মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
মানুষের জীবনধারণের জন্য যে কয়টি উপাদান অপরিহার্য, তার মধ্যে পানি অন্যতম। পানি ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। মানুষ খাদ্য ছাড়া কিছুদিন টিকে থাকতে পারে, কিন্তু পানি ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই যুগে যুগে বলা হয়েছে, পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু এই জীবনদায়ী উপাদান আজ ভয়াবহ সংকটে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার করছে। যে পৃথিবী একসময় নদী, হ্রদ, খাল-বিল ও ঝরনার প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল, আজ সেখানে পানির সংকট মানবসভ্যতার টিকে থাকার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের প্রসার, নদী-নালা ভরাট ও দখল, দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা-সব মিলিয়ে সুপেয় পানির সংকট দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশও এই সংকট থেকে রেহাই পায়নি। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি।
বাংলাদেশে পানির বেশির ভাগ চাহিদা মেটানো হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। প্রায় ৮০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে, যা খাবার পানি, রান্না, গোসল থেকে শুরু করে কৃষি ও সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে এর ফলাফল ভয়াবহ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরকে উদাহরণ হিসেবে ধরলে দেখা যায়, এখানে প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে এক মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, তা চলতে থাকলে একসময় গভীর নলকূপ থেকেও আর পানি উঠবে না।
পানির সংকট শুধু প্রাপ্যতার নয়, এটি গুণগত মানের সংকটও। যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তার বড় অংশই নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ডব্লিউএইচওর মানদ-ে দেশের প্রায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। গৃহস্থালি পর্যায়ে এই হার ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী উৎসে আর্সেনিকের হার ১১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং গৃহস্থালি পর্যায়ে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর ফলে অন্তত এক কোটি ৭৫ লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানির সংস্পর্শে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশ মারাত্মক পানিসংকটে রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ সুপেয় পানির সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা, নদী দখল ও দূষণ-সব মিলিয়ে এশিয়ার এই অঞ্চল এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলসংকটের এলাকায় পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী শতাব্দীতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হবে পানির জন্য।
সমাধানের পথ রয়েছে। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নগরায়ণের কারণে ভরাট জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রতিটি গ্রাম ও শহরে বড় জলাশয়, পুকুর, খাল তৈরি করতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত থাকে। দ্বিতীয়ত, নদী-নালা খনন ও দখলমুক্ত করতে হবে।
এছাড়া আর্সেনিক ও লবণাক্ততা দূর করতে আধুনিক ফিল্টার প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও প্রয়োজন। সীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টন ন্যায্যভাবে সমাধান করতে হবে। নদীর পানি কেবল এক দেশের সম্পদ নয়, এটি সবার।
পানির সংকট আজ শুধুই পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। পানি ছাড়া জীবন নেই। সুপেয় পানি নিশ্চিত করা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এখনই উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। পানি অপচয় মানে জীবন অপচয়। নদী-নালা খনন, বড় জলাশয় তৈরি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পানির অপচয় রোধ-এগুলো এখনই প্রয়োজন, নইলে আমরা ভয়াবহ পানিসংকটে পড়ব, যা খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সভ্যতাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।
শাকিলা খাতুন
তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া।
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন
রোববার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
মানুষের জীবনধারণের জন্য যে কয়টি উপাদান অপরিহার্য, তার মধ্যে পানি অন্যতম। পানি ছাড়া জীবন কল্পনাই করা যায় না। মানুষ খাদ্য ছাড়া কিছুদিন টিকে থাকতে পারে, কিন্তু পানি ছাড়া একদিনও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই যুগে যুগে বলা হয়েছে, পানির অপর নাম জীবন। কিন্তু এই জীবনদায়ী উপাদান আজ ভয়াবহ সংকটে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার করছে। যে পৃথিবী একসময় নদী, হ্রদ, খাল-বিল ও ঝরনার প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল, আজ সেখানে পানির সংকট মানবসভ্যতার টিকে থাকার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়নের প্রসার, নদী-নালা ভরাট ও দখল, দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহার, আর্সেনিক ও লবণাক্ততা-সব মিলিয়ে সুপেয় পানির সংকট দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশও এই সংকট থেকে রেহাই পায়নি। ভৌগোলিক অবস্থান ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশ এখন বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি।
বাংলাদেশে পানির বেশির ভাগ চাহিদা মেটানো হয় ভূগর্ভস্থ পানি থেকে। প্রায় ৮০ শতাংশ পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে, যা খাবার পানি, রান্না, গোসল থেকে শুরু করে কৃষি ও সেচের কাজে ব্যবহৃত হয়। তবে এর ফলাফল ভয়াবহ। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরকে উদাহরণ হিসেবে ধরলে দেখা যায়, এখানে প্রতিদিন কোটি কোটি লিটার পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর গড়ে এক মিটার করে নিচে নেমে যাচ্ছে। যে হারে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে, তা চলতে থাকলে একসময় গভীর নলকূপ থেকেও আর পানি উঠবে না।
পানির সংকট শুধু প্রাপ্যতার নয়, এটি গুণগত মানের সংকটও। যে পানি পাওয়া যাচ্ছে, তার বড় অংশই নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুযায়ী, ডব্লিউএইচওর মানদ-ে দেশের প্রায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ পানিতে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। গৃহস্থালি পর্যায়ে এই হার ১৬ দশমিক ৭ শতাংশ। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী উৎসে আর্সেনিকের হার ১১ দশমিক ৮ শতাংশ এবং গৃহস্থালি পর্যায়ে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। এর ফলে অন্তত এক কোটি ৭৫ লাখ মানুষ আর্সেনিক দূষিত পানির সংস্পর্শে রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতিও ভিন্ন নয়। এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশ মারাত্মক পানিসংকটে রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশ সুপেয় পানির সংকটে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা, নদী দখল ও দূষণ-সব মিলিয়ে এশিয়ার এই অঞ্চল এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলসংকটের এলাকায় পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী শতাব্দীতে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হবে পানির জন্য।
সমাধানের পথ রয়েছে। প্রথমত, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে, বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। নগরায়ণের কারণে ভরাট জলাশয়গুলো পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রতিটি গ্রাম ও শহরে বড় জলাশয়, পুকুর, খাল তৈরি করতে হবে, যাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষিত থাকে। দ্বিতীয়ত, নদী-নালা খনন ও দখলমুক্ত করতে হবে।
এছাড়া আর্সেনিক ও লবণাক্ততা দূর করতে আধুনিক ফিল্টার প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও প্রয়োজন। সীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টন ন্যায্যভাবে সমাধান করতে হবে। নদীর পানি কেবল এক দেশের সম্পদ নয়, এটি সবার।
পানির সংকট আজ শুধুই পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। পানি ছাড়া জীবন নেই। সুপেয় পানি নিশ্চিত করা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। এখনই উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। পানি অপচয় মানে জীবন অপচয়। নদী-নালা খনন, বড় জলাশয় তৈরি, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পানির অপচয় রোধ-এগুলো এখনই প্রয়োজন, নইলে আমরা ভয়াবহ পানিসংকটে পড়ব, যা খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও সভ্যতাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে।
শাকিলা খাতুন
তেকানীচুকাইনগর, সোনাতলা, বগুড়া।