alt

মুক্ত আলোচনা

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

কাকলী তালুকদার : শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪

নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে

নাটোর জেলার নাম শুনলেই শুরুতেই মনে আসে নাটোরের কাঁচাগোল্লা ও জীবনানন্দের বনলতা সেনের নাম। কিন্তু নাটোরের জেলা ব্র্যান্ডিং নাম হলো ‘রাজসিক নাটোর।’ এর কারন হলো নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেমন অনেক অনেক বছরের পুরোনো, একই সাথে রাজা রাণীর রাজত্বের ইতিহাস নাটোর শহরের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নাটোরের রাণী অর্ধ বঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানীর রাজত্ব সেই সময়ে এতো বিশালাকার ছিলো যে তার আশেপাশে আর কোন এতো বড় রাজত্ব ছিলো না।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলাটি দেশের বেশ কয়েকটি জেলার কেন্দ্র বিন্দু। এই জেলার ইতিহাস শুধু সমৃদ্ধ নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নাটোর জেলাতে চলনবিল অবস্থিত হওয়াতে বেশ কয়েকটি নদী ও খালবিল এখানে একত্রিত হয়েছে। রাজসিক জেলা নামকরণ সার্থকতা লাভ করেছে অসংখ্য রাজবাড়ী এবং রাজ পরিবারের বিভিন্ন বাসভবন, জমিদারদের বাড়ির অবস্থানের কারনে। নাটোরের উত্তরা গণভবন তেমনই প্রধান একটি রাজবাড়ী। চলববিল এবং এইসব রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে নাটোর জেলা হতে পারে পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাল, বিল, নদী, শত শত বছরের রাজ পরিবারের এলাকা সব মিলিয়ে সম্ভাব্য জিআই পণ্যের একটি জেলা হিসেবে নাটোর জেলার অনেক পণ্যই তালিকায় স্থান করে নিতে পারে।

নাটোর জেলা শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বিখ্যাত নয়। দেশের বিখ্যাত বৃহৎ চলনবিল নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা সংলগ্ন হওয়ার কারনে কৃষি ক্ষেত্র এবং মৎস উৎপাদনে নাটোর জেলা অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে আমাদের দেশের দেশি মাছ, দেশি ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদনের দিক থেকে নাটোর জেলা সুপরিচিত। নাটোরের হালতির বিলকে স্বাদুপানির বা মিঠা পানির মাছের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও চলনবিলে পাওয়া যায় বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন মাছ। যেমন- বোয়াল, টাকি, শোল, মৃগেল, চিংড়ি, টেংরা, কালবাউশ, রিটা, মৌসি, গজার, বৌ, চিতল, মাগুর, কৈ, শিং, সরপুটি, পুঁটি, গুজা, গাগর, বাঘাইর কাঁটা, তিতপুটি এমন সব মাছ যা অন্য অনেক যায়গায় একেবারে নেই বললেই চলে।

নাটোর চলনবিল এলাকাতে অবস্থিত এবং বর্ষার মৌসুমে বন্যার পানিতে এবং বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে ভরা থাকলেও এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো ধান। আউশ, আমন ,বোরো এমন সব বিলুপ্ত প্রায় ধান এখনও নাটোর জেলাতে এবং নাটোর জেলার অধীনে উপজেলা, ইউনিয়ন এবং গ্রামগুলোতে উৎপাদন হয়ে থাকে। ধান ছাড়াও নাটোরে প্রচুর পরিমাণে আখ, গম, ভুট্টা, বিভিন্ন ধরনের ডাল, রসুন, পান, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি শস্য উৎপাদিত হয়। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত হলেও নাটোর জেলা এবং তার আশেপাশের উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন উন্নত মানের আম চাষ হয়। এই পণ্যগুলোর সহজলভ্যতার কারনে পণ্যগুলোকে কেন্দ্র করে নাটোর জেলাতে বেশ কিছু শিল্প কারখানাও গড়ে উঠেছে। এই সব শিল্প কারখানা পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনগনের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

নাটোরের কাঁচাগোল্লা বর্তমানে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে যার সাথে নাটোরের কয়েকশত বছরের পুরোনো ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। আমরা জানি যেকোন জিআই পণ্য মানেই পণ্যটি অসাধারণ ও বিখ্যাত। শুধু তাই নয়, জিআই স্বীকৃতির সাথে সাথে সেই পণ্যের যেমন মর্যাদা বৃদ্ধি পায় একই সাথে সেই পণ্যের বিক্রিও বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও সেই পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল ও এর সাথে জড়িত সকলের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর সবগুলো খাতের উন্নয়নের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক গবেষনা, প্রচার এবং কমার্শিয়ালাইজেশনের জন্য পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন।

নাটোরের কাঁচাগোল্লা ছাড়াও আর কোন কোন পণ্য জিআই হতে পারে সেদিকে চিন্তা করার সময় চলে এসেছে। সেজন্য প্রথমে প্রয়োজন জেলার সম্ভাব্য জিআই পণ্যের তালিকা করা। যেমন-

কুমড়ো বড়ি: নাটোর জেলার একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় একটি খাবার হলো কুমড়ো বড়ি। এটি চালকুমড়া এবং মাসকলাই ডালের সাহায্যে তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করা হয় এই খাবার টি। নাটোর জেলার এই কুমড়ো বড়ি তৈরিকে অনেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন এবং এটি অনেকেই পণ্য হিসেবে লোকাল বাজার সহ ই-কমার্সের কল্যাণে অনলাইনে বিভিন্ন জেলায় পৌছে দিচ্ছেন। কুমড়ো বড়ি বিভিন্ন মাছের সাথে ঝোল করে, কখনও ভর্তা করে অথবা কখনও সব্জির সাথেও রান্না করে খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। অনেকেই কুমড়ো বড়ি সম্পর্কে জানেন না। তাই এটি যদি জিআই পণ্য করা যায় এবং সঠিক ভাবে প্রচারের করা যায় তাহলে কুমড়ো বড়ির চাহিদা ও বিক্রি বৃদ্ধি পাবে।

অবাক সন্দেশ: বিখ্যাত সব মিষ্টির মধ্যে নাটোরের অবাক সন্দেশ বেশ জনপ্রিয়। কাঁচাগোল্লার পরে এটি দ্বিতীয় বিখ্যাত মিষ্টি। শুকনো জাতীয় মিষ্টি হওয়ায় বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়। ঘন দুধ এবং চিনি মূলত অবাক সন্দেশের মূল উপাদান। অনেকেই মনে করেন এই মিষ্টির স্বাদ এতটাই সুস্বাদু যে সবাইখেয়ে অবাক হয়ে যায় তাই এর নাম অবাক সন্দেশ। অবাক সন্দেশ নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য হতে পারে। কারন এটি যেমন বিখ্যাত তেমনি এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই মিষ্টির গুণগত মানও অনেক উন্নত। শুকনো ধরনের মিষ্টি হওয়াতে অবাক সন্দেশের বাজারজাতকরণ করা সহজ। জিআই করণের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো রপ্তানি বৃদ্ধি। নাটোর জেলার অবাক সন্দেশ রপ্তানি যোগ্য একটি মিষ্টি হতে পারে।

আম: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত আমরা সবাই জানি। তবে নাটোর জেলাতে বিভিন্ন জাতের আম উৎপাদন করা হয় যা খুবই সুস্বাদু এবং সুমিষ্ট। লালপুর, বাগাতিপাড়া, বনপাড়া, চাচকৌড় এলাকায় আমের উৎপাদন ভাল হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ করা হচ্ছে। ভাল মান বজায় রাখার জন্য তাতে কীটনাশকের ব্যবহার না করে প্রাকৃতিকভাবে আম চাষ করা হয়। এর পিছনে আসল উদ্যোগ হলো আমগুলো গুণগত মান বজায় রেখে যেন রপ্তানি করা যায়। যেমন- গোপালভোগ, ল্যাংড়া, রাণীপছন্দ, ফজলি আম বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয় এসব অঞ্চলে। এই আমগুলোর জিআই স্বীকৃতির জন্য যদি আমরা চিন্তা করতে পারি তাহলে এর উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। জিআই পণ্য সব সময় মানসম্মত হবে -এটি জিআই পণ্যের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে চিন্তা করলে নাটোরের আম সম্ভাব্য জিআই পণ্য হতে পারে।

রাঘব শাহী মিষ্টি: রাঘব শাহী মিষ্টি নাটোরের আরেকটি সম্ভাব্য জিআই পণ্য হতে পারে। এই মিষ্টি আরো কিছু জেলাতে পাওয়া যেতে পারে। তবে নাটোরেই প্রথম তৈরি হয় বলে ধারনা করা হয়। এছাড়াও নাটোরের রাঘব শাহী মিষ্টির স্বাদ অন্য জেলার মিষ্টির থেকে আলাদা। স্কয়ার আকৃতির এই রাঘব শাহী মিষ্টি খুবই সুস্বাদু। কারন গরুর খাঁটি দুধ থেকে এই মিষ্টি তৈরি করা হয় হয় এবং বছরের পর বছর ধরে এর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলাটি দেশের বেশ কয়েকটি জেলার কেন্দ্র বিন্দু। এই জেলার ইতিহাস শুধু সমৃদ্ধ নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নাটোর জেলাতে চলনবিল অবস্থিত হওয়াতে বেশ কয়েকটি নদী ও খালবিল এখানে একত্রিত হয়েছে। রাজসিক জেলা নামকরণ সার্থকতা লাভ করেছে অসংখ্য রাজবাড়ী এবং রাজ পরিবারের বিভিন্ন বাসভবন, জমিদারদের বাড়ির অবস্থানের কারনে। নাটোরের উত্তরা গণভবন তেমনই প্রধান একটি রাজবাড়ী। চলববিল এবং এইসব রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে নাটোর জেলা হতে পারে পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাল, বিল, নদী, শত শত বছরের রাজ পরিবারের এলাকা সব মিলিয়ে সম্ভাব্য জিআই পণ্যের একটি জেলা হিসেবে নাটোর জেলার অনেক পণ্যই তালিকায় স্থান করে নিতে পারে। লেখক: প্রেসিডেন্ট, ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি)।Email : president@edcbn.com

সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: উন্নত ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

বাত ব্যথার কারণ ও আধুনিক চিকিৎসা

ছবি

স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত বঙ্গবন্ধু

ছবি

মহান নেতার স্বভূমিতে ফিরে আসা

ছবি

মেট্রোরেল : প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল

ছবি

আমার মা

ডিজিটাল বাংলাদেশ: প্রগতিশীল প্রযুক্তি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নতি

ছবি

৩ নভেম্বর: ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা

দেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনক দ্বিতীয় অধ্যায়

এইচ এস সি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের অনুশীলন

ছবি

ত্রিশ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

tab

মুক্ত আলোচনা

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

কাকলী তালুকদার

নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪

নাটোর জেলার নাম শুনলেই শুরুতেই মনে আসে নাটোরের কাঁচাগোল্লা ও জীবনানন্দের বনলতা সেনের নাম। কিন্তু নাটোরের জেলা ব্র্যান্ডিং নাম হলো ‘রাজসিক নাটোর।’ এর কারন হলো নাটোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেমন অনেক অনেক বছরের পুরোনো, একই সাথে রাজা রাণীর রাজত্বের ইতিহাস নাটোর শহরের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নাটোরের রাণী অর্ধ বঙ্গেশ্বরী রাণী ভবানীর রাজত্ব সেই সময়ে এতো বিশালাকার ছিলো যে তার আশেপাশে আর কোন এতো বড় রাজত্ব ছিলো না।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলাটি দেশের বেশ কয়েকটি জেলার কেন্দ্র বিন্দু। এই জেলার ইতিহাস শুধু সমৃদ্ধ নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নাটোর জেলাতে চলনবিল অবস্থিত হওয়াতে বেশ কয়েকটি নদী ও খালবিল এখানে একত্রিত হয়েছে। রাজসিক জেলা নামকরণ সার্থকতা লাভ করেছে অসংখ্য রাজবাড়ী এবং রাজ পরিবারের বিভিন্ন বাসভবন, জমিদারদের বাড়ির অবস্থানের কারনে। নাটোরের উত্তরা গণভবন তেমনই প্রধান একটি রাজবাড়ী। চলববিল এবং এইসব রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে নাটোর জেলা হতে পারে পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাল, বিল, নদী, শত শত বছরের রাজ পরিবারের এলাকা সব মিলিয়ে সম্ভাব্য জিআই পণ্যের একটি জেলা হিসেবে নাটোর জেলার অনেক পণ্যই তালিকায় স্থান করে নিতে পারে।

নাটোর জেলা শুধু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে বিখ্যাত নয়। দেশের বিখ্যাত বৃহৎ চলনবিল নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা সংলগ্ন হওয়ার কারনে কৃষি ক্ষেত্র এবং মৎস উৎপাদনে নাটোর জেলা অনেক এগিয়ে। বিশেষ করে আমাদের দেশের দেশি মাছ, দেশি ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপাদনের দিক থেকে নাটোর জেলা সুপরিচিত। নাটোরের হালতির বিলকে স্বাদুপানির বা মিঠা পানির মাছের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও চলনবিলে পাওয়া যায় বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন মাছ। যেমন- বোয়াল, টাকি, শোল, মৃগেল, চিংড়ি, টেংরা, কালবাউশ, রিটা, মৌসি, গজার, বৌ, চিতল, মাগুর, কৈ, শিং, সরপুটি, পুঁটি, গুজা, গাগর, বাঘাইর কাঁটা, তিতপুটি এমন সব মাছ যা অন্য অনেক যায়গায় একেবারে নেই বললেই চলে।

নাটোর চলনবিল এলাকাতে অবস্থিত এবং বর্ষার মৌসুমে বন্যার পানিতে এবং বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে ভরা থাকলেও এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো ধান। আউশ, আমন ,বোরো এমন সব বিলুপ্ত প্রায় ধান এখনও নাটোর জেলাতে এবং নাটোর জেলার অধীনে উপজেলা, ইউনিয়ন এবং গ্রামগুলোতে উৎপাদন হয়ে থাকে। ধান ছাড়াও নাটোরে প্রচুর পরিমাণে আখ, গম, ভুট্টা, বিভিন্ন ধরনের ডাল, রসুন, পান, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি শস্য উৎপাদিত হয়। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত হলেও নাটোর জেলা এবং তার আশেপাশের উপজেলাগুলোতে বিভিন্ন উন্নত মানের আম চাষ হয়। এই পণ্যগুলোর সহজলভ্যতার কারনে পণ্যগুলোকে কেন্দ্র করে নাটোর জেলাতে বেশ কিছু শিল্প কারখানাও গড়ে উঠেছে। এই সব শিল্প কারখানা পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জনগনের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

নাটোরের কাঁচাগোল্লা বর্তমানে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে যার সাথে নাটোরের কয়েকশত বছরের পুরোনো ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। আমরা জানি যেকোন জিআই পণ্য মানেই পণ্যটি অসাধারণ ও বিখ্যাত। শুধু তাই নয়, জিআই স্বীকৃতির সাথে সাথে সেই পণ্যের যেমন মর্যাদা বৃদ্ধি পায় একই সাথে সেই পণ্যের বিক্রিও বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও সেই পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল ও এর সাথে জড়িত সকলের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাই নাটোরের কাঁচাগোল্লা জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর সবগুলো খাতের উন্নয়নের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজন সঠিক গবেষনা, প্রচার এবং কমার্শিয়ালাইজেশনের জন্য পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন।

নাটোরের কাঁচাগোল্লা ছাড়াও আর কোন কোন পণ্য জিআই হতে পারে সেদিকে চিন্তা করার সময় চলে এসেছে। সেজন্য প্রথমে প্রয়োজন জেলার সম্ভাব্য জিআই পণ্যের তালিকা করা। যেমন-

কুমড়ো বড়ি: নাটোর জেলার একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় একটি খাবার হলো কুমড়ো বড়ি। এটি চালকুমড়া এবং মাসকলাই ডালের সাহায্যে তৈরি করা হয়। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করা হয় এই খাবার টি। নাটোর জেলার এই কুমড়ো বড়ি তৈরিকে অনেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন এবং এটি অনেকেই পণ্য হিসেবে লোকাল বাজার সহ ই-কমার্সের কল্যাণে অনলাইনে বিভিন্ন জেলায় পৌছে দিচ্ছেন। কুমড়ো বড়ি বিভিন্ন মাছের সাথে ঝোল করে, কখনও ভর্তা করে অথবা কখনও সব্জির সাথেও রান্না করে খেতে অনেকেই পছন্দ করেন। অনেকেই কুমড়ো বড়ি সম্পর্কে জানেন না। তাই এটি যদি জিআই পণ্য করা যায় এবং সঠিক ভাবে প্রচারের করা যায় তাহলে কুমড়ো বড়ির চাহিদা ও বিক্রি বৃদ্ধি পাবে।

অবাক সন্দেশ: বিখ্যাত সব মিষ্টির মধ্যে নাটোরের অবাক সন্দেশ বেশ জনপ্রিয়। কাঁচাগোল্লার পরে এটি দ্বিতীয় বিখ্যাত মিষ্টি। শুকনো জাতীয় মিষ্টি হওয়ায় বেশ কিছুদিন সংরক্ষণ করে খাওয়া যায়। ঘন দুধ এবং চিনি মূলত অবাক সন্দেশের মূল উপাদান। অনেকেই মনে করেন এই মিষ্টির স্বাদ এতটাই সুস্বাদু যে সবাইখেয়ে অবাক হয়ে যায় তাই এর নাম অবাক সন্দেশ। অবাক সন্দেশ নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য হতে পারে। কারন এটি যেমন বিখ্যাত তেমনি এর জনপ্রিয়তা রয়েছে। এই মিষ্টির গুণগত মানও অনেক উন্নত। শুকনো ধরনের মিষ্টি হওয়াতে অবাক সন্দেশের বাজারজাতকরণ করা সহজ। জিআই করণের অন্যতম একটি উদ্দেশ্য হলো রপ্তানি বৃদ্ধি। নাটোর জেলার অবাক সন্দেশ রপ্তানি যোগ্য একটি মিষ্টি হতে পারে।

আম: চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আমের জন্য বিখ্যাত আমরা সবাই জানি। তবে নাটোর জেলাতে বিভিন্ন জাতের আম উৎপাদন করা হয় যা খুবই সুস্বাদু এবং সুমিষ্ট। লালপুর, বাগাতিপাড়া, বনপাড়া, চাচকৌড় এলাকায় আমের উৎপাদন ভাল হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে আমের চাষ করা হচ্ছে। ভাল মান বজায় রাখার জন্য তাতে কীটনাশকের ব্যবহার না করে প্রাকৃতিকভাবে আম চাষ করা হয়। এর পিছনে আসল উদ্যোগ হলো আমগুলো গুণগত মান বজায় রেখে যেন রপ্তানি করা যায়। যেমন- গোপালভোগ, ল্যাংড়া, রাণীপছন্দ, ফজলি আম বাণিজ্যিক ভাবে চাষ করা হয় এসব অঞ্চলে। এই আমগুলোর জিআই স্বীকৃতির জন্য যদি আমরা চিন্তা করতে পারি তাহলে এর উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। জিআই পণ্য সব সময় মানসম্মত হবে -এটি জিআই পণ্যের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। এদিক থেকে চিন্তা করলে নাটোরের আম সম্ভাব্য জিআই পণ্য হতে পারে।

রাঘব শাহী মিষ্টি: রাঘব শাহী মিষ্টি নাটোরের আরেকটি সম্ভাব্য জিআই পণ্য হতে পারে। এই মিষ্টি আরো কিছু জেলাতে পাওয়া যেতে পারে। তবে নাটোরেই প্রথম তৈরি হয় বলে ধারনা করা হয়। এছাড়াও নাটোরের রাঘব শাহী মিষ্টির স্বাদ অন্য জেলার মিষ্টির থেকে আলাদা। স্কয়ার আকৃতির এই রাঘব শাহী মিষ্টি খুবই সুস্বাদু। কারন গরুর খাঁটি দুধ থেকে এই মিষ্টি তৈরি করা হয় হয় এবং বছরের পর বছর ধরে এর জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নাটোর জেলাটি দেশের বেশ কয়েকটি জেলার কেন্দ্র বিন্দু। এই জেলার ইতিহাস শুধু সমৃদ্ধ নয়, সাংস্কৃতিক দিক থেকেও অনেক বেশি সমৃদ্ধ। নাটোর জেলাতে চলনবিল অবস্থিত হওয়াতে বেশ কয়েকটি নদী ও খালবিল এখানে একত্রিত হয়েছে। রাজসিক জেলা নামকরণ সার্থকতা লাভ করেছে অসংখ্য রাজবাড়ী এবং রাজ পরিবারের বিভিন্ন বাসভবন, জমিদারদের বাড়ির অবস্থানের কারনে। নাটোরের উত্তরা গণভবন তেমনই প্রধান একটি রাজবাড়ী। চলববিল এবং এইসব রাজবাড়ীকে কেন্দ্র করে নাটোর জেলা হতে পারে পর্যটকদের জন্য একটি দর্শনীয় স্থান। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, খাল, বিল, নদী, শত শত বছরের রাজ পরিবারের এলাকা সব মিলিয়ে সম্ভাব্য জিআই পণ্যের একটি জেলা হিসেবে নাটোর জেলার অনেক পণ্যই তালিকায় স্থান করে নিতে পারে। লেখক: প্রেসিডেন্ট, ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি)।Email : president@edcbn.com

back to top