ওয়াহিদুল ইসলাম ডিফেন্স
রূপনারায়ণ রায়
তুমি কি মিলিয়ে গেলে শূন্যতায় ভাস্বর পুরুষ?
না, তুমি নিদ্রিত দ্বিপ্রহরে;
যেন যুদ্ধ বিরতির পর কোনো পরিশ্রান্ত সেনানী বিশ্রামে
ভরপুর। কবি শামসুর রাহমান এর ভাষায় বলতে গেলে এমনি কী কমরেড রূপনারায়ণ রায়?
তেভাগা আন্দোলনের প্রেরণায় শত শতাব্দীর অবনত মস্তক বাংলার কৃষকের মেরুদ- সোজা করে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস অর্জন করেছিল। তেভাগা এক মৃত্যুহীন সংগ্রামের নাম, যা হয়ে উঠে সংগ্রামের অনির্বাণ শিখা। এই শিখা যারা সেদিন প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন, দরিদ্র কৃষক সন্তান রূপনারায়ণ রায় তাদেরই অন্যতম। সেই কমরেড রূপনারায়ণ রায়ের প্রয়াণ দিবস আজ ২৪ মার্চ। জমিদারি শাসন ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর এই নেতার নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।
দেশে ব্রিটিশ শাসন কিংবা জমিদারি-জোতদারী শাসন ব্যবস্থার কথা মনে পড়লেই কল্পনায় চলে আসে সেই সময়ের জুলুম আর নির্যাতনের কথা। আর এসব জুলুম নির্যাতনকে যুগে যুগে রুখে দিতে ক্ষণ জন্মা কিছু অগ্নিপুরুষের জন্ম হয় এই বাংলায়। গড়ে উঠে বিভিন্ন আন্দোলশ সংগ্রাম। শোষিত আর নিপিড়িত মানুষের মঙ্গলের জন্য। এসব আন্দোলনের মধ্য উল্লেখ্য যোগ্য ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি শাসন, তেভাগা আন্দোলন বা তোলাবাটি আন্দোলন কিংবা কৃষক সমিতির কথা উঠলেই যাদের নাম উঠে আসে এই অঞ্চলে তাদের মধ্যে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কমরেড রূপনারায়ণ রায়।
বৃহত্তর দিনাজপুর (বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর) বর্তমান দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার পৌরশহর থেকে দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তায় প্রায় ২ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই খয়েরবাড়ী ইউনিয়নের লালপুর গ্রাম। গ্রামের নাম লালপুর হলেও উপজেলা প্রবাহিত ছোট যমুনার কোল ঘেঁষেই গ্রামটি হওয়ায় গ্রামটি সবুজে ভরপুর। এই লালপুর গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন কমরেড রূপনারায়ণ রায়।
কমরেড রূপনারায়ন রায় ছিলেন বাবার ছিলেন বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার ছিল অনেক সম্পত্তি। বাড়ীতে ছিল কাচারী ঘর। কৈশর কালে কমরেড দেখেছেন, তাদেরই কাচারী ঘরে জমিদারের খাজাঞ্চিরা এসে জমিদারী খাজনা তুলতেন। যারা দিতে পারতেন না তাদের ভাগ্যে জুটত নানা ধরনের নির্যাতন। সেই থেকে কিশোর রূপনারায়ন রায় মনে মনে ফুসে উঠতেন। একসম বলে ফেলেন কিসের খাজনা। জমি যার খাজনা তার। জমিদারকে আবার কেন খাজনা দিতে হবে। এ ভাবে রূপনারায়নের শোষিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো শুরু হয়। যমুনার পানি গড়িয়ে যেতে থাকে কালে কালে চলে আসে-১৯৩৮ সালে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার লালপুরে কৃষক সমিতির এক বিশাল সমাবেশ চলছিল, যেখানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি। এই বক্তৃতা শুনে রূপনারায়ণ রায়ের মনে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তিনি উপলব্ধি করেন যে এগুলো কেবল বক্তৃতার কথা নয়, বরং তাঁর মনের অব্যক্ত অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ। এই উপলব্ধি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং তিনি সংগ্রামের পথে আত্মনিয়োগ করেন।
রূপনারায়ণ রায় কৃষক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। হাটের তোলাবাটি আন্দোলন, মেলায় তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, কৃষকদের তেভাগার দাবিসহ সকল সংগ্রামে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান সংগঠক। দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কমরেড জনার্দন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশাল কৃষক মিছিলে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
দেশে জমিদারি শাসন এবং ব্রিটিশ শাসনের উৎপিড়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষক শ্রমিক-জনতার পক্ষে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই সময় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকায় গঠন করা হয় কৃষক সমিতি। কালী সরকার ও রূপনারায়ণের যৌথ নেতৃত্বে বৃহত্তর দিনাজপুর (বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর) এলাকায় কৃষক আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে। ১৯৩৯-৪০ সালে দিনাজপুর ও রংপুর জেলার বিভিন্ন হাটে তোলা বাটি আন্দোলন কৃষক সমিতির এক সফল আন্দোলন। এই আন্দোলনের পুরাধা পুরুষ কররেড রূপনারায়ণ রায়।
বিভিন্ন আন্দোলনে সাফল্য লাভ করার পর এলো ১৯৪৬ সালে নির্বাচন। ১৯৪৬ সালের ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ১৩ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে তিন জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। রেলওয়ে শ্রমিকদের পক্ষে কমরেড জ্যোতি বসু (পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী), দার্জিলিং চা শ্রমিকদের পক্ষে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও কৃষকদের পক্ষে কমরেড রূপনারায়ণ রায়। এই ঘটনা সারা ভারতবর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কমরেড রূপনারায়ণ রায় জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন।
এর পর এলো দেশ বিভাগ। পালটে গেলো রাজনীতির অঙ্গন। ১৯৭১ সালে সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ। তখন কমরেড রূপনারায়ণ রায়ে খোঁজ কেউ নিতেন না। শেষ বয়সে তিনি পত্রিকার হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কী নির্মম ইতিহাস। যে মানুষটি সারা জীবন অত্যাচারিত, নিপিড়িত, শোষিতর পক্ষে কথা বলতেন; তাকেই ১৯৭৩ সালের ২৪ মার্চ গভীর রাতে এক দল দুষ্কৃতিকারী রাতে আঁধারে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার হত্যার দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ হত্যার কারণ এবং কোন প্রাকার বিচার আজও দেখতে পায়নি ফুলবাড়ীবাসী।
ব্যক্তিজীবনে কমরেড রূপনারায়ণ বিবাহিত ছিলেন। তার ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে। তার এক চিলতে বসতভিটার মধ্যে বসবাস করেন বড় ছেলের পরিবার। ছোট ছেলে থাকেন ফুলবাড়ী উপজেলা এক গুচ্ছ গ্রামে। আর মেজো ছেলে থাকেন উপজেলার মাদিলা গোয়ালপাড়া গ্রামে। সবাই আজ বিচ্ছিন্ন।
সম্প্রতি কমরেড রূপনারায়ণ রায়ের স্মৃতি বিজরিত লালপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় কমরেডের বড় ছেলে মৃত বিমল রায়ের বড় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি উত্তম রায়ের সাথে। উত্তম রায় বলেন, আমার দাদু রূপনারায়ণ রায় সারা জীবন মানুষের জন্য সংগ্রাম করে শেষ জীবনে প্রাণ টুকুও দিয়েছেন। কিন্তু আমার দাদুর খবর এখন কেউ রাখেন না। আমার বাবা-কাকারা অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। দাদুর পৈত্রিক সূত্রে ৫ শতাংশ জমিতে কোন মতে আমরা মাথা গুজোর ঠাঁই করে ছিলাম। হঠাৎ চোখের সমস্য দেখা দেয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। চিকাৎসার জন্য দাদুর নাম উল্লেখ করে সেই সময় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেই। সেই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে আমার দাদুর সেই সময়ের বন্ধু সিপিএম নেতা মানবেশ চৌধুরীসহ শ্যামল সেন গুপ্ত, সিদ্ধার্ত সেন আমার সাথে দেখা করেন। পরবর্তী সময়ে তারা ২০১০ সালে বাংলাদেশে আসেন আমাদের বাড়ীতে। আমাদের এই পরিস্থিতি দেখে শ্যামল সেন তার নিজ তহবিল থেকে এই ৫ শতাংশ জমির ওপর টিন সেডের একটি পাকা বাড়ী নির্মাণ করে দেন। বাড়ীর নাম দেন শহীদ রূপনারায়ণ ভবন। দাদুর স্মৃতি বলতে এই ৫ শতক জায়গা আর তার বন্ধুর অর্থায়নের নির্মিত এই বাড়ী। তাছাড়া কিছুই নেই।
উত্তম রায় আরও বলেন, ২০১৩ সালের দিকে গ্রামের পার্শ্বে জেলা পরিষদের অর্থায়নে দাদুর নামে রূপনারয়ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাও আজ বন্ধ। আক্ষেপের সাথে তিনি বলেন, মানুষ আজ ভুলে যেতে বসেছে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কমরেড রূপনারায়ণ রায়ের নাম।
তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার কৃষক মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছিল। এই ঐতিহ্য আজও দুই বাংলার সকল গণ-আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে আছে। তেভাগা আন্দোলন এক অমর সংগ্রামের নাম, যা চিরকাল সংগ্রামী মানুষের পথ প্রদর্শন করে যাবে।
প্রতিবছর ২৪ মার্চ এলে ফুলবাড়ী উপজেলা শাখা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া কমরেড রূপনারায়ণ রায়কে কেউ স্মরণ করে না।
[লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ফুলবাড়ী প্রেসক্লাব, দিনাজপুর]
ওয়াহিদুল ইসলাম ডিফেন্স
রূপনারায়ণ রায়
সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
তুমি কি মিলিয়ে গেলে শূন্যতায় ভাস্বর পুরুষ?
না, তুমি নিদ্রিত দ্বিপ্রহরে;
যেন যুদ্ধ বিরতির পর কোনো পরিশ্রান্ত সেনানী বিশ্রামে
ভরপুর। কবি শামসুর রাহমান এর ভাষায় বলতে গেলে এমনি কী কমরেড রূপনারায়ণ রায়?
তেভাগা আন্দোলনের প্রেরণায় শত শতাব্দীর অবনত মস্তক বাংলার কৃষকের মেরুদ- সোজা করে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস অর্জন করেছিল। তেভাগা এক মৃত্যুহীন সংগ্রামের নাম, যা হয়ে উঠে সংগ্রামের অনির্বাণ শিখা। এই শিখা যারা সেদিন প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন, দরিদ্র কৃষক সন্তান রূপনারায়ণ রায় তাদেরই অন্যতম। সেই কমরেড রূপনারায়ণ রায়ের প্রয়াণ দিবস আজ ২৪ মার্চ। জমিদারি শাসন ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর এই নেতার নাম স্মরণীয় হয়ে আছে।
দেশে ব্রিটিশ শাসন কিংবা জমিদারি-জোতদারী শাসন ব্যবস্থার কথা মনে পড়লেই কল্পনায় চলে আসে সেই সময়ের জুলুম আর নির্যাতনের কথা। আর এসব জুলুম নির্যাতনকে যুগে যুগে রুখে দিতে ক্ষণ জন্মা কিছু অগ্নিপুরুষের জন্ম হয় এই বাংলায়। গড়ে উঠে বিভিন্ন আন্দোলশ সংগ্রাম। শোষিত আর নিপিড়িত মানুষের মঙ্গলের জন্য। এসব আন্দোলনের মধ্য উল্লেখ্য যোগ্য ব্রিটিশ শাসন, জমিদারি শাসন, তেভাগা আন্দোলন বা তোলাবাটি আন্দোলন কিংবা কৃষক সমিতির কথা উঠলেই যাদের নাম উঠে আসে এই অঞ্চলে তাদের মধ্যে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কমরেড রূপনারায়ণ রায়।
বৃহত্তর দিনাজপুর (বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর) বর্তমান দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার পৌরশহর থেকে দক্ষিণ দিকে পাকা রাস্তায় প্রায় ২ কিলোমিটার এগিয়ে গেলেই খয়েরবাড়ী ইউনিয়নের লালপুর গ্রাম। গ্রামের নাম লালপুর হলেও উপজেলা প্রবাহিত ছোট যমুনার কোল ঘেঁষেই গ্রামটি হওয়ায় গ্রামটি সবুজে ভরপুর। এই লালপুর গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন কমরেড রূপনারায়ণ রায়।
কমরেড রূপনারায়ন রায় ছিলেন বাবার ছিলেন বাবার একমাত্র সন্তান। বাবার ছিল অনেক সম্পত্তি। বাড়ীতে ছিল কাচারী ঘর। কৈশর কালে কমরেড দেখেছেন, তাদেরই কাচারী ঘরে জমিদারের খাজাঞ্চিরা এসে জমিদারী খাজনা তুলতেন। যারা দিতে পারতেন না তাদের ভাগ্যে জুটত নানা ধরনের নির্যাতন। সেই থেকে কিশোর রূপনারায়ন রায় মনে মনে ফুসে উঠতেন। একসম বলে ফেলেন কিসের খাজনা। জমি যার খাজনা তার। জমিদারকে আবার কেন খাজনা দিতে হবে। এ ভাবে রূপনারায়নের শোষিত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো শুরু হয়। যমুনার পানি গড়িয়ে যেতে থাকে কালে কালে চলে আসে-১৯৩৮ সালে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার লালপুরে কৃষক সমিতির এক বিশাল সমাবেশ চলছিল, যেখানে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ভারতবর্ষের প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি। এই বক্তৃতা শুনে রূপনারায়ণ রায়ের মনে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তিনি উপলব্ধি করেন যে এগুলো কেবল বক্তৃতার কথা নয়, বরং তাঁর মনের অব্যক্ত অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ। এই উপলব্ধি তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় এবং তিনি সংগ্রামের পথে আত্মনিয়োগ করেন।
রূপনারায়ণ রায় কৃষক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়ে ওঠেন। হাটের তোলাবাটি আন্দোলন, মেলায় তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন, কৃষকদের তেভাগার দাবিসহ সকল সংগ্রামে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান সংগঠক। দিনাজপুর জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কমরেড জনার্দন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে পরিচালিত বিশাল কৃষক মিছিলে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
দেশে জমিদারি শাসন এবং ব্রিটিশ শাসনের উৎপিড়নের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে কৃষক শ্রমিক-জনতার পক্ষে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই সময় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকায় গঠন করা হয় কৃষক সমিতি। কালী সরকার ও রূপনারায়ণের যৌথ নেতৃত্বে বৃহত্তর দিনাজপুর (বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর) এলাকায় কৃষক আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে। ১৯৩৯-৪০ সালে দিনাজপুর ও রংপুর জেলার বিভিন্ন হাটে তোলা বাটি আন্দোলন কৃষক সমিতির এক সফল আন্দোলন। এই আন্দোলনের পুরাধা পুরুষ কররেড রূপনারায়ণ রায়।
বিভিন্ন আন্দোলনে সাফল্য লাভ করার পর এলো ১৯৪৬ সালে নির্বাচন। ১৯৪৬ সালের ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার আইন পরিষদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ১৩ জন প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে তিন জন নির্বাচিত হয়েছিলেন। রেলওয়ে শ্রমিকদের পক্ষে কমরেড জ্যোতি বসু (পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী), দার্জিলিং চা শ্রমিকদের পক্ষে রতনলাল ব্রাহ্মণ ও কৃষকদের পক্ষে কমরেড রূপনারায়ণ রায়। এই ঘটনা সারা ভারতবর্ষে আলোড়ন সৃষ্টি করে। আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কমরেড রূপনারায়ণ রায় জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন।
এর পর এলো দেশ বিভাগ। পালটে গেলো রাজনীতির অঙ্গন। ১৯৭১ সালে সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ। তখন কমরেড রূপনারায়ণ রায়ে খোঁজ কেউ নিতেন না। শেষ বয়সে তিনি পত্রিকার হকারি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
কী নির্মম ইতিহাস। যে মানুষটি সারা জীবন অত্যাচারিত, নিপিড়িত, শোষিতর পক্ষে কথা বলতেন; তাকেই ১৯৭৩ সালের ২৪ মার্চ গভীর রাতে এক দল দুষ্কৃতিকারী রাতে আঁধারে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার হত্যার দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও এ হত্যার কারণ এবং কোন প্রাকার বিচার আজও দেখতে পায়নি ফুলবাড়ীবাসী।
ব্যক্তিজীবনে কমরেড রূপনারায়ণ বিবাহিত ছিলেন। তার ৩ ছেলে ও ১ মেয়ে। তার এক চিলতে বসতভিটার মধ্যে বসবাস করেন বড় ছেলের পরিবার। ছোট ছেলে থাকেন ফুলবাড়ী উপজেলা এক গুচ্ছ গ্রামে। আর মেজো ছেলে থাকেন উপজেলার মাদিলা গোয়ালপাড়া গ্রামে। সবাই আজ বিচ্ছিন্ন।
সম্প্রতি কমরেড রূপনারায়ণ রায়ের স্মৃতি বিজরিত লালপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় কমরেডের বড় ছেলে মৃত বিমল রায়ের বড় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি উত্তম রায়ের সাথে। উত্তম রায় বলেন, আমার দাদু রূপনারায়ণ রায় সারা জীবন মানুষের জন্য সংগ্রাম করে শেষ জীবনে প্রাণ টুকুও দিয়েছেন। কিন্তু আমার দাদুর খবর এখন কেউ রাখেন না। আমার বাবা-কাকারা অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। দাদুর পৈত্রিক সূত্রে ৫ শতাংশ জমিতে কোন মতে আমরা মাথা গুজোর ঠাঁই করে ছিলাম। হঠাৎ চোখের সমস্য দেখা দেয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। চিকাৎসার জন্য দাদুর নাম উল্লেখ করে সেই সময় পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেই। সেই বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরে আমার দাদুর সেই সময়ের বন্ধু সিপিএম নেতা মানবেশ চৌধুরীসহ শ্যামল সেন গুপ্ত, সিদ্ধার্ত সেন আমার সাথে দেখা করেন। পরবর্তী সময়ে তারা ২০১০ সালে বাংলাদেশে আসেন আমাদের বাড়ীতে। আমাদের এই পরিস্থিতি দেখে শ্যামল সেন তার নিজ তহবিল থেকে এই ৫ শতাংশ জমির ওপর টিন সেডের একটি পাকা বাড়ী নির্মাণ করে দেন। বাড়ীর নাম দেন শহীদ রূপনারায়ণ ভবন। দাদুর স্মৃতি বলতে এই ৫ শতক জায়গা আর তার বন্ধুর অর্থায়নের নির্মিত এই বাড়ী। তাছাড়া কিছুই নেই।
উত্তম রায় আরও বলেন, ২০১৩ সালের দিকে গ্রামের পার্শ্বে জেলা পরিষদের অর্থায়নে দাদুর নামে রূপনারয়ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাও আজ বন্ধ। আক্ষেপের সাথে তিনি বলেন, মানুষ আজ ভুলে যেতে বসেছে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী কমরেড রূপনারায়ণ রায়ের নাম।
তেভাগা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলার কৃষক মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছিল। এই ঐতিহ্য আজও দুই বাংলার সকল গণ-আন্দোলনের প্রেরণা হয়ে আছে। তেভাগা আন্দোলন এক অমর সংগ্রামের নাম, যা চিরকাল সংগ্রামী মানুষের পথ প্রদর্শন করে যাবে।
প্রতিবছর ২৪ মার্চ এলে ফুলবাড়ী উপজেলা শাখা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া কমরেড রূপনারায়ণ রায়কে কেউ স্মরণ করে না।
[লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ফুলবাড়ী প্রেসক্লাব, দিনাজপুর]