আসফাক বীন রহমান
(১)
’ অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ মি-ল মা-স-কা-রা-স ‘ ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ রেসলিং টুর্নামেন্টের রিং-এ এনাউন্সারের গলা ফাটানো চিৎকারের সাথে সাথে রেফারী ‘লুচাডর’ মিল মাস্কারাসের হাত উঠিয়ে জয় ঘোষণা করেন । গোগ্রাসে প্রতি সপ্তাহে সন্ধ্যায় ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ রেসলিং না দেখলে আমাদের পেটের ভাত হজম হয় না । ইমনের সাথে অনেক ব্যাপারে বিপরীত পছন্দ থাকলেও রেসলিং-এ আমরা দুজনই মুখোশধারী মিল মাস্কারাসের ভক্ত । তার অবিশ্বাস্য ফ্লাইং কিক ,কনুই দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে নাকে ডলা দেওয়া এবং এক্রোবেটিক নৈপুণ্যে আমাদের সব বন্ধুরাই মুগ্ধ । অন্যান্য জনপ্রিয় রেসলার হাল্ক হোগান , এন্ড্রু দা জায়ান্ট তাদেরও আলাদা ভক্তকূল তৈরি করেছেন ।
অদেখা , অচেনার প্রতি মানুষের চিরন্তন আকর্ষণ । মেক্সিকোর ‘লুচা লিব্রা’ বা মুখোশধারী পেশাদার কুস্তি প্রতিযোগীতা ল্যাটিন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । ১৮৬৩ সালে ফরাসি দখলদারিত্বের সময় মেক্সিকোতে এই ধরনের মুখোশধারী কুস্তিগীরদের আবির্ভাব ঘটে । মুখোশের আড়ালে তাদের আসল নাম হারিয়ে যায় ; কুস্তি উপভোগকারী দর্শকেরা জানেন না মুখোশের আড়ালে কে আছেন ? রহস্যময় মুখোশধারী লুচাডরবৃন্দ মুখোশ দিয়ে তাঁদের অতীত জীবনের কোন একটা ঘটনার প্রতীক প্রকাশ করেন । এজন্য দেখা যায় ,অনেক সময় সাধারণ রেসলারদের টার্গেট থাকে লুচাডরদের মুখোশ খুলে ফেলা ।
আব্বা-আম্মা মেজো মামার বাসায় সন্ধ্যায় বেড়াতে গেছেন । আমরা অধীর আগ্রহে বিটিভির পর্দায় রেসলিং প্রতিযোগীতার মাঝখানের বিজ্ঞাপন দেখছি । আমাদের বাসার সাহায্যকারী বাবুল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আমাদের দুই ভাইকে উস্কানি দিচ্ছে রেসলিং করার জন্য । ‘ মামা, আনপেরা দুইটা খাট এক জায়গায় জোড়া দিয়া মিল মাস্কারাসের মতন ফ্লাইং কিক মারেন । আমি রেফারী হমু, ‘ বাবুল । বাবুইল্লাকে আমি একটা ধমক দেওয়ায় বলতে থাকে , ‘ ইমন মামার সাথে আনপে পারবেন না । এর লাইগ্যাই ডরে রেসলিং করতেছেন না ।’ কলিংবেলের শব্দে বাবুল দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় । ‘ কি রে টেমা তোর খবর কী? ‘শুনতে পেলাম । বাবুল চিৎকার করে ঘোষণা দেয়,’ সানী দাদা আইছে ‘। জাকিয়া মামী ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমাদেরকে বলেন ‘ টিভিতে এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো ? ‘
সানী মামা রেসলারদের কেরামতি দেখে হাসতে থাকেন , ‘ মিছামিছি মারামারি করে ; ব্যথা পায় না ‘। এটা শুনে ইমন মৃদু প্রতিবাদ করে বলে ‘ না ,না, এটা সত্যিকারের মারামারি ।ওই যে দেখেন , কি ফ্লাইং কিক মারলো ? ‘ আমারও একটু সন্দেহ জাগলো। সানী মামা বলতে থাকেন ,’দেখ , ঘুসি মারার আগে সামনে পা দিয়ে জোরে রিং এ আওয়াজ করে । এতো যে মারামারি করে , রক্ত বের হয় না। ‘ আমাদের ফিলিপস বাত্তির মতো জ্বল জ্বলে মুখ নিমিষেই কুপীর আলোর মতো ম্লান হয়ে যায়। জাকিয়া মামী , মামাকে থামানোর চেষ্টা করেন,’ দেখো তো ওরা কতো উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রেসলিং দেখছে ,তুমি তাদের আগ্রহটা নষ্ট করে দিচ্ছো।’ তাহলে কি মোহাম্মদ আলী, নাসের ভুলু, ভুলু পালোয়ান আপসে মারামারি করতেন ?
(২)
বক্সিংয়ে সব সময় শুধু মোহাম্মদ আলী নামটাই শুনে এসেছি ; হঠাৎ লোকমুখে মোহাম্মদ আলীর আগমনের নিউজটা শুনে পুরো ঢাকাবাসীর মতো আমরাও উদ্বেলিত । সাদা হাফপ্যান্ট পরা মোহাম্মদ আলীর সাথে কয়দিন আগে লিওনেল স্পিংস এর ফাইট টিভিতে দেখেছি । সাদা মানে ভালো আর কালো মানে খারাপ ,এটা আমাদের বদ্ধমূল ধারনা । এমনিতেই মোহাম্মদ আলী সাদা হাফপ্যান্ট পড়েন ,তার উপর কয়দিন আগে খ্রিস্টান থেকে মুসলমান হয়েছেন ; তাই আমাদের উনাকে নিয়ে জানার অনেক আগ্রহ ! বড় ভাইদের কাছে শুনেছি, আমেরিকান মোহাম্মদ আলীর পূর্বের নাম ‘কেসিয়াস ক্লে’ । ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করায় আমেরিকান সরকার তাকে বক্সিং রিংয়ে নিষিদ্ধ করেছিল ; পদক কেড়ে নিয়েছিল । বাংলাদেশের জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ১২ বছরের গিয়াসউদ্দিনের কাছে নক আউট হয়ে রিং এর ভেতর পড়ে যাওয়া আলীকে দেখে মনে হলো, তিনি মানুষ হিসেবেও অমায়িক এবং নিরহংকার । মোহাম্মদ আলীর সফরের পর আমরাও স্কুলের জুতার মোজা হাতে গলিয়ে গ্লাভস বানিয়ে বিপুল উদ্যমে মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করা শুরু করি ।
(৩)
আম্মা, ‘আমাদের সময় গামা পালোয়ান দশ সের দুধ খাইতো , দশটা মুরগী একবারে খাইতো , ত্রিশটা ডিম দিয়ে নাস্তা করতো ! আর তোরা এক গ্লাস দুধ না খাওয়ার জন্য কত রকম মুখ ভেংচি কাটিস !’ দুধের কেমন কেমন গন্ধ ! অনেক কষ্ট হয় এক গ্লাস দুধ খেতে । আর,হাফ বয়েল ডিমতো আমাদের চোখের বিষ ; মামলেট চলতে পারে । কিন্তু আম্মা ভাজাপোড়া খাবার দিবেন না । তাই অনেক কসরত আর অনেক বাহানার পর ডিম- দুধ খাই । আম্মা প্রায়ই গামা পালোয়ানের উদাহরণ দেন । আম্মাকে জিজ্ঞেস করলে ,বলেন ‘পুরো ভারতবর্ষের কুস্তি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন গামা পালোয়ান ।’ কিন্তু কুস্তিগীর আর সুমো কুস্তিগীরদের ড্রেস আপের কথা চিন্তা করে আমরা দুই ভাই মুখ চেপে উচ্চকণ্ঠে হাসতে থাকি ।
দুপুর থেকেই একটি ছোট্ট বিমান আকাশের বেশ নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে । ভেবেছিলাম , হয়তো মশার ঔষুধ ছিটাচ্ছে । কিন্তু ,হঠাৎ মাঠে ছেলেপেলেদের চিৎকার ‘ ঐযে ,ঐযে ,ধর ,ধর ! ‘ জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে দেখি , আকাশ থেকে কাগজের বৃষ্টি হচ্ছে । দরজা খুলে দৌড়ে অন্যান্য ছেলেপেলেদের উত্তেজনায় আমরাও সামিল হই । বাদল বললো ,’ মনে হয়, প্লেন থেকে টাকা ফেলছে !’ দৌড়াতে দৌড়াতে সবার সাথে হুটোপুটি করে কয়েকটি নিউজপ্রিন্ট কাগজের লিফলেট পেলাম । লেখা রয়েছে , ‘ কুস্তি ! কুস্তি ! কুস্তি ! ‘ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফ্রী স্টাইল কুস্তি প্রদর্শনীর লিফলেট এটি । পাকিস্তানের বিখ্যাত ভুলু পরিবারের নাসের ভুলু , আসলাম গোঁগা, ভারতের নির্মল সিং ,ইংল্যান্ডের এলেন টার্নার , বাংলাদেশের পুলিশ সদস্য টাইগার জলিল এই প্রতিযোগীতার মূল আকর্ষণ । ব্যাপক প্রচার ও টেলিভিশনে খেলা দেখানোয় পুরো দেশেই খুব আলোড়ন তুলে ।
(৪)
‘দুলাভাই ,আজকে সুমন-ইমনকে আটকানো হয়েছে ; রূবী আপাকে নিয়ে বিকেলে নাস্তা আর রাতে ভাত খেলে আপনার ছেলেদের ছাড়বো ‘ জাকিয়া মামী টেলিফোনে আব্বাকে হাসতে হাসতে ‘আজব মুক্তিপণ ‘ চাইলেন । আব্বা যতোই ‘বোন , আজকে অফিসের অনেক ঝামেলা আছে ‘ বলতে থাকেন ,মামী একটাই দাবী জানাতে থাকেন । শেষ পর্যন্ত রাতে ভাত খাবার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় মামী টেলিফোন রাখেন । মামী, ডাক্তার জাকিয়া সুলতানা ডেন্টাল সার্জন - পিজি হাসপাতালে এম এস কোর্সে উচ্চতর ট্রেনিং নিচ্ছেন । উনার বাসায় কেউ গেলে না খাইয়ে ছাড়বেন না ; হাসি-খুশি ,সহজ-সরল মামী খুব সহজেই অন্যকে আপন করে নেন ।
মাঝে মাঝে আমরা দুই ভাই সকাল নয়টা-সাড়ে নয়টা থেকে মামা-খালাদের বাসায় সফর শুরু করি । আজিমপুরের বাসা থেকে হেঁটে ধানমন্ডি এক নাম্বারে ছোট খালা, ছোট খালার বাসা থেকে হেঁটে ভূতের গলিতে মেজো খালার বাসা , সেখান থেকে আবার পদব্রজে গ্রীন রোড কলোনীতে সানী মামার বাসা - শেষ পর্যন্ত ধানমন্ডিতে মেজো মামার বাসা দিয়ে আমাদের সফর শেষ হয় । মামীকে আমাদের সফরের সার্কেল পূর্ণ করার জন্য মেজো মামার বাসার কথা জানাতে , মামী বিকেলের নাস্তার আগে ফেরত আসার অঙ্গীকার চাইলেন । হুমকি দিলেন , ‘যদি না আসো তোমাদের বাসায় আর যাবো না ।’
গ্রীনরোড কলোনী থেকে বের হয়ে ভুঁইয়া একাডেমীর কাছে আসতেই রিক্সা থেকে দেখি একদল পথচারী গোল হয়ে ব্যাপক উৎসাহের সাথে কাউকে বাহবা দিচ্ছেন । ‘ আরে পিচ্চীটারে সামনের বৈশাখে লালদীঘির জব্বারের বলী খেলায় পাঠামু ‘ একজন দর্শকের মন্তব্য । রিকশার উপর দাঁড়িয়ে আমরাও দেখার চেষ্টা করি ‘ কি ঘটনা ‘! ভিন্ন সাইজের দুই পথশিশু মল্লযুদ্ধে লিপ্ত । ছোট বাচ্চাটি বেশী মার খেলেও- তার জেদ বেশী ; প্রতিবারই ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে । আমরা রিক্সাওয়ালা মামুকে তাদের মারামারি বন্ধের জন্য অনুরোধ জানালে , জানান ‘ গরীবের পুলাদের এই জিদটাই আছে - জিদ না থাকলে কঠিন পৃথিবীতে টিকতে পারবো না ।’
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]
আসফাক বীন রহমান
শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
(১)
’ অ্যান্ড দ্য উইনার ইজ মি-ল মা-স-কা-রা-স ‘ ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ রেসলিং টুর্নামেন্টের রিং-এ এনাউন্সারের গলা ফাটানো চিৎকারের সাথে সাথে রেফারী ‘লুচাডর’ মিল মাস্কারাসের হাত উঠিয়ে জয় ঘোষণা করেন । গোগ্রাসে প্রতি সপ্তাহে সন্ধ্যায় ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ রেসলিং না দেখলে আমাদের পেটের ভাত হজম হয় না । ইমনের সাথে অনেক ব্যাপারে বিপরীত পছন্দ থাকলেও রেসলিং-এ আমরা দুজনই মুখোশধারী মিল মাস্কারাসের ভক্ত । তার অবিশ্বাস্য ফ্লাইং কিক ,কনুই দিয়ে গলা পেঁচিয়ে ধরে নাকে ডলা দেওয়া এবং এক্রোবেটিক নৈপুণ্যে আমাদের সব বন্ধুরাই মুগ্ধ । অন্যান্য জনপ্রিয় রেসলার হাল্ক হোগান , এন্ড্রু দা জায়ান্ট তাদেরও আলাদা ভক্তকূল তৈরি করেছেন ।
অদেখা , অচেনার প্রতি মানুষের চিরন্তন আকর্ষণ । মেক্সিকোর ‘লুচা লিব্রা’ বা মুখোশধারী পেশাদার কুস্তি প্রতিযোগীতা ল্যাটিন সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ । ১৮৬৩ সালে ফরাসি দখলদারিত্বের সময় মেক্সিকোতে এই ধরনের মুখোশধারী কুস্তিগীরদের আবির্ভাব ঘটে । মুখোশের আড়ালে তাদের আসল নাম হারিয়ে যায় ; কুস্তি উপভোগকারী দর্শকেরা জানেন না মুখোশের আড়ালে কে আছেন ? রহস্যময় মুখোশধারী লুচাডরবৃন্দ মুখোশ দিয়ে তাঁদের অতীত জীবনের কোন একটা ঘটনার প্রতীক প্রকাশ করেন । এজন্য দেখা যায় ,অনেক সময় সাধারণ রেসলারদের টার্গেট থাকে লুচাডরদের মুখোশ খুলে ফেলা ।
আব্বা-আম্মা মেজো মামার বাসায় সন্ধ্যায় বেড়াতে গেছেন । আমরা অধীর আগ্রহে বিটিভির পর্দায় রেসলিং প্রতিযোগীতার মাঝখানের বিজ্ঞাপন দেখছি । আমাদের বাসার সাহায্যকারী বাবুল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আমাদের দুই ভাইকে উস্কানি দিচ্ছে রেসলিং করার জন্য । ‘ মামা, আনপেরা দুইটা খাট এক জায়গায় জোড়া দিয়া মিল মাস্কারাসের মতন ফ্লাইং কিক মারেন । আমি রেফারী হমু, ‘ বাবুল । বাবুইল্লাকে আমি একটা ধমক দেওয়ায় বলতে থাকে , ‘ ইমন মামার সাথে আনপে পারবেন না । এর লাইগ্যাই ডরে রেসলিং করতেছেন না ।’ কলিংবেলের শব্দে বাবুল দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় । ‘ কি রে টেমা তোর খবর কী? ‘শুনতে পেলাম । বাবুল চিৎকার করে ঘোষণা দেয়,’ সানী দাদা আইছে ‘। জাকিয়া মামী ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমাদেরকে বলেন ‘ টিভিতে এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো ? ‘
সানী মামা রেসলারদের কেরামতি দেখে হাসতে থাকেন , ‘ মিছামিছি মারামারি করে ; ব্যথা পায় না ‘। এটা শুনে ইমন মৃদু প্রতিবাদ করে বলে ‘ না ,না, এটা সত্যিকারের মারামারি ।ওই যে দেখেন , কি ফ্লাইং কিক মারলো ? ‘ আমারও একটু সন্দেহ জাগলো। সানী মামা বলতে থাকেন ,’দেখ , ঘুসি মারার আগে সামনে পা দিয়ে জোরে রিং এ আওয়াজ করে । এতো যে মারামারি করে , রক্ত বের হয় না। ‘ আমাদের ফিলিপস বাত্তির মতো জ্বল জ্বলে মুখ নিমিষেই কুপীর আলোর মতো ম্লান হয়ে যায়। জাকিয়া মামী , মামাকে থামানোর চেষ্টা করেন,’ দেখো তো ওরা কতো উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রেসলিং দেখছে ,তুমি তাদের আগ্রহটা নষ্ট করে দিচ্ছো।’ তাহলে কি মোহাম্মদ আলী, নাসের ভুলু, ভুলু পালোয়ান আপসে মারামারি করতেন ?
(২)
বক্সিংয়ে সব সময় শুধু মোহাম্মদ আলী নামটাই শুনে এসেছি ; হঠাৎ লোকমুখে মোহাম্মদ আলীর আগমনের নিউজটা শুনে পুরো ঢাকাবাসীর মতো আমরাও উদ্বেলিত । সাদা হাফপ্যান্ট পরা মোহাম্মদ আলীর সাথে কয়দিন আগে লিওনেল স্পিংস এর ফাইট টিভিতে দেখেছি । সাদা মানে ভালো আর কালো মানে খারাপ ,এটা আমাদের বদ্ধমূল ধারনা । এমনিতেই মোহাম্মদ আলী সাদা হাফপ্যান্ট পড়েন ,তার উপর কয়দিন আগে খ্রিস্টান থেকে মুসলমান হয়েছেন ; তাই আমাদের উনাকে নিয়ে জানার অনেক আগ্রহ ! বড় ভাইদের কাছে শুনেছি, আমেরিকান মোহাম্মদ আলীর পূর্বের নাম ‘কেসিয়াস ক্লে’ । ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করায় আমেরিকান সরকার তাকে বক্সিং রিংয়ে নিষিদ্ধ করেছিল ; পদক কেড়ে নিয়েছিল । বাংলাদেশের জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ১২ বছরের গিয়াসউদ্দিনের কাছে নক আউট হয়ে রিং এর ভেতর পড়ে যাওয়া আলীকে দেখে মনে হলো, তিনি মানুষ হিসেবেও অমায়িক এবং নিরহংকার । মোহাম্মদ আলীর সফরের পর আমরাও স্কুলের জুতার মোজা হাতে গলিয়ে গ্লাভস বানিয়ে বিপুল উদ্যমে মুষ্টিযুদ্ধ অনুশীলন করা শুরু করি ।
(৩)
আম্মা, ‘আমাদের সময় গামা পালোয়ান দশ সের দুধ খাইতো , দশটা মুরগী একবারে খাইতো , ত্রিশটা ডিম দিয়ে নাস্তা করতো ! আর তোরা এক গ্লাস দুধ না খাওয়ার জন্য কত রকম মুখ ভেংচি কাটিস !’ দুধের কেমন কেমন গন্ধ ! অনেক কষ্ট হয় এক গ্লাস দুধ খেতে । আর,হাফ বয়েল ডিমতো আমাদের চোখের বিষ ; মামলেট চলতে পারে । কিন্তু আম্মা ভাজাপোড়া খাবার দিবেন না । তাই অনেক কসরত আর অনেক বাহানার পর ডিম- দুধ খাই । আম্মা প্রায়ই গামা পালোয়ানের উদাহরণ দেন । আম্মাকে জিজ্ঞেস করলে ,বলেন ‘পুরো ভারতবর্ষের কুস্তি চ্যাম্পিয়ন ছিলেন গামা পালোয়ান ।’ কিন্তু কুস্তিগীর আর সুমো কুস্তিগীরদের ড্রেস আপের কথা চিন্তা করে আমরা দুই ভাই মুখ চেপে উচ্চকণ্ঠে হাসতে থাকি ।
দুপুর থেকেই একটি ছোট্ট বিমান আকাশের বেশ নীচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে । ভেবেছিলাম , হয়তো মশার ঔষুধ ছিটাচ্ছে । কিন্তু ,হঠাৎ মাঠে ছেলেপেলেদের চিৎকার ‘ ঐযে ,ঐযে ,ধর ,ধর ! ‘ জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে দেখি , আকাশ থেকে কাগজের বৃষ্টি হচ্ছে । দরজা খুলে দৌড়ে অন্যান্য ছেলেপেলেদের উত্তেজনায় আমরাও সামিল হই । বাদল বললো ,’ মনে হয়, প্লেন থেকে টাকা ফেলছে !’ দৌড়াতে দৌড়াতে সবার সাথে হুটোপুটি করে কয়েকটি নিউজপ্রিন্ট কাগজের লিফলেট পেলাম । লেখা রয়েছে , ‘ কুস্তি ! কুস্তি ! কুস্তি ! ‘ বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ফ্রী স্টাইল কুস্তি প্রদর্শনীর লিফলেট এটি । পাকিস্তানের বিখ্যাত ভুলু পরিবারের নাসের ভুলু , আসলাম গোঁগা, ভারতের নির্মল সিং ,ইংল্যান্ডের এলেন টার্নার , বাংলাদেশের পুলিশ সদস্য টাইগার জলিল এই প্রতিযোগীতার মূল আকর্ষণ । ব্যাপক প্রচার ও টেলিভিশনে খেলা দেখানোয় পুরো দেশেই খুব আলোড়ন তুলে ।
(৪)
‘দুলাভাই ,আজকে সুমন-ইমনকে আটকানো হয়েছে ; রূবী আপাকে নিয়ে বিকেলে নাস্তা আর রাতে ভাত খেলে আপনার ছেলেদের ছাড়বো ‘ জাকিয়া মামী টেলিফোনে আব্বাকে হাসতে হাসতে ‘আজব মুক্তিপণ ‘ চাইলেন । আব্বা যতোই ‘বোন , আজকে অফিসের অনেক ঝামেলা আছে ‘ বলতে থাকেন ,মামী একটাই দাবী জানাতে থাকেন । শেষ পর্যন্ত রাতে ভাত খাবার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় মামী টেলিফোন রাখেন । মামী, ডাক্তার জাকিয়া সুলতানা ডেন্টাল সার্জন - পিজি হাসপাতালে এম এস কোর্সে উচ্চতর ট্রেনিং নিচ্ছেন । উনার বাসায় কেউ গেলে না খাইয়ে ছাড়বেন না ; হাসি-খুশি ,সহজ-সরল মামী খুব সহজেই অন্যকে আপন করে নেন ।
মাঝে মাঝে আমরা দুই ভাই সকাল নয়টা-সাড়ে নয়টা থেকে মামা-খালাদের বাসায় সফর শুরু করি । আজিমপুরের বাসা থেকে হেঁটে ধানমন্ডি এক নাম্বারে ছোট খালা, ছোট খালার বাসা থেকে হেঁটে ভূতের গলিতে মেজো খালার বাসা , সেখান থেকে আবার পদব্রজে গ্রীন রোড কলোনীতে সানী মামার বাসা - শেষ পর্যন্ত ধানমন্ডিতে মেজো মামার বাসা দিয়ে আমাদের সফর শেষ হয় । মামীকে আমাদের সফরের সার্কেল পূর্ণ করার জন্য মেজো মামার বাসার কথা জানাতে , মামী বিকেলের নাস্তার আগে ফেরত আসার অঙ্গীকার চাইলেন । হুমকি দিলেন , ‘যদি না আসো তোমাদের বাসায় আর যাবো না ।’
গ্রীনরোড কলোনী থেকে বের হয়ে ভুঁইয়া একাডেমীর কাছে আসতেই রিক্সা থেকে দেখি একদল পথচারী গোল হয়ে ব্যাপক উৎসাহের সাথে কাউকে বাহবা দিচ্ছেন । ‘ আরে পিচ্চীটারে সামনের বৈশাখে লালদীঘির জব্বারের বলী খেলায় পাঠামু ‘ একজন দর্শকের মন্তব্য । রিকশার উপর দাঁড়িয়ে আমরাও দেখার চেষ্টা করি ‘ কি ঘটনা ‘! ভিন্ন সাইজের দুই পথশিশু মল্লযুদ্ধে লিপ্ত । ছোট বাচ্চাটি বেশী মার খেলেও- তার জেদ বেশী ; প্রতিবারই ভূমিশয্যা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে । আমরা রিক্সাওয়ালা মামুকে তাদের মারামারি বন্ধের জন্য অনুরোধ জানালে , জানান ‘ গরীবের পুলাদের এই জিদটাই আছে - জিদ না থাকলে কঠিন পৃথিবীতে টিকতে পারবো না ।’
[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ]