বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়।
এর আগে, ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে ১৯৭২ সালে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন সচিবের এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বাংলাদেশে।
১৯৭২ সালে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে ২০% ছিল মেধা কোটা এবং বাকি ৮০% জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার মাঝে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% ক্ষতিগ্রস্ত নারী কোটা ও ৪০% জেলা কোটা রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে আনুমানিক ১৫২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও ১৯৭৯ সালে শুধুমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়েয় কারণে তাঁদের বেশিরভাগই পদোন্নতি পাননি।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই সোনার বাংলাদেশে শুরু হয় কালো অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময় ১৯৭৫-৯৬ সাল থেকে দীর্ঘ ২১ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নেমে আসে দুর্বিষহ অত্যাচার। এ সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরুপে ব্যাহত হয়। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা তদুপরি সর্বমহলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
স্বাধীনতার সূর্য-সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের সন্তানাদিদের পড়াশোনা করানোর মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। অর্থনৈতিক দৈন্য দশা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়ানোসহ সব মিলিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৭৫ এর পরবর্তী ২১ বছর সকল প্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। এমনকি তাঁরা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত হারিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অতি নগণ্য পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আত্মগোপনে থাকা শিক্ষিত গোষ্ঠীকেই পরবর্তীতে আমলা নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ পদে অধিষ্ঠ করা হয়েছিল। ৯ মাস যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তা আজো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে যেই পুনর্বাসন মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায্য অধিকার ছিল, দুই দশকের বেশি সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য রাষ্ট্র এই কর্তব্যটুকু পালনে ব্যর্থ ছিল।
১৯৮৫ সালে আবারও পরিবর্তন আনা হয় কোটা ব্যবস্থায়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ, জেলা কোটায় ১০ শতাংশ ও নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয় ৫ শতাংশ কোটা।
১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার আশার আলো দেখলো। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য আবার কোটা চালু করেন। সাথে সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি যখন ক্ষমতায় আসলেন ততদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ, এই কোটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কাজে আসলো না। তখন,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ১৭ মার্চ এ কোটা সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত করলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার বার বার লক্ষ্য করেছে, কোনো অবস্থাতেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ ৭৫-৯৬ এর মাঝে নিয়োগকৃত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলা ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
১৯৯৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সরকার যথাযথ ভাবে কোটা অনুসরণ এবং কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে খালি রাখা এবং খালি পদ গুলো পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নিয়োগ দিতে আদেশ করে আরেকটি পরিপত্র জারি করে।তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রশাসন থাকায় কোটা নীতি অনুসরণ করেনি।
১৯৯৯ সালের ৭জুন সরকার সরকার আবার আদেশ জারি করে। যার বিষয় ছিল এমন- “আমরা দেখতে পাচ্ছি কোনো ভাবেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তাই কোটা যথাযথ ভাবে পুরণ করার জন্য পুনরায় আদেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।” একইসাথে আদেশ জারির পর মোট কতজন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এর মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কতজন; তা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু,মাঝের দীর্ঘ ২১ বছরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা সরকারের কথা মানে নি।
১৯৯৯ সালে ৬ ডিসেম্বর সরকার আবার আদেশ জারি করে এবং কড়া ভাষায় নির্দেশনা দিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে এবং তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের ঢুকানো হচ্ছে, যা দুঃখজনক। এবং সরকার এখানে স্পষ্ট বলেন, ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংক্রান্ত সরকারি আদেশ প্রতিপালিত না হলে নিয়োগকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা সরকারের কোনো আদেশ অনুসরণ করেনি।
২০০০ সালের ৫ জুন, সরকার ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা যথাযথ ভাবে পালনের কঠোর আদেশ দেন এবং স্পষ্ট বলে দেন অন্য প্রার্থী দ্বারা কোটা পুরণ করা যাবে না। ২০০২ সালে ১৭ জুন, সরকার আবার আদেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করতে কোন রকম ব্যপতায় যাতে না ঘটে এবং তা সকল বিভাগকে নির্দেশ দেন এবং কত শতাংশ কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে তার ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন চাওয়া হয় বিভাগ গুলোর কাছে। অর্থাৎ, বছরের পর বছর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিরা এদেশের সূর্যসন্তানদের প্রবাহমান রক্তকে সরকার এবং রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নানান ভাবে বাধা প্রদান করে।
১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী ৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করার জন্য এমন ৮/১০ টার মতো পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা তা মানেনি, যা পরিপত্র গুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে। আবার তখন সরকার পরিবর্তন, জোট সরকার ক্ষমতায়।
২০০২ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর কোটা সংশোধন করা হয় । আওয়ামিলীগ সরকারের আমলে জারি করা কোটা সংরক্ষণ ও কোটা অনুসরণে বাধ্যবাধকতা থাকায় ১৯৯৮,১৯৯১, ও ২০০০ সালে জারিকৃত পরিপত্র সংশোধন করে বলা হয়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা তালিকা থেকে নিতে হবে। এ পরিপত্রের অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাশ করার পরও বাদ দিয়ে দেওয়া হতো।
২০০০ সালে ২০তম বিসিএস অনুষ্ঠিত হওয়ায় কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ক্যাডার হয়েছিল। কিন্তু ২১তম বিসিএস থেকে আবার বঞ্চিত। এভাবেই, আবার জোট সরকারের আমলে ৫ বছর বঞ্চিত হলো বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। ২০০৭ থেকে ক্ষমতায় আসলো কেয়ারটেকার সরকার এবং তার পরবর্তী দুই বছর আবারও মুক্তিযুদ্ধ সন্তানরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
২০১০ সালের ৫ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত পরিপত্রে বলা হয়, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান/নাতি-নাতনি, নারী কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। প্রথমে জনসংখ্যা ভিত্তিক জেলা কোটা (১০ শতাংশ) অনুযায়ী উপযুক্ত প্রার্থীদের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। জেলা কোটার সব পদ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ সম্ভব না হলে জেলা কোটার জাতীয় মেধা তালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে। বিভিন্ন জেলার বিতরণ করা কোটায় যোগ্য প্রার্থী বিবেচিত না হলে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিশেষ কোটার প্রার্থীদের দিয়ে বিশেষ কোটাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও উপজাতীয়দের জন্য জাতীয়ভিত্তিক মেধা তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। এরপর বিশেষ কোটার অধীন জাতীয় ভিত্তিক স্ব স্ব কোটার প্রার্থীদের জাতীয় তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।
সর্বশেষ, ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগে ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি ৩০ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ মিলিয়ে শতকরা ৫৬ ভাগ কোটা পদ্ধতি চালু ছিল।
এ অবস্থায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ২০১৮ সালের ২ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। প্রাথমিকভাবে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও পরে আরও ৯০ কার্যদিবস সময় পায় কমিটি। ওই বছরে ১৭ সেপ্টেম্বর কোটা সংস্কার বা পর্যালোচনা কমিটির প্রধান তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোটা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন।কোটা পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের দিন ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এভাবেই বছরের পর বছর স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রজন্ম তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, নিগৃহীত। তাই, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বর্তমান সরকার তাঁর কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে বলে আমি আশাবাদী।
লেখক : সংবাদ-এর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
 
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                        ইপেপার
                        
                                                	                            	জাতীয়
                           	                            	সারাদেশ
                           	                            	আন্তর্জাতিক
                           	                            	নগর-মহানগর
                           	                            	খেলা
                           	                            	বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
                           	                            	শিক্ষা
                           	                            	অর্থ-বাণিজ্য
                           	                            	সংস্কৃতি
                           	                            	ক্যাম্পাস
                           	                            	মিডিয়া
                           	                            	অপরাধ ও দুর্নীতি
                           	                            	রাজনীতি
                           	                            	শোক ও স্মরন
                           	                            	প্রবাস
                           	                            নারীর প্রতি সহিংসতা
                            বিনোদন
                                                                        	                            	সম্পাদকীয়
                           	                            	উপ-সম্পাদকীয়
                           	                            	মুক্ত আলোচনা
                           	                            	চিঠিপত্র
                           	                            	পাঠকের চিঠি
                           	                                            শুক্রবার, ০৫ জুলাই ২০২৪
বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন। ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ (বিজয় দিবস) থেকে কার্যকর হয়।
এর আগে, ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর এক আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে ১৯৭২ সালে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরবর্তীতে, ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন সচিবের এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বাংলাদেশে।
১৯৭২ সালে সরকারি কর্মচারী নিয়োগে ২০% ছিল মেধা কোটা এবং বাকি ৮০% জেলা কোটার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার মাঝে ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১০% ক্ষতিগ্রস্ত নারী কোটা ও ৪০% জেলা কোটা রাখা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে আনুমানিক ১৫২০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যদিও ১৯৭৯ সালে শুধুমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়েয় কারণে তাঁদের বেশিরভাগই পদোন্নতি পাননি।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই সোনার বাংলাদেশে শুরু হয় কালো অধ্যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময় ১৯৭৫-৯৬ সাল থেকে দীর্ঘ ২১ বছর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নেমে আসে দুর্বিষহ অত্যাচার। এ সময়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরুপে ব্যাহত হয়। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা তদুপরি সর্বমহলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
স্বাধীনতার সূর্য-সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তাঁদের সন্তানাদিদের পড়াশোনা করানোর মতো আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। অর্থনৈতিক দৈন্য দশা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে বেড়ানোসহ সব মিলিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৭৫ এর পরবর্তী ২১ বছর সকল প্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল। এমনকি তাঁরা স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পর্যন্ত হারিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্র পুনর্গঠনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের অতি নগণ্য পরিমাণে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আত্মগোপনে থাকা শিক্ষিত গোষ্ঠীকেই পরবর্তীতে আমলা নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ পদে অধিষ্ঠ করা হয়েছিল। ৯ মাস যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ২১ বছরে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তা আজো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে যেই পুনর্বাসন মুক্তিযোদ্ধাদের ন্যায্য অধিকার ছিল, দুই দশকের বেশি সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য রাষ্ট্র এই কর্তব্যটুকু পালনে ব্যর্থ ছিল।
১৯৮৫ সালে আবারও পরিবর্তন আনা হয় কোটা ব্যবস্থায়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ, জেলা কোটায় ১০ শতাংশ ও নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয় ৫ শতাংশ কোটা।
১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার আশার আলো দেখলো। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের কল্যাণে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য আবার কোটা চালু করেন। সাথে সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি যখন ক্ষমতায় আসলেন ততদিনে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ, এই কোটা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কাজে আসলো না। তখন,প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালে ১৭ মার্চ এ কোটা সন্তান পর্যন্ত বর্ধিত করলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার বার বার লক্ষ্য করেছে, কোনো অবস্থাতেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরিতে নেওয়া হচ্ছে না। কারণ ৭৫-৯৬ এর মাঝে নিয়োগকৃত মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলা ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।
১৯৯৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সরকার যথাযথ ভাবে কোটা অনুসরণ এবং কোটায় প্রার্থী না পাওয়া গেলে খালি রাখা এবং খালি পদ গুলো পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে নিয়োগ দিতে আদেশ করে আরেকটি পরিপত্র জারি করে।তখন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রশাসন থাকায় কোটা নীতি অনুসরণ করেনি।
১৯৯৯ সালের ৭জুন সরকার সরকার আবার আদেশ জারি করে। যার বিষয় ছিল এমন- “আমরা দেখতে পাচ্ছি কোনো ভাবেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে না। তাই কোটা যথাযথ ভাবে পুরণ করার জন্য পুনরায় আদেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।” একইসাথে আদেশ জারির পর মোট কতজন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এর মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কতজন; তা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু,মাঝের দীর্ঘ ২১ বছরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা সরকারের কথা মানে নি।
১৯৯৯ সালে ৬ ডিসেম্বর সরকার আবার আদেশ জারি করে এবং কড়া ভাষায় নির্দেশনা দিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে এবং তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের ঢুকানো হচ্ছে, যা দুঃখজনক। এবং সরকার এখানে স্পষ্ট বলেন, ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংক্রান্ত সরকারি আদেশ প্রতিপালিত না হলে নিয়োগকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা সরকারের কোনো আদেশ অনুসরণ করেনি।
২০০০ সালের ৫ জুন, সরকার ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটা যথাযথ ভাবে পালনের কঠোর আদেশ দেন এবং স্পষ্ট বলে দেন অন্য প্রার্থী দ্বারা কোটা পুরণ করা যাবে না। ২০০২ সালে ১৭ জুন, সরকার আবার আদেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করতে কোন রকম ব্যপতায় যাতে না ঘটে এবং তা সকল বিভাগকে নির্দেশ দেন এবং কত শতাংশ কোটা অনুসরণ করা হচ্ছে তার ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন চাওয়া হয় বিভাগ গুলোর কাছে। অর্থাৎ, বছরের পর বছর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিরা এদেশের সূর্যসন্তানদের প্রবাহমান রক্তকে সরকার এবং রাষ্ট্র গঠনে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে নানান ভাবে বাধা প্রদান করে।
১৯৯৬ সাল থেকে পরবর্তী ৫ বছরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অনুসরণ করার জন্য এমন ৮/১০ টার মতো পরিপত্র জারি করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী আমলারা তা মানেনি, যা পরিপত্র গুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে। আবার তখন সরকার পরিবর্তন, জোট সরকার ক্ষমতায়।
২০০২ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর কোটা সংশোধন করা হয় । আওয়ামিলীগ সরকারের আমলে জারি করা কোটা সংরক্ষণ ও কোটা অনুসরণে বাধ্যবাধকতা থাকায় ১৯৯৮,১৯৯১, ও ২০০০ সালে জারিকৃত পরিপত্র সংশোধন করে বলা হয়, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে মেধা তালিকা থেকে নিতে হবে। এ পরিপত্রের অজুহাতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাশ করার পরও বাদ দিয়ে দেওয়া হতো।
২০০০ সালে ২০তম বিসিএস অনুষ্ঠিত হওয়ায় কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ক্যাডার হয়েছিল। কিন্তু ২১তম বিসিএস থেকে আবার বঞ্চিত। এভাবেই, আবার জোট সরকারের আমলে ৫ বছর বঞ্চিত হলো বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা। ২০০৭ থেকে ক্ষমতায় আসলো কেয়ারটেকার সরকার এবং তার পরবর্তী দুই বছর আবারও মুক্তিযুদ্ধ সন্তানরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।
২০১০ সালের ৫ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশোধিত পরিপত্রে বলা হয়, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তান/নাতি-নাতনি, নারী কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জেলা কোটা ১০ শতাংশ, নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। প্রথমে জনসংখ্যা ভিত্তিক জেলা কোটা (১০ শতাংশ) অনুযায়ী উপযুক্ত প্রার্থীদের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে। জেলা কোটার সব পদ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ সম্ভব না হলে জেলা কোটার জাতীয় মেধা তালিকা থেকে তা পূরণ করতে হবে। বিভিন্ন জেলার বিতরণ করা কোটায় যোগ্য প্রার্থী বিবেচিত না হলে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বিশেষ কোটার প্রার্থীদের দিয়ে বিশেষ কোটাভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা, নারী ও উপজাতীয়দের জন্য জাতীয়ভিত্তিক মেধা তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। এরপর বিশেষ কোটার অধীন জাতীয় ভিত্তিক স্ব স্ব কোটার প্রার্থীদের জাতীয় তালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।
সর্বশেষ, ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে নিয়োগে ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনি ৩০ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ মিলিয়ে শতকরা ৫৬ ভাগ কোটা পদ্ধতি চালু ছিল।
এ অবস্থায় সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে ২০১৮ সালের ২ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। প্রাথমিকভাবে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও পরে আরও ৯০ কার্যদিবস সময় পায় কমিটি। ওই বছরে ১৭ সেপ্টেম্বর কোটা সংস্কার বা পর্যালোচনা কমিটির প্রধান তখনকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোটা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করে প্রতিবেদন জমা দেন।কোটা পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরের দিন ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে সরাসরি নিয়োগে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি তুলে দিয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এভাবেই বছরের পর বছর স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা ও প্রজন্ম তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত, নিগৃহীত। তাই, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বর্তমান সরকার তাঁর কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে বলে আমি আশাবাদী।
লেখক : সংবাদ-এর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি
