মন্জুর এ খোদা
সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে প্রথাগত ধারণা রয়েছে যে শুধুমাত্র গিটে গিটে ব্যথা বোধ করা বাত ব্যথার একমাত্র লক্ষণ; এবং আরেকটি বদ্ধমূল ধারণা-এই বাতরোগ শুধুমাত্র প্রবীণ বা বয়স্কদের হয়ে থাকে, অন্য কারো নয়। এই লেখায় শিশু থেকে প্রৌঢ় সব বয়সে বাত ব্যথার বয়সভিত্তিক কারণ বিশ্লেষণ, ব্যথাসহ আরও যে লক্ষ্মণাদি হয়ে থাকে সেগুলো উল্লেখপূর্বক এসব জটিল রোগের আধুনিক চিকিৎসা ও সেগুলোর প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা থাকবে।
প্রথমে এটা জানা প্রয়োজন যে বাত বিজ্ঞান (রিউমাটোলজি) এর ভিত্তি কী? এক কথায় বললে, এটি কঠিন শোনাবে তাই একটি সাধারণ বিষয় আগে বলে নেই, মানবশরীরে বহিরাগত কোন রোগ-জীবাণু যেমন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে, শরীরের প্রহরীকোষ বা বিপদ সংকেত ব্যবস্থা সেটি টের পায় এবং এসবের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে রক্তে ‘এন্টিবডি’ নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে যা এসব জীবাণু কোষ বা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে আমাদের এসব ইনফেকশন বা সংক্রামক ব্যধি থেকে রক্ষা করে। জীবাণু প্রতিরোধী এসব উপকারী এন্টিবডি শুধুমাত্র শরীরে প্রবেশকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল থাকার কথা। কিন্তু জিনগত ত্রুটির কারণে বা শরীরে কোন দীর্ঘমেয়াদি দূষক বা জীবাণু প্রবেশের ফলে উপকারী ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ধরনের এন্টিবডিগুলো শরীরের সুস্থ কোষ যেমন, অস্থিসন্ধি, মেরুদণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু, লালা গ্রন্থি, ফুসফুস, কিডনি, ত্বক এমনকি মস্তিষ্ক ও চোখ আক্রমণ করে এবং প্রদাহ তৈরি করে। এই প্রদাহের ফলে মূলত গিটে ব্যথাসহ অন্যান্য লক্ষ্মণ তৈরি হয়। এর ফলে অস্থিসন্ধির নড়ন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেখানে আনুষাঙ্গিক গাঠনিক উপাদান হিসেবে যে লিগামেন্টগুলো থাকে সেগুলোতেও প্রদাহ ছড়িয়ে পড়ে। এরূপ ঘটনা কেবলে অটো ইমিউন রোগ বা শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজের বিরুদ্ধে নিজেই কাজ করে ধ্বংসলীলা ঘটাচ্ছে এবং অঙ্গসমূহে অতিরিক্ত প্রদাহ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ব্যথা সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ বাড়িয়ে দিয়ে শারীরিক কষ্ট বা লক্ষ্মণ সৃষ্টি করে।
অটো ইমিউন কারণে সৃষ্ট বাতরোগগুলোর নাম, বয়স ও লক্ষণ জেনে নেই :
গেঁটেবাত বা রিউমাটয়েড আর্র্থ্রাইটিস : সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাত-পা-কবজি বা গোড়ালি সন্ধিগুলোর ব্যথা থাকে জোড়ায় জোড়ায়, ধীরে ধীরে হাত-পা নড়াচড়া করে সচল করলে ব্যথা হ্রাস পায়। এছাড়া হাত-পা এ ঝিম-ঝিম অনুভূতি হতে পারে, চোখে প্রদাহ বা লাল হতে পারে, এমনকি করোনারি প্রদাহের ফলে হৃদরোগ পর্যন্ত হতে পারে। এই রিউমাটয়েড বাত কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী থেকে মধ্য বয়স বা বৃদ্ধ বয়স যেকোন বয়সে হতে পারে। আবার কৈশোরে এই বাত হলে একে বলে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস।
রিউমাটিক জ্বর বা বাত জ্বর : শিশু বয়সে সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা বা গলা ব্যথার ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন থেকে ভুলভাবে এন্টিবডি তৈরি হয়ে যে জ্বর হয় এবং এর ফলে বিশেষ ধরনের যে গিটে ব্যথা হয় তাকে বলে বাত জ্বর। এটি রিউমাটয়েড বা গেঁটে বাতের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর ফলে হার্ট ভাল্বের সমস্যা বা কিডনি জটিলতা হতে পারে।
এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস : কোমরের মেরুদণ্ডের প্রদাহজনিত বিশেষ বাত বা কটি বাত। এটি যুবক বয়সে ২০-৩০ বছর বয়সি পুরুষদের কোমর ব্যথার কারণ যা বিশ্রাম নিলে বেড়ে যায় এবং পরিশ্রম করলে হ্রাস পায়।
দীর্ঘমেয়াদি আমাশয় বা যৌনবাহিত ইনফেকশন জনিত বাত : পরিপাকনালির প্রদাহের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া বা ইনফেকশনজনিত আমাশয়ের পরে এক ধরনের বাত সৃষ্টি হয়। আবার যৌনবাহিত ইনফেকশন যেমন, গনোরিয়ার পর একই ধরনের গিটে ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
চর্মরোগজনিত বাত : ত্বকের বিশেষ প্রদাহ বা চুলকানিজনিত রোগ সোরিয়াসিসের ফলেও বাত সৃষ্টি হয়ে গিটে ব্যথা হতে পারে।
লুপাস বা নারীদের বিশেষ বাত : গিটে ব্যথাসহ সূর্যালোকে বাইরে গেলে মুখে-গালে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, মুখের ঘা, চুল পড়া, বারবার সন্তান গর্ভধারণ হলেও দু-তিন মাস পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া, কিডনির সমস্যা এসব বিচিত্র লক্ষ্মণ নিয়ে নারীদের যে বাত হয়, তাকে লুপাস বলে।
এন্টি ফসফোলিপিড সিনড্রোম : বারবার সন্তান গর্ভধারণ হলেও দু-তিন মাস পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া, পা এর ত্বকে বিশেষ ধরনের ঘাসহ অতিরিক্ত রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
সিস্টেমিক সেক্লরোসিস : হাত-পা-মুখের ত্বক টান টান হয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া, ফুসফুসের প্রদাহ হয়ে করোনার মতো ফুসফুস শক্ত হয়ে যাওয়া, কিডনি সমস্যাসহ যে বাত হয় তাকে সিস্টেমিক সেক্লরোসিস বলে।
জোগ্রেন সিনড্রোম : মুখের লালা শুকিয়ে যাওয়া, চোখের পানি-ঘাম এসব প্রাকৃতিক তরল শুকিয়ে গিয়ে শুষ্কতাজনিত যে বাত হয় তাকে বলে জোগ্রেন রোগ।
ডার্মাটোমায়োসাইটিস বা পলিমায়োসাইটিস : ত্বক বা মাংসপেশির প্রদাহ হয়ে ত্বকে বিশেষ ঘা দেখা যায় এবং শরীরের পেশিতে ব্যথা হয়ে এই বাত হয়।
অটো ইমিউন কারণ ছাড়াও শরীরের বিশেষ পুষ্টি উপাদান যেমন ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হয়ে হাড় ক্ষয় হয়ে বাতব্যথা সৃষ্টি হতে পারে যেমন, অস্টিওপরোসিস। এ কারণে শুধু যে ব্যথা হচ্ছে তা নয় হাত-পা ঝিম-ঝিম করা, জ্বালা পোড়া হওয়া, নিদ্রাহীনতা এমনকি স্মৃতিভ্রষ্ম পর্যন্ত হতে পারে।
আবার বিশেষ ধরনের বর্জ্য পদার্থ যেমন ইউরিক এসিড শরীর থেকে নিষ্কাশন না হতে পারার জন্য বর্জ্য পদার্থ অস্থিসন্ধিতে জমা হয়ে বাতের কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে খাদ্যভ্যাসও দায়ী যেমন, অতিরিক্ত ডাল, বিচি জাতীয় খাবার, সামুদ্রিক খাবার, গরুর মাংস গ্রহণের ফলে ইউরিক এসিড সৃষ্টি হয়। যেমন: গাউট।
আবার, সাধারণভাবে মেরুদণ্ডসহ যেকোন অস্থিসন্ধিতে আঘাত বা অতিরিক্ত ভারত্তোলন বা অবস্থহানগত ত্রুটির জন্য স্বাভাবিক নড়াচড়া বাধাগ্রস্ত হয়ে, দুই হাড়ের মধ্যবর্তী নরম ডিস্ক সরে গিয়ে বা লিগামেন্টে প্রদাহ সৃষ্টি হয়েও বাত ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, পিএলআইডি (সায়াটিকা) বা টেনডিনাইটিস বা বার্সাইটিস। এর ফলে পায়ের রগ বা স্নায়ু সমস্যা হতে পারে যেমন, রগে টান অনুভূত হওয়া, ঝিম ঝিম করা বা পিন ফোটানোর মতো অনুভূতি।
আবার, বয়সজনিত কারণে বা অতিরিক্ত স্থুলতা বা ওজনের কারণে দুটি হাড়ের মধ্যবর্তী আঠালো তরল শুকিয়ে গিয়ে হাড়ের মধ্য ঘর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং হাড়ের উপরে থাকা নমনীয় তরুণাস্থি ক্ষয় হয়ে যে বাত হয় তাকে বলে অস্টিও আর্থ্রাইটিস।
আবার, ডায়াবেটিস জনিত কারণে কাঁধের বাত ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। তাহলে এটা পরিষ্কার যে যেকোন বয়সেই বাত রোগ হতে পারে এবং গিটের ব্যথা ছাড়াও হরেক রকমের কষ্টদায়ক লক্ষ্মণ হতে পারে এসব রোগে।
বাত রোগের আধুনিক চিকিৎসা : বাত রোগের চিকিৎসা প্রথাগতভাবে স্টেরয়েড ধরনের ব্যথানাশক প্রয়োগ আর মুখে খাওয়ার সাধারণ প্রদাহ বিনাশি বড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে যেমন রক্ত পরীক্ষা ও ডিএনএ পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এসব রোগ এখন আর অজানা থাকছে না, সম্পূর্ণ ডায়াগনসিস করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি এখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগ লক্ষ্মণ প্রশমিত করা সম্ভব। এছাড়াও সহযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপি (হস্তগত ব্যায়াম ও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত মেশিনের মাধ্যমে আক্রান্ত অস্থি সন্ধিকে নমনীয় করা হয়) প্রয়োগ করে বাত উপশম করা যায়। পাশাপাশি বাত প্রতিরোধে খাদ্যাভাসের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে যেমন, হলুদ বা কিউকারমিন; আদা; গ্রিন টি বা ক্যাটেকিন; আনারস; চেরিফল বা এর রস; টক ফল মাল্টা, কমলা, লেবু; যেকোন বেরি যেমন, স্ট্রবেরি, ব্লু-বেরি, মালবেরি; গাজর; অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল; মোটা শস্য বা হোল গ্রেইন বা ওটস। এগুলো বাত বা প্রদাহ প্রতিরোধী খাবার হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত।
আধুনিক চিকিৎসা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে:
বায়োলজিক চিকিৎসা : সাধারণ বাংলায় বললে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এর অর্থ যেসব এন্টিবডি রক্তে বেশি মাত্রায় থাকার ফলে অটোইমিউন বাত রোগ হচ্ছে সেসব এন্টিবডির বিরুদ্ধে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করে রক্তে থাকা ক্ষতিকর বাত সৃষ্টিকারী এন্টিবডি ধ্বংস করা হচ্ছে। এগুলো বিশেষ ধরনের ব্যথামুক্ত ইনজেকশন যা ত্বকের নিচে বা শিরা পথে দিলে রোগ উপশম হচ্ছে।
পিআরপি : আঘাতজনিত বা বয়সজনিত অস্টিও আর্থ্রাইটিস এবং ডায়াবেটিসজনিত কাঁধের ব্যথায় যুগান্তকারী চিকিৎসা পিআরপি। রোগির রক্ত থেকে ছাঁকনকৃত রক্তের হলুদ অংশের মধ্যে যে অনুচক্রিকা থাকে সেটিকে পৃথক করে, এই হলুদ তরলটি আক্রান্ত অস্থিসন্ধির মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। রক্তের অনুচক্রিকার মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান বা গ্রোথ ফ্যাক্টর ক্ষয় হয়ে যাওয়া অস্থিসন্ধির পুনর্জাগরণের খাদ্য হিসেবে কাজ করে ব্যথা নিরাময় করে।
স্টেমসেল থেরাপি : ক্ষয়িষ্ণু অস্থিসন্ধিকে আবার পুনর্জাগরণী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচল করা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব গবেষণা স্টেমসেলকে ঘিরে। রোগীর অস্থিমজ্জা বা চর্বির মধ্যে জমে থাকা স্টেম কোষ বা মাতৃ কোষগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাঁকন করে সেই বিশুদ্ধ স্টেমসেল তরল আক্রান্ত অস্থিসন্ধি বা অঙ্গে প্রতিস্থাপন করলে সেই অঙ্গে নতুনভাবে কোষ বিভাজনের ফলে আক্রান্ত অস্থিসন্ধি পুনরায় নড়ন ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে।
হায়ালুরনিক জেল চিকিৎসা : দুটো হাড়ের ঘর্ষণ প্রতিরোধী আঠালো তরল হলো হায়ালুরনিক এসিড। প্রাকৃতিক তরল শুকিয়ে গেলে যে বাত ব্যথা হয়, তা উপশমের জন্য, সেখানে পুনরায় সেই হায়ালুরনিক জেল প্রতিস্থাপন করা হয়, এর ফলে আন্তঃহাড় ঘর্ষণ হয় না, এতে ব্যথা নিরাময় হয়।
প্রো-বায়োটিক থেরাপি : বলা হয়ে থাকে, সচল অটোইমিউন বাতের উৎস পরিপাকনালিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য আর উপকারী ব্যাকটেরিয়া হ্রাস পাওয়া। তাই, উপকারী ব্যাকটেরিয়া খাদ্যে গ্রহণের মাধ্যমে রক্তে এন্টিবডি তৈরির প্রবণতা কমানো যায়।
এই সমস্ত চিকিৎসাগুলো কোনটি কোন ধরনের রোগীর জন্য প্রযোজ্য তা রোগের অবস্থা, জটিলতা ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করবেন একজন ইন্টারভেনশনাল রিউমাটোলজিস্ট। তাই বিচলিত না হয়ে বাত রোগের যেকোন লক্ষ্মণ অনুভব করলেই পরামর্শ নিন একজন রেজিস্টার্ড বাত ব্যথা বিশেষজ্ঞের।
[লেখক: ইন্টার্নাল মেডিসিন ও রিউমাটোলজি (বাত) বিশেষজ্ঞ]
মন্জুর এ খোদা
বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৩
সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে প্রথাগত ধারণা রয়েছে যে শুধুমাত্র গিটে গিটে ব্যথা বোধ করা বাত ব্যথার একমাত্র লক্ষণ; এবং আরেকটি বদ্ধমূল ধারণা-এই বাতরোগ শুধুমাত্র প্রবীণ বা বয়স্কদের হয়ে থাকে, অন্য কারো নয়। এই লেখায় শিশু থেকে প্রৌঢ় সব বয়সে বাত ব্যথার বয়সভিত্তিক কারণ বিশ্লেষণ, ব্যথাসহ আরও যে লক্ষ্মণাদি হয়ে থাকে সেগুলো উল্লেখপূর্বক এসব জটিল রোগের আধুনিক চিকিৎসা ও সেগুলোর প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়ার চেষ্টা থাকবে।
প্রথমে এটা জানা প্রয়োজন যে বাত বিজ্ঞান (রিউমাটোলজি) এর ভিত্তি কী? এক কথায় বললে, এটি কঠিন শোনাবে তাই একটি সাধারণ বিষয় আগে বলে নেই, মানবশরীরে বহিরাগত কোন রোগ-জীবাণু যেমন, ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করলে, শরীরের প্রহরীকোষ বা বিপদ সংকেত ব্যবস্থা সেটি টের পায় এবং এসবের বিরুদ্ধে রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে রক্তে ‘এন্টিবডি’ নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে যা এসব জীবাণু কোষ বা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে আমাদের এসব ইনফেকশন বা সংক্রামক ব্যধি থেকে রক্ষা করে। জীবাণু প্রতিরোধী এসব উপকারী এন্টিবডি শুধুমাত্র শরীরে প্রবেশকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল থাকার কথা। কিন্তু জিনগত ত্রুটির কারণে বা শরীরে কোন দীর্ঘমেয়াদি দূষক বা জীবাণু প্রবেশের ফলে উপকারী ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই ধরনের এন্টিবডিগুলো শরীরের সুস্থ কোষ যেমন, অস্থিসন্ধি, মেরুদণ্ড, রক্তনালি, স্নায়ু, লালা গ্রন্থি, ফুসফুস, কিডনি, ত্বক এমনকি মস্তিষ্ক ও চোখ আক্রমণ করে এবং প্রদাহ তৈরি করে। এই প্রদাহের ফলে মূলত গিটে ব্যথাসহ অন্যান্য লক্ষ্মণ তৈরি হয়। এর ফলে অস্থিসন্ধির নড়ন ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং সেখানে আনুষাঙ্গিক গাঠনিক উপাদান হিসেবে যে লিগামেন্টগুলো থাকে সেগুলোতেও প্রদাহ ছড়িয়ে পড়ে। এরূপ ঘটনা কেবলে অটো ইমিউন রোগ বা শরীরের ইমিউন সিস্টেম নিজের বিরুদ্ধে নিজেই কাজ করে ধ্বংসলীলা ঘটাচ্ছে এবং অঙ্গসমূহে অতিরিক্ত প্রদাহ সৃষ্টি করার মাধ্যমে ব্যথা সৃষ্টিকারী রাসায়নিক পদার্থের ক্ষরণ বাড়িয়ে দিয়ে শারীরিক কষ্ট বা লক্ষ্মণ সৃষ্টি করে।
অটো ইমিউন কারণে সৃষ্ট বাতরোগগুলোর নাম, বয়স ও লক্ষণ জেনে নেই :
গেঁটেবাত বা রিউমাটয়েড আর্র্থ্রাইটিস : সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর হাত-পা-কবজি বা গোড়ালি সন্ধিগুলোর ব্যথা থাকে জোড়ায় জোড়ায়, ধীরে ধীরে হাত-পা নড়াচড়া করে সচল করলে ব্যথা হ্রাস পায়। এছাড়া হাত-পা এ ঝিম-ঝিম অনুভূতি হতে পারে, চোখে প্রদাহ বা লাল হতে পারে, এমনকি করোনারি প্রদাহের ফলে হৃদরোগ পর্যন্ত হতে পারে। এই রিউমাটয়েড বাত কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী থেকে মধ্য বয়স বা বৃদ্ধ বয়স যেকোন বয়সে হতে পারে। আবার কৈশোরে এই বাত হলে একে বলে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস।
রিউমাটিক জ্বর বা বাত জ্বর : শিশু বয়সে সাধারণ ঠাণ্ডা লাগা বা গলা ব্যথার ব্যাকটেরিয়া ইনফেকশন থেকে ভুলভাবে এন্টিবডি তৈরি হয়ে যে জ্বর হয় এবং এর ফলে বিশেষ ধরনের যে গিটে ব্যথা হয় তাকে বলে বাত জ্বর। এটি রিউমাটয়েড বা গেঁটে বাতের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এর ফলে হার্ট ভাল্বের সমস্যা বা কিডনি জটিলতা হতে পারে।
এঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস : কোমরের মেরুদণ্ডের প্রদাহজনিত বিশেষ বাত বা কটি বাত। এটি যুবক বয়সে ২০-৩০ বছর বয়সি পুরুষদের কোমর ব্যথার কারণ যা বিশ্রাম নিলে বেড়ে যায় এবং পরিশ্রম করলে হ্রাস পায়।
দীর্ঘমেয়াদি আমাশয় বা যৌনবাহিত ইনফেকশন জনিত বাত : পরিপাকনালির প্রদাহের ফলে দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া বা ইনফেকশনজনিত আমাশয়ের পরে এক ধরনের বাত সৃষ্টি হয়। আবার যৌনবাহিত ইনফেকশন যেমন, গনোরিয়ার পর একই ধরনের গিটে ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে।
চর্মরোগজনিত বাত : ত্বকের বিশেষ প্রদাহ বা চুলকানিজনিত রোগ সোরিয়াসিসের ফলেও বাত সৃষ্টি হয়ে গিটে ব্যথা হতে পারে।
লুপাস বা নারীদের বিশেষ বাত : গিটে ব্যথাসহ সূর্যালোকে বাইরে গেলে মুখে-গালে ত্বক লাল হয়ে যাওয়া, মুখের ঘা, চুল পড়া, বারবার সন্তান গর্ভধারণ হলেও দু-তিন মাস পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া, কিডনির সমস্যা এসব বিচিত্র লক্ষ্মণ নিয়ে নারীদের যে বাত হয়, তাকে লুপাস বলে।
এন্টি ফসফোলিপিড সিনড্রোম : বারবার সন্তান গর্ভধারণ হলেও দু-তিন মাস পর গর্ভপাত হয়ে যাওয়া, পা এর ত্বকে বিশেষ ধরনের ঘাসহ অতিরিক্ত রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
সিস্টেমিক সেক্লরোসিস : হাত-পা-মুখের ত্বক টান টান হয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া, ফুসফুসের প্রদাহ হয়ে করোনার মতো ফুসফুস শক্ত হয়ে যাওয়া, কিডনি সমস্যাসহ যে বাত হয় তাকে সিস্টেমিক সেক্লরোসিস বলে।
জোগ্রেন সিনড্রোম : মুখের লালা শুকিয়ে যাওয়া, চোখের পানি-ঘাম এসব প্রাকৃতিক তরল শুকিয়ে গিয়ে শুষ্কতাজনিত যে বাত হয় তাকে বলে জোগ্রেন রোগ।
ডার্মাটোমায়োসাইটিস বা পলিমায়োসাইটিস : ত্বক বা মাংসপেশির প্রদাহ হয়ে ত্বকে বিশেষ ঘা দেখা যায় এবং শরীরের পেশিতে ব্যথা হয়ে এই বাত হয়।
অটো ইমিউন কারণ ছাড়াও শরীরের বিশেষ পুষ্টি উপাদান যেমন ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হয়ে হাড় ক্ষয় হয়ে বাতব্যথা সৃষ্টি হতে পারে যেমন, অস্টিওপরোসিস। এ কারণে শুধু যে ব্যথা হচ্ছে তা নয় হাত-পা ঝিম-ঝিম করা, জ্বালা পোড়া হওয়া, নিদ্রাহীনতা এমনকি স্মৃতিভ্রষ্ম পর্যন্ত হতে পারে।
আবার বিশেষ ধরনের বর্জ্য পদার্থ যেমন ইউরিক এসিড শরীর থেকে নিষ্কাশন না হতে পারার জন্য বর্জ্য পদার্থ অস্থিসন্ধিতে জমা হয়ে বাতের কারণ হতে পারে। এক্ষেত্রে খাদ্যভ্যাসও দায়ী যেমন, অতিরিক্ত ডাল, বিচি জাতীয় খাবার, সামুদ্রিক খাবার, গরুর মাংস গ্রহণের ফলে ইউরিক এসিড সৃষ্টি হয়। যেমন: গাউট।
আবার, সাধারণভাবে মেরুদণ্ডসহ যেকোন অস্থিসন্ধিতে আঘাত বা অতিরিক্ত ভারত্তোলন বা অবস্থহানগত ত্রুটির জন্য স্বাভাবিক নড়াচড়া বাধাগ্রস্ত হয়ে, দুই হাড়ের মধ্যবর্তী নরম ডিস্ক সরে গিয়ে বা লিগামেন্টে প্রদাহ সৃষ্টি হয়েও বাত ব্যথা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন, পিএলআইডি (সায়াটিকা) বা টেনডিনাইটিস বা বার্সাইটিস। এর ফলে পায়ের রগ বা স্নায়ু সমস্যা হতে পারে যেমন, রগে টান অনুভূত হওয়া, ঝিম ঝিম করা বা পিন ফোটানোর মতো অনুভূতি।
আবার, বয়সজনিত কারণে বা অতিরিক্ত স্থুলতা বা ওজনের কারণে দুটি হাড়ের মধ্যবর্তী আঠালো তরল শুকিয়ে গিয়ে হাড়ের মধ্য ঘর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং হাড়ের উপরে থাকা নমনীয় তরুণাস্থি ক্ষয় হয়ে যে বাত হয় তাকে বলে অস্টিও আর্থ্রাইটিস।
আবার, ডায়াবেটিস জনিত কারণে কাঁধের বাত ফ্রোজেন শোল্ডার হতে পারে। তাহলে এটা পরিষ্কার যে যেকোন বয়সেই বাত রোগ হতে পারে এবং গিটের ব্যথা ছাড়াও হরেক রকমের কষ্টদায়ক লক্ষ্মণ হতে পারে এসব রোগে।
বাত রোগের আধুনিক চিকিৎসা : বাত রোগের চিকিৎসা প্রথাগতভাবে স্টেরয়েড ধরনের ব্যথানাশক প্রয়োগ আর মুখে খাওয়ার সাধারণ প্রদাহ বিনাশি বড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আধুনিক রোগ নির্ণয় পদ্ধতি প্রয়োগ করে যেমন রক্ত পরীক্ষা ও ডিএনএ পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এসব রোগ এখন আর অজানা থাকছে না, সম্পূর্ণ ডায়াগনসিস করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি এখন আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার মাধ্যমে রোগ লক্ষ্মণ প্রশমিত করা সম্ভব। এছাড়াও সহযোগী চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ফিজিওথেরাপি (হস্তগত ব্যায়াম ও বিভিন্ন প্রযুক্তিগত মেশিনের মাধ্যমে আক্রান্ত অস্থি সন্ধিকে নমনীয় করা হয়) প্রয়োগ করে বাত উপশম করা যায়। পাশাপাশি বাত প্রতিরোধে খাদ্যাভাসের একটি বিশাল ভূমিকা রয়েছে যেমন, হলুদ বা কিউকারমিন; আদা; গ্রিন টি বা ক্যাটেকিন; আনারস; চেরিফল বা এর রস; টক ফল মাল্টা, কমলা, লেবু; যেকোন বেরি যেমন, স্ট্রবেরি, ব্লু-বেরি, মালবেরি; গাজর; অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল; মোটা শস্য বা হোল গ্রেইন বা ওটস। এগুলো বাত বা প্রদাহ প্রতিরোধী খাবার হিসেবে গবেষণায় প্রমাণিত।
আধুনিক চিকিৎসা বলতে যা বোঝানো হচ্ছে:
বায়োলজিক চিকিৎসা : সাধারণ বাংলায় বললে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এর অর্থ যেসব এন্টিবডি রক্তে বেশি মাত্রায় থাকার ফলে অটোইমিউন বাত রোগ হচ্ছে সেসব এন্টিবডির বিরুদ্ধে মনোক্লোনাল এন্টিবডি প্রয়োগ করে রক্তে থাকা ক্ষতিকর বাত সৃষ্টিকারী এন্টিবডি ধ্বংস করা হচ্ছে। এগুলো বিশেষ ধরনের ব্যথামুক্ত ইনজেকশন যা ত্বকের নিচে বা শিরা পথে দিলে রোগ উপশম হচ্ছে।
পিআরপি : আঘাতজনিত বা বয়সজনিত অস্টিও আর্থ্রাইটিস এবং ডায়াবেটিসজনিত কাঁধের ব্যথায় যুগান্তকারী চিকিৎসা পিআরপি। রোগির রক্ত থেকে ছাঁকনকৃত রক্তের হলুদ অংশের মধ্যে যে অনুচক্রিকা থাকে সেটিকে পৃথক করে, এই হলুদ তরলটি আক্রান্ত অস্থিসন্ধির মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। রক্তের অনুচক্রিকার মধ্যে থাকা পুষ্টি উপাদান বা গ্রোথ ফ্যাক্টর ক্ষয় হয়ে যাওয়া অস্থিসন্ধির পুনর্জাগরণের খাদ্য হিসেবে কাজ করে ব্যথা নিরাময় করে।
স্টেমসেল থেরাপি : ক্ষয়িষ্ণু অস্থিসন্ধিকে আবার পুনর্জাগরণী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সচল করা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব গবেষণা স্টেমসেলকে ঘিরে। রোগীর অস্থিমজ্জা বা চর্বির মধ্যে জমে থাকা স্টেম কোষ বা মাতৃ কোষগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছাঁকন করে সেই বিশুদ্ধ স্টেমসেল তরল আক্রান্ত অস্থিসন্ধি বা অঙ্গে প্রতিস্থাপন করলে সেই অঙ্গে নতুনভাবে কোষ বিভাজনের ফলে আক্রান্ত অস্থিসন্ধি পুনরায় নড়ন ক্ষমতা ফিরে পাচ্ছে।
হায়ালুরনিক জেল চিকিৎসা : দুটো হাড়ের ঘর্ষণ প্রতিরোধী আঠালো তরল হলো হায়ালুরনিক এসিড। প্রাকৃতিক তরল শুকিয়ে গেলে যে বাত ব্যথা হয়, তা উপশমের জন্য, সেখানে পুনরায় সেই হায়ালুরনিক জেল প্রতিস্থাপন করা হয়, এর ফলে আন্তঃহাড় ঘর্ষণ হয় না, এতে ব্যথা নিরাময় হয়।
প্রো-বায়োটিক থেরাপি : বলা হয়ে থাকে, সচল অটোইমিউন বাতের উৎস পরিপাকনালিতে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য আর উপকারী ব্যাকটেরিয়া হ্রাস পাওয়া। তাই, উপকারী ব্যাকটেরিয়া খাদ্যে গ্রহণের মাধ্যমে রক্তে এন্টিবডি তৈরির প্রবণতা কমানো যায়।
এই সমস্ত চিকিৎসাগুলো কোনটি কোন ধরনের রোগীর জন্য প্রযোজ্য তা রোগের অবস্থা, জটিলতা ও অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নির্ধারণ করবেন একজন ইন্টারভেনশনাল রিউমাটোলজিস্ট। তাই বিচলিত না হয়ে বাত রোগের যেকোন লক্ষ্মণ অনুভব করলেই পরামর্শ নিন একজন রেজিস্টার্ড বাত ব্যথা বিশেষজ্ঞের।
[লেখক: ইন্টার্নাল মেডিসিন ও রিউমাটোলজি (বাত) বিশেষজ্ঞ]