alt

মুক্ত আলোচনা

পয়লা বৈশাখ : বাঙালির সংহতি চেতনার সংস্কৃতি

সুরঞ্জন রায়

: রোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

মানুষের, বিশেষত হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের, পরিব্রাজন শুরু হয়েছিলো প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। তারা জীবন ধারনের প্রয়োজনে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে নানা কিছু শিখেছে। একদিন সভ্যতার দোরগড়ায় পৌঁছে সবিস্ময়ে ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’-এর মাঝখানে তারা আবিষ্কার করল নানা বিষয়।এরপর পৃথিবী ছেড়ে সেই মহাকাশ জয়ের প্রত্যাশায় কতই না চেষ্টা করে চলেছে। সে চলমানতার ধারায় দৈনন্দিন জীবনকে কাঠামোবদ্ধ করার অভিপ্রায় থেকে আকাশের তারা, নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্যের গতিকে কেন্দ্র করে বৎসর, মাস, দিন, ক্ষণ গণনা করতে শুরু করল। এভাবে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষেরা নানা দিক থেকে বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ অবদান রেখেছে। তাদের সব পঞ্জিকার ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়াও সম্ভবপর নয়। সে জন্যে এ প্রবন্ধের সীমা সৌরবর্ষ, চান্দ্রবর্ষ, হিজরিবর্ষ, জুলিয়াস সিজারের-এর বর্ষসংস্কার, পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির বর্ষসংস্কার ছাড়া রাজা শশাঙ্কের বঙ্গাব্দের সূচনা ও সম্রাট আকবরের ফসলি সন নিয়ে আলোচনাসহ নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে, নববর্ষ উৎসবকে ইহজাগতিক হয়ে ওঠা এবং এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে দেখার চেষ্টা থাকবে।

বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা

পঞ্জিকা ও দিনপঞ্জি বা বর্ষপঞ্জির ভিন্নতা আছে। পঞ্জিকাকে ইংরেজিতে বলা হয় Almanac, আর, দিনপঞ্জিকে বলা Calender। Almanac-এ থাকে বৎসরের বার, সপ্তাহ, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, রাশিফল, জোয়ার-ভাঁটা, চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্ত, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ প্রভৃতি। যে কারণে হিন্দু পঞ্জিকাকে “পঞ্চাঙ্গ” বলা হয়েছে। আর, Calender-এ থাকে একটি বছরের দিন, সপ্তাহ, মাস, যা দেয়ালে টানিয়ে রাখা যায়। নাগরিক জীবনে এখনও পর্যন্ত বর্ষপঞ্জি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দিন-মাসের গণনা ছাড়া পালা-পার্বণ, ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় দিবস, ছুটির তালিকা, আর হিন্দুদের দিন, ক্ষণ, তিথি, নক্ষত্রসহ পূজাপার্বণের সময় ও শুভ-অশুভ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পঞ্জিকার প্রয়োজন অপরিহার্য। (অজয় রায়, ‘প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জি : একটি সমীক্ষা,’ শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত,বাংলাসন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, পৃ. ২) এ-সব চিন্তা মাথায় রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বর্ষপঞ্জি তৈরি করে যাচ্ছেন। কিন্তু বার বা সপ্তাহ ও দিনের প্রথম ব্যবহার করেন সম্ভবত ক্যালেডিয়ান জ্যোতির্বিদগণ। সাত বারকে সাতটি জ্যোতিষ্কের নামে নামকরণ করেন তাঁরা। ৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত স¤্রাট বুদ্ধগুপ্তের একটি উৎকীর্ণ লিপিতে সপ্তাহভিত্তিক দিনের নাম প্রথম উল্লিখিত হয়।

বর্ষপঞ্জির প্রাচীনত্বও বর্ষপঞ্জি সংস্কার

অনেকে বলতে পারেন : হলকর্ষ বা হালখাতা থেকে, কিংবা বিভিন্ন লোকাচার থেকে বর্ষগণনার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে এ-সব অনুষঙ্গ বা লোকসংস্কৃতি হিসেবে যুক্ত হলেও, বর্ষগণনা বা নববর্ষ পালনের নিয়ামক নয়। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকে রোমের অধিবাসী ও সম্রাটদের মধ্যে বর্ষগণনার প্রথা প্রচলিত ছিলো। তখন রোমানদের বৎসর ছিলো ৩০৪ দিনের মধ্যে সীমিত। মাস ছিলো ১০টি। পরবর্তীকালে রাজা নুসা পম্পিলিয়াস খ্রিস্ট পূর্ব ৭৯৩ অব্দে ৩০৪ দিনের সঙ্গে ৬০ দিন যোগ করেন। আর, জুলিয়াস সিজার ১০ মাসের সঙ্গে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি যোগ করে ১২ মাসে বছর নির্ধারণ করেন। তখনকার দিনে বৎসর আরম্ভ হতো মার্চ মাস থেকে। ইরানে মার্চ মাসের ২১ তারিখ থেকে বর্ষগণনার সূত্রপাত হয় এবং সেখানে ইসলামের আমলেও সৌর সাল প্রচলিত ছিলো। রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজার এ মাসের নামকরণ চূড়ান্ত করেন ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দেলাতিন শব্দ ‘মার্তিয়াস,’ বা রোমানদের যুদ্ধের দেবতার নাম থেকে। রোমানদের মাসের নামগুলো দেবদেবী নির্ভর। শুধু জুলিয়াস সিজারের পর তাঁর ভাইপো অগাস্টাস সিজারের নামে আগস্ট, সেপ্টেম্বরের septem মানে সাত, octo হলো আট, novem নয়, আর, decem হলো দশ। এভাবে দশ মাসের নামকরণ করা হয়েছিলো। এখনকার হিসেবে এ নিয়ম নেই।

অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে শুধু ভারতবর্ষের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে আর্যভারতে প্রায় ২৫ প্রকার অব্দের বা বর্ষগণনার প্রচলন ছিলো। তার মধ্যে ঋগৈ¦দিক পর্বে বসন্তকে প্রথম ঋতু হিসেবে গণনা করা হতো। তখন ঋতুই ছিলো বর্ষ গণনার সূচক। ৩৬০ সাবন দিনে (civil days) হতো এক বছর এবং ৯০ দিন করে চারটি ঋতু ছিলো। এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত হতো এক দিন। (বেলাবাসিনী গুহ ও অহনা গুহ, ঋগে¦দ ও নক্ষত্র, পৃ. ৬৩-৬৪)তখন ঋতু ছিলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। মানুষেরা সুপ্রাচীনকাল থেকে সূর্যের বিভিন্ন অবস্থিতি, যেমন, বাসন্ত বিষুব, দক্ষিণায়ন দিন, শারদ বিষুব, উত্তরায়ণ দিন সম্পর্কে জানার যে চেষ্টা করেছে, তার প্রমাণ হলো ইংল্যান্ডের Stoneheng, যা ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। এই চতুঃসীমার মধ্যে দিন গণনা করে ক্যালডিয়ান ও গ্রিক জ্যোতির্বিদগণ মাসের মোট হিসেব পেয়েছিলেন।

বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ শীত মোটদিন

ক্যালডিয়ানÑ ৯৪.৫০ ৯২.৭৩ ৮৮.৫৯ ৮৯.৪৪ = ৩৬৫.২৬

গ্রিকÑ ৯৪ ৯২ ৮৯ ৯০ = ৩৬৫

ঋগে¦দে প্রথমে তিনটিঋতু, যেমন, গ্রীষ্ম ঋতু : চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়; বর্ষা ঋতু : শ্রাবণ, ভাদ্র, আশি^ন, কার্তিক, আর, হেমন্ত ঋতু : অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, পরে পাঁচটি এবং সবশেষে ছয়টি ঋতুর আভাস দেয়া হয়েছে। তৈত্তিরীয় (১।৫।২) ও শতপথ ব্রহ্মণে (২।১।৩) বলা হয়েছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতু তিনটি দেবগণ, এবং শরৎ, হেমন্ত ও শিশির হলো পিতৃগণ। রোমানরা মাসের নামকরণ করেছিলো বিভিন্ন দেবদেবী, গাণিতিক সংখ্যা ও স¤্রাটের নামে, ভারতে প্রচলিত মাসের নামকরণ করা হয়েছিলো নক্ষত্রের নামে। অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা থেকে সূর্যের অবস্থান সাপেক্ষে এ জাতীয় নামকরণ। এ নিরিখে বলা যায়, পাশ্চাত্য পঞ্জিকার সঙ্গে ভারতীয় পঞ্জিকার আছে বড়ো ব্যবধান।

প্রত্যেক অব্দ গণনার পেছনে একটি কাল পরিমাপনের প্রসঙ্গ বিন্দু থাকে। সেটি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে ধরা যেতে পারে। যেমন, খ্রিস্টীয় অব্দ গণনার ক্ষেত্রে যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময়কে গ্রেগরীয় অব্দের প্রারম্ভ বিন্দু হিসেবে ধরা হয়েছে। অথবা, কোনো রাজার সিংহাসনে আরোহন করার সময়কে কাল পরিমাপন হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন ভারতে নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি অব্দের প্রচলন আছে। আলবেরুনী তাঁর গ্রন্থে কয়েকটির উল্লেখ করেন, যেমন, শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ প্রধান। বিক্রমাব্দ বাংলাদেশ ছাড়া উত্তর ভারত জুড়ে প্রচলিত ছিলো এবং এখনো বর্তমান। কথিত আছে উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য এই অব্দের প্রচলন করেন। তিনি ৫৭ খ্রি. পূর্বাব্দে শকদের বিতারণ করেছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বিক্রমাব্দের প্রচলন হয়। এ অব্দ সম্পর্কে একটা ভিন্ন মত প্রচলিত আছে, যেমন, ‘শকাব্দ’-এর প্রচলন করেছিলেন কুশান রাজা কনিষ্ক। পরে এটি রাজা বিক্রমাদিত্যের শক বিজয়ের বছর থেকে গণনা করা হয়। এ অব্দকে সংবৎও বলা হয়।উপরি-উক্ত বিষয়টিকে জনশ্রুতি হিসেবে ধরা হয়। এর পাশাপাশি উত্তর ভারতে গুপ্তাব্দের প্রচলন ছিলো, ৫২০ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তদের ক্ষমতা চলে যাবার পর লুপ্ত হয়ে যায়। সম্ভবত গুপ্তাব্দের প্রচলন হয়েছিলো ৩১৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকে। এরপর হর্ষাব্দ চালু হয় হর্ষবর্ধনের সময় থেকে। (অজয় রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১) এছাড়া লক্ষণাব্দ, জালালি সন, ত্রিপুরাব্দ প্রভৃতি প্রচলিত ছিলো।

সন ও সালের প্রথমটি আরবি, দ্বিতীয়টি ফারসি। দুটোর অর্থ একই। কিন্তু বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত সিভ্যাঁ লেভি আনুমানিক ‘৫৯৫’ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অব্দের সঙ্গে ‘সন’ শব্দটির সাদৃশ্য দেখতে পান তিব্বতী রাজা রি স্রঙ-সনের বা তাঁর ছেলে স্রঙ-সন-গাম-পোর নামের সঙ্গে। ‘সন’ শব্দের সঙ্গে মিল থাকলেও তিব্বতে কোনো অব্দ বোঝাতে এ নামটি ব্যবহৃত হয়নি। এক সময় জ্যোতিষ্কভাস্কর মহামুনি ভৃগুর সিদ্ধান্ত মতে পঞ্জিকা প্রচলিত হয়। সেই পঞ্জিকায় বৈশাখ মাসের নাম তিনি রাখেন মধুসূদন (৩১), জ্যৈষ্ঠ- ত্রিবিক্রম (৩২), আষাঢ়- বামন (৩১), শ্রাবণ- শ্রীধর (৩২), ভাদ্র- ঋষিকেশ (৩১), আশ্বিন- পদ্মনাভ (৩০), কার্তিক- দামোদর (৩০), অগ্রহায়ণ- কেশব (৩০), পৌষ- নারায়ণ (২৯), মাঘ- মাধব (২৯), ফাল্গুন- গোবিন্দ (৩০) ও চৈত্র- বিষ্ণু (৩১)।

গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও বঙ্গাব্দ

১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি একটি বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। এ বর্ষপঞ্জিটি ছিলো সৌর বৎসরকে কেন্দ্র করে। অনেক ভ্রান্তি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে এ ক্যালেন্ডারটিকে বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এ পঞ্জিকা আমেরিকা ও ব্রিটেনে গৃহীত হয় ১৭৫২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি গ্রহণের কারণ হলো : আগে জুলিয়ান নামক এক সম্রাট বর্ষপঞ্জি গণনায় একটি মহাবিষুব থেকে আর একটি মহাবিষুবের সময়কাল ধরেছিলেন ৩৬৫.২৫ দিন, যা ছিলো ১১ সেকেন্ড কম। এর ফলে ৪০০ বছর অন্তর তিন দিনের ব্যবধান হতো। সেই জন্যে পঞ্জিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আছে যুগপৎ সৌর ও চান্দ্র বছর। গ্রেগরীয় পদ্ধতিকে স্বীকরণ করার ফলে খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে বঙ্গাব্দের মিশ্রণ ঘনিষ্ঠতর হয়েছে।কারণ হিন্দুদের পূজা-পার্বণ তিথিভিত্তিক বলে গ্রেগরীয় বঙ্গাব্দ মেনে সব কিছু করা সম্ভবপর হলেও, মুসলিমপর্ব চান্দ্রবর্ষের এদিক ওদিক হওয়ার নয়। উপমহাদেশে একজন হিন্দু নাগরিকের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় ১. গ্রেগরীয় পঞ্জিকার দ্বারা, ২. সৈদ্ধান্তিক সৌর পঞ্জিকা দ্বারা, ৩. সৈদ্ধান্তিক চান্দ্র পঞ্জিকা দ্বারা। অপরদিকে, একজন মুসলিম নাগরিকের জীবন চালিত হয় গ্রেগরীয় ও ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকা বা হিজরি পঞ্জিকা দ্বারা।

এই বৈষম্য দূর করার জন্যে সর্বভারতীয় একটি বর্ষপঞ্জি ১৯৫৫ সালে প্রথম শুরু হয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার (১৮৯৩-১৯৫৬) সভাপতিত্বে। তিনি ‘শকাব্দ’কে ধরে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনে এবং বাকি আশ্বিন থেকে চৈত্র মাসকে ৩০ দিনে ধরে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেন। অধিবর্ষ, মলমাস, ক্ষয় মাস বা Leap year-এর ক্ষেত্রে প্রতি চার বছর অন্তর একদিন বাড়িয়ে দিয়ে বর্ষগণনার নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। মলমাস বা অধিবর্ষ শুধু্ৃ ঋগ্বৈদিক আমলে নয় অনেক আগে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিতেও উল্লিখিত হয়েছে। এদিক থেকে বাংলাদেশে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মিলেমিশে প্রচলিত আছে।

বঙ্গাব্দ ও পঞ্জিকা সংস্কার

বঙ্গাব্দ বাংলা সন হিসেবেই প্রচলিত, কিন্তু এটি কোনো মৌলিক অব্দ নয়। এর সঙ্গে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, হিজরি, শকাব্দ প্রভৃতি দেশি বিদেশি বর্ষপঞ্জি মিশে আছে। বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বলে এই সমতা যথার্থ কিনা তা গবেষণার বিষয়। তবে সমতা থাকলেও স্থানিক প্রভাবজনিত কিছু সংযোজন যে হয়নি তা নয়। বঙ্গাব্দের কথা উঠলে মহামতি আকবর বাদশার ইলাহি অব্দের কথা বলতেই হয়। এর আগে অবশ্য কয়েকজন পণ্ডিত শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দের সূচনাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, সোমবার) বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। কেননা, ওই দিন শশাঙ্ক গৌড়-বঙ্গে রাজত্ব আরম্ভ করেন। দুঃখের বিষয়, এ সম্পর্কে প্রমাণযোগ্য যথেষ্ট তথ্য বা সূত্র পাওয়া যায়নি।

আর একজন হলেন মিথিলার রাজা শিবসিংহ। তাঁর এক লেখে চারটি তারিখ দেয়া আছে। সেগুলো হলো- ল সং ২৯২, শক ১৩২১, সম্বৎ ১৪৫৬, সন ৮০৭। কিন্তু এ লেখের সালটিও যথার্থ প্রমাণের অভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সংস্কারকদের মধ্যে বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহী বংশের আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)-র নামও উঠে আসে। কিন্তু এটি প্রমাণিত হয়েছে একটি প্রবাদ হিসেবে। অবশ্য হোসেন শাহ্র আমল বা তার কিছু পরে হিজরি অব্দ ছাড়া ‘পরগণাতি সন’ নামে একটি সনের প্রচলন ছিলো। সেটি ১২০১-২ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণনা করা হতো। বল্লাল সেনের নামে ‘বলালী সন’-এর প্রচলন ছিলো, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার অস্তিত্ব নেই। তবে বাংলায় শকাব্দ, হিজরি, কোথাও বা লক্ষ্মণ সেন সম্বৎসরের অর্থাৎ ল-সং-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারনা মুঘল সম্রাট আকবরের আমলেই ইলাহি অব্দের প্রচলন হয়। অন্তত আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে সে রকমই উল্লেখ আছে।

আকবর বহুদিন ধরেই হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে [দিন গণনার] সমস্যাকে সহজ করে দেবার জন্য এক নূতন বৎসর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরা [অব্দ] ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। ... আমীর ফত্হুল্লাহ্ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এই অব্দের প্রবর্তন হল। এর বৎসর ও দিনগুলি স্বাভাবিক সৌর, অধিবর্ষহীন। পারসীক মাস ও দিনগুলির নামের কোনও পরিবর্তন হয়নি। মাসিক দিনগুলির সংখ্যা ২৯ থেকে ৩২ এবং শেষের মাসের [শেষ] দুদিন রোজ-ও-শব্ (দিন ও রাত্রি) নামে পরিচিত। ... ইলাহী [দৈব] অব্দের মাসগুলি হচ্ছে ফরওরদিন, অর্দিবিহিষ্ট, খুবর্দাদ, তির, অমুরদাদ, শারেবার, মিহ্র, আবান, আজব, দয়, রহ্মন ও ইস্ফন্দারমাজ্। (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত, পৃ. ৮২-৮৩)

অন্য অধ্যায়ের এক স্থানে বলা হয়েছে :

স¤্রাট ২৯ দৈব বৎসরের (প্রকৃতপক্ষে রাজ্য বর্ষের) এবং হিজরি অব্দের ৮ই রবিউল আউয়াল, বুধবার রাত্রির কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে পর সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং সমান দিন ও রাত্রির (অর্থাৎ মহাবিষুব দিবসের) শুরু হয়। ... এই বৎসরের প্রারম্ভে (অর্থাৎ ২৯তম রাজ্য বর্ষে) ইলাহি অব্দ প্রবর্তিত হয়েছিল। (অজয় রায়, প্রগুক্ত, পৃ. ৩৫)

আকবরনামায় উল্লেখ আছে, ‘৯৬৩ হিজরি সনের ২রা রবিয়াস্্সানি শুক্রবার প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ ফেব্রুয়ারি) স¤্রাট সিংহাসনে আরোহন করেন।’আর তাঁর পিতা হুমায়ুনের মৃত্যু হয় ১৫৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারিতে। আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ সালে ১০ বা ১১ মার্চ। এই আরোহনের তারিখ নিয়ে একটা মতান্তর দেখা দিলেও এ কথা সত্যি যে, এ সময় থেকে ফসলি সন বা ইলাহি সন গণনা শুরু হলেও এটি প্রযুক্ত হয়েছিলো রাজত্বের ২৮ কী ২৯ তম বছর থেকে। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ বলেন যে, বৈরাম খানের অভিভাবকত্ব থেকে আকবর মুক্ত হন ১৫৬০ সালের দিকে। তখন আকবরের বয়স ১৮ বা ২০। ১৫৭৫ থেকে ১৬১৬ সাল পর্যন্ত তাঁকে বারো ভুঁইয়াদের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে লড়াই করতে হয়। এর মধ্যে ইলাহি সাল চালু করা আদৌ সম্ভব কিনা,আরও বঙ্গদেশে, তা ভেবে দেখা দরকার। আর, এ সালটিকে ‘বঙ্গাব্দ’ বলার যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক কারণ কী? ‘বঙ্গ’ একটি অঞ্চল মাত্র। হিজরি অব্দ বাদ দিয়ে ইলাহি অব্দ প্রচলনে মুসলিমদের আপত্তি ও দ্রোহের আশঙ্কা তাঁর ছিলো। কিন্তু যে আকবর মুসলিম সন্তান হয়ে কুরআন, হাদিসকে উপেক্ষা করে ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ মত প্রচারে দ্বিধা করেননি, তিনি ইলাহি সন প্রতিষ্ঠার জন্যে কাউকে পরোয়া করবেন, এটি ভাবা যায় না।তখন বাঙলা ও বঙ্গ নামে দেশ বা অঞ্চলের পরিচিতি থাকলেও, বাংলার ঠিক কোন অঞ্চলে ইলাহি সনের প্রচলন হয়েছিলো, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এমনকি, কোন অঞ্চলটি বঙ্গ তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায়নি। (আহমদ শরীফ, ‘বঙ্গাব্দের উদ্ভব কবে ও কোথায়?’ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪-৭৫)

বঙ্গাব্দের সঙ্গে তারিখ-ই-ইলাহি সনের সম্পৃক্ততা আছে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী জ্যোতিপদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহার মন্তব্য শোনা যেতে পারে। ড. সাহা বলেন :

In 1079 A.D. Sultan Jalaluddin Melik Shah of Iran introduces solar calendar of Iran, and this was introduced by Emperor Akber in India in 1584 A.D. under the name tarik-i-ilahi, Akber’s calendar was used to date all events from his accession (1556 A.D.) and was official calendar during the reign of Jahangir and early part of Sahjahan’s reign when it fell into disuse. Butit gave rise to a number of hybrid Era like the ÔBengali SanÕ and of ÔFasliÕ Era which are still in use. (M.N. Saha, `The Reform of the Indian Calendar,’ Presidential Addresses of the Indian Astronomical and Astrophysical Society, 1952; the indian Science News Association, 1952)

বস্তুত ড. সাহার নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে। সেখানে ‘শকাব্দে’র সংস্কার সাধন করা হয়। যেমন,

০১. ক. ১৯৫৭ খিস্টাব্দের ২২ মার্চকে [মহাবিষুব সংক্রান্তি (vernal equinox) পর দিন] ধরা হরে ১৮৭৯ শকাব্দের প্রথম মাস : ১লা চৈত্র।

০২. মাসের দিনের সংখ্যা হবে

প্রথম মাস চৈত্র : ৩০ দিন

পরবর্তী ৫ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) হবে : প্রতিটি ৩১x৫ = ১৫৫ দিন

পরবর্তী ৬ মাস (আশ্বিন থেকে ফাল্গুন) : প্রতিটি ৩০x৬ =১৮০ দিন

অর্থাৎ সাধারণ বর্ষ হবে ৩৬৫ দিনে।

০৩. অধিবর্ষে (leap year) প্রথম চৈত্র মাস হবে ৩১ দিনে। অর্থাৎ অধিবর্ষ হবে ৩৬৬ দিনে।

ড. সাহার সুপারিশকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমিও ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’-এর উদ্যোগ নেয়। যাকে বলা হয় ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’। এ কমিটির সুপারিশগুলো নিম্নরূপ :

০১. বর্তমান বাংলা মাসের তারিখ গণনা অত্যন্ত দুষ্কর বিধায় ১৩৭১ সালে (১৯৬৪ সালের ১৪ই এপ্রিল) বৈশাখ হইতে প্রতিবছর ভাদ্রমাস পর্যন্ত এই ৫ মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত এই ৭ মাস ৩০ দিন ধরে গণনা করা হউক।

২. যেহেতু ১৩৬৯ অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) গণনা করা হইয়াছে এ বর্ষ হইতে প্রতি ৪র্থ বৎসরে ১ দিন বৃদ্ধি পাইয়া চৈত্রমাস ৩১ দিনে গণনা করা হউক। (১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ই জুন তারিখে গৃহীত)

উল্লেখ্য যে, ১৩৬৯ বাংলা সনের প্রাতিষঙ্গিক প্রেগরি বর্ষ ছিল নিম্নরূপ :

১লা বৈশাখ- ১৭ই পৌষ (১৩৬৯) : ১৩৬৯+৫৯৩ = ১৯৬২ (১৪ই এপ্রিল- ৩১ শে ডিসেম্বর)

১৮ই পৌষ- ৩০ শে চৈত্র (১৩৬৯) : ১৩৬৯+৫৯৪ = ১৯৬৩ (১লা জানুয়ারি- ১৩ই এপ্রিল)

এ পঞ্জিকা সংস্কার করা হলেও লিপ ইয়ার নিয়ে একটা সমস্যা থেকে গেছে। যে সংখ্যাটি প্রতি চার বছর অন্তর ৪ দ্বারা বিভাজ্য সেটি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ হয়। কিন্তু শহীদুল্লাহ কমিটির উল্লিখিত ১৯৬২ বা ১৯৬৩ যেমন লিপ ইয়ার নয়, তেমনি বাংলা ১৩৬৯ও লিপ ইয়ার নয়। এটিই এ কমিটির একটি দুর্বলতার দিক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সরকারি কাগজে বাংলায় নোট লেখা, স্বাক্ষর করা এবং তারিখ প্রদানের প্রথা চালু করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমানও এ কাজটি আরও জোরদার করেন। অবশেষে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ইংরেজি সালের পাশাপাশি বাংলা সাল তারিখ লেখার নির্দেশ জারি করেন। এবং ১৯৮৮-৮৯ অর্থ বছরে শহীদুল্লাহর কমিটির সুপারিশ কৃত বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়। (অজয় রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮-৩৯)

বিভিন্ন সময় নববর্ষ উদ্যাপন ও ছুটি ঘোষণা

বাংলা বর্ষবরণ অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে, কিন্তু কবে থেকে তা বলা মুশকিল। এটি যেমন একটি উৎসব তেমনি পুণ্যকর্মের সূচকও বটে। আজ যেমন পয়লা বৈশাখকে গ্রেগরীয় পঞ্জিকার সূত্র ধরে উদযাপনের দিন হিসেবে নেওয়া হয়েছে, একদিন অগ্রহায়ণ মাসেও নববর্ষ পালিত হতো (অগ্র = প্রথম, হায়ণ = বছর )। ড. নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, নবান্নই ছিলো বাঙালি কৃষকের নববর্ষের উৎসব। ভারতের মহারাষ্ট্রে পঞ্জিকা সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক, শঙ্করলাল দীক্ষিত, ভেংকটেশ বাপুশাস্ত্রী কেতকর প্রমুখ। আর, বাংলায় যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি। নববর্ষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা হোলি সেই উৎসবের স্মারক।’

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের সময় রাখীবন্ধন, অরন্ধন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালিকে দ্বিধাবিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইলেও, আজকের দিনে রবীন্দ্র বিদূষণের মতো সেদিনও বিদূষণক্রিয়া থেমে থাকেনি। বরং সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দিয়ে যাঁরা দ্বিধাবিভক্তির চিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন, তাঁরা যেমন কেউ বাঙালি ছিলেন না, তেমনি ভাষাগত দিক থেকে ছিলেন উর্দুভাষী। তাঁদের মন্ত্রণায় এবং ব্রিটিশ শাসনের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির কারণে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজিত হলো। তার আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে অনেকবার। অনেকবার বলা হয়েছে পয়লা বৈশাখ হৈন্দুক। এরকম বোধ সত্ত্বেও বাঙালি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যুদ্ধ করলেও, মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর পরে এ জাতির বৃহৎ সংখ্যাকে সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় আনা সম্ভবপর হয়নি। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় কিছু সংখ্যক মুক্তমনা মানুষের আয়োজন যে আয়োজন নয়, সে বিষয়েও ভাবতে হবে। গায়ের জোরে নয়, প্রেমের জোরে, সংস্কৃতির জোরে আম জনতাকে সামিল করাই কিন্তু নববর্ষের প্রতিপাদ্য। কেননা, একদিন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নববর্ষের উৎসব পালন করত। এর সঙ্গে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অনুষ্ঠান চিরকাল অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এ দিন হলকর্ষ, পুণ্যাহ, বার্ষিক মেলা, হালখাতা, স্থানীয়ভাবে আমানি, গম্ভীরা, বলীখেলা, ঘোড়দৌড়, গরুর দৌড়, নৌকা বাইচে শরিক হতো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে।

তবে সেদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত ধর্মভিত্তিক পূর্ব বাংলায় যে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের চেষ্টা হয়নি, তা নয়। এবং সেটির রাজনৈতিক প্রমাণ দিয়েছিলো ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে। সে বছর যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। এটি ছিলো বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের উৎসমুখ খুলে গেলেও পাকিস্তান সরকার সব কিছু থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করে ছদ্ম সামরিক শাসন চালু করে। এ ধারায় নিষ্ঠ থেকে ১৯৬১ সালে জননেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে বের করা হয় গোপন লিফলেট ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’। স্বাধীনতা লাভের প্রেরণা থেকে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে আবদুল আজিজ বাগমার স্বাধীনতার তিনটি ইশতিহার প্রকাশসহ তৈরি করেন “অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার” সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। ইশতিহার তিনটির লেখক ছিলেনযথাক্রমে অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবদুল আজিজ বাগমার ও ড. আহমদ শরীফ। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় নিযুক্ত উপহাই কমিশনারের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্কশেখর ব্যানার্জির মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরুর কাছে একটি চিঠিতে বলা হয় যে, ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের মধ্যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রবাসী সরকার গঠন করবেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ও ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের উদ্ভাবন বাঙালির স্বাধীনতার বোধকে তীব্র করে তোলে। এ বছরে বাঙালি চেতনার অভিঘাতে প্রাদেশিক সরকার পয়লা বৈশাখ ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন নববর্ষ পালন করেছিলো ‘বাংলা একাডেমি,’‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ,’‘প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ,’‘সমাজকল্যাণ ছাত্র সংসদ,’‘গীতিকলা সংসদ’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৭ সালে ঢাকার রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ (প্রতিষ্ঠা : ১৯৬১)। ১৯৫৪ সালের রাজনৈতিক বিজয়কে‘বাঙালির নবজাগরণের ব্রহ্মমুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ।

পাকিস্তান সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কাজী মেতাহের হোসেন পয়লা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করার কথা বলেন।১৯৬১ সাল যদিও পয়লা বৈশাখ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্যে নয়, স্রেফ সাংস্কৃতিক জাগরণের সূত্রে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী অন্য রকম চেতনায় বাঙালি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো। সেদিন পয়লা বৈশাখের মতো জাতীয় অনুষ্ঠানে যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলো আজ তা ম্লান হয়ে পড়েছে। সে কারণে ১৯৮৯ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা করেন তার মধ্যে ‘নানা প্রাণীর অবয়ব ও মুখোশ বকধার্মিক ও ঐতিহ্যবিরোধীদের নানাভাবে আঘাত করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শিকড় স্পর্শ করে নতুন বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছি।’ (শামসুজ্জামান খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪-১৬)

আজকের দিনে বাংলাদেশের মানুষের একটা দাবি : বাংলা সালকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারির মতো ১৪ই এপ্রিলকে নববর্ষ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। সর্বভারতীয় পর্যায়ে ড. মেঘনাদ সাহা বাংলা পঞ্জিকার যে সংস্কার করেন, সেটির আদলে বাংলা একাডেমি একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করলেও ভারতে সেটি আজও প্রচলিত হয়নি। মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকাকে কিছু সংশোধন করে এস. পি. পা-ে কমিটি ১৪ই এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তবুও বিভেদ রয়েই গেছে।

বাংলা নববর্ষ একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি। এর পেছনে রয়েছে যেমন সংগ্রামী পটভূমি, তেমনি প্রতিবাদী মানবিক উৎস। সেই প্রতিবাদ ছিলো পাকিস্তান কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক শাসন যন্ত্রের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিবাদের সূত্র ধরে রমনার বটমূলে ছায়ানটেরনববর্ষোৎসবের আয়োজন। অবশ্য এর পেছনে ছিলো রাবীন্দ্রিক মিলন মহোৎসব রচনার অনিবার্য অভিঘাত। কেননা, রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই প্রাকৃতিক ও সর্বজনীন উৎসবের প্রধানতম কবি সার্বভৌম। এ দিনে সংহতির প্রশ্নে বাঙালি ঐক্যমন্ত্রে উজ্জীবিত হোক এবং যুব সমাজ শুধু নববর্ষের অনুষ্ঠানে নয়, যে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে যুক্ত করার মানে হবে জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রযাত্রা। আজকের দিনই হোক সেই যাত্রার শুভারম্ভ। শুভ নববর্ষ ১৪৩২।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সহকারি অধ্যাপক]

বিশ্ব রেড ক্রস দিবস

আত্মরক্ষার খালি-হাতের ইতিহাস ও আধুনিক বিস্তার

বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর : সমাজ সংস্কারের পথিকৃৎ

ছবি

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস “বিজয় বসন্ত“গ্রন্থের লেখক

ছবি

স্মরণ : কমরেড রূপনারায়ণ রায়

সাংবাদিক-সাহিত্যিক কাজী মোহাম্মদ ইদরিসের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকীতে কিছু কথা

রেসলিং

কোটা সমাচার

বাজেট ২০২৪-২৫: তথ্যপ্রযুক্তি খাতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যাত্রা শুরু হোক এবার

সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১: উন্নত ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন পূরণে বাংলাদেশের মহাকাশ জয়

ছবি

নাটোরের সম্ভাব্য জিআই পণ্য

রিলিফ

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

বঙ্গাব্দ প্রচলনের ইতিকথা

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব

কেউতো অপেক্ষায় নেই

ফরগেট মি নট

ছবি

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বীমা শিল্পের গুরুত্ব

একুশে ফেব্রুয়ারি আত্মপরিচয়ের দিন

দিদি, আপা, “বু” খালা

হিজল-করচ-আড়াংবন

ছবি

শেখ হাসিনা, এক উৎসারিত আলোকধারা

মনমাঝি

সেই ইটনা

ছবি

আংকর ওয়াট : উন্নত সভ্যতার স্মৃতিচিহ্ন যেখানে

নিয়ত ও নিয়তি

হারিয়ে যাওয়া ট্রেন

টম সয়ার না রবিনহুড

ছবি

‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’

বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতা স্মারক: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অনন্য মাইলফলক

রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনের পরিবর্তন আশু প্রয়োজন

কুয়েতের জীবনযাত্রার সাতকাহন: পর্ব-১-বিয়ে

বিবেকের লড়াই

ছবি

ছবি যেন শুধু ছবি নয়

tab

মুক্ত আলোচনা

পয়লা বৈশাখ : বাঙালির সংহতি চেতনার সংস্কৃতি

সুরঞ্জন রায়

রোববার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

মানুষের, বিশেষত হোমো স্যাপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষের, পরিব্রাজন শুরু হয়েছিলো প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। তারা জীবন ধারনের প্রয়োজনে পৃথিবীর নানা জায়গা থেকে নানা কিছু শিখেছে। একদিন সভ্যতার দোরগড়ায় পৌঁছে সবিস্ময়ে ‘আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ’-এর মাঝখানে তারা আবিষ্কার করল নানা বিষয়।এরপর পৃথিবী ছেড়ে সেই মহাকাশ জয়ের প্রত্যাশায় কতই না চেষ্টা করে চলেছে। সে চলমানতার ধারায় দৈনন্দিন জীবনকে কাঠামোবদ্ধ করার অভিপ্রায় থেকে আকাশের তারা, নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্যের গতিকে কেন্দ্র করে বৎসর, মাস, দিন, ক্ষণ গণনা করতে শুরু করল। এভাবে পৃথিবীর নানা দেশের মানুষেরা নানা দিক থেকে বর্ষপঞ্জি সম্পর্কে বিশেষ বিশেষ অবদান রেখেছে। তাদের সব পঞ্জিকার ধরন সম্পর্কে অবহিত হওয়াও সম্ভবপর নয়। সে জন্যে এ প্রবন্ধের সীমা সৌরবর্ষ, চান্দ্রবর্ষ, হিজরিবর্ষ, জুলিয়াস সিজারের-এর বর্ষসংস্কার, পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির বর্ষসংস্কার ছাড়া রাজা শশাঙ্কের বঙ্গাব্দের সূচনা ও সম্রাট আকবরের ফসলি সন নিয়ে আলোচনাসহ নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে, নববর্ষ উৎসবকে ইহজাগতিক হয়ে ওঠা এবং এর পেছনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সম্পর্কে দেখার চেষ্টা থাকবে।

বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা

পঞ্জিকা ও দিনপঞ্জি বা বর্ষপঞ্জির ভিন্নতা আছে। পঞ্জিকাকে ইংরেজিতে বলা হয় Almanac, আর, দিনপঞ্জিকে বলা Calender। Almanac-এ থাকে বৎসরের বার, সপ্তাহ, তিথি, নক্ষত্র, যোগ, রাশিফল, জোয়ার-ভাঁটা, চন্দ্র-সূর্যের উদয়-অস্ত, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ প্রভৃতি। যে কারণে হিন্দু পঞ্জিকাকে “পঞ্চাঙ্গ” বলা হয়েছে। আর, Calender-এ থাকে একটি বছরের দিন, সপ্তাহ, মাস, যা দেয়ালে টানিয়ে রাখা যায়। নাগরিক জীবনে এখনও পর্যন্ত বর্ষপঞ্জি একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। দিন-মাসের গণনা ছাড়া পালা-পার্বণ, ধর্মীয় উৎসব, জাতীয় দিবস, ছুটির তালিকা, আর হিন্দুদের দিন, ক্ষণ, তিথি, নক্ষত্রসহ পূজাপার্বণের সময় ও শুভ-অশুভ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পঞ্জিকার প্রয়োজন অপরিহার্য। (অজয় রায়, ‘প্রাচীন ভারতীয় বর্ষপঞ্জি : একটি সমীক্ষা,’ শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত,বাংলাসন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, পৃ. ২) এ-সব চিন্তা মাথায় রেখে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বর্ষপঞ্জি তৈরি করে যাচ্ছেন। কিন্তু বার বা সপ্তাহ ও দিনের প্রথম ব্যবহার করেন সম্ভবত ক্যালেডিয়ান জ্যোতির্বিদগণ। সাত বারকে সাতটি জ্যোতিষ্কের নামে নামকরণ করেন তাঁরা। ৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত স¤্রাট বুদ্ধগুপ্তের একটি উৎকীর্ণ লিপিতে সপ্তাহভিত্তিক দিনের নাম প্রথম উল্লিখিত হয়।

বর্ষপঞ্জির প্রাচীনত্বও বর্ষপঞ্জি সংস্কার

অনেকে বলতে পারেন : হলকর্ষ বা হালখাতা থেকে, কিংবা বিভিন্ন লোকাচার থেকে বর্ষগণনার সূত্রপাত। পরবর্তীকালে এ-সব অনুষঙ্গ বা লোকসংস্কৃতি হিসেবে যুক্ত হলেও, বর্ষগণনা বা নববর্ষ পালনের নিয়ামক নয়। ভারতবর্ষে আর্যদের আগমনের অনেক আগে থেকে রোমের অধিবাসী ও সম্রাটদের মধ্যে বর্ষগণনার প্রথা প্রচলিত ছিলো। তখন রোমানদের বৎসর ছিলো ৩০৪ দিনের মধ্যে সীমিত। মাস ছিলো ১০টি। পরবর্তীকালে রাজা নুসা পম্পিলিয়াস খ্রিস্ট পূর্ব ৭৯৩ অব্দে ৩০৪ দিনের সঙ্গে ৬০ দিন যোগ করেন। আর, জুলিয়াস সিজার ১০ মাসের সঙ্গে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি যোগ করে ১২ মাসে বছর নির্ধারণ করেন। তখনকার দিনে বৎসর আরম্ভ হতো মার্চ মাস থেকে। ইরানে মার্চ মাসের ২১ তারিখ থেকে বর্ষগণনার সূত্রপাত হয় এবং সেখানে ইসলামের আমলেও সৌর সাল প্রচলিত ছিলো। রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজার এ মাসের নামকরণ চূড়ান্ত করেন ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দেলাতিন শব্দ ‘মার্তিয়াস,’ বা রোমানদের যুদ্ধের দেবতার নাম থেকে। রোমানদের মাসের নামগুলো দেবদেবী নির্ভর। শুধু জুলিয়াস সিজারের পর তাঁর ভাইপো অগাস্টাস সিজারের নামে আগস্ট, সেপ্টেম্বরের septem মানে সাত, octo হলো আট, novem নয়, আর, decem হলো দশ। এভাবে দশ মাসের নামকরণ করা হয়েছিলো। এখনকার হিসেবে এ নিয়ম নেই।

অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে শুধু ভারতবর্ষের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে আর্যভারতে প্রায় ২৫ প্রকার অব্দের বা বর্ষগণনার প্রচলন ছিলো। তার মধ্যে ঋগৈ¦দিক পর্বে বসন্তকে প্রথম ঋতু হিসেবে গণনা করা হতো। তখন ঋতুই ছিলো বর্ষ গণনার সূচক। ৩৬০ সাবন দিনে (civil days) হতো এক বছর এবং ৯০ দিন করে চারটি ঋতু ছিলো। এক সূর্যোদয় থেকে পরবর্তী সূর্যোদয় পর্যন্ত হতো এক দিন। (বেলাবাসিনী গুহ ও অহনা গুহ, ঋগে¦দ ও নক্ষত্র, পৃ. ৬৩-৬৪)তখন ঋতু ছিলো বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। মানুষেরা সুপ্রাচীনকাল থেকে সূর্যের বিভিন্ন অবস্থিতি, যেমন, বাসন্ত বিষুব, দক্ষিণায়ন দিন, শারদ বিষুব, উত্তরায়ণ দিন সম্পর্কে জানার যে চেষ্টা করেছে, তার প্রমাণ হলো ইংল্যান্ডের Stoneheng, যা ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কথা। এই চতুঃসীমার মধ্যে দিন গণনা করে ক্যালডিয়ান ও গ্রিক জ্যোতির্বিদগণ মাসের মোট হিসেব পেয়েছিলেন।

বসন্ত গ্রীষ্ম শরৎ শীত মোটদিন

ক্যালডিয়ানÑ ৯৪.৫০ ৯২.৭৩ ৮৮.৫৯ ৮৯.৪৪ = ৩৬৫.২৬

গ্রিকÑ ৯৪ ৯২ ৮৯ ৯০ = ৩৬৫

ঋগে¦দে প্রথমে তিনটিঋতু, যেমন, গ্রীষ্ম ঋতু : চৈত্র, বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়; বর্ষা ঋতু : শ্রাবণ, ভাদ্র, আশি^ন, কার্তিক, আর, হেমন্ত ঋতু : অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, পরে পাঁচটি এবং সবশেষে ছয়টি ঋতুর আভাস দেয়া হয়েছে। তৈত্তিরীয় (১।৫।২) ও শতপথ ব্রহ্মণে (২।১।৩) বলা হয়েছে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ঋতু তিনটি দেবগণ, এবং শরৎ, হেমন্ত ও শিশির হলো পিতৃগণ। রোমানরা মাসের নামকরণ করেছিলো বিভিন্ন দেবদেবী, গাণিতিক সংখ্যা ও স¤্রাটের নামে, ভারতে প্রচলিত মাসের নামকরণ করা হয়েছিলো নক্ষত্রের নামে। অর্থাৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা থেকে সূর্যের অবস্থান সাপেক্ষে এ জাতীয় নামকরণ। এ নিরিখে বলা যায়, পাশ্চাত্য পঞ্জিকার সঙ্গে ভারতীয় পঞ্জিকার আছে বড়ো ব্যবধান।

প্রত্যেক অব্দ গণনার পেছনে একটি কাল পরিমাপনের প্রসঙ্গ বিন্দু থাকে। সেটি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে প্রসঙ্গ বিন্দু হিসেবে ধরা যেতে পারে। যেমন, খ্রিস্টীয় অব্দ গণনার ক্ষেত্রে যিশু খ্রিস্টের জন্মের সময়কে গ্রেগরীয় অব্দের প্রারম্ভ বিন্দু হিসেবে ধরা হয়েছে। অথবা, কোনো রাজার সিংহাসনে আরোহন করার সময়কে কাল পরিমাপন হিসেবে ধরা হয়। প্রাচীন ভারতে নানা ঘটনাকে কেন্দ্র করে কয়েকটি অব্দের প্রচলন আছে। আলবেরুনী তাঁর গ্রন্থে কয়েকটির উল্লেখ করেন, যেমন, শ্রীহর্ষাব্দ, বিক্রমাব্দ, শকাব্দ, বলভাব্দ ও গুপ্তাব্দ প্রধান। বিক্রমাব্দ বাংলাদেশ ছাড়া উত্তর ভারত জুড়ে প্রচলিত ছিলো এবং এখনো বর্তমান। কথিত আছে উজ্জয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য এই অব্দের প্রচলন করেন। তিনি ৫৭ খ্রি. পূর্বাব্দে শকদের বিতারণ করেছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে বিক্রমাব্দের প্রচলন হয়। এ অব্দ সম্পর্কে একটা ভিন্ন মত প্রচলিত আছে, যেমন, ‘শকাব্দ’-এর প্রচলন করেছিলেন কুশান রাজা কনিষ্ক। পরে এটি রাজা বিক্রমাদিত্যের শক বিজয়ের বছর থেকে গণনা করা হয়। এ অব্দকে সংবৎও বলা হয়।উপরি-উক্ত বিষয়টিকে জনশ্রুতি হিসেবে ধরা হয়। এর পাশাপাশি উত্তর ভারতে গুপ্তাব্দের প্রচলন ছিলো, ৫২০ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তদের ক্ষমতা চলে যাবার পর লুপ্ত হয়ে যায়। সম্ভবত গুপ্তাব্দের প্রচলন হয়েছিলো ৩১৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকে। এরপর হর্ষাব্দ চালু হয় হর্ষবর্ধনের সময় থেকে। (অজয় রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১) এছাড়া লক্ষণাব্দ, জালালি সন, ত্রিপুরাব্দ প্রভৃতি প্রচলিত ছিলো।

সন ও সালের প্রথমটি আরবি, দ্বিতীয়টি ফারসি। দুটোর অর্থ একই। কিন্তু বিশ্ববিশ্রুত পণ্ডিত সিভ্যাঁ লেভি আনুমানিক ‘৫৯৫’ খ্রিস্টাব্দে বাংলা অব্দের সঙ্গে ‘সন’ শব্দটির সাদৃশ্য দেখতে পান তিব্বতী রাজা রি স্রঙ-সনের বা তাঁর ছেলে স্রঙ-সন-গাম-পোর নামের সঙ্গে। ‘সন’ শব্দের সঙ্গে মিল থাকলেও তিব্বতে কোনো অব্দ বোঝাতে এ নামটি ব্যবহৃত হয়নি। এক সময় জ্যোতিষ্কভাস্কর মহামুনি ভৃগুর সিদ্ধান্ত মতে পঞ্জিকা প্রচলিত হয়। সেই পঞ্জিকায় বৈশাখ মাসের নাম তিনি রাখেন মধুসূদন (৩১), জ্যৈষ্ঠ- ত্রিবিক্রম (৩২), আষাঢ়- বামন (৩১), শ্রাবণ- শ্রীধর (৩২), ভাদ্র- ঋষিকেশ (৩১), আশ্বিন- পদ্মনাভ (৩০), কার্তিক- দামোদর (৩০), অগ্রহায়ণ- কেশব (৩০), পৌষ- নারায়ণ (২৯), মাঘ- মাধব (২৯), ফাল্গুন- গোবিন্দ (৩০) ও চৈত্র- বিষ্ণু (৩১)।

গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও বঙ্গাব্দ

১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি একটি বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন। এ বর্ষপঞ্জিটি ছিলো সৌর বৎসরকে কেন্দ্র করে। অনেক ভ্রান্তি সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে এ ক্যালেন্ডারটিকে বাংলা বর্ষপঞ্জির সঙ্গে একীভূত করে ফেলা হয়েছে। এ পঞ্জিকা আমেরিকা ও ব্রিটেনে গৃহীত হয় ১৭৫২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি গ্রহণের কারণ হলো : আগে জুলিয়ান নামক এক সম্রাট বর্ষপঞ্জি গণনায় একটি মহাবিষুব থেকে আর একটি মহাবিষুবের সময়কাল ধরেছিলেন ৩৬৫.২৫ দিন, যা ছিলো ১১ সেকেন্ড কম। এর ফলে ৪০০ বছর অন্তর তিন দিনের ব্যবধান হতো। সেই জন্যে পঞ্জিকা সংশোধনের কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রচলিত আছে যুগপৎ সৌর ও চান্দ্র বছর। গ্রেগরীয় পদ্ধতিকে স্বীকরণ করার ফলে খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে বঙ্গাব্দের মিশ্রণ ঘনিষ্ঠতর হয়েছে।কারণ হিন্দুদের পূজা-পার্বণ তিথিভিত্তিক বলে গ্রেগরীয় বঙ্গাব্দ মেনে সব কিছু করা সম্ভবপর হলেও, মুসলিমপর্ব চান্দ্রবর্ষের এদিক ওদিক হওয়ার নয়। উপমহাদেশে একজন হিন্দু নাগরিকের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় ১. গ্রেগরীয় পঞ্জিকার দ্বারা, ২. সৈদ্ধান্তিক সৌর পঞ্জিকা দ্বারা, ৩. সৈদ্ধান্তিক চান্দ্র পঞ্জিকা দ্বারা। অপরদিকে, একজন মুসলিম নাগরিকের জীবন চালিত হয় গ্রেগরীয় ও ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকা বা হিজরি পঞ্জিকা দ্বারা।

এই বৈষম্য দূর করার জন্যে সর্বভারতীয় একটি বর্ষপঞ্জি ১৯৫৫ সালে প্রথম শুরু হয় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার (১৮৯৩-১৯৫৬) সভাপতিত্বে। তিনি ‘শকাব্দ’কে ধরে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস ৩১ দিনে এবং বাকি আশ্বিন থেকে চৈত্র মাসকে ৩০ দিনে ধরে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করেন। অধিবর্ষ, মলমাস, ক্ষয় মাস বা Leap year-এর ক্ষেত্রে প্রতি চার বছর অন্তর একদিন বাড়িয়ে দিয়ে বর্ষগণনার নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন। মলমাস বা অধিবর্ষ শুধু্ৃ ঋগ্বৈদিক আমলে নয় অনেক আগে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিতেও উল্লিখিত হয়েছে। এদিক থেকে বাংলাদেশে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার ও বাংলা বর্ষপঞ্জি মিলেমিশে প্রচলিত আছে।

বঙ্গাব্দ ও পঞ্জিকা সংস্কার

বঙ্গাব্দ বাংলা সন হিসেবেই প্রচলিত, কিন্তু এটি কোনো মৌলিক অব্দ নয়। এর সঙ্গে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি, হিজরি, শকাব্দ প্রভৃতি দেশি বিদেশি বর্ষপঞ্জি মিশে আছে। বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বলে এই সমতা যথার্থ কিনা তা গবেষণার বিষয়। তবে সমতা থাকলেও স্থানিক প্রভাবজনিত কিছু সংযোজন যে হয়নি তা নয়। বঙ্গাব্দের কথা উঠলে মহামতি আকবর বাদশার ইলাহি অব্দের কথা বলতেই হয়। এর আগে অবশ্য কয়েকজন পণ্ডিত শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দের সূচনাকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সুনীলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এ সম্পর্কে তিনি বলেন যে, ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল (১লা বৈশাখ, সোমবার) বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। কেননা, ওই দিন শশাঙ্ক গৌড়-বঙ্গে রাজত্ব আরম্ভ করেন। দুঃখের বিষয়, এ সম্পর্কে প্রমাণযোগ্য যথেষ্ট তথ্য বা সূত্র পাওয়া যায়নি।

আর একজন হলেন মিথিলার রাজা শিবসিংহ। তাঁর এক লেখে চারটি তারিখ দেয়া আছে। সেগুলো হলো- ল সং ২৯২, শক ১৩২১, সম্বৎ ১৪৫৬, সন ৮০৭। কিন্তু এ লেখের সালটিও যথার্থ প্রমাণের অভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। সংস্কারকদের মধ্যে বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহী বংশের আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)-র নামও উঠে আসে। কিন্তু এটি প্রমাণিত হয়েছে একটি প্রবাদ হিসেবে। অবশ্য হোসেন শাহ্র আমল বা তার কিছু পরে হিজরি অব্দ ছাড়া ‘পরগণাতি সন’ নামে একটি সনের প্রচলন ছিলো। সেটি ১২০১-২ খ্রিস্টাব্দ থেকে গণনা করা হতো। বল্লাল সেনের নামে ‘বলালী সন’-এর প্রচলন ছিলো, কিন্তু সত্যিকার অর্থে তার অস্তিত্ব নেই। তবে বাংলায় শকাব্দ, হিজরি, কোথাও বা লক্ষ্মণ সেন সম্বৎসরের অর্থাৎ ল-সং-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারনা মুঘল সম্রাট আকবরের আমলেই ইলাহি অব্দের প্রচলন হয়। অন্তত আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরীতে সে রকমই উল্লেখ আছে।

আকবর বহুদিন ধরেই হিন্দুস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে [দিন গণনার] সমস্যাকে সহজ করে দেবার জন্য এক নূতন বৎসর ও মাস গণনাক্রম প্রবর্তন করতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি হিজরা [অব্দ] ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। ... আমীর ফত্হুল্লাহ্ শিরাজীর প্রচেষ্টায় এই অব্দের প্রবর্তন হল। এর বৎসর ও দিনগুলি স্বাভাবিক সৌর, অধিবর্ষহীন। পারসীক মাস ও দিনগুলির নামের কোনও পরিবর্তন হয়নি। মাসিক দিনগুলির সংখ্যা ২৯ থেকে ৩২ এবং শেষের মাসের [শেষ] দুদিন রোজ-ও-শব্ (দিন ও রাত্রি) নামে পরিচিত। ... ইলাহী [দৈব] অব্দের মাসগুলি হচ্ছে ফরওরদিন, অর্দিবিহিষ্ট, খুবর্দাদ, তির, অমুরদাদ, শারেবার, মিহ্র, আবান, আজব, দয়, রহ্মন ও ইস্ফন্দারমাজ্। (ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত, পৃ. ৮২-৮৩)

অন্য অধ্যায়ের এক স্থানে বলা হয়েছে :

স¤্রাট ২৯ দৈব বৎসরের (প্রকৃতপক্ষে রাজ্য বর্ষের) এবং হিজরি অব্দের ৮ই রবিউল আউয়াল, বুধবার রাত্রির কিছু সময় অতিক্রান্ত হলে পর সূর্য মেষ রাশিতে প্রবেশ করে এবং সমান দিন ও রাত্রির (অর্থাৎ মহাবিষুব দিবসের) শুরু হয়। ... এই বৎসরের প্রারম্ভে (অর্থাৎ ২৯তম রাজ্য বর্ষে) ইলাহি অব্দ প্রবর্তিত হয়েছিল। (অজয় রায়, প্রগুক্ত, পৃ. ৩৫)

আকবরনামায় উল্লেখ আছে, ‘৯৬৩ হিজরি সনের ২রা রবিয়াস্্সানি শুক্রবার প্রায় দ্বিপ্রহরের সময় (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ, ১৪ ফেব্রুয়ারি) স¤্রাট সিংহাসনে আরোহন করেন।’আর তাঁর পিতা হুমায়ুনের মৃত্যু হয় ১৫৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারিতে। আকবর সিংহাসনে বসেন ১৫৫৬ সালে ১০ বা ১১ মার্চ। এই আরোহনের তারিখ নিয়ে একটা মতান্তর দেখা দিলেও এ কথা সত্যি যে, এ সময় থেকে ফসলি সন বা ইলাহি সন গণনা শুরু হলেও এটি প্রযুক্ত হয়েছিলো রাজত্বের ২৮ কী ২৯ তম বছর থেকে। এ প্রসঙ্গে ড. আহমদ শরীফ বলেন যে, বৈরাম খানের অভিভাবকত্ব থেকে আকবর মুক্ত হন ১৫৬০ সালের দিকে। তখন আকবরের বয়স ১৮ বা ২০। ১৫৭৫ থেকে ১৬১৬ সাল পর্যন্ত তাঁকে বারো ভুঁইয়াদের সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলে লড়াই করতে হয়। এর মধ্যে ইলাহি সাল চালু করা আদৌ সম্ভব কিনা,আরও বঙ্গদেশে, তা ভেবে দেখা দরকার। আর, এ সালটিকে ‘বঙ্গাব্দ’ বলার যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক কারণ কী? ‘বঙ্গ’ একটি অঞ্চল মাত্র। হিজরি অব্দ বাদ দিয়ে ইলাহি অব্দ প্রচলনে মুসলিমদের আপত্তি ও দ্রোহের আশঙ্কা তাঁর ছিলো। কিন্তু যে আকবর মুসলিম সন্তান হয়ে কুরআন, হাদিসকে উপেক্ষা করে ‘দ্বীন-ই-ইলাহি’ মত প্রচারে দ্বিধা করেননি, তিনি ইলাহি সন প্রতিষ্ঠার জন্যে কাউকে পরোয়া করবেন, এটি ভাবা যায় না।তখন বাঙলা ও বঙ্গ নামে দেশ বা অঞ্চলের পরিচিতি থাকলেও, বাংলার ঠিক কোন অঞ্চলে ইলাহি সনের প্রচলন হয়েছিলো, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। এমনকি, কোন অঞ্চলটি বঙ্গ তাও নির্দিষ্ট করে বলা যায়নি। (আহমদ শরীফ, ‘বঙ্গাব্দের উদ্ভব কবে ও কোথায়?’ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৪-৭৫)

বঙ্গাব্দের সঙ্গে তারিখ-ই-ইলাহি সনের সম্পৃক্ততা আছে। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞানী জ্যোতিপদার্থবিদ ড. মেঘনাদ সাহার মন্তব্য শোনা যেতে পারে। ড. সাহা বলেন :

In 1079 A.D. Sultan Jalaluddin Melik Shah of Iran introduces solar calendar of Iran, and this was introduced by Emperor Akber in India in 1584 A.D. under the name tarik-i-ilahi, Akber’s calendar was used to date all events from his accession (1556 A.D.) and was official calendar during the reign of Jahangir and early part of Sahjahan’s reign when it fell into disuse. Butit gave rise to a number of hybrid Era like the ÔBengali SanÕ and of ÔFasliÕ Era which are still in use. (M.N. Saha, `The Reform of the Indian Calendar,’ Presidential Addresses of the Indian Astronomical and Astrophysical Society, 1952; the indian Science News Association, 1952)

বস্তুত ড. সাহার নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ভারত সরকার বর্ষপঞ্জি সংস্কার কমিটির সুপারিশ গ্রহণ করে। সেখানে ‘শকাব্দে’র সংস্কার সাধন করা হয়। যেমন,

০১. ক. ১৯৫৭ খিস্টাব্দের ২২ মার্চকে [মহাবিষুব সংক্রান্তি (vernal equinox) পর দিন] ধরা হরে ১৮৭৯ শকাব্দের প্রথম মাস : ১লা চৈত্র।

০২. মাসের দিনের সংখ্যা হবে

প্রথম মাস চৈত্র : ৩০ দিন

পরবর্তী ৫ মাস (বৈশাখ থেকে ভাদ্র) হবে : প্রতিটি ৩১x৫ = ১৫৫ দিন

পরবর্তী ৬ মাস (আশ্বিন থেকে ফাল্গুন) : প্রতিটি ৩০x৬ =১৮০ দিন

অর্থাৎ সাধারণ বর্ষ হবে ৩৬৫ দিনে।

০৩. অধিবর্ষে (leap year) প্রথম চৈত্র মাস হবে ৩১ দিনে। অর্থাৎ অধিবর্ষ হবে ৩৬৬ দিনে।

ড. সাহার সুপারিশকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমিও ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নেতৃত্বে ‘বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার’-এর উদ্যোগ নেয়। যাকে বলা হয় ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’। এ কমিটির সুপারিশগুলো নিম্নরূপ :

০১. বর্তমান বাংলা মাসের তারিখ গণনা অত্যন্ত দুষ্কর বিধায় ১৩৭১ সালে (১৯৬৪ সালের ১৪ই এপ্রিল) বৈশাখ হইতে প্রতিবছর ভাদ্রমাস পর্যন্ত এই ৫ মাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত এই ৭ মাস ৩০ দিন ধরে গণনা করা হউক।

২. যেহেতু ১৩৬৯ অধিবর্ষ (লিপ ইয়ার) গণনা করা হইয়াছে এ বর্ষ হইতে প্রতি ৪র্থ বৎসরে ১ দিন বৃদ্ধি পাইয়া চৈত্রমাস ৩১ দিনে গণনা করা হউক। (১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ই জুন তারিখে গৃহীত)

উল্লেখ্য যে, ১৩৬৯ বাংলা সনের প্রাতিষঙ্গিক প্রেগরি বর্ষ ছিল নিম্নরূপ :

১লা বৈশাখ- ১৭ই পৌষ (১৩৬৯) : ১৩৬৯+৫৯৩ = ১৯৬২ (১৪ই এপ্রিল- ৩১ শে ডিসেম্বর)

১৮ই পৌষ- ৩০ শে চৈত্র (১৩৬৯) : ১৩৬৯+৫৯৪ = ১৯৬৩ (১লা জানুয়ারি- ১৩ই এপ্রিল)

এ পঞ্জিকা সংস্কার করা হলেও লিপ ইয়ার নিয়ে একটা সমস্যা থেকে গেছে। যে সংখ্যাটি প্রতি চার বছর অন্তর ৪ দ্বারা বিভাজ্য সেটি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ হয়। কিন্তু শহীদুল্লাহ কমিটির উল্লিখিত ১৯৬২ বা ১৯৬৩ যেমন লিপ ইয়ার নয়, তেমনি বাংলা ১৩৬৯ও লিপ ইয়ার নয়। এটিই এ কমিটির একটি দুর্বলতার দিক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সরকারি কাগজে বাংলায় নোট লেখা, স্বাক্ষর করা এবং তারিখ প্রদানের প্রথা চালু করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমানও এ কাজটি আরও জোরদার করেন। অবশেষে ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ইংরেজি সালের পাশাপাশি বাংলা সাল তারিখ লেখার নির্দেশ জারি করেন। এবং ১৯৮৮-৮৯ অর্থ বছরে শহীদুল্লাহর কমিটির সুপারিশ কৃত বাংলা ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ দেয়া হয়। (অজয় রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৮-৩৯)

বিভিন্ন সময় নববর্ষ উদ্যাপন ও ছুটি ঘোষণা

বাংলা বর্ষবরণ অতি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে, কিন্তু কবে থেকে তা বলা মুশকিল। এটি যেমন একটি উৎসব তেমনি পুণ্যকর্মের সূচকও বটে। আজ যেমন পয়লা বৈশাখকে গ্রেগরীয় পঞ্জিকার সূত্র ধরে উদযাপনের দিন হিসেবে নেওয়া হয়েছে, একদিন অগ্রহায়ণ মাসেও নববর্ষ পালিত হতো (অগ্র = প্রথম, হায়ণ = বছর )। ড. নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, নবান্নই ছিলো বাঙালি কৃষকের নববর্ষের উৎসব। ভারতের মহারাষ্ট্রে পঞ্জিকা সংস্কারের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয়। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক, শঙ্করলাল দীক্ষিত, ভেংকটেশ বাপুশাস্ত্রী কেতকর প্রমুখ। আর, বাংলায় যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি। নববর্ষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রাচীনকালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে নববর্ষের উৎসব হতো। দোলযাত্রা বা হোলি সেই উৎসবের স্মারক।’

রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের সময় রাখীবন্ধন, অরন্ধন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বাঙালিকে দ্বিধাবিভক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে চাইলেও, আজকের দিনে রবীন্দ্র বিদূষণের মতো সেদিনও বিদূষণক্রিয়া থেমে থাকেনি। বরং সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দিয়ে যাঁরা দ্বিধাবিভক্তির চিহ্ন এঁকে দিয়েছিলেন, তাঁরা যেমন কেউ বাঙালি ছিলেন না, তেমনি ভাষাগত দিক থেকে ছিলেন উর্দুভাষী। তাঁদের মন্ত্রণায় এবং ব্রিটিশ শাসনের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির কারণে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজিত হলো। তার আগে ও পরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে অনেকবার। অনেকবার বলা হয়েছে পয়লা বৈশাখ হৈন্দুক। এরকম বোধ সত্ত্বেও বাঙালি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যুদ্ধ করলেও, মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর পরে এ জাতির বৃহৎ সংখ্যাকে সংস্কৃতির ছত্রছায়ায় আনা সম্ভবপর হয়নি। প্রশাসনের ছত্রছায়ায় কিছু সংখ্যক মুক্তমনা মানুষের আয়োজন যে আয়োজন নয়, সে বিষয়েও ভাবতে হবে। গায়ের জোরে নয়, প্রেমের জোরে, সংস্কৃতির জোরে আম জনতাকে সামিল করাই কিন্তু নববর্ষের প্রতিপাদ্য। কেননা, একদিন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নববর্ষের উৎসব পালন করত। এর সঙ্গে ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক অনুষ্ঠান চিরকাল অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এ দিন হলকর্ষ, পুণ্যাহ, বার্ষিক মেলা, হালখাতা, স্থানীয়ভাবে আমানি, গম্ভীরা, বলীখেলা, ঘোড়দৌড়, গরুর দৌড়, নৌকা বাইচে শরিক হতো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে।

তবে সেদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজিত ধর্মভিত্তিক পূর্ব বাংলায় যে সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের চেষ্টা হয়নি, তা নয়। এবং সেটির রাজনৈতিক প্রমাণ দিয়েছিলো ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে উৎখাত করার মধ্য দিয়ে। সে বছর যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন। এটি ছিলো বাঙালির জাতিগঠন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুস্পষ্ট পথনির্দেশ। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণের উৎসমুখ খুলে গেলেও পাকিস্তান সরকার সব কিছু থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করে ছদ্ম সামরিক শাসন চালু করে। এ ধারায় নিষ্ঠ থেকে ১৯৬১ সালে জননেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে বের করা হয় গোপন লিফলেট ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’। স্বাধীনতা লাভের প্রেরণা থেকে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে আবদুল আজিজ বাগমার স্বাধীনতার তিনটি ইশতিহার প্রকাশসহ তৈরি করেন “অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার” সংক্ষেপে ‘অপূর্ব সংসদ’। ইশতিহার তিনটির লেখক ছিলেনযথাক্রমে অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আবদুল আজিজ বাগমার ও ড. আহমদ শরীফ। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় নিযুক্ত উপহাই কমিশনারের পলিটিক্যাল অফিসার শশাঙ্কশেখর ব্যানার্জির মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরুর কাছে একটি চিঠিতে বলা হয় যে, ১৯৬৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চের মধ্যে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রবাসী সরকার গঠন করবেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ও ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের উদ্ভাবন বাঙালির স্বাধীনতার বোধকে তীব্র করে তোলে। এ বছরে বাঙালি চেতনার অভিঘাতে প্রাদেশিক সরকার পয়লা বৈশাখ ছুটি ঘোষণা করে। সেদিন নববর্ষ পালন করেছিলো ‘বাংলা একাডেমি,’‘পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ,’‘প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ,’‘সমাজকল্যাণ ছাত্র সংসদ,’‘গীতিকলা সংসদ’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান। বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৭ সালে ঢাকার রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ (প্রতিষ্ঠা : ১৯৬১)। ১৯৫৪ সালের রাজনৈতিক বিজয়কে‘বাঙালির নবজাগরণের ব্রহ্মমুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন কেউ কেউ।

পাকিস্তান সাহিত্য পরিষদের সভাপতি কাজী মেতাহের হোসেন পয়লা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করার কথা বলেন।১৯৬১ সাল যদিও পয়লা বৈশাখ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্যে নয়, স্রেফ সাংস্কৃতিক জাগরণের সূত্রে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী অন্য রকম চেতনায় বাঙালি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলো। সেদিন পয়লা বৈশাখের মতো জাতীয় অনুষ্ঠানে যে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলো আজ তা ম্লান হয়ে পড়েছে। সে কারণে ১৯৮৯ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা যে মঙ্গল শোভাযাত্রা করেন তার মধ্যে ‘নানা প্রাণীর অবয়ব ও মুখোশ বকধার্মিক ও ঐতিহ্যবিরোধীদের নানাভাবে আঘাত করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের শিকড় স্পর্শ করে নতুন বাঙালিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছি।’ (শামসুজ্জামান খান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪-১৬)

আজকের দিনে বাংলাদেশের মানুষের একটা দাবি : বাংলা সালকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়ে ২১ শে ফেব্রুয়ারির মতো ১৪ই এপ্রিলকে নববর্ষ হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া। সর্বভারতীয় পর্যায়ে ড. মেঘনাদ সাহা বাংলা পঞ্জিকার যে সংস্কার করেন, সেটির আদলে বাংলা একাডেমি একটি বর্ষপঞ্জি তৈরি করলেও ভারতে সেটি আজও প্রচলিত হয়নি। মেঘনাদ সাহার পঞ্জিকাকে কিছু সংশোধন করে এস. পি. পা-ে কমিটি ১৪ই এপ্রিলকে পয়লা বৈশাখ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তবুও বিভেদ রয়েই গেছে।

বাংলা নববর্ষ একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি। এর পেছনে রয়েছে যেমন সংগ্রামী পটভূমি, তেমনি প্রতিবাদী মানবিক উৎস। সেই প্রতিবাদ ছিলো পাকিস্তান কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক শাসন যন্ত্রের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিবাদের সূত্র ধরে রমনার বটমূলে ছায়ানটেরনববর্ষোৎসবের আয়োজন। অবশ্য এর পেছনে ছিলো রাবীন্দ্রিক মিলন মহোৎসব রচনার অনিবার্য অভিঘাত। কেননা, রবীন্দ্রনাথই ছিলেন এই প্রাকৃতিক ও সর্বজনীন উৎসবের প্রধানতম কবি সার্বভৌম। এ দিনে সংহতির প্রশ্নে বাঙালি ঐক্যমন্ত্রে উজ্জীবিত হোক এবং যুব সমাজ শুধু নববর্ষের অনুষ্ঠানে নয়, যে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠানে যুক্ত করার মানে হবে জাতির জাতীয় জাগরণের অগ্রযাত্রা। আজকের দিনই হোক সেই যাত্রার শুভারম্ভ। শুভ নববর্ষ ১৪৩২।

[লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সহকারি অধ্যাপক]

back to top