৫০ সালের মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭% এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে, যার ফলে বাস্তুচ্যুত হবে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং খরার প্রভাব সরাসরি কৃষিক্ষেত্রে পড়ছে। কৃষিজমির অবনতি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি। একইসঙ্গে, তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতা, যেমন ডিহাইড্রেশন এবং তাপমাত্রা সম্পর্কিত হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। কৃষিতে মিঠাপানির অভাব এবং লবণাক্ততার কারণে ধান উৎপাদন প্রতি বছরে কমে যাচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ধান উৎপাদন ১০-১৫% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের বাস্তুচ্যুত হয়। এই পরিস্থিতি গ্রামীণ থেকে শহরে জনসংখ্যা চাপ বাড়িয়ে দেয়, যা নগরায়ণের সমস্যাকে তীব্র করে।
বাংলাদেশ জলবায়ু সহনশীল ভবিষ্যতের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (ঘঅচ) কৌশল গ্রহণ করবে। এই পরিকল্পনা কৃষি, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস এবং পুনর্বাসনে বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছে। এছাড়াও, ২০০৯ সালে গৃহীত বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান (ইঈঈঝঅচ) জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। এছাড়া বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (ইঈঈঞঋ) গঠন করে নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন, বনায়ন কর্মসূচি, সাইক্লোন শেল্টার স্থাপন, এবং জলবায়ু সহনশীল কৃষি প্রযুক্তি উন্নয়নসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্যারিস চুক্তি এবং অন্যান্য জলবায়ু আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নত দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে চাপ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাব উন্নয়নকে ব্যাহত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক কারণেও বাংলাদেশকে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
তবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব। বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং তরুণ প্রজন্মকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করাও অত্যন্ত জরুরি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে গভীরভাবে অনুভূত হলেও, এর মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে এই লড়াই আরও কার্যকর করতে প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার শক্তিশালী ভিত্তি।
স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর সহযোগিতা এবং টেকসই উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান সম্ভব। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এ লড়াই শুধু বাংলাদেশের নয় বরং বৈশ্বিক অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য।
মালিহা মেহনাজ
শিক্ষার্থী
শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিউট
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা